প্রাচীন ভারতে নারী/সামাজিক অবস্থা

উইকিসংকলন থেকে

সামাজিক অবস্থা: বিবাহ

 মানুষ সামাজিক জীব। ঘর-সংসার বাঁধিয়া পরিবার পল্লী সমাজ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত করিয়া কুলোচিত আচার পালন করিয়া মানুষ জীবন যাপন করে। তবে ইহার মধ্যেও দেশভেদে স্কুলভেদে আচার-বিচারের ইতরবিশেষ দেখা যায়।

 ভারতে আর্যদেরও পূর্বে দ্রবিড়দের বাস ছিল, দ্রাবিড়দের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ছিল রীতিমত উচ্চ ধরনের। তাহার পূর্বেও বহু জাতি নানা রকম সভ্যতা ও সংস্কৃতি লইয়া এইদেশে বাস করিয়া গিয়াছে। আর্যরা এইদেশে আসিয়া কতকটা নিজেদের প্রাচীন আচার-বিচার বজায় রাখিতে পারিল এবং চারিদিকের প্রভাবে ও জাতিগত মিশ্রণের ফলে কতকটা চারিদিকের আচারবিচার গ্রহণ করিতেও বাধ্য হইল। আর্যপূর্ব নাগ প্রভৃতি জাতির সঙ্গে ব্রাহ্মণাদি আর্যজাতির বিবাহ সর্বদাই হইত। দক্ষিণের চেররা নাগবংশীয়, ইহা ছাড়া আরও বহু নাগবংশীয় এখনও ভারতের নানা স্থানে আছে।[১]

 পূর্বে বৈদিকযুগে বরকন্যার বিবাহ হইত যৌবনে। তখন জাতিভেদ প্রবর্তিত হয় নাই এবং প্রবর্তিত হইয়া থাকিলেও তাহার তেমন বাঁধাবাঁধি ছিল না। বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিবাহ হইলেও সামাজিক কোনো অসুবিধা ঘটিত না। কিন্তু পরে যখন জাতিভেদ ভালো করিয়া প্রতিষ্ঠিত হইল, তখন ছেলেমেয়েদেরই পছন্দের উপর বিবাহ-ব্যাপারটা ছাড়িয়া দেওয়া আর চলিল না। কারণ এইসব পছন্দ তো আর জাতিকুল বাঁচাইয়া হইবার কথা নহে। কাজেই নামে বর থাকিলেও বরণ প্রথাটি গেল। গুরুজনদের ব্যবস্থা অনুসারে অপ্রাপ্তবয়স্ক বরকন্যাকেই বিবাহ দিবার প্রথা প্রবর্তিত হইল।

 আর্যদের মধ্যে পুরুষদেরই ছিল প্রাধান্য। দ্রবিড়দের সামাজিক ব্যবস্থাতে মেয়েদেরই ছিল মুখ্যতা। দ্রাবিড়দের মধ্যে মেয়েদের অনেকটা স্বেচ্ছাচার চলিত। সেখানে আর্যদের যাগযজ্ঞ গিয়া পৌঁছিলেও তাহাদের মধ্যে দ্রাবিড়জাতিসুলভ স্বাধীন মেয়েদের প্রভাব বজায় ছিল। মেয়েরা সেখানে যজ্ঞাগ্নি ফুঁ দিয়া জ্বালাইতেন (মহাভারত, বঙ্গবাসী সংস্করণ, সভা, ৩১.২৯)। সেখানে নারীরা দেবতার বরে ‘অপ্রতিবারিতা’ ‘স্বৈরিণী’ (ঐ ৩১.৩৮)। এসব কথা পূর্বেও বলা হইয়াছে। শ্রীযুত নঞ্জুনদায়্যা এবং অনন্তকৃষ্ণ আইয়ার মনে করেন স্বেচ্ছাবিহারিণী দ্রবিড় কন্যাদের মধ্যে বিবাহের পূর্বে যে ব্যভিচার দেখা যাইত তাহা দেখিয়াই হয়তো এদেশে আর্য বরকন্যাদের বিবাহের বয়স সীমাবদ্ধ করা হইল।[২]

 মন্বাদি স্মৃতিতে আমরা আট প্রকারের বিবাহের উল্লেখ পাই। তাহার মধ্যে ব্রাহ্ম দৈব আর্য প্রাজাপত্য এই চতুর্বিধ বিবাহই মন্বাদির প্রশংসিত। প্রচলিত থাকিলেও আসুর গান্ধর্ব রাক্ষস পৈশাচ এই চতুর্বিধ বিবাহ নিন্দিত। আসুর-বিবাহে কন্যার জন্য ধন গৃহীত হয়, গান্ধর্ব-বিবাহে বরকন্যা কামতঃ পরস্পরে যুক্ত হয়, অনিচ্ছায় কন্যা হৃত হইলে হয় রাক্ষস-বিবাহ, সুপ্তা বা প্রমত্তা কন্যাকে গোপনে সংগ্রহ করাকে পৈশাচ-বিবাহ বলে (মনু, ৩. ২১-৩৪)।

 সগোত্রা সমানপ্রবরা কন্যাকে বিবাহ করা চলে না। বাংলাদেশে গোধূলিতে বিবাহ হইলেও দিনে বিবাহ হয় না। ভারতের আর-সব স্থানে দিবাভাগে বিবাহ হয়। মহারাষ্ট্র গুজরাট প্রভৃতি প্রদেশে এবং ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে দিনেও বিবাহ হয়। অনন্তকৃষ্ণ আইয়ার বলেন, মহীশূর প্রভৃতি স্থানের শুদ্ধবেদাচারী ব্রাহ্মণদের মধ্যে দিবা-বিবাহ প্রচলিত। বরযাত্রীরা বিবাহের পূর্বরাত্রিতে কন্যার বাড়ির অতিথি হন। সকালে বরকন্যা স্নাত ভূষিত হইলে বরণ ও মুখদর্শন হয়। তারপর মধুপর্ক ও বিবাহ আচার চলিতে থাকে। বিবাহহোম পানিগ্রহণ লাজ-হোম সপ্তপদী প্রভৃতি তখনই হইয়া যায়। সন্ধ্যার সময় বরকন্যা অরুন্ধতী দর্শন করেন। সন্ধ্যার সময় গৃহপ্রবেশ-হোম সম্পন্ন হয়। তাহার পর স্থালীপাক হইয়া ঔপাসনে অগ্নিহোত্র হয়।[৩]

 এই যে অনুষ্ঠানপূর্বক বিবাহ এবং পতিপত্নীর পবিত্র সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠা, ইহা একদিনে সাধিত হয় নাই। সমাজের মধ্যে বহুযুগের সংস্কৃতির ও সভ্যতার ফলে ক্রমে ইহা স্থাপিত হইয়াছে। বিবাহাদি সামাজিক অনুষ্ঠান স্থাপিত হইলেও তাহার আশেপাশে বহুকাল ধরিয়া নানা চ্যুতি-বিচ্যুতিও চলিয়াছে। প্রবল বৃষ্টি হইলে যেমন কতক জল নদীর ধারাপথে চলে, প্রবলতর বন্যা হইলে কতকটা জল নদীর ধারাপথে চলিলেও আশেপাশে বন্যার অনেকখানি প্লাবন চলে, তেমনি কতক মানুষের মধ্যে এই সামাজিক শৃঙ্খলা চলিলেও মানুষের এই আদিম প্রবৃত্তির বন্যাও যে আশেপাশে বিলক্ষণ বহিয়া যাইত তাহার পরিচয় প্রাচীন বেদ-পুরাণেও পাওয়া যায়। খাল কাটিয়া বন্যা রোধ করা বরং সহজ, কিন্তু বিধিবিধানের দ্বারা মানবের এই দুর্বার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করা কঠিন। আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতসাহিত্যই তাহার সাক্ষ্য দিবে। আর যেসব মুনিঋষিরা সমাজকে সংযত করিতেন সেই প্রবলদেবতা কামের কাছে তাঁহারাও কম বিড়ম্বিত হন নাই। তাহা ছাড়া যেসব দেবতার দোহাই দিয়া মানুষকে নিবৃত্ত করিতে হইবে তাঁহাদেরও বহু দুর্গতির কথা শাস্ত্রে পুরাণে বর্ণিত। আইনে দেখা যায় বটে ব্যভিচারীদের প্রতি কঠিন দণ্ডের বিধান ছিল। বরুণপ্রঘাস নামে বরুণপাশমোচনের জন্য একটি অনুষ্ঠান আষাঢ় পূর্ণিমায় করিতে হইত।[৪] ইহাতে স্ত্রীকে তাহার গোপন প্রেমাস্পদের নাম প্রকাশ্যে বিজ্ঞপিত করিতে হইত।

 শাঙ্খায়ন-গৃহ্যসূত্রে দেখা যায়, মাতা পাতিব্রত্য হইতে ভ্রষ্ট হইলে সেই দোষস্খলনের জন্য যজ্ঞকালে ব্রতীকে মন্ত্রপাঠ করিতে হয়। সামান্য এক-আধটু পাঠান্তর থাকিলেও আপস্তম্ব-শ্রৌতসূত্রে (১. ১. ৯.) আপস্তম্ব-মন্ত্রপাঠে (২. ১৯. ১) ও হিরণ্যকেশি-গৃহ্যসূত্রে (২.১০.৭) সেই একই কথা। মনু পর্যন্ত এইরূপ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা দিয়াছেন। তিনি সেইজন্য মন্ত্রেরও উল্লেখ করিয়াছেন—

যন্মে মাতা প্রলুলুভে বিচরন্ত্যপতিব্রতা।
তন্মে রেতঃ পিতা বৃঙ্‌ক্তামিত্যসৈতন্নিদর্শনম্। ৯. ২০

অর্থাৎ মাতার ব্যভিচারজনিত দোষ পিতার দ্বারা শুদ্ধ হউক। এইজন্যই কি কাঠক-সংহিতাতে (৩০.১) ব্রাহ্মণের পিতামাতার খবর জিজ্ঞাসা করা নিষিদ্ধ ছিল, ধর্মশাস্ত্রে ও দৈবকর্মে ব্রাহ্মণপরীক্ষা (শঙ্খ-সংহিতা ১৩. ১) নিষিদ্ধ ছিল।

 পুরুষদের ব্যভিচারের কথাও বহুস্থলে উল্লিখিত আছে। ইন্দ্র-অহল্যার কথা সকলেই জানেন। যজুর্বেদে তৈত্তিরীয়-সংহিতায় (৭.৪. ১৯. ২-৩) এবং বাজসনেয়ি-সংহিতায় (১৩. ৩০. ৩১) দৃষ্টিপাত করিলে বুঝা যায় শূদ্রাতেও আর্যগণ ব্যভিচাররত হইতেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদের এমন কয়েকটি মন্ত্র আছে (৬. ৪. ৯-১১) যাহা অনুবাদ করাও অসম্ভব।

 তৈত্তিরীয়-সংহিতা (৬.৮.৩ মন্ত্র) এবং মৈত্রায়ণী-সংহিতা (৩.৪. ৭ মন্ত্র) দেখিলে বুঝা যায় তখনকার দিনেও নৈতিক বিষয়ে বেশি কড়াকড়ি করিলে চলিত না। স্মৃতি ও অর্থশাস্ত্রে গূঢ়োৎপন্ন সন্তানদের কথা ও ব্যবস্থা আলোচিত হইয়াছে। বোধায়ন (২. ২.৩৪) ও আপস্তম্ব (২. ১৩. ৭) ধর্মসূত্র বলেন যে, জনকের কথায় বুঝা যায় কোনোকালে স্ত্রীগণ ছিল সাধারণভোগ্যা। শ্বেতকেতু তাহা নিবৃত্ত করেন। নারীদের এই দুর্বলতার কথা বৃহস্পতিও (২.৩০) উল্লেখ করিয়াছেন।[৫]

 বেদে যম-যমীর উপাখ্যানের (ঋগ্বেদ ১০.১৩) হয়তো অন্য কোনো অর্থ আছে। ঋগ্বেদে (১০.৬১) যে আপন দুহিতার প্রতি প্রজাপতির কামমোহের কথা আছে তাহার অর্থ কুমারিলভট্ট দেখাইয়াছেন, উষার দিকে সূর্যের ধাবমান হইবার কথা, কাজেই এইসব যন্ত্রের দ্বারা কিছু প্রমাণিত হয় না। ঐতরেয় (৩. ৩৩) এবং শতপথ ব্রাহ্মণেও (১. ৭. ৪. ১) এই প্রসঙ্গের অন্য ব্যাখ্যা আছে। কখনও কখনও ভ্রাতা বা জাররূপে দুর্ভাগ্য আসিয়া গর্ভ নষ্ট করে (ঋগ্বেদ ১০. ১৬২. ৫), কখনও নিদ্রাবস্থায় দুষ্টসত্বেরা ভ্রাতা বা পিতা হইয়া সঙ্গত হয় (অথর্ব ৮. ৬. ৭)। এইসব মন্ত্রেরও হয়তো অন্য কোনো হেতু থাকিতে পারে। তবে অথর্ব-ব্রাত্যকাণ্ডে (১৫. ২. ৫) ব্রাত্যের সঙ্গে পুংশ্চলীর উল্লেখ করায় বুঝা যায়, পরপুরুষপ্রিয়া ব্যভিচাররতা রমণীর তখনও অভাব ছিল না। অথর্বের ১৪. ১. ৩৬ মন্ত্রে সূর্যার প্রসঙ্গে আমরা ‘মহানগ্ন্যাঃ' শব্দ পাই। অথর্বে (২০.১৩৬.৫ মন্ত্রে) ‘মহানগ্নী’ শব্দ দেখি। মহানগ্নী শব্দও নির্লজ্জা-ব্যভি- চারিণী অর্থে প্রযুক্ত। বাজসনেয়ি-সংহিতায় (৩০.১৬) ‘অতিত্বরী বিজর্জরা’ শব্দেও তাহাই বুঝায়। তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণে (৩.৪.২.১) এবং বাজসনেয়ি-সংহিতায় (৩০.৬) ‘কুমারী-পুত্র’ শব্দ দেখা যায়। অথর্বে (৫.৫.৮) ‘কানীন-পুত্রের’ কথা আছে। ঋগ্বেদে (৪.১৯.৯) দেখা যায়, অগ্রুবকে বল্মীক কীটেরা খাইতেছিল, ইন্দ্র তাহাকে উদ্ধার করেন। সায়ণ বলেন, সেই সন্তানের মাতার নাম অগ্রূ। অনেকে মনে করেন বিবাহের অগ্রে জাত বলিয়া অগ্রূব। এই রকম সন্তানকে নির্জনে প্রসব করিয়া কোথাও ফেলিয়া দেওয়া হইত। ঋগ্বেদের ২.২৯.১ মন্ত্রে আদিত্যগণের স্তবে বুঝা যায়, দেবতা ‘রহসূঃ’কে ক্ষমা করিতেন। ‘রহসূঃ’ অর্থে সায়ণ বলেন, রহসি অন্যৈরজ্ঞাতপ্রদেশে সূয়তে, ইতি রহসূর্ব্যভিচারিণী— যে ব্যভিচারিণী গোপনস্থানে প্রসব করিয়া যায়।

 নারীপুরুষদের মিলনস্থানে ‘সমন’ প্রভৃতিতে লোকে পতি খুঁজিত।[৬] সমন প্রভৃতি মেলার মিলনস্থানে পুরুষ-নারীর অবাধ ও অবৈধ মিলনও ঘটিত। সেখানে অনেক দুর্নীতিও প্রশ্রয় পাইত। এইরূপ সমনে সুন্দর মধুর স্মিতহাস্যময়ী নারীদের উল্লেখ দেখা যায়—

সমনেব যোষাঃ কল্যাণ্যস্ময়মানাসঃ। ঋগ্বেদ ৪.৫৮.৮

 ঋগ্বেদের ৬.৭৫.৪ মন্ত্রেও ‘সমনের ঘোষা’ পদ দেখা যায়। ঋগ্বেদের দশমমণ্ডলে আছে, “সমনং ন যোষা” (১০.১৬৮.২)।

 এইসব স্খলন কখনও কখনও ঘটিত সাংসারিক অভাবে এবং রক্ষাকর্তার অভাবে। যে কন্যার পিতা বা ভ্রাতা থাকিত না তাহাদের অনেক সময় এইরূপ দুর্গতি ঘটিত (ঋগ্বেদ ১.১২৪.৭)। বিবাহবিনা এইরূপে পিতৃগৃহে যেসব কন্যার বয়স চলিয়া যাইত তাহাদিগকে ‘অমাজুর’ বলিত।[৭] যোষা ছিলেন এইরূপ কন্যা (ঋগ্বেদ ১.১১৭.৭)।

 ভ্রাতৃহীনা কন্যাকে ‘পুত্রিকা’ বলিত। আর-এক কারণেও পুত্রিকাকে কেহ বিবাহ করিতে চাহিত না। কারণ তাহার সন্তান তাহার মাতামহের বংশরক্ষা করিত।[৮]

 ঋগ্বেদে দেখা যায়, ভ্রাতৃহীনা কন্যারা অনেক সময় পতিদ্বেষিণী দুরাচারা স্বৈরিণী পাপরতা মিথ্যা ও অসত্যপরায়ণা হইয়া গভীর নরকগামিনী হইত—

অভ্রাতরো ন যোষণো ব্যন্‌তঃ পতিরিপো ন জনয়ো দুরেবাঃ।
পাপাসঃ সংতো অনৃতা অসত্যা ইদম্‌পদমজনতা গভীরং। ৪.৭.৫

অথর্ব বেদে আছে, ভ্রাতৃহীনা যুবতী লোহিতবস্ত্রা কন্যা যেন চলিয়াছে—

যন্তি যোষিতে লোহিতবাসসঃ
অভ্রাতর ইব জাময়ঃ। ১.১৭.১

 ভ্রূণহত্যাও যে তখন চলিত তাহা বুঝি সর্বত্র তাহার বিরুদ্ধে উচ্চারিত সব বিধি-বিধানের দ্বারা। ভ্রূণহত্যা অতি নিন্দিত পাতক।[৯] আরণ্যকে এবং উপনিষদেও ভ্রূণহত্যা বহুনিন্দিত।[১০] শাঙ্খায়ন-শ্রৌতসূত্রেও (১৬.১৮.১৯) এই কথা পাই। সেই যুগে কন্যাহত্যার কথা বিশেষ শোনা যায় না, অথচ ভ্রূণহত্যার এত নিন্দা দেখিয়া মনে হয়, ভারতে পরে কোনো-কোনো শ্রেণীর মধ্যে যে কন্যাহত্যা চলিত হইয়াছিল তাহা খুব প্রাচীন কালের নহে।

 ক্রমে যখন বিবাহ প্রথা সুপ্রতিষ্ঠিত হইল, তখনও ব্যভিচার ও দুর্নীতি একেবারে বিদূরিত হয় নাই। কোনো দেশে কোনোকালেই তাহা হয় না। তবে জাতিভেদের যুগে ভারতের স্ত্রীগণের মধ্যে ব্যভিচার ঘটিলে পাছে অজ্ঞাতসারে বর্ণসঙ্কর উৎপন্ন হয়, তাই অনেক সাবধানতা অবলম্বিত হইয়াছে। কিন্তু তবু তখনও শুধু এই কারণে পত্নীকে ত্যাগ করা চলে নাই (নারদ ১২. ৯০)। পরাশরের (১০, ১৫) মতে ব্যভিচারের ফলে সন্তান যদি জন্মে এবং স্ত্রী যদি কুল ছাড়িয়া যায় তবেই তাহাকে ত্যাগ করা চলে। হারিত (৩. ১৩) এরূপস্থলেও স্ত্রীত্যাগের বিরুদ্ধে।[১১]

 বৈজ্ঞানিকদের মতে সৃষ্টির প্রারম্ভে সবই ছিল অগ্নিময়, বাষ্পময়; তাহার পর ক্রমে স্থিরা শীতলা হইলে ভূতধাত্রী ধরিত্রীর বক্ষে জীবকুল প্রতিষ্ঠিত হইল। তেমনি সমাজেও প্রথমে এইরূপ উচ্ছৃঙ্খল যুগ যায়। তাহার পর ক্রমে সুব্যবস্থিত সংসারযাত্রার যুগ আসে। তখনও যে মানুষের উচ্ছৃঙ্খলতা সর্বতোভাবে দূর হয় তাহা নহে। আজও কোনো দেশেই তাহা হয় নাই। সব দেশেরই বিচারশালার ফলাফল দেখিলেই তাহা বুঝা যায়। ভারতের বহু পুরাতন কথা লোকে স্মরণে রাখিয়াছে, তাই তাহার অনেক গলদের খবর এখনও পাওয়া যায়। এমনকি একদিন যে বিবাহ প্রথাও সমাজে ছিল না সেকথা অন্যসব দেশ ভুলিয়া গেলেও ভারতবর্ষ ভোলে নাই। সেইসব অতিপুরাতন উচ্ছৃঙ্খল যুগের কথা ভারতবর্ষ এখনও রক্ষা করিয়া চলিয়াছে। এই জন্য সমাজবিজ্ঞানের আলোচকদের বহু ধন্যবাদ ভারতের প্রাপ্য।

 পূর্বেই বলা হইয়াছে, বোধায়ন ধর্মসূত্রে ও আপস্তম্বে সেই যুগের উল্লেখ আছে যে যুগে বিবাহ প্রথা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। মহাভারতেও তাহার উল্লেখ পাই। উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন (আদি ১২২.৯)। তাঁহার পুত্র শ্বেতকেতু বিবাহের মর্যাদা স্থাপন করিলেন (ঐ ১০)। উদ্দালক এবং শ্বেতকেতুর সমক্ষেই এক ব্রাহ্মণ উদ্দালক-পত্নীর হাত ধরিয়া লইয়া গেলেন। ইহাতে শ্বেতকেতু জ্বলিয়া উঠিলেন (ঐ ১১-১৩)। পিতা বুঝাইলেন, বাবা রাগ করিও না, ইহাই সনাতন ধর্ম। সংসারে সর্ববর্ণের নারীরাই এই বিষয়ে অনাবৃত অর্থাৎ স্বেচ্ছাবিহারিণী—

মা তাত কোপং কার্বীত্ত্বমেষ ধর্মঃ সনাতনঃ।
অনাবৃতা হি সর্বেষাং বর্ণনামঙ্গনা ভুবি। আদি ১৪

 সনাতনধর্ম হইলেও শ্বেতকেতু ঐ নিকৃষ্ট ধর্ম না মানিয়া তাহার স্থানে উত্তম নূতন ধর্ম স্থাপন করিলেন। তখন হইতে বিবাহ ছাড়া স্ত্রীপুরুষের সঙ্গম পাপ হইল (ঐ ১৬-২০)। প্রথা শুধু সনাতন হইলেই হইবে না, তাহা ভালো কি মন্দ তাহাও দেখিতে হইবে। মহর্ষি শ্বেতকেতু সেইভাবে দেখিয়াছিলেন বলিয়াই আজ আমাদের সমাজে বিবাহ প্রথা চলিয়াছে, নহিলে সেই সনাতন প্রথায় নারী-পুরুষের অবাধ মিলন আজও চলিত।

 বোধায়ন-ধর্মসূত্রে দেখা যায়, উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সর্বপ্রথমে ঔরসপুত্রের দাবি এই কথা আচার্য ঔপজঙ্ঘনি বলেন (২.২.৩৩)। ঔপজঙ্ঘনিকে রাজা জনক জিজ্ঞাসা করেন, পুত্র কাহার, উৎপাদয়িতার না ক্ষেত্রস্বামীর অর্থাৎ জননীর পতির? তদুত্তরে ঔপজঙ্ঘনি জনককে পুরাতন কথা বলেন, একবার সত্যযুগে যমরাজা আমাকে (ঔপজঙ্ঘনিকে) ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করেন যে, পরস্ত্রীতে উৎপন্ন পুত্র কি উৎপাদয়িতার অথবা সেই স্ত্রীর স্বামীর—

যমঃ কৃতে যুগে ঔপজঙ্ঘনিমাহূয় প্রপ্রচ্ছ
পরবারেষুঃপাদিতঃ পুত্রঃ কিং জনয়িতুরিতি উতাহো ক্ষেত্রিণ ইতি।

—বোধায়ন-ধর্ম সুত্রে গোবিন্দস্বামী প্রণীত বিবরণ ২.২.৩৪

 সন্তান জনয়িতারই হইবে ইহাই নিশ্চয় করিয়া সেইকথা আমি তখন যমপুরে বলিয়াছিলাম—

 এবং প্রজা জনয়িতুরেবেতি নিশ্চিত্য তদিদং পুরা যমস্য সদনে জনয়িতুঃ পুত্রমব্রুবন্। (ঐ)

 কিন্তু এখন আমার আর সেই মত নাই। এখন বুঝিতেছি সেই প্রথা ভালো নহে। কাজেই স্ত্রীগণের সঙ্গে যাহারা পতি না হইয়াও চরণ করেন তাঁহাদের আমি আর এখন সহিতে পারি না—

সম্প্রতি অহং নের্য্যামি ন সহে স্ত্রীণাং চরন্তং পুরুষং নের্য্যানি। ঐ

 হে জনক, পূর্বে যে আমি ধর্মরাজ যমের ভবনে বলিয়াছিলাম যে, ঋষিগণ বলিয়াছেন জনয়িতারই সন্তান ক্ষেত্রস্বামীর অর্থাৎ জননীর পতির নহে—

 হে জনক, পুরা যস্মাদ্ যমস্য ধর্মরাজস্য সদমে স্থানে বেশ্মনি জনয়িতুরেব পুত্রমব্রুবন্ ঋষয়ো, ন ক্ষেত্রিণ ইতি। (ঐ)

 কিন্তু ধর্মরাজ যমরাজ সকাশে নিশ্চিত অর্থ তো মিথ্যা হইতে পারে না—

নহি যমরাজসকাশে নিশ্চিতোঽর্থো মিথ্যা ভবিতুমর্হতি। ঐ

ইহাই ঔপজঙ্ঘনি মুনির মত—

ইতি ঔপজঙ্ঘনের্মুনের্মতম্। ঐ

 কাজেই দেখা গেল, ঔপজঙ্ঘনি পুরাতন ঋষিদের বাক্য এবং যমরাজার ভবনে তাঁহার নিজেরই পূর্বনিশ্চয় হইলেও পরক্ষেত্রে উৎপাদিত পুত্র জনয়িতারই হইবে পরে আর এই কথা পছন্দ করিতেছেন না। বোধায়ন-ধর্ম সূত্রে মূল সূত্রটি এই—

ইদানীমহমীর্য্যামি স্ত্রীণাং জনক নো পুরা
যতো যমস্য সদনে জনয়িতুঃ পুত্রমব্রুবম্। ঐ ২, ২,৩৪

 বোধায়ন আরও বলেন, রেতোধা অর্থাৎ রেতঃসেকের দ্বারা উৎপাদনকারীই যমলোকে গিয়া পুত্র অর্থাৎ পুত্রকৃত্যের ফললাভ করে। তাই সকলে ভয়ে পররেতঃ হইতে ভার্যাকে রক্ষা করে——

রেতোধা পুত্রং নয়তি পরেত্য যমসাদনে।
তস্মাদ্ ভার্য্যাং রক্ষন্তি বিভ্যন্তঃ পররেতসঃ। ঐ ২.২, ৩৫

 তাই জনক বলিলেন, অপ্রমত্ত হইয়া নিজ বংশধারা রক্ষা কর, তোমাদের ক্ষেত্রে পরকে বীজবপন করিতে দিও না। পরলোকে পুত্র যখন জনয়িতারই হয় তখন যে এরূপে বীজ বপন করে সে বংশধারাকে ব্যর্থ অর্থাৎ ছিন্ন করিয়া দেয়—

অপ্রমত্তা রক্ষণ তস্তুমেতং
মা বঃ ক্ষেত্রে পরবীজানি বাপ্‌সুঃ
জনয়িতুঃ পুত্রো ভবতি সাম্পরায়ে
মোঘং বেত্তা কুরুতে তন্তুমেতমিতি। ঐ ২.২.৩৬

 আপস্তম্ব-ধর্মসূত্রও বলেন, ব্রাহ্মণ বলেন পুত্র হইবে জনয়িতারই,—

উপপাদয়িতুঃ পুত্র ইতি হি ব্রাহ্মণম্। ঐ ২,১৩.৬

 এখানে উদাহরণস্বরূপে বৈদিক বাণী বলিতেছেন, এতদিন ভাবিতাম যখন স্ত্রী আমার, তখন তাহার গর্ভে উৎপন্ন পুত্রও আমারই। যখন বিচারে দেখা গেল পুত্র হইবে উৎপাদনকারীর তখন এতদিন পর্যন্ত স্ত্রীগণের পরপুরুষ-সংসর্গ সহিয়া থাকিলেও এখন আর আমি স্ত্রীগণের পরপুরুষ-সংসর্গ সহিতে পারিব না। কারণ ধর্মজ্ঞেরা বলিতেছেন, যমসাদনে পুত্র জনয়িতারই হইবে (উজ্জ্বলাকার হরদত্তকৃত ব্যাখ্যা)। মূল আপস্তম্ব বাণীও দেওয়া যাউক, অত্রাপ্যুদাহরন্তি।

ইদানীমেবাহং জনকঃ স্ত্রীণামীর্য্যামি নো পুরা।
যদা যমসা সাদনে জনয়িতুঃ পুত্রমব্রুবন্। ঐ

 তারপর বোধায়নের মতই আপস্তম্ব ধর্মসূত্রেও আছে—

রেতোধাঃ পুত্রং নয়তি। ঐ

 এবং

অপ্রমত্তা রক্ষথ তন্তুমেতম্। ঐ

 ইহাতে বুঝা যায়, বিবাহ প্রথা প্রতিষ্ঠিত হইবার পরেও বহুকাল পরপুরুষসঙ্গমে কোনো বাধা স্ত্রীগণের ছিল না। জনক ঔপজঙ্ঘনি প্রভৃতি বহু ঋষি মুনিগণের বহুকাল ধরিয়া বহু চেষ্টায় সেইসব প্রথা ক্রমে সংযত হইয়া আসে। আজও তাহা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় নাই, কোনো দেশেই বা কোনো কালেই তাহা হয় না।

 নঞ্জুন দায়্যা এবং অনন্তকৃষ্ণ আইয়ার বলেন, বৃহস্পতি-স্মৃতিতেও এইরূপ শৈথিল্যের প্রাচীনতার কথা জানা যায়।[১২]

 ছান্দোগ্য উপনিষদে (৪.৪. ১) ঋষি সত্যকামকে তাহার মাতা জবালা বলিয়াছিলেন, কাহার ঔরসে তোমার জন্ম কেমন করিয়া বলি; যৌবনে অনেকের পরিচারণায় তোমাকে পাইয়াছি—

বহ্বহং চরন্তী যৌবনে ত্বামলভে

 বিবাহ প্রথা প্রতিষ্ঠিত হইয়া ক্রমে গৃহপরিবার সুব্যবস্থিত হইল। পূর্বেই বলা হইয়াছে, আর্যদের মধ্যে পিতাই পরিবারের কর্তা (শতপথ-ব্রাহ্মণ, ২. ৫. ১. ১৮), মায়ের নাম তার পরে (ছান্দোগ্য উপনিষদ ৭. ১৫.২)। পতি-পত্নীর সম্বন্ধের মধ্যেও পতির স্থান প্রধান। দ্রবিড় সভ্যতায় নারীদের প্রাধান্যের যতটা পরিচয় মেলে আর্য সভ্যতায় ততটা দেখা যায় না।

 তখনকার দিনে সকলেই পুত্রকামনা করিতেন। তাই বৃহদারণ্যকের এইসব (১. ৪. ৮) বাণী, ‘তাহা পুত্র হইতেও প্রিয়’—

 “তদেতৎ প্রেয়ঃ পুত্রাৎ” এবং “পুত্রাণাং কামায় পুত্রাঃ প্রিয়া ভবন্তি।” (ঐ ২. ৪. ৫) “কারণ আত্মা বৈ জায়তে পুত্রঃ,” “আত্মা বৈ পুত্রনামাসি” (শতপথ-ব্রাহ্মণ ১৪. ৯. ৪. ২৬)। বৃহদারণ্যকেও এই কথা; সেখানে আরও দেখি, “প্রতিরূপঃ পুত্রো জায়তে” (৪. ১. ৬)। ঋগ্বেদ দশম মণ্ডলে ১৮৩ সূক্তে আগাগোড়াই পুত্রের মহত্ব ঘোষিত। ঋগ্বেদের ৫. ২৫. ৫ মন্ত্রে, অথর্বের ৬. ৮১. ৩ মন্ত্রে এবং আরও বহু বহু স্থলে পুত্রের জন্যই প্রার্থনা। পুত্রৈষণা বিত্তৈষণাই গৃহীর ধর্ম।

 কন্যাকে দুহিতা বলে। কন্যাও স্নেহের ছিল, কিন্তু পুত্রের মত নহে। কন্যারা বাল্যে পিতার আশ্রিতা থাকিত। পিতার অভাবে ভাইয়ের আশ্রয় এবং বিবাহ হইলে পতির আশ্রয় মিলিত। ভাই না থাকিলে কন্যাদের যে বিবাহ হওয়া কঠিন ছিল সেকথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। পিতার অভাবে ভাইয়েরা ভগ্নীকে পালন করিত। সংসারে বাপের পরেই মা তাহার পর ভাই তাহার পর ভগ্নী।

 ছান্দোগ্যে (৭ ১৫. ২.) এইভাবেই পর-পর মহত্ত্ব দেখা যায়। ভগ্নীকে স্বসা বলে। ভগিনী অর্থে ভাগ্যবতী, অথবা যে পিতার ধনের ভাগ পায়।

 ঋগ্বেদে প্রায়ই বিবাহ প্রসঙ্গে নারী বলিয়া স্ত্রীলোকের উল্লেখ পাই।[১৩] বৈদিক কালে যৌবনেই বিবাহ হইত। কখনও কখনও কন্যার ভাই না থাকিলে বা অন্য কোনো দোষ থাকিলে পিতৃগৃহেই কন্যা জীর্ণ হইত, সেইরূপ কন্যাকে যে ‘অমাজুর’ বলিত তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। অভিরূপ পতির জন্য প্রার্থনায় বুঝা যায় যুবতী-বিবাহই চলিত ছিল। যখন কন্যা যুবতী, পতিলাভের জন্য তখন ব্যাকুলতা জাগিয়াছে। সূর্যার বিবাহের মন্ত্রগুলি (ঋগ্বেদ ১০.৮৫) দেখিলে বেশ বুঝা যায়, কন্যা রীতিমত যুবতী। সূত্র-যুগে অল্পবয়সে বিবাহের উল্লেখ আরম্ভ হয়। ছান্দোগ্য-উপনিষদে (১.১০.১) ‘আটিক্যা সহ জায়য়া’ কথায় কেহ বলেন, উযস্তি চাক্রায়ণের স্ত্রীর নামই ছিল আটিকী; কেহ অর্থ করেন, ‘অটনযোগ্যা’ অর্থাৎ পর্যটন-সমর্থা; শঙ্কর বলেন, ‘অনুপজাতপয়োধরাদি স্ত্রীব্যঞ্জনা’।

 নারীদের অবরোধের কথা বেদে দেখা যায় না। সমাজে নারীরা সহজেই বিচরণ করিতেন, যাগযজ্ঞে যোগ দিতেন। নারীরা বেদমন্ত্রও রচনা করিতেন। অথর্বে নারীদের উপনয়ন ও ব্রহ্মচর্যের কথা আছে, তাই বুঝা যায় নারীদের শিক্ষার অধিকার ছিল। উপনিষদে ব্রহ্মবিদুষী নারীদের কথা পাই। নৃত্যগীতে নারীর শিক্ষা নিতে হইত (তৈত্তি-সং ৬. ১. ৬. ৫; মৈত্রা-সং ৩. ৭. ৩)। জাতিভেদ প্রথা সুপ্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্ব পর্যন্ত বরকন্যার পছন্দ ও যৌবনবিবাহ চলিত। তাহার পর পছন্দ ও যৌবনবিবাহ গেল। স্মৃতির যুগে কন্যাদের অল্পবয়সেই বিবাহ হইত।

 ভাই-ভগ্নীতে বিবাহ বৌদ্ধশাস্ত্রে দেখা যায়, কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে তাহা নিন্দিত। গোভিল-গৃহ্যসূত্রে (৩.৪. ৫) সগোত্রা কন্যা বিবাহ নিষিদ্ধ। আপস্তম্ব ধর্মসূত্রে (২. ৫. ১৫) দেখা যায়, সগোত্রকে কন্যা দিবে না, ‘সগোত্রায় দুহিতরং ন প্রযচ্ছেৎ’। গৌতম ধর্মসূত্রে (৪. ২) দেখি, অসমান-প্রবরের সঙ্গে বিবাহ হইবে। পিতৃবন্ধু হইতে সাতপুরুষ ছাড়াইলে এবং মাতৃবন্ধু হইতে পাঁচপুরুষ ছাড়াইলে বিবাহ চলে (৪.৩-৫)। মনু (৩.৫) বলেন, পিতার অসগোত্রা মাতার অসপিণ্ডা কন্যা প্রশস্ত। যাজ্ঞবল্কের (১. ৫২-৫৩) মতও এই রকম। সবর্ণা-বিবাহ শ্রেষ্ঠ হইলেও অনুলোম-রীতিতে অসবর্ণা-বিবাহ তখন রীতিমতই চলিত এবং তাহা শাস্ত্রসম্মতও ছিল। তবে দ্বিজাতির পক্ষে শূদ্রকন্যাকে বিবাহটা অনেকে পছন্দ করিতেন না। বোধায়ন গৌতম ও উশনার মতে এইরূপ বিবাহে সস্তানেরা পিতার বর্ণই প্রাপ্ত হইত।

 বর্ণশুদ্ধিরক্ষা প্রয়াসী মনু যে অনুলোম-বিবাহের বিধান দিয়াছেন (২. ২৩৮; ৩. ১২-১৩) তাহার কারণ, তাহা ছিল সমাজপ্রচলিত, একদিনে তাহা উঠাইয়া দেওয়া সম্ভব ছিল না। অনুলোম-বিবাহের সম্মতি গৌতম (৪.১৬) বোধায়ন (১. ১৬. ২-৫) এবং বসিষ্ঠ (১. ২৪-২৫) তাঁহাদের ধর্মসূত্রে দিয়াছেন। পারস্কর-গৃহ্যসূত্রেও (১, ৪) সেই সম্মতি দেখা যায়। ব্যাস- সংহিতাও বলেন, ঊঢ়া অসবর্ণা পত্নীতে জাত সন্তান সবর্ণার গর্ভে জাত সন্তান হইতে হীন হয় না— ন স্বর্ণাৎ প্রহীয়তে (২.১০)।

 সাধারণত লোকে একই পত্নী বিবাহ করিতেন। তবে একাধিক বিবাহও পুরুষের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল না। মৈত্রায়ণী-সংহিতা বলেন, ধর্ম শাস্ত্রব্যবস্থাপক মনুরই দশটি পত্নী ছিলেন। মনুপত্নীদের দশজনের মধ্যে একজন দশপুত্রা তার পর নবপুত্রা তার পর অষ্টপুত্রা সপ্তপুত্রা ষট্‌পুত্রা পঞ্চপুত্রা চতুষ্পুত্রা ত্রিপুত্রা দ্বিপুত্রা ও একপুত্রা ছিলেন—

 ‘মনের্বৈ দশজায়া আসন্ দশপুত্রা নবপুত্রা অষ্টপুত্রা সপ্তপুত্রা ষট্‌পুত্রা পঞ্চপুত্রা চতুষ্পুত্রা ত্রিপুত্রা দ্বিপুত্রা একপুত্রা’ (১. ৫. ৮)। তবেই মনুর দশপত্নীর পঞ্চান্নটি পুত্র ছিলেন। শতপথ ব্রাহ্মণেও (৯. ১. ৪. ৬) এই প্রথার বৈধতা বুঝাইবার চেষ্টা করা হইয়াছে। রাজাদের প্রায়ই চারিটি স্ত্রীর উল্লেখ দেখা যায়। প্রথমা হইলেন মহিষী। তার পর পরিবৃক্তী বা ‘দুয়ো’রানী, হয়তো সন্তান না হওয়ায় তিনি উপেক্ষিতা। তার পর বাবাতা বা ‘সুয়ো’। তার পর পালাগলী, ইনি রাজার কোনো অনুচরের কন্যা। এইসব কথা নানাস্থানের উল্লেখসহ Macdonell এবং Keith এর Vedic Index গ্রন্থে (vol. 1. p. 478) ভালো করিয়া লিখিত আছে। নারীর একসঙ্গে বহুপতির প্রথা বেদে দেখা যায় না। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরকে লঙ্ঘন করা নিষিদ্ধ ছিল। তবে আইনে বিধান না থাকিলেও কোথাও কোথাও যে বিধির ব্যতিক্রম হইত, তাহা দেখাই যায়। আর তাহা কোন্ দেশে অথবা কোন্ কালেই বা না দেখা যায়?

 প্রাচীন কালে যখন বরকন্যা পরস্পরকে পছন্দ করিয়া বিবাহ করিতেন তখন টাকা-পয়সার প্রশ্ন উঠিতই না। তার পর কোথাও কোথাও পণ দিয়া কন্যাসংগ্রহ করিতে হইত।[১৪]

 মনুও (৩. ৫৩) ইহার উল্লেখ করেন, কিন্তু অনুমোদন করেন না। তবে বরপক্ষ যাহা দেন তাহা যদি পিতৃকুলে গৃহীত না হইয়া কন্যাকেই দেওয়া হয় তবে তাহাতে বিক্রয় হয় না (৩. ৫৪)। কন্যাবিক্রয়কে মনু নিন্দা করিয়াছেন। বরপক্ষ স্নেহ বা শ্রদ্ধাবশতঃ যাহা কন্যাকে দেন তাহাতে দোষ নাই (৩, ৫৪-৫৫)। এইসব বিষয়ে মধ্যেমধ্যে জামাতা ও বরপক্ষের কার্পণ্যও নিন্দিত হইয়াছে। তবে অঙ্গহীনা কুশ্রী কন্যার বিবাহে বরকে অর্থ দিয়াই বিবাহে সম্মত করিতে হইত (ঋগ্বেদ ১০. ২৭. ১১)। সুন্দরী কন্যা সবাই চাহিত, তাহার উপর কন্যা যদি ভালো হয় তবে তো কথাই নাই (ঐ ১০.২৭. ১২)। সুন্দরী না হইলে ভগ্নীকে টাকা দিয়া ভাইরা বিবাহ দিতেন (ঐ ১. ১০৯.২)। কন্যার বিবাহের সঙ্গে ‘অনুদেয়ী’ কথাটি ঋগ্বেদে (১০. ৮৫. ৬) পাওয়া যায়। সায়ণ অর্থ করেন, মেয়ের মন প্রসন্ন রাখিবার জন্য তার সঙ্গে দীয়মানা বয়স্যা (“বধূবিনোদায় অনুদীয়মানা বয়স্যা”)। কেহ কেহ অর্থ করেন, কিছু পণ।[১৫]

বিবাহ-অনুষ্ঠান

 বৈদিক যুগেও বিবাহ-অনুষ্ঠানে ঘটা করিয়া নানারকমের আচার প্রতিপালিত হইত। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ৮৫ সূক্তটির বিষয় হইল সূর্যার বিবাহ। এই সূক্তটি বেশ দীর্ঘ, কারণ ইহাতে ৪৭টি ঋক্ আছে। অথর্ববেদেরও চতুর্দশ কাণ্ডের প্রথম ও দ্বিতীয় সূক্ত সূর্যার বিবাহ লইয়া। তবে তাহা আরও বিশদভাবে বর্ণিত। কারণ, প্রথম সূক্তে আছে ৬৪টি মন্ত্র এবং দ্বিতীয়সূক্তে আছে ৭৫টি। তবেই মোট হইল ১৩৯টি মন্ত্র। তাহার পরে গৃহ্যসূত্রগুলিতেও বিবাহপদ্ধতিটি সবিস্তারে বর্ণিত। অনেকে মনে করেন, বৈদিক বিবাহপদ্ধতির সঙ্গে প্রাচীন য়ুরোপীয় আর্যদেরও বিবাহপদ্ধতির মিল কিছুকিছু আছে।

 বিবাহে বরপক্ষ কন্যার বাপের বাড়ি আসিতেন। সেখানেই অনুষ্ঠান আরম্ভ হইত। বরপক্ষীয়দের জন্য ঘটা করিয়া উৎসবের আয়াজন হইত। উৎসবে গোহত্যা করা হইত।

 সূর্যার বিবাহ-মন্ত্রে আছে, সূর্যার বিবাহে সূর্য যে উপহার পাঠাইয়াছেন তাহা আগেই রওয়ানা হইয়া চলিল। মঘাতে যে গোহত্যা করা হয় পূর্ব ও উত্তর ফাল্গুনী নক্ষত্রে তাহা বহন করিয়া লইয়া যাওয়া হয়—

সূর্যায়া বহুতুঃ প্রাগাৎ সবিতা যমবাসৃজৎ।
অঘাসু হন্যংতে গাবোঽর্জ্জু্ন্যোঃ পর্যুহ্যতে। ঋগ্বেদ ১০, ৮৫, ১৩

 একসময় গোহত্যার এত প্রচলন ছিল যে গোহত্যার জন্য বিশেষ স্থানও নির্দিষ্ট ছিল। সেখানে অনেক গো নিহত হইত (ঐ ১০. ৮৯.১৪)।

 এখনও বিবাহে সেই গবালম্ভের একটু অবশেষমন্ত্র উচ্চারিত হয়। বিবাহ- কালে নাপিত আসিয়া বলে “গৌর্গৌঃ” অর্থাৎ “অনুষ্ঠানে হন্তব্য গো যে এই রহিয়াছে, তাহার সম্বন্ধে কি করা যায়?” তখন বর বলিবেন—

ওঁ মুঞ্চ গাং বরুণপাশাদ্ দ্বিষন্তং মেঽভিধেহীতিত‍ৎ
জহ্যমৃষ্য চোভরোরুৎসৃজ গামত্তু তৃণানিপিবতূদকমিতি ব্রূয়াৎ। গোভিলীয়-গৃহ্য।৪. ১০, ১৯

অর্থাৎ “এই গোকে বরুণপাশ হইতে মুক্ত কর। যজমানের এবং আমার উভয়ের অনুমতিতে ইহাকে ছাড়িয়া দাও, গোবধকারীকেও যাইতে বল। এই গো এখন তৃণ খাউক, জলপান করুক।”

 এই মন্ত্রটি সামমন্ত্র-ব্রাহ্মণে (২. ৮. ১৩) এবং খাদির-গৃহ্যসূত্রেও আছে (৪.৪. ১৭)। সামমন্ত্র-ব্রাহ্মণ গ্রন্থখানি পণ্ডিত সত্যব্রতসামশ্রমী মহাশয়ের দ্বারা সম্পাদিত হইয়াছিল। তাহাতে এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা ও অনুবাদ দেওয়া আছে।

 “গৌর্গৌঃ” শব্দ নাপিত উচ্চারণ করিলে প্রথমে পূর্বোক্ত মন্ত্রটি বলিয়া তাহার পর বরকে বলিতে হয়,—

ওঁ মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসুনাং
স্বসাদিত্যানামমৃতস্য নাভিঃ।
প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়
মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট। ঋগ্বেদ ৮. ১০১, ১৫

অর্থাৎ “এই গাভী হইলেন রুদ্রগণের মাতা, বসুগণের দুহিতা, আদিত্যগণের ভগ্নী, অমৃতের আবাসস্থান, সেই নির্দোষ মুক্ত গোকে বধ করিও না; এই কথা চেতনান্বিত লোকদের কহিয়াছিলাম।”

 এই শেষোক্ত ঋকের ঋষি হইলেন ভার্গব জমদগ্নি।

 পুরোহিতের দ্বারা এই দুইটি মন্ত্র উচ্চারণের পর এখনকার দিনে নাপিত চলিয়া যায়, এবং তাহার পর অচ্ছিদ্রাবধারণ ও বৈগুণ্যসাধন করিয়া সম্প্রদাতা বর ও কন্যা সকলেই নারায়ণকে প্রণাম করেন। তার পর এখন বরকন্যাকে বাসরঘরে লইয়া যাওয়া হয়।[১৬] বিবাহে নাপিতেরা এখন যে “গৌর্গৌর্” কেন বলে তাহা তাহারা নিজেরাও জানে না। তাহারা মনে করে ইহা ‘গৌরবচন’। কোথাও তাই বিবাহের সভায় নাপিত ‘গৌর’স্তুতি কোথাও বা হর-গৌরীর প্রণতিসূচক বাংলা দু-চারটি ছড়া কবিতা উচ্চারণ করে। বৈদিক মন্ত্রটির কথাও লোকে ভুলিয়া গিয়াছে। এই মন্ত্রটির অর্থ ও উদ্দেশ্য এখন আর কে-বা যত্নপূর্বক দেখিবেন?

 এই মন্ত্র উচ্চারণে দেখা যায় একসময়ে বিবাহে আর্যদের মধ্যে গবালম্ভ ছিল, তাহা ক্রমে চারিদিকের অহিংসা-সমর্থক মতবাদের সংস্পর্শে ধীরে ধীরে অহিংস হইয়া পড়িল। তাই ইহার প্রথমমন্ত্র বেদের উত্তরভাগের। অহিংসা-সূচক দ্বিতীয় মন্ত্রটি প্রাচীন সংহিতা হইতেই সংগৃহীত। অহিংসা প্রচার করিবার জন্যই বেদবাহ্য জৈন বৌদ্ধাদি মতের উৎপত্তি।

 আর্যদের ক্রিয়াকাণ্ড, পারিবারিক কৃত্য ক্রমেই এইরূপে অহিংস হইতে লাগিল। জৈন বৌদ্ধাদি মতের সংস্পর্শে ক্রমে সামাজিক জীবনে বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসের আদর্শ আসিতে লাগিল। চারি আশ্রমের মধ্যে গৃহস্থ-আশ্রম মোটে একপাদ অর্থাৎ চারিভাগের একভাগ হইয়া দাঁড়াইল। বাকি তিনপাদই সন্ন্যাস বা ব্রহ্মচর্য। বিধবাদের মধ্যে পুনর্বিবাহের স্থলে ব্রহ্মচর্য প্রতিষ্ঠিত হইল। এখন পুরুষেরা চারি আশ্রমের দায় হইতে মুক্ত হইয়াছে, কিন্তু বিধবার উপর সারাজীবনব্যাপী ব্রহ্মচর্যটি ঠিক তেমনি চাপানো আছে। ব্রত উপবাসাদিও সবই এখন বিধবার কৃত্য। এইগুলি বিধবাদের প্রকরণে আবার আলোচিত হইবে।

 এখন যে প্রসঙ্গ চলিতেছে তাহাতেই আসা যাউক, অর্থাৎ প্রাচীন কালের বিবাহ-অনুষ্ঠানের কথাই চলুক। কন্যাকে শয্যা-আভরণ প্রভৃতি উপহার সাজাইয়া দেওয়া হইত (ঋগ্বেদ ১০. ৮৫. ৭)। বিবাহের রথটি সুন্দর করিয়া প্রস্তুত করা হইত এবং তাহা পুষ্পে পল্লবে সাজানো হইত। (ঐ ১০. ৮৫. ১৩; ঐ, ২০)। ঋগ্বেদের সূর্যা-বিবাহ দেখিলে বুঝা যায়, পতিকুলে কন্যা যাহাতে ধ্রুব হয় তাহা প্রার্থনা করিয়া মন্ত্রপাঠ হইত। কন্যাকে তাই ধ্রুব প্রতিষ্ঠা স্বরূপ শিলাতে আরোহণ করাইয়া পতি তাহার হস্ত ধারণ করিয়া হোমাগ্নিকে প্রদক্ষিণ করিতেন।

 বিবাহের প্রধান তিনটি অঙ্গ। সেই সবই অবশ্য বরকন্যার পরস্পরকে বরণ করিবার পর অনুষ্ঠিত হইত। ‘একত্র গমন’— তাহা হয় সপ্তপদীতে, স্বামীর গৃহের অগ্নিতে ‘একত্রে যজন’ (যজ্ঞ), ও পতিগৃহের সকলের সঙ্গে ‘একত্রে ভোজন’ (বৌভাত)। বিবাহে উভয়ের ঘনিষ্ঠ যোগ, দীর্ঘজীবন, সৌভাগ্য এবং পুত্র-পৌত্রাদিই কাম্য ছিল। ধন জনবৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করা হইত। তবে বিবাহানুষ্ঠানের সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম কথাই হইল বরণ (নারদীয়-মনুসংহিতা ১২.২)। তার পরই হইল একত্রে গমন-যজন-ভোজন। এই তিনটিই বিবাহানুষ্ঠানের মুখ্য অঙ্গ।

 অথর্বে সূর্যার বিবাহের আদিতেই সত্যে ও বিশ্বে ও দেবতার মধ্যে বিবাহের প্রতিষ্ঠামন্ত্র দেখা যায়। পূর্বকৃত কোনো দুর্নীতি যদি থাকে তবে তাহা হইতে মুক্তির জন্য বরুণের কাছে নিষ্কৃতি প্রার্থিত হয় (১৪. ১. ১৯)। স্বামীর পক্ষে কন্যা যাহাতে বরের ‘স্যোনা’ বা আনন্দদায়িণী হয় তাহাই সকলে চাহিতেন। পতির গৃহে যাহাতে কন্যা গিয়া ‘পত্নী’ হইতে পারে (১৪.১.২০), গার্হপত্য ধর্মে সদা জাগ্রত থাকে (১৪. ১.২১), দীর্ঘজীবী হইয়া পুত্রপৌত্র সহ সুখী হইতে পারে (১৪.১. ২২) তাহাই প্রার্থনা করা হইত। নিত্য যেন উভয়ের কাছে উভয়ে নবীন হইতে থাকে (১৪. ১. ২৪)। বিচ্ছেদ বা মতান্তর না ঘটে (১৪.১.৩২), পত্নী যেন দীপ্ত গৌরবে শোভমানা হয় (১৪. ১. ৩৫-৬), সমস্ত প্রকৃতি যেন বধূর কল্যাণকারিণী হয় (১৪. ১.৪০), ইহাই আশীর্ব্বাদ করা হইত। দাক্ষিণ্যে ও উদারতায় পতিগৃহে গিয়া যেন কন্যা সম্রাজ্ঞীর ন্যায় গৌরবান্বিত হয়, ইহা কামনা করা হইত (১০.১. ৪৩-৪৪)। পতিও সৌভাগ্যকল্যাণ কামনা করিয়া পত্নীর হস্ত গ্রহণ করিতেন (১৪. ১. ৫০)। পতি বলিতেন, “আমি তোমাকে নীতির দেবতা বরুণের পাশ হইতে মুক্ত করিলাম (১৪. ১.৫৮)। হে সুন্দরি, পুষ্পশোভিত সুকিংশুক বিচিত্র সজ্জায় সজ্জিত, হিরণ্যবর্ণ, সুবৃত চক্ররথে আরোহণ করিয়া পতির পক্ষে এই রথকে আনন্দময় করিয়া অমৃতলোকে যাত্রারম্ভ কর (১.১৪. ৬১)। সর্বদিকে ব্রহ্মপরিবৃত হইয়া, হে কল্যাণি, আনন্দময়ি, তুমি দেবপুরে গিয়া পতিলোকে বিরাজমানা হও (১৪. ১. ৬৪)।”

 দ্বিতীয় সূক্তে ৭৫টি মন্ত্র। তাহাতে প্রধানত অকল্যাণ দূর করিয়া নানা সৌভাগ্য কামনা করা হইয়াছে: “বিধাতা এই নারীকে এই সংসার দিয়াছেন, সে এখানে কল্যাণী হউক (১৪.২.১৩)। বিষ্ণুর সরস্বতীর মত এখানে তুমি প্রতিষ্ঠিত হও, তুমি বিরাট হও (১৪.২.১৫)। সকলের আনন্দ ও কল্যাণ বিধান কর, পতির কল্যাণকারিণী হও (১৪.২. ১৭-১৮)। গার্হপত্য অগ্নি, পিতৃগণ ও সরস্বতীকে (২৬-২৭) নমস্কার কর (১৪.২. ২০)। বিদায় লইবার পূর্বে সমবেত সকলে এই সুমঙ্গলী নববধূকে আশীর্বাদ করুন (১৪. ২.২৮)। “হে নববধূ, আজ হইতে ইন্দ্রাণীর ন্যায় ঊষার ন্যায় শোভমানা হও, নবচেতনায় সকলকে জাগ্রত কর (১৪.২, ২১)।

 “এইসব তরুণীরা যখন আনন্দিত মনে, আগ্রহে পতির গৃহে যাত্রা করে তখন আমরাও বলি ‘স্বাহা’ (১৪. ২. ৫২), অর্থাৎ ‘ভালো ভালো’। সর্বযশ সর্বরস ইহাতে প্রবেশ করুক (১৪. ২. ৫৮)। এই কন্যাও লাজ-শস্য ছড়াইয়া পতিকুলের শুভ কামনা করে (১৪.২.৬৩)। হে কন্যা, গৃহের পত্নী হইয়া গৃহে গমন কর, শতজীবিনী হও, সবিতা তোমাকে দীর্ঘায়ু করুন (১৪. ২.৭৫)।”

 গৃহ্যসূত্র ও পরবর্তী স্মৃতি এবং নিবন্ধগুলির মধ্যে ক্রমে ক্রমে বিবাহপ্রথা যেরূপ বিপুল হইয়া উঠিল তাহা অনুসন্ধিৎসু পাঠকেরা সহজেই দেখিতে পারেন। তাহার পর দেশাচার কুলাচার ভেদে স্ত্রীগণের নানা আচার-অনুষ্ঠানে বিবাহ একটা বিরাট মহোৎসবে পরিণত হইল।

 বেদে ‘সপত্নী’ শব্দ আছে। ঋগ্বেদের তৃতীয় মণ্ডলে প্রথম ও ষষ্ঠ সূক্তে এবং আরও নানা স্থানে সপত্নী কথাটি দেখা যায়। ইহাতে সেইখানে একাধিক পত্নীর উল্লেখ থাকিলেও সাধারণ একপত্নী থাকাই প্রথা ছিল, যদিও মনুর দশ ও যাজ্ঞবল্ক্যের দুই পত্নী ছিলেন। রাজারা একাধিক বিবাহ করিতেন। কিন্তু বৈদিক সাহিত্য দেখিলে ইহাই মনে হয়, একপত্নী লইয়াই সাধারণত সকলেই ঘর করিতেন। এক স্ত্রীর বহুপতি থাকা আর্যেতর জাতির মধ্যে প্রচলিত থাকিলেও আর্যদের মধ্যে তাহা চলিত ছিল না। সূর্যার বিবাহ-বিষয়ে যে ‘পতিভ্যো জায়াং’ কথা আছে এখানে পতিকুল সম্বন্ধে অথবা সম্মানে বহুবচন করা হইয়াছে। অর্থব বেদের (১৪. ১. ৬১) “স্যোনং পতিভ্যো বহুতুং কৃণুত্বম্” অর্থাৎ পতিকুলের জন্য এই রথযাত্রাকে আনন্দময় কর।

 সূর্যার বিবাহ প্রসঙ্গেই একটি কথা আছে, “তুরীয়স্তে মনুষ্যজাঃ”— এই মানুষ তোমার চতুর্থপতি (ঋগ্বেদ. ১০.৮৫, ৪০)। ইহাতে কেহ যেন ভুল না বোঝেন। কারণ পূর্ণমন্ত্রটি এই—

সোমঃ প্রথমো বিবিদে গন্ধর্বো বিবিদ উত্তরঃ।
তৃতীয়ো অগ্নিষ্টেপতিস্তরীয়স্তে মনুষ্যজাঃ।

অর্থাৎ, প্রথমে তোমাকে পাইয়াছেন সোমদেবতা; তাহার পর তোমাকে পাইলেন গন্ধর্ব; অগ্নি তোমার তৃতীয় পতি; চতুর্থ পতি হইলেন এই মনুষ্যবর।

 ইহার পরের মন্ত্রটি এই—

সোমো দদদ্ গন্ধর্বায় গন্ধর্বোদদদগ্নয়ে। ১০, ৮৫, ৪১

সোম ইঁহাকে দিলেন গন্ধর্বকে, গন্ধর্ব দিলেন অগ্নিকে।

 এখানে দেবতার সঙ্গে কন্যার বিবাহ যে কোনো মতেই হইতে পারে না তাহা সকলেই বোঝেন। তবে এইকথা বলিবার আসল তাৎপর্য কি? গোভিলীয়-গৃহ্যসূত্র-পরিশিষ্টে দেখা যায় (২. ১৭-১০) ঋতুমতী না হইলে কন্যাকে বলে ‘নগ্নিকা’; ঋতুমতী হইলে ‘অনগ্নিকা’, এই অনগ্নিকা কন্যাই বিবাহে দান করিতে হয়। নগ্নিকাকে ‘গৌরী’ এবং ঋতুমতী অনগ্নিকাকে ‘রোহিণী’ও বলে। যৌবন চিহ্ন দেখা না গেলে ‘কন্যা’, কুচাদিহীনাকেও ‘নগ্নিকা’ বলে। যৌবনব্যঞ্জন দেখা গেলে সোম সেই কন্যাকে গ্রহণ করেন (অর্থাৎ তখন সে সৌম্য হয়), পয়োধর হইলে গন্ধর্ব গ্রহণ করেন এবং ঋতুমতী হইলে অগ্নি তাহাকে গ্রহণ করেন। তাই অব্যঞ্জনোপেতা, অরজা, অপয়োধরা কন্যকাদান ভালো নয়, কারণ বেদে-উক্ত দেবতাদের সঙ্গে তাহার তখনও কোনো যোগ হয় নাই—

তস্মাদবাঞ্জনোপেতামরজামপয়োধরাম্।
অভুক্তাং চৈব সোমাদ্যৈঃ কন্যকাং ন প্রশস্যতে।

 এইসব দেবতাদের সঙ্গে যোগের ও ভোগের কথা যে অর্থবাদমাত্র তাহা বুঝা যায় বসিষ্টস্মৃতির এই শ্লোক দেখিয়া—

পূর্বঃ স্ত্রিয়ঃ সুরৈর্ভুক্তাঃ সোমগন্ধর্ববহ্নিভিঃ॥[১৭]

অর্থাৎ, পূর্বে স্ত্রীগণ সোম গন্ধর্ব বহ্নির দ্বারা ভুক্ত। ইহার তাৎপর্যও পরশ্লোকেই তিনি বলিতেছেন, সোমদেবতা নারীকে দেন শুচিতা, গন্ধর্ব দেন শিক্ষিত বাণী, অগ্নি দেন সর্বভক্ষত, তাই নারীগণ নিষ্কল্মষ—

তাসাং সোমেঽদদচ্ছৌচং গন্ধর্বঃ শিক্ষিতাং গিরম্।
অগ্নিশ্চ সর্বভক্ষত্বং তস্মান্নিষ্কল্মষাঃ স্ত্রিয়ঃ। ২৮.৬

বৌধায়নও এইকথা বলেন (বৌধায়ণ-স্মৃতি, ২. ২. ৫৮)।

 মহর্ষি অত্রি বলেন—

পূর্বং স্ত্রিয়ঃ সুরৈর্ভুক্তাঃ সোমগন্ধর্ববহ্নিভিঃ।
ভুঞ্জন্তে মানবাঃ পশ্চান্ ন তা দুয্যন্তি কর্হিচিৎ[১৮]

 সোম গন্ধর্ব বহ্নির পরে মানব স্ত্রীকে ভোগ করেন, ইহাকে কেহ দোষ দিতে পারে না। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যও বলিলেন, সোম কন্যাকে দিলেন শৌচ, গন্ধর্বেরা দিলেন শুভা বাণী, পাবক দিলেন সর্বমেধ্যতা, তাই তো নারীগণ সর্বদাই পবিত্র—

সোমঃ শৌচং দদৌ তাসাং গন্ধর্বাশ্চ শুভাং গিরম্।
পাবকঃ সর্বমেধ্যত্বং মেধ্যা বৈ যোষিতোহ্যতঃ। যাজ্ঞবল্ক্য-সংহিতা ১.৭১

 কাজেই এইসব মন্ত্র দেখিয়া বুঝা যায় কন্যাদের বহু-পতিত্ব ইহাতে বুঝায় না। তবে কন্যাদের বহু-পতিত্ব যে একেবারে ছিল না তাহা নহে, সেকথা পরে হইবে।

 এই বিচারে দেখা গেল, তখন যৌবনেই বিবাহ হইত।

 আপস্তম্ব-ধর্মসূত্রে (২. ১. ১৭) দেখা যায়, ঋতুমতী না হইলে স্ত্রীর সঙ্গে বাস করিবে না। গৌতম ধর্মসূত্রেও (৫.১) সেই উপদেশ। প্রাচীন কালে কথার কথাই ছিল—

প্রাগ্‌রজোদর্শনাৎ পত্নীং নেয়াৎ।

অর্থাৎ, পত্নীকে রজোদর্শনের পূর্বে গমন করিবে না। গোভিলীয়-গৃহ্যসূত্রাদি গ্রন্থে এই বিষয়ে যথেষ্ট উপদেশ আছে। অথচ বিবাহের পরই গর্ভাধান করিবার জন্য অতন্তঃ কয়টি দিন প্রতীক্ষা করিতে হইবে তাহারও বিধান সেইসব গৃহ্যসূত্রে আছে। তিনরাত্রি উভয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া গর্ভাধান করিবে, ইহাই গোভিলীয়-গৃহ্যসূত্রের ব্যবস্থা।

 এই ব্যবস্থার মূল ছিল বীর ও তপস্যাশীল পুত্রলাভের বাসনা। অবশ্য এই বিষয়ে এখন Eugenics শাস্ত্রবিদ্‌দের কি মত তাহা বলিতে পারি না, কিন্তু আশ্বলায়ন বলেন—

অত ঊর্ধ্বমক্ষারলবণাশিনাবধঃশায়িনৌ ব্রহ্মচারিণৌ স্যাতাম্। ত্রিরাত্রং
দ্বাদশরাত্রং সংবৎসরংবৈক ঋষির্জায়ত ইতি। অশ্বলায়ন-গৃহা ১.৬.১১

অর্থাৎ, বিবাহের পর তখনই গর্ভাধান না করিয়া অন্তত কয়েকদিন উভয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করিবে। ভোজনে ক্ষার-লবণ ত্যাগ করিয়া খাট-পালঙ্কে না শুইয়া সংযত ব্রহ্মচর্যব্রতধারী হইয়া স্বামী স্ত্রী উভয়ে থাকিবে। কাহারও কাহারও মতে তিনরাত্রি থাকিলেই চলে, কেহ বলেন দ্বাদশরাত্রি, কেহ বলেন পুরা এক বৎসর এই ব্রত পালণীয়। ইহার উদ্দেশ্য হইল সন্তান যেন একজন ঋষি হয়।

 এখানে বৃত্তিকার হরদত্তাচার্য বলেন, এইরূপ নিয়মে থাকিলে ঋষিকল্প সন্তান হয়—

এবং নিয়মযুক্তস্য ঋষিকল্পঃ পুত্রো জায়তে।

 গণপতি শাস্ত্রীর মতে হরদত্ত খৃস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর লোক। তাঁহার বৃত্তির নাম ‘অনাবিলা’।

 গোভিলীয়-গৃহ্যসূত্রেও দেখা যায়—

তাবুভৌ তৎপ্রভৃতি ত্রিরাত্রমক্ষারলবণাশিনৌ ব্রহ্মচারিণৌ ভূমৌ সহ শরীয়াতাম্॥ ২,৩, ১৫

অর্থাৎ, বিবাহকর্মারম্ভের পর বরকন্যা উভয়ে কিছু কাল ভোজনে ক্ষার-লবণ বর্জন করিয়া ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া একসঙ্গে ভূমিশয্যায় শয়ন করিবে।

 ভাষ্যকার চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার মহাশয় বলেন, এখানে ব্রহ্মচর্যের অভিপ্রায় হইল সংযতেন্দ্রিয় হইয়া তিন রাত্রি কাটাইতে হইবে।

 তিনরাত্রির পরই সম্ভবকাল, এইকথা কোনো কোনো আচার্য বলেন—

ঊর্দ্ধং ত্রিরাত্রাৎ সম্ভব ইত্যেকে। গোভিলীর-গৃহ্য ২. ৫. ৭

 কোনো-কোনো আচার্যের মতে যখন ঋতু নিবৃত্ত হয় তখন সম্ভবকাল—

যদর্ত্তুমতী ভবত্যুপরতশোণিতা তদা সম্ভবকালঃ। ঐ ২, ৫, ৮

 ইহাতেই বুঝা যায় বিবাহের পরই সম্ভোগ চলিত। তবে সুসন্তান লাভের জন্য কয়েকদিন ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া গর্ভাধান করার বিধান আচার্যেরা দিয়াছেন।

 অপ্রাপ্তযৗবনা নারীর সঙ্গে উপহাসও করিবেনা— এইরূপ কঠিন অনুশাসন ছিল—

নাজাতলোম্ন্যোপহাসমিচ্ছেৎ। ঐ ৩.৫ ৩

এইসব বাক্যে বুঝা যায় তখন কন্যা রীতিমত বড়ই হইত। ভাষ্যকার চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার বলেন, বৈদেহরীতিতে যে সদ্য স্ত্রীপুরুষ সম্ভোগ দেখা যায়, তাহাই এই ব্রহ্মচর্যবিধির দ্বারা নিষিদ্ধ হইতেছে—

বৈদেহেষু চ সদ্য এব ব্যবায়ো দৃষ্টঃ।
সোঽয়মিদানীং প্রতিষিধ্যতে। ঐ ২.৩.১৫ ভাষ্য

 এখন অর্থাৎ পরবর্তীকালে অতি অল্পবয়সে কন্যাদের বিবাহ হওয়ায় বিবাহান্তে যখন বধূর রজোদর্শন হয়, তখন দ্বিতীয় বিবাহ বলিয়া একটি আচার পালিত হয়। ইদানীং আবার শিক্ষিত সমাজে কন্যাদের বেশি বয়সে বিবাহ হইতেছে বলিয়া দ্বিতীয় বিবাহের অনুষ্ঠান বহুস্থানে প্রায় লোপ পাইয়া আসিতেছে। কিন্তু আমরা বাল্যকালে এই আচার পল্লীগ্রামে পালিত হইতে দেখিয়াছি।

 সেই দ্বিতীয় বিবাহ সময়ে একটা ব্রহ্মচর্যের অভিনয় করা হইত। অর্থাৎ ব্রহ্মচারীর ন্যায় ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করিয়া ক্ষার-লবণ বিনা কন্যাকে খাইতে হইত। এই ভিক্ষাকে ‘মাঙ্গন’ বলিত। এখনকার দিনে যেমন ব্রহ্মচারীরা শূদ্রমুখ দেখার ভয়ে অন্ধকার ঘরে কিছুকাল বদ্ধ থাকিয়া কল্পনাতে আশ্রমবাস ফললাভ করে, দ্বিতীয় বিবাহে বধূরাও সেইরূপ করিত; কারণ তাহারাও তখন ব্রহ্মচর্য পালন করিতেছে। এখন ইহার কতটা কোথায় পালিত হইতেছে তাহা ঠিক বলিতে পারি না। পল্লীগ্রামে এই রীতি কতকটা এখনও পালিত হয়।

 এই দ্বিতীয় বিবাহের সঙ্গে স্ত্রীলোকদের যেসব আচার ও গান প্রভৃতি ছিল তাহা শ্লীলতার সীমাবহির্ভূত। তবে তাহাতেও বিবাহকালীন কিছু আচার পালিত হয়। ইহাতে মনে হয়, পূর্বে এই বিবাহই মুখ্য বিবাহ ছিল।

 এখন যে বিবাহের পরের রাত্রিটি ‘কালরাত্রি’ নামে অভিহিত তাহাতে যে বরকন্যার যোগ ঘটিতে দেওয়া হয় না, তাহা কি এই ব্রহ্মচর্যেরই অবশেষ? পূর্ব-ইতিহাস বিস্মৃত হওয়ায় এখন কেহ কেহ বলেন, কালরাত্রিতে বেহুলার সঙ্গে থাকায় লখিন্দর সর্পদংশনে মারা যায়, তাই এই নিষেধ।

 যৌবনে কন্যাদের বিবাহ হইলে একটা মুশকিল এই হইতে পারে যে, বিবাহকালে হোমাগ্নির সম্মুখে যদি কন্যা রজস্বলা হয় তখন কি করা যায়? কারণ রজস্বলা অবস্থায় নারী তো যজ্ঞে যোগ দিতে পারেন না। তাহার প্রতিবিধানার্থ আপস্তম্ব প্রথমে এই প্রশ্ন তুলিয়াছেন—

বিবাহে বিত্ততে যজ্ঞে সংস্কারে চ কৃতে যদা।
রজস্বলা ভবেৎ কন্যা সংস্কারস্তু কথং ভবেৎ। ৭.৯

অর্থাৎ, বিবাহের যজ্ঞ যখন বিস্তৃতভাবে আরম্ভ করা হইয়াছে, যখন সংস্কার করা হইতেছে, তখন যদি কন্যা রজস্বলা হয়, তবে সংস্কার সমাপ্ত হইবে কেমন করিয়া?

 তাহার উত্তরে আপস্তম্ব নিজেই বলিতেছেন, কন্যাকে তখন স্নান করাইয়া নূতন বস্ত্রাদির দ্বারা শোভিত করিয়া পুনরায় আহুতি দিয়া বাকি কর্ম সমাপ্ত করিবে—

স্নাপয়িত্বা তদা কন্যামন্যৈর্বস্ত্রৈরলঙ্কৃতাম্।
পুনঃ প্রত্যাহুতিঃ হুত্বা শেষং কর্ম সমাচরেৎ॥ আপস্তম্ব-স্মৃতি ৭.১০

 এইরূপ বিবাহযজ্ঞে রজোদর্শনে কি করা উচিত তাহা শাস্ত্রের আরও বহু স্থানে বিবৃত হইয়াছে। বাহুল্যভয়ে এখানে তাহা আর দেওয়া হইল না।

সম্পত্তির অধিকার

 কন্যাকে দান ও যৌতকাদি যে দেওয়া হইত তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তবে সংসারে পত্নীর স্থান কেমন ছিল তাহা বলা একটু কঠিন। আদর্শ তখনকার দিনে খুবই উচ্চ ছিল। কারণ কন্যাকে পতিগৃহে গিয়া সম্রাজ্ঞী হইতে হইবে, এই আশীর্বাদ বেদের বহুস্থলেই আছে। কিন্তু আসল কথা হইতেছে, তখনকার আইনে কিরূপ বিধান দেখা যায়। পিতৃগৃহ হইতে প্রাপ্ত ধন এবং পতি যাহা স্ত্রীকে বিশেষ করিয়া দিতেন তাহা হইল স্ত্রীধন। এই স্ত্রীধনে নারীর নিজস্ব অধিকার ছিল। আর্যেরা যখন আর্যকন্যাই বিবাহ করিতেন তখন নারীদের অবস্থা উন্নততর ছিল। কিন্তু যখন তাঁহাদের মধ্যে শূদ্রা-পত্নী গ্রহণ বেশি করিয়া চলিল তখন ক্রমে সেই সম্মান আর রহিল না।

 শতপথ-ব্রাহ্মণে যে আছে নারীদের নিজের বা সম্পত্তির উপর অধিকার নাই (৪. ৪. ২. ১৩) তাহা সেই জাতীয় কথা। মৈত্রায়ণী-সংহিতায় (৪. ৬. ৪) ও তৈত্তিরীয়-সংহিতায়ও (৬.৫. ৮. ২) অনুরূপ কথা দেখা যায়।

 বিবাহকালে অগ্নির সমক্ষে পিতৃকুল হইতে যাহা প্রাপ্ত তাহা ‘অধ্যগ্নি‘। পিতৃগৃহ হইতে পতিগৃহে যাইবার সময় প্রাপ্ত ধনকে বলে ‘অধ্যাবাহনিক’ (কুল্লূকভট্ট)। মনু বলেন, অধ্যগ্নি অধ্যাবাহনিক প্রীতিবশত পতির কাছে প্রাপ্ত ভাইয়ের কাছে মায়ের কাছে বাপের কাছে প্রাপ্ত এই ছয় প্রকারে প্রাপ্ত ধনই স্ত্রীধন—

অধ্যগ্ন্যধ্যাবাহনিকং দত্তং চ প্রীতিকর্মণি।
ভ্রাতৃমাতৃপিতৃপ্রাপ্তং ষড়্‌বিধং স্ত্রীধনং স্মৃতম্। মনু ৯. ১৯৪

 নারদীয়-মনুসংহিতাতেও (১৩.৮) এই ব্যবস্থা দিয়াছেন। যাজ্ঞবল্ক্যেও (৮.৩-১৪৪) এই বিধানই দেখা যায়।[১৯]

 বরদরাজ-কৃত ব্যবহার-নির্ণয়ে দেখা যায়, নারদ ও বিষ্ণুর সেই মত। সেইখানে দেবলের ও কাত্যায়নের মতও উদ্ধৃত হইয়াছে।[২০]

 মহাভারতে দেখা যায়, নারীরা বিবাহকালে শ্বশুরাদি গুরুজনের কাছে প্রীতি-উপহার বা প্রীতিদাত্মস্বরূপে ধনরত্নাদি লাভ করিতেন। তখন কন্যাদের আদর ছিল—

শ্বশুরাৎ প্রীতিদায়ং তৎ প্রাপ্য সা প্রীতমানসা। অশ্বমেধ, ৮৯. ২৯

 এই ধন যৌতক স্বরূপে গণনীয়। কন্যাপক্ষীয়রাও বরপক্ষের বাড়ি গেলে বরপক্ষের কাছে রত্নাদি উপহার পাইয়া ফিরিতেন—

রত্নান্যাদায় শুভ্রাণি দত্তানি কুরুসত্তমৈঃ। আদি ২২১, ৬২

 বৈদিকযুগে স্ত্রীধনরূপে নারীরা কি পাইতেন তাহা আলোচনা করিতে গেলে তখনকার দিনের বেশভূষা ও অলংকারাদির বিষয় আলোচনা করিতে হয়। এই বিষয় অধ্যাপক Macdonell এবং Keith তাঁহাদের সম্পাদিত Vedic Index-এ ভালোরূপ আলোচনা করিয়াছেন। তাঁহারা বলেন, ‘নীবি’ অর্থ মেয়েদের অন্তর্বাস। অথর্বে ইহা উল্লিখিত। ঋগ্বেদে ‘পেশস্’ পাওয়া যায়, তাহা জরির কারুকার্যময় বস্ত্র। বাঈজীদের ‘পেশোয়াজে’র সঙ্গে কি ইহার কোনো মিল আছে? বধূ যে বস্ত্র পরিয়া বিবাহের সভায় আসিতেন তাহার নাম ‘বাধুয়’ (ঋগ্বেদ ১০. ৮৫. ৩৪)। এই সুন্দর বস্ত্রখানি পরে কোনো ব্রাহ্মণকে দেওয়া হইত। কাপড়ের সুন্দর পাড় থাকিত। তাহাকে ‘সিচ্’ বলিত (ঋগ্বেদ ১০. ১৮. ১১)। খুব জমকালো পোশাক অর্থে ‘সুবসন’ শব্দ পাই (ঋগ্বেদ ৫. ৫১. ৪)।

 বসনের পরই আভূষণ অলংকার। ঋগ্বেদে সূর্যার বিবাহপ্রসঙ্গে কিছু বেশভূষা উপকরণের নাম দেখা যায়। ‘ওপশ’ জিনিসটা কি? ঋগ্বেদে (১০. ৮৫. ৮) ইহার উল্লেখ দেখি। সায়ণ বলেন, “যেন উপশেরতে”। কেহ মনে করেন বেণি বা চূড়া, কেহ বা বুঝেন শিরোভূষণ বিশেষ। ‘কর্ণশোভনা’কে (ঋগ্বেদ ৮. ৭৮. ৩) সায়ণ মনে করেন কর্ণাভরণ। অথর্ববেদের (৬. ১৩৮. ৩) ‘কুম্ব’ ও ‘কুরীর’ দেখা যায়। হয়তো তাহা শৃঙ্গনির্মিত চিরুণি (comb?) বা বিশেষ প্রকারের কেশসজ্জা। ‘খাদি’ (ঋগ্বেদ ৫. ৫৪. ১১) হাতের বা পায়ের খাড়ু বলিয়া মনে হয়। অথর্ববেদের (৮.৬. ৭) ‘তিরীটিনঃ’ অর্থে সায়ণ মনে করেন অন্তর্ধাননিপুণ। কিন্তু অনেকের মতেই তিরীট একপ্রকার শিরোভূষণ। ‘নিষ্ক’ (ঋগ্বেদ ২. ৩৩. ১০; ৮. ৪৭. ১৫ ইত্যাদি) হইল গলার হার। নিষ্ক নামে একপ্রকার মুদ্রাও পরে দেখা যায়। হয়তো মোহরের মত বস্তুর মালা। ‘ন্যোচনী’ (ঋগ্বেদ ১০. ৮৫. ৬) অর্থ সায়ণ বলেন দাসী। সূর্যার বিবাহে ন্যোচনী দেওয়া হইয়াছিল। কেহ মনে করেন ভূষণবিশেষ। অথর্বে ব্রাত্যসূক্তে ‘প্রবর্ত’ দেখা যায়। তৈত্তিরীয়-সংহিতার টীকার মতে ইহা কুণ্ডল বিশেষ। ‘প্রাকাশ’ (তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১. ৮. ২. ৩) বোধ হয় দর্পণ। মৈত্রায়ণী-সংহিতায় ‘প্রাবেপ’ও এই বস্তুই (৪. ৪. ৮)। ঋগ্বেদে (৮.৭৮. ২) দেখা যায়, “সচা মনা হিরণ্যয়া”; সায়ণ অর্থ করেন, মননীয় হিরণ্ময় উপকরণ। ‘রুক্ম’ (ঋগ্বেদ ১. ১৬৬, ১০ ইত্যাদি) হইল বুকের অলংকার। ইহা প্রায়ই স্বর্ণময় হইত। খুব সম্ভব ইহা গোলাকার হইত। ইহা ঝুলাইবার যে হার তাহাকে বলিত ‘রুক্মপাশ' (শতপথ-ব্রাহ্মণ ৬. ৭. ১. ৭. ২৭)। রুক্মিণী ইহা হইতেই সম্পন্ন শব্দ। ষড়্‌বিংশ ব্রাহ্মণে (৫. ৬) ‘বি-মুক্তা’ও দেখা যায়। অথর্বে ‘শঙ্খ’ দেখা যায় (৪. ১০. ১); তাহার সম্বন্ধে সায়ণ বলেন, উপনয়নের পরে বালকের দেহ শঙ্খমণির দ্বারা ভূষিত করিবে, “শঙ্খমণিং বধ্নীয়াৎ”। তৈত্তিরীয়-ব্রাহ্মণে (২.৩. ১০. ২) ‘স্থাগর’ নামক অলংকারের উল্লেখ আছে, কিন্তু জিনিসটা কি তাহা বুঝা গেল না। ‘স্রজ্’ মালা বা হারের নাম বহু স্থলেই উল্লিখিত (ঋগ্বেদ ৪. ৩৮. ৬ ইত্যাদি)। ‘মণি’ শব্দও বেদে বহুস্থানে পাওয়া যায় (ঋগ্বেদ ১. ৩৩. ৮), হারে গাঁথিয়া গলায় মণি ঝুলানো হইত। যজুর্বেদ পুরুষমেধপ্রসঙ্গে মণিকারেরও উল্লেখ আছে।

  1. Mysore Tribes and Castes Vol. 11, p 476
  2. Mysore Tribes and Castes, Vol. 11, p 35
  3. pp 329-349
  4. মৈত্রায়ণী-সংহিতা ১, ১০. ১১; শতপথ ব্রাহ্মণ ২, ৫.২.২.
  5. Mysore Tribes and Castes, Vol II, p. 361
  6. অথর্ব ২,৩৬.১; ঋগ্বেদ ৭.২.৫
  7. ঋগ্বেদ ২.১৭.৭; ৮.২১.১৫; ১০.৩৭.৩
  8. গৌতম ধর্মসূত্র ২৮.২০; বলিষ্ঠ ধর্মসূত্র ১৭.১৭; মনু ৯.১২৭-১৪০
  9. কপিসুল-সং, ৪৭.৭; কাঠক-সং, ৩১.৭; তৈত্তিরীয়-ব্র. ৩.৮.২০.১; ৩.৯.১৫.৯; ৩,২,৮,১১; তৈত্তিরীয়-সং. ৬.৬.১০.৩; মৈত্রায়ণী সং. ৪.১.৯
  10. তৈত্তিরীয় আরণ্যক, ২৭.৩; ২.৮.২; ২.৮.৩; ১০.১.১৫; কৌষীতকি-ব্রাহ্মণ- উপনিষৎ ৩.১; বৃহদারণ্যক, ৪.৩.২২; মহানারায়ণ, ৬.১১; ১৭.৭; ১০.১; নৃসিংহ-পূর্বতাপনী, ৫.৪; ইত্যাদি।
  11. Mysore Tribes and Castes', Vol. II, p. 356
  12. বৃহস্পতি ২, ৩০; Mysore Tribes and Castes, vol. II, p. 36
  13. ঋগ্বেদ ১০. ১৮, ৭-৮. অথর্ব ১৪, ২, ১৩.২০. ২১. ৬৩. ইত্যাদি
  14. তৈত্তিরীয়-সংহিতা ২.৩.৪.১; কাঠক-সংহিতা ৩৬. ৫; মৈত্রায়ণী-সংহিতা ১, ১০, ১১ তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১, ১, ২. ৪
  15. Whitney's Translation of the Atharva Veda Samhita. 14.1.7
  16. সামবেদীয় বিবাহসংস্কার, পৃ ৪০৮; পুরোহিত দর্পণ, সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সংকলিত অষ্টম সংস্করণ।
  17. স্মৃতীনাং সমুচ্চয় সংস্করণে, বসিষ্টস্মৃতি, আনন্দাশ্রম ২৮. ৫
  18. অত্রিসংহিতা, মন্মথনাথ দত্ত সংহিতা, ৯০
  19. Adyar Series, 29
  20. দায়বিভাগ কাণ্ড। পৃ ৪৬৪