পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/বীরনারায়ণের পালা

উইকিসংকলন থেকে

বীরনারায়ণের পালা

 বীরনারায়ণের পালাটি শ্রীনগেন্দ্রচন্দ্র দে ১৯২৯ সনে সংগ্রহ করেন। মৈমনসিংহের অন্তবর্ত্তী মুক্তাগাছার নিকট সলিদা গ্রামবাসী কালাচাঁদ মাল ইহার কয়েকটি পঙ্‌ক্তি নগেন্দ্রবাবুকে শোনায়। কিন্তু উক্ত মাল আর একটি লোকের নাম করে এবং বলে যে সেই ব্যক্তি পালাটি সমস্তই জানে। এই ব্যক্তির নাম সেখ পানাউল্লা এবং ইহার বাড়ী মৈমনসিংহ জেলার সাকুরিয়া গ্রামে। নগেন্দ্রবাবু পানাউল্লার নিকট এই পালার অনেকটা অংশ সংগ্রহ করেন। এবং অবশিষ্ট অংশ মৈমনসিংহ জেওলিয়া গ্রামের আর একটি লোকের নিকট প্রাপ্ত হন। ইহার নাম অপরিজ্ঞাত কিন্তু, ইহাকে লোকে ‘কালার বাপ’ বলিয়া ডাকে। দুঃখের বিষয় যদিও বহু পরিশ্রম করিয়া নগেন্দ্র বাবু পালাটি সংগ্রহ করিয়াছিলেন তথাপি তিনি ইহা সম্পূর্ণভাবে পান নাই। এই অসমাপ্ত অবস্থাতেই ইহা এখানে প্রকাশিত হইল।

 পালাগানগুলির সাধারণতঃ একটা লক্ষণ এই যে, উহাদের শেষ দিকে করুণ রস খুব জমাট বাঁধে এবং নায়ক-নায়িকার, বিশেষ নায়িকার শেষটা খুব গৌরবমণ্ডিত হয়। কিন্তু পরিসমাপ্তির দিকটা না পাওয়াতে আমরা হয়ত সেই রসাস্বাদ হইতে বঞ্চিত হইলাম।

 লেখা দেখিয়া মনে হয় পালাগানটি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগের রচনা, কিন্তু এ বিষয়ে কোন অকাট্য প্রমাণ আমরা পাই নাই। আমরা পুনঃ পুনঃ ঐ প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে স্ত্রীলোকের উপর কঠোর সামাজিক শাসনের ব্যবস্থা পাইতেছি। এই নিষ্ঠুর সামাজিক বিধান অযোধ্যার মহারাজ্ঞীর সময় হইতে চলিয়া আসিতেছে। ফুলটি মাটিতে পড়িলে যেরূপ আর পূজায় লাগে না, মেয়েদের শরীরে সেইরূপ বাহিরের কোনরূপ হাওয়া লাগিলে তাঁহারা আর অন্তঃপুরবাসিনী হইবার যোগ্যা হ’ন না। একান্ত নিরপরাধী অত্যাচারিতা সোণা নাম্নী নায়িকার সামাজিক ব্যবস্থার যে দুৰ্গতির দৃষ্টান্ত পাইতেছি তাহার নিদর্শন মলুয়া, কাজলরেখা প্রভৃতি অনেক নায়িকারই জীবনে প্রদৰ্শিত হইয়াছে। এই পালাটির বৈশিষ্ট্য—নায়ক বীরনারায়ণের তেজঃপূর্ণ চরিত্র ও একনিষ্ঠ প্রেম। সমস্ত বিপদ্ ও দুঃখকে শিরোধার্য্য করিয়া লইয়া বীরনারায়ণ তাঁহার প্রেমের পূজার অর্ঘ্য সাজাইয়াছিলেন। পালাগানগুলিতে উৎকৃষ্ট নায়িকার অভাব নাই, কিন্তু নায়িকার উপযুক্ত নায়কের সংখ্যা তদনুপাতে অল্প। এই অল্পসংখ্যক নায়কের মধ্যে বীরনারায়ণ একজন। পালাটি খণ্ডিত হওয়াতে বীরনারায়ণের চরিত্রের শেষের দিকটা সম্বন্ধে আমরা অপরিজ্ঞাত আছি কিন্তু যাহারা নগেন্দ্রবাবুকে পালাটি এই খণ্ডিত অবস্থায় দিয়াছিল, তাহারা বলিয়াছিল যে শেষের দিকে বীরনারায়ণ বীরত্ব সহকারে পিতার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিয়া সোণাকে পাইবার অভিলাষ ব্যক্তি কািরয়াছিলেন এবং ইহার ফলে তাঁহার মৃত্যুদণ্ড হইয়াছিল।

 এই পালাটিতে রাজা-প্রজার সম্বন্ধ বিষয়ে কতকগুলি কথা আমরা জানিতে পারিতেছি। রাজার দুঃশাসন প্রজারা নীরবে মানিয়া লইত না। তাহাদের মনে বিদ্রোহের ভাব অবিচারের ফলে জাগিয়া উঠিত। ক্রুদ্ধ নাগরিকগণ রাজাকে সন্দেহ করিয়া মারিয়া ফেলিবার ইচ্ছাও প্রকাশ করিয়াছিল। সাধারণতঃ প্রজারা নিঃসহায়ভাবে রাজার অত্যাচার সহ করিত। প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে ইহার দৃষ্টান্তের অভাব নাই, তথাপি আমরা কয়েকটি পালাগানে প্রজাদের কতকটা তেজ ও সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা দেখিতে পাইতেছি। এই পালাটিতে প্রজাদের ছবি কতকটা স্বতন্ত্র রকমের।

 বীরনারায়ণের সঙ্গে সোণার বনবাস স্বর্গের সুষমা দেখাইতেছে। নানাবিধ বিপদ্ ও দুর্ঘটনার মধ্যে এই সুখের আভাসটুকু বিদ্যুতের মতই চমকপ্রদ এবং সুন্দর।

 খণ্ডিত অবস্থায় আমরা পালাটির ৫৫৭ ছত্র পাইতেছি। আমরা উহাকে দশটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করিয়াছি।

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন

বীরনারায়ণের পালা

বীরনারায়ণের পালা

(১)

দারুণ আঞ্জুক্যা[১] নিশিরে আরে নিশি পরভাত হইল।
হেনকালে বীরনারায়ণের আরে ভালা ঘুম না ভাঙ্গিল॥
ঘুমত্তনে[২] উঠতে বাধারে আরে হারুইলে[৩] টিক্ মারে।
ঘরতনে বাহির হইতে বৈরীরে আরে ভালা দুষমনের হাচি পড়ে।

যৈবন ডাঙ্গর বয়েস গো আর বীরনারাইণ জমিদারের বেটা।
উজ্যাতাম[৪] করিয়া বাহির হারে আরে ভালা না মানিল বাধা॥
উজ্যাতাম করিলে তেও সে রে আরে মনের মধ্যে সন্দে।
আইজ দিননি পারয় তাররে আরে ভালা ছন্দে আর বন্দে[৫]
ঘর বস্যা উঠবইস করেরে আর না যায় ঘর ছাইড়ে।
বাধা লইয়া উঠছে কুমার গো আর ভালা পড়ে নাকিন ফেরে॥
উসারা[৬] থাকিয়া কুমাররে আরে গণ্যা ফালায় পাও।
উঠক বৈঠক নাইসে কাররে আরে ভালা নাই সে কার রাও॥

বিয়ান গেল দুপুর গেল রে, আরে দুঃখ, না খাটিয়া।
একেলা ঘরের পিড়াত রে আরে ভালা কেমনে থাকে বইয়া॥

ভাটি বেইল বীরনারায়ণ গো আরে ফাফর হইয়া।
ঘর না ছাইড়া বাইর হয় গো আরে ভালা ছুটা হাতে লইয়া[৭]
একেলা বাইর হইল কুমারে রে আরে সঙ্গে নাই সে কেউ।
গাঙ্গের পাড় ধরিয়া চলেরে কুমার আরে দেখে গাঙ্গের ঢেউ॥
দরান্যা[৮] গাঙ্গের পানিরে আরে পানি ভাটী বইয়া যায়।
ভরা লইয়া সাউধের ডিঙ্গারে আরে ভালা পবনের আগে যায়॥
এক যায় আর আইরে গো আর তেও সে না ফুরায়।
রঙ্গ বিরঙ্গের ডিঙ্গা দেখ্যা আরে ভালা চউখ না জুড়ায়॥
সেই সে সুন্দর তামসারে আরে কুমার দেখিতে দেখিতে।
ঘুমাইয়া নারে কুমার গো আরে ভালা বিরক্ষের তলেতে॥

সাম[৯] যায় গুঞ্জরিয়া[১০] রে আরে সুরুজ বইছে পাটে।
এন কালে সোণা কন্যারে আরে ভালা যায় জলের ঘাটে॥
মায়ের আহ্লাদী কন্যাগো আরে বাপের সোহাগী।
ভরা কলসী উবরা[১১] কইরারে আরে ভালা যাইব জলের ঘাটে॥
ছুডু অতি সোণা কন্যার গো আরে এমুন লয় হইছে।
সাম না গুজুরনে কন্যাগো আরে ভালা জলেরে বাহির হইছে[১২]
মনের সুখেতে কন্যাগো আরে চাইয়া চাইয়া যায়।
নানা ইতি[১৩] শোভা দেখ্যা গো আরে ভালা ফির‍্যা ফির‍্যা চায়॥
পভাত বেইলের সোণা তেজগো আরে ঢাল্যা দিছে মুখে।
সোণার অঙ্গে সোণার ঢেউ গো আরে ভালা ঝলকে ঝলকে॥

চলিতে চলিতে কন্যা গো আরে ডাইনে আর বায়।
চৌদিকে নজর কন্যার গো আরে ভালা চাইয়া চাইয়া যায়॥
চাইয়া চাইয়া যায় কন্যা গো আরে দেখিয়া নয়ানে।
চান্দের উদয় যেমুন গো আরে ভালা সুরুজের হিতানে[১৪]
যাইতে যাইতে কন্যা গো আরে গাঙ্গের ঘাটে গেলা।
ঘুমুন্ত সুন্দর কুমাররে আরে ভালা নয়ানে দেখিলা॥
দেখিয়া সে কুমার কন্যারে আরে তরাস যে লাগে।
যত দেখে তার আউস[১৫] রে আরে ভালা বলকিয়া[১৬] ওঠে॥
দেখিয়া দেখিয়া কন্যার রে আউস তেও সে না যায়।
ঘুরাইয়া ফিরাইয়া চউখ রে আরে ভালা বারে বারে চায়॥
আড় নয়ানে বার নয়ানে[১৭] আরে নিউলিয়া[১৮] দেখে।
সাম গুজুরা রাইত হইছেরে আরে ভালা তেও সে না যায় ঘরে॥

* * * *

একেত যৈবনের ভার আর উছলে জ্বালা।
সুন্দর কন্যা সোণার মন হইল উতালা॥
মনের গোপন কথা কেউ নাই সে জানে।
মনে মনে সপ্যা দিল কেবল জানে মনে॥
মনেতে গুঞ্জিয়া[১৯] মন আড় নয়ানে চায়।
কি জানি ভাবিয়া কন্যা কান্দিয়া ভাসায়॥
“এই ত সুন্দর কুমার জমিদারের বেটা।
মুই নারী গিরস্থের ঝি হইছে বিষম লেঠা॥

বাউন[২০] হইয়া চাইলাম আসমান ছুইতে।
এই হেন মনের আশ না পারে পুরিতে॥
মচ্ছি[২১] হইয়া চলিলাম উড়িতে আসমানে।
মনেরে বুঝাইলে মন ধৈরজ না মানে॥”

ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যার চউখে বয় পানি।
পাই বা না পাই তেও সে সঙ্গে পরাণ খানি॥
সমুদ্দরের মধ্যে কন্যা মাণিক পলকে ডুবাইল[২২]
আউগ[২৩] পাছ কিচ্ছু নাই যে মনেতে ভাবিল॥
মনেতে গুঞ্জিয়া মন আড় নয়ানে চায়।
নিরাশ হইয়া পুনি কান্দ্যা বুক ভাসায়॥
মনের আগুনে কন্যা জ্বলে মনে মনে।
কারে কইব দুঃখের কথা কে লইব পরাণে॥
চউখ মুছিয়া কন্যা আক্ষি মেল্যা চায়।
পিরথিমী গিলিয়া ধরছে আঞ্জুকা নিশায়॥
সন্ধ্যা গুঞ্জুরিয়া হইল বিষম অন্ধকার।
মুইত যুবতী কন্যা কিবা কইব বাপ মায়॥
এই না ভাবিয়া কন্যা খরপদে[২৪] চলে।
গাঙ্গের কিনার গিয়া নামে গাঙ্গের জলে॥ (১—৭২)

(২)

সাউদের না ডিঙ্গাখানি গো
আরে ডিঙ্গা ভাটী বাইয়া যায়।
আন্ধাইর দেখিয়া সাধুরে
আরে সাধু ঘাটেতে ভিড়ায়॥

ঘাটেতে সুন্দরী কন্যারে আরে সাধু
দেখে আড় নয়ানে।
কন্যার লাগিয়া সাধু
আরে সাধু উচাটন মনে॥
চৌদিকে চাইয়া সাধুরে
আরে সাধু না দেখে লোকজন।
কন্যার লাগিয়া সাধুরে আরে সাধু
পরাণ কইল পণ॥
পানিত[২৫] লাগিয়া কন্যারে
আরে কন্যা কলসী বুড়ায়।
পাছমুড়[২৬] দিয়া সাধুরে
আরে সাধু ধরিল কন্যায়॥
গুলিবন[২৭] করিয়া ধরে রে
আরে সাধু ডাকে লোক জন।
একে একে লাম্যা আইলরে
আরে পিঁপড়ার সার যেমুন॥
একেলা অবুলা কন্যারে
আরে সেই না বিপদে পড়িয়া।
চিক্কাইর[২৮] দিয়া কান্দে কন্যারে
আরে কেউনি নেয় উদ্ধার কইরা॥
মুনিষ্যির গতাগম্ব[২৯] নাই
আরে ভাইরে গাঙ্গের পাড়ে।
বিরথা কেবুল কান্দন কাটীরে
আরে কেবা কও শুনে॥

কন্যার কান্দনে ভাইরে
আরে পাত্তর[৩০] যায় গলিয়া।
নিদারুণ সাউদের পুতরে
আরে নেয় কন্যায় মুখটিপা দিয়া॥
সেই সে চিক্কাইরে কুমাররে
আরে কুমার ঘুম না ভাঙ্গিল।
কন্যারে ধরিয়া সাধুরে
আরে ডিঙ্গাও উঠিল।
এরে দেখ্যা বীরনারায়ণরে
আরে কুমার মনে দুঃখু পায়।
বৈদেশী সাধুর এমুনরে
আরে সেদারাতি[৩১] জানায়॥
চৌদিকে চাহিয়া কুমাররে
আরে কেউরে নাই সে পায়।
একেশ্বর কি করিব রে
আরে কুমার মনেতে ভাওয়ায়॥
সেদারতি কর‍্যা সাধুরে
আরে কন্যা যায় লইয়া।
বিরথায় আমরার তবেরে
আর জমিদারী কইরা॥ (১—৪৮)

(৩)

কন্যার কান্দনে কুমার বড় দুঃখু পাইল।
চুপ চাপ গিয়া তবে ডিঙ্গাত উঠিল॥
ডিঙ্গাত উঠিয়া সাধু ডিঙ্গা দিল ছাড়ি।
দাঁড়ের টানেতে ডিঙ্গা যায় শূন্য় উড়া করি॥

ডিঙ্গা না ছাড়িয়া সাউদ কন্যার ধার যায়।
মিঠান মিঠান কথা কইয়া কন্যারে ফুসলায়[৩২]

“শুনলো যৈবতী কন্যা ভরা গাঙ্গে জুয়ার।
উছুল্যা পড়িয়া গেলে[৩৩] সগল অসার॥
ভাটী না ধরিতে কন্যা করলো তুমি দান।
তোমার লাগিয়া কবুল এই জান পরাণ॥
আমি সে কাঙ্গাল কন্যা মিন্নতি যে করি।
অধম জানিয়া যৌবন দান কর মোরে॥
এই সে ডিঙ্গার ভরা[৩৪] লাখ টেকার মুল।
পিরথিমীর মাঝে কন্যা নাইসে আর তুল॥
তোমার হাতে সপ্যা দিবাম আছে যত ধন।
সদায় বস্যা তোমার সেবিবাম চরণ॥
শত-বিশতে দাসী তোমার করব পদর্চ্চনা।
হীরামতি জার‍্যা[৩৫] দিবাম শরীল গয়না।
সোণার পালঙ্ক দিবাম তোমার বিছান।
মাটি না পাড়িব তোমার রাঙ্গা দুই চরাণ॥
হুকুম তামিল অইব সকলের আগে।
দেবতা হেন তোমায় রাখিবাম মাথাতে॥”

ফিরিয়া না চায় গো কন্যা কান্দে অবিরত।
কথা নাই সে কয় কন্যা সাউদের সহিত॥
চউখ না মেলিয়া চায় থাকে দূরে বইয়া।
মুখামুখি হইল সাউদ থাকে পাছদিয়া॥

শায়ণ মাস্যা ধারা যেমন চউখ অবিরত।
বেগেরতা[৩৬] করিয়া সাধু করত চায় পিরীত॥

সাধুর যত কাণ্ড দেখ্যা কুমার পায় দৈছত[৩৭]
কি উপায় করবাইন কুমার হইলা ভাবিত॥
চুপাচুপ গিয়া কুমার হাতিয়ার পাতি যতে।
এক এক কর‍্যা ফালাইল গাঙ্গের মধ্যেতে॥
বাছিয়া লইল কুমার ভালা রামদাও খানি।
চোরের মতন আইল কুমার ডিঙ্গার পিছনি॥
পাছাত আইয়া কুমার কাটে কাড়ালীরে[৩৮]
কাড়ালীর সাজ ধইরা কুমার ডিঙ্গার কাড়াল ধরে॥
কাড়াল ধরিয়া ডিঙ্গা ঠেকাইল চরেতে।
না লড়ে না চড়ে ডিঙ্গা কি হইল আচম্বিতে॥
নাইয়া মাল্লা যত আছিল হিক পায়্যা[৩৯] টানে।
বালুর কামুরে ডিঙ্গা লাগ্যাছে বিষুমে॥
নাইয়া মাল্ল। যত আছিল সকলে নামিল।
হিয়া হৈল বল্যা সবে হিক পাইয়া টানিল॥
টানাটানি কর‍্যা ডিঙ্গা না পারে লড়াইতে।
এরে দেখ্যা সাধু আস্যা নামিল চরেতে॥

এন কালে বীরনারায়ণ কোন্ কাম করে।
দাখিল হইল গিয়া কন্যার গোচরে॥
দেখিয়া সে কন্যা সোণা[৪০] কুমারে চিনিল।
কুমারের দুই পায় বেড়িয়া ধরিল॥

গায়েত ধরিয়া কন্যা জুড়িল কান্দন।
কুমার বলে উদ্ধার করবাম না কর চিন্তন॥

এই কথা বলিয়া কুমার ডোঙ্গ নাও[৪১] খুলিয়া।
কন্যারে তাহার মধ্যে দিল উঠাইয়া॥
বৈঠা আর রামদাও হাতে কুমার উঠিল।
ভবানীর শরণ লইয়া ডোঙ্গ বাইছ নিল[৪২]

এরে দেখ্যা সাধু যায় করি মার মার।
কুমার বুলে “আগু আইলে করিবাম সংহার॥”
রামদাও ভাঞ্জাইয়া কুমার খাড়ইল ডেঙ্গিতে।
বৈঠা ধইরা কন্যা বায় মাইঝ গাঙ্গেতে॥
হাতিয়ার পাতি আনতে সাধু ডিঙ্গার মাঝে গেল।
কই পাইব হাতিয়ার পাতি সকল বিফল॥
মার মার বলিয়া যত নাইয়া মাল্লাগণ।
ডেঙ্গি ধরিবারে তবে করিল গমন॥
এক এক করা সকলেরে করিল সংহার।
এরে দেখ্যা সাধু না আগুয়ায় আর॥

আইতে আইতে ভাইরে তিনপর রাত ভাট্যাইল[৪৩]
হেন কালে ডেঙ্গি আস্যা ঘাটেতে লাগিল॥ (১—৬৬)

(8)

সন্ধ্যাকাল সোণা কন্যা আইল জলের ঘাটে।
একপর রাত গুয়াইয়া যায় না আইল বাড়িতে॥

রাধারমণ বাপ বলে কি হইল সোণার।
মায় বাপে চুপচাপ বিছড়ায়[৪৪] বারবার॥
কেউর ঠান এই কথা পরকাশ না করে।
কলঙ্ক হইবে তবে যুদি কয় পরেরে॥
বিছড়াইতে বিছড়াইতে তারা পরাণ পাইয়া।
পাড়া পড়সি ডাক্যা কথা কয় যে খুলিয়া॥
আন্ধাইর ঘরের মাণিক কন্যা চুরে লইয়া গেছে।
সগলে বাইর হইল তবে কন্যার তল্লাসে॥

মোটে মাত্রক এক কন্যা কান্দে রাধারমণ।
কলঙ্কী বানাইল বুঝি কোন না দুষ্‌মন॥
রাধারমণ বুলে হায়রে কি হইল সোণার।
লোকজন লইয়া যায় গাঙ্গের পাড়॥
গাঙ্গের পাড় গিয়া দেখে শুদা কলসী ঘাটে।
কোথায় গেল সোণা কন্যা না পায় দেখিতে॥
মইরাছে মইরাছে বুঝি জলেতে পড়িয়া।
আনইলে[৪৫] নিছে কুমিরে টানিয়া॥
পাতি পাতি কইরা তারা কন্যারে বিছড়ায়।
কেউবা জলের মাধ্যে কেউবা শুক্‌নায়॥
বিছড়াইতে বিছড়াইতে তারার দুপর রাইত ভাট্যাইল
আর নাইসে পারে বড় পরাব পাইল॥

হেন কালে দেখে তারা চান্নির পশরে[৪৬]
সোণা কন্যা আর কুমার ডেঙ্গির মাঝারে॥

ডেঙ্গি তনে লাম্যা যেই ভূমিত খাড়াইল।
কাওলা কাওলি[৪৭] কর‍্যা সবে তাহারে ঘেরিল॥

কুমার সগল কথা কইল বুঝাইয়া।
রাধারমণ বুলে রাখছুইন সম্মান বাচাইয়া[৪৮]

আস্‌সি পশ্‌শি[৪৯] “বুলে মিছা ভাড়াইল সকলে।
বেইজ্জাত কর‍্যা কুমার কাম কথার ছলে॥
ঘর নাইসে তুলন যায় এই সে কন্যারে।
দেশতনে বিদায় কর এই সে পাপেরে॥”
কেউ বুলে “খেদাইয়া দাও বিদেশ কর‍্যা পার॥”
কেউ বুলে “কাট্যা ভাসাও গাঙ্গের মাঝার।
ছালাত ভরিয়া দেও মনডুবি করিয়া॥”

এই কথা বল্যা সবে ধরিবারে যায়।
এরে দেখ্যা বীরনারায়ণ রামদাও ভাঞ্জায়॥
এক হাতে ধরি কন্যায় আর হাতে মারে।
যত ইতি লোক লস্কর পালায় তার ডরে॥ (১—৩৯)

(৫)

সোণা কন্যা কান্দি পড়ে বীরনারায়ণের পায়।
“আমি অভাগীর কও কি হইবে উপায়॥
আমিত অবুলা নারী না জানি পাপ মনে।
বিধারতা[৫০] বিবাদী হইলা কি আছে করমে॥
জমিদারের পুত্র আপনে আপনের কিবা দুঃখ।
বিনা দোষে কলঙ্কিনী, ফাট্যা যায় মোর বুক॥”

“উদ্ধার কর‍্যা আনছি তোমায় জানের আশা ছাড়ি।
তোমার যে দুঃখু আমি সইতে না পারি॥
মনের কথা কইবাম কন্যা শুন দিয়া মুন।
তোমারে দেখিয়া মন হইল উচাটন॥
তোমার যে চান্দমুখ যেমুন পউদের ফুল।
আসমানের কালা মেঘ তোমার মাথার চুল॥
পত্যা[৫১] তারার হেন তোমার দুই আখি।
পউদের নাল হেন তোমার অঙ্গ দেখি।
পরথম যৈবন তোমার ফাট্যা বাইরায় রূপ।
আমার চউখ না পরিছে তোমার হেন রূপ॥
এই রূপের লাগিল কন্যা হইয়াছি কাঙ্গালী।
একেলা বসিয়া কন্যা থাকি নিরিবিলি॥
যত ইতি কন্যা মোর বিয়ার কারণে।
কেউ না সে লাগিল হেন আমার মনে॥
তোমারে দেখিলাম কন্যা মনের মতন।
তুমি যুদি ঘুচাও কন্যা মোর মনের বেদন॥”
“আপনে হইছুইন জমিদার, মুই গিরস্থের নারী।
আপনের লগে মোর পিরীতি পউদ পাতার পানি[৫২]
আপনি করবেন জমিদারী রাজপাটে বইয়া।
মুই কলঙ্কিনীর পানে না চাইবাইন ফিরিয়া॥
দুই দিনের লাগ্যা কেনে আপদোষী[৫৩] হও।
ক্ষেমা দিয়া যাউখাইন[৫৪] কুমার ধরি দুই পাও॥
মুই কলঙ্কিনী নারী ঘুরি বনে বনে।
আনইলে ডুবিয়া মরি আপনের সামনে॥

মোর লাগিয়া আপনে কেনে হইবাইন আপদোষী।
জমিদারের পুত্র আপনে করবাইন জমিদারী॥
মুই কলঙ্কিনীর লাগ আপনের কেনে দুঃখ।
মায় বাপে খেদাইব আদরের পুত॥
রাজ্যতি ছাড়িয়া কেনে ঘুরবাইন ছনে বনে।
সুখে রাজ্যতি করবাইন হরষিত মনে॥
যাওখাইন যাউখাইন কুমার আপনে বাড়ীত চলিয়া।
মুই কলঙ্কিনী নারী মরি দরিয়াত ডুবিয়া॥”

এই কথা বলিয়া কন্যা গাঙ্গে দিল মেলা।
বীরনারায়ণ ফিরায় তারে পন্থে আগুলিয়া॥
“শুন শুন কন্যালো আমার বেদন।
তুমি ছাড়া মোর পরাণ শূন্য ময়দান॥
তোমারে ছাড়িয়া কন্যা তিলেক না বাচি।
তুমি যদি মর কন্যা আমি আগে মরি॥
তোমারে লইয়া আমার নরকে রাজভোগ।
তুমি বিনে স্বর্গ মোর হইব নরক-ভোগ॥
নিদয়া হইয়া কন্যা যুদি যাও ছাড়ি।
খাড়ইয়া দেখ আগে আমি ডুব্যা মরি॥”

এই কথা বলিয়া কুমার লামিল জলেতে।
আঞ্জাদিয়া ধরে কন্যা কুমারের দুই পায়েতে॥
“তুমি মোরে জিউদান দিলা আর কলঙ্কের ডালী।
আমি নারী কেমুন কইরা তোমার মরণ দেখি॥
কিরপা করিলা যুদি কলঙ্কিনীর পানে।
সর্ব্বস্ব ঢালিয়া দিলাম তোমার চরণে॥
জীবন যৈবন আমার সকল ধনের সার।
আইজ হতি এই সকলি সকল তোমার॥

সাক্ষী থাক চান্দ তারা আর বিরক্ষগণ।
তোমরা সাক্ষী থাক্য মুই সকল করলাম দান॥
মায়ে ছাড়ল বাপে ছাড়ল ছাড়ল সর্ব্বজনে।
কলঙ্কিনী বল্যা ছাড়ল পাড়াপড়শী জনে॥
মনে চিন্তে না জানি পাপ বিমুখ বিধারতা।
আশা দিয়া রাখলা মোরে তুমি যেন দেবতা॥”

এই কথা শুনিয়া কুমার হরষিত হইয়া।
পাওতনে[৫৫] উঠাইল কন্যা বুকেত রাখিয়া॥
আসমান তলে লাম্যা স্বরগ ভূমেতে আসিল।
এই মতে বীরনারায়ণের বিয়া যে হইল॥

ভাবনা চিন্তা কিছু নাই তারার মনে।
দোহে দোহা এক কায়া হইল মিলনে॥
বর্ম্মাণ্ডের কথা তারা পাশরিয়া গেল।
আউস মিটাইয়া দোহে দোহারে দেখিল[৫৬]

* * * *

এর পর তবে তারার হইল চিন্তন।
কেমুন কইরা দেশের মধ্যে করবাম বিচারণ॥
মায়ে বাপে পাইলে কাট্যা করব চাক চাক।
কলঙ্কী বলিয়া সবে রটাইব দেশের মাঝ॥
যাই মোরা দোহে মিলি দেশ ছাড়িয়া।
আপদ বালাই যত যাউক দুর হইয়া॥
সল্লা করিয়া দোহে ডেঙ্গিতে উঠিল।
প্রেমের টানেতে ডিঙ্গা পঙ্খী উড়া দিল॥ (১—৭৮)

(৬)

দুঃখের দারুণ নিশিরে
আরে নিশি পোহাইতে না চায়।
সারা নিশি কান্দ্যা গোয়ায় সোণার বাপ মায়॥
আস্‌সি পশ্যি দলা হইয়ারে কুদাকুদি করে[৫৭]
“কুত্তার বাচ্ছা জনম লইছে জমিদারের ঘরে॥
জমিদারে আশ্রা দিয়া
আরে ভালা রাখে পরজাগণে।
ভুগা দিয়া খাইল সেত আপনে নিখামানে॥
জাত্তি আচার বিচার ধরমরে
আরে ভালা সগল ডুবাইয়া।
দেশের ইজুত মাইল[৫৮] মুখ না পুড়িয়া॥
আইজ মাইল রাধারমণের রে
আর কাইল মারে আর কারে।
এমুন অবিচারের মাধ্যে কেমনে ঘর গিরস্থি করে॥”
মাইয়া মাইনষে সল্লা করে রে
“আরে মার সেই কুত্তারে।
কাটিয়া দরিয়ায় ভাসা যা হয় হইবে পরে॥”

সগলে মিলিয়া তবে রে
আরে সলকি[৫৯] বল্লম লইয়া।
গাঙ্গের পাড় ধর‍্যা যায় বিছড়াইয়া বিছড়াইয়া॥

ঝাড় জঙ্গল্যা যত আছিলরে
আরে ভাঙ্গা করল গুড়া গুড়া।
বিছড়াইয়া না পায় কোথা চল্যা গেছে তারা॥
বিছড়াইতে বিছড়াইতে তারারে
আরে ভালা পরাবরে পায়।
সেই না ক্ষুরধেতে[৬০] তারার পিত্তি জল্যা যায়॥
মনের দুঃখেতে ভালারে হাত পাঁচ ভাবে।
আপন পুত্রু জান্যা জমিদার সমুটিয়া[৬১] রাখছে।
সল্লা যুক্তি কইর‍্যা তারারে আরে কুপিত হইয়া।
ফুইদ[৬২] করিবারে চায় বাপের কাছে গিয়া॥
কুপুত্রার কাণ্ড যতরে
আরে ভালা বাপেরে জানায়।
“এমুন পুত্রু আর কেউ হইলে গাঙ্গেতে ভাসায়॥
বিচার কর কাইল জমিদার গো বিচারের মালীক।
আপুন পুত্রু জান্যা নাইসে করবাইন বিপরীত॥”
কুপুত্রের কথা যত বাপে শুনিল।
রাগেতে গিরগির অঙ্গ কাঁপিতে লাগিল॥
আগুন হইয়া বাপে কটুয়ালে[৬৩] বুলে।
“বীরনারায়ণ পুত্রে ধরা আন সভার আগে॥
হাচা যুদি হয় কথা উচিত দণ্ড দিবাম।
পুত্রু বলিয়া নাইসে ঘুরা ঘাট্যা[৬৪] লইবাম॥
কুপুত্রু থাকনের থাকা না থাকন ভালা।
এমুন পুত্রু কেবুল হায়রে কুলের কালা॥”

কটুয়াল ফিরিয়া আইয়া কয় বাপের আগে।
“কাইল থাক্যা কুমারেরে কেউ নাইসে দেখে॥”

হুকুম করলাইন জমিদার দেখত বিছড়াইয়া।
যেখানে পায় তারে আনিত বান্ধিয়া॥
জমিদার বিচারুইন মনে ‘মিছা নয় সে কথা।
কাইল থাক্যা কোথায় সে গেছে কুপুত্রা॥
এইসে কুকাম না করিলে থাকিত বাড়িতে।
তাইসে কাইল অতি[৬৫] কেউ না পায় দেখিতে॥’

কটুয়ালরে ডাক্যা বাপে কয় তারা গোচরে।
“বান্ধ্যা আন্যা হাজির কর যেখানে পাও তারে॥
কুপুত্রা কুলের কালি গেল কোন্ খানে।
জীবমানে থাকলে সে না রাখব সর্ম্মান।
ধরা আন্যা বলি দিলে শীতল হইব প্রাণ॥
কুপুত্রু অতি জমিদারী যাইব রসাতলে।
মুখ না দেখাইতাম পারবাম কোন কালে॥”
লোক লস্কর যত সকলে ডাকিয়া।
আপনে অতি জমিদার দিলাইন বুঝাইয়া॥
“বান্ধিয়া আনিবা তারে আমার গোচরে।
যেখানে পাইবা মোর কুপুত্রারে॥
দেশে দেশে রাজ্যে রাজ্যে পাতি পাতি কইরে।
যেখানে পাও ধইরা আনবা আমার গোচরে॥
বুঝাইয়া কই যদি এতে কর আন।
জন বাচ্ছা সইতে তরায় যাইব গর্দ্দান॥

মোর পুত্রু বলিয়া যুদি এতে কর আন।
ভিটা খালি করবাম রাজ্যি হইব লানবান[৬৬]

লোক লস্কর ষত আছিল এই কথা শুনিয়া।
কুমারের তল্লাসে যায় টডরস্থ[৬৭] হইয়া॥ (১—৭০)

* * * *

(৭)

এক রাজার মুল্লুক নারে দুই রাজার থইয়া।
সোণা কন্যায় লইয়া গেল তিন মুল্লুক ছাড়িয়া॥
খিদায় করে টগবগ না পারে বাইত[৬৮] নাও।
ডিঙ্গা না ছাড়িয়া তারা টানে[৬৯] দিল পাও॥
টানের মধ্যে উঠা তারা কোন কাম করে।
অরণ্য জঙ্গলাত মাধ্যে পরবেশ করে॥
জঙ্গলাত মেওয়া ফল পাক্যা রইছে গাছে।
দুই জনে পেট ভইরা খাইল যত আছে॥
মুনিষ্যির মেল নাই পশু পংখীর বাসা।
এমুন জাগাৎ বসৎ করব কেউ না পাইব দিশা॥
ঘর নাই দুয়ার নাই কোথায় কাটাব রাতি।
ভাবনা চিন্তা নাই মন কেবুল পিরীতি॥
এক পহর বেইল থাকতে জঙ্গল বেড়ল আন্ধারে।
বাঘ ভালুক যত ইতি বাহির হইল আঁধারে॥
ডেরা ডেঙ্গরা কোথায় পাইব জঙ্গলার মাইকে।
বাঘ ভালুক হায়রে চৌদিকে ডুক্কারে॥

বিছড়াইতে বিছড়াইতে এক গফর[৭০] পাইল।
এর মধ্যে দুইয়ে জনে পরবেশ করিল॥
গফরের মধ্যে এক জানোয়ার ঘুমাইয়া।
এরে দেখ্যা পরাণি গেল যে উড়িয়া॥

রামদাও খান বাহির করিয়া কুমার মাইল কুব[৭১]
তিন ছেও দিল পরে দিয়া তিন কুব॥
বাহির করিয়া দেখে সিঙ্গি জানোয়ার।
সাপ সাপ্যানা কইরা থাকে গফরের মাঝার[৭২]

বনের ফল খাইয়া তারার দিন যায়।
হরিণা হরিণী যেমুন সুখেতে গুয়ায়॥
দিন রাইত প্রেমালাপে সদাই মাতুয়ারা।
ভাবনা চিন্তা নাইসে মন পিরীতের পশরা॥
মেওয়া ফল জুগাইয়া বীরনারাইণে আনে।
সুখেতে বসিয়া তারা খায় দুই জনে॥
উনা ভাতে দুনা বল হইছে তারার গাও।
বাঘ ভালুকের লগে তারার হইছে বাও[৭৩]
জানুয়ার দেখ্যা তারা কিয়ার[৭৪] না করে।
তারারে দেখিয়া জানুয়ার যায় পথ ছাইড়ে॥
এই সে না হালেতে তারার দিন যায়।
রাজার পুত্রু কাঙ্গাল হইল পিরীতের দায়॥ (১—৩৬)

(৮)

জমিদারের লোকজন দেশে দেশে ভরমণ
করে ভাইরে কুমারের তল্লাসে।
ঘর গেরাম জঙ্গলা সকল বিচরণ কৈলা
না পাইলা সে কুমারের উদ্দিশে॥
না যায় ফিরিয়া ঘরে কহিছে সে জমিদারে
জন বাচ্ছা সইতে তারার লইব গর্দ্দান।
ভিটা করব খান ছাড়া দেশ গেলে কুমার ছাড়া
রাজ্যির মধ্যে জ্বালাইব আগুন॥
আছিল যত লোক লস্কর ঘর গেরাম জঙ্গলার ভিতর
কিছু নাই সে রাখিল বাকি।
পাতি পাতি কইরা বিছড়ায় কুমারে সে না পায়
বিছড়ায় তারা যথায় যায় দুই আখি॥
বিছড়াইতে বিছড়াইতে তারা নিশাতড়ি(?) হইল পার
তেও সে না পাইল তারে।
কেমুনে যাইব ঘর উদবিচ্ছ[৭৫] পরাণ বড়
লইব গর্দ্দান কইছে জমিদার॥
কেউ বুলে যাইবাম ঘরে কেউ ফির‍্যা মানা করে
স্তিরি পুত্রু কোন্ হালে আছে।
স্তিরি পুত্রু কি আর আছে জমিদারে গর্দ্দান লইছে
আমরা কেরে মরি যুদি জন বাচ্ছা গেছে॥
এই খান বসত কর ঘর গিরস্তি সুবিস্তর
কাজ নাই ফিরিয়া ঘরেতে।
ঘর গেলে পড়বা মারা ডাক্যা কনে আনবা বুড়া[৭৬]
বস্তি কর‍্যা থাক এই জঙ্গলাতে॥

রাজার খিরাজ নাই গর্দ্দানের ডর না পাই
নিশ্চিন্তা হইয়া থাকবা সুখে।
বাপ দাদার ভিটা ছাড়িয়া পাপে মরবা পুড়িয়া
কুবুদ্ধি করিয়া কেবুল ডাক্যা আন দুঃখে॥
এই জঙ্গলা বিছড়াইয়া দেখ একবার দর হইয়া
পাও কিনা পাও সে কুমারে।
পরে বুদ্ধি ঠাওর কর‍্যা যাইবাম ঘর ফিরিয়া
দেখবাম কিবা করে জমিদারে॥ (১—৩২)

(৯)

বীরনারাইণ জুর‍্যা আনে দুইজনে খায়।
আর সম বস্যা দুইয়ে[৭৭] সুখেতে গুয়ায়॥
রঙ্গে ঢঙ্গে বস্যা তারা করে আলাপন।
বনের ফুল দিয়া অঙ্গ করয়ে সাজন॥
দুষ্‌মন বালাই নাই কেউ নাইসে পীড়ে।
জঙ্গলার মধ্যে ফিরে হরষ অন্তরে॥

জমিদারের লোক লস্কররে আরে জাইরে জঙ্গলা বিছড়াইয়া।
বিরথা পেরাসনি[৭৮] পাইল কুমারে না পাইয়া॥
ঘুমত উঠিয়া কুমাররে আরে কুমার আধারের[৭৯] তল্লাসে।
ঘুরিতে ঘুরিতে আইল তারার আশে পাশে॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া তারারে আরে ভাইরে বাড়ীত ফিরত চায়।
এমুন সময় দেখে কে যেন পথত দিয়া যায়।
নজর কর‍্যা দেখে তারারে আরে ভালা কুমারের আলছা[৮০]
বেকে বের‍্যা মিল্যা ধরে কুমারের কাছা॥
ধরিয়া দেখিল কুমাররে এই সে বীরনারাইণ।
হরষিত হইয়া তারা করে পরস্থান॥

ভূমিত লুটাইয়া হায়রে আরে কান্দে সে কুমার।
আমার যে নারী আছে কি হইব তারার॥
কথা নাই সে শুনে তারারে আরে ভালা করে পরস্থান।
তোমরার লাগ্যা আমরার কেরে যায় গর্দ্দান॥
কুমাররে লইয়া তারারে আরে ভাইরে ঘর ফির‍্যা আইল।
একলা যে সোণা কন্যা জঙ্গলায় রইল॥ (১—২২)

(১০)

সোণাকন্যা জানে কুমার আধার জুগাইত[৮১] গেছে।
আজি কেনে অত বেইল ফির‍্যা না আইতেছে॥
উঠ বইস করে কন্যা কুমারের লাগিয়া।
এই মতে সারা দিনমান রইল বসিয়া॥
সন্ধ্যা কালে যখন জঙ্গল আন্ধাইরে ঘিরিল।
কন্যা বুলে হায় হায় কুমার কোথায় রইল॥
কোথায় জানি রইল কুমার বুঝিত না পারে।
পুড়া মনের মধ্যে কত উঠে আর পড়ে॥

রামদা হাত লইয়া কন্যা বিছড়ায় কুমারে।
আউলা হইয়া না কন্যা জঙ্গলাত ফিরে॥
বাঘ যুদি খাইত বন্ধে পইড়া থাকত হাড়।
ছন্ন বংশ[৮২] না পাই কিছু জঙ্গলার মাঝার॥
আমার বন্ধু সেরা[৮৩] জোয়ান বাঘে ভরার তারে।
বুঝিবা পরীরা ধইরা লইয়া গেছে তারে॥
আনইলে বন্ধু মোরে গেছে ফাকি দিয়া।
আমি অভাগিনী সোণায় জঙ্গলায় ফালাইয়া॥
যেখানে গেলারে বন্ধু সুখে থাক্য তুমি।
তোমার দুঃখের কথা যেন কাণে নাইসে শুনি॥

আসমান পাতাল দেখবাম বন্ধুরে বিছড়াইয়া।
দেশে দেশে ঘুরে কন্যা বন্ধুর লাগিয়া॥

(বারমাসী)

হায়রে বন্ধু আমার নাই দেশে।
আইলা না পরাণের বন্ধু
রইলা তুমি কোন্ দেশে
হায়রে বন্ধু নাই দেশে॥
ফাল্গুন ত না মাসরে বন্ধু
আরে ছুটছে মদন বাও।
দিন যায় আনায় তানায়[৮৪]
রাত না পোয়ায় রে॥
চৈতনা মাসরে বন্ধু আরে চৈতালা বাতাসে।
তাপিত বক্ষ শীতল না হয় গো
আমার বন্ধু কোন্ দেশে রে॥
বৈশাখ না মাসরে বন্ধু
আরে কুইলে কাড়ে রা।
কাণে মধ্যে ঠাণ্ডা বাজেগো
আমার বন্ধুর কথা মিঠা রে॥
জেঠ না মাসারে বন্ধু
আরে রইদের খর তেজ।
তা অতি অধিক জ্বালা গো
আমার বন্ধুর বিচ্ছেদ রে॥
আষাঢ় না মাসরে বন্ধু
আরে ঘন মেঘের ধারা।
দেহার মাঝে জ্বলছে আগুন গো
আমার মন হইল অঙ্গরা রে॥

শায়ণ না মাসরে বন্ধু
আরে ফুটছে পউদের ফুল।
তুমি বন্ধু আন্যা দিতাগো
পিন্‌তাম[৮৫] কাণে ফুল রে॥

* * * * *

বন্ধুয়ার লাগি কন্যা ফিরে দাওনা হইয়া।
কোথায় পাইবাম চেংরা বন্ধু কে দেখছ দেও কইয়ারে॥
চারি যুগের বিরক্ষ তোমার জঙ্গলার মধ্যে আছে।
আমার বন্ধু কোথায় গেল তোমরানি দেখ্যাছরে॥
জঙ্গলার পশুপক্ষী চিন মোর বন্দেরে।
কোন্ দেশে গেলে আমি পাইবাম তারেরে॥
আসমানের তারারে তুমি মিট মিটইয়া হাস।
আমার বন্ধুরে যাইতে তোমরানি দেখ্যাছরে॥
বাপ ছাড়লা মাও ছাড়লা আমার লাগিয়া।
শেষ কাটালে কেনেরে বন্ধু গেলা ফাকি দিয়া॥
আগে যুদি জানতামরে বন্ধু যাইবা ছাড়িয়া।
দরিয়াত ডুবতামরে বন্ধু গলাত কলস লইয়া॥ (১—৫৯)

* * * *

(অসম্পূর্ণ)

 ইহার পর জমিদার বীরনারায়ণকে জল্লাদ দ্বারা বন্ধ করিয়াছিলেন এরূপ শুনিতে পাওয়া যায়। সম্পূর্ণ পালাটি পাওয়া যায় নাই—সুতরাং প্রবাদটির সত্যতা সম্বন্ধে কিছু বলিতে পারা গেল না।

  1. আঞ্জুক্যা=অন্ধকার।
  2. ঘুমত্তনে=ঘুম হইতে।
  3. হারুইলে=টিক্‌টিকিতে।
  4. উজ্যাতাম=উদ্ধত ভাব।
  5. উজ্যাতাম......বন্দে=যদিও বাধা না মানিয়া উদ্ধত ভাবে বাহির হইল, তথাপি মনের মধ্যে সন্দেহ রহিয়া গেল—তাহার আজকার দিনটা ভাল যতে পার হইবে কিনা।
  6. উসারা=বাড়ীর আঙ্গিনা—বারান্দা।
  7. ছুটা হাতে লইয়া=শূন্য হাতে, কোন অস্ত্রশস্ত্র না লইয়া।
  8. দরন্যা=দারুণ।
  9. সাম=সন্ধ্যা।
  10. গুঞ্জরিয়া=অতীত হইয়া।
  11. উবরা=উপুড় করিয়া, খালি করিয়া।
  12. ছুডু·····হইছে=ছোট কাল হইতেই এই কুমারীর এরূপ অভ্যাস (লয়) হইয়া গিয়াছে যে সন্ধ্যা অতীত হইবার পূর্ব্বেই সে নদীর দিকে ছুটিয়াছে।
  13. নানা ইতি=বিচিত্র।
  14. হিতানে=নিম্নভাগে, (শয্যার পার্শ্বে); সূর্য্য এক দিকে অস্তমিত হইয়াছে, আর তাহার অপর দিকে নিম্নে চাঁদ উঠিয়াছে।
  15. আউস=হাউস (ইচ্ছা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা, লোভ)।
  16. বলকিয়া=উচ্ছ্বসিত হইয়া।
  17. আড় নয়ানে বার নয়ানে=(কথার পিঠে কথা), আড় চক্ষে এবং সোজা দৃষ্টিতে।
  18. নিউলিয়া=নেহারিয়া।
  19. গুঞ্জিয়া=গোপন করিয়া।
  20. বাউন=বামন (খর্ব্বাকৃতি)।
  21. মচ্ছি=মাছ।
  22. সমুদ্দরের······ডুবাইল=সমুদ্রের মধ্যে যেন নিমিষে তাহার মণি-মাণিক্য ডুবাইয়া দিল, অর্থাৎ তাহার মন অতল সমুদ্রে নিক্ষেপ করিল।
  23. আউগ=অগ্র, আগ।
  24. খরপদে=দ্রুতপদে
  25. পানিত=পানির জন্য, জলের নিমিত্ত।
  26. পাছমুড়=(পাছমোড়া দিয়া) পশ্চাৎ দিক্ হইতে ঘিরিরা ধরিয়া।
  27. গুলিবন=গোলবন্ধ, বৃত্তাকারে জড়াইয়া।
  28. চিক্কাইর=চীৎকার।
  29. গতাগম্ব=গতিবিধি।
  30. পাত্তর=পাথর।
  31. সেদারাতি=জবরদস্তি।
  32. ফুসলায়=কুপথে আনিতে চেষ্টা করে।
  33. উছুল্যা পড়িয়া গেলে=বন্যা চলিয়া গেলে, যৌবন অতীত হইলে।
  34. ভরা=ডিঙ্গার দ্রব্যাদি।
  35. জার‍্যা=জহরৎ, জড়োয়া।
  36. বেগেরতা=ব্যগ্রতা।
  37. দৈছত=ব্যথা
  38. কাড়ালী=কাণ্ডারী, যে ব্যক্তি হা’ল ধরিয়াছিল।
  39. হিক পায়্যা=যথাসাধ্য জোরে।
  40. সোণা=কন্যার নাম
  41. ডোঙ্গ নাও=ডিঙ্গা নৌকা। বড় ডিঙ্গার সঙ্গে ছোট ছোট ডোঙ্গা বাঁধা থাকিত।
  42. ডোঙ্গ বাইছ নিল=ডিঙ্গা বাহিয়া চলিল।
  43. আইতে···ভাট্যাইল=আসিতে আসিতে তিন প্রহর রাত্রি অতিবাহিত হইল।
  44. বিছড়ায়=অনুসন্ধান করে; বিচার করিয়া দেখে।
  45. আনইলে=তাহা না হইলে।
  46. চান্নির পশরে=চাঁদের জ্যোৎস্নায়।
  47. কাওলা কাওলি=কলরব।
  48. রাখছুইন··-বাচাইয়া=সম্মান বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন।
  49. আস্‌সি পশ্‌শি=প্রতিবাসীরা।
  50. বিধারতা=বিধাতা।
  51. পত্যা=প্রভাতিয়া।
  52. আপনের······পানি=আপনার সঙ্গে আমার প্রণয় পদ্মপত্রের উপর জলের ন্যায় অস্থায়ী হইবে।
  53. আপদোষী=অপবাদের ভাগী।
  54. যাউখাইন=যাউন।
  55. পাওতনে=পায়ের নিকট হইতে।
  56. বর্ম্মাণ্ডের......দেখিল=তাহারা ব্রহ্মাণ্ডের কথা ভুলিয়া গেল, প্রাণের সাধ যিটাইয়া উভয়ে উভয়কে দেখিতে লাগিল।
  57. আস্‌সি.......করে=প্রতিবাসীরা দল বাঁধিয়া বাদ-বিসংবাদ করিতে লাগিল।
  58. দেশের.......মাইল=দেশের সম্মান নষ্ট করিল; মুখ পুড়াইয়া দিয়া আমাদের সম্মান-হানি করিল।
  59. সলকি=সর্‌কি, বর্শার মত অস্ত্র।
  60. ক্ষুরধ=ক্রোধ।
  61. সমুটিয়া=গোপন করিয়া, সংবরণ করিয়া।
  62. ফুইদ=জিজ্ঞাসা।
  63. কটুয়াল=কোটাল।
  64. ঘুরা ঘাট্যা=দোষ মাপ করিয়া।
  65. অতি=হইতে
  66. লানবান=লণ্ডভণ্ড।
  67. টডরস্থ=তটস্থ, ভীত।
  68. বাইত=বাহিতে।
  69. টানে=মাটিতে।
  70. গফর=গহ্বর।
  71. কুব=কোপ।
  72. সাপ......মাঝার=হয়ত এই গহ্বরে কোন সাপ থাকিতে পারে।
  73. বাও=ভাব।
  74. কিয়ার=কেয়ার (care)।
  75. উদবিচ্ছ=উদ্বিগ্ন।
  76. ডাক্যা··বুড়া=ডাকিয়া কেন বুড়ী (অমঙ্গল) আনিবে।
  77. সম বস্যা দুইয়ে=সমবয়স্ক দুইজন।
  78. পেরাসনি=কষ্ট।
  79. আধারের=খাদ্যের।
  80. কুমারের আলছা=কুমারের মত।
  81. আধার জুগাইত=খায়-সংগ্রহ করিতে।
  82. ছন্ন বংশ=অতি ক্ষুদ্র চিহ্ন, কোনরূপ নিদর্শন।
  83. সেরা=শ্রেষ্ঠ।
  84. আনায় তানায়=কোন রকমে।
  85. পিন্‌তাম=পরিতাম।