বিষয়বস্তুতে চলুন

প্রাকৃতিকী/বৈজ্ঞানিকের স্বপ্ন

উইকিসংকলন থেকে

প্রাকৃতিকী


বৈজ্ঞানিকের স্বপ্ন

আমাদের শাস্ত্রে “ক্ষিত্যপ্‌তেজোমরুদ্ব্যোম” বলিয়া যে পঞ্চভূতের উল্লেখ আছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্ব্বে পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ তাহাদের চারিটি— মৃত্তিকা, জল, অগ্নি ও বায়ুকে ভূত অর্থাৎ মূলপদার্থ বলিয়া স্বীকার করিতেন। ইহাদের বিশ্বাস ছিল, ভূ-পৃষ্ঠের এই প্রাণিউদ্ভিদ্ নদীসমুদ্র, শিলাকঙ্কর সকলই সেই চারিটি মূলপদার্থে গঠিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর পণ্ডিতগণ যখন বহুযুগের অসম্বদ্ধ ভাব, চিন্তা ও অদ্ভুত কাহিনীর আবর্জ্জনা হইতে রাসায়নিক তত্ত্বের সারোদ্ধার করিয়া তাহাকে মুর্ত্তিমান্ করিতে চেষ্টা করিতেছিলেন, তখনো ইহারা সেই চাতুর্ভৌতিক সিদ্ধান্তে বিশ্বাস করিতেন।

 ঊনবিংশ শতাব্দীকে সর্ব্বপ্রকারে উন্নতির যুগ বলা যাইতে পারে। বসন্তের দক্ষিণ বায়ুর স্পর্শ যেমন সমস্ত প্রকৃতিকে সজীব করিয়া তোলে, ঊনবিংশ শতাব্দীর ঊষালোকের স্পর্শ তেমনি সমগ্র সভ্যদেশকে জাগ্রত করিয়া তুলিয়াছিল। বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিৎ প্রভৃতি সকলেই দীর্ঘকালের জড়তা ত্যাগ করিয়া সত্যকে বুঝিবার জন্য লালায়িত হইয়া পড়িয়াছিলেন। রসায়নবিদগণও প্রাচীন পুঁথির পাতা উল্টাইয়া মৃত্তিকা, জল, বায়ু ও অগ্নি কি কারণে মূলপদার্থ হইয়া দাঁড়াইল, তাহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছিলেন। বীক্ষাণাগারেও দেশবিদেশে মহাপণ্ডিতগণ পরীক্ষা সুরু করিয়া দিয়াছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে স্থির হইয়া গেল, জলবায়ু বা অগ্নিমৃত্তিকার কোনটিও মূলপদার্থ নয়। অক্সিজেন, হাইড্রোজেন প্রভৃতি কয়েকটি বায়ব পদার্থ এবং গন্ধক, তাম্র, লৌহ, স্বর্ণ, রৌপ্য, পারদ প্রভৃতি কয়েকটি তরল ও কঠিন পদার্থ সৃষ্টির মূল উপাদান। ইহার পরে অণু-পরমাণুর অস্তিত্বের প্রমাণ- প্রয়োগ করিয়া কি প্রকারে আধুনিক রসায়ন শাস্ত্রের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল, তাহার বিশেষ বিবরণ প্রদান নিষ্প্রয়োজন। অধিক দিন নয়, দশ বারো বৎসর পূর্ব্বেও বৈজ্ঞানিকগণ সেই অণু-পরমাণুরই স্বপ্ন দেখিতেছিলেন এবং উহাদিগকে অবলম্বন করিয়াই সৃষ্টির মূল রহস্য আবিষ্কারের চেষ্টা করিতেছিলেন। সম্প্রতি এক বৃহৎ সমস্যা উপস্থিত হইয়া বৈজ্ঞানিকদিগের সেই সুখস্বপ্ন ভাঙ্গিয়া দিয়াছে।

 পদার্থকে সচরাচর কঠিন, তরল ও বায়ব, এই তিন অবস্থাতেই আমরা দেখিয়া থাকি। ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে ইংরাজ-বৈজ্ঞানিক ক্রুক্‌স্ (Crooks) সাহেব পদার্থের এক চতুর্থ অবস্থার কথা প্রচার করিয়াছিলেন। প্রায়-বায়ুশূন্য কাচের নলের দুই প্রান্তে ব্যাটারির তার জুড়িয়া বিদ্যুৎপ্রবাহ চালাইতে থাকিলে, শূন্য নলের ভিতর বিদ্যুৎ চলিতে আরম্ভ করে। এই পরীক্ষায় ক্রুক্‌স্ সাহেব এক প্রকার অতি সূক্ষ্ম জড়কণাকে বিদ্যুৎ বহন করিতে দেখিয়াছিলেন। কণিকাগুলিতে কঠিন, তরল বা বায়ব কোন পদার্থেরই লক্ষণ দেখা যায় নাই। কাজেই আবিষ্কর্তা উহাদিগকে পদার্থের চতুর্থ অবস্থা বলিয়া প্রচার করিয়াছিলেন। আধুনিক বৈজ্ঞানিকদিগের অন্যতম নেতা সার উইলিয়ম্‌ লজ্ (Lodge) এই অদ্ভুত কণাগুলি লইয়া পরীক্ষা আরম্ভ করিয়াছিলেন এবং ইহার ফলে জানা গিয়াছিল, তাহারা আকারে ও গুরুত্বে লঘুতম পরমাণু অপেক্ষাও সহস্রগুণে ক্ষুদ্র! লজ্ সাহেব বুঝিয়াছিলেন, হয় ত এই জিনিষটাই সমগ্র সৃষ্ট পদার্থের মূল উপাদান, কিন্তু তখন বিষয়টির বিশেষ আলোচনা হয় নাই। কাজেই ক্রুক্‌স্‌ সাহেবের সেই চতুর্থ অবস্থার কথা চাপা পড়িয়া গিয়াছিল।

 প্রায় কুড়ি বৎসর হইল সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ষ্টোনি সাহেব (Johnstone Stoney) দেখিয়াছিলেন, অনেক যৌগিক পদার্থে ব্যাটারির দুইপ্রান্ত ডুবাইয়া রাখিলে পদার্থটি বিশ্লিষ্ট হইয়া যায় এবং বিশ্লিষ্ট অংশগুলি (Ions) তারের প্রান্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ বহন করিয়া সঞ্চিত হইতে থাকে। ইনি মাপিয়া ঐ বিদ্যুতের পরিমাণকে ইলেক্ট্রন (Electron) নামে অভিহিত করিয়াছিলেন। ইহার পর ক্রুক্‌স্‌ সাহেবের সেই পরমাণু অপেক্ষাও ক্ষুদ্র বিদ্যুৎপূর্ণ কণিকার উপর বৈজ্ঞানিকগণের দৃষ্টি পড়িয়াছিল। হিসাবে দেখা গেল, এগুলিরও বিদ্যুতের পরিমাণ ষ্টোনি সাহেবের ইলেক্ট্রনের সহিত অবিকল এক। সকলে ক্রুক্‌সের সেই সুক্ষ্ম কণিকাগুলিকে ইলেক্ট্রন নামে আখ্যাত করিতে লাগিলেন, এবং চিন্তাশীল বৈজ্ঞানিকগণ জড়কণিকা ও ইলেক্টনের একতা দেখিয়া ভাবিতে লাগিলেন, এ পর্য্যন্ত স্বর্ণ-রৌপ্য হাইড্রোজেন-নাইট্রোজেন প্রভৃতিকে যে, মূলপদার্থ বলা হইতেছে, তাহা ভুল। ইলেক্ট্রনের আবিষ্কার প্রচলিত রাসায়নিক সিদ্ধান্তকে খুবই বিচলিত করিয়া দিয়াছিল।

 এই প্রকার একটা প্রকাণ্ড ব্যাপারকে সম্মুখে রাখিয়া বৈজ্ঞানিকগণ আর নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকিতে পারেন নাই। নূতন গবেষণার শত দ্বার মুক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। ইংলণ্ড, ফ্রান্স ও জর্ম্মানী প্রভৃতি সকল দেশেরই বড় বড় বৈজ্ঞানিক মনে করিতে লাগিলেন, সত্তর বা আশীটি মূলপদার্থ নাই; বোধ হয়, এক মূলপদার্থে সমগ্র বিশ্বের রচনা হইয়াছে এবং তাহা সেই ইলেক্ট্রন্।

 ক্রুক্‌স্‌ সাহেবও নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া ছিলেন না। সকল পদার্থের গোড়ায় একটা মাত্র মূলপদার্থেরই অস্তিত্ব থাকা সম্ভব বলিয়া ইহার মনে হইয়াছিল। এই কাল্পনিক জিনিষটাকে “Protyle” নামে আখ্যাত করিয়া, ইনি তাঁহার নির্জ্জন বীক্ষণাগারে বসিয়া বিশ্বরচনার স্বপ্ন দেখিতে লাগিলেন। ইহাই মনে হইতে লাগিল, তাঁহার আবিষ্কৃত সেই সূক্ষ্ম কণাগুলি যেন কোন এক অজ্ঞাত শক্তিতে একত্র হইয়া হাইড্রোজেনের পরমাণুর রচনা করিতেছে। তাহাদেরই সহিত আবার কতকগুলি নূতন কণিকা অল্পাধিক পরিমাণে মিলিয়া গন্ধক, আর্সেনিক্, লৌহ, তামাদির সৃষ্টি করিতেছে এবং সমবেত কণিকার সমষ্টি অত্যন্ত অধিক হইয়া দাঁড়াইলে ইউরেনিয়ম্ প্রভৃতি গুরু ধাতুর সৃষ্টি চলিতেছে। স্বপ্নের শেষে দেখিতে পাইলেন, সেই বিদ্যুদ্বাহক কণিকা লঘুগুরু পদার্থের জন্ম দিয়াই ক্ষান্ত হইতেছে না, গুরু ধাতু হইতে তাহারা গোলা-গুলির মত ছুটিয়া বাহির হইয়া তাহাকে লঘুতর পৃথক্ পদার্থে পরিণত করিতেছে।

 পঁচিশ বৎসর পূর্ব্বে অধ্যাপক ক্রুক্‌সের পূর্ব্বোক্ত চিন্তা সত্যই স্বপ্নের ন্যায় ছিল। বিংশ শতাব্দীর আবির্ভাবে কিন্তু তাহাই সত্যে পরিণত হইতে চলিতেছে। ইলেক্ট্রন জিনিষটা যে কি, তাহা আজও নিঃসংশয়ে স্থির হয় নাই। কেহ সেগুলিকে বিদ্যুৎপূর্ণ জড়কণা বলিয়া প্রচার করিতেছেন, কেহ ইহাদিগকে খাটি বিদ্যুৎ বা মুর্ত্তিমান শক্তি বলিতে চাহিতেছেন। কিন্তু জিনিষটা যে সৃষ্টির মূল উপাদান সে বিষয়ে প্রায় সকলেই নিঃসন্দেহ হইয়া আসিয়াছেন।

 সংগঠনতত্ত্ব জানা না থাকিলেও, ইলেক্ট্রনের আকার প্রকার সম্বন্ধে অনেক নূতন তথ্য সংগৃহীত হইয়াছে। এগুলি আয়তনে এত ক্ষুদ্র যে, হাজারটি মিলিয়া জোট না বাঁধিলে, তাহাদের সমবেত আয়তন বা গুরুত্ব হাইড্রোজেনের পরমাণুর সমান হয় না এবং যখন ছুটিয়া চলে তখন উহাদের বেগের পরিমাণ আলোকের বেগের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ হইয়া দাঁড়ায়।

 রসায়নবিদ্‌গণ যখন এই অদ্ভুত জিনিষের সন্ধান পাইয়া তাহার রহস্য আবিষ্কারের জন্য অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন, তখন রেডিয়ম্ নামক এক অদ্ভূত ধাতুর আবিষ্কার গবেষণার এক নূতন পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছিল। নূতন ধাতুর আণবিক গুরুত্ব স্থির হইয়া গেল, বর্ণচ্ছত্রে (Spectrum) উহা কোন্ কোন্ বর্ণরেখার পাত করে তাহা দেখা গেল, এবং কোন্ কোন্ পদার্থের মিলনে তাহা কতগুলি যৌগিক উৎপন্ন করে তাহাও নির্দ্দিষ্ট হইল, কিন্তু রতিপ্রমাণ রেডিয়ম্ হইতে অবিরাম যে তাপরশ্মি ও ইলেকট্রন নির্গত হয় তাহার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। মূল পদার্থের পরিবর্ত্তন নাই ও বিয়োগও নাই বলিয়া যে বিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিকগণ শত বৎসর ধরিয়া পোষণ করিয়া আসিতেছিলেন, তাহা একটা প্রকাণ্ড ধাক্কা পাইয়া গেল। তা’ ছাড়া আলোক ও বিদ্যুতের উৎপত্তি প্রসঙ্গে যে সিদ্ধান্ত প্রচলিত আছে, তাহারো ভিত্তি যেন একটু চঞ্চল হইয়া পড়িল।

 পূর্ব্বোক্ত ঘটনার পর সেই বিদ্যুন্ময় ইলেক্ট্রন-প্রবাহ ও রেডিয়ম্ লইয়া এ পর্যন্ত নানা দেশে নানা গবেষণা হইয়া গিয়াছে। ইহার ফলে

প্রচলিত রাসায়নিক সিদ্ধান্তে বৈজ্ঞানিকদিগের অবিশ্বাসের মাত্রা ক্রমে বাড়িয়াই চলিয়াছে। রেডিয়ম্ একটা ধাতু এবং মূলপদার্থ, সুতরাং প্রচলিত সিদ্ধান্তানুসারে ইহার রূপান্তর না হইবারই কথা। কিন্তু ইহারই দেহ হইতে যে সকল ইলেক্ট্রন্ অবিরাম নির্গত হয়, তাহা যখন জোট বাঁধিয়া হেলিয়ম্ (Helium) নামক আর একটি ধাতুর উৎপত্তি করে, তখন রেডিয়মকে পরিবর্ত্তনশীল মূল পদার্থ বলিয়া স্বীকার করিতেই হয়। কেবল রেডিয়মেরই এই সৃষ্টিছাড়া ধর্ম্ম দেখিলে নিশ্চিন্ত থাকা যাইত, কিন্তু বৈজ্ঞানিকগণ ক্রমে অনেক মূলপদার্থে এই প্রকার ভাঙা-গড়ার সন্ধান পাইয়াছেন, কাজেই ব্যাপারটিকে হঠাৎ উড়াইয়া দেওয়া যাইতেছে না।

 ক্রুক্‌স্‌ সাহেব তাঁহার স্বপ্নের এই আংশিক সফলতা দেখিয়াই নিরস্ত হন নাই। ইনি পূর্ব্বোক্ত ইউরেনিয়ম্ নামক গুরু ধাতু পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছেন, ইহা খনির যে স্থানে থাকে, তাহার চারিদিকে রেডিয়ম্ পাওয়া যায়। প্রথমে ইহাকে একটা আকস্মিক ব্যাপার বলিয়াই বোধ হইয়াছিল; কিন্তু এখন দেখা যাইতেছে, যেখানে ইউরেনিয়ম্ আছে, তাহারি চারিদিকে রেডিয়ম্ জমিয়া রহিয়াছে। সুতরাং ইউরেনিয়ম্ ইলেকট্রন ত্যাগ করিয়া ক্ষয় পাইলেই যে, লঘুতর ধাতু রেডিয়মের উৎপত্তি করে, ইহাতে আর অবিশ্বাস করা চলিতেছে না। বংশের পরিচয় দিতে গেলে, বংশের প্রতিষ্ঠাতার নাম তালিকা-শীর্ষে স্থান পায়। তার পর পুত্র কন্যা পৌত্র দৌহিত্রের নাম যথাক্রমে বংশতালিকায় লেখা হইয়া থাকে। ক্রুক্‌স্ সাহেব ও অপর বৈজ্ঞানিকগণ ইউরেনিয়মের এক বংশতালিকা প্রস্তুত করিয়াছেন। জিনিষটা জ্ঞাত অজ্ঞাত ও ধাতু অধাতু পদার্থের মধ্যে গুরুত্বে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ। কাজেই ইহাকে প্রতিষ্ঠাতার আসন দিতে হইয়াছে। তাহার পরে ইহারি দেহচ্যুত ইলেক্ট্রন দ্বারা কোন্ কোন্ পদার্থের উৎপত্তি হইল দেখিয়া, তাহাদিগকে তালিকাভুক্ত করা হইতেছে। এই প্রকারে এক ইউরেনিয়নেরই পুত্র-পৌত্রাদির নামসহ এক প্রকাগু বংশতালিকা পাওয়া গিয়াছে। সস্তান-দিগের মধ্যে কে কোন্ খনিতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া কি আকারে আছে, আজও তাহার সন্ধান হয় নাই, তথাপি উহার বংশধরের সংখ্যা প্রায় কুড়ি হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহাদের সকলেই ডাল্‌টনের সিদ্ধান্তে মূলপদার্থ অর্থাৎ খাঁটি কুলীন, কিন্তু এখন ইহারা সকলেই ভাঙ্গিয়া চুরিয়া নিজেদের কুল গৌরব হারাইতেছে।

 বিদ্যালয়ের অধ্যাপক মহাশয় সত্তর-আশীটি মূলপদার্থের নাম মুখস্থ করাইয়া ছাত্রদের শিক্ষা দিতেন যে, মূলপদার্থের পরিবর্ত্তন নাই এবং ক্ষয়ও নাই। এখন দেখিতেছি এই দু’টির উল্‌টাই উনবিংশ শতাব্দীর মূল-পদার্থের প্রধান ধর্ম্ম। জীবরাজ্যে সকল জীবের আয়ুষ্কাল সমান নয়। যাহারা দুই চারি ঘণ্টায় জীবনের লীলা শেষ করে, এ প্রকার অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদের সহিত আমাদের পরিচয় আছে। আবার যাহারা দুইশত বৎসর বা হাজার বার বাঁচিয়া আছে, এ প্রকার জীবের সহিতও আমাদের পরিচয় রহিয়াছে। এ পর্যন্ত যে সকল বস্তুকে মূলপদার্থ বলা হইতেছিল, তাহাদের জীবনের ঐ প্রকার এক একটা সীমা আবিষ্কার হইয়া পড়িতেছে। ইউরেনিয়ম্ প্রায় ত্রিশকোটী বৎসর জীবিত থাকে এবং রেডিয়ম্ কয়েক সহস্র বৎসরের মধ্যেই বিকার প্রাপ্ত হইয়া পদার্থান্তরে পরিণত হয়। অর্থাৎ কয়েক রতি ইউরেনিয়ম্ ধাতুকে কোন পাত্রে রাখিয়া যদি ত্রিশ কোটি বৎসর প্রতীক্ষা করা হয়, তবে ঐ দীর্ঘকালের শেষে পাত্রে আর ইউরেনিয়মের সন্ধান পাওয়া যাইবে না; উহার দেহনির্গত তেজ অর্থাৎ ইলেক্ট্রন হইতে যে সকল অপর পদার্থের উৎপত্তি হইবে, তাহারাই পাত্রটিকে পূর্ণ করিয়া রাখিবে। সীসকের (Lead) গুরুত্ব স্বর্ণ ও রৌপ্য প্রভৃতি ধাতুর তুলনায় অনেক কম, সুতরাং কালক্রমে ক্ষয় দ্বারা সীসকের স্বর্ণে পরিবর্ত্তিত হওয়া বিচিত্র নয়। কোন ভবিষ্যদ্দর্শী ব্যক্তি তাঁহার লোহার বাক্সে সীসা বোঝাই করিয়া যদি সুবর্ণপ্রাপ্তির আশায় প্রতীক্ষা করেন, তবে অবৈজ্ঞানিকদিগের নিকট লাঞ্ছিত হইলেও বৈজ্ঞানিক সমাজে এখন তাঁহার সমাদর লাভের সম্ভাবনা আছে।

 এই সকল দেখিয়া শুনিয়া পদার্থতত্ত্ববিদ্‌গণ বলিতেছেন, এই যে নদীসমুদ্রপ্রাণিউদ্ভিদ্‌ময় জগৎ দেখিতেছ, ইহা মূলে কিছুই নয়। জড় বলিয়া কোন জিনিষই বিশ্বে নাই। জড়ের সূক্ষ্মতম কণা অর্থাৎ পরমাণুকে ভাঙ্গিয়া হাজারটি বা ততোধিক সূক্ষ্মতর অংশে ভাগ কর, দেখিবে, এই সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণাগুলি সেই ইলেক্ট্রনের মূর্ত্তি গ্রহণ করিয়াছে। আবার ইলেক্ট্রনগুলি খাঁটি বিদ্যুতের কণিকা ব্যতীত আর কিছুই নয়। কাজেই বলিতে হইতেছে, এই ব্রহ্মাণ্ড এক বিদ্যুতেরই রূপান্তর। অর্থাৎ জগতে জড় নাই, এক শক্তিকে লইয়াই বিশ্ব।

 ক্রুক্‌স্ সাহেব গত শতাব্দীর শেষে যে স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, তাহা সফল হইয়াছে। পদার্থতত্ত্ববিদগণ এখন স্বপ্নে জড়ের শক্তিমূর্তি দেখিতেছেন; স্বপ্ন সাফল্যের দিকেই অগ্রসর হইতেছে। শতাব্দীর শেষে এই সকল স্বপ্নের স্থানে কোন স্বপ্ন আসিয়া বিশ্বের কোন মূর্ত্তি সম্মুখে ধরিবে, তাহা কেবল বিশ্বনাথই জানেন।