প্রাকৃতিকী/প্রাণিদেহের উত্তাপ

উইকিসংকলন থেকে

প্রাণিদেহের উত্তাপ

দেহকে উত্তপ্ত রাখা প্রাণীর একটা বিশেষত্ব। উদ্ভিদের দেহেও তাপ আছে, কিন্তু প্রাণিদেহে ইহা যেমন সুস্পষ্ট, উদ্ভিদের দেহে তেমন নয়। সাধারণ নির্জীব বস্তুকে কোন স্থানে রাখিলে, সেখানকার উষ্ণতা সে গ্রহণ করে। লৌহ গোলককে রৌদ্রে রাখিলে সেটি রৌদ্রের উষ্ণতাই গ্রহণ করে; বরফে ডুবাইয়া রাখিলে বরফের উষ্ণতাই গোলকটির উষ্ণতা হইয়া দাঁড়ায়। অর্থাৎ চারিদিকের বায়ু-মৃত্তিকার ন্যায় উষ্ণ হইবার একটা চেষ্টা নির্জীব পদার্থমাত্রেই আছে। সজীব বস্তু তাপের গ্রহণ-বর্জ্জনে এই নিয়ম মানিয়া চলে না। নানাজাতীয় প্রাণীর মধ্যে প্রত্যেকেরই দেহে এক একটা নির্দ্দিষ্ট উষ্ণতা আছে। সেই উষ্ণতাকে রক্ষা করিয়া যখন চলা-ফেরা করিতে পারে, তখনি প্রাণী সুস্থ থাকে। কোন কারণে উষ্ণতার ন্যূনাধিক্য ঘটিলেই বুঝিতে হয়, তাহারা অসুস্থ। সুস্থ মানুষের দেহের উষ্ণতার মাত্রা ফার্ণহিটের যন্ত্রের প্রায় সাড়ে আটানব্বুই ডিগ্রি। খুব শীতল বা গরম স্থানে রাখিলেও সুস্থ মানবদেহের উষ্ণতা এই সীমার উপরে উঠে না এবং নীচেও নামে না। যদি সেই সাড়ে আটানব্বুই কখন নিরানব্বুই হইয়া দাঁড়ায়, তখন বুঝিতে হয় মানুষ অসুস্থ। সুস্থ মানবদেহেরই যে, উষ্ণতার মাত্রা নির্দ্দিষ্ট আছে তাহা নয়, আণুবীক্ষণিক জীবাণু হইতে আরম্ভ করিয়া অতিকায় হস্তী গণ্ডার প্রভৃতি সকল জীবেরই দৈহিক তাপ নির্দ্দিষ্ট আছে!

 প্রাণিদেহের তাপরক্ষার বিষয়টা প্রাচীন পণ্ডিতদিগেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। জলস্থল ও আকাশের কোন স্থূল ঘটনাই মহাপণ্ডিত আরিষ্টটলের তীক্ষ্ণদৃষ্টিকে এড়াইতে পারে নাই। সেই অবৈজ্ঞানিক যুগে প্রত্যেক প্রাকৃতিক ঘটনারই তিনি এক একটা সহজ ব্যাখ্যা দিবার চেষ্টা করিতেন। প্রাণিদেহের উষ্ণতা-সম্বন্ধে তিনি বলিতেন, কাঠ পোড়াইয়া বা কাঠে কাঠে ঘর্ষণ করিয়া আমরা যে তাপ উৎপন্ন করি, তাহা শারীরিক তাপ হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মহাকাশের অধিবাসী জ্যোতিষ্কগণ যে অগ্নি ধারণ করিয়া আছে, তাহারি দুই এক স্ফুলিঙ্গ প্রাণিদেহে আশ্রয় গ্রহণ করে বলিয়াই তাহা এত উষ্ণ। মহাকাশের জ্যোতিষ্কদিগের অত্যাশ্চর্য্য গতিবিধি লক্ষ্য করিয়া আরিষ্টটল্ তাহাদিগকে বুদ্ধিমান জীবের পর্য্যায়ে ফেলিতেন।

 এই ত গেল দেহতাপের পুরাবৃত্তের কথা। বলা বাহুল্য, পরবর্ত্তী বৈজ্ঞানিকগণ ঐ সকল কথায় বিশ্বাস করেন নাই। সপ্তদশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিকগণ অক্সিজেনের অস্তিত্ব জানিতেন না। কাঠ ও কয়লা ইত্যাদির দহনের কারণ নির্দ্দেশ করিতে গিয়া, ইঁহারা বায়ুতে মিশ্রিত কোন এক দাহ্য পদার্থের অস্তিত্ব কল্পনা করিয়া লইতেন এবং তাহাই কাঠ ও কয়লাকে পোড়ায় বলিয়া সিদ্ধান্ত করিতেন। প্রাণিদেহের তাপের কথা জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহারা বলিতেন, সাধারণ দাহ্য পদার্থ যেমন বায়ুতে পুড়িয়া তাপের উৎপত্তি করে, বায়ুতে মিশ্রিত সেই অজ্ঞাত পদার্থ ভুক্তদ্রব্যকে দেহের অভ্যন্তরে পোড়াইয়া সেই প্রকারে দেহকে উষ্ণ রাখে। প্রিষ্ট্‌লি ও ল্যাভোসিয়ার কর্ত্তৃক অক্সিজেনের আবিষ্কার হইলে সকলেই বুঝিয়াছিলেন, বায়ুর অক্সিজেনই দাহ্য-পদার্থের অঙ্গার ও হাইড্রোজেনের সহিত মিলিত হইবার সময়, যে তাপের উৎপত্তি করে তাহাই অগ্নির তাপ। অগ্নি-তাপের এই ব্যাখ্যানে দেহ-তাপেরও উৎপত্তি নির্ণীত হইয়া পড়িয়াছিল। বৈজ্ঞানিকগণ বলিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, সাধারণ দাহ্যবস্তুর উপাদান যেমন বায়ুর অক্সিজেনের সহিত মিলিয়া তাপের উৎপত্তি করে, ভুক্তদ্রব্যের অঙ্গার ও হাইড্রোজেন ঠিক্ সেই প্রকারে অক্সিজেনের সহিত মিলিয়া দেহ-তাপের সৃষ্টি করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে অক্সিজেনের আবিষ্কার হইলে দেহজ তাপের এই সিদ্ধান্তটিই প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল, আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও মূলে ইহাকে স্বীকার করিতেছেন। ল্যাভোসিয়ার সাহেব বলিতেন, প্রাণীর শ্বাসযন্ত্রই তাপের উৎপত্তিস্থান; শোণিতের সহিত সেই তাপ সর্ব্বাঙ্গে চালিত হইলে দেহ উত্তপ্ত হয়। বলা বাহুল্য, তাপোৎপত্তির স্থান-সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তটিকে এখন আর কেহ স্বীকার করেন না। মাংসপেশী (Muscles) এখন শারীরিক তাপের কেন্দ্র বলিয়া স্বীকৃত হইতেছে; এবং তন্মধ্যে হৃৎপিণ্ড যকৃৎ প্রভৃতির পেশীতে যে তাপ উৎপন্ন হয়, তাহাই পরিমাণে অধিক বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে।

 শরীর হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরও যে, রক্তহীন মাংসপেশী তাপের উৎপত্তি করে, জর্ম্মান্ পণ্ডিত হেলম্‌হোজ্ একাধিক পরীক্ষায় তাহা সুস্পষ্ট দেখাইয়াছেন। ভেকের দেহ হইতে নিঃশেষে সমস্ত রক্ত বহির্গত করিয়া, শিরায় উপশিরায় লবণের জল চালাইতে থাকিলে, দেহের উষ্ণতা কমে না; সুস্থ অবস্থায় শ্বাস প্রশ্বাসের সহিত যেমন অঙ্গারক বাষ্প বাহির হয়, এখানেও তাহা সেই প্রকারেই বাহির হইতে থাকে। রক্তের সহিত যে দেহের উষ্ণতার বিশেষ সম্বন্ধ নাই, তাহা এই পরীক্ষায় বেশ বুঝা যায়।

 দেহের উষ্ণতা লইয়া প্রাণিজাতিকে উষ্ণশোণিত (Homeiothermic) এবং শীতলশোণিত (Poikilothermic) নামক যে দুই শ্রেণীতে বিভাগ করা হয় তাহার বিশেষ পরিচয় প্রদান নিষ্প্রয়োজন। যে-সকল প্রাণী চারিপার্শ্বের উষ্ণতা অনুসারে দেহের উষ্ণতাকে পরিবর্ত্তিত করিতে পারে, সেগুলি শীতলশোণিত প্রাণী নামে পরিচিত। সর্প, সরীসৃপ, ভেক, পতঙ্গ প্রভৃতি প্রাণী এই শ্রেণীভুক্ত। স্তন্যপায়ী প্রাণী বা পক্ষিজাতি খুব ঠাণ্ডা বা গরমে পড়িলেও দেহের উষ্ণতাকে এক একটি নির্দ্দিষ্ট সীমার উপরে বা নীচে যাইতে দেয় না। এই জন্য ইহারা উষ্ণশোণিত প্রাণী বলিয়া পরিচিত। কেবল দেহের উষ্ণতা দেখিয়া প্রাণিজাতির এই শ্রেণীবিভাগ প্রচলিত থাকিলেও, জীবতত্ত্ববিদ্‌গণ আজকাল এ বিভাগকে বিজ্ঞানসম্মত বলিতে চাহেন না। মধুমক্ষিকা পতঙ্গশ্রেণীভুক্ত। উত্তাপ পরীক্ষা করিলে ইহাদিগকে শীতলশোণিত প্রাণীর দলে ফেলিতে হয়। কিন্তু ঘোর শীতের সময়েও মৌ-চাকের ভিতরকার উষ্ণতাকে বাহিরের উষ্ণতা অপেক্ষা প্রায় সত্তর ডিগ্রি অধিক দেখা যায়। ভেক বা মৎস্যকে ঈষদুষ্ণ জলে ছাড়িয়া দিলে তাহাদের দেহের উষ্ণতা অতি অল্প সময়ের মধ্যে জলের অনুরূপ হইয়া দাঁড়ায়। ভেক, সর্প প্রভৃতি যেমন শীতকালে মৃতবৎ হইয়া নিদ্রা যায়, শীতপ্রধান দেশের অনেক স্তন্যপায়ী সেই প্রকার দীর্ঘ শিশিরসুপ্তি (Hibernation) উপভোগ করে। উষ্ণশোণিত প্রাণী হইলেও, এই সময়ে ইহাদের দেহের উষ্ণতা স্পষ্ট কমিয়া বাহিরের বায়ুর উষ্ণতার সমান হইয়া দাঁড়ায়। তা’ ছাড়া মানবশিশু পক্ষিশাবক প্রভৃতিও যে শীতলশোণিত প্রাণীর ন্যায় দেহ-তাপকে নিয়মিত করিতে পারে তাহারও অনেক দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়াছে। কাজেই সুস্পষ্ট রেখাপাত করিয়া শীতলশোণিত ও উষ্ণশোণিত এই দুই ভাগে প্রাণীকে ভাগ করা চলে না; করিতে গেলেই সঙ্কটে পড়িতে হয়।

 যাহা হউক কি প্রকারে প্রাণিদেহে তাপের উৎপত্তি হয় এখন আলোচনা করা যাউক; এই বিষয়ের মীমাংসা করিতে গিয়া বৈজ্ঞানিকগণ দেহকে একটা যন্ত্রের সহিত তুলনা করিয়াছেন। কাঠ বা কয়লার যে শক্তি সুপ্তাবস্থায় (Latent) থাকে, বাষ্পযন্ত্রের চুল্লীতে পোড়াইতে আরম্ভ করিলে তাহাই জাগ্রত তাপ শক্তিতে পরিণত হইয়া কলকে চালায়। প্রাণিদেহের ভিতরে পড়িয়া ভুক্ত দ্রব্যের সুপ্ত শক্তিও ঠিক সেই প্রকারে জাগিয়া উঠে এবং দেহকে উত্তপ্ত করিয়া ও শরীরের পেশীগুলিকে চালাইয়া উদাহরণের কয়লার শক্তির ন্যায়ই আত্মপরিচয় দিতে আরম্ভ করে। বাষ্পযন্ত্র ও দেহযন্ত্রের আকার প্রকার ও গঠনোপাদানে অসাদৃশ্য অমিল থাকিলেও, বৈজ্ঞানিকের চক্ষে উভয়ই যন্ত্র।

 আমাদের টাকাকড়ির জমাখরচে, জমার অঙ্ক কখন কখন খরচের অঙ্ক অপেক্ষা ছোট হইয়া দাঁড়ায়। প্রকৃতির জমাখরচে এই ফাজিল হিসাবের স্থান নাই। যে শক্তি লইয়া হিসাব পত্তন করা হয়, খরচের খতিয়ানে তাহার কড়াক্রান্তির অমিল দেখা যায় না। পরিমাণ শক্তি কয়লায় সুপ্ত থাকে, পোড়াইবার সময় ঠিক তাহাই তাপ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ শক্তিতে পরিণত হয়। জমাখরচে সুপ্ত ও জাগ্রত শক্তির মধ্যে একটুও অমিল দেখা যায় না। কোন ক্ষুদ্র প্রাণীকে তাপপরিমাপক (Calorimeter) যন্ত্রের ভিতরে আবদ্ধ রাখিয়া সেটি ঘণ্টায় কত তাপ উৎপন্ন করিতেছে হিসাব করিতে গেলে দেখা যায়, পরীক্ষাকালে সে যতটা ভুক্ত দ্রব্য হজম করে, তাপের পরিমাণও সেই অনুসারে বাড়িয়া চলে। সুতরাং দেখা যাইতেছে কাঠ বা কয়লাকে কলে ফেলিয়া জ্বালানো ও খাদ্যদ্রব্যকে উদরে ফেলিয়া হজম করা একই ব্যাপার। দাহ্য বস্তুতে যে শক্তি সুপ্তাবস্থায় থাকে, পোড়াইতে গেলে যেমন তাহার অধিক এক কণা শক্তিও প্রকাশ পায় না, তেমনি ভুক্ত দ্রব্যের যে অংশটাকে পরিপাক করা হয় তাহার অন্তর্নিহিত শক্তির অধিক এক কণাও দেহে উৎপন্ন হয় না। কয়লার দহন ও খাদ্যের হজম, এই দুয়ের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য এই যে, দহনে দাহ্য বস্তুর সুপ্তশক্তি অতি অল্পকাল মধ্যে জাগ্রত হইয়া পড়ে, হজমে ভুক্ত দ্রব্যে সেই শক্তি বন্ধনমুক্ত হইতে অধিক সময় লয়। এই জন্যই পোড়াইবার সময় সমগ্র শক্তিকে অল্পকাল মধ্যে একত্র পাইয়া আমরা তাপের মাত্রাকে অধিক দেখি এবং জঠরানলে বহুক্ষণ ধরিয়া ধীরে ধীরে দগ্ধ হইয়া ভুক্ত দ্রব্য যে তাপ বাহির করে তাহার পরিমাণকে অল্প মনে করি। খাদ্য হজম করিবার কলটিকে প্রকৃতিদেবী যদি বাষ্পযন্ত্রের চুল্লীর মত করিয়া গড়িতেন, তবে ভুক্ত দ্রব্য উদরে পড়িয়া কয়লার মত অল্প সময়ের মধ্যে পুড়িয়া ভয়ানক তাপের উৎপত্তি করিত। তখন মানুষ, গরু, ঘোড়া এবং ছাগল প্রত্যেকেই এমন এক একটা বিকট জীব হইয়া দাঁড়াইত যে, খাবার হজমের সময়ে তাহাদের নিকটে দাঁড়ানো দায় হইত।

 বাষ্পযন্ত্রকে চব্বিশ ঘণ্টা অবিরাম চালাইলে তাহা কয়লা পোড়াইয়া যত তাপ উৎপন্ন করিল, তাহা গণনা করা যায়। ভুক্ত দ্রব্য অক্সিজেন ইত্যাদির সহিত মিশিলে হজমের সময় যে দহন আরম্ভ হয়, তাহাতে কত তাপ উৎপন্ন হয় তাহা স্থির করাও কঠিন নয়। এক সের জলকে সেণ্টিগ্রেডের এক ডিগ্রী পরিমাণে উষ্ণ করিতে যে তাপের প্রয়োজন তাহার পরিমাণ বড় অল্প নয়। হিসাব করিলে দেখা যায়, সুস্থ মানুষ চব্বিশ ঘণ্টায় দেহে যে তাপ উৎপন্ন করে, তাহাতে তিন হাজার সের, (পঁচাত্তর মণ) জলকে অনায়াসে এক ডিগ্রী পরিমাণে উষ্ণ করা যাইতে পারে অর্থাৎ ত্রিশ সের বরফের ন্যায় শীতল জলকে ঐ তাপে ফুটাইতে পারা যায়। কোন কারণে যদি দেহের সমবেত তাপের পরিমাণ ইহা অপেক্ষা অধিক বা অল্প হইয়া দাঁড়ায়, তবে তাহা দ্বারা শরীরের কার্য চালানো দায় হয়; মাল গাড়ীর এঞ্জিনের মত তখন দেহ-যন্ত্রটা কোন গতিকে চলাফেরা করে মাত্র।

 কলের চুল্লীতে যত ভাল কয়লা পোড়ানো যায়, কাজও তত ভাল হয়। অল্প ছাই রাখিয়া যাহা প্রায় নিঃশেষে পুড়িয়া যায়, তাহাই ভাল কয়লা। পাথর ও নানা আকরিক পদার্থ মিশানো কয়লা পুড়িবার সময়ে অতি অল্প তাপ উৎপন্ন করিয়া স্তূপীকৃত ভস্মে পরিণত হয়। নিকৃষ্ট কয়লার এক মণে যে কাজ পাওয়া যায়, উৎকৃষ্ট কয়লার আধ মণেই হয় ত সেই কাজ হয়। দেহের কলে তাপ উৎপন্ন করিবার জন্য আমরা খাদ্যাকারে যে ইন্ধন যোগাই, তাহারো ভালমন্দ আছে। অর্দ্ধসের চাউলের দাহনে দেহ-যন্ত্রে যে তাপের উৎপত্তি হয়, অর্দ্ধ ছটাক ভাল খাদ্যে তাহা অপেক্ষা অনেক অধিক তাপ জন্মাইতে পারা যায়। কোনখান হজম হইবার সময়ে কি পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে, তাহার একটা হিসাব স্থির করা কঠিন নয়। এই প্রকার হিসাবে জানা গিয়াছে, পনর গ্রেণ ওজনের মাংস হজম হইবার সময়ে যে তাপ নির্গত করে, তাহাতে প্রায় দুই সের ওজনের জলকে সেণ্টিগ্রেডের এক ডিগ্রী পরিমাণে উষ্ণ করা যাইতে পারে, কিন্তু ঠিক্ সেই পরিমাণ ঘৃত বা চর্ব্বি হজম করিলে তাপের পরিমাণ উহার দ্বিগুণেরও অধিক হইয়া দাঁড়ায়। সুতরাং আমাদের প্রধান আহার্য্যগুলির এই প্রকার একটা তালিকা প্রস্তুত করিতে পারিলে, সুগৃহিণীগণ স্বাস্থ্যবিধানের উপরেও একটু দৃষ্টি রাখিতে পারিবেন বলিয়া আশা হয়।

 কোন্ খাদ্য হইতে কি পরিমাণ তাপ পাওয়া যায়, তাহা মোটামুটি স্থির থাকিলেও খুঁটিনাটিতে যথেষ্ট মতদ্বৈধ আছে। জগদ্বিখ্যাত জীবতত্ত্ববিদ লিবিগ্ (Liebig) সাহেব আমাদের সাধারণ খাদাকে মাংসবর্দ্ধক ও তাপবর্দ্ধক এই দুই প্রধান ভাগে ভাগ করিতেন। এই বিভাগ অনুসারে আমিষ খাদ্য মাংসবর্দ্ধক এবং শ্বেতসার (Starch) চিনি ও তৈল ঘৃতাদি তাপবর্দ্ধক বলিয়া আজও স্বীকৃত হইতেছে। তবে লিবিগ্ সাহেব আমিষ খাদ্যকে কেবলি মাংসবন্ধক বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়া ছিলেন, আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ তাহা স্বীকার করিতেছেন না। ইঁহাদের মতে, আমিষের কোন অংশই বৃথা যায় না। ইহাতে যে নাইট্রোজেন্ থাকে তাহা দেহের ক্ষয় পূরণ করে এবং তার পরে নাইট্রোজেন্-বর্জ্জিত যে অংশটা অবশিষ্ট থাকে উহা তাপোৎপত্তির কার্য্যে নিযুক্ত হয়।

 আমাদের দেহে নিয়ত যে তাপের উৎপত্তি হইতেছে, তাহার কত ভাগ কি প্রকারে দেহ হইতে নির্গত হয়, ইহারও একটা মোটামুটি হিসাব করা হইয়াছে। এই হিসাবে দেখা যায়, সমবেত তাপের শতকরা ৭৩ ভাগ দেহ হইতে বিকীর্ণ হইয়া পার্শ্বের বায়ুকে উত্তপ্ত করে এবং ২২ ভাগ শ্বাসযন্ত্র ও চর্ম্মের জলীয় অংশকে বাষ্পীভূত করে। ইহার পর যে পাঁচ ভাগ অবশিষ্ট থাকে, কেবল তাহাই প্রশ্বাসের বায়ু ও মলমূত্রাদিকে গরম করিতে ব্যয়িত হয়। কম্বল বা অপর পশমী বস্তু গায়ে জড়াইলে কেন উষ্ণতা অনুভূত হয়, দেহনির্গত তাপের কথা মনে করিলে তাহা বেশ বুঝা যায়। পশমী বস্ত্র তাপের পরিচালক নয়; কাজেই এই প্রকার কাপড়ে শরীর আবৃত রাখিলে পূর্বোক্ত শতকরা ৭৫ ভাগ তাপ দেহ ত্যাগ করিয়া দূরে যাইতে পারে না;— শরীরের চারি পাশের বায়ুতেই তাহা আবদ্ধ থাকে। এই কারণেই পশমী কাপড় গরম কাপড় নামে খ্যাত।

 সভ্য মানুষ এত শিল্পকুশলী হইয়াও শিল্পনৈপুণ্যে অদ্যাপি প্রকৃতির সমকক্ষ হয় নাই। প্রাণীর দেহ কেবলমাত্র যন্ত্র নয়, এপ্রকার সর্ব্বাঙ্গসুন্দর আর একটি যন্ত্র ইউরোপ বা আমেরিকার কোন কারখানায় মেলা ভার। আজকাল আমরা যে-সকল বাষ্পযন্ত্রকে খুব ভাল বলি, তাহাতে কয়লা পোড়াইলে কয়লার শক্তি শতকরা বারো ভাগ মাত্র চাকা ইত্যাদি ঘুরাইয়া কাজ করে, অবশিষ্ট ৮৮ ভাগ তাপ ইত্যাদির আকার গ্রহণ করিয়া নষ্ট হইয়া যায়। এই অপচয় বড় কম নয়। প্রকৃতির স্বহস্তনির্ম্মিত যন্ত্রে যে অপব্যয় নাই, একথা বলা যায় না; কিন্তু বাষ্পযন্ত্রের অপচয়ের তুলনায় ইহার পরিমাণ অনেক অল্প। হিসাব করিলে দেখা যায়, খাদ্য দ্রব্য হইতে দেহে যে শক্তির উৎপত্তি হয়, তাহার শতকরা পঁচিশ ভাগ প্রকৃত কাজে লাগে এবং অবশিষ্ট ৭৫ ভাগ দেহকে গরম করিয়াই ব্যয়িত হয়। কিন্তু এই গরম করা ব্যাপারটাকে কোনক্রমে অনাবশ্যক কাজ বলা যায় না। দেহ সামগ্রী Protoplasm দ্বারা কাজ চালাইতে হইলে, তাহাকে উষ্ণ রাখা একান্ত প্রয়োজন। সুতরাং দেহ-শক্তির যে শতকরা ৭৫ ভাগ তাপে পরিণত হয় তাহাকে কোন ক্রমে অপব্যয় বলা চলে না। কিন্তু বাষ্প-যন্ত্রে সেই ৮৮ ভাগের সত্যই অপব্যয় হয়।

 আমরা পূর্ব্বেই বলিয়াছি শারীরিক উষ্ণতাকে নির্দ্দিষ্ট রাখা এক শ্রেণীর প্রাণীর প্রধান ধর্ম্ম। মানুষ এই শ্রেণীরই অন্তর্গত। অতি গরমে মানবদেহের সেই সাড়ে আটানব্বই ডিগ্রি উষ্ণতার কখনই পরিবর্ত্তন হয় না। যে প্রক্রিয়ায় দৈহিক উষ্ণতা এই প্রকার চিরনির্দ্দিষ্ট থাকে, আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ তাহারো সন্ধান পাইয়াছেন। ইঁহারা এই ব্যাপারটির ব্যাখ্যানে বলেন, উন্নত প্রাণীর দেহকে যে স্নায়ুমণ্ডলী (Nervous System) আচ্ছন্ন করিয়া আছে, তাহাই দৈহিক উষ্ণতাকে স্থির রাখে। মনে করা যাউক, যেন কোন স্তন্যপায়ী প্রাণী বা মানুষকে বরফ-গলা জলে ডুবাইয়া তাহার তাপ হরণ করা যাইতেছে। কিয়ৎকালের জন্য তাহার দেহের তাপ অবশ্যই কমিয়া আসিবে কিন্তু শেষে দেখা যাইবে, বরফ-জল স্থায়িভাবে দেহভাগকে কমাইতে পারিতেছে না। জল যেমন তাপ হরণ করিতেছে, তেমনি কোথা হইতে নূতন তাপ আসিয়া ক্ষয়ের পূরণ করিতেছে। আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণ এই অদ্ভুত ব্যাপারের ব্যাখ্যানে বলিতেছেন, গাত্রের উষ্ণতা কমিবামাত্র সর্ব্বাঙ্গের স্নায়ুজাল তাপ-হরণ-সংবাদ স্নায়ুকেন্দ্রগুলিতে পৌঁছাইয়া দেয়। স্নায়ুকেন্দ্র এই দুঃসংবাদে নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে না; সর্ব্বাঙ্গের পেশীগুলি য়াহাতে সঙ্কুচিত হইয়া যথাবিধি তাপ উৎপন্ন করে, তাহার জন্য সমগ্র দেহে উত্তেজনা প্রেরণ করে। স্নায়ুর আদেশকে অবহেলা করার সামর্থ্য কোন অঙ্গেরই নাই। কাজেই স্নায়বিক উত্তেজনায় পেশী সঙ্কুচিত হইয়া তাপ উৎপন্ন করিতে থাকে, এবং এই তাপই ক্ষয় পুরণের পক্ষে প্রচুর হয়। অধিক শীতে দেহের যে কম্পন হয়, তাহা ঐ স্নায়বিক উত্তেজনাজাত পেশীর সঙ্কোচ ব্যতীত আর কিছুই নয়।

 জমাখরচের খাতায় জমার অঙ্কে যখন বৃদ্ধি দেখা যায়, হিসাবী লোককে ইহার দুই প্রকার কারণ উল্লেখ করিতে দেখা যায়। খরচের পরিবর্ত্তন না করিয়া জমার ঘরে নূতন কিছু যোগ করিতে থাকিলে জমার বৃদ্ধি হয়; তা’ ছাড়া খরচ কমাইতে থাকিলেও জমার অঙ্ক বাড়িয়া চলে। নানাপ্রকার ব্যাধিতে আমাদের দৈহিক উত্তাপের যে বৃদ্ধি দেখা যায় তাহাতে খরচ কমা ও জমা বাড়া এই দুইয়েরই কার্য্য ধরা পড়িয়াছে। সুস্থ মানুষের দেহের উষ্ণতা প্রায় সাড়ে আটানব্বই ডিগ্রি, কিন্তু জ্বর হইলে তাহা বাড়িয়া কখন কখন একশত ছয় বা সাত হইয়া দাঁড়ায়। সত্য সত্য তাপ বাড়িয়া এই উষ্ণতা প্রকাশ করে, কিংবা অসুস্থ মানুষ তাপ বিকিরণ করিতে না পারিয়া কি প্রকারে স্বাভাবিক তাপকে জমাইয়া এই বৃদ্ধি দেখায়, শারীরতত্ত্ববিদ্‌গণ বহু চেষ্টাতেও নিঃসন্দেহে তাহা স্থির করিতে পারেন নাই। বিখ্যাত ইংরেজ শারীরবিৎ ডাক্তার হোয়াইট্‌ (Dr. Hale White) সম্প্রতি এসম্বন্ধে যে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাহাই এখন যথার্থ বলিয়া স্বীকৃত হইতেছে। ইনি বলিতেছেন, নিউমোনিয়া অর্থাৎ শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ এবং রিসিপেলাস্ প্রভৃতি রোগে দেহতাপের যে বৃদ্ধি হয়, তাহা প্রকৃতই তাপবৃদ্ধির ফল। এই অবস্থায় দেহে সত্যই তাপের বৃদ্ধি হয়, কিন্তু খরচ পূর্ব্বের মতই চলে; সুতরাং দেহ পূর্ব্বাপেক্ষা উষ্ণ হইয়া পড়ে। শরীরের কোন অংশে পূঁজের সঞ্চয় হইতে থাকিলে যে তাপ বৃদ্ধি হয়, তাহার কারণ উহারি ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ এই অবস্থায় তাপের উৎপত্তি পূর্ব্বের ন্যায়ই চলে, কিন্তু শরীরের তাপ-বিকিরণশক্তি কমিয়া আসে বলিয়া, উষ্ণতার মাত্রা বৃদ্ধি পাইয়া যায়।

 ম্যালেরিয়া প্রভৃতি জ্বরে দৈহিক উষ্ণতার যে আকস্মিক বৃদ্ধি দেখা যায়, তাহার কারণটা কিছু স্বতন্ত্র। বাহির হইতে কোনপ্রকার আঘাত-উত্তেজনা পাইলেই জীবদেহের আহত অংশ সহজে উত্তেজিত হইয়া পড়ে; কিন্তু মৃত বা নির্জীব পদার্থে আঘাত দিলে, তাহা ঐ প্রকারে সাড়া দেয় না। সজীব পদার্থের এই সাড়া দেওয়া ব্যাপারে একটা গভীর তত্ত্ব নিহিত আছে। বৈজ্ঞানিকগণ দেখিয়াছেন, আঘাতে উত্তেজিত হইয়া পড়া জীবনীশক্তিরই প্রধান লক্ষণ এবং উত্তেজিত হইয়া সাড়া দেয় বলিয়াই আহত অংশ আঘাতের অপকারিতা হইতে মুক্তি লাভ করে। সুতরাং সবল রোগীর দেহে ম্যালেরিয়ার সেই কোটি কোটি জীবাণু আশ্রয় গ্রহণ করিয়া যখন দেহ-কোষগুলিতে আঘাত দিতে থাকে, তখন সেই আহত কোষগুলি নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিতে পারে না; অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য তাহারা আপনা হইতেই চঞ্চল ও উত্তেজিত হইয়া প্রতিক্রিয়ার আরম্ভ করিয়া দেয়। কাজেই ইহাতে দেহে তাপের মাত্রা বাড়িয়া চলে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, সাধারণ জ্বরে দেহের যে উষ্ণতা বৃদ্ধি হয়, তাহা ব্যাধি নয়, বরং ব্যাধি প্রশমনেরই একটা উপায়। কিছুদিন পূর্ব্বেও চিকিৎসকগণ নানা ঔষধ প্রয়োগে জোর করিয়া জ্বরের তাপ কমাইবার চেষ্টা করিতেন। আজকাল এই চিকিৎসা পদ্ধতির বড় প্রচলন দেখা যায় না। যে সকল ঔষধ জীবাণু নাশ করিয়া উত্তেজনার মূল কারণটিকে উন্মূলিত করে, সাধারণ জ্বরের চিকিৎসায় এখন তাহাদেরি আদর বাড়িতেছে। কুইনিন্ জ্বরের তাপকে কমায় না, যে সকল জীবাণু দেহে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া তাপের উৎপত্তি করে তাহাদিগকে নষ্ট করে বলিয়াই উহার এত আদর।

 জ্বরে যে তাপের বৃদ্ধি দেখা যায়, তাহা দেহরক্ষার জন্যই হয় সত্য, কিন্তু তাই বলিয়া অত্যধিক তাপ যে স্বাস্থ্যের হানিকর নয়, এ কথা কখনই বলা যায় না। পরীক্ষায় দেখা গিয়াছে মানব দেহের উষ্ণতা কোন ক্রমে দীর্ঘকালের জন্য ১০৮° ডিগ্রি হইয়া দাঁড়াইলে মস্তিষ্ক স্থায়িরূপে বিকৃত হইয়া পড়ে। এই অবস্থায় মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত। তার পরে যদি উষ্ণতা বাড়িয়া ক্ষণিকের জন্যও ১১৬° ডিগ্রি হইয়া দাঁড়ায়, তবে আর কোন ক্রমে নিস্তার থাকে না। সর্দ্দি-গর্‌মি (Sun Stroke) পীড়াটা মস্তিষ্ক-বিকৃতিরই ফল। পক্ষান্তরে কোন কারণে যদি দেহের উষ্ণতা দীর্ঘকালের জন্য সেই সাড়ে আটানব্বুইয়ের নীচে নামে তাহা হইলেও জীবন রক্ষা দায় হয়। অধিক শীত দেহের সর্ব্বাংশকে ধীরে ধীরে নির্জীব করে। কিছুকালের জন্য শারীরিক উষ্ণতা আশী ডিগ্রির নীচে আসিয়া দাঁড়াইলে, মানুষের মৃত্যু প্রায়ই অনিবার্য্য হইয়া পড়ায়।