প্রাচীন ভারতে নারী/বিবাহবন্ধন-ছেদনে শাস্ত্রবিধি

উইকিসংকলন থেকে

বিবাহবন্ধন-ছেদনে শাস্ত্রবিধি

 এই প্রকরণের কিছু কিছু কথা ব্যবহার-নির্ণয়ের আলোচনা সময়ে আবার পুনরুক্তি করিতে হইবে। উভয় স্থলে এই কথাগুলির প্রয়োজন থাকায় তাহা এড়াইবার উপায় নাই।

 বিবাহে কন্যাদোষপ্রসঙ্গে শাস্ত্রকারেরা বলিয়াছেন, চিররোগ, কুৎসিত রোগ, অঙ্গহীনতা, ধৃষ্টতা, অন্যের সঙ্গে প্রীতি ও অন্যসঙ্গতা হইয়া থাকিলে সেই কন্যা বিবাহ করিবে না (নারদীয় মনুসংহিতা ১২. ৩৬)। বরেও চিররোগ, কুৎসিত রোগ থাকিলে, উন্মত্ত, পতিত, ক্লীব, দুর্ভাগ্য ও ত্যক্তবান্ধব হইলে তাহা বরদোষ (ঐ ১২.৩৭)। এইসব দোষ লুকাইয়া বিবাহ দিলে সে বিবাহ বৈধ নহে।

 প্রাচীন শাস্ত্রে একটি পুরাতন বিধি আছে, ‘নাবীজী ক্ষেত্রমর্হতি’ অর্থাৎ যাহার বীজ নাই সে ক্ষেত্র পাইতে পারে না। নারদীয় মনুসংহিতায়ও (১২. ১৯) সেই কথাই পাই।

 এইজন্যই দেবণ্ণ ভট্ট বলেন, বিবাহের পূর্বে বর পৌরুষসম্পন্ন কি না তাহা যত্নে পরীক্ষা করিয়া দেখা চাই। যাজ্ঞবল্ক্যেরও এই মত। তিনি আরও বলেন, বর যুবা, ধীমান, জনপ্রিয় হওয়া আবশ্যক (আচার, ৩. ৫৫)।

 এইসব বিষয়ে অনুমান বা কল্পনার উপর নির্ভর করিলে চলিবে না। রীতিমত বৈজ্ঞানিকভাবে শরীরতত্ত্ববিদ পণ্ডিত ও বিজ্ঞজনের দ্বারা শরীর ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করাইলে তাহা বিধিসংগত হইবে না। এই কারণেই নারদ বলেন, স্বীয় অঙ্গলক্ষণের দ্বারা পৌরুষ আছে ইহা নিশ্চিতরূপে পরীক্ষাসিদ্ধ হইলে তবে বিবাহার্থী-পুরুষ কন্যা পাইতে পারে (নারদীয় মনু ১২. ৮)।

 এই দৈহিক পরীক্ষায় যাহাতে সব দিকে নজর থাকে সেইজন্য শাস্ত্র নানা দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন। তাই ইহার পর নারদীয় মনুসংহিতায় (১২. ৯-১০) বহু আলোচনা দেখা যায়। পৌরুষের সব অঙ্গ-লক্ষণ দেওয়া আছে, ইহার অভাবে ক্লীব মনে করা উচিত। ক্লৈব্যও যে বহুবিধ হইতে পারে তাহা তাঁহাদের জানা ছিল। তাই তার পর নানাপ্রকারের ক্লৈব্যের কথা নারদীয় মনুসংহিতায় আছে। কতক ক্লীবত্ব জন্মগত, কতক ইন্দ্রিয়হীনতাবশত, কতক ক্লৈব্য কালগত, কতক ঈর্ষ্যাদিহেতুক, কতক বা সাময়িকভাবে অপগত হয়। কতক ক্লৈব্যে কিছু অদ্ভুতত্ব (abnormality) থাকে, কতক ক্লৈব্য যথাস্থানে নিষেক হয় না অথবা নিষেকই হয় না, হইলেও সন্তান হয় না। কাহারও পৌরুষ বা নারীর কাছে সংকুচিত, কাহারও বা স্বভার্যায় পৌরুষ হয় না অথচ অন্যত্র হয় (ঐ ১২. ১২. ১৩)। ভাষ্যকার ভবস্বামী বলেন, এইসব ক্লীবত্বের কথা না জানাইয়া যে বিবাহ করে, অথবা বরের এই দোষ জানিয়াও যে কন্যা দেয়, সে রাজদণ্ডে দণ্ডনীয় (ঐ ১২. ১৪. ভাষ্য), কারণ বিবাহসংস্কার জীবনব্যাপী ব্রত ও তাহা সামাজিক দায়িত্ব। তাই এই অপরাধে বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষ উভয়কেই সমাজ ও রাজা শাসন করিতে বাধ্য। তবু যদি কোনো কারণে এইরূপ বিবাহ ঘটিয়া যায়, তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক মাস, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্বৎসর প্রতীক্ষা করিবে (ঐ ১২. ১৪)। যদি তাহার পরও বরের এইসব প্রকারের কোনো না কোনো ক্লৈব্য আছে ইহা বুঝা যায় তবে তাহার পরেও সেই বরকে ত্যাগ করিবে, এবং তাহা অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না (ভবস্বামী, তত্র)। কোনো কোনো ক্লৈব্যে যে মানসিক (psychological) অদ্ভুতত্ব বা বীজদোষ থাকে সেইরূপ চারি প্রকার ক্লৈব্য-ক্ষেত্রে পতিসমাগম হইয়া থাকিলেও পতিতবৎ পতিকে ত্যাগ করিতে হইবে (নারদীয় মনু, ১২. ১৫)।

 সমাগমকালেই এইসব ক্লৈব্য অনেক সময় ধরা পড়ে। তাই সমাগতা হইলেও এইরূপ ক্ষেত্রে কন্যাকে যোগ্য পতির সহিত সংগত করিবে। তাহার অর্থ এইরূপ ক্ষেত্রে পত্যন্তর গ্রহণই বিহিত। বীজে জননশক্তি না থাকিলে, এক বৎসর প্রতীক্ষা করিয়া পত্যন্তর গ্রহণ করিবে (ঐ ১৬)। নারীতে যদি পৌরুষ সংকুচিত বা নিজ স্ত্রীতে যদি পৌরুষ না হয়, তবে সেই নারী পত্যন্তর গ্রহণ করিবে (ঐ ১৭-১৮)। কারণ অপত্যার্থ ই স্ত্রী সৃষ্ট, সেই ক্ষেত্র বীজবানকেই দিবে; যে বীজহীন সে ক্ষেত্র পাইতে অধিকারী নহে (ঐ ১৯)। এমন স্থলে সেই কন্যাকে পিতাই পুনরায় অন্য বরে দান করিবেন, বা তদভাবে অন্য কোনো গুরুজন দান করিবেন। অথবা হয়তো মাতা বা স্বজাতি কেহ দান করিবেন। ইহাও যদি সম্ভব না হয় তবে রাজার আজ্ঞায় কন্যা স্বয়ংই পতি-বরণ করিবে (ঐ ২০-২২)। অর্থাৎ এইরূপ ক্ষেত্রে পিতা-মাতা নাই বলিয়া পত্যন্তরগ্রহণ ফেলিয়া রাখিলে চলিবে না, কারণ তাহাতে সমাজেরই ক্ষতি। কাজেই এমন স্থলে সমস্ত সমাজের হইয়া রাজাই সেই কন্যাকে অনুরূপ বরে দিবেন। সবর্ণ, কুল-রূপ-বয়ঃ-শ্রুতাদিতে যে অনুরূপ, সেই বরের সহিত কন্যা বিবাহ-ধর্মাচরণ করিবে এবং তাহার দ্বারা পুত্রাদি উৎপন্ন করাইবে—

সবর্ণমনুরূপং চ কুলরূপবয়ঃশ্রুতৈঃ।
সহধর্মং চরেৎ তেন পুত্রাংশ্চোৎপাদয়েৎ ততঃ। ঐ ১২.২৩

 তবু বীজহীনকে ক্ষেত্র ফেলিয়া দিয়া রাখা চলিবে না, কারণ তাহা সামাজিক ধর্মের বিরোধী। সমাজ চাহে সম্প্রসারণ। এইসব অপরাধে সমাজ ক্রমে সংকুচিত হয়, কাজেই এইরকমের অপরাধ সর্বভাবে দূর করিতে হইবে। যে পুরুষ প্রজাসৃষ্টিতে অক্ষম, সে সমাজের পক্ষে বৃথা ভার মাত্র। তাহার বিবাহকে বিবাহই ধরা হইবে না। এইরূপ বিবাহে সমাজের দুর্গতি দিন দিন বাড়িয়া চলে, কাজেই এইরূপ বিবাহ হইয়া থাকিলেও তাহা অসিদ্ধ।

 কেহ যদি বিবাহ করিয়াই কন্যাকে ফেলিয়া দেশান্তরে চলিয়া যায় তখনও তো বীজ থাকিতেও ক্ষেত্রে বীজের অভাব ঘটে। তাই নারদ (১২. ২৪) বলিতেছেন, বরণ করিয়াই যদি কেহ দেশান্তরে যায় তবে তিনটি ঋতুকাল প্রতীক্ষা করিয়া কন্যা অন্য বরকে বরণ করিবে; ঋতু যাহাতে ব্যর্থ না হয় তাই প্রত্যেক ঋতুর কথা কন্যা বান্ধবদের বলিবেন, তাঁহারা যদি তিনটি ব্যর্থ ঋতুর পরেও সেই কন্যাকে অন্য বরের কাছে না দেন তবে তাঁহারাই পাপী হইবেন (ঐ ২৫)।

 কন্যার জন্য যদি শুল্ক গ্রহণ করার পর আরও ভালো বর আসে তবে ভদ্রভাবে পূর্ব সম্বন্ধ ভাঙিয়া দিলেও দোষ হইবে না (ঐ ৩০)। অক্ষতযোনি (ঐ ৪৬), ক্ষতযোনি (ঐ ৪৭) উভয় প্রকারই পুনর্ভূ হইতে পারে। দেবর না থাকিলে অন্য কোনো অসবর্ণ বা সবর্ণের সঙ্গে যদি কন্যার পুনরায় বিবাহ দেওয়া হয় তবে তাহাও পুনর্ভূ (ঐ ৪৮)। পুত্রকামনায় গুরুজনের আজ্ঞায় দেবরকে গ্রহণ করিলে ব্যভিচার দোষ ঘটে না (ঐ ৮০)।

 প্রব্রজিত, নষ্ট, ক্লীব, পতিত ও মৃত এই পঞ্চ আপদে নারীদের পত্যন্তর গ্রহণ বিহিত হয় (ঐ ৯৯) ইহা ইঁহারও অভিমত।

 পতি প্রোষিত হইলে ব্রাহ্মণ স্ত্রী পতির জন্য আট বৎসর প্রতীক্ষা করিবে। সন্তান না হইয়া থাকিলে চারি বৎসর প্রতীক্ষা করিয়া অন্য পতি সমাশ্রয় করিবে (ঐ ১০০); ক্ষত্রিয়া ছয় বৎসর প্রতীক্ষা করিবে, অপ্রসূতা হইলে তিন বৎসর; বৈশ্যা চারি বৎসর, অপ্রসূতা হইলে দুই বৎসর প্রতীক্ষা করিবে (ঐ ১০১); শূদ্রাদের কোনো কাল-নিয়ম নাই, ধর্ম-ব্যতিক্রমও নাই। বিশেষতঃ সন্তান না থাকিলে এক বৎসরের পর পত্যন্তরগ্রহণে শূদ্রার কোনো দোষই নাই (ঐ ১০২)। যদি পতির কোনো খবর না পাওয়া যায় তবে এই বিধি। তাহার কোনো খবর-বার্তা জানিলে ইহার দ্বিগুণকাল প্রতীক্ষা করিবে (ঐ ১০৩)। প্রজাপ্রবৃত্তির জন্যই প্রজাপতির সৃষ্টি, তাই এইভাবে সমাজে প্রজাস্থিতির জন্য অন্য-পুরুষ-গমনে নারীদের কোনো দোষই হয় না (ঐ ১০৪)।

 গৌতমও অনুরূপ স্থলে পত্যন্তরগ্রহণের ব্যবস্থা দিয়াছেন (গৌতম সংহিতা, ১৮ অধ্যায়); গৌতম ধর্মসূত্রেও (১৮ অধ্যায়) এই বিষয়ের সমর্থন আছে এবং সেখানে ভাষ্যকার বৃহস্পতিরও সমর্থক-বচন উদ্ধৃত করিয়াছেন।[১]

 বসিষ্ঠ সংহিতাও বলেন, স্বামী প্রোষিত হইলে পঞ্চবর্ষ প্রতীক্ষা করিবে। প্রজাতা অর্থাৎ সন্তানবতী হইলে ব্রাহ্মণী পাঁচ বৎসর, ক্ষত্রিয়া চারি বৎসর, বৈশ্যা তিন বৎসর, শূদ্রা দুই বৎসর প্রতীক্ষা করিবে। ইহার পরে সমানোদক সপিণ্ড সজন্ম স-ঋষি ও সগোত্রের মধ্যে পূর্ব পূর্বই শ্রেষ্ঠ। তাহা প্রাপ্তিতে তাহাকেই পতিরূপে গ্রহণ করিবে। স্বকুলজাত পাইলে পরগামিনী হইবে না।[২]


 আনন্দাশ্রম সংস্করণে আর-একটু এইখানে আছে— পঞ্চবর্ষ প্রতীক্ষা করিয়া পতির কাছে প্রোষিত পত্নী যাইবে। যদি ধর্মার্থ বা কামার্থ যাওয়া সম্ভব না হয়, তবে বিধবার মত ব্রতধারিণী হইয়া প্রতীক্ষা করিবে। প্রজাতা ব্রাহ্মণী ক্ষত্রিয়া বৈশ্যা শূদ্রা পাঁচ-চার-তিন-দুই বৎসর প্রতীক্ষা করিয়া তাহার পরে পতির সমানোদক, সপিণ্ড, সপ্রবর, সগোত্র পত্যন্তর গ্রহণ করিবে। ইহাতে সগোত্র অপেক্ষা সপ্রবর ভালো। তদপেক্ষা সপিণ্ড, তদপেক্ষা সমানোদক ভালো। স্বকুলজাত পাইলে পরগামিনী হইবে না।[৩]

  1. Mysore Tribes and Castes, Vol II, পৃ ৩৬০
  2. বসিষ্ঠ সংহিতা, মন্মথনাথ দত্ত সংস্করণ, ১৭ অধ্যায়
  3. বসিষ্ঠস্মৃতি, আনন্দাশ্রম, ১৭. ৬৭. ৭১