পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা)/রাজা তিলক বসন্ত

উইকিসংকলন থেকে

রাজা তিলকবসন্ত

 এই পালাটি চন্দ্রকুমার দে মহাশয়ের সংগ্রহ। ইহা তিনি সমাজঝিকরলো অঞ্চলে রামচরণ বৈরাগী ও কতকাংশ লোচনদাসের নিকট পাইয়াছেন।

 যদিও আমরা এই গানটি পালাগানের ধরনে পাইতেছি, তথাপি ইহাতে কিছু কিছু ব্রাহ্মণ্য-প্রভাব যে পড়িয়াছে তাহা সহজেই দেখা যায়। বাঙ্গালা মহাভারতে শ্রীবৎস ও চিন্তার উপাখ্যানটি কোন সংস্কৃত পুরাণ হইতে গৃহীত কিনা ইহা ৺রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয় বিশেষ করিয়া খুঁজিয়াছিলেন কিন্তু এগুলি বাঙ্গালাদেশেরই কথা, পল্লীগীতিকা। ইহার সন্ধান সংস্কৃত সাহিত্যে কখনই মিলিবে না। বিদেশী বণিক্ কর্ত্তৃক সতীসাধ্বী মহিলারা এই ভাবে বাঙ্গালী-প্রচলিত রূপকথাগুলিতে যে কতবার লাঞ্ছিত হইয়াছেন তাহার অবধি নাই। বিপদে পড়িয়া সেই মহিলা সূর্য্য কিংবা অপর কোন দেবতার নিকট প্রার্থনা-পূর্বক দেহশ্রী নষ্ট করিবার জন্য কুষ্ঠব্যাধি বরণ করিয়া লইয়াছেন। রাজা কাঠুরিয়া সাজিয়াছেন এবং বাছিয়া বাছিয়া চন্দন কাষ্ঠ সংগ্রহ করিয়াছেন। আমাদের শৈশবে দিদিমা যে সুবৃহৎ স্বপ্নরাজ্য প্রস্তুত করিতেন, তাহাতে এইরূপ কাঠুরিয়া রাজা ও সাধ্বী মহিলার কথা আমরা বহুবার শুনিয়াছি। মহাভারতোক্ত নল-দময়ন্তীর উপাখ্যানের সঙ্গে এই তিলকবসন্তের গল্পের কতকটা মিল দেখিতে পাওয়া যায়। নল শনির অভিসন্ধিতে সর্বস্ব হারাইলেন, তিলকবসন্ত ‘করম পুরুষে’র অভিশাপে তদ্রূপ বিপন্ন হইয়াছেন। নলের শরীর বিবর্ণ হইল, এদিকে রাণীও কুণ্ঠগ্রস্ত হইলেন। কিন্তু আমার মনে হয় শ্রীবৎস-চিন্তার কাহিনীটি এই ধরনের গল্পের আদর্শ। রাণীকে জাহাজে ধরিয়া লইয়া যাওয়া, রাজার কাঠুরিয়া সাজা—এ সমস্তই শ্রীবৎস-চিন্তার গল্পে যেরূপ পাইয়াছি, তিলকবসন্তেও তাহাই। এজন্যই এ কথা বলা যায় যে গল্পটি বাঙ্গালা পল্লীর নিজস্ব, অথচ ইহা কর্ম্মপুরুষের আবির্ভাব দ্বারা কতকটা ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবান্বিত হইয়াছে। খাস দেশী গল্পে যদি-বা কোন অলৌকিক কিছু থাকে তাহা কোন সিদ্ধ পুরুষের কাণ্ড। কিন্তু এই কর্ম্মপুরুষটি হিন্দুর দেবতার মত। ইঁহার কৃপায় ফকির রাজা হইতেছেন এবং ভ্রূকুটিতে রাজা পুনরায় ফকিরের ঝুলি গ্রহণ করিতেছেন। ইনি ভক্তের নিকট অসম্ভব ও উৎকট রকমের দান চাহিয়া তাহার ভক্তির পরীক্ষা করিতেছেন। রাজা তিলকবসন্ত নিজের দুইটি চক্ষু কাটারি দিয়া কাটিয়া কর্ম্মপুরুষকে উপহার দেওয়ার পর তবে রাজা তাহার প্রসন্নতা লাভ করিয়াছিলেন। পৃথিবীর যাবতীয় সুখসম্পদ্—তাহা ব্রাহ্মণের বরে লাভ হয় এবং যত কিছু দুঃখ, বিপদ্-গ্লানি—তাহা ব্রাহ্মণের অভিশাপের ফল; সংস্কৃত-প্রভাবান্বিত বাঙ্গালী কবিরা এই শিক্ষাই জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করিয়াছিলেন। ইঁহারা শিখাইয়াছিলেন, চন্দ্রের কলঙ্ক, সমুদ্রের জলের লবণত্ব, বিষ্ণুবক্ষে পদাঘাতের চিহ্ন, কৌরব ও যদুবংশ-ধ্বংস এ সমস্তই ব্রাহ্মণের অভিশাপের ফল। কর্ম্মপুরুষের প্রভাব ইহাদের অপেক্ষা কোনও অংশে কম নহে। ব্রাহ্মণ আসিলে তাঁহাকে পাদ্যঅৰ্ঘ্য দিয়া পূজা করিতে হয়, ব্রাহ্মণ্যসাহিত্যের এই চিরন্তন রীতি আমরা এই পালাটিতেও দেখিতেছি। পল্লীগানে সচরাচর এই ভাবের ব্রাহ্মণ্য-ভক্তি বড় দেখা যায় না, যদিও বাঙ্গালী গৃহস্থমাত্রই এই ভাবের সঙ্গে এখন সম্পূর্ণ পরিচিত।

 যদিও ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবের চিহ্ন এই পালাতে অনেক স্থলে দৃষ্ট হয়, তথাপি পল্লীর সরলতা ও সৌন্দর্য্য ইহাতে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ষিত হইয়াছে। তিলকবসন্তের রাণী ঠিক পল্লী-নায়িকা নহেন। তিনি বিবাহিতা পত্নী। তাঁহার এবং তাঁহার সপত্নীর কষ্ট-সহিষ্ণুতা, ধৈর্য্য প্রভৃতি গুণ অসামান্য। ইহা সত্ত্বেও আমাদের বলা উচিত যে এই দুইটি মহিলা হিন্দুরই সতীর আদর্শ ইঁহাদের স্বামিভক্তি এবং পাতিব্রত্য সীতা, সাবিত্রীকে স্মরণ করাইয়া দেয়। পল্লী-নায়িকাদের স্বভাব-সুলভ লীলামাধুরী অপেক্ষা স্বামিভক্তির পরাকাষ্ঠা প্রদৰ্শন করাই কবির বেশী লক্ষ্য ছিল। আমরা এই দুই রাজ্ঞীর আদর্শ ব্রাহ্মণ্য-প্রভাবান্বিত স্বীকার করিয়াও এ কথা কখনই বলিব না যে চরিত্রের মাহাত্ম্য হিসাবে কবি তাঁহার কাব্যনায়িকাদিগকে কোন অংশে খাটো করিয়াছেন। ইহাতে সতীত্বের ব্যাখ্যা, স্বামিভক্তির উপদেশ এ সকলের কোন বালাই নাই। আছে শুধু সেই আদর্শটি, যাহা হিন্দু মহিলারা এখনও পর্য্যন্ত অনুসরণ করিয়া গৌরব বোধ করেন। সুতরাং যদিও খাস পল্পী-সাহিত্যের নায়িকার মত এই দুই মহিলা শুধু প্রেমের অনুপ্রাণনায় সমাজকে তুচ্ছ করিয়া ভিন্ন আদর্শের মহিমা প্রদৰ্শন করেন নাই, তথাপি অপরাপর পালার উৎকৃষ্ট নায়িকাদের পঙ্‌ক্তিতে আমরা ইঁহাদিগের আসন নির্দ্দেশ করিতে পারি।

 রাজার বনবাসের চিত্র বড়ই মনোজ্ঞ হইয়াছে। কাঠুরিয়াদিগের সরল ব্যবহার, ঐকান্তিক যত্ন এবং স্বাভাবিক শীলতা এত সুন্দর হইয়াছে যে আমাদের মনে হয়। সেই তরুলতার দেশের তরুলতার মতই ইহারা নৈসৰ্গিক শোভা প্রদৰ্শন করিতেছে। মানুষ বিপদে পড়িলে কতটা সহিষ্ণু হইতে পারে, পবনকুমারী তাহা দেখাইয়াছেন। পালাগানে সচরাচর আমরা নায়কদিগকে কতকটা হীনভাবাপন্ন দেখিতে পাই। নায়িকারাই অধিকাংশ স্থলে চরিত্র-গৌরবে আমাদিগকে মুগ্ধ করেন। কিন্তু নায়কগণের মধ্যে অনেকেই বিপদ্ বা প্রলোভনে পড়িলে তাঁহাদের আদর্শচ্যুত হইয়া আমাদের অবজ্ঞাভাজন হন। কিন্তু এই পালাটিতে যেমন তিলকবসন্ত, তেমনি তাঁহার দুই রাজ্ঞী। এই তিনটি চরিত্রই অতি মহৎ। অবশ্য তিলকবসন্ত দুইটি দার পরিগ্রহ করিয়াছিলেন। পাশ্চাত্ত্য আদর্শে তিনি হয়ত-বা এজন্য একটু গৌরবহীন হইয়া থাকিবেন, কিন্তু পালাটি পড়িলে এই দুইবার দার-পরিগ্রহের জন্য কোন স্থানে আমাদের বেদনা বোধ বা দাগ থাকে না। তিলকবসন্ত সর্ব্বত্রই উজ্জ্বল, সহিষ্ণু, প্রেমিক, একনিষ্ঠ এবং বীর। তাঁহার দানের অবধি নাই, ধৈর্য্যের সীমা নাই, আনন্দের ত্রুটি নাই। যখন তিনি চক্ষু দুইটি উপ্‌ড়াইয়া ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের হস্তে দিলেন, তখন রাণী কাঁদিতে কাঁদিতে নিজের বস্ত্রাঞ্চলে তাঁহার চক্ষু মুছাইতে গিয়া সত্যই বলিয়াছিলেন-“তোমার মত লোক জগতে জন্মে নাই, তুমি নির্বিবকারভাবে এখনও ভগবান্‌কে আশ্রয় করিয়া আছ।” পালার শেষে যখন দুইটি সপত্নী জানু পাতিয়া বসিয়া রাজাকে প্রণাম করিয়া নূতন গৃহস্থালীর পত্তন করিলেন, তখন কবি সত্যই বলিয়াছেন—এ যেন সোণার হারে মাণিক বসান হইল।—“দুই চান্দে রাজপুরী উজ্জ্বলা হইল।” এই সপত্নীর সহযোগ এখানকার রুচিতে যদি গ্লানিকর মনে হয়, তবে সেই সুরুচিবিশিষ্ট পাঠকেরা আমাদের দেশের প্রাচীন আদর্শ ঠিক বুঝিতে পরিবেন না। প্রাচীন রুচিবাদী দুৰ্গাচন্দ্র সান্যাল মহাশয় অপর দিক্ হইতে চীৎকার করিয়া বলিতেছেন—“এক স্ত্রীকে ভালবাসিলে যে অন্য কাহাকেও ভালবাসা যায় না। ইহা নিতান্ত অযৌক্তিক বিলাতী মত মাত্র।” (বাঙ্গালার সামাজিক ইতিহাস-১২ পৃষ্ঠা।) আমাদের দুটি হাতে কোন্ দিকে তালি দিব, তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।

 পালাগানের ভাব ও ভাষা দেখিয়া মনে হয় ইহা পঞ্চদশ শতাব্দীর রচনা, যেহেতু ষোড়শ শতাব্দীতে কাশীদাস, শ্রীবৎস ও চিন্তার প্রাচীন উপাখ্যানটি স্বীয় মহাভারতে সন্নিবিষ্ট করিয়াছিলেন। অবশ্য এই ভাবের রূপকথা সে সময়েরও পূর্বে প্রচলিত ছিল।

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন

রাজা তিলক বসন্ত

রাজা তিলক বসন্ত

(১)

ওরে ও দূরের নদী উজান বইয়া যা।
উজান বইয়া যারে নদী ভাট্যাল বইয়া যা॥
সেইনা নদীর পাড়ে আছিল রাজা ভারী মহাজন।
তিলক বসন্ত নাম রূপে গুণে অনুপম॥
তার কথা শুন দিয়া মনরে
ওরে নদী উজান বাহিয়া যা।

সভা কইরা বইছ যত হিন্দু মুসলমান।
তোমাদের চরণে আমার পন্নাম॥
ওস্তাদ বন্দুম গুরু বন্দুম বন্দুম মাও বাপরে।
ছত্তিশা রাগিণী বন্দুম আর ছয় রাগেরে॥
সরস্বতী মায়েরে বন্দুম তাল যন্ত্র হাতেরে!
যার কিরপায় গাহান করি সভাস্থলেরে॥
গাহি কি না গাহি গান তাল বোধ নাই।
ওস্তাদের কিরপায় গান কিছু কিছু গাই॥
আইস মাগো সরস্বতী লাম্যা দেউখাইন বর।

* * * *

তুমি যদি ছাড় মাগো না ছাড়িব আমি।
বাজুন্ত নূপুরা হইয়া বেড়ব চরণ খানি॥
তুমি হইবা বিরখ মাগো আমি হইয়ম্ পাতা।
বেইড়া থাকব যোগল চরণ আর যাইবা কোথা॥

* * * *

জল থল বিরখ আমার কথা শুনরে।
রাজার বাড়ীর কথা শুনরে—
রাজার বাড়ীর হাতি ঘোড়া লেখা নাই সে জোখারে॥
দুয়ারে দুয়ারে পাড়া,[১] রাজমন্দির চুড়া।
চান্দ সুরুজে ছুইয়া হাসেরে॥
এহি ধন এহি দৌলত কোন্ জনে দিল।
করম পুরুষ দিলাইন বর রাজা হইল ধনেশ্বর॥
অহঙ্কার হইল মনে বড় রে।
বৃদ্ধ বরাম্মনের বেশে গোঁসাঞ আইস্যা ছলনা করিল রে॥
রাত্তির না দুপরিয়া কালে—অতিথি ডাকিয়া বলে
খিদায় তিষ্টায় প্রাণ জ্বলে রে
অন্ন দেরে নগরবাসী অন্নের কাঙ্গালে।
হেনকালে নাগরিয়া লোক ঘুমে অচেতন।
ডাকিলে না শুনে কথা অতিথি পাইল বেথা
বিমুখ হইল ততক্ষণ॥
রাজার ভাণ্ডারী যত ডাক শুনিয়া না শুনে।
রাজারাণীর কপাল দেখ পুড়িল আগুনে॥ (১—৩৬)

 রাজা কিন্তু কিছুই জানে না—না জানে কিছু রাণী। জোড় যোগলা-মন্দির মাঝে তারা শুইয়া নিদ্রা যায়। রাত্রি গেছে আড়াই পর আর আছে দেড় পর। করমপুরুষ রাজারে স্বপন দেখায়।

(২)

সুখনিদ্রায় আছরে রাজা জোড় মন্দির ঘরে।
অতিথি বৈমুখ হৈল আজি তোর রাজপুরে॥

না থাকিব খাটপালং জোেড় মন্দির ঘর।
রাজ্যবাসে যতেক লোক আপন হবে পর॥
হাতি ঘোড়া লোক লস্কর রাজা পাত্রমিত্র জন।
বিপাকে ফেলিয়া তোরে দিব বিড়ম্বন॥
সোণার মন্দির চূড়া ভাঙ্গিয়া না হইবে গুড়া
অঙ্কার যাইব রসাতলে রে।
সুখনিদ্রায় আছ তুমি রাজারে।
ভাণ্ডার হবে লক্ষ্মীশূন্য ওহে রাজা লক্ষ্মী যাইব ছাড়ি।
কাল বিয়ানে হইবা রাজা পন্থের ভিখারী॥
যারা তোরে আপনা বলে তারা হইব পরা।
ভাণ্ডার লুটিয়া লইব পন্থের সম্বল কড়া॥
না থাকিব পন্থের সম্বল কড়ারে।
সুখ নিদ্রায় আছ তুমি রাজারে॥

ধছমচাইয়া[২] উঠে রাজা চউখ মেলিয়া চায়।
কোন জনে ডাকিয়া কইলো কথা দেখিতে না পায়॥
সোণার মন্দিরে জ্বলে বাতি সোণালী পশরা।
ধীরে ধীরে সেই দীপ নিব্যা অন্ধকারা॥

“জাগো জাগো ওগো রাণী চক্ষু মেলি চাও।
সর্ব্বনাশ অইলো রাণী না দেখি উপায়॥
কি কালনিদ্রায় খাইলো রাণী তোরে আর আমারে।
পুরীতে আগুন লাগিল কে নিবাইতে পারে॥
অতিথি ফিরিয়া গেল বৈমুখ হইয়া।
ধনদৌলত গেল ত রাণী সায়রে ভাসিয়া॥

বর যে দিলাইন করমপুরুষ ধনে পুত্রে বড়।
যার প্রসাদে পাই লোক লস্কর॥
একদিন অতিথি যদি বৈমুখ হইয়া যায়
রাজ্যধন সকল মোর যাইব বেথায়[৩]
পরতিজ্ঞা করিলাম ভালা ঠাকুরের কাছে।
না জানি অদিষ্টে আমার কত দুঃখ আছে॥
ভাণ্ডার হইব লক্ষ্মীছাড়া সগল যাইব ছাড়ি।
কাল বিয়ানে হইবাম আমি পন্থের ভিখারী॥

ধন জন সব হইব নিয়রের পানি।
স্বপনে পাইলাম যেমন সোণার না খনি॥
স্বপনে পাইয়া ধন রাণী স্বপনে হারাই।
নিশি থাকিতে চল রাণী রাজ্য ছাড়িয়া যাই॥
তেঠেঙ্গা ঠাকুর[৪] আমার চক্ষে আছে লাগি।
কম্মদোষে অইলাম রাণী পণভঙ্গের ভাগী॥
আমি ত যাইবাম রাণী তোমার কি উপায়।
রাজ্যের না পউখ পাখালী কান্দব তোমার দায়॥
তুমিত রাজার ঝি দুঃখ না সইব পরাণে।
বনের কণ্টক কাঁটা বিন্ধিবাই চরণে॥
দারুণা রইদেতে সোণার দেহ হইব অঙ্গার।
তিষ্টায় না মিলব পানি ক্ষুধায় আহার॥
বনে ত শুইয়া রাণী নিদ্‌ কি আসিব।
কান্দিয়া মরিলে রাণী কেউ না জিগুইব[৫]
আইজ যে দেখছ সংসার ভরা দাসদাসীগণে।
আনিছে ফরমাসীর দব্ব তোমার কারণে॥

বনে গিয়া দেখবা চাহিয়া কেউত কাছে নাই।
সেজয়ালীর[৬] বাত্তি না দিতে কড়ার তৈল না পাই॥”
রাজা কাইন্দা জারে জার না দেখি উপায়।
বাপের বাড়ী যাও রাণী বলিয়া বুঝায়॥

রাণী— “তুমি না ধার্ম্মিক রাজা সব্বলোকে কয়।
নিজ নারী সঙ্গে লইতে কেন কর ভয়॥
তুমি হইলা কায়া পরভু আমি গায়ের মলা।
তোমার চরণায় পরভু আমি পন্থের ধূলা॥
তুমি ত সায়র পরভু আমি কাঞ্জিল মীনরে।
দণ্ডেক ছাড়িলে মোর না রইব পরাণরে॥
হিয়ার পরশমণি গো পরভু দুই নয়ানের তারা।
তিলদণ্ড না থাকিব তোমায় হইয়া ছাড়া॥
আমি থাকবা বাপের বাড়ী তুমি থাকবা বনে।
পতি যদি নারীরে ছাড়ে কি করব তার ধনে॥
বাপের মায়ের সোহাগেতে আমার কাজ নাই।
কিরপা কইরা লহ সঙ্গে বনে চইলা যাই॥
জোড় মন্দির ঘর সোণার পালং খাট।
নারীর নাই সে দেয় শুন ভাইয়ের রাজ্য পাট॥
বনের মন্দিরে গো রাজা আঞ্চল বিছাইব।
মাটির পালঙ্কে শুইয়া সুখে নিদ্রা যাইব॥
বিরকতলা[৭] বাড়ী ঘর পাতায় বান্ধিও।
সেই ঘরে অভাগী সূলায় পদে স্থান দিও॥
বাপের বাড়ী ক্ষীর ননী এসবে না চাই।
বনে আছে বনের ফল তাতে সুখ পাই॥

দুই জনে মিলিয়া বনের ফল টুকাইয়া[৮] আনিব।
বনের মন্দিরে আমরা সুখে গোঁয়াইব॥
বনের যত পশুরে পঙ্খী তারা সদয় হবে।
আপনা বলিয়া তারা শুধাইয়া লবে॥
রাত্রি বুঝি বেশী নাই রাজা বনে ডাকে কুইলা।
রাজ্য ছাড়িয়া যাইবা যুদি যাব এই বেলা॥” (১—৮০)

(৩)

কথার ভাবে— 
বনে থাকে কাঠুরিয়া।
বুকভরা দয়া মায়া॥
গাছ কাটে বিরক্ষ কাটে।
বিকায় নিয়া দূরের হাটে॥
শাল চন্দন তাল তমাল আর যত।
বিরক্ষের নাম কহিবাম কত॥
ছয় মাস থাকে বনে।
ছয় মাস থাকে ধনে॥
কাট বিকাইয়া খায়।
এক রাজার মুল্লুক হইতে আর রাজার মুল্লুকে যায়॥

যত সব কাঠুরাণী।
তারা সব বনের রাণী॥
পিন্ধন পছারা ছান্দে।
মাথার বেণী উঁচু কইরা বান্ধে॥

বনের ফল খায়।
পাতার কুটে[৯] শুইয়া নিদ্রা যায়॥

মুখভরা হাসি চান্দের ধারা।
না জানে ছল—না জানে চাতুরী তারা॥
বনের গমন বনের পথে।
বাঘ ভালুক ফিরে সাথে সাথে॥
মুখভরা হাসি চান্দের ধারা।
না জানে ছল—না জানে চাতুরী তারা॥
পন্থে পাই টুকায়[১০] ফল—টুকায় ময়ূরের পাখা।
ধার্ম্মিক রাজারাণীর সঙ্গে হইল পন্থে দেখা॥

কে গো সোণার মানুষ তোমরা গহিন বনে।
রাজ্যপাট সোণার পাট বনে আইলা কাটতে কাঠ
রাজ্যপাট ছাইড়া কেন ভেউর বনে॥
আথালের ঘাম পাথালে পড়ে।
বাঘ ভালুকে বনে বসতি করে॥
দানা আছে দক্ষি আছে।
এই বনে কি আইতে আছে॥

সঙ্গে নারী।
লক্ষ্মী যায় না ছাড়ি॥
অত দুঃখে বাঁচে।
তও লগে লগে আছে॥
রূপে গুণে ধন্যা।
ওগো তুমি কোন রাজার কন্যা॥

এ দেহে কি দুঃখ সয়।
বনে আসা তোমার উচিত নয়॥

এমন দীঘল কেশ পিন্ধন পাটের শাড়ী।
তুমি কোন্ রাজার মাইয়া— তুমি কোন্ রাজার নারী॥
রূপে বন মন পসরা।
সঙ্গে তোমার কে? একি তোমার পতি।
পতি থাকিতে তোমার এতেক দুগ্‌গতি॥
কোন দেবতায় কৈলা পৈরাস[১১]
যে করিল এমুন সর্ব্বনাশ॥
নিষ্ঠুর নিদয় ধাতাকাতা।
বজ্জরে ভাঙ্গিল মাথা॥
টুটাইয়া হাসি।
রাজপাট কাইড়া লইয়া করলো বনবাসী॥

গানে— 
এই কথা শুনিয়া অঝ্‌ঝুরে রাণীর ঝরে দু’নয়ন।
কাঠুরিণী সবে কহে জন্মেয় বিবরণ॥
তোমরা ত বনের মাইয়া কইয়া বুঝাই আমি।
একদিন ছিলাম ভালা রাজ্যপাটের রাণী॥
লোক লস্কর ছিল যতেক ছিল দাসদাসী।
কপালে আছিল দুখ্‌খু হইলাম বনবাসী॥
আমার দুঃখ নাই।
কাটিয়া ফেলিলে অঙ্গে বেথা নাইসে পাই॥

এক দুঃখ বড়।
যাঁর ছিল দাসদাসী শতেক নফর॥
রাজ-সিংহাসন ছিল সংসারের রাজা।
দৈব বিরোধী হইয়া তারে দিল সাজা॥
(হায় হায়) হাঁটিয়া অভ্যাস নাই পায়ে ফুটে কাঁটা।
সুদিনে উজান দরিয়া আজ ধরিয়াছে ভাটা॥
খাট পালং নাই পাতার বিছানা।
সোণার মন্দির থুইয়া বিরক্ষতলা থানা॥
ভাণ্ডার ভরা রতন মাণিক না ছিল গুণাতি[১২]
ভাণ্ডারে জ্বলিত যার রতনের বাতি॥
কাণাকড়া সঙ্গে নাই কি হবে উপায়।
তিনদিনের উপাসী রাজা কান্দিয়া বেড়ায়॥
সোণার না রাজছত্র উড়ত যার শিরে।
গাছের পাতায় তার মাথা নাহি ঘুরে॥
অঙ্গেতে বসন নাই পরিধানে টেটী।[১৩]
ভাবিয়া সোণার অঙ্গ হইছেরে মাটী॥

কথার ভাবে— 
আইঞ্চলে বাঁধা ফল।
দূর নদীতে জল॥
কেউ জল আনে কেউ করে হা হুতাশ।
গাছের ডাল ভাঙ্গিয়া কেউ শিরে করে বাতাস॥
মক্ষির চাক কচলাই মধু দিলা।
রাজারাণীর চক্ষের জল ঝরে।
এমন সোহাগ মায় না করে॥

যত সব কাঠুরি।
না জানে ছল—না জানে চাতুরী॥
তারা সান্ত্বনা করিয়া।
সঙ্গে গেল যে লইয়া॥

ডাইল কাটিয়া কুবে[১৪]
ঘর বান্ধিয়া দিল পূবে॥
পূব দুয়ারী ঘর মধ্যে মধ্যে পালা।
রাজাবাড়ীর পাঁচতালা॥
কেবা তারে পুছে।
কেবা তারে জিজ্ঞাসে॥
সাত পরতে শাল বিরক্ষের পাতার বিছানি।
সেই ঘরে আছুইন রাজা আর রাণী॥

রাণী টুকায়[১৫] ময়ুরের পাখা।
নিজ হাতে বানায় শীতল মন্দির পাখা॥
আগুন নিভে মায়ে।
বুড়ী কাঠুরাণী সইতর থাকে তারা মায়ে ঝিয়ে॥

সকালে উট্যা রাজা কি করে।
কুড়াল কাঁধে যায় বনান্তরে॥
ষত সব কাঠুরি কাঠ কাট্‌ত যায়।
রাজা পাছে পাছে যায়॥
বড় বড় বোঝা আলধা লতায় বান্ধে।
বন ছাইল চন্দনের গন্ধে॥
বনের রাতি বনে পোহায়।
এমনি করিয়া চল্লিশ রজনী যায়॥ (১—১০৫)

(8)

গানে— 
একদিন ধার্ম্মিক রাজা কোন্ কাম করিল।
রাজা  গেল দুরের হাট বিকাইল চন্দন কাঠ
ভরা কাউন যোগাড় করিল॥
রাণীর মনের সাধ শুন দিয়া মন।
কাঠুরিয়া সবে খাওয়ায় করিয়া রন্ধন॥
তবেত তিলক রাজা কোন্ কাম করিল।
কাঠুরিয়া যতক জনে নিমন্ত্রণ দিল॥
ছত্রিশ ব্যঞ্জন রাণী রান্ধয়ে যতনে।
কাঠ কাটিতে রাজা চলিলাইন বনে॥
পায়স পিষ্টক আদি করিয়া রসুই করিল।
পাতার ডুঙ্গায়[১৬] করিয়া যতনে রাখিল॥
চিকুনি চাউল ভাত গন্ধে আমোদিত।
সেই ভাত রাইন্ধা রাণী পাতায় ঢালিল॥

রান্ধিয়া বাড়িয়া ধর্ম্মের রাণী কোন্ কাম করিল।
দূরের নদীতে রাণী সিনানেতে গেল॥
সঙ্গেত চলিল যতক কাঠুরিয়া নারী।
হাসিয়া নাচিয়া চলে লইয়া কলসী॥

হেন সময় হইল কিবা শুন দিয়া মন।
দইরা[১৭] বাইয়া দেশ ত ফিরে সাধু মহাজন॥
চৌদ্দ ডিঙ্গা সাজাইয়াছে সাধু বাণিজ্যের ধনে।
ডিঙ্গায় নাহি ধরে ধন আনিল কেমুনে॥

পারে থাক্যা লড়িতে ভর বিদ্ধ বরাম্মন।
ডাক্যা কহে শুন সাধু আমি অভাজন॥
সাত দিনের উপবাসী অন্নের কাঙ্গালী।
এক টঙ্কা ধন দিয়া রাখহ পরাণী॥
এই কালে বাইরব পরাণ ভিক্ষা নাহি দেও।
নগরে বেড়াইয়া আইলাম না জিজ্ঞাসে কেও॥
মাঝি মাল্লাগণে হাসি নৌকা বাহিয়া যায়।
শুনিয়া না শুনে ত্বরিত ডিঙ্গা বায়॥
মুন্নি[১৮] দিয়া ভিক্ষাশূর বনেতে মিশাইল।
চরে ত ঠেকিয়া ডিঙ্গা বন্দী ত হইল॥

কান্দিতে লাগিল সাধু শিরেতে নিঘ্‌ঘাত।
বিনা মেঘেতে যেমুন বজ্জর হইল পাত॥
ডাক দিয়া কয় করম পুরুষ “সাধু না কান্দিও আর।
যেমুনি করিয়া পাপ শাস্তি পাইলা তার॥
বার বছর থাক হেথা খাও ডিঙ্গার ধন।
পুরীতে লাগিব তোমার বেহাতি আগুন॥”
গলুইয়ে আছড়াইয়া মাথা সাধু রোদন করে।
কপালী কাটিয়া রক্ত বহে শতধারে॥

তবেত করম পুরুষের দয়া যে হইল।
আসমানে থাকিয়া তবে ডাকিয়া কহিল॥
“শুন শুন সাধু আরে সাধু কহি যে তোমারে।
সতী কন্যা পাও যদি সঙ্গে লইও তারে॥
সতী কন্যা ডিঙ্গা যদি আঙ্গুলেতে ছোয়।
অবশ্য ভাসিব ডিঙ্গা অন্যথা না হয়॥

হেন কালে ত যতেক কাঠুরিয়া রমণী।
সিনান করিতে আইল সঙ্গে লইয়া রাণী॥
দেখিতে পুন্নিমার চান, হারে, চন্দ্র সমান মুখ।
ইহারে দেখিয়া ভাবে ডিঙ্গার যত লোক॥
কেউ কহে জোরে জোরে কেউ কাণাকাণি।
বনেতে এমুন কন্যা রূপের বাখানি॥
কোন্ রাজা বনবাসী করিল এহার।
মাঝি মাল্লা যত জনে দেখ্যা চমৎকার।

এহি কথা তবে সাধুর কাণে ত উঠিল।
গলায় বান্ধিয়া গামছা পায়ে ত পড়িল॥
“শুন শুন ধর্ম্মের মাও গো কহি যে তোমারে।
আমার বিপদ্ কথা জানাই যে তোমারে॥
রুষ্ট হইয়া বিধি মোরে দারুণা শাপ দিল।
তেকারণে চৌদ্দ না ডিঙ্গা চড়ায় ঠেকিল॥
সতী নারী হও যুদি ডিঙ্গায় দেও গো পা।
সকাল করিয়া মুক্ত কর আমার চৌদ্দ না॥
নইলে আমি নিজ মাথা পাষাণে ভাঙ্গিব
শুন শুন সতী মাও অল্পে না ছাড়িব॥”

জনম-দুঃখিনী কন্যা মনে দুঃখ পাইল।
সদাগরের ডিঙ্গা যত পরশ করিল॥
ভাসিয়া উঠিল ডিঙ্গা অলছ তলছ পানি।
আচানকা[১৯] কাণ্ড দেখে যত কাঠুরাণী॥
মাঝি মাল্লা কয় “সাধু কাণ্ড বিপরীত।
এহি কন্যায় সঙ্গে ত লও যদি চাহ হিত॥

দরিয়ার বিপদ্ কথা ভালা জান তুমি।
এহি কন্যা সঙ্গেতে লও সঙ্কটতারিণী॥
আরবার ঠেকে ডিঙ্গা কোথায় পাইবা।
বিধি মিলাইল নিধি কেন হারাইবা॥”
তবে ত কুবুদ্ধি সাধুরে কোন্ কাম করিল।
ধরিয়া বান্ধিয়া সাধু সঙ্গে ত লইল॥

“শুন শুন কাঠুরাণী মাও বহিন যত।
রাজারে কহিও কথা যতেক ঘটিল॥
দুরন্ত রাক্ষসা সাধু লইয়া যায় মোরে।
এহি কথা কহিও তোমার রাজার গোচরে॥
রান্ধা ভাত পইরা রইল পাতার কুটীরে।
কে খাওয়াইবে কে ধুয়াইবে পাগল রাজারে॥
রাজ্য যে গেছিল মোর দুঃখ নাইসে তায়।
এত দিনে রাজ্যহারা কি হবে উপায়॥
আমার রাজারে তোমরা বুঝাইয়া রাখিও।
ক্ষুধার অন্ন তিষ্টার জল তোমরা যোগাইও॥
সিন্থের সিন্দুর মোর খসিয়া না পড়ে।
এহি মাত্র ভিক্ষা মোর বিধির গোচরে॥
হায় পাতার বিছানা মোর পড়িয়া রহিল।
জন্নমের যত সুখ আইজ হইতে গেল॥
বাইয়া যায়রে চৌদ্দ ডিঙ্গা দূর বন্দরের পানে।
আর না দেখিবাম আমি তোমরারে নয়ানে॥
কাইল বিয়ানে জাগ্যা না দেখবাম সবার মুখ।
কাইল বিয়ানে জাগ্যা না দেখবান আমার পরাণ সুখ॥
অনেক কইরাছি দোষ সবার চরণে।
অভাগী জানিয়া দোষ ক্ষেমা দিও মনে॥”

রাণীর কাঁদনে দেখ দইরার বাড়ে পানি।
উজান পথ ভাইঙ্গা চলে চৌদ্দ ডিঙ্গা খানি॥
হেন কালেতে সুলা রাণী কোন্ কাম করিল।
করম ঠাকুরের কথা মনেত পড়িল॥
কাইন্দা কাইন্দা কয় ঠাকুর ধর্ম্ম গেল মোর।
পরপুরুষে অঙ্গ ছইল আমার॥
কুড়িকুষ্ট[২০] হউক অঙ্গ যাউক গলিয়া।
মনে রাখ ওহে বিধি এহি বর দিয়া॥
যদি আমি সতী হই পতি পদে মতি।
অবশ্য ফলিব বাক্য না হইব অন্যতি॥
যদি আমি সতী হই ধর্ম্মে থাকে মন।
তেইমত এ চৌদ্দ ডিঙ্গার হউক বিড়ম্বন॥”

অকাট্যা সতীর কথায় পরমাদ পড়িল।
আরবার চৌদ্দ ডিঙ্গা চড়াতে ঠেকিল॥
কুড়িকুষ্ঠি গল্যা পড়ে সোণার বরণ।
দেখিয়া পাইল ভয় যত মাঝি মাল্লাগণ॥
“এ কন্যা মুনুষ্যি নয় সাধু শুন মন দিয়া।
এই বনে ফালাইয়া চল দেশে ডিঙ্গা বাইয়া॥”
এতেক ভাবিয়া সবে কোন্ কাম করিল।
বনে ত এড়াইয়া কন্যা উজান চলিল॥ (১-১১৫)

(৫)

সন্ধ্যা বেলা আইল রাজা হাসিখুসি মন।
“সুলা সুলা” বলিয়া ডাকয়ে ঘন ঘন॥

“শুন গো বনের রাণী শুন মন দিয়া।
সুক্ষণে গেছিলাম রে বনে দেবের হইল দয়া॥
আজি যে পাইয়াছি কাষ্ঠ কি কহিব তোমারে।
সোণায় বিকাইব কাষ্ঠ দূরের নগরে॥
রন্ধনা বাড়ানা তোমার বিলম্ব বা কত।
সিনান করিতে যাই বাইড়া তোল ভাত॥
যতেক কাঠুরিয়ার পাইল বড় ক্ষিদা।
সিনান করিতে তারা নদীতে চলিল॥”
ঘন ঘন ডাকে রাজা উত্তর না পায়।
যতেক কাঠুরি কন্যায় তবে ত জিগায়॥
“শুন শুন কাঠুরাণী শুন মোর কথা।
রাঁধিয়া বাড়িয়া অন্ন রাণী গেল কোথা॥
সিনান করিতে রাণী গেল বুঝি ঘাটে।”
পাগল হইয়া রাজা ধাইয়া চলে ধাটে॥

যতেক ঘটন কথা কাঠুরাণী কয়।
নয়নের জলে দেখ নদী নালা বয়॥
কেউ বা ফুকুরি কান্দে কেউ বিলাপিয়া।
“তোমার রাণীরে লইল সাধু ত হরিয়া॥”
এই কথা ধর্ম্মিক রাজাগো যইখনে শুনিল।
কাত্যানির[২১] কলাগাছ ভূমিত পড়িল॥

“হায় হায় রাজ্যধন হারাইলাম আপন কর্ম্মদোষে।
তোমারে লইয়াছিলাম গো রাণী মনের সন্তোষে॥

(হায় রাণী) বনেত আছিলাম রাণী বনের ফল খাইয়া।
দুঃখ নাইসে ছিল মনে তোমারে লইয়া॥
সাত রাজার ধন মাণিক আমার কোন্ জনে হরিল।
নয়ানের মণি আমার কে কাড়িয়া নিল॥
এতদিনে বুঝিলাম বিধি বাদী হইল।
এতদিনে বুঝিলাম রাজ্যসুখ গেল॥
পাতার বিছানা ঘর পইরা আছে খালি।
বাড়াভাতে দারুণ বিধি দিলা মোরে ছালি॥
পাতার কুটীরে আমার কোন্ প্রয়োজন।
জলেত ঝাপাইয়া আমি ত্যজিবাম জীবন॥
যাহার সুখের লাগ্যা কাটতাম বনে কাট।
যে জনা আছিল আমার সুখের রাজ্যপাট॥
আর না থাকিব আমি এই গয়িন বনে।
বিদায় দেও কাঠুরিয়া যাইব অন্য স্থানে।”

এই কথা শুনিয়া বনে উঠে কান্দনের রোল।
কাঠুরিয়া যত কাইন্দা হইল উতরোল॥
মন্তনা করিল তারা রাত্রি পোষাইলে।
নানান দেশে যাইব তারা কন্যার তল্লাসে॥
তবেত পাগল রাজা পরবোধ না মানে
পাত্তার কুটীর জ্বালাইল বেড়ার আগুনে॥
রজনী পোষাইল যুদি কেউ না দেখে তারে।
হায় হায় পাগেলা রাজা গেল বা কোথাকারে॥ (১—৪৬)

(৬)

কথার ভাবে— 
আর এক রাজার দেশ আর এক মুল্লুক।
আসমান জমীন টলমল।
চান্দা সুরুজ ঝলমল॥

ভাণ্ডারে ধন আটে না।
রাজার গৌরব ভাঙ্গে না॥
হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া।
হাজার দুয়ারে কটুয়াল[২২] খাড়া॥
আবের ঘর আবের ছানি।
এই পুরে থাকুইন রাজা আর রাণী॥
সাত মহলা পুরী।
ভাত কাপড়ে দুঃখ নাই।
ধাই দাসীর সীমা নাই॥
রাজার এক কন্যা সাত পুত্র আঁধাইর ঘরের বাতি।
হাসিতে রতন ঝলে কান্দিতে মাণিক জ্বলে॥
এইমন সুন্দর কন্যা তিরভুবনে নাই।
মাথার কেশ ভূমিত পড়ে
সাজন পাড়ন তেল সিন্দূরে॥

আবিয়াত[২৩] কন্যা।
কত আইয়ে কত যায়।
রাজা না পছন্ত তায়॥
কত রাজপুত্র ফিরিয়া ফিরিয়া যায়।
একদিন হইল কি?
রাজকন্যা রাজার মন্দিরে গেল।
শীতল ভিঙ্গার মন্দিরে ছিল॥

মায় কইল ঝি আমার শীতল ভিঙ্গার আনিয়া দেও। আমি পানি পিইব 

ধাইরে না কইল।
দাসীরে না কইল॥

মায়ের কথা মাইন্যা কন্যা মন্দিরে সামাইল[২৪]
রাজার অঘুর নিঘুর[২৫] ঘুম।
আচম্বিতে চাহিয়া দেখে রাণী।
শীতল ভিঙ্গারে গিয়ে পানি॥
রাজা চিন্‌তে পারল না।
কাল কেশে বদন ঢাকা।
মেঘের মুখ চাকা মাখা॥
রাজা পৈরাস[২৬] করল॥
আৎকা দেখে রাজকন্যা বাহির হৈয়া যায়।

 এত নয় রাণী, কি সব্বনাশ কারে পৈরাস কর্‌লাম। আসমান ফাট্যা চৌচির। কোথায় লুকাই, কোথায় যাই, লাজে কাটে মাথা।

অত বড় কন্যা ঘরে।
বিয়া না দিলাম তারে॥
রাজা ভাবিয়া চিন্তিয়া পণ করিল।
সকালে উঠিয়া দেখবাম যারে।
কন্যা বিলাইবাম তারে॥
এতেক কথা কেউ জানে না।
সক্কাল বেলা বাগে ফুল ফুটে।
আসমানেতে সর্য্যু উঠে।

 হেন কালে হইলা বা কি। নয়া মালী কোন্ দেশে বাড়ী কোন্ বা দেশে ঘর। কেউ চেনে না তারে। রাজার বির্দ্ধ মালীর হইয়া কাম করে।

 কাঞ্চন পুরুষ, অঙ্গে নাই তার কোন দোষ। কেউ কয় মালী, কেউ কয় রাজকুমার। কেউ কয় দেববংশী। রাজার চোখে নাই ঘুম। পরভাতে উঠিরা দেখে মালীর মুখ।

রাজার দুই চোখ বইয়া পড়ে দরিয়ার পানি।
এত বাছ্যা নিছ্যা কন্যা হইল মালীর ঘরণী॥

 যা থাকে কূলে যা থাকে কপালে। কন্যা দিবাম এরে। বিধাতা লিখ্যাছে দুঃখ কে খণ্ডাবে। রাজার কন্যা পবন কুমারীর সঙ্গে মালীর হইল বিয়া।

রাজ্যের লোক করে হায় হায়।
এমন দুঃখের রজনী পোষায়॥
তারা কত খাইত কত পিন্‌ত[২৭]
কত আমোদ উল্লাস কর্‌ত॥

না বাজিল ঢোল, না বাজিল ডাগ্‌রা, রাজ্যে না জ্বালিল বাতি।
অভাগ্যা মালী হইল রাজ কন্যার পতি॥

 রাজা হুকুম দিল। মালীর বাড়ীতে এক ভাঙ্গা ঘরে রাজকন্যা আছে থাকে খায়। নিদ্রা যায় খেংরা চাটিতে শুইয়া। রাজকন্যার মনে কোন দুঃখ নাই সতী পতি লইয়া পরম সুখে আছে। রাজা হুকুম দিল, বার ভাণ্ডারের ধান চাউল গোলা ভইরা দেও। আমার কন্যা যেন দুঃখ না করে। আমার বড় সোহাগের ধন।

মাথায় থুইলে উকুনে খায়।
মাটিতে রাখলে পিঁপড়ায় খায়॥ (১—৫৩)

 কত যত্নে তারে পালন করছি। রাজার কান্দনে পাথর গলে। রাণীর কান্দনে দরিয়া ভাসে। এইমতে দিন যায়।

(৭)

গানে— 
“কোন্ সে নিঠুর বিধি আনিল নগরে।
চান্দের সমান রাজার কন্যা, দুঃখ দিলাম তোরে।
ওরে চান্দের সমান রাজার ছাওয়াল দুঃখ দিলাম তোরে॥
রাজ সোহাগে তুল্ল যারে লালিয়া পালিয়া।
তার কপালে ছিল হায়রে ঘিন্ন মালীর সাথে বিয়া॥
যে অঙ্গে ফুলের ঘাও বজ্জর সমান বাজে।
সেইত সোণার অঙ্গ লুটায় মাটির শেষে॥
কন্যালো তোর বাপের সোণার পুরী খাট পালং থুইয়া।
কন্যা খাট পালং থুইয়া।
খেংড়া চাটির বিছানা মাটিতে সাতিয়া॥

হায় হায় দুঃখ কহিব কাহারে।
এমুন দুঃখের কপাল বিধি দিল তোরে॥
তোমার বাপের বাড়ী কন্যা ঝিলমিল মশারি।
ননীর দেহাতে তোমার মশার কামুড়ি॥
অঙ্গে নাই হারামণি দুঃখে যায় দিন।
উপাসে কাপাসে মুখ হইয়াছে মলিন॥”

* * * *

“শুন শুন ওহে পতি দুঃখ নাইসে কর।
বিধাতা দিয়াছে দুঃখ সুখ ভোঞ্জন[২৮] কর॥
আমার লাগিয়া পতি নাই সে কর দুঃখ।
তুমি যার আছ পতি তার সব সুখ॥

দুই হস্ত তোমার পতি আমার গলার সাতনালা[২৯]
তোমার সোহাগের ডাক আমার কণ্ণদোলা[৩০]
তোমার পায়ের ধূলা অঙ্গ আভরণ।
তুমি আমার হিরা মণি তুমি সে কাঞ্চন॥
নয়নের জলেরে পতি তোমার পা ধুয়াই।
সেই পা মুছাইয়া কেশে বড় তিপ্তি পাই॥
সেইত না ধুয়ার পানি কেশে সাঁচি তেল।
মা বাপের পুরীর সুখ বড় হইতেই গেল॥
তোমার চরণ পতি আমার উত্তম বিছান।
ধরম করম তুমি জাত্তি কুল যে মান॥”

এহি মত করিয়া সতী কন্যা পতিরে বুঝায়।
বার ভাণ্ডারের ধন কাঙ্গালে বিলায়॥
রাজ্যের যতেক কাঙ্গালিয়া না যায় রাজার বাড়ী।
ভিক্ষা লইতে আস্যে তারা মালী রাজার বাড়ী॥ (১—৩৪)

(৮)

 কথার ভাবে—

 রাজার সাত পুত্র রিশাইয়া[৩১] সার। কি? আমার বাপের মালী। সে হইল ‘মালী রাজা’। তার বাড়ীত যত কাঙ্গাল গরীবের থানা। তার জয় জয়কার। বুড়া বাপ না থাকলে কোট্টালে কাটত মাথা। শুন শুন ভাণ্ডারী মালীরে কাণাকড়ি দিও না।

ভাণ্ডারে কপাটে তিন তালা।
দেখবাম কেমনে বাঁচে শালা॥
আমার ঘোড়া আমার হাতী।
আমার ভাণ্ডারের ধন লইয়া করে চিকনাতি[৩২]

 সাত রাজপুত্রের হুকুমে দুয়ারে তালা পড়ল।

রাজ্যের দুঃখী কাঙাল সব ভিখ পায়।
কাণাকড়ির হুকুম নাই কেবল রাজা মালীর দায়॥
মায়ে শুন্‌ল কি?
বড় দুঃখে পইড়াছে দরদের ঝি॥

 তখন দাসীরে কইল। “ধাই দাসী বলি তরারে। ক্ষুদকণা যা থাকে দেও আমা ঝিএরে।” পুকাইয়া[৩৩] শুকাইয়া তারা দেয় ক্ষুদকণা। এক কাণা ভরে পেটের আর এক থাকে উন্না। রাজকন্যার দুঃখ নাই। মুখে তার হাসি।

 সুখেরে বিদায় করিয়া দুঃখ কর্‌ছে সাথী। কাঙ্গাল গরীব যারা তারা অত জানে না। পিত্যহের মত তারা মালীরাজার দুয়ারে খাড়া।

 গানে-

তখনও ত সতী কন্যা কোন্ কাম করে।
অঙ্গের যত গয়নাগাটি বিলায় সবাকারে॥
কাণের না কণ্ণদোলা গলার না হার।
একে একে দিল কন্যা ভিক্ষুক বিদায়॥

হেন কালেতে দেখে দৈবের লিখনি।
ভিক্ষা লইতে আইল এক ভিক্ষাশূর বামুন

অন্ধসন্ধ্যা বামুন বুড়া লড়িত ভর করি।
ডাকিতে লাগিল মাও ভিক্ষা দেও মোরে॥
কিবা ভিক্ষা দিব কন্যা ভাবে মনে মন।
ফুরাইয়া হইয়াছে খালি বার ভাণ্ডারের ধন॥
ক্ষুদকণা নাই সে দেখ সকল বিলানিতে গেছে।
অঙ্গের বসন মাত্র বাকী তার আছে॥
আধেক কাটিয়া দিব ভাবে মনে মন।
এন কালে ডাক দিয়া কহিছে বাম্মন।

“রাজলক্ষী মাও মোর শুন দিয়া মন।
বারবচ্ছর করলাম আমি কত না ভরমন॥
কত রাজার মুল্লুক চাইয়া মাগো কত দেশে যাই।
আমার মনের ভিক্ষা কোথাও না পাই॥
কেউ দেয় ধন রত্ন কেউ দেয় কড়ি।
কেউ বা খেদায় দূরে গাল মন্দ পাড়ি॥
অঙ্কের যতেক দুঃখ না যায় কহন।
নগর ভরমনা করি ভিক্ষার কারণ॥”

কন্যা বলে “বামুন ঠাকুর কিবা ভিক্ষা চাও।
আগে ত আসন কর ধইয়া তুমি পাও॥”
বরম্মন বলে “মাও ইতে কার্য্য নাই।
ভিক্ষা পাইলে আমি দেশে চল্যা যাই॥
ভিক্ষা লইতে গেছলাম আমি ঐনা রাজার বাড়ী।
দেখাইয়া দিল তারা মালী রাজার বাড়ী॥
রাজার বাড়ীতে আমার ভিক্ষা না মিলিল।
তোমার না বাড়ী খানি তারা সুধাইয়া দিল॥”

কন্যা কহে “কিবা ভিক্ষা কহতো বামন।”
ভিক্ষাশূর কহে “মোরে দেহ ত নয়ন”॥

এত আচানকা কথা কন্যার ভয় হইল মনে।
এ ভিক্ষা কেমুনে দিব ভাবে মনে মনে॥
আজি হতে বিধি বুঝি এ সুখেও বৈরী।
কোন দেবতা আইল বুঝি ছলিতে এ পুরী॥
“ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা কয় বরাম্মনে।
“দয়া করিয়া বইস ঠাকুর এইত আসনে॥
পতি মোর নাই ঘরে আসুক এখন।
যে ভিক্ষা চাইবা তুমি পাইবা তখন॥”
ভিক্ষুক ফিরিয়া গেলে ধম্ম নষ্ট হবে।
উপায় ভাবিয়া কন্যা না পাইল তবে॥

হেন কালে মালী রাজা ঝাড়ু কাঁধে লইয়া।
আপন পুরীতে দেখ দাখীল অইল আসিয়া॥
কন্যা কহে “শুন গো পতি বিপদ্ হইল ভারী।
আচানকা ভিক্ষাশূর আইল তোমার বাড়ী॥
কড়িতঙ্কা নাহি চায় কিম্বা অন্য ধন।
ভিক্ষাশূর দান চায় অন্ধের নয়ন॥
কোন্ দেবতা পুণ ছলিতে আইল।
এত সুখের দিন বুঝি ঘনাইয়া আসিল॥” (১—৫৮)

(৯)

শুনিয়া এতেক কথা চিন্তিত হইল মালী রাজা
ভাবে মনে মন।
উপায় চিন্তন করি কোন্ দেবত! আইল পুরী
নিচ্চয় বা দেবের ছলন॥
এতেক ভাবিয়া মনে মালী গেল তার স্থানে
জিজ্ঞাস করে কথা।

বিদ্ধ বরাম্মন কয় “শুন শুন মহাশয়
শুন্যাছি তুমি না দাতা।
বড় দুঃখ পাইয়া আমি আইলাম তোমার নাম শুনি
শুন শুন আমার দুঃখের কথা॥
বারবচ্ছর বার না দিন গত হইয়া যায়।
অন্ধের রজনী তেও ত না পোহায়॥
বড় দুঃখ পাইয়া আমি আইলাম তোমার ঠাঁই।
তোমার কিরপায় যদি চক্ষুদান পাই॥”

এই কথা শুনিয়া মালী চিন্তিত হইল।
তিনবার কামপুরুষ স্মরণ করিল॥
মালী রাজা কয় “শুন কহি যে তোমারে।
মানুষে নয়ন প্রাণী নাই সে দিতে পারে॥
যদ্যপি পাইবা ঠাকুর দেবের থাকে দয়া।”
কাটারি লইয়া চক্ষু উপারি তুলিল।
ভিক্ষাশূর বাম্মনের হাতে তুল্যা দিল॥
ভিক্ষা পাইয়া ভিক্ষাশূর হইল বিদায়।
বড় দুঃখে রাজকন্যা করে হায় হায়॥

(হায় ভালা) শীতল ভিঙ্গারের জলে রক্তধারা মুছে।
এত্ত দুঃখু অভাগীর কপালেতে আছে॥
মালী রাজা কয় “কন্যা হাসি মুখে রও।
করম পুরুষ দিলাইন দুঃখ হাসিমুখে সও॥
দান কইরা যেবা পাইলা অন্তরেতে সুখ।
তার দান বিফলা হইল বিধাতা বিমুখ॥”

কন্যা কহে “পতি তোমার ঠাকুর নিদারুণা।
এত দুঃখ দিল তুমি ভরিছ আপনা॥”

মালী রাজা কয় “কন্যা না কর কান্দন।
সুখ যদি চাও কর দুঃখেরে ভজন॥
ফলের উপুর টুঙ্গা খোসা যেমুন ভারী।
সুখের ঘরে সামাইতে দারুণ দুঃখ সে পহরী॥
সুখ যদি পাইতে চাও দুঃখ আপন কর।
ভজনার[৩৪] পন্থে চল তবে পাইবা বর॥”

পতির বদলে কন্যা কোন্ কাম করে।
নিতি নিতি ঝাড়ু দেয় রাজার আন্দরে॥
সাত ভাইয়ের সাত বউ এরে দেখ্যা হাসে।
বার দুঃখ পাইলা কন্যা বার ত না মাসে॥
এক দুঃখ পাইল কন্যা হিয়ায় বিদ্ধে ছেল।
পাইরণের কাপড় নাই শিরে নাই সে তেল॥
এক হাতে তুল্যা কন্যা লইছে হাছুনি।
আর হাতে মুছে কন্যা দুই নয়ানের পানি॥

ধাই দিল ক্ষুদ কণা আইঞ্চল বাইন্ধা লয়।
এরে খাইয়া অতি দুঃখে দিন গত হয়॥
সাত ভাইয়ের বধূর ডরে খায় না কয় কথা।
অন্তরে রহিল দারুণ ছত্তি[৩৫] ছেলের ব্যথা॥
হায় গো আদুরের ঝি ছিরা[৩৬] টামনি[৩৭] গায়।
এরে দেখ্যা পাগল রাণী করে হায় হায়॥
ভাণ্ডারেতে আছে ধন সাত ভাইয়ের ডরে।
কাণা কড়ি ধন মায় না দেয় ঝিয়ারে॥

মায়ের কান্দনে দেখ বিরখের পাতা ঝরে।
মায় সে জানে ঝিএর বেদন আর কে জানতে পারে॥

 কথার ভাবে—

 এই মত তারা আছে থাকে খায়। নিত্য নিত্য রোজ রাজ-কন্যা ঝাড়ু দিত যায়। রম রমা, যম যমা[৩৮] পুরী। কুকুর বিলাইও সুখে আছে। সুখ নাই কেবল অভাগী রাজার মাইয়ার। একদিন হইল কি। রাজবাড়ী শীকারের বাদ্য বাজ্যা উঠ্‌ল। ঢোল ডগরা কড়া নকাড়া। হৈ হৈ রৈ রৈ। “কন্যা, একি শব্দ। কিসের বাজনা।” “আমার সাতভাই শীকারে যায়। শীকারের বাদ্য বাজে। অন্ধরাজা ভাবে মনে মনে। অনেকদিন না যাইলাম শীকারে। “কন্যা, আমি শীকারে যাইব। তুমি তোমার বাপের কাছে যাও। একটা ধুন[৩৯] আর একটা শব্দবাদী[৪০] বাণ লইয়া আস।”

 গানে—

কন্যা কহে “শুন পতি আমার মাথা খাও।
বাঘ ভালুক বনে শীকারে না যাও॥
একে অন্ধ বনের পথ তা হইতে দুর্গম।
বনপন্থে গেলে হবে অতি দুর্ঘটন॥
তুমি ছাড়া পতি ওগো আমার কেহ নাই।
বিধির বিপাকে ত্যজিল বাপ ভাই॥
সুতের সেওলা যেমন সুতে করে ভর।
তোমারে হারাই পাছে তেই সে মোর ডর॥
সুখ ছাড়িয়া করবাম গো পতি দুঃখের ভরসা।
সে দুঃখ ছাড়িয়া গেলে কেবল নিরাশা॥

না ভাঙ্গিলে শূন্য ভাণ্ড শতগুণ ভালা।
তোমারে ছাড়িয়া ঘরে না রইব একেলা॥
আমারে এড়িয়া যদি নিঠুর হইয়া যাও।
লোহার কাটারি ঘরে গলে দিয়া যাও॥”

এইমত রাজকন্যা কান্দিতে লাগিল।
বুঝাইয়া অন্ধ মালী কহিতে লাগিল॥
“হরিণের মাংসু কন্যা অনেকদিন না খাই।
হরিণ শীকারে যাব মানা কর নাই॥”
কন্যা বুলে “শুন পতি শুন দিয়া মন।
সাতভাই মারিয়া যত আনিব হরিণ॥
মাগিয়া চাহিয়া মাংস আনিয়া দিবাম তোমারে।
তবুত পরাণ পতি না যাও বনান্তরে॥”
বুঝাইলে পরবোধ নাহি মানে অন্ধ রায়।
ভাবিয়া চিন্তিয়া কন্যা বাপের আগে যায়।

“শুন শুন বাপ আগো কহি যে তোমারে।
অন্ধ না জামাই তোমার যাইব শীকারে॥
অন্ধ জামাই তোমার কইয়া দিল মোরে।
শব্দবাদী বাণ আর ধনু দেও তাহারে॥”

কন্যারে দেখিয়া রাজা কান্দিতে লাগিল।
এত সোহাগের ঝি গো এতো দুঃখ ছিল॥

রাজা দিলাইন শব্দভেদী ধনু আর ছিলা।
এরে লইয়া অন্ধ রাজা পন্থ বাহিরিলা॥
আগে আগে চলে বাদ্য মহা রোল করি।
বাদ্য শুন্যা চলে রাজা জঙ্গলার মাঝে॥
হাতড়াইয়া বিতড়াইয়া রাজা ক্ষণে উঠে পড়ে।
কতদিনে দাখিল হইল ঘুঙ্ঘবনের মাঝে॥ (১—৯০)

(১০)

 কথায়—

 সাত দিন সাত রাত বন ঢুইরা[৪১] সাত রাজপুত হায়রান। না মিলে বাঘ না মিলে হরিণ। একটা পঙ্খ পাখালীও না। কি সর্ব্বনাশ। লোকজন কোন মুখে দেশে ফিরব।

 এদিকে হইল কি। অন্ধ রাজা বনের মধ্যে ঘুইরা বেড়াইতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে অনেক দূর গেল। চক্ষে দেখে না হরিণ যায় কি বাঘ যায়। শব্দ টব্দ নাই। রাণ এড়ে বাণ ছাড়ে। শূন্য এড়িয়া বাণ পড়ে। বাণের মুখে ক্ষুরের ধার। গাছে কাটে পাথ্‌থর কাটে। বাঘ ভালুক পলাইয়া যায়। রাজা শব্দভেদী বাণ ছাড়ে না। আৎকা আচম্বিতে রাজার পায়ে কি ঠেকল। মানুষ না জন্তু জানোয়ার। অমনি রাজা চউখ খুল্যা গেল। রাজা চাইয়া দেখলো। এযে তার পরাণের পরাণ সুল্যা রাণী। সোয়ামীর পা লাগ্যা রাণীর কুরকুষ্ট দূর হইয়া গেল। যেমুন আগুনের ফুলুঙ্গির মত গায়ের রঙ। সেইমত কাঞ্চা সোণা জ্বলত লাগল। বার বচ্ছর পরে দেখা।

 গানে—

তবে রাণী সুলা দেখ কি কাম করিল।
ধরিয়া পতির গলা কান্দিতে লাগিল॥
বার বচ্ছরের দুঃখ পাশুরিতে নারে।
একে একে কাঁদিয়া কয় পতির গোচরে॥
কেমন করিয়া দুজ্জন সাধু ডিঙ্গায় তুলিল।
কেমন দেখিয়া তারে বনে ফালাইল॥

এতেক শুনিয়া রাজা আচানক হইল।
মনে ভাবে করম পুরুষ সদয় হইল॥

“শুন শুন সুলারাণী না কান্দিহ আর।
তোমারে পাইলাম যুদি রাজ্যে নাই সে কাজ॥
বনেতে থাকিব মোরা বনের ফল খাইয়া।
কোন জনে পায় নিধি এমুন হারাইয়া॥
কোথায় জানি কাঠুরি মা বাপ কেমুন জানি আছে।
একবার যাইতে মনে তাহাদের কাছে॥
দুইজনে দেখা হইল সুখের সীমা নাই।
দুর্দ্দিন খণ্ডিতে আর বেশী বাকী নাই॥” (১—১৮)

(১১)

 কথায়—

 এদিকে সাত ভাই রাজার সাতপুত্র হয় রাগ। শীকার বিফল হইল। সাত ভাইর বদন কালি। কি লইয়া যাইব দেশে। চলতে চলতে দেখে কি এক দারাক বিরক্ষ। তার মুলে পাতাল ছইছে। ডাল পাতায় আসমান ছইছে।

 তার নীচে বইয়া এক দেব আর দেবী। তাদের হমকে[৪২] সাতটা হরিণ। সাত ভাই জিজ্ঞাসা করে তোমরা কে? তখন রাজা কয়। তোমরা চিন্তা না[৪৩]। ভালা কইরা দেখ। তখন তারা দেখল যে সেই অন্ধ মালী। আচানক ব্যাপার। অন্ধ সোণার মানুষ হইল কিরূপে। চক্ষুদান পাইল কোথায়! বনের দেবতা বুঝি দয়া করলো। সাত পাঁচ ভাব্যা চিন্ত্যা সাত ভাই কয়। আমরাত একটা হরিণও পাইলাম না। তুমি সাত পাঁচটা হরিণ পাইলা কোথায়, তখন সাত ভাই কি করিল।

 গানে—

তখন সাত ভাইর কুবুদ্ধি হইল করিল চিন্তন।
শুধা হাতে গিরে ফিরি বল কিসের কারণ॥

দুরন্ত দুষ্মনে লইব শেষে রাজ্য সে কাড়িয়া।
হরিণা ছিনাইয়া লইব এহার মারিয়া॥
এতেক করিয়া যুক্তি কোন্ কাম করে।
সাত ভাইয়ে সাত বাণ ধনুকেতে ঝুরে॥

বারবন্ত তিলক রায় কোন্ কাম করিল।
সাত গোটা বাণ দিয়া ধনুক কাটিল॥
ছিলাতে বান্ধিয়া হাত কহিল তখন।
পরাণে রাখিলাম সবে ভগ্নীর কারণ॥
হাতের না ছিরি আঙ্গুট আগুনে পুড়িয়া।
সাত ভাইয়ের কপালেতে দিল সে দাগিয়া॥

এই শাস্তি দিয়া রায় কোন্ কাম করে।
সাত ভাইয়ের হস্তের বন্ধন মোচন কইরা দিল॥
রাজা কয় দেশে যাও হরিণ লইয়া।
কষ্ট কেন পাও তোমরা বনেতে থাকিয়া॥
এই ছিরি আঙ্গুট দিও রাজকন্যার কাছে।
রাজকন্যার নি ভালা আমায় মনে আছে॥
একদিন পরিচয় কন্যা কথা জানিতে চাহিল।
পরিচয় কন্যা আমি তখন না বলিল॥
এইত না ছিরি আঙ্গুট দিব আমার পরিচয়।
দেশে ফিরিয়া যাও তোমরা না করিও ভয়॥

সাত ভাই অপমানে অঙ্গ জার জার।
দেশেতে ফিরিয়া কিছু না বলিল আর॥

হাতের না ছিরি আঙ্গুট বনের কাছে দিল।
কান্দিয়া বনের কাছে কহিতে লাগিল॥
“শুন শুন বইন ওগো কহি যে তোমারে।
এই ছিরি আঙ্গুট অন্ধ দিল যে তোমারে॥

তাহারে খাইয়াছে বইন গো জঙ্গলার বাঘে।
কপালের দুঃখ তোমার খণ্ডাইব কে?
বাপত দুষ্মন হইয়। ঘটাইল দায়।
এত এত রাজার পুত্র বিমুখ হইয়া যায়॥
এমুনি শীতল দেখ চান্দের না ধারা।
শেষ কালে খাইল তারে দুরন্ত বাদুরা॥
এমুন সোণার পউদ মধুতে ভরিয়া।
তাহার ভাণ্ডাইয়া খাইল দারুণ গোবরিয়া॥
মরবার কালে অন্ধ মালী কইয়া গেল তোরে।
পরিচয় কথা নাকি জিজ্ঞাসিলা তারে॥
হস্তের না ছিরি অঙ্গুট দিব পরিচয়।
সেইত অঙ্গুইট হাতে তুল্যা লয়॥”

কান্দন কাটি নাই কন্যার মুখে নাই সে রাও।
ছুটিবার কালে যেমুন কাল বৈশাখের বাও॥
“শুন শুন ছিরি অঙ্গুট কহি যে তোমারে।
মিথ্যা কি কহিয়া ভাই ভাড়াইল মোরে॥
কহ কহ ছিরি অঙ্গুট সত্য পরিচয়।
বনের মধ্যে কি হইল সকল পরিচয়॥”
তবেত ছিরি অঙ্গুইট সকল কহিল।
একে একে সকল কথা পরিচয় দিল॥

কোন বা দেশের রাজা ছিল কোন্ বা দেশের রাণী।
একে একে বলে কন্যায় সকল সত্যবাণী॥
তবে রাজার কন্যা পবনকুমারী।
পবনের গতি গেল রাজার রাজ্য ছাড়ি॥
কত দেশ কত নদী পার যে হইল।
কত খনে কত দুঃখু পরাণে পাইল॥ (১—৫৪)

(১২)

সেই দেশে আছিল রাজার ধোপা একজন।
তাহার আশ্রিত হইয়া রহিল পবন॥
ধোপানীরে কয় কন্যা ওগো ধর্ম্মের মাও।
ধুয়া কাপড় লইয়া তুমি রাণীর কাছে যাও॥
রাণীর কাপড় যত কন্যা যতনে ধুইল।
রোইদেতে শুকাইয়া কন্যা ভাজ যে করিল॥
ভাজেত রাখিল কন্যা ছিরি অঙ্গুট খানি।
কাপড় লইয়া তবে চলিল ধোপানী॥

সুলারাণী কহে ধোপানী কহত উত্তর।
এমন করিয়া কে ধুইল আজকের কাপড়॥
ভাজ খুলিয়া রাণী আঙ্গুট পাইল।
সেইত না আঙ্গুইট তবে রাজারে দেখাইল॥
রাজা কয় সুলারাণী শুন মোর কথা।
এই ছিরি অঙ্গুইট ভালা তুমি পাইলা কোথা॥
রাণী কয় ধোপানী যে কাপড় আনিল।
ভাজেতে পাইলাম আঙ্গুইট কোন্ জনে বা দিল॥

দাসী পাঠাইয়া রাজা ধোপানীরে ডাক্যা আনে।
ভয়ে কাঁপে ধোপানী কহিছে রাজার আগে॥
এক কন্যা ঘরে মোর লক্ষ্মী সরস্বতী।
নাহি জানি পরিচয় কোথায় বসতি॥
মাও ত বলিয়া কন্যা আমারে সুধায়।
শীতল কথায় অঙ্গ জুড়াইয়া যায়॥

তবেত তিলক রায় কোন্ কাম করে।
দোলা পাঠাইল রাজা কন্যা আনিবারে॥

অন্দরে সামাইল কন্যা দোলাতে চড়িয়া।
সুলার সমান রূপ দেখে নাগরিয়া॥
খবর পাইয়া রাজা দৌড়িয়া আসিল।
পতির পদে পড়িয়া কন্যা মূর্চ্ছিত হইল॥
তবে রাজা সুলারে কহিল পরিচয়।
তোমা হইতে দুঃখ সুলা এই কন্যা পায়॥

এই কথা শুনিয়া সুলা দিল আলিঙ্গন।
বইনে বইনে হইল তারা সয়ালী[৪৪] মিলন॥
সোণার না হার ছড়ায় মাণিক্য বসাইল।
দুই চান্দে রাজপুরী উজ্জ্বলা হইল॥

শুনিয়া পবনের বাপ কোন্ কাম করে।
অৰ্দ্ধেক রাজত্বি দিল রাজা বসন্তেরে॥
এইখানে পালা মোর করিলাম ইতি।
নিজগুণে ক্ষেমা মোরে কর সভাপতি॥(১—৩৮)


  1. পাড়া=পাহারা
  2. ধছমচাইয়া=ধড়ফড় করিয়া, হঠাৎ ভয় পাইয়া ঘুম ভাঙ্গিলে যেরূপ হয়
  3. বেথায়=বৃথা।
  4. তেঠেঙ্গা ঠাকুর=কর্ম্মপুরুষের তিনটি পদ বলিয়া কল্পিত হয়।
  5. জিগুইব=জিজ্ঞাসা করিব।
  6. সেজয়ালীর=সাঁঝের।
  7. বিরকতলা=বৃক্ষতলা
  8. টুকাইয়া=কুড়াইয়া।
  9. কুটে=কুটিরে।
  10. টুকায়=কুড়ায়।
  11. পৈরাস=পরিহাস
  12. না ছিল গুণাতি=অগুন্তি, গণিয়া শেষ করা যায় না।
  13. টেটী=ছিন্নবস্ত্র।
  14. কুবে=কোপে।
  15. টুকায়=কুড়ায়।
  16. ডুঙ্গায়=ঠোঙায়।
  17. দইরা=দরিয়া (নদী)।
  18. মুন্নি=অভিশাপ, (সং) মন্যু
  19. আচানকা=বিস্ময়কর
  20. কুড়িকুষ্ট=কুষ্ঠব্যাধি
  21. কাত্যানির=কাত্যান অর্থাৎ প্রবল বৃষ্টিসহ ঝড়, পূর্ব্ববঙ্গে এই কথা খুব প্রচলিত আছে। কাত্যানির কলাগাছ অর্থ অত্যধিক ঝড়বৃষ্টি হইলে যেমন কলাগাছ পড়িয়া যায়।
  22. কটুয়াল=কোটাল।
  23. আবিয়াত=অবিবাহিত।
  24. সামাইল=প্রবেশ করিল।
  25. অঘুর নিঘুর=গভীর।
  26. পৈরাস=পরিহাস।
  27. পিন্‌ত=পরিত
  28. ভোঞ্জন=ভোগ।
  29. সাতনালা=সাতলহরী, সাতনরী হার।
  30. কণ্ণদোলা=কর্ণের দুল
  31. রিশাইয়া=ঈর্ষ্যায় জ্বলিয়া।
  32. চিকনাতি=বড়মানুষী।
  33. পুকাইয়া=পোকা বাছিয়া।
  34. ভজনার=সাধনের।
  35. ছত্তি=শক্তি।
  36. ছিরা=ছেঁড়া।
  37. টামনি=কাঁথা
  38. রম রমা, যম যমা=ঐশ্বর্য্য ও লোকপূর্ণ।
  39. ধুন=ধনু
  40. শব্দভেদী।
  41. ঢুইরা=ভ্রমণ করিয়া, ঢুরি, হিন্দী শব্দ।
  42. হমকে=সম্মুখে।
  43. চিন্তা না=চিন্‌তে পার্‌ছ না?
  44. সয়ালী=সখী।