প্রাকৃতিকী/বিম্ব

উইকিসংকলন থেকে

বিম্ব

জলবিম্ব যদিও আমাদের অনেকের নিকট পার্থিব ব্যাপারের ক্ষণস্থায়িত্ব ও অসারবত্তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বলিয়া বিখ্যাত আছে, কিন্তু বৈজ্ঞানিকদিগের নিকট অনেকদিন অবধিই ইহা গভীর চিন্তা ও গবেষণার বিষয় হইয়া রহিয়াছে। অনেকানেক বিখ্যাত পণ্ডিত অসার জলবিম্বের উৎপত্তিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করিতে অনেক কথা বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু বিশ্বের প্রকৃতি ও পদার্থভেদে ইহার স্থায়িত্বের পরিবর্ত্তন বিষয়ে এ পর্য্যন্ত কেহ বেশ সন্তোষজনক কারণ দেখাইতে পারেন নাই।[১] বিখ্যাত ইংরাজ পণ্ডিত লর্ড র‍্যালে, পূর্ব্বতন বৈজ্ঞানিকগণের মত আলোচনা ও বিষয়টির নানারূপ পরীক্ষাদি করিয়া কিছু দিন পূর্ব্বে বিশ্বোৎপত্তি সম্বন্ধে একটি চিত্তাকর্ষক ও সারগর্ভ বিবরণ প্রচার করিয়াছিলেন। নানা তর্কবিতর্কের পর র‍্যালের প্রচারিত মতটি আজকাল সত্যমূলক বলিয়া পণ্ডিতসমাজে গৃহীত হইয়াছে।

 পাঠকপাঠিকাগণ দেখিয়া থাকিবেন, পরিষ্কার ও অকলুষিত তরল পদার্থে প্রায়ই বুদ্বুদ লক্ষিত হয় না। পরিষ্কৃত জল ঘন ঘন আন্দোলিত করিয়া বহু চেষ্টা করিলেও, তাহাতে স্থায়ী বুদ্বুদ উৎপন্ন হয় না এবং অবিমিশ্র আল্‌কোহল বা ঈথরেও বিম্ব দেখা যায় না। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় পূর্ব্বোক্ত পরিষ্কার জল ও আল্‌কোহল যে কোন পরিমাণে মিশ্রিত করিয়া আলোড়িত করিলে বহু পরিমাণে স্থায়ী বুদবুদ উঠিতে থাকে—কর্পূরযুক্ত জলেও অল্পায়াসে এই প্রকার অনেক বিম্ব উত্থিত হইতে দেখা যায়। বুদ্বুদ-সম্বন্ধে এই সকল সহজসাধ্য পরীক্ষা এবং আরও অনেক উদাহরণাদি দেখিয়া বৈজ্ঞানিকগণ বলেন,—বিজাতীয় পদার্থের সংমিশ্রণ ব্যতীত কোনও তরল পদার্থে বিম্বোৎপত্তি হইতে পারে না। পানীয় জলাদি বিজাতীয় পদার্থের সংমিশ্রণে কলুষিত কি না, তাহা পুর্ব্বোক্তরূপে বুদ্বুদ পরীক্ষা দ্বারা সহজে মোটামুটি স্থির করা যাইতে পারে। মৃদু সঞ্চালনে জল হইতে স্থায়ী বুদ্বুদ উত্থিত হওয়া ইহার কলুষতার একটি প্রধান লক্ষণ। আমরা সমুদ্র ও নদীজলে যে সকল স্থায়ী বিম্ব ভাসমান দেখি, তাহাও ঠিক পূর্ব্বোক্ত কারণে উৎপন্ন হইয়া থাকে। সাধানের ন্যায় স্থায়ী বিম্বোৎপাদক নানাপ্রকার উদ্ভিজ্জ পদার্থ নদীজলে সর্ব্বদাই মিশ্রিত থাকে, ইহারই ফলে জল ফেনিল দেখায়। সমুদ্র জলে লবণ মিশ্রিত আছে জানিয়া লবণের অস্তিত্বই বুদ্বুদোৎপত্তির কারণ বলিয়া এ পর্য্যন্ত স্তির ছিল, কিন্তু বাস্তবিক তাহা নয়, বুদ্বুদোৎপত্তি-বিষয়ে লবণের কিছুই সহায়ত। নাই, সমুদ্রজ শৈবালজাতীয় উদ্ভিজ্জের গলিতাংশ হইতে বিম্বোৎপত্তি হয় বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে।

 তরল পদার্থে বিজাতীয় বস্তুর অস্তিত্বই যদি বিম্বোৎপত্তির কারণ হইল,—কি প্রকারে এই কার্য্য হয়, তাহা এখন আলোচ্য। সকলেই দেখিয়াছেন, বিশ্বমাত্রই সূক্ষ্ম আবরণ দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে; পরিষ্কার জল ও ঈথরের নিমেষকাল-স্থায়ী বিম্ব এবং সাবানের স্থায়ী বুদ্বুদেও উক্ত আবরণ দৃষ্ট হয়। এই সূক্ষ্ম আবরণ যতই দৃঢ় ও চাপসহনশীল হইবে, বিশ্বের স্থায়িত্বও তত অধিক হইবে। কাজেই দেখা যাইতেছে, তরল পদার্থের সূক্ষ্মাবরণের প্রকৃতিগত বৈষম্যই, বিম্বোৎপত্তি ও তাহার স্থায়িত্বের একমাত্র কারণ।

 তরল পদার্থমাত্রেরই মুক্তাংশের উপরিভাগ পূর্ব্বোক্ত সূক্ষাবরণ দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। এই আবরণের একটি বিশেষ গুণ আছে; এক খণ্ড রবার টানিয়া ধরিলে যেমন ইহা সঙ্কুচিত হইবার চেষ্টা করে— তরল পদার্থের সূক্ষ্মাবরণেরও এই প্রকার একটি আকুঞ্চনপ্রবণতা দৃষ্ট হইয়া থাকে। প্রত্যেক নির্দ্দিষ্ট তরল পদার্থে, এই গুণ সর্ব্বদাই সম পরিমাণে বর্ত্তমান থাকে। ইহার অস্তিত্ব নানা সহজসাধ্য উপায়ে বেশ প্রত্যক্ষ করা যায়। সাবানজলস্থ একটি বুদ্বুদ মধ্যে, ধীরে ধীরে সূক্ষ্ম কাচের নল প্রবিষ্ট করিলে বিম্বস্থ বায়ু নলের মুক্ত প্রান্ত দিয়া সবেগে বহির্গত হয়; ইহা দেখিলে জলাবরণের যে একটি আকুঞ্চনগুণ আছে তাহা বুঝা যায় এবং ইহা দ্বারাই যে বিম্বস্থ বায়ু সবেগে নিষ্কাশিত হইল তাহাও সুন্দর বুঝিতে পারা যায়। সাধারণ বিম্বাবরণের বহিঃস্থ ও মধ্যস্থ উভয় অংশেরই অল্পাধিক আকুঞ্চন ক্ষমতা আছে—জলবিন্দু বা পাত্রস্থ স্থির তরল পদার্থাদিতে, আবরণের কেবল মাত্র বহিরংশেই আকুঞ্চনশক্তি দৃষ্ট হয়।

 কোন নির্দ্দিষ্ট তরল পদার্থে সকল সময়ে যে, কেবল একটিমাত্র আবরণ থাকে তাহা নয়: অপর পদার্থ সংমিশ্রণে পৃথক্ আকুঞ্চনগুণসম্পন্ন একাধিক আবরণও থাকিতে পারে। জলে ভাসমান তৈলবিন্দুতে ইহার একটি বেশ উদাহরণ পাওয়া যায়। তৈল জল ও বায়ু এই পদার্থত্রয়ের সম্মিলনে, ভাসমান তৈলবিন্দুর বহির্ভাগে, তৈল ও বায়ু মধ্যে, ইহার নিম্নে জল ও তৈল মধ্যে এবং বাহিরে জল ও বায়ু মধ্যে, পৃথক্ গুণসম্পন্ন তিনটি আবরণ দৃষ্ট হয়। আবরণত্রয়ের আকুঞ্চন-শক্তি, যখন তৈলবায়ু ও তৈলজলের মধ্যস্থ আবরণদ্বয়ের আকুঞ্চন-শক্তির সমষ্টির সহিত সমান বা তদপেক্ষা অধিক হয়, তখন ইহা ক্ষুদ্র লেন্সের আকারে জলে ভাসিতে থাকিবে। কিন্তু সাধারণতঃ পরিষ্কার জল ও বায়ুমধ্যস্থ আবরণের আকুঞ্চনশক্তি অপর দুই আবরণের সমবেত শক্তি অপেক্ষা প্রায়ই অধিক দেখা যায়, এজন্য জলে তৈল নিক্ষেপ করিলে প্রথমোক্ত আবরণ, শক্তির আতিশয্য বশতঃ তৈলবিন্দুকে টানিয়া, সমগ্র জলে ব্যাপ্ত করিয়া ফেলে, কাজেই ইহা একস্থানে স্থির থাকিয়া ভাসিতে পারে না। তবে আমরা যখন ক্ষুদ্র তৈলবিন্দুকে জলের অত্যল্পস্থান অধিকার করিয়া ভাসিতে দেখি, তখন তাহার অপর কারণ থাকে। সমগ্র জল তৈলাচ্ছাদিত না হইয়া, কেবল একস্থানে তৈল ভাসিতে দেখা, পরিষ্কার জলে কিছুতেই সম্ভব নয়। যে জল পূর্ব্বে বিজাতীয় পদার্থযুক্ত বা তৈল সংমিশ্রিত হইয়া, উপরিস্থ আবরণের আকুঞ্চন ক্ষমতা কমাইয়া তাহাকে তৈলবিন্দুস্থ আবরণদ্বয়ের সমবেত শক্তির সহিত সমান করিয়াছে, তাহাতেই কেবল তৈলবিন্দু ব্যাপ্ত না হইয়া ভাসিতে পারে। কৌতূহলী পাঠকপাঠিকাগণ একটি ক্ষুদ্র পাত্রে জল রাখিয়া অনায়াসে ইহার পরীক্ষা করিতে পারেন।

 এখন পূর্ব্ববর্ণিত সহজ পরীক্ষা এবং আরো অনেক উদাহরণ দ্বারা দেখা যায় যে,—বিজাতীয় পদার্থ দ্বারা কলুষিত হইলে, তরল পদার্থের আবরণের স্বাভাবিক আকুঞ্চনশক্তি অনেক হ্রাস হয় এবং ইহারই ফলে বিম্বোৎপত্তির অনেক সুযোগ উপস্থিত হইয়া পড়ে। কারণ আকুঞ্চনশক্তি হ্রাস হওয়ায়, বিম্বাবরণে অধিক টান থাকে না, কাজেই ইহা চাপসহনশীল হইয়া উঠে এবং সহজে ছিন্ন হয় না।

 বিজাতীয় পদার্থ সংযোগে, সূক্ষ্মাবরণের আকুঞ্চনশক্তির বৈলক্ষণ্যের আরো দুই একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। বোধ হয় অনেকে দেখিয়া থাকিবেন, প্রশস্ত পাত্রস্থ নির্ম্মল জলে, কর্পূর নিক্ষেপ করিলে, ভাসমান কর্পূর-কণা জীবন্ত কীটের ন্যায় নানা গতিতে সবেগে জলের উপরে বিচরণ করিতে থাকে,—অনুসন্ধান দ্বারা দেখা গিয়াছে ইহা কর্পূর সংযোগে জলাবরণের আকুঞ্চনশক্তির হ্রাসের ফলমাত্র। প্রশস্ত পাত্রের সর্ব্বাংশে কর্পূর পরিব্যাপ্ত হইতে না পাইয়া, ইহা কেবল নিকটস্থ জলভাগের আকুঞ্চনশক্তি হ্রাস করে, কাজেই দূরস্থ জলাবরণের শক্তির আধিক্য প্রযুক্ত টান পাইয়া সেগুলি ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে থাকে। জলকে কোন প্রকারে কলুষিত বা তৈলাক্ত করিয়া তাহার আকুঞ্চন শক্তির হ্রাস করিলে, কর্পূরের গতি এককালে বন্ধ হইয়া যায়।

 এতদ্ব্যতীত ঝটিকাকালে সমুদ্রজলে তৈল নিক্ষেপ দ্বারা স্রোতের প্রকোপ প্রশমিত করিয়া, ঝটিকার অনিষ্টকারিতার হস্ত হইতে উদ্ধার পাইবার আজকাল যে একটি উপায় উদ্ভাবিত হইয়াছে, তাহাও জলাবরণের উপর, তৈলের প্রভাবের ফল বলিয়া অনেকে স্থির করিয়াছেন। ঝটিকাকালীন উদ্বেলিত সমুদ্রজলে তৈল নিক্ষেপ করিলে ইহা চতুর্দ্দিকে বিস্তৃত হইয়া, আবরণের আকুঞ্চন শক্তি দ্বারা, তৈলব্যাপ্ত জলে এক প্রকার টান উৎপাদন করে, এবং ইহারই ফলে জল সম্পূর্ণ স্থির হইয়া এক সমতলে থাকিবার জন্য চেষ্টা করে। কাজেই এই টানের বিরুদ্ধে প্রবল বায়ুরেগও সহসা স্রোত উৎপন্ন করিতে পারে না।

 পূর্ব্বে বলা হইয়াছে কলুষিত তরল পদার্থে, আবরণের আকুঞ্চন শক্তি হ্রাস হওয়ায়, বিশ্বাবরণে টান থাকে না, এইজন্য সহজে বিম্বোৎপত্তি হয়; ইহা বিম্বোৎপত্তি ও তাহার স্থায়িত্বের কারণ বটে, কিন্তু ইহাই যথেষ্ট নয়, এতদ্ব্যতীত আরে। কারণ আছে। কলুষিত তরল পদার্থ বা সাবানজলের সর্ব্বাংশে আকুঞ্চনশক্তি সমান থাকে না, এজন্যই বিম্ব অধিক কাল স্থায়ী হয়। আবরণের আকুঞ্চনশক্তি সর্ব্বাংশে সমান থাকিলে, ইহা বিম্বাকারে কিছুতেই শূন্যে দাঁড়াইতে পারিত না, স্বীয় ভারে আপনিই জলে লীন হইয়া যাইত। পূর্ব্বে বলা হইয়াছে, বিজাতীয় পদার্থের পরিমাণ ভেদে, তরল পদার্থের আবরণের আকুঞ্চনশক্তির পরিবর্ত্তন ঘটে; একই পদার্থের যে অংশ বিজাতীয় পদার্থ যোগে অধিক কলুষিত, তাহার সেই অংশের আকুঞ্চনশক্তি অপরাংশ অপেক্ষা অনেক কম। বিম্বাবরণের উর্দ্ধাংশ অপেক্ষা, অধোভাগে বিজাতীয় পদার্থ অধিক পরিমাণে সঞ্চিত থাকে। এ জন্য তাহার নিম্নাংশ অপেক্ষা, অল্প কলুষিত ঊর্দ্ধাংশের আকুঞ্চনশক্তি অধিক হইয়া পড়ে এবং ইহারই ফলে বিম্বও অধিক কাল স্থায়ী হয়।


  1. See Proccedings of the Royal Institute of Great Britain, March 1890.