প্রাকৃতিকী/পৃথিবীর শৈশব

উইকিসংকলন থেকে

পৃথিবীর শৈশব

যে বিশাল নীহারিকা-স্তুপ হইতে এই সসাগরা উদ্ভিদ্‌শ্যামলা ধরার উৎপত্তি হইয়াছে, তাহা কোথায় ছিল এবং কি প্রকারেই বা তাহা বৃহস্পতি, শনি, পৃথিবী প্রভৃতি গ্রহগণের উৎপত্তি করিল, আমরা তাহার আলোচনা করিব না। কোন বিশাল নীহারিকা-রাশি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যখন পৃথিবীর সমগ্র উপাদান উত্তপ্ত বাষ্পাকারে ভীমবেগে আবর্ত্তিত হইতেছিল, সেই সময়টিকেই আমরা পৃথিবীর জন্মকাল বলিতেছি। এই জন্মকাল হইতে আমাদের পৃথিবী কি প্রকারে ধীরে ধীরে নদী সমুদ্র পাহাড় পর্ব্বত ও তরুলতাতে আবৃত হইয়া এখন প্রাণীর আবাসক্ষেত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে, আমরা বর্ত্তমান প্রবন্ধে তাহারি কিঞ্চিৎ আভাস দিব

 পৃথিবী এখন যেমন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টায় একবার ঘুরপাক্ খায়, তখন পূর্ণাবর্ত্তন দিবার জন্য শিশু পৃথিবী এত দীর্ঘকাল ক্ষেপণ করিত না। ঠিক কালটি নিরূপণ করা কঠিন; কিন্তু আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি তখন প্রতি ঘণ্টায় পৃথিবী যে, তিন চারি বার পূর্ণাবর্ত্তন সমাপন করিত, তাহা বোধ হয় নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। পৃথিবী এখন চব্বিশ ঘণ্টায় পূর্ণাবর্ত্তন শেষ করে, ইহাতে আমরা চব্বিশ ঘণ্টা অন্তর সূর্য্যের উদয়াস্ত দেখি; আমাদের অনুমান সত্য হইলে বলিতে হয়, সেই অতি প্রাচীন যুগে জীবশূন্যা বসুন্ধরায় প্রতি ঘণ্টায় অন্ততঃ তিন চারিবার সূর্য্যের উদয়াস্ত হইত। তখন পৃথিবীর কেন্দ্রস্থানটি হয় ত জমাট বাঁধিয়া সদ্য কঠিনাকার প্রাপ্ত হইয়াছিল, কিন্তু ইহার পৃষ্ঠভাগ তখনও অত্যুঞ্চ তরল ও বায়বীয় আবরণে আচ্ছন্ন ছিল। এই আবরণই কালক্রমে জমাট বাঁধিয়া এখনকার নদীসমুদ্র পাহাড়পর্ব্বতের সৃষ্টি করিয়াছে।

 আমাদের এখনকার আকাশে নাইট্রোজেন্ ও অক্সিজেন্ বায়ুর আকার গ্রহণ করিয়া অবস্থান করিতেছে। তা ছাড়া কিছু অঙ্গারক বাষ্প ও জলীয় বাষ্পও আছে। মাথার উপরে কোন জিনিষ চাপিয়া থাকিলে, তাহা বাহকের মস্তকে বিলক্ষণ চাপ দেয়। আমাদের ধরিত্রী সর্ব্বংসহা হইলেও, তাহাকে ঘেরিয়া যে, নাইট্রোজেন্ অক্সিজেন্ প্রভৃতি বায়বীয় পদার্থ রহিয়াছে, তাহা ভূপৃষ্ঠে চাপ দিতে ছাড়ে না। হিসাব করিলে দেখা যায়, আকাশের বায়বীয় পদার্থ এখন প্রতি বর্গইঞ্চিপরিমিত স্থানে প্রায় ৭০০ সের চাপ দিয়া থাকে। নদনদী সাগরমহাসাগরাদির জলরাশি এবং আমাদের ভূপৃষ্ঠের অধিকাংশ উপাদানই যখন বায়বীয় আকারে সদ্যোজাত পৃথিবীকে ঘেরিয়া ছিল, তখন পৃথিবীর উপরে আকাশের চাপের পরিমাণ যে, অত্যন্ত অধিক ছিল তাহা সহজেই অনুমান করা যায়। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ শিশু পৃথিবীর উপরকার চাপের পরিমাণ হিসাব করিয়া, প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে অন্ততঃ ৬২ মণ হইতে দেখিয়াছেন। এখন প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে আকাশের বায়ুরাশি যে সাড়ে সাত সের চাপ দেয়, তাহার পরিচয় আমরা হঠাৎ পাই না, কিন্তু আমাদের অলক্ষ্যে উহা অনেক কাজ করে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহযন্ত্রগুলির কথা স্মরণ করিলে বায়ুর চাপ দ্বারাই ইহাদের অনেকগুলিকে নিয়ন্ত্রিত হইতে দেখা যায়। সেই অত্যুষ্ণ দ্রব পদার্থময় ধরাপৃষ্ঠে তখন জীবের বাস ছিল না, কাজেই জীবের উপরে সেই বিশাল ৬২ মণ চাপের কোনই কার্য্য দেখা যাইত না, কিন্তু ইহা দ্বারা সেই সময়ে ভূপৃষ্ঠের যে কোন পরিবর্ত্তন হয় নাই একথা বলা যায় না।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি, কোন নীহারিকা-রাশি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আমাদের পৃথিবী যখন মূর্ত্তি গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তখন ভূপৃষ্ঠ অত্যুষ্ণ দ্রব পদার্থে আচ্ছন্ন ছিল, এবং ইহার উপরে আবার আবর্ত্তনবেগটাও অত্যন্ত অধিক ছিল; সুতরাং অনুমান করিতে পারা যায় যে, পৃথিবীর নিরক্ষ-বৃত্তের (Equator) চারিদিকে দ্রব পদার্থগুলি একত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই অনুমান যে যথার্থ, পৃথিবীর বর্ত্তমান আকৃতি হইতে তাহা সুস্পষ্ট বুঝা যায়; আবর্ত্তনবেগের প্রাবল্যে যে-সকল দ্রব পদার্থ নিরক্ষ-প্রদেশে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল, কালক্রমে তাহাই জমাট বাঁধিয়া এখন নিরক্ষ-প্রদেশকে মেরুপ্রদেশের তুলনায় কিঞ্চিৎ স্ফীত করিয়া তুলিয়াছে। কিন্তু শিশু পৃথিবীর প্রবল আবর্ত্তন-বেগ কেবল মেরুপ্রদেশকে কিছু চাপা করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই; নানা বায়বীয় পদার্থে পূর্ণ পৃথিবীর আকাশের উপরেও উহার কার্য্য ছিল বলিয়া মনে হয়। আকাশের বায়ব-পদার্থগুলি আবর্ত্তনের বেগে নিরক্ষ-প্রদেশের উপরকার আকাশে সঞ্চিত হইয়া সম্ভবতঃ পৃথিবীর বায়ব-আবরণের গভীরতা বৃদ্ধি করিত। বাষ্পাবরণ যেখানে গভীর তথাকার উষ্ণ দ্রব্য সহজে শীতল হইতে চাহে না; অগভীর আবরণের ভিতরকার জিনিষই তাপ ত্যাগ করিয়া অল্প সময়ে শীতল হইয়া পড়ে। নিরক্ষ-প্রদেশের উপরকার আকাশে অধিক বায়বীয় পদার্থ সঞ্চিত হইয়া পড়ায়, পৃথিবীর মেরুপ্রদেশের বাষ্পাবরণের গভীরতা নিশ্চয় কমিয়া আসিয়াছিল এবং ইহাতে নিরক্ষপ্রদেশের তুলনায় মেরুপ্রদেশের দ্রব পদার্থগুলি শীতলতর হইয়াছিল। জল গরম করিতে গেলে যেমন পাত্রের নিম্নের জল অগ্নির তাপে স্ফীত হইয়া উপরে উঠে এবং উপরকার শীতল জল নীচে নামিয়া পাত্রে এক প্রকার প্রবাহের উৎপত্তি করে, পৃথিবীর নিরক্ষ-প্রদেশের উষ্ণ দ্রব পদার্থ এবং মেরুপ্রদেশের অপেক্ষাকৃত শীতল তরলপদার্থ, এই দুইটির মধ্যে সম্ভবতঃ এই প্রকারেরই প্রবাহ দীর্ঘকাল ব্যাপিয়া চলিয়াছিল। বলা বাহুল্য, এই প্রবাহ পৃথিবীর তাপক্ষয়ের বিশেষ সহায় হইত এবং আকাশের স্থান বিশেষে সঞ্চিত গভীর বাষ্পরাশি, অগভীর আকাশের দিকে ছুটাছুটি করিয়াও পৃথিবীর তাপ হরণ করিত।

 ভুপৃষ্ঠের দ্রবপদার্থের স্তূপে এবং আকাশের ঘন বাষ্পরাশিতে পূর্ব্বোক্ত প্রবাহ কত কাল চলিয়াছিল, তাহা অনুমান করাও কঠিন, কিন্তু ইহার পরেই যে, অত্যুষ্ণ দ্রবপদার্থের স্থানে স্থানে ভাসমান কঠিন পদার্থ দেখা দিতে আরম্ভ করিয়াছিল, তাহা নিশ্চিত। এই সময়কেই পৃথিবীর স্থলসংস্থানের প্রারম্ভ বলিতে হয়। এখন আমাদের মহাসমুদ্রগুলি যেমন জলে আবৃত রহিয়াছে, প্রাচীনকালে সমগ্র ভূপৃষ্ঠ সেই প্রকার এক দ্রবপদার্থে আবৃত ছিল বটে, কিন্তু এই দ্রবপদার্থের ঘনতা সকল স্থানে সমান ছিল না। যেখানে অধিক তাপ সেখানে তাহা খুবই তরলাকারে থাকিত, এবং যেখানে অল্প উত্তাপ তথায় উহাই হয় ত জমিয়া দ্বীপের সৃষ্টি করিত।

 সূর্য্য বহু দূরে অবস্থান করিয়াও পৃথিবীর উপরে প্রভুত্ব প্রকাশ করিতে ক্ষান্ত হয় না। এখন ধরাপৃষ্ঠ শীতল হইয়া কঠিন মৃত্তিকা ও শিলায় পরিণত হইয়াছে, কাজেই সূর্য্যের টানে ভূপৃষ্ঠের কোন প্রত্যক্ষ পরিবর্ত্তন দেখা যায় না, কিন্তু সমুদ্র-জলের উপরে ঐ টানের প্রভাব প্রতিদিনই দেখা যায়। আধুনিক সমুদ্রের জল টানিয়া সূর্য্য যে-সকল প্রবল জলোচ্ছ্বাস উৎপন্ন করে তাহার শক্তি নিতান্ত অল্প নহে, প্রাচীনকালে যথন দ্রবধাতুময় সমুদ্র ব্যতীত ভুপৃষ্ঠে আর কিছুই ছিল না, সেই সময়ে সূর্য্যের আকর্ষণ-জনিত জোয়ার-ভাঁটা যে কত প্রবল বেগে চলিত তাহা আমরা অনুমান করিতে পারি। তখন পৃথিবীর কেন্দ্র স্থানটিও হয়ত সম্পূর্ণ কঠিনাকার প্রাপ্ত হয় নাই, কাজেই সূর্য্যের জোয়ারের টান ভুগর্ভের গভীরতম অংশ পর্য্যন্ত পৌঁছিত। পৃথিবীর উপগ্রহ চন্দ্র বয়সে পৃথিবী অপেক্ষা অনেক ছোট,—আধুনিক জ্যোতিষশাস্ত্রের মতে ইহা পৃথিবীরই আত্মজ। ভূতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতগণ অনুমান করেন, পৃথিবী যখন সদ্য সদ্য তরল পদার্থে পরিণত হইয়াছিল এবং এই তরল পদার্থের উপরে যখন সূর্যের আকর্ষণে প্রবল জোয়ার-ভাঁটা চলিতেছিল, সম্ভবতঃ সেই সময়েই আমাদের চন্দ্রের জন্ম হইয়াছিল। সূর্য্যের আকর্ষণই চন্দ্রের জন্মের কারণ। সূর্য্য পৃথিবীকে এখন যে প্রকার বলে টানিয়া সমুদ্রের জলে জোয়ার-ভাঁটার উৎপত্তি করে, তখনও উহা হয় ত ঠিক সেই প্রকার বলেই টানিত, কিন্তু তখনকার টান্ তরল পৃথিবীকে বড়ই চঞ্চল করিয়া তুলিত এবং এই টানে পড়িয়াই পৃথিবীর এক অংশ বিচ্ছিন্ন হইয়া চন্দ্রের উৎপত্তি করিয়াছিল। জ্যোতিষিগণ অনুমান করেন, চন্দ্রের জন্মকালে পৃথিবী তাহার ভ্রমণ-পথের সহিত এগারো বা বারো ডিগ্রি পরিমিত হেলিয়া দুই বা তিন ঘণ্টায় এক একবার পূর্ণাবর্ত্তন (Rotation) শেষ করিত। চন্দ্রের উৎপত্তি সম্বন্ধে অনেক মতবাদ জ্যোতিষিক গ্রন্থে দেখা যায়, কিন্তু আজ এই সিদ্ধান্তটির উপরে সকলে বিশ্বাস স্থাপন করিতেছেন।

 উষ্ণ দ্রবপদার্থের একটা বিশেষ ধর্ম্ম এই যে, ইহা অনেক বায়বীয় পদার্থ শোষণ করিয়া রাখিতে পারে। যে উপাদানে চন্দ্রের উৎপত্তি হইয়াছিল, তাহা যথেষ্ট উষ্ণ ছিল, তাছাড়া প্রতি বর্গইঞ্চি স্থানে ৬২ মণ পরিমিত চাপ পড়ায় তাহার অন্তর্নিহিত বাষ্পের পরিমাণ আরো বাড়িয়া চলিয়াছিল। এই অবস্থায় যখন উহা পৃথিবী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া দূরে উপনীত হইয়াছিল, তখন ঐ বাষ্পরাশি আর আবদ্ধ থাকিতে পারে নাই; চাপমুক্ত হইয়া চন্দ্রদেহ হইতে বাহির হইবার জন্য তাহার এক স্বাভাবিক চেষ্টা দেখা দিয়াছিল। আধুনিক জ্যোতিষিগণ বলেন, চন্দ্রের দেহে যে অসংখ্য নির্ব্বাপিত আগ্নেয়গিরির চিহ্ন দেখা যায়, সেগুলি উক্ত আবদ্ধ বাষ্পেরই কাজ। যখন চন্দ্র পৃথিবীর দেহাভ্যন্তরে ছিল, তখন পৃথিবীর আকাশের প্রবল চাপ ঐ বাষ্পকণিকাকে বাহির হইতে দেয় নাই; কিন্তু যখনই উহা পৃথিবী ত্যাগ করিয়া চাপমুক্ত হইয়া পড়িয়াছিল, তখন হইতেই বাহির হইবার জন্য যেন উহাতে নূতন বলের সঞ্চার হইয়াছিল। জমাট চন্দ্রদেহের আবরণ ভেদ করিয়া ঐ আবদ্ধ বাষ্পরাশি বাহির হইবার সময়ে যে সকল বৃহৎ গহ্বর রচনা করিয়াছিল, তাহাদিগকেই আমরা এখন দূর হইতে আগ্নেয়গিরির আকারে দেখিতেছি। কোন সংকীর্ণ স্থানে আবদ্ধ বারুদে আগুন দিলে যে বাষ্প উৎপন্ন হয়, তাহা পাত্রটিকে খণ্ড খণ্ড করিয়া বহির্গত হয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে পাত্রের দুই চারিখানি ভগ্ন অংশও বহিয়া লইয়া দূরে ফেলিয়া দেয়। পণ্ডিতগণ বলেন, চন্দ্রদেহের আবদ্ধ বাষ্প যখন সবেগে বাহির হইতে আরম্ভ করিয়াছিল, তখন সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রের দেহের টুক্‌রা উর্দ্ধে উৎক্ষিপ্ত করিয়াছিল। এই টুক্‌রাগুলিই ক্ষুদ্র জ্যোতিষ্কের আকারে বহুদিন আকাশে ঘুরিয়া পৃথিবীর আকর্ষণের সীমায় আসিলে এখন উল্কাপিণ্ডের আকারে ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়। অনেক উল্কাপিণ্ডই আমাদের আকাশের বায়ুর ভিতর দিয়া আসিবার সময়ে, বায়ুর ঘর্ষণজ তাপে জ্বলিয়া পুড়িয়া ভস্ম হইয়া যায়, এবং যেগুলি খুব বড় সেগুলিরই দগ্ধাবশেষ ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। এই সকল উল্কার গঠনোপাদান পরীক্ষা করিলে আমাদের পৃথিবীর শিলামৃত্তিকার সকল উপাদানগুলিই তাহাতে একে একে ধরা পড়িয়া যায়। উল্কাপিণ্ডগুলি এখন স্বাধীন জ্যোতিষ্কের আকারে বিচরণ করিলেও দূর অতীত কালে উহা যে, পৃথিবীর আত্মজ চন্দ্রেরই কুক্ষিগত ছিল, পূর্ব্বোক্ত প্রমাণগুলির কথা স্মরণ করিয়া অনেকেই ইহা স্বীকার করিতেছেন।

 যাহা হউক চন্দ্রের জন্ম সময়ে পৃথিবীর যে এক সঙ্কটকাল উপস্থিত হইয়াছিল, ইহা নিশ্চিত। চন্দ্র জন্মগ্রহণ করিয়াই দূরে গমন করে নাই; পৃথিবী হইতে এখন চন্দ্রের যে দূরত্ব দেখিতেছি, তাহা অতি ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময়ে হইয়াছে। অতি নিকটে থাকিয়া চন্দ্র পৃথিবীর উপর কি প্রকার প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল তাহা জানিবার উপায় নাই, এবং সেসম্বন্ধে কোন অনুমান করাও চলে না। ক্রমে দুরবর্ত্তী হইয়া চন্দ্র যখন পৃথিবী হইতে ছত্রিশ হাজার মাইল দূরে অবস্থান করিতেছিল, সেই সময়ের অবস্থার কথা পণ্ডিতগণ অনুমান করিতে পারেন। এই ব্যবধানে যাইতে কত সময় লাগিয়াছিল তাহাও গণনা করা যায়। এই প্রকার গণনায় দেখা গিয়াছে, জন্মগ্রহণের পর অন্ততঃ পাঁচ কোটী ষাইট্ লক্ষ বৎসর অতিবাহন না করিয়া চন্দ্র কখনই পৃথিবী হইতে ছত্রিশ হাজার মাইল দূরে যাইতে পারে নাই।

 পৃথিবীর অভ্যন্তরে কি আছে, ইহা লইয়া আধুনিক ও প্রাচীন পণ্ডিতমহলে অনেক বাগ্‌বিতণ্ডা হইয়া গিয়াছে। যাহা হউক পণ্ডিতদিগের মধ্যে অনেকেই স্বীকার করেন, আমরা ভূপৃষ্ঠে যে শিলামৃত্তিকা দেখিতেছি, তাহা ভূগর্ভের কেবল চারিশত মাইল পর্য্যন্ত বিস্তৃত আছে, তাহার নীচে আকেন্দ্র সমস্ত স্থানই লৌহ প্রধান গুরুপদার্থে পূর্ণ। শিলামৃত্তিকাদি গড়ে জল অপেক্ষা তিন গুণ অধিক ভারি, কিন্তু গভীরতর প্রদেশের সেই ধাতুজ দ্রব্যের গুরুত্ব জল অপেক্ষা প্রায় আট গুণ অধিক। বৈজ্ঞানিকগণ বলেন, যখন চন্দ্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিল তখন পৃথিবীর ধাতুজ অংশটা বোধ হয় ভূ-কেন্দ্রে কঠিনাবস্থাতেই ছিল; কেবল ভূপৃষ্ঠের শিলামৃত্তিকারই উপাদান দ্রব ও বায়ব আকারে পৃথিবীকে ঘেরিয়া অবস্থান করিতেছিল। কাজেই চন্দ্র তাহার নিজের দেহখানি পৃথিবীর শিলামৃত্তিকা দিয়াই প্রস্তুত করিতে পারিয়াছিল; ভূগর্ভের গভীর প্রদেশে যে ধাতব দ্রব্য ছিল তাহা নিজের দৈহিক পুষ্টির জন্য স্পর্শ করিতে পারে নাই।

 বৈজ্ঞানিকগণ মনে করেন, চন্দ্রের জন্মের কিছুকাল পরেই পৃথিবী আমূল কঠিনাকার প্রাপ্ত হইয়াছিল। কিন্তু তখনও ভূ-পৃষ্ঠের উত্তাপ কখনই সেণ্টিগ্রেডের এগারো শত সত্তর ডিগ্রির কম ছিল না, কাজেই সে সময়ে আকাশ এখনকার মত নির্ম্মল হইতে পারে নাই; প্রাথমিক বাষ্পের অবশেষ এবং জলীয় বাষ্প আকাশকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিত। পৃথিবীকে আমরা এখন যে আকারে দেখিতে পাইতেছি, তাহা এই সময়েই একে একে প্রকাশ পাইতে আরম্ভ করিয়াছিল। বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকগণ এই বিষয়টি লইয়া দীর্ঘ গবেষণা করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে এই অবস্থাটি আজ হইতে অন্ততঃ দুই কোটী বৎসর পূর্ব্বে পৃথিবীতে দেখা দিয়াছিল। ভূপৃষ্ঠ কঠিনাকার প্রাপ্ত হইলেও তখন উহার উপরের কিছু দুর কর্দ্দমবৎ কোমল ছিল ইহা স্বীকার করিতেই হয়। কাজেই ভূপৃষ্ঠের যে অংশে আকাশের চাপ অধিক গড়িত তাহা তখন নীচু হইয়া যাইত এবং যে-সকল স্থানের উপরে চাপ অল্প ছিল তাহা উঁচু হইত। ভূপৃষ্ঠের উপরিস্থিত পাহাড়পর্ব্বতে এবং নদীসমুদ্রে এখন যে উঁচুনীচু ভাবটা সুস্পষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়াছে, পৃথিবীর এই সময়টাকেই তাহার আরম্ভ বলা যাইতে পারে।

 পৃথিবী নিজের দেহের তাপ বর্জ্জন করিতে করিতে যখন ৩৭ ডিগ্রি পরিমিত উষ্ণ হইয়া পড়িয়াছিল, তখন ভূপৃষ্ঠের আর একটি বিশেষত্ব দেখা দিয়াছিল। আকাশের জলীয় বাষ্পরাশি তাপাধিক্যপ্রযুক্ত এ পর্য্যন্ত জমাট বাঁধিতে পারে নাই, কাজেই ভূ-পৃষ্ঠে বিন্দুপ্রমাণ জলেরও অস্তিত্ব ছিল না। এই সময়ে উত্তাপ ৩৭ ডিগ্রিতে নামিয়া পড়ায়, আকাশের জলীয় বাষ্পরাশি অত্যুষ্ণ বৃষ্টির ধারাকারে ভূতলে পতিত হইতে আরম্ভ করিয়াছিল, এবং তাহাই নিম্নভূমিতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া আধুনিক সমুদ্রের ভিত্তি স্থাপন করিতেছিল।

 ভূপৃষ্ঠের অগভীর প্রাথমিক সমুদ্রগুলি কিপ্রকারে গভীরতর হইয়া বর্ত্তমান আকার প্রাপ্ত হইয়াছে, সেসম্বন্ধে অনেক সিদ্ধান্তের কথা শুনিতে পাওয়া যায়। আমরা এগুলির মধ্যে কেবল একটিমাত্রের উল্লেখ করিব। ব্যাপারটি বুঝিতে হইলে জড়ের একটি সুপরিচিত ধর্ম্মের কথা স্মরণ করা প্রয়োজন। আমরা পৃথিবীতে যত সামগ্রী দেখিতে পাই, তাহাদের প্রত্যেকেই এক একটি নির্দ্দিষ্ট উত্তাপ পাইলে দ্রব হয়। লৌহকে অল্প তাপ দিতে থাক, তাহা গলিবে না, কিন্তু প্রযুক্ত তাপের মাত্রা ১১৫০° ডিগ্রিতে উঠিলেই উহা গলিতে আরম্ভ করিবে। কেবল লৌহ নয়, স্বর্ণ রৌপ্য তাম্র শিলা মৃত্তিকা সকল বস্তু ঐ লৌহের ন্যায়ই এক একটি নির্দ্দিষ্ট উষ্ণতায় গলিতে আরম্ভ করে। কিন্তু এই প্রকারে দ্রব হওয়ার সহিত বাহিরের চাপের একটা অতি নিকট সম্বন্ধ আছে। যে-পাত্রে ধাতুকে গালানো যাইতেছে, তাহার ভিতরে যদি কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করা যায়, তাহা হইলে সাধারণ বায়ুর চাপে উহা যে উষ্ণতায় গলিয়া যাইত, এখন আর সে উষ্ণতায় গলিবে না। উষ্ণতা অধিক লাগিবে। জড়ের এই সুপরিচিত ধর্মটির কথা মনে রাখিয়াই বৈজ্ঞানিকগণ বলেন, ভূগর্ভের কেন্দ্রসন্নিহিত স্থান খুব উষ্ণ হইলেও তথাকার ধাতুমৃত্তিকা দ্রবাবস্থায় নাই; উপরিস্থিত চারি হাজার মাইল গভীর শিলা মৃত্তিকার স্তরগুলি কেন্দ্র-সন্নিহিত পদার্থে যে চাপ প্রয়োগ করিতেছে তাহা অতিক্রম করিয়া লৌহ প্রভৃতি ধাতুকে দ্রবীভূত করিতে পারে এমন উত্তাপ পৃথিবীর কেন্দ্রে নাই। কাজেই যদি কেহ বলেন, ভূপৃষ্ঠে এক শত বা দুই শত মাইল নীচেকার পদার্থ গলিতাবস্থায় আছে, তাহা বিশ্বাস করা যায়। কারণ সেখানে তাপের তুলনায় চাপ অল্প। কিন্তু যদি কেহ বলিয়া ফেলেন যে, পৃথিবীর কেন্দ্র প্রদেশ কেবল দ্রব ধাতুতেই পূর্ণ, তবে তাহা কোন ক্রমে বিশ্বাস করা যায় না।

 পূর্ব্বোক্ত ব্যাপারটি অবলম্বন করিয়া আধুনিক বৈজ্ঞানিক গণ সমুদ্রের ক্রমিক প্রসারতালাভের যে ব্যাখ্যান দিয়াছেন, এখন তাহা আলোচনা করা যাউক। পৃথিবীর অধিকাংশ সমুদ্রেরই গভীরতা আমাদের জানা আছে, সুতরাং সমগ্র সমুদ্রের জলের পরিমাণও হিসাব করা যায়। এই হিসাবে সমুদ্রের গড় গভীরতা দুই মাইল সাত শত গজের কিঞ্চিৎ কম হয়। পৃথিবীর জল, নদী ও সমুদ্রের গর্ভে আশ্রয় গ্রহণ না করিয়া যদি সমভাবে সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠে বিস্তৃত থাকিত, তাহা হইলে জলের গভীরতা কত হইত তাহাও হিসাব করা হইয়াছে। ইহাতে দেখা গিয়াছে, সমুদ্রের জল ভূপৃষ্ঠের সর্ব্বাঙ্গে ছড়াইয়া পড়িলে জলের গভীরতা এক মাইল বারো শত গজের কিঞ্চিৎ অধিক হইয়া দাঁড়ায়। কাজেই স্বীকার করিতে হইতেছে, সমুদ্রের জল যখন বাষ্পাকারে আকাশে ভাসমান ছিল তখন উহা এক মাইল বারো শত গজ উচ্চ জলের চাপের অনুরূপ বলে ভূপৃষ্ঠকে চাপিয়া রাখিত। এখন মনে করা যাউক, যেন এক দিন হঠাৎ আকাশের সমগ্র জলীয় বাষ্প জমিয়া ভূপৃষ্ঠের নিম্ন ভূমিতে আশ্রয়গ্রহণ করিল। বলা বাহুলা, ইহাতে স্থলভাগের উপরকার চাপই কমিয়া আসিবে, এবং নিম্ন ভূমির যে-সকল অংশে জল সঞ্চিত হইল তাহার উপরকার চাপ বাড়িয়া যাইবে। সমুদ্রের উৎপত্তির পরে, এই প্রকারে স্থলভাগের উপরকার চাপ বৃদ্ধি হওয়াকে অবলম্বন করিয়াই পণ্ডিতগণ সমুদ্রের ক্রমিক প্রসারের ব্যাখ্যান দিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইঁহারা বলিতেছেন, স্থলভাগে যখন জলীয় বাষ্পের চাপ ছিল, তখন প্রচুর উষ্ণ থাকা সত্ত্বেও ভূগর্ভের অনেক দূর কঠিনাবস্থায় ছিল, কারণ চাপের আধিক্য থাকিলে কোন জিনিষ, সহজে গলিতে চায় না। জলের উৎপত্তির সহিত এই চাপ অন্তর্হিত হইবামাত্র স্থলভাগের নিম্ন স্তরগুলি আর কঠিনাকারে থাকিতে পারে নাই। ভূগর্ভস্থ তাপ এই অবস্থায় পূর্ব্বের কঠিন শিলা মৃত্তিকাগুলিকে গলাইয়া স্ফীত করিয়া তুলিয়াছিল; কাজেই জলাচ্ছাদিত অংশ অপেক্ষা জলবর্জ্জিত স্থলভাগটাই উচ্চ হইয়া সমুদ্রকেই তুলনায় গভীরতর করিয়াছিল।

 পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি কেবল অনুমানমূলক নহে। চাপ প্রয়োগ করিয়া কোন অত্যুষ্ণ জিনিষকে গলিতে না দিয়া, চাপের বা তাপের সামান্য হ্রাসবৃদ্ধি করিতে থাকিলে তাহাতে যে, আকুঞ্চন-প্রসারণ দেখা যায়, নানা পরীক্ষায় তাহা প্রমাণিত হইয়াছে। অঙ্গারক বাষ্পকে শীতল করিলে তাহা তরলাকার প্রাপ্ত হয়। এই তরল অঙ্গারক-বাষ্পের ১২০ ঘন ইঞ্চি লইয়া ৩০° ডিগ্রি উত্তাপ দিলেই তাহা ১৫০ ঘন ইঞ্চি হইয়া দাঁড়ায়, অথচ জিনিষটা তরলাবস্থাতেই থাকে। এই সকল প্রমাণের বিষয় আলোচনা করিলে মনে হয়, শিশু পৃথিবীতে উচ্চ-নিম্ন ভূমির উৎপত্তি এবং জন্মস্থলের সংস্থানসম্বন্ধে আধুনিক পণ্ডিতগণ যে সিদ্ধান্ত করিতেছেন, তাহা একবারে অযৌক্তিক নয়।

 ভূপৃষ্ঠের বৈচিত্র্যবিধানে রাসায়নিক কার্য্যের প্রভাব নিতান্ত অল্প নয়। বায়ু ও জলের প্রবাহ প্রভৃতি শক্তি ভূতলের মূর্ত্তি ফিরাইয়া দেয় সত্য, কিন্তু আমাদের অলক্ষ্যে রাসায়নিক সংযোগ-বিয়োগ যে-সকল পরিবর্ত্তনের সূত্রপাত করে, তাহা উপেক্ষার বিষয় নহে। পণ্ডিতগণ অনুমান করিতেছেন, আমাদের পৃথিবীর শৈশবের শেষ ভাগে অপরাপর শক্তির সহিত রাসায়নিক শক্তিও কার্য্য করিয়াছিল। ভূতলে যখন প্রাথমিক সমুদ্রগুলির উৎপত্তি হইয়াছিল, তখন সমুদ্র-জল কখনই এখনকার জলের ন্যায় শীতল ছিল না। ইহার উষ্ণতা নিশ্চয়ই এখনকার ফুটন্ত জলের উষ্ণতা অপেক্ষাও অধিক ছিল। ভূপৃষ্ঠের ঊর্দ্ধ স্তরগুলি যে-সকল উপাদানে গঠিত, তাহার সহিত গরম জল প্রবল রাসায়নিক কার্য্য শুরু করিয়া থাকে। কাজেই সমুদ্রের উৎপত্তি হইবামাত্র ভূপৃষ্ঠে রাসায়নিক শক্তি কার্য্য আরম্ভ করিয়াছিল। সমুদ্রতলের গভীর প্রদেশে যে নানা রাসায়নিক পদার্থের স্তর দেখা যায়, তাহা ঐ কার্য্যেরই চিহ্ন।

 আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে পৃথিবীর শৈশব-ইতিবৃত্ত যতটুকু সংগ্রহ করা যাইতে পারে, তাহা মোটামুটিভাবে লিপিবদ্ধ হইল। ইহার পরে স্তরবিন্যাস প্রভৃতিতে পৃথিবীর যে পরিবর্ত্তন হইয়াছিল, এবং সঙ্গে সঙ্গে ভূপৃষ্ঠে যে হরণ-পূরণ চলিয়াছিল, তাহার ধারা আজও লোপ পায় নাই। এই পরিবর্ত্তনের ধারা কি প্রকারে শিশু পৃথিবীকে যৌবনে উপনীত করিয়া শেষে প্রৌঢ়ত্ব প্রদান করিয়াছে, তাহা আমরা পৃথক্ প্রবন্ধে আলোচনা করিব।