প্রাকৃতিকী/প্রাণী ও উদ্ভিদের বিষ

উইকিসংকলন থেকে

প্রাণী ও উদ্ভিদের বিষ

উদ্ভিদ্ ও ইতর প্রাণীর উপর মানুষ যে কত অত্যাচার করে তাহার সীমা নাই। গো, মেষ, মহিষ, ছাগ ও শুকরাদির কথা ছাড়িয়া দিলেও দেখা যায়, ঘোটক এবং উষ্ট্রও মনুষ্যের খাদ্য। পক্ষীদের ত কথাই নাই। তা’র পর ইঁদুর, সাপ, গো-সাপ, কাঠবিড়াল, ফড়িং প্রভৃতি পতঙ্গজাতিও মানুষের কবল হইতে উদ্ধার পায় নাই। উদ্ভিদের উপর মানুষ এতটা অত্যাচার করিতে পারে না, সকল গাছপাতা বা ফলমূল স্বাদু নয়, কাজেই উদ্ভিদ্‌গুলির মধ্য হইতে অনেক দেখিয়া শুনিয়া মানুষ খাদ্যাখাদ্য নির্ণয় করে। কিন্তু আমিষ-খাদ্য-নির্ণয়ে এ প্রকার বিচার করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না; সভ্য মানুষ আম-মাংস ভোজন করে না; যদি কোন প্রাণীর মাংসে কোন প্রকার অস্বাদুকর জিনিষ থাকে সিদ্ধ করিলেই তাহা নষ্ট হইয়া যায়। ফলমুল ও অনেক শাকসব্‌জি অপক্কাবস্থাতেই মানুষ আহার করে, কাজেই অগ্রে স্বাদুতা স্থির করিয়া পরে আহার্য্য বলিয়া তাহাদিগকে গ্রহণ করিতে হয়। আবার অধিকাংশ উদ্ভিদেরই দেহে যে বিস্বাদজনক পদার্থ মিশ্রিত থাকে, তাহা সিদ্ধ করিলে নষ্ট হয় না,—কাজেই সিদ্ধ করিলে যেমন সকল প্রাণীর মাংসই খাদ্য হইয়া দাঁড়ায় উদ্ভিদ্ তেমনটি হয় না। নচেৎ মানুষের অত্যাচারে হয় ত, ভূমণ্ডলের গাছপালাও বিরল হইয়া আসিত।

 শাস্ত্রে বলে, “যজ্ঞার্থে পশবঃ সৃষ্টা স্বয়মেব স্বয়ম্ভুবা”। কিন্তু প্রকৃতির কার্য্য পরীক্ষা করিলে শাস্ত্রের উক্তির সহিত ঘোর অসামঞ্জস্য দেখা যায়। এ কথা কখনই স্বীকার করা যায় না যে, উচ্চবুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণীদের যজ্ঞের আহুতির জন্যই দুর্ব্বল ও অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন জীবের সৃষ্টি হইয়াছে। বাঘ ভালুকের তীক্ষ্ণ নখদন্ত, সজারুর গায়ের কাঁটা, কচ্ছপ ও শম্বুকজাতীয় প্রাণীর কঠিন দেহাবরণ, গো, মেষ ছাগাদির শৃঙ্গ, বোল্‌তা ও মধুমক্ষিকার হুল, এবং সাপের বিষদন্ত সকলই আত্মত্রাণের মহা অস্ত্র। কীট-পতঙ্গ অতি ক্ষুদ্র প্রাণী, ইহাদের ধারালো হুল নাই, কিন্তু কেহ কেহ দেহ হইতে এমন দুর্গন্ধযুক্ত রস নিঃসৃত করে যে, তাহাতে শত্রু উহাদের নিকটবর্ত্তী হইতে ভয় পায়। গ্রীষ্ম ও বর্ষার রাত্রিতে আলো জ্বালিয়া বসিলে, এই প্রকার দুর্গন্ধযুক্ত বহু কীটপতঙ্গ দেখা গিয়া থাকে। বেঙ্ অতি নিরীহ প্রাণী, ইহাদের শিং নাই, ধারালো দাঁত বা হুল নাই, কিন্তু ইহারা লম্বা লম্বা লাফ দিতে পারে, তাহাই আত্মরক্ষার পক্ষে যথেষ্ট হয়। গেছো এবং সেপো বেঙের লাফও খুব বড় এবং সঙ্গে আবার ইহাদের দেহ হইতে এক প্রকার বিষও বাহির হয়, এই বিষের একটু পরিচয় পাইলেই কোন শত্রু ইহাদের নিকটবর্ত্তী হয় না। কয়েক জাতীয় গিরগিটিও এই প্রকারে দেহ হইতে বিষ নির্গত করিয়া আত্মরক্ষা করে। সুতরাং দেখা যাইতেছে প্রকৃতিদেবী তাঁর এই অল্পবুদ্ধি ও দুর্ব্বল সন্তানগুলিকে এই সকল অস্ত্রে সজ্জিত করিয়া ভূতলে ছাড়িয়া দিয়াছেন, অপর বলবান প্রাণীদের সহিত সংগ্রাম করিয়া নিজেদের অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রাখুক্ ইহাই তাঁহার অভিপ্রায়। উদ্ভিদ্‌গণ ইতর প্রাণী অপেক্ষা আরো দুর্ব্বল ও নিঃসহায়, বেঙ্ বা হরিণের মত লম্বা লম্বা লাফ দিয়া যে শত্রুর আক্রমণ ব্যর্থ করিবে, তাহার সাধ্য ইহাদের নাই। কাজেই একস্থানে দাঁড়াইয়া যাহাতে আত্মরক্ষা করিতে পারে তাহার ব্যবস্থা ইহাদের দেহে রাখিতে হইয়াছে। এই জন্যই কাহারো গায়ে কাঁটা, কাহারো পাতায় সুঁয়ো, কাহারো ফলে, ফুলে, মূলে ও পাতায় বিষ। প্রবল ইতর প্রাণীরা


এই সকলের ভয়ে উদ্ভিদের অনিষ্ট করিতে পারে না, অতি বুদ্ধিমান মানুষও ইহাদের নিকট হার মানিয়া যায়। নিম, নিসিন্দা মাখাল ফল তাহাদের দেহকে অতি বিস্বাদ রসে পূর্ণ রাখিয়া কেমন আত্মরক্ষা করে! মানুষ কোন দিন যে এগুলির দ্বারা রসনাতৃপ্তিকর ব্যঞ্জন রাঁধিতে পারিবে, তাহার সম্ভাবনা আজও দেখা যাইতেছে না।

 যাহা হউক, দুর্ব্বল জীব কি প্রকারে আত্মরক্ষা করে তাহা বর্ত্তমান প্রবন্ধের আলোচ্য নয়। আত্মরক্ষার জন্য কোন কোন প্রাণী ও উদ্ভিদের শরীরে যে বিষ সঞ্চিত থাকে, এই প্রবন্ধে আমরা তাহারই কিঞ্চিৎ পরিচয় দিব।

 প্রথমে উদ্ভিদের বিষের কথাই আলোচনা করা যাউক। খেজুর বা কুলের কাঁটা গায়ে লাগিলে আমরা বেদনা পাই, কিন্তু সে বেদনা স্থায়ী হয় না। বিছুটি বা আল্‌কুশীর সুঁয়ো গায়ে ঠেকিলে যে জ্বালা-যন্ত্রণা হয়, তাহা সত্যই বিষের জ্বালা। উদ্ভিদের বিষের ইহা একটি সুপরিচিত উদাহরণ। ছোটখাটো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া পরীক্ষা করিলে বিছুটির সুঁয়োকে নিরেট্ দেখায় না। এগুলির আগাগোড়া নলের মত ফাঁপা। ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলে এই শূন্যস্থানে এক প্রকার জলবৎ স্বচ্ছ রসও দেখা যায়। এই রসই বিছুটির বিষ। নলাকার সুঁয়োগুলি প্রাণীর দেহে প্রবিষ্ট হইলে, আপনা হইতেই ভাঙ্গিয়া যায়, এবং নলের ভিতরকার রস শরীরে প্রবেশ করিয়া বিষের কার্য্য দেখাইতে আরম্ভ করে। বিছুটির বিষ লইয়া বৈজ্ঞানিকগণ অনেক পরীক্ষা করিতেছেন। পিপীলিকার বিষে যে ফরমিক্‌ এসিড্ (Formic Acid) নামক দ্রাবক মিশানো থাকে, বিছুটির রসের অধিকাংশই সেই দ্রাবকে গঠিত। তা’ ছাড়া সাপের বিষের মত এক প্রকার রসও অল্পমাত্রায় উহাতে মিশ্রিত দেখা যায়। বিছুটির জ্বালাপোড়ার কারণ এই বিষ। সুতরাং অচল উদ্ভিদ্‌কে যদি সচল সাপের সহিত তুলনা করা যায়, তাহাতে অন্যায় হয় না।

 আলকুশীর সুঁয়োর বিষ আরো ভয়ানক। বিষের পরিমাণ ইহাতে বিছুটির তুলনায় অধিক। মানুষ বা গোরু প্রভৃতি প্রাণীর দেহে আল্‌কুশী লাগিলে আর নিস্তার নাই। অধিক পরিমাণে সুঁয়ো গায়ে লাগিলে মৃত্যু পর্য্যন্ত ঘটিতে পারে।

 ফুলের উগ্র গন্ধ নির্গত করিয়াও কতকগুলি উদ্ভিদ্‌কে আত্মরক্ষা করিতে দেখা গিয়াছে। প্রকৃতি যে-সকল বেশভূষায় সাজাইয়া প্রাণী ও উদ্ভিদ্‌কে পৃথিবীতে ছাড়িয়া দেন, কেবল স্বভাবের সৌন্দর্য্যবৃদ্ধি করাই তাহার উদ্দেশ্য নয়, পত্রপুষ্পের বিচিত্র বর্ণ এবং তাহাদের বিচিত্র গঠনের মূলে এক একটা শুভ উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে। যে সুগন্ধ লইয়া পুষ্প জন্মগ্রহণ করে, তাহা কখনই মানুষের প্রীতি উৎপাদনের জন্য নয়। উদ্ভিদ্‌তত্ত্ববিদ্‌গণ ইহার স্বতন্ত্র কার্য্য নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। ফল প্রসব করিয়া নিজের বংশ অক্ষুণ্ণ রাখাই উদ্ভিদ্-জীবনের সার্থকতা। উদ্ভিদ্‌বিদ্‌গণ বলেন, ফুলের গন্ধ এই কার্য্যেরই সহায়তা করে। উদ্ভিদ্ পুষ্প-পুটে মধুভাণ্ড সজ্জিত রাখিয়া গন্ধের দ্বারা দূরের প্রজাপতি প্রভৃতি পতঙ্গকে আমন্ত্রণ করে। প্রজাপতি পুষ্পের মধুপান করিতে বসিয়া যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ফুলের পরাগ গর্ভকেশরে সংযুক্ত করিয়া ফলের গঠন শুরু করিয়া দেয়। কিন্তু আমরা উদ্ভিদের যে তীব্র দুর্গন্ধের কথা বলিতেছি, তাহা পতঙ্গের আমন্ত্রণের জন্য নহে। যাহাতে অনিষ্টকর প্রাণী কাছে আসিতে না পারে তাহারি জন্য এই ব্যবস্থা। লিলি জাতীয় কতকগুলি ফুলের গন্ধ যে মানুষ সহ্য করিতে পারে না, এবং এই গন্ধে যে নানা প্রকার পীড়া দেখা দেয়, তাহার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। আমাদের চাঁপা ফুলের গন্ধে মাথা ধরার কথাটাও এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

 উদ্ভিদ ছাড়িয়া এখন প্রাণীর কথা আলোচনা করা যাউক। আত্ম-রক্ষার জন্য এবং কখনো কখনো আহার্য্য সংগ্রহের জন্য যে কত প্রাণীর দেহে কত রকম বিষ আছে, তাহার সংখ্যা করাই কঠিন। ইহারা সাধারণ উদ্ভিদের মত দেহকে বিস্বাদ করিয়া আত্মরক্ষা করে না, কাজেই জীবন-সংগ্রামে জয়ী করাইবার জন্য প্রকৃতি ইহাদের দেহেই নানা বিষদিগ্ধ অস্ত্র রাখিয়া দিয়াছেন। যাহা হউক প্রাণীর বিষগুলি পরীক্ষা করিলে, দেহে উহাদের দুই প্রকার কার্য্য দেখিতে পাওয়া যায়। কতকগুলি বিষ রক্তের সহিত যুক্ত না হইলে দেহের কোন অনিষ্ট করিতে পারে না। সাপের বিষ, বিচ্ছুর বিষ এই শ্রেণীর অন্তর্গত। অপর কতকগুলি, রক্তের সহিত মিশিবার জন্য প্রতীক্ষা করে না, খাদ্মপানের সহিত উদরস্থ হইলেই ইহারা বিষের কার্য্য দেখাইতে শুরু করে। মাকড়সা প্রভৃতির বিষ বোধ হয় এই শ্রেণীভুক্ত। কেবল সাপ ও বিচ্ছুর বিষই যে দেহপ্রবিষ্ট হইলে অনিষ্ট করে তাহা নয়। ভেকের গাত্র হইতে যে ঘর্ম্মবৎ রস নির্গত হয়, তাহা মানুষের শরীরে প্রবেশ করাইয়া দেখা গিয়াছে, ইহাতে অল্পক্ষণের মধ্যে মানুষ অসুস্থ হইয়া পড়ে। ইল্ অর্থাৎ বাইন জাতীয় সামুদ্রিক মৎস্যের (Eel) রক্ত যে-কোন প্রাণিদেহে প্রবেশ লাভ করিলেই বিষের লক্ষণ প্রকাশ করে। কয়েক জাতীয় মৎস্য এবং গিরিগিটির মুখের লালাও রক্তের সহিত যুক্ত হইলে বিষের কার্য্য দেখাইতে আরম্ভ করে। শিশুর মুখের লালায় যে বিষ আছে, ফরাসী বৈজ্ঞানিক পাষ্টুর সাহেব তাহা দেখাইয়াছেন: এক মাস দেড় মাস বয়সের শিশুর লালা সংগ্রহ করিয়া খরগোস ইত্যাদি প্রাণীর শরীরে প্রবিষ্ট করাইলে, বিষের লক্ষণ প্রকাশ পাইতে থাকে। কিন্তু এই সকল বিষ খাওয়াইলেই কোন প্রাণীতে অসুস্থতার চিহ্ন দেখা যায় না।

 বিষদাঁতযুক্ত প্রাণীর দেহে কোথায় বিষের উৎপত্তি হয় তাহার অনুসন্ধান হইয়াছে। ইহার ফলে জানা গিয়াছে, যাহাদের বিষ-দাঁত আছে, তাহাদের দাঁতের মূলে এক একটি ক্ষুদ্র কোষ থাকে। এই কোষই বিষভাণ্ড। সাপের বিষদন্তে যেমন এক একটা খাঁজ কাটা থাকে, বিষদন্তযুক্ত অপর প্রাণীর দাঁতেও ঠিক তাহাই দেখা যায়। ইচ্ছা করিলেই দন্তমূলের কোষস্থ বিষ ইহারা দাতের খাঁজের ভিতর দিয়া আনিয়া শত্রুকে দংশন করিতে পারে। মাগুর বা শিঙ্গি মৎস্যের কাঁটায় বিষ আছে, ইহারা হাতে পায়ে কাঁটা ফুটাইলে বেশ যাতনা হয়। এই শ্রেণীর অনেক মাছের কাঁটার মূলে এই প্রকার বিষকোষ ধরা পড়িয়াছে, এবং ইহাদের কাঁটাগুলিতে সাপের বিষদন্তের মত খাঁজ কাটাও দেখিতে পাওয়া যায়।

 কাঁটা হানিয়া বা নখ দিয়া আঁচড়াইয়া প্রাণীরা যে বিষ শত্রুর দেহে প্রবেশ করাইয়া দেয়, তাহার প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য বৈজ্ঞানিকগণ অনেক পরীক্ষা করিয়াছেন। আশ্চর্য্যের বিষয় বিছুটি প্রভৃতি উদ্ভিদের বিষে যে ফর্‌মিক্ এসিড দেখা গিয়াছে, ইহাতেও তাহাই ধরা পড়িয়াছে। স্নায়ুমণ্ডলীকে অসাড় করিয়া দেওয়া ফর্‌মিক্ এসিডের একটা প্রধান কার্য্য। বিষের সহিত এই জিনিষটা মিশ্রিত থাকায় দুর্ব্বল প্রাণীদিগকে শিকার করার কার্য্যে ইহা খুবই সাহায্য করে। কাঁচপোকা যখনি বৃহৎ আরসুলাকে শিকার করিতে যায়, তখন কোন গতিকে আরসুলার গায়ে একবার হুল ফুটাইতে পারিলেই সেটি ঐ ফর্‌মিক্‌ এসিড দ্বারা পক্ষাঘাতের রোগীর মত্ত অবশাঙ্গ হইয়া পড়ে। তা’র পর কাঁচপোকা উহার সুঁয়ো ধরিয়া অনায়াসে যথেচ্ছা লইয়া যাইতে পারে।

 মৌমাছি ও ভীমরুলের ন্যায় বিচ্ছুর বিষও তাহাদের পুচ্ছে থাকে। ইহাদের সম্মুখের দুটা দাঁড়া এবং দাঁত একেবারে নির্বিষ। পুচ্ছের প্রান্তস্থিত ধারালো হুল এবং তৎসংলগ্ন ক্ষুদ্র বিষকোষই ইহাদের আত্মত্রাণের মহা অস্ত্র। সূক্ষ্মাগ্র হুলটিকে ইহারা অতি সাবধানে কুণ্ডলী পাকাইয়া উপরে উঠাইয়া রাখে, তা’র পর শত্রুপক্ষ সম্মুখে আসিলেই তাহা দেহে বিদ্ধ করিয়া দেয়।

 জেলি মৎস্য (Jelly fish) নামক এক প্রকার সামুদ্রিক প্রাণীর দেহেও বিষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহাদের হুল বিষদন্ত বা শিঙ্গি মাছের মত বিষময় কাঁটা কিছুই নাই। দেহ হইতে মাকড়সার সূত্র অপেক্ষাও সূক্ষ্ম বিষপূর্ণ সুঁয়ো বাহির করিয়া ইহারা শত্রুকে আঁকড়াইয়া ধরে। সুঁয়োর বিষে শত্রুর দেহে বিছুটির মত যন্ত্রণা উপস্থিত হয়। এই জন্য জেলি-মৎস্য সামুদ্রিক বিছুটি (Sea Nettles) নামে অভিহিত হইয়া থাকে।

 প্রাণীদের মধ্যে পতঙ্গ জাতির দেহে যত বিষ দেখা যায়, বোধ হয় অপর কোন জাতির মধ্যে সে প্রকার দেখা যায় না। মৌমাছি, বোলতা, ভীমরুল, পিপীলিকা সকলেই বিষাক্ত এবং ইহাদের সকলেরই বিষ পুচ্ছদেশে রক্ষিত দেখা যায়। কেবল সুঁয়ো পোকা ও মশক তাহীদের বিষ পুচ্ছে রাখে না। সুঁয়ো পোকার বিষ তাদের চুলে এবং মশকের বিষ তাহাদের মুখে থাকে। মাকড়সা-জাতীয় পতঙ্গ তাহাদের পায়ের নখে রাখে। নখের মূলেই ইহাদের বিষ-স্থালী। আমাদের তেঁতুলে-বিছের বিষ তাহাদের দাঁতে থাকে, দন্তমূলে যে বিষস্থালী থাকে তাহা হইতে ইচ্ছামত বিষ নির্গত করিয়া শত্রুকে দংশন করিতে পারে। পতঙ্গের সংখ্যা যেমন অধিক, ইহাদের শত্রুও তেমন অনেক। অনেক পক্ষীর পতঙ্গই প্রধান আহার। তা ছাড়া টিক্‌টিকি, গিরগিটি, এমন কি আমাদের সেই অতি নিরীহ ভেকগুলি সম্মুখে পতঙ্গ পাইলে, সিংহের মত তাহাদিগকে আক্রমণ করে। এই সকল শত্রুর কবল হইতে রক্ষা পাইবার জন্য পতঙ্গের গায়ে, মুখে, লেজে, দাঁতে, নখে, বিষ রাখিতে হইয়াছে।

 বড় আশ্চর্য্যের বিষয় আমাদের কাঁক্‌ড়াগুলির বড় বড় দাঁড়া আছে, কিন্তু তাহাতে বিষ নাই। চিংড়িমাছেরও সেই দশা। খুব লম্বা লম্বা দাঁড়া আছে, কিন্তু সেগুলি একবারে নির্বিষ। পক্ষীদের পায়ের নখ ও ঠোঁট খুব ধারালো, কিন্তু সেগুলিতেও বিষের চিহ্ন দেখা যায় নাই।

 যে-সকল প্রাণীর দেহে কোন প্রকার বিষযুক্ত অঙ্গ নাই, তাহাদের মধ্যে অন্ততঃ কতকগুলির মাংসে বিষের লক্ষণ ধরা পড়িয়াছে। ইংলণ্ডের সুপ্রসিদ্ধ চিন্তশীল বৈজ্ঞানিক ল্যাঙ্কেষ্টার্ সাহেব (Sir Ray Lankester) হিসাব করিয়া দেখিয়াছেন, অন্ততঃ শতকরা দশজন লোক ইচ্ছা করিলেও মৎস্য মাংস আহার করিতে পারে না; জোর করিয়া খাওয়াইলে নানাপ্রকার পীড়ার লক্ষণ দেখা দেয়। ইহা দেখিয়া ল্যাঙ্কেষ্টার্ সাহেব বলিতেছেন,—মৎস্য-মাংসাহারে এই অসুস্থতার লক্ষণ বিষেরই পরিচায়ক। বিষ খাইলেই সকলে অসুস্থ হয় না, এমন বিষ অনেক আছে, যাহা একজনের শরীরে যে ফল দেখায় অপরে তাহা দেখায় না। একই খাদ্য আহার করিয়া এবং একই জল পান করিয়া এক ব্যক্তি পীড়িত হইল এবং অপর ব্যক্তি খাদ্যস্থ বিষ হজম করিয়া সুস্থ থাকিল, এ প্রকার ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। এই সকল কথা মনে করিয়া ল্যাঙ্কেষ্টার সাহেব বলিতেছেন, নিরামিষাহারিগণ মৎস্য মাংস খাইলেই যে অসুস্থতা বোধ করেন, তাঁহাদের এই অসুস্থতার কারণ মৎস্য-মাংসের বিষ ব্যতীত আর কিছুই নয়। এমন অনেক লোক দেখিতে পাওয়া যায়, যাঁহারা যথেষ্ট মাংস আহার করিতে পারেন, কিন্তু মৎস্য ভক্ষণ করিতে পারেন না। চিংড়ি মৎস্য বা কাঁকড়া খাইলেই অসুস্থ হইয়া পড়েন, এ প্রকারও অনেক লোক দেখা গিয়াছে। রন্ধন করিলেও মৎস্য মাংসে মৃদু বিষ থাকিয়া যায়, ইহা স্বীকার করিয়া লইয়া ল্যাঙ্কেষ্টার্ সাহেব নিরামিষাহারীর রুচি অরুচির ব্যাখ্যান দিবার চেষ্টা করিয়াছেন।

 বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয়, সাপ প্রভৃতির যে তীব্র বিষের বিন্দুমাত্র রক্ত স্পর্শ করিলে বৃহৎ প্রাণীরও মৃত্যু হয়, তাহা উহাদের নিজের দেহে প্রবেশলাভ করিলে কোনই অনিষ্ট করিতে পারে না। একটি সর্প আর একটিকে দংশন করিলে আহত সর্পের যে, কোন অনিষ্টই হয় না, তাহা একাধিক পরীক্ষায় সুস্পষ্ট দেখা গিয়াছে। কয়েক জাতীয় সর্পকে রাগাইলে তাহারা নিজেদের গায়ে নিজেরাই কামড় দিতে থাকে, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়, নিজের বিষে ইহাদের কেহই নিজে মরে না। সম্প্রতি এই ব্যাপার লইয়া জীবতত্ত্ববিদ্‌গণ নানা গবেষণা করিয়াছেন। ইহার ফলে স্থির হইয়াছে যে, বসন্তের বা ডিপ্‌থেরিয়া প্রভৃতি রোগের বীজ অল্পমাত্রায় দেহস্থ করিলে যেমন এই সকল রোগের তাজা বিষ আর মানুষকে পীড়িত করিতে পারে না, সেই প্রকার সর্প প্রভৃতির দেহেই বিষ-কোষ আছে বলিয়া সেই বিষে তাহাদের অনিষ্ট হয় না। হাইড্রোফোবিয়া অর্থাৎ জলাতঙ্ক রোগের শান্তির জন্য যেমন আমরা ক্ষিপ্ত কুকুরের মৃদু বিষের টিকা লইয়া নিশ্চিন্ত থাকি, সাপগুলিও ঠিক সেই প্রকার যেন নিজের বিষের টিকা লইয়া নিশ্চিন্ত হইয়া আছে। তাই পরস্পর কামড়াকামড়ি করিলে বা নিজের দেহে নিজের বিষ ঢালিয়া দিলে ইহাদের কোনই অনিষ্ট হয় না।