প্রাকৃতিকী/নূতন নীহারিকাবাদ
নূতন নীহারিকাবাদ
সূর্যাকে মাঝে রাখিয়া যে, গ্রহগণ নিয়তই পরিভ্রমণ করিতেছে, ইহা অতি প্রাচীন জ্যোতিষীদিগের জানা ছিল। কিন্তু ইঁহারা গ্রহের ভ্রমণপথগুলিকে সম্পূর্ণ বৃত্তাকার বলিয়া মনে করিতেন। পথ ত্রিভুজ বা চতুর্ভুজ না হইয়া কেন বৃত্তাকার হইল, জিজ্ঞাসা করিলে ইঁহারা
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
জর্ম্মান্ জ্যোতিষী কেপ্লার
বলিতেন, সমস্ত জ্যামিতিক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে এক বৃত্তেরই গঠনে সর্ব্বাঙ্গীণ সুশৃঙ্খলা বর্ত্তমান। এ জন্যই ভগবান গ্রহদিগকে বৃত্তাকার
ছয় শত দশ লক্ষ মাইল নীহারিকারাশি হইতে সূর্য্য পৃথিবী ইত্যাদি গ্রহ উপগ্রহের জন্ম পথে ঘুরাইয়া থাকেন। জ্যোতিঃশাস্ত্রের এই ঔপন্যাসিক যুগের কথা ছাড়িয়া দিলে দেখা যায়, ১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দে যে দিন প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী কেপ্লার (Kepler) গ্রহদিগকে বৃত্তাভাস (Elliptical) পথে ভ্রমণ করিতে দেখিয়াছিলেন, সেই দিনই নব্য জ্যোতিষের জন্মদিন। কেপ্লার সাহেব এই নূতন তথ্যটি কেবল সংগ্রহ করিয়াই গিয়াছিলেন; বৃত্তাভাস পথের উৎপত্তি প্রসঙ্গে কোন নূতন কথা তাঁহার নিকট হইতে শুনা যায় নাই। প্রকৃত তত্ত্ব জানিবার জন্য প্রায় শত বৎসর প্রতীক্ষা করিতে হইয়াছিল; গত ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দে অদ্বিতীয় মহাপণ্ডিত লাপ্লাস্ সাহেব জগৎ-উৎপত্তির একটা ব্যাখ্যান দিয়া বিষয়টির মীমাংসা করিয়াছিলেন। চন্দ্র, সূর্য্য, বৃহস্পতি, শনি প্রভৃতি গ্রহোপগ্রহের উপাদান এককালে জ্বলন্ত নীহারিকার আকারে আকাশে ঘুরিতেছিল বলিয়া ইঁহার বিশ্বাস হইয়াছিল, এবং কালক্রমে উহাই জমাট বাঁধিয়া এই জগতের উৎপত্তি করিয়াছে সিদ্ধান্ত হইয়াছিল। দ্রব জিনিস কঠিন হইয়া গেলে, একটিমাত্র জমাট পিণ্ড পাওয়া যায়। একই নীহারিকা জমাট বাঁধিয়া কি প্রকারে বহু জ্যোতিষ্কের সৃষ্টি করিল জানিতে চাহিলে তিনি বলিতেন, সেই বিশাল নীহারিকা কঠিন হইয়া সঙ্কুচিত হইবার সময়, উহার দেহের কিয়দংশ মাঝে মাঝে বলয়াকারে রাখিয়া গিয়াছিল। এখন সেইগুলিই পুঞ্জীভূত হইয়া মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, পৃথিবী প্রভৃতি গ্রহের উৎপত্তি করিয়াছে। উপগ্রহের উৎপত্তির কথা জিজ্ঞাসা করিলেও লাপ্লাস্ সাহেব ঐ ব্যাখ্যান দিতেন। গ্রহগণ যে-সকল বলয় হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, তাহার সামগ্রীগুলি একত্র হইয়া পিণ্ডাকারে পরিণত হইলে, ইহাদেরও চারিদিকে ছোট ছোট বলয়ের উৎপত্তি হইত। আমাদের চন্দ্র এবং বৃহস্পতি শনি ও মঙ্গলের উপগ্রহগুলি সেই সকল বলয়েরই জমাট মূর্ত্তি।
যাহা হউক ঘূর্ণমান বৃহৎ নীহারিকা হইতে বিচ্যুত হইয়াই যে, এই গ্রহ উপগ্রহাদির সৃষ্টি হইয়াছে গত এক শত বৎসর ধরিয়া তাহা অবিসম্বাদে স্বীকৃত হইয়া আসিতেছে। সূর্য্যকে সেই নীহারিকাস্তূপের মূল অংশ এবং গ্রহউপগ্রহাদিকে তাহারই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অংশ বলিয়া সকলেই মানিতেছিল। সম্প্রতি অধ্যাপক সি, (J. J. See) সৃষ্টিতত্ত্বের এই প্রাচীন সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ করিয়া কয়েকটি নূতন কথার অবতারণা করিয়াছেন। সি, সাহেব আমেরিকার একজন খ্যাতনামা জ্যোতিষী এবং নানা জ্যোতিষিক গবেষণায় তাঁহার নাম এখন জগদ্বিখ্যাত। বৈজ্ঞানিক সাময়িক পত্রগুলির পাতায় পাতায় আজকাল যে-সকল নব সিদ্ধান্তের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, সি সাহেবের কথাগুলিকে সেই শ্রেণীভুক্ত করা যায় না। ইঁহার প্রত্যেক উক্তিই গাণিতিক প্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত। তা’ ছাড়া দীর্ঘকাল আকাশপর্য্যবেক্ষণ করিয়া যে-সকল তথ্য সংগ্রহ করা হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটির সহিত নব সিদ্ধান্তের ঐক্য আছে। এই সকল কারণে হঠাৎ ইঁহাকে উড়াইয়া দেওয়া চলিতেছে না। দেশবিদেশের জ্যোতিষিমহলে আজকাল ইঁহার খুবই আলোচনা চলিতেছে।
শিশু সূর্য্য হইতে স্খলিত হইয়া যে, এই সৌরজগতের উৎপত্তি হইয়াছে এ কথাটা সি, সাহেব প্রথমেই অস্বীকার করিয়াছেন। প্রথম কালের এক বিশাল নীহারিকাস্তূপের অস্তিত্ব মানিয়া লইয়া ইনি বলিতেছেন, সেই নীহারিকারই নানা অংশ জমাট বাঁধিয়া বৃহস্পতি শনি, প্রভৃতি গ্রহের উৎপত্তি করিয়াছে। এই সকল জমাট অংশগুলির মধ্যে সূর্য্যেরই গুরুত্ব ও আয়তন বৃহৎ ছিল, কাজেই নিজের প্রবলতর আকর্ষণে সে দূরবর্ত্তী সকল গ্রহকেই টানিয়া নিকটে আনিয়াছে। উপগ্রহের উৎপত্তিপ্রসঙ্গেও তিনি এই কথা বলিতেছেন। আমাদের চন্দ্র এবং শনি বা বৃহস্পতির উপগ্রহগুলি কুখনই মূলগ্রহের অঙ্গীভূত ছিল না। আকর্ষণের সীমার মধ্যে জমাট হইতে আরম্ভ করিয়াছিলএই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
বলিয়াই এগুলি গ্রহদিগের নিকট ধরা দিয়াছে। আকর্ষণের বন্ধন ছিন্ন করিয়া পলাইবার সামর্থ্য এখন ইহাদের কাহারো নাই।
পূর্ব্বের কথাগুলি হইতে বুঝা যায়, সিদ্ধান্তটি প্রচলিত নীহারিকাবাদেরই এক নূতন সংস্করণ। প্রচলিত সিদ্ধান্তে আমরা এক ঘূর্ণ্যমান নীহারিকার অস্তিত্ব মানিয়া থাকি, এবং তার পর আবর্ত্তনের চাপে উহার সীমান্তবর্ত্তী কতক অংশ বিচ্যুত হইয়া পড়ে বলিয়া স্বীকার করি। সি. সাহেব এইগুলিই মানিতে চাহিতেছেন না; ইনি বলিতেছেন, প্রাথমিক নীহারিকায় আবর্ত্তনের চাপ ছিল না। চিনির রসে দানা বাঁধিতে শুরু হইলে রসভাণ্ডের স্থানে স্থানে যেমন আপনা হইতেই দানা বাঁধা শুরু হয়, কতকটা সেই প্রকারে নীহারিকার গ্রহগুলি জমিতে আরম্ভ করিয়াছিল।
এই নব সিদ্ধান্তের সাহায্যে ধূমকেতুর এক নূতন জন্মপত্রিকা প্রস্তুত হইয়াছে। সি. সাহেব বলিতেছেন, এই ক্ষুদ্র জ্যোতিষ্কগুলি প্রাথমিক নীহারিকারই সীমান্ত প্রদেশে জন্মিয়াছিল; বোধ হয় নীহারিকার ভিতরকার অংশটা গ্রহোপগ্রহের রচনাতেই নিঃশেষ হইয়া গিয়াছিল। এখন সূর্য্যের আকর্ষণে এক একবার জগতের কেন্দ্রের নিকট আসিয়া তাহা আবার সেই সীমান্তবর্ত্তী জন্মস্থানের কাছাকাছি হইতেছে।
অতি প্রাচীনকাল হইতে জ্যোতিষিগণ আকাশের নানা অংশে বহু নীহারিকা দেখিয়া আসিতেছেন; কিন্তু এগুলির উৎপত্তিতত্ত্ব অদ্যাপি জ্যোতিঃশাস্ত্রের একটা প্রকাণ্ড সমস্যা হইয়া রহিয়াছে। নূতন সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠাতা বলিতেছেন, শত সূর্য্যোপম নক্ষত্র হইতে আরম্ভ করিয়া ক্ষুদ্র উল্কাপিণ্ড প্রভৃতি ছোটবড় সকল জ্যোতিষ্কই নিজ নিজ দেহ হইতে নিয়তই অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা ত্যাগ করিতেছে। এই গুলিই দীর্ঘকাল এলোমোলো ভাবে আকাশে অসিয়া শেষে একত্র হইয়া নীহারিকার উৎপত্তি করে। প্রায় সমগ্র আকাশই যে জ্যোতিষ্কদেহচ্যুত ধুলিতে আচ্ছন্ন, তাহা আকাশের ফোটোগ্রাফ্চিত্রে এখন প্রত্যক্ষ দেখা যায়। সুতরাং বুঝা যাইতেছে, জ্যোতিষ্কের দেহই ক্ষয় পাইয়া নীহারিকার উৎপত্তি করে এবং কালক্রমে জমাট বাঁধিয়া আবার নূতন সৃষ্টির কারণ হয়। জন্মমৃত্যু ও ভাঙ্গাগড়ার ব্যাপার কেবল আমাদের ক্ষুদ্র পৃথিবীর ঘটনা নয়। অনন্ত নক্ষত্রলোকেও অনন্তকাল ধরিয়া সেই লীলা চলিতেছে। সর্ব্বত্রই মৃত্যু পুরাতনকে নূতন জীবন দান করিতেছে।
নীহারিকাগুলির অবস্থান পরীক্ষা করিলে দেখা যায়, ইহাদের প্রায় সকলেই ছায়াপথ (Milky Way) হইতে দূরে অবস্থিত। এই ব্যাপারটি শতাধিক বৎসর পূর্ব্বে ইংলণ্ডের প্রসিদ্ধ জ্যোতিষী সার্ উইলিয়ম্ হার্সেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল, এবং পরে তাঁহারই স্বনামখ্যাত পুত্র সার্ জন্ হার্সেল উহা লইয়া অনেক গবেষণা করিয়া ছিলেন। কিন্তু কি কারণে আকাশের অপরাংশ ছাড়িয়া নীহারিকাগুলি ছায়াপথ হইতে দূরে অবস্থান করে, তাহার প্রকৃত তত্ত্ব জানা যায় নাই। অধ্যাপক সি, গত দশ বৎসর জ্যোতিষ্কের আকর্ষণবিকর্ষণের ফল অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন। এই সময়ে নীহারিকার অবস্থানসম্বন্ধে একটা নূতন তত্ত্ব তাঁহার মনে হইয়াছিল। এখন তাহাই অবলম্বন করিয়া বলিতেছেন, যখন বিকর্ষণ শক্তির প্রভাবে তাড়িত হইয়া নক্ষত্রদিগের দেহের কণাই নীহারিকার রচনা করে, তখন সেগুলি যে, নক্ষত্রবহুল ছায়াপথের নিকট পুঞ্জীভূত হইবে, ইহা কখনই সম্ভব নয়।
পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি সত্য হইলে ছায়াপথে নক্ষত্রের যে বিশ্বাস দেখিয়া হার্সেল্ সাহেব অবাক্ হইয়াছিলেন, তাহার একটা সুব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সি, সাহেব বলিতেছেন, নীহারিকাগুলি ছায়াপথের
ইংরাজ-জ্যোতিষী সার্ জন হার্সেল্ বাহিরে থাকিয়া যখন কালক্রমে বহুগ্রহবেষ্টিত নক্ষত্রের মূর্ত্তি গ্রহণ করে, তখন সেই ছারাপথেরই বৃহৎ নক্ষত্রদিগের টানে উহাদিগকে সাড়া দিতে হয়। কাজেই দূরে জন্মগ্রহণ করিয়াও শেষে তাহাদিগকে ছায়াপথের ক্রোড়ে আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইতেছে।
কেবল আকর্ষণ-বিকর্ষণের মূলতত্ত্বগুলিকে অবলম্বন করিয়া অধ্যাপক সি, এই প্রকারে রহস্যময় নক্ষত্রলোকের অভিব্যক্তি দেখাইয়াছেন। তা ছাড়া যুগলনক্ষত্র, ধূমকেতু, উল্কা, গ্রহ-উপগ্রহ প্রভৃতি সকল জ্যোতিষ্কেরই উৎপত্তিতত্ত্ব এই সিদ্ধান্তের সাহায্যে জানা যাইতেছে। গোঁজামিলের জন্য অনেক সময় যেমন কতকগুলি অদ্ভুত ধর্ম্ম স্বীকার করিতে হয়, ইহাতে তাহার প্রয়োজন হয় নাই। জড়ের যে-সকল ধর্ম্ম অতি সুপরিচিত, এবং শত শত পরীক্ষায় যে-গুলির অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে প্রতিপন্ন করা যাইতেছে, সি, সাহেব কেবল তাহাদেরই সাহায্য গ্রহণ করিয়া সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। মানুষের হাতে গড়া বিধি এবং প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে প্রধান পার্থক্য এই যে, প্রকৃতি নিষ্করুণভাবে সমগ্র বিশ্বকে অনন্তকাল ধরিয়া তাহার চিরন্তন নিয়মের অনুগত রাখে। প্রকৃতির অধিকারে খণ্ডরাজা নাই, একই ব্যাপক এবং কঠোর নিয়ম চিরদিনই বিশ্বকে শাসন করে। এই কথাটা স্মরণ করিলে, প্রাকৃতিক ব্যাপারের যে-সকল ব্যাখ্যান আমাদের চিরপরিচিত ও পরীক্ষিত নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত, কেবল তাহাতেই বিশ্বাস স্থাপন করিতে ইচ্ছা যায়। সি, সাহেবের সিদ্ধান্তে এই গুণটা পূর্ণ মাত্রায় বর্ত্তমান। বোধ হয় এই জন্যই তাঁহার কথাগুলি লইয়া আজকাল এত আলোচনা চলিতেছে।
পরিবর্ত্তনশীল (Variable) নক্ষত্রের কথা পাঠক অবশ্যই শুনিয়াছেন। এই শ্রেণীর জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বলতা স্থির থাকে না, এক একটি নির্দ্দিষ্ট সময়ের অন্তে এবং কখন কখন অনিয়মিতভাবে ইহারা হঠাৎ উজ্জ্বল হইয়া পড়ে। আধুনিক জ্যোতিষিগণ এই ঘটনার নানা কারণ নির্দ্দেশ করিয়া আসিতেছিলেন। সি, সাহেব বলিতেছেন, জ্যোতিষ্কদিগের দেহ হইতে স্খলিত হইয়া, যে ধূলিপুঞ্জ মহাকাশে ব্যাপ্ত হইয়া আছে, তাহাই এই সকল পরিবর্ত্তনের মূল কারণ। নির্দ্দিষ্ট পথে চলিবার সময় কোন অনুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক যদি ঘন ধূলিপুঞ্জের সংঘর্ষণ প্রাপ্ত হয়, তবে ইহার তাপে উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি হইবারই সম্ভাবনা। এই প্রকারে আকস্মিক উজ্জ্বল নক্ষত্রগুলিকেই আমরা দূর হইতে পরিবর্ত্তনশীল তারকার আকারে দেখি। যে-সকল নক্ষত্র জোড়া জোড়া বা তিন চারিটি করিয়া একত্র অবস্থান করে, তাহাদেরও উজ্জ্বলতার নিয়মিত পরিবর্ত্তনসম্বন্ধে এই ব্যাখ্যান প্রয়োগ করিতে পারা যায়। যে গুলিকে আমরা যুগল নক্ষত্র বলি, তাহা সত্যই খুব কাছাকাছি থাকিয়া নির্দ্দিষ্টকালে পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে। সুতরাং ইহাদের কাহারো কক্ষার মাঝে যদি কোন ধূলিপুঞ্জ আসিয়া দাঁড়ায়, তবে প্রত্যেক প্রদক্ষিণের শেষে উহাকে ধূলির সংঘর্ষণে জ্বলিয়া উঠিতে হয়।
নবীন জ্যোতিঃশাস্ত্রে অদ্যাপি কোন নক্ষত্রের মৃত্যু সংবাদ লিপিবদ্ধ হয় নাই। কোটি কোটি বৎসরজীবী নক্ষত্রগুলি যে, দুই হাজার বৎসরের শিশু পৃথিবীকে মৃত্যুর বিভীষিকা দেখাইবে, তাহাও আশা করা যায় না। কিন্তু নক্ষত্রের জন্ম বড় দুর্লভ ঘটনা নয়। আকাশের যে সকল স্থান সম্পূর্ণ নক্ষত্রবর্জ্জিত, কখন কখন সেখানে হঠাৎ নূতন নক্ষত্রের প্রজ্জ্বলন দেখা গিয়াছে। এগুলি প্রায়ই কয়েকদিন মাত্র উজ্জ্বলালোক বিতরণ করিয়া নির্ব্বাণপ্রাপ্ত হয়। যাহা হউক অধ্যাপক সি, ইহাদের উৎপত্তিপ্রসঙ্গে বলিতেছেন, অনুজ্জল বা স্বল্পোজ্জ্বল নক্ষত্র যখন গন্তব্য দিক্ ধরিয়া যাইতে যাইতে সেই ধূলিপুঞ্জ বা অপর কোন অনুজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের সংঘর্ষণ প্রাপ্ত হয় তখন উভয়েই সংঘর্ষণ তাপে জ্বলিয়া উঠে। আমরা দূর হইতে এই বিশাল অগ্নিকাণ্ডকেই নূতন নক্ষত্রের আকারে দেখি।
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
দূরবীক্ষণযন্ত্র দিয়া চন্দ্রমণ্ডল পর্য্যবেক্ষণ করিলে, আগ্নেয়গিরির গহ্বরের অনুরূপ কতকগুলি চিহ্ন চন্দ্রের সর্ব্বাঙ্গে পরিব্যাপ্ত দেখা যায়। আধুনিক জ্যোতিষিগণ এগুলিকে নির্ব্বাপিত আগ্নেয়গিরির বিবর বলিয়াই প্রচার করিয়া আসিতেছেন। নুতন নীহারিকাবাদের প্রতিষ্ঠাতা সি, সাহেব এই সিদ্ধান্ত গ্রাহ্য করিতেছেন না। ইঁহার মতে সেগুলি উল্কাপাতের চিহ্ন। কাদায় ঢিল ফেলিলে যেমন তাহাতে এক প্রকার চিহ্ন রহিয়া যায়, কোমল চন্দ্রদেহে সেই প্রকার বহু উল্কা পড়িয়া এক সময়ে ঐ চিহ্নগুলি উৎপন্ন করিয়াছিল।
নূতন নীহারিকাবাদের সাহায্যে গ্রহদিগের আবর্ত্তন (Rotation) ও পরিভ্রমণ (Revolution) এই দুইয়েরই সুন্দর ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়াছে, এবং গ্রহদিগের কক্ষ বৃত্তাকার না হইয়া কেন বৃত্তাভাস হইল, তাহারও কারণ নির্দ্দেশ করা চলিতেছে। সি, সাহেব এই সকল ব্যাপারে গণিতের প্রমাণ দিয়াছেন, সুতরাং তাঁহার বিরুদ্ধে বলিবার কিছুই নাই।
অর্দ্ধশতাব্দী পূর্ব্বে জ্যোতিষিগণ সৌরজগৎকে অতি ক্ষুদ্র বলিয়া মনে করিতেন। শনিগ্রহের বাহিরে সৌরপরিবারভুক্ত অপর কোন জ্যোতিষ্ক নাই বলিয়াই ইঁহাদের বিশ্বাস ছিল। ইহার পর কয়েক বৎসরের মধ্যে ইউরেনস্ ও নেপ্চুন্ গ্রহযুগলের আবিষ্কারে সৌরজগতের প্রসার খুবই বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সি, সাহেব তাঁহার নব সিদ্ধান্তের সাহায্যে আমাদের জগৎকে আরো বৃহৎ বলিয়া প্রমাণ করিতেছেন। নেপ্চুন্-গ্রহের কক্ষ সূর্য্য হইতে বহু দূরবর্ত্তী থাকিয়াও, আকারে প্রায় বৃত্তের ন্যায় রহিয়াছে। ইনি গণিতের প্রমাণ প্রয়োগ করিয়া বলিতেছেন, নেপ্চুন সৌরজগতের সীমান্তবর্ত্তী হইলে ইহার কক্ষ বৃত্তের অনুরূপ না হইয়া সুস্পষ্ট ডিম্বাকৃতি হইত। কাজেই বলিতে হইতেছে, নেপ্চুনের বাহিরে এখনো একাধিক বৃহৎ গ্রহ বর্ত্তমান আছে। সূর্য্য হইতে বহুদূরবর্ত্তী বলিয়া ইহারা আমাদের অলক্ষ্যে সূর্য্য প্রদক্ষিণ করিতেছে। অদূর ভবিষ্যতে এ গুলি একদিন ইউরেন্স্ ও নেপ্চুনের ন্যায় হঠাৎ ধরা দিবে।
অপর জ্যোতিষ্কাদিতে জীববাস আছে কি না, এই প্রশ্নটি লইয়া যে সুদীর্ঘ আলোচনা চলিতেছে তাহার বিশেষ পরিচয় প্রদান নিষ্প্রয়োজন। জ্যোতিষিগণ বহু বিচার করিয়াও কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপস্থিত হইতে পারেন নাই। বহু দূরের জ্যোতিষ্কগুলির কথা ছাড়িয়া আমাদেরই গৃহদ্বারে যে শুক্র ও মঙ্গল অবস্থান করিতেছে, তাহাদের ঘরের খবর জানিতে গেলেও হতাশ হইতে হয়। কোন জ্যোতিষীই ইহাদের আকাশ এবং পৃষ্ঠদেশের অবস্থা নিঃসন্দেহে নিরূপণ করিতে পারেন নাই। এই প্রসঙ্গে সি, সাহেব বলিতেছেন, যে এক মহানিয়মের শাসনে এই বিশ্বের অভিব্যক্তি হইয়াছে, তাহা কখনই বিশেষভাবে পৃথিবীতে কার্য্য করে নাই। ধরাপৃষ্ঠ জীববাসের উপযোগী হওয়া এবং জড়কে জীবে পরিণত করা যখন ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী একই মহাশক্তির কার্য্য, তখন সেই শক্তিরই লীলাভূমি অপর জ্যোতিষ্কগুলিতে কেন জীব জন্মগ্রহণ করিবে না, তাহার সঙ্গত কারণ নাই।