পোকা-মাকড়/ষষ্ঠ শাখার প্রাণী/কঠিনবর্ম্মী/চিংড়ি মাছ

উইকিসংকলন থেকে

কঠিনবর্ম্মী

চিংড়িমাছ

 চিংড়িকে আমরা মাছ বলি, কিন্তু সত্য কথা বলিতে গেলে ইহাকে জালের পোকা বলিতে হয়। ইহা প্রজাপতি মাকড়সা কেন্নো বা বিছেরই জাত-ভাই। আমরা যখন বেশ মজা করিয়া চিংড়ি মাছ খাই, তখন জলের পোকা খাইতেছি ইহা মনেই হয় না। কিন্তু চিংড়ি-মাছ খাঁটি পোকা।

 এখানে একটা চিংড়ি মাছ এবং একটা বিছের ছবি দিলাম। দেখ,—দেহে কত মিল। ইহাদের প্রত্যেকেরই

চিত্র ২১—চিংড়ি।

শরীর আংটির মত অনেকগুলি ভাঙা ভাঙা অংশ দিয়া প্রস্তুত। আবার প্রত্যেক গাঁটের গোড়া হইতে জোড়া জোড়া পা বাহির হইয়াছে। বিছেরা এই সব পা দিয়া চলিয়া বেড়ায়। চিংড়ি মাছেরা তাহার কতকগুলি পা দিয়া

চিত্র ২২—বিছে।

খাবার ধরিয়া খায় এবং আর কতকগুলি দিয়া জলে সাঁতার কাটে। দুইয়েরই মুখে লম্বা লম্বা শুঁয়ো আছে।

 আমরা এখানে কেবল দুই-একটি মিলের কথা বলিলাম। তোমরা খোঁজ করিলে ইহা ছাড়া আরো অনেক মিল নিজেরাই দেখিতে পাইবে। কেবল বিছের সঙ্গেই যে চিংড়ি মাছের দেহের মিল তাহা নয়। তোমরা শুঁয়োপোকা প্রজাপতি মাকড়সা ইত্যাদি অনেক পোকা-মাকড়ের সঙ্গেই ইহাদের মিল ধরিতে পারিবে। এই সকল দেখিয়া শুনিয়াও যদি তোমরা চিংড়ি মাছকে পোকা না ভাবিয়া মাছই মনে করিতে থাক, তবে ভুল করিবে।

 চিংড়ি অনেক রকম দেখা যায়। আমাদের দেশে খাল, বিল বা পুকুরের ধারে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিলে তোমার জলের ভিতরে এক রকম ছোট চিংড়িকে ছুটিয়া চলিতে দেখিবে। ইহাদের গায়ে যে-শক্ত আবরণ থাকে, তাহা কাচের মত স্বচ্ছ। এইজন্য আবরণের ভিতর দিয়া শরীরের অনেক অংশ স্পষ্ট দেখা যায়। এই চিংড়িকে অনেকে ঘুসো চিংড়ি বলে। পুকুরের কাদায় যে-সকল ছোট চিংড়ি দেখা যায়, তাহাদের ছট্‌কা চিংড়ি বলে। ইহাদের গায়ের রঙ্ কালো। গল্‌দা চিংড়ি তোমরা সকলেই দেখিয়াছ। এগুলি লম্বায় কখনো কখনো আধ হাতের উপরেও দেখা যায়। গায়ের রঙ্ সাদা ও কতকটা কালো বা নীলে মিশানো। ইহা ছাড়া চারি পাঁচ আঙুল লম্বা ও সাদা চিংড়ি আমাদের জলাশয়ে পাওয়া যায়। এগুলিকে রস্‌না চিংড়ি বলে।

 সমুদ্রের জলেও চিংড়ির অভাব নাই। সেখানে নানা আকারের চিংড়ি দেখা যায়। আবার শীতের দেশে যে-রকম আকৃতির চিংড়ি পাওয়া যায়, গ্রীষ্মের দেশে সে-রকম খুঁজিয়া মিলে না। চিংড়িদের আকৃতি এই রকম বিচিত্র হইলেও, শরীরের মোটামুটি গড়ন ও জীবনের কাজ সকল চিংড়িরই এক।

 যদি ইহাদের চলাফেরা সাঁতার-কাটা পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা কর, তবে একটি কাচের পাত্রে জল ভরিয়া তাহাতে একটি ছোট জীবন্ত চিংড়ি মাছ ছাড়িয়া দিয়ো। এই রকম পাত্রে আবদ্ধ থাকিয়া সেটি যখন চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইবে, তখন তাহার জীবনের অনেক কাজ তোমরা স্বচক্ষেই দেখিতে পাইবে।

 চিংড়ির যে ছবি দেওয়া হইয়াছে, তাহা একবার এখন ভালো করিয়া দেখ; ইহার দশ জোড়া পা আছে, কিন্তু মুখের দিকে ইহার পা পাঁচ জোড়া মাত্র। কিন্তু এই সকল পা দিয়া তাহারা হাঁটে না এবং সব পায়ে নখ থাকে না, বা সেগুলিতে আঙুলের মত কোনো অংশ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। প্রথম বা দ্বিতীয় পা দুটাই মোটা হয় এবং প্রত্যেকের শেষে কামারের দোকানের সাঁড়াশির মত দু’টো অংশ জোড়া থাকে। এই সাঁড়াশি-লাগানো পা-দুখানিকে চিংড়ির দাড়া বলে। দাড়া দিয়া ধরিয়া ইহারা খাদ্য মুখে তুলিয়া দেয়,—ইহা আমাদের হাতের মত কাজ করে। দেহের পিছনে গাঁটে গাঁটে যে আরো পাঁচ জোড়া পায়ের মত অংশ আছে, তাহা সাঁতার কাটিবার জন্য। এইগুলি দিয়া চিংড়িরা জল কাটিয়া সাঁতার দেয়। দেহের শেষে চিংড়ির যে পাখার মত লেজ থাকে, তাহা তোমরা অবশ্যই দেখিয়াছ। কতকগুলি শক্ত খোলা একত্র হইয়া এই লেজের সৃষ্টি করিয়াছে। চিংড়িরা জলের মধ্যে সোজা সাঁতার দিতে দিতে এক এক সময়ে হঠাৎ পিছু-সাঁতার দেয়। সমস্ত দেহটাকে না ঘুরাইয়া ইহারা ঐ লেজের সাহায্যেই পিছু-সাঁতার দিতে পারে।

 চিংড়ি ভাজা তোমরা নিশ্চয়ই খাইয়াছ, আমরাও খাইয়াছি। ইহাদের গায়ের উপরে খোলা কি রকমে সাজানো থাকে, তোমরা দেখ নাই কি? এবার বাজার হইতে চিংড়ি মাছ আসিলে নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিয়ো। পরীক্ষা করিলে দেখিবে, ইহাদের মাথাটা একখানা বড় খোলা দিয়া ঢাকা আছে। এই খোলার গায়েই করাতের মত একটা অংশ খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে। ইহা চিংড়িদের খড়্গ। শত্রু আসিয়া আক্রমণ করিলে আমরা বন্দুক বাহির করি ও তলোয়ার হাতে লইয়া শত্রুকে তাড়া করি। চিংড়ি মাছদের ঘরবাড়ি নাই, তলোয়ার বন্দুকও নাই; আছে কেবল মাথার উপরে করাতের মত খাঁড়া। শত্রুরা উৎপাত আরম্ভ করিলেই, তাহারা ঐ খাঁড়া দিয়া শত্রুকে তাড়াইয়া দেয়। ইহা তাহাদের আত্মরক্ষার অস্ত্র।

 চিংড়িদের মাথা ভয়ানক জটিল যন্ত্র। ইহাতে অনেক ছোট-খাটো অংশ জোড়া থাকে; এইজন্যই সকল অঙ্গের চেয়ে মাথাটাই জটিল হইয়া পড়িয়াছে। চিংড়ির মাথায় পায়ের মতো ছয় জোড়া অবয়ব লাগানো দেখা যায়। আমরা আগেই বলিয়াছি, পোকা-মাকড়দের দেহে যত গাঁট থাকে, প্রায়ই তাহার প্রত্যেকটি হইতে জোড়া জোড়া পা বা ডানা প্রভৃতি নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাহির হয়। সুতরাং মাথায় যে ছয় জোড়া পায়ের মত অংশ আছে, তাহা দেখিলে বুঝা যায়, চিংড়িদের মাথা ছয়টা গাঁটে প্রস্তুত। প্রকৃত ব্যাপার তাহাই বটে, কিন্তু চিংড়ির দেহ পরীক্ষা করিলে তাহার মাথার ঐ রকম ছয়টা গাঁট দেখিতে পাইবে না। এই ছয়টা গাঁট জোট বাঁধিয়া এক হইয়া গিয়াছে। কোনো এক সময়ে যে এই ছয়টা গাঁট পৃথক্ ছিল, তাহা মাথার ছয় জোড়া পায়ের মত অংশ দেখিলেই আন্দাজ করা যায়।

 যাহা হউক, এখন চিংড়ির মুখটি কি রকম তাহা দেখা যাউক। মাথার পূর্ব্বের ছয় জোড়া অঙ্গ ছাড়া ইহাদের দাড়ার কাছ হইতে আরো তিন জোড়া অঙ্গ বাহির হয়। এগুলি দেখিতে কতকটা আঙুলের মত; কেবল শেষের দুই জোড়ায় শুঁয়োর মত অংশ জোড়া থাকে। দাড়া দিয়া ধরিয়া চিংড়িরা যে খাদ্য মুখের গোড়ায় আনে, তাহারা ঐ শেষের তিন জোড়া বিশেষ অঙ্গ দিয়া তাহাই মুখে পূরিয়া দেয়।

 মুখে খাবার পূরিলেই খাওয়া শেষ হয় না। যাহাতে খাদ্য মুখ হইতে পড়িয়া না যায়, তাহার জন্য উপর ও নীচের ওষ্ঠ চালনা করিতে হয়। তাহার পরে সহজে হজম করার জন্য খাদ্য চিবাইয়া পেটে পূরিতে হয়। চিংড়িদের মুখে যে শেষ তিন জোড়া অঙ্গের কথা বলিলাম, তাহা দিয়াই এই সকল কাজ চলে। দুই জোড়া দিয়া তাহারা খাদ্য আটকাইয়া রাখে এবং আর এক জোড়ায় তাহা চিবায়। এই তিন জোড়াতে কতকটা আমাদের মুখের চোয়ালের মত কাজ পাওয়া যায়। কিন্তু খাদ্য চিবাইবার জন্য দাঁত কেবল এক জোড়াতেই থাকে।

 বড় চিংড়ি মাছের মাথা-ভাজা তোমরা খাইয়াছ কি? খাইবার সময় তোমরা হয় ত ইহাদের চোয়াল ও দাঁত দেখিয়া থাকিবে। দাঁত হাড়ের মত শক্ত, অথচ বেশ ধারালো। আমরা কোনো জিনিস ছিঁড়িয়া খাইবার সময়ে, চোয়াল উপর নীচে নাড়াচাড়া করি, ইহাতে খাদ্য খণ্ড খণ্ড ভাগ হইয়া যায় কিন্তু চিবানো হয় না। চিবাইতে হইলে চোয়ালকে পাশাপাশি চালাইতে হয়; ইহাতে খাবার পিষিয়া যায়। গোরু যখন “জাওর কাটায়,” তখন তাহারা চোয়াল পাশা-পাশি চালায়। চিংড়ি মাছেরা চোয়াল এই রকম কেবল পাশা-পাশিই চলাইতে পারে। ইহাতে খুব শক্ত খাদ্যও দাঁতের ধারে পিষিয়া কাদার মত হইয়া যায়।