পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/মুকুট রায়

উইকিসংকলন থেকে

মুকুটরায়

 মুকুটরায়ের পালাটিও মৈমনসিং হইতে সংগৃহীত। ইহাকে ঠিক পালাগান বলা যায় না। ইহা গীতি কথার লক্ষণাক্রান্ত। গীতিকথা ও পালাগানে কতকটা গুরুতর পার্থক্য আছে। গীতিকথার অনেক অংশ গদ্যে রচিত এবং তাহার মধ্যে মধ্যে কথকেরা পয়ার গাহিয়া যায়। সুতরাং গীতিকথার অর্দ্ধেক গদ্য এবং অর্দ্ধেক পদ্য। সময়ে সময়ে পদ্যের ভাগ বেশী থাকে। কিন্তু পালাগানের অনেকগুলিই সমস্তই পদ্যে লেখা। দ্বিতীয়তঃ গীতিকথায় অনেক আজগুবি বিষয়ের অবতারণা আছে। বিশেষতঃ তান্ত্রিকদিগের মন্ত্রতন্ত্রের অসাধারণ গুণে নানারূপ অলৌকিক ঘটনার সংঘটন গীতিকথার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। যাঁহারা দক্ষিণারঞ্জন বাবুর ঠাকুর দাদার ঝুলির মালঞ্চ মালা ও কাঞ্চন মালা এই দুইটি গীতিকথা পড়িয়াছেন তাঁহারা এই বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অভিজ্ঞ। আমাদের সংগৃহীত এই পালাগানগুলির মধ্যেও কতকগুলি গীতিকথা আছে। যথা ‘কাজল রেখা’, ‘কাঞ্চন মালা’, ‘ভারৈ রাজা’, প্রভৃতি। এই মুকুটরায়ের পালায় তন্ত্রমন্ত্রের প্রভাবে অসাধ্য সাধনের অনেক কথা আছে। যে আকারে মুকুটরায়ের পালাটি প্রথম বিরচিত হইয়াছিল সে আকারটি পাইবার উপায় নাই। ইহার প্রথমভাগ ঠিক রাখিয়া মুসলমান লেখক একটা হিন্দুকাহিনীকে শেষভাগে রূপান্তরিত করিয়া ফেলিয়াছেন। ইহাতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোন চিহ্ন নাই, কিন্তু মুসলমান ধর্ম্মের মহিমা ঘোষণা করার চেষ্টা আছে। সম্ভবতঃ এই গীতিকথাটির দ্বিতীয় লেখক এইরূপ আরো তিন চারটি গীতিকথা রচনা করিয়াছিলেন। তাহাদের প্রত্যেকটিতে একটি হিন্দুকাহিনীর অবতারণা হইয়া শেষে তাহাতে ইসলামের জয় প্রচারিত হইয়াছিল। এই গীতিকথাটির শেষের ছত্রটি হইতে আমরা এই অনুমান করিয়াছি।

 প্রথমতঃ রাজকুমার যখন নির্জ্জন গভীর অরণ্য-প্রদেশে তাঁহার প্রেমিকাকে দেখিতে পান সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আমরা একাকী মিরাণ্ডাকে সামুদ্রিক দ্বীপে দর্শন করিয়া যেরূপ বিস্মিত হইয়াছিলাম, এই কুমারীর সন্দর্শনেও আমাদের তদ্রূপই বিস্ময় হইয়াছিল। নির্জ্জনে ঋষির আশ্রমে শকুন্তলা, সমুদ্রের উপকূলে কপালকুণ্ডলা এবং এই গভীর অরণ্যে পার্ব্বত্য কুমারী যেন এক হাতের আঁকা ছবি। কুমারী বিন্দুমাত্র পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত ছিল না। বন্য হরিণীর ন্যায় সে অরণ্যে ছুটিয়া বেড়াইত, ধনুর্ব্বাণহস্তে সে পুরুষবেশে শিকার করিত এবং তাহার স্বভাবজাত সৌন্দর্য্য আরণ্য সরলতার সহিত মিশ্রিত হইয়া তাহাকে এক বনদেবতার মত সুন্দরী করিয়া তুলিয়াছিল। ইহা একটি রাজকুমারের সঙ্গে রাজকুমারীর পরিণয়ের কাহিনী নয়। এখানে রাজকুমারী সম্পূর্ণ অসংস্কৃত, সামাজিকতার অতীত এক অপূর্ব্ব ললনা। কানন-কুসুমকে রাজকুমার রাজবাটীকার উদ্যানে লইয়া আনিয়াছিলেন। সে বেশভূষা জানিত না, কাহাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিতে হয় তাহা জানিত না। অতি তেজস্বিনী হইয়াও সে একটি ননীর পুতুলের ন্যায় কোমলপ্রাণ। যেমনি তাহার অবয়বে তেমনি তাহার কথাবার্ত্তায় নিত্যনিত্য রাজকুমার নব সৌন্দর্য্য এবং অপূর্ব্বত্ব আবিষ্কার করিতেন। এ যেন পৃথিবী এবং স্বর্গের মিলন। কিন্তু এই পর্ব্বতীয়―নিতান্ত বন্য রমণীর হৃদয়ে যে প্রেম ছিল, তাহা অতীব একনিষ্ঠ; তাহাতে পাতিব্রত্যের ও শাস্ত্রীয় সংস্কারের কোন চিহ্ন নাই; কিন্তু তথাপি তাহা এত ঐকান্তিক ও একনিষ্ঠ, যে সেই প্রেম সর্ব্বশাস্ত্রকে অতিক্রম করিয়া উঠিয়াছে। গীতিকথাটি সমাপ্ত করিয়া আমাদের মনে সেই নিষ্কলঙ্ক অপাপবিদ্ধ ও সরল ধনুর্দ্ধারিণীর চিত্রটি মনে থাকিবে। সে রাজকুমারকে পাইয়া যেরূপ আনন্দিত হইয়াছিল এবং সেই আনন্দের কথা যেরূপ আবেগে প্রকাশ করিয়াছিল বোধহয় পৃথিবীর কোন নায়িকা তাহা করে নাই। অসভ্য দুর্বৃত্তদিগের হাত হইতে কুমারকে সে কিভাবে রক্ষা করিবে এই ছিল তাহার প্রধান ভাবনা। একদিন গাছের উপর পত্রান্তরালে, অন্যদিন বৃক্ষের কোটরে, অন্যদিন তাহার কুটিরের পার্শ্বে সে কুমারকে লুকাইয়া রাখিল―যেন সে হারানো মাণিক―কত দুর্লভ ধন। গীতিরচয়িতা বলিতেছেন সে ত শাস্ত্রও পড়ে নাই, সামাজিকতাও জানিত না, কেহ গল্প করিয়াও তাঁহাকে প্রেমের কাহিনী শোনায় নাই। তবে সে এতটা প্রেম শিখিল কোথায়? “কেমনে পিরীতের জ্বালা বুঝিল বনেলা?” এই বন্য রমণী এত প্রেম কি করিয়া শিখিল?

 এই গীতিকথাটিতে রাজাদিগের স্বেচ্ছাচারিতা এবং তাঁহাদের পার্শ্বচরদের রাজার অভিপ্রায়-অনুসারে সম্মতিসূচক ঘাড়নাড়া প্রভৃতির বৃত্তান্ত পাঠ করিয়া মনে হয় যে দেশে পূর্ণ মাত্রায় অরাজকতা বিদ্যমান ছিল। প্রত্যেক দেশেরই সন্নিকটে বন্য বর্ব্বর জাতিরা ঘুরিত এবং উৎপাত করিত। আমাদের ‘সুজলা সুফলা’ বঙ্গভূমি তখনও খুব নিরাপদ ছিল এমন বোধ হয় না।

 আর একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। বঙ্গদেশে ছবি আঁকার প্রথা এত বেশী প্রচলিত ছিল যে ঘটকেরা সর্বদাই নানা দেশের রাজকুমার ও রাজকুমারীদের ছবি লইয়া দেশ-বিদেশে ঘুরিত, এবং অনেক সময় সেই ছবি দেখিয়াই উভয় পক্ষ বিবাহের সম্বন্ধ প্রায় ঠিক করিয়া ফেলিত। শুধু এই গীতিকথায় নয়, অনেক প্রাচীন পালাগানে ও বাঙ্গালা পুস্তকে ইহার ইঙ্গিত আছে। হরিবংশ পুরাণে দৃষ্ট হয় যে বাণের কন্যা ঊষা যখন অনিরুদ্ধকে স্বপ্নে দেখেন―অথচ এই তরুণ যুবক কে, তাহা নির্ণয় করিতে সমর্থ না হইয়া একান্ত ব্যাকুল হইয়া পড়েন, তখন ঊষার সখী চিত্রলেখা ভারতবর্ষের যাবতীয় তরুণ রাজকুমারের ছবি আঁকিয়া তাঁহাকে দেখান। এই ছবিগুলির মধ্যে ঊষা তাঁহার স্বপ্নদৃষ্ট কুমার অনিরুদ্ধের মূর্ত্তি সহজেই চিনিতে পারিয়াছিলেন। এই সকল উপাখ্যান হইতে বেশ বুঝা যায় চিত্রবিদ্যা এদেশে কতটা ব্যাপকতা ও উৎকর্ষ লাভ করিয়াছিল। সাধারণতঃ স্ত্রীলোকেরাই এই চিত্র ও অপরাপর কোমল শিল্পের চর্চা করিতেন। এই বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভারতী।

শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন। 


মুকুট রায়

মুকুট রায়

(১)

শিলুই রাজা আছিল ভাইরে ও ভাই দক্ষিণ মুল্‌কে ঘর।
হাইকো হাজারী পাইকো পাছারী পুরান্ধর[১]
লোক লস্কর আরে ভাই খেজমতকার না যায় গণন।
হাতী ঘোড়া লাখ বিলাখ শুন সভাজন॥
এই মতে রাজত্বি তাইন[২] করে শুন দিয়া মন।
আচম্বিতে হইল রাজার গো একটি নন্দন॥
(খেউরাল ভাই) ভালা দিশা টান রে ভাই মনেত ধরিয়া।
শিলুই রাজার কথা শুনু মন না দিয়া॥

এক পুত্রু শিলুই রাজার পছন্তে সুন্দর।
এমুন ছুরৎ নাই রে ভালা দক্ষিণার স’র[৩]১০
বেহেস্ত পরীর রাজা যেমন অগ্নির সমান জ্বলে।
চান্দ জম্মিল যেমুন জমিনের কোলে॥১২
যা’র দিকে চায় পুত্রু দুই আঁখি মেলে।
সেই ত আসিয়া তা’রে তুল্লিহা লহে কোলে॥১৪

(আহারে ভাই) এক দুই তিন করি বরষ গুজরে।
দেখিতে দেখিতে কুমার কুড়ি বছর ধরে॥১৬
বাছার যৈবন অইল চন্দ্রের সমান।
সানন্দিত অইল রাজা দেখিয়া বয়ান॥১৮

তবে ত শিলুই রাজা যুক্তি যে করিল।
পুত্রের বিবাহ দিতে মনে থির কইল॥২০
উজির নাজিরে ডাক্যা কয় ভালা তোমরা সবে শুন।
কেথায় আছে শুন্দর কন্যা চেরাবন্দি[৪] আন॥২২
যেমুন আমার পুত্রধন মুকুট কুমার।
সেই মত কন্যা আন ভালা পছন্দ বাহার॥২৪
যেমুন আমার পুত্র চান্দের সমান।
সেই মতে হবে কন্যা ভালা তিল নয় সে আন[৫]২৬

যে বাগে[৬] গোলাপ গুল গো দেখিতে সুন্দর।
এক লস্করে রাজা পাঠাইল উত্তর॥২৮
আর ত লস্কর রাজার পূবে মেলা নাই সে দিল।
আর ত লস্কর রাজার পশ্চিম মেলা করল॥৩০
আর ত লস্কর ভাইরে দক্ষিণ বুল্যা যায়।
চাইর দিকে লোক তবে পাঠাইল রায়॥৩২

কতদিনে উত্তর‍্যা ফিরিয়া আইল ঘর।
উত্তর রাজার কন্যা দেখিতে সুন্দর॥৩৪
সন্ধ্যা কালের তারা যেমুন আসমানেতে জ্বলে।
হাট্যা যাইতে কেশ কন্যার দাসীরা লয় কোলে॥৩৬
চাম্পা না ফুলের মতন কন্যার অঙ্গের বরণ রে।
আষাঢ়িয়া নদীর পানি কন্যার প্রথম যৈবন রে॥৩৮
এও কন্যা মুকুট কুমার পছন্দ না করে।
চেরাবন্দি পট কুমার ফেলাইল দূর ক’রে॥৪০

তবে দক্ষিণা কন্যার চেরাবন্দি আনে।
এমন সুন্দর কন্যা নাই সে তিরভুবনে॥৪২
সোণার বরণ কন্যার জমিনে পড়ে কেশ।
সন্ধ্যাকালের তারা রে ভাই দুই নয়ানে জ্বলে।
এও পট মুকুট রায় ফালাইল দূরে॥৪৫

পূবের দেশের কন্যা ভাই রে ভবে মিলা ভার।
তাহার রূপের কথা কইতে চমৎকার॥৪৭
হীরামন পালে কন্যা খাট পালঙ্গে বইসারে।
জমিনে পড়িলে ছায়া জমিন উজল করে॥৪৯
জলেতে পড়িলে ছায়া জল ত উজালা।
সোণার পালঙ্কে কন্যা ভালা শুইয়া নিদ্রা যায় রে।
সোণার মন্দির দেখে কন্যার রূপে যুড়ে॥৫২
এও কন্যা মুকুট রায় পছন্ত না করিল।
পচ্চিম মুল্লুক হইতে লস্কর ফিরিয়া আইল রে॥৫৪

আরে ভাই ভাই রে পচ্চিম রাজার বেটি বেহেস্তের পরী।
সংসারেতে নাই ভাই এই মত সুন্দরী॥৫৬
যেমুন কেশ তেমুন বেশ তেমুন সুসুরা[৭]
দুই আঁখিতে ভইরা থুইছে কন্যায় জ্বলন্ত আঙ্গেরা॥৫৮
এক খাটে ঘুমায় কন্যা আর খাটে ত চুল।
মুখে ত ফুটিয়া কন্যার শতেক চাম্পা ফুল॥৬০
হাট্যা যাইতে কন্যার মাইঝা ভাইঙ্গা পড়ে।
এক শত ধাই দাসী কন্যার সঙ্গে ত ফিরে॥৬২
এও কন্যা মুকুট রায় ভালা পছন্ত না করিল।
চেরাবন্দি পট রায় দূরত ফালাইল রে॥৬৪

(হারে ভাই রে ভাই) 
এরে শুন্যা শিলুই রায় ভালা গোস্বায় না জ্বলিল।
কটুয়াল জল্লাদে পুত্রে হাওলা[৮] সে করিল॥৬৬
আরে র দুর্জ্জন পুত্র অইল কুলাঙ্গারা।
আমারে অপমান কল্লে কি কহিবাম তোরে॥৬৮
পাত্র মিত্র জনে তবে বুঝাইল রাজারে।
তবে রাজা মুকুট রায় ভালা হুকুম যে দিলা রে।
শুন পুত্র শুন বাপধন বলি যে তোমারে॥৭১
(আরে পুত্রু) একশত ঘোড়া লওরে বাছাই করিয়া।
একশত হাতী লওরে বাছাই করিয়া॥৭৩
যারে মনে ধরে পুত্র লও রে লস্কর।
এহি সব লইয়া তুমি যাহ নিরান্তর॥৭৫
দিনদুইনারে যত আছে রাজার কুমারী।
তার মধ্যে দেখ্যা আইস পছন্ত সুন্দরী॥৭৭
তার মধ্যে দেখ্যা কুমার আরে যেবা লহে মনে।
তাহারে করাইবাম বিয়া তোমার কারণে॥৭৯
ধুবা নাপিতের কন্যা খেউরের ভাণ্ডারী।
যা’রে পছন্তিবে তা’রে আন বিভা করি’॥৮১

এরে শুন্যা মুকুট রায় তবে কোন্ কাম করিল।
লোক লস্করা লইয়া মেলা যে করিল॥৮৩
মায় কান্দে ভাই সে কান্দে কাইন্দা জারে জার[৯]
আইজ হইতে দক্ষিণা মুলুক হইল অন্ধকার॥৮৫

(২)

আরে ভাই রে— 
সাত জঙ্গল তের নদী দুরন্ত হাওর[১০] রে।
পার হইয়া যায় কুমার নেয়াজা সহরে॥
নেয়াজা হইয়া পার রে পূবমুখী চলে।
বেইল ভাটি[১১] দাখিল হইল বেহুরা জঙ্গলে॥
ভাই রে ভাই— 
বেহুরা জঙ্গলার কথা শুন দিয়া মন।
শতেক যোজন ভইরা বেড়া সেই বন॥
আরে ভাই রে ভাই— 
বেহুরা জঙ্গলা কি রে বাঘ ভালুক হায় রে।
বড় বড় অজাগর হরিণা ধইরা খায় রে॥
সেই বনে প্রবেশত কুমার রে।
শুন শুন লোকজন রে বলি যে তোমরার কাছে রে।
তোমরা সবে যাহ ত মুল্লুকে রে॥১১
মায়ের ধন মায়ের কোলে
তোমরা যাহ ত চইলে রে।
আমি ত হইলাম বনবাসী রে॥১৩
ও লোক লস্কর খাড়া হইয়া শুন রে।
যদি সে জিগায়[১২] মায় পন্নাম তাহান পায় রে।
কইয়ো মায় খাইছে জংলার বাঘে রে॥১৬
আরে লোক জন— 
বাপে যদি ফুইদ[১৩] করে।
আমার পন্নাম জানাইয়ো তারে রে॥১৮

কইয়ো তা’রে আমার দুক্ষের বাণী—
বনেলা সে অজাগর আমারে না ধইরা খায় রে।
কইয়ো দেশে আর না ফিরমু আমি রে॥২১
এই মতে কাইন্দা কুমার আরে কোন্ কাম করিল।
দৌড়ের ঘোড়ার পিষ্ঠে ভালা শোয়ার যে অইল॥২৩

রক্ত করম্‌জা গোটা ভাইরে ঘোড়ার বরণ।
কাম সিন্দুর দেখি তাহার বদন॥২৫
চলিবারে পক্ষীরার দুই কন্ন খাড়া।
জিহ্বা গোটা দেখি ঘোড়ার জ্বলন্ত আঙ্গেরা।
চারিখানি পাও তার শোভে সুধন[১৪] ক্ষুরা॥২৮
সেহি ত ঘোড়ার পিষ্ঠে কুমার যখনি বসিল।
জঙ্গলা ভাঙ্গিয়া ঘোড়া শূন্যে উড়া দিল॥৩০

(হায়) লোক জন কোথায় রইল কেবা কারে জানে।
সন্ধ্যা বেলায় দাখিল[১৫] গিয়া কাঠুরিয়া ভবনে॥৩২
(হায়) কাঠ কাট কাঠুরী ভাইরে মিন্নতি আমার।
আজি নিশি মোরে দেহ একটুকু ঠাঁই॥৩৪
কাঠুরীর ভবনে কুমার আরে রাত্রি পোষাইল।
এক দুই তিন কইরা সাত দিন গেল রে॥৩৬
সাত দিন পরে কুমার কিবা ন কৈল মনে।
শিকার করিতে কুমার চলে বেউর বনে॥৩৮
ভাই রে ভাই— 
হাতে লইল ধনু ছিলা পিষ্ঠে লইল তীর।
ঘোড়ার পিষ্ঠেতে তবে হইলা শুয়ার॥৪০

(হায়) বেউর জঙ্গলা পথে ঘোড়া চলিতে না পারে।
হাটিয়া চলিল কুমার ছাড়িয়া ঘোড়ারে॥৪২
কতখানি দূর গিয়া নজর কর‍্যা চায়।
হীরামন তোতা এক গাছের ডালে দেখা যায়॥৪৪
মাথায় সোণার ছিট সোণার বরণ পাখী।
এমন সুন্দর রূপ নয়ানে না দেখি॥৪৬

জীবন্ত ধরিতে কুমার মনে যে করিল।
হেনকালে হীরামন শূন্যেতে উড়িল॥৪৮
পাছে পাছে চলে কুমার উর্দ্ধপানে চাইয়া।
মেহনত[১৬] অইল বড় জঙ্গলা ঘুরিয়া॥৫০
কতখানি দূর গিয়া কুমার সামনেতে চায়।
একটি সুন্দর কন্যা সামনে দেখতে পায়॥৫২

পিন্ধনে গাছের পাতা গাছের বাকলা।
কন্যার গায়ের রঙ্গে বেউর উজালা॥৫৪
ভাই রে ভাই— 
মুখের বরণ কন্যার সোণা চাম্পা কলি।
দুই হস্ত তুল্‌ছে কন্যার বেলাইনতে বেলি’[১৭]৫৬
পিষ্ঠেতে বাহিয়া পড়ে উদাম[১৮] দীঘল চুল।
দুই ত কন্নেতে শোভে ধামনার[১৯] ফুল॥৫৮
এক হাতে শোভে ধনু আর হাতে তীর।

আগে আগে চলে কন্যা উন্নমুখী[২০] হইয়া।
পাছে ত চলিল কুমার পাগল হইয়া॥৬১
কতকখানি দূর গিয়া কন্যা কোন্ বা দেখিল।
দুই হাঁটু পাতিয়া কন্যা ভূমে ত বসিল॥৬৩
ডানি হাতে ধরে ধনু বাঁও হাতে ছিলা।
হেনকালে ত কুমার কোন্ কাম করিলা॥৬৫

ভাই রে ভাই— 
দারাকের[২১] ডালে বসিয়া হীরামন তোতা।
তাহার চৌদিকে বেড়ে গাছের নয়া পাতা॥৬৭
জল্‌দি করিয়া কুমার ধনু হাতে লইল।
এক তীরে কুমার যে পঙ্খিরে মারিল॥৬৯
ডাইল ছাইড়া হীরামন জমিনে লুটায়।
এতেক দেখিয়া কন্যা পিছু পানে চায়॥৭১

শুন শুন বনেলা কন্যা কহি যে তোমারে।
আমি মারছি তোমার পঙ্খি লো কন্যা,
তুমি বধ মোরে॥৭৩
আঁখি নাই সে ফিরে, কন্যা চমকি চাহিল।
আচানক পুরুষ হেথা কোন খান থাক্যা আইল॥৭৫

শুন রে ভিন্ন দেশী কুমার শুন দিয়া মন।
বেউর জঙ্গলায় দেখি কিসের কারণ॥৭৭
কে বা তোমার মাও বাপ রে কে বা তোমার ভাই।
কুয়াবে[২২] এমুন রূপ কভু দেখি নাই॥৭৯

বনুয়ার নারী আমি জঙ্গলায় বসতি।
শিকার করিয়া ফিরি অন্য কার্য্য নাই॥৮১
বনেলা বিয়াধের মাইয়া মুঞ[২৩] আকপালী[২৪]
পশুপঙ্খী মাইরা আমরা করি উদ্দর-পালি[২৫]৮৩
আমার পঙ্খীরে তুমি মারলা কি কারণ।
কুমার কহিলা শুন মোর ত বিবারণ॥৮৫

দক্ষিণ মুলুক কন্যা আমার বসতি।
শুইয়া আছিলাম কন্যা জোড়-মন্দির ঘরে॥৮৭
কুয়াব দেখিলাম কন্যা রাত্তর নিশাকালে।
কুয়াবে দেখিলাম কন্যা লো কন্যা তোর চান্দ বয়ান
ঘুরিয়া তামাম দেশ হইলাম হয়রান॥৯০

কত কত রাজার মাইয়া নয়ানেতে দেখি।
এক এক কন্যা যেমুন বেহস্তের পঙ্খী॥৯২
এ সব রাজার বেটী মনে না ধরিল।
এ মতি পাগল মন বৈদেশী করিল॥৯৪
নানান দেশ ঘুর‍্যা কন্যা লো বেউরে আসিনু।
সপ্পনের ধন মোর সাক্ষাতে মিলিল॥৯৬

কুমারের কথা শুন্যা কন্যার দুই আঁখি ঝুরে।
দুই ত নয়ানের পানি ঝরঝরি পড়ে॥৯৮
কি করিলে সুন্দর কুমার কি করিলে হায়।
আর না দেখিবা কুমার তোমার বাপ মায়॥১০০

আর না পাইবা রাজ্জতি কুমার রাজার ছাওয়াল
বনেলা বিয়াধের দেশ জঙ্গলায় কাল॥১০২
যারে দেখে তারে মারে মায়া বাস্‌না নাই।
বুকে ত মারিব তীর পন্থে লাগাল পাই॥১০৪
বাঘ ভালুক হইতে কুমার আরে বেশী ডর দেখি।
অল্প ত মাথার কেশ, কোথায় ছাপাইয়া রাখি রে[২৬]১০৬

কলিজার লৌহ যদি বুকে দিতাম থান[২৭]
দেহাতে ভরিয়া রাখতাম হইলে পরাণ॥১০৮
নয়ানে রাখতাম ভইরা না হইতাম পাশুরা।
দিশালে হইতে যদি দুই নয়ানের তারা॥১১০
এ সবার বেশী তুমি পরাণের পরাণ।
কোন্‌খানে লুকাইয়া রাখি এই পুন্নুর[২৮] চরণ॥১১২

কান্দিয়া কাটিয়া কন্যা ফালায় ধলুক ছিলা।
কেমুনে পিরীতের জ্বালা বুঝিল বনেলা॥১১৪
মাস নহে বচ্ছর নহে দণ্ড দুই চারি।
পিরীতের দুঃখু কেমনে বুঝে বনের নারী॥১১৬
পাইলে মাণিক যেমুন সাত রাজার ধন।
উপায় ভাবিতে কন্যা চিন্তে মনে মন॥১১৮
আরে ভাইরে এক নিশি লুকাইয়া রাখে দাড়াকের ডালে।
আর দিন লুকাইয়া রাখে বিক্কের[২৯] কুটলে[৩০]১২০

আর ভাই, 
আর দিন ঢাকে কন্যা গাছের পাতা দিয়া।
সাত রোজ রাখে কন্যা আড়ালি করিয়া॥১২২
রাইতে আসে দিনে যায় বিয়াধের দল।
গামরা[৩১] হইয়া কন্যা না ঢুঁড়ে জঙ্গল॥১২৪
মাথায় দারুণ বিষ সকলে ভাড়ায়।
পলাইবার পথ নাই কি মতে পলায়॥১২৬

শুন শুন কন্যা লো বলি তোমার ঠাই।
বেউর ছাড়িয়া চল মুল্লুকেতে যাই॥১২৮
শুনিয়া বনের নারী চমকিরা উঠিল।
কুমারের সঙ্গে যাইতে মনে স্থির কৈল॥১৩০
একদিন বনুয়ার দল শিকারেতে যায়।
সময় বুঝিয়া দূরে পলাইয়া যায়॥১৩২

(৩)

আর ভাই রে— 
দক্ষিণা মুল্লুকখানি করে তোলপার।
বিভা[৩২] করিয়া দেশে আইসাছে কুমার॥
বাপে ত বান্ধিয়া দিল জলটুঙ্গি ঘর।
কন্যারে লইয়া কুমার থাকে নিরন্তর॥
সোণার খাট সোণার পালঙ্ক যোড়মন্দির ঘরে।
আবের[৩৩] পাঙ্খায় ধাই[৩৪] বাতাস না করে॥
কইন্যারে পরায় কুমার নানান রত্ন অলঙ্কার।
পায়ে ত পঞ্চম আর গলায় রত্নহার॥

সিঁথিতে সিঁথানি কন্যা তারা যেন জ্বলে।
বাহার করিয়া সাড়ী তুলিল কাঁকালে॥১০
আর যতেক অলঙ্কার কহিতে না পারি।
এহিমতে সাজন করিল বনেলা সুন্দরী॥১২
চৈত না ফাল্গুন মাস যায় এই মতে।
ফুলের মধু খাইয়া দেখ গুঞ্জরে ভমরা।
কন্যার দেখিয়া রূপ কুমার বেহুরা[৩৫]১৫
দিনে দিনে বাড়ে রূপ তিল নাই সে কমে।
হেনকালে শুন কিবা করিল দুষ্‌মনে॥১৭

আরে, ভালা কইরা গাইও দিশা তালে রাইখ পাও।
এই না দিশা রাখ্যা তোমরা আরেক দিশা গাও॥১৯
পুষ্পমধু খাইয়া যেমন ভমরা পাগল।
কন্যারে লইয়া কুমার থাকে নিরন্তর॥২১
একদিন বইসা কুমার যোড়মন্দির ঘর।
পান গুয়া খায় কুমার হরষিত অন্তর॥২৩
(ভাই রে ভাই) কৈতরা-কৈতরী[৩৬] যেমুন মুখে মুখ দিয়া।
মধু পান করে দুহে আসক[৩৭] হইয়া॥২৫

গৈরব না কর বান্দারে আরে বন্দা দৈব কাছে কাছে।
আজ ত আইসাছে সুখ, দুঃখু তাহার পাছে॥২৭
আজ যে হাসিছ বান্দা না রাখ খবর।
কালুকা কান্দিয়া মরবা বেইলের[৩৮] আড়াই প’র[৩৯]২৯
আজত সুখের গুজরান করছ গুণাগার।
কাইল ত চাহিয়া দেখ্‌বা দুইনারি[৪০] আন্ধার॥৩১

কোদালে কাটিয়া মাটি উপরে দিবে চাপা।
চারিদিকে চাহিয়া দেখ্‌বে কোথারে মা বাপা॥৩৩
কিড়ায়[৪১] কাটিয়া মাংস সুখেতে ভুঞ্জিবে।
দিন-দুইনারির[৪২] সুখ কৈবা পইড়া রবে॥৩৫
আর ভাই মারফতি[৪৩] কথা এখন নিরবধি থুইয়া।
দিশা গাও খেরুয়াল ভাইরে সভার হুকুম লইয়া॥৩৭

তার পরে হইল কিবা শুন বিবারণ।
দুয়ে মিলি রসকলা করয়ে ভুঞ্জন॥৩৯
একদিন সন্ধ্যা বেলা জল-টুঙ্গি ঘরে।
দুইজনে বস্যা তারা আলাপন করে॥৪১
হেনকালে সন্ধ্যা দেখ গুজরিয়া যায়।
দুরান্ত দুষ্মন বনুয়া[৪৪] কিবান[৪৫] করে হায়॥৪৩

মারিল বিষের তীর কুমারের বুকে।
জমিনে পড়িল কুমার—লহু[৪৬] ছুটে মুখে॥৪৫
কলিজা ভেদিয়া তীর পিষ্ঠেতে বাইরল।
দেখিয়া বনেলা কন্যা কোলে তুইল্যা লইল॥৪৭

আহা আহা পরাণের পতি এমুন হইল।
কেমুন দুষ্মনে জানি এমুন করিল॥৪৯
আঁখি মেইলা চাও বান্ধুই আঁখি মেইলা চাও।
আমারে একেলা থুইয়া কইবা[৪৭] চল্যা যাও॥৫১

মাও নাই বাপ নাই মোর গর্ভ-সোদর ভাই।
দুইনায়ে আপনা বল্‌তে কেউ মোর যে নাই॥৫৩
আছিলাম বনের পঙ্খী জঙ্গলায় বসতি।
পিঞ্জরে ভরিয়া বন্ধু শিখাইলে পিরীতি॥৫৫
আমার পরাণ, বন্ধু, তোরে দিয়া যাই।
তোমার নিছুনি[৪৮] লইয়া আমি মইরা যাই॥৫৭

মুখে মুখ দিয়া কন্যা করয়ে চুম্বন।
দুই নয়ানের পানি কন্যার মেঘের বরিষণ॥৫৯

না জানি না চিনি দেশ কেবা তার কেমুন।
তোমার লাগিয়া চিনা হইল এমুন॥৬১
কালুকা বিয়ানে মায় পুছিবে যখনি।
কি বাৎ কহিমু তাঁরে পাগল জননী॥৬৩
কালুকা বিয়ানে রাজা পুছিবে যখন।
কি বাৎ কহিয়া তাঁর প্রবোধিব মন॥৬৫
রাজ্যের যতেক লোক পুছিবে আমারে।
পুছিলে উত্তর কিবা দিমু তা’ সবারে॥৬৭
যতেক নাগরিয়া লোকে দিবে বেড়াবাড়ি[৪৯]
মুখেত পাড়িবে গালি পুরুষ-বধী নারী॥৬৯

এহি মতে কান্দ্যা কন্যা কোন্ কাম করে।
মড়া লইয়া যায় কন্যা জোড়মন্দির ঘরে॥৭১
কান্দিয়া কাটিয়া কন্যায় রাত্রি পোষাইল।
যতেক নাগরিয়া লোকে পরভাতে জানিল॥৭৩
রাজা কান্দে রাণী কান্দে মরা পুত্র লইয়া।
ধাই দাসী সবে কান্দে জমিনে পড়িয়া॥৭৫

পাত্রমিত্র জনে কান্দে নগরের লোকে।
হায়রে দারুণ বিধি ফালাইল বিপাকে॥৭৭

তবে রাজা বনেলারে[৫০] করে জিজ্ঞাসন।
কি মতে হইল মোর পুত্রের মরণ॥৭৯
কন্যার যতেক কথা বিশ্বাস না করে।
পাত্রমিত্র কহে, রাজা, বান্ধহ ইহারে॥৮১
বনুয়া[৫১] রাক্ষুসী এই মোর লয় মন।
খাইতে মড়ার মাংস বইধাছে জীবন॥৮৩

পাত্রমিত্র সহ রাজা যুক্তি সে করিল।
দোছালে[৫২] সিন্ধুক এক কামেলা বানাইল॥৮৫
সিন্ধুকে ভরিয়া পুত্র মরার সঙ্গেতে।
জীবন্ত বনেলা কথা দিল তার সাথে॥৮৭

আরে ভাই রে— 
কুলুপ করি সিন্ধুক জলে ভাসাইল।
জলের উপরে সিন্ধুক ভাসিয়া চলিল॥৮৯

হায় ভালা— 
তারপরে হইল কিবা শুন বিবারণ।
জাল বায় জালুয়া দেখ ভাই দুইজন॥৯১
দৈব যোগ সিন্ধুক যে জালেতে ঠেকিল।
টানিয়া টুনিয়া তারা উপরে আনিল॥৯৩
কুলুপ ভাঙ্গিয়া তারা দেখে আচরিত।
মড়ার সঙ্গেতে জেতা, কেমুন পিরীত॥৯৫

ভয় পাইয়া জালুয়ারা পলাইয়া গেল।
মরা পতি লইয়া কন্যা বাহির হইল॥৯৭

মরা কান্ধে লইয়া কন্যা জঙ্গলা বেড়ায়।
দুই আঁখির জল পইরা কন্যার গহিন[৫৩] ভাস্যা যায়॥৯৯
“জাগ জাগ পতি আরে চক্ষু মেলি চাও।
অভাগ্যা বনেলা কন্যায় কেন বা ভাঁরাও[৫৪]১০১
মাও বাপ নাহি ছিল গর্ভ-সোদর ভাই।
অভাগ্যা বনেলা জাতি কোনু দুঃখু নাই॥০৩
স্বপনে রাজার রাণী, স্বপনে কাঙালী।
স্বপনে করিলে মোরে দুঃখের কপালী॥০৫
রাজত্বি ঠাকুরালী কিছুই না চাই।
বনে ত বসতি করি তোমায় যদি পাই॥১০৭
হায় কোথায় রহিলে প্রভু তুমি নিরঞ্জন।
অভাগ্যা বনেলা কন্যা করিছে কান্দন॥১০৯
প্রভুরে বাঁচাও আল্লা আর নাই সে চাই।
তোমার জনাবে আল্ল। সেলাম জানাই॥১১১

সপ্ততালা বেহেস্ত পুরী সোণার ভুবন।
তাহার উপরে আছুন আল্লা নিরঞ্জন॥১১৩
বনেলার কান্দনেতে আসন নড়িল।
বত্রিশ পেগাম্বরে ডাক্যা কহিতে লাগিল॥১১৫
শুন শুন পেগাম্বর কহি যে তোমারে।
জল্‌দি করিয়া যাও জঙ্গলার ভিতরে॥১১৭
নোয়াজার কন্যা কান্দে পতি হারাইয়া।
তাহার পরাণ রাখ পতি দান দিয়া॥১১৯

এই দিকে হইল কিবা শুন বিবারণ।
মড়ার গায়েত করে কীড়ার দংশন॥১২১
কান্দে বনেলা কন্যা হরদিশ[৫৫] বেহুরা[৫৬]
দুই হাতে বাছ্যা ফেলে মড়ার শরীলের কীড়া॥১২৩
মাংস খসিয়া পড়ে, হাড় রইল খালি।
কান্দে বনেলা কন্যা পতি পতি বলি॥১২৫
হেনকালে বত্রিশ পেগাম্বর।
জল্‌দি চলিয়া আইল জঙ্গলা ভিতর॥১২৭

নেয়াজার সরের রাজা তোমার যে বাপ।
জঙ্গল ঢুঁড়িয়া কন্যা পাইলে বড় তাপ॥১২৯
প্রভুর কেরামতে[৫৭] আমি এহারে জিয়াই।
তুরন্ত[৫৮] চলিয়া যাও তুমি নেয়াজার সরে॥১৩১
আমি যে জিয়াইব পতি না দেখিবা তুমি।
মনিষ্যি দেখিলে করা হইবে হয়রানি[৫৯]১৩৩
জিয়ন মরণ দশা মুরশীদের হাতে।
মরায় না আসে পরাণ মানুষ থাকিতে॥১৩৫
বিখালী[৬০] বনের মাধ্যে জিউদান দিব।
পউখ পাখালী কারে সামনে না থাকিব॥১৩৭

এই কথা শুনিয়া কন্যা জমিনে ঢলিল।
কেমুনে জানিমু পতি পরাণে বাঁচিল॥১৩৯
এই কথা শুন্যা তবে রসুল পেগাম্বর।
একে একে জোরা দিল বত্রিশ পঞ্জর॥১৪১

কালাম ঝাড়িয়া তবে মন্তর পড়িল।
হাড়ের উপরি মাংস জুরা ত লাগিল॥১৪৩
আর মন্তর পড়ে মুর্‌শীদ গো
আরে মুর্‌শীদ মড়ার পানে চাইয়া।
জিয়ন চর্ম্মেত দেহা লইল ঢাকিয়া॥১৪৬

বনেলা ক্যারে মুর্‌শীদ কহিল বচন।
বে-পত্যয়[৬১] না হও কন্যা শুন দিয়া মন॥১৪৮
এহিবার পতিরে তোমার দিনু জিউ দান।
জল্‌দি করি যাও তুমি নেয়াজার সর”॥১৫০

হুর নবী বৈল্লা মুর্‌শীদ তিন ডাক মাইল।
নেয়াজার সরে কন্যায় উড়াইয়া নিল॥১৫২

আর ভাইরে— 
তবে ত শিলুই রাজা আনন্দ অপার।
মরা পুত্রু জিয়া আইসে এমুন ভাগ্যি কার॥১৫৪
জলটুঙ্গি ঘরে কুমার দাখিল হইল।
তথায় কন্যার দেখা খুঁজিয়া না পাইল॥১৫৬
মায়ে পুছে বাপে পুছে রে কুমার পুছে বান্ধই জনে।
এই যে আছিল কন্যা গেল কেথাকারে॥১৫৮
জানের জান কন্যায় আমার কেমুন জনে বধিল।
দানাপানি ছাইরা কুমার পাগল হইয়া গেল॥১৬০
পশর রাজার পুরী আবেতে ঘিরিল।
পুন্নিমার চান কেন মেঘে আবুরিল।
সহর বাজারে ঢোল মারিতে লাগিল॥১৬৩

যেই জনে পুত্রে মোর ভালা কইরা দিবে।
সুমানে করিয়া ভাগ অর্দ্ধরাজ্য নিবে॥১৬৫

ভাই রে ভাই— 
উত্তর দক্ষিণ ভাইরে পূব দেশ চাইয়া।
গিরদে গিরদে[৬২] ঢোল রাজা দিল পাঠাইয়া॥১৬৭

এই দিকে হইল কিবা শুন দিয়া মন।
নেওয়াজের রাজা কন্যায় পাইল যখন॥১৬৯
কন্যার রূপেত রাজার রাজ্যখানি জুরে।
সেহি ঘর পশর কন্যা থাকে যেই ঘরে॥১৭১

ভাই রে ভাই— 
যুব্বমানা দেখ্যা রাজা কন্যা বিয়া দিতে।
লস্কর পাঠাইল রাজা নানান দেশেতে॥১৭৩
হেন কালে শিলুই রাজার যতেক লস্কর।
ঢোল লইয়া মারে নেয়াজার সর॥১৭৫

হেনকালে মুর্‌শীদ গো কোন্ কাম করিল।
ভালা কইরা দিব পুত্রে ঢোল যে ছুঁইল॥১৭৭
লোক লস্কর তবে কোন্ কাম করে।
মুর্‌শীদে ধরিয়া লইল শিলুই রাজার কাছে১৭৯

মুর্‌শীদ ডাকিয়া কয় শিলুই রাজারে।
নেয়াজার কন্যা তুমি বিয়া করাও তারে॥১৮১
তবে ত চলিল লোক নেয়াজার সরে।
চেরাবন্দী পট আন্যা দেখাইল কুমারে॥১৮৩

চেরাবন্দী পট গো কুমার আহা ভালা যইখানে[৬৩] দেখিল।
বুকেত লইয়া পটগে। কাঁদিতে লাগিল॥১৮৫

আহারে দারুণা বিধি কোন্ কাম করিল।
আমার জানের জান কি লাগি বধিল॥১৮৭
বাপ দুষ্মন, মাও দুষ্মন, সুহৃদ বলি কারে।
আমার পরাণের কন্যা ভাসাইল সায়রে॥১৮৯
আমার জানের জান জলে ডুব্যা মরে।
আর না থাকিবাম আমি শিলুই রাজার ঘরে॥১৯১

দিশা—কান্দে মুকুট কুমার মাথা থাপাইয়া— 

আর ভাইরে ভাই— 
এই দিকে নেয়াজার কন্যা পাগল হইল।
দুইনারির[৬৪] চিজবস্তু সকলে ছাড়িল॥১৯৪
ভালা ভালা সাড়ী আর রত্ন অলঙ্কার।
দাঁতে ত ছিঁড়িয়া করে পার পার॥১৯৬
কেশ নাহি বান্ধে কন্যা না পিন্ধে বসন।
প্রাণপতি বল্যা কন্যা কাঁদে ঘন ঘন॥১৯৮
তবে ত নেয়াজার রাজা দুঃখিত হইল।
সহর বাজার জুরা ঢোল যে মারিল॥২০০
যেহি জনে আমার কন্যা ভাল করিয়া দিবে।
সুমানে অর্দ্ধেক কইরা রাজত্বি না লইবে॥২০২
এও ঢোল মুর্‌শীদ যে আগুরি[৬৫] ধরিল।
নেয়াজার কন্যা আনি দাখিল করিল॥২০৪

হীরামনে পাইল শাড়ী চান্দে যেমুন তারা।
অজগারে পাইল মণি, অন্ধে নয়ন তারা॥২০৬

রাজা কয় মুর্‌শীদ গো ধরি তোমার চরণ!
পুত্রুদান পাইলাম তোমার কারণ॥২০৮
কোন্ রাজ্য কত ধন চাহত কি দিম[৬৬]
মুরশীদ কহিছে আমি মুইটের ফকির॥২১০

হায় মুরশীদের কেরামত রাজা যখনি জানিল।
নবীর কলেমা পইরা মুছুলমান হইল॥২১২
তবে ত নেয়াজার রাজা বিসমেল্লা বলিয়া।
কাফের আছিল রাজা বেদীন হইয়া॥২১৪
মুছলমান হইল রাজা সানন্দিত মন।
পূব পশ্চিম দিক্ করিয়া বন্দন।
যতেক কাফের লোক মুছুল্লি হইল॥২১৭

আল্লা আল্লা বল ভাইরে নবী কর সার।
নবীর কলেমা পড় বন্দা গুণাগার॥২১৯
গৈরব করিছ বান্দা এ দেহের মিছা।
মিছা কথা এ দুনিয়া আল্লা নবী সাঁচা॥২২১
আইজ হাসিছ বান্দা না রাখ খবর।
কালুকা কান্দিয়া মরবা বেইলের আড়াই পর॥২২৩
আইজত সুখের গুজরান করছ গুনাগার।
কাইল ত চাহিয়া দেখ্‌বা দুইনাই আঁধার॥২২৫
কোদালে কাটিয়া মাটি উপুরেতে চাপা।
চারিদিকে চাইয়া দেখ্‌বে কোথাও মাও বাপা॥২২৭

কিড়ায় কাটিয়া মাংস সুখেতে ভুঞ্জিবে।
দিন দুইনারীরি সুখ কোথায় পইরা রইবে॥২২৯

আল্লা আমিন বল মমিন বল মমিনা ভাই।
সার কেবল আল্লাজীর নামটি অসার দুইনাই[৬৭]২৩১
দুই দিনের হাসি কান্দন বেইল গেলে ফুরায়।
কার লাগ্যা কেবা কান্দে বুঝন হইল দায়॥২৩৩
দিন থাকিতে ধর ভাইরে মুর্‌শীদের চরণ।
দিন থাকিতে ভজ ভাইরে আল্লা নিরাঞ্জন॥২৩৫
দক্ষিণ মুল্লকের কথা এইখানে থুইয়া।
পূবেত কাফেরের দেশ শুন মন দিয়া॥২৩৭

(বাকীটা পাওয়া যায় নাই।)

  1. পুরান্ধর=(?)
  2. তাইন=তিনি।
  3. স’র=সহর।
  4. চেরাবন্দি=চেহারাবন্দি অর্থাৎ ছবি তুলিয়া।
  5. তিল ময় সে আন=এক তিল অন্যরূপ হইবে না।
  6. বাগে=বাগানে।
  7. সুসুরা=সুশ্রী।
  8. হাওলা=দাখিল (সমর্পণ করিয়া দিল)
  9. জারে জার=অতিশয় বিহ্বল হইল।
  10. হাওর=জলাভূমি।
  11. বেইল ভাটি=বেলার ভাটার অর্থাৎ সন্ধ্যাকালে।
  12. জিগায়=জিজ্ঞাসা করে।
  13. ফুইদ=খোঁজ।
  14. সুধন=সুবর্ণ, সোনার।
  15. দাখিল=উপস্থিত।
  16. মেহনত=পরিশ্রম।
  17. দুই হস্ত...বেলি’=দুইটি হাত এমন সুগোল, যেন বেলুন দিয়া বেলিয়া সৌষ্ঠবসম্পন্ন করা হইয়াছে।
  18. উদাম=খোলা।
  19. ধামনার=(?)
  20. উন্নমুখী=উর্দ্ধমুখী।
  21. দারাকের=একরূপ বৃহৎ বন্য বৃক্ষ।
  22. কুয়াবে=খোয়াবে, স্বপ্নে।
  23. মুঞ=আমি।
  24. আকপালী=ভাগ্যহীনা।
  25. উদ্দর-পালি=উদর-পালন।
  26. অল্প......রাখি রে=আমার মাথার চুল এত বেশী নহে যে তোমাকে তাহার মধ্যে লুকাইয়া রাখিতে পারি।
  27. থান=স্থান
  28. পুন্নুর=পুণ্যের।
  29. বিক্কের=বৃক্ষের।
  30. কুটলে=কোটরে।
  31. গামরা=(?)
  32. বিভা=বিবাহ।
  33. আবের=অভ্রের।
  34. ধাই=পরিচারিকা।
  35. বেহুরা=পাগল।
  36. কৈতরা-কৈতরী=কপোত-কপোতী।
  37. আসক=প্রণয়াসক্ত।
  38. বেইলের=বেলায়।
  39. আড়াই প’র=আড়াই প্রহর।
  40. দুইনারি—দুনিয়া, পৃথিবী।
  41. কিড়ায়=কীটে, পোকায়।
  42. দিন-দুইনারির=দিন-দুনিয়ার, পৃথিবীর।
  43. মারফতি=ফরমাইসি, শ্রোতৃবর্গের ইচ্ছায় অবান্তর কথা।
  44. বনুয়া=শ্যালক, গালাগালি দিয়া সম্বোধন।
  45. কিবান=কি।
  46. লহু=রক্ত।
  47. কইবা=কোথায়।
  48. নিছুনি=যত আপদ-বালাই।
  49. বেড়াবাড়ি-গালি।
  50. বনেলারে=জঙ্গলী মেয়েরে।
  51. বনুয়া=বনের
  52. দোছালে=(?)
  53. গহিন=ঘন বন।
  54. ভাঁরাও=ঠকাও।
  55. হরদিশ=হারা উদ্দেশে, লক্ষ্যশূন্য ভাবে।
  56. বেহুরা=পাগলা, বাউরিয়া, বাউলিয়া ইত্যাদি শব্দ পাগল অর্থে ব্যবহৃত হইত।
  57. কেরামতে=মাহাত্ম্যে।
  58. তুরন্ত=ত্বরিত।
  59. হয়রানি=বিপন্ন।
  60. বিখালী=বৃক্ষসমন্বিত।
  61. বে-পত্যয়=বিশ্বাসহারা।
  62. গরদে গিরদে=রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে।
  63. যইখানে=যখন।
  64. দুইনারির=দুনিয়ার জগতের।
  65. আগুরি=আগুলিয়া, আটকাইয়া।
  66. কি দিম=কি দিব।
  67. দুইনাই=দুনিয়া।