বাঁশরী/দ্বিতীয় অঙ্ক/দ্বিতীয় দৃশ্য
দ্বিতীয় অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
চৌরঙ্গি-অঞ্চলে বাঁশরীদের বাড়ি। ক্ষিতীশ ও বাঁশরী
ক্ষিতীশ
তোমার হিন্দুস্থানী শোফার্টা ভোরবেলা মুহুর্মুহু বাজাতে লাগল গাড়ির ভেঁপু। চেনা আওয়াজ, ধড়্ফড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লুম।
বাঁশরী
ভোরবেলায়? অর্থাৎ?
ক্ষিতীশ
অর্থাৎ, আটটার কম হবে না।
বাঁশরী
অকালবোধন!
ক্ষিতীশ
দুঃখ নেই, তবু জানতে চাই কারণটা। কোনো কারণ না থাকলেও নালিশ করব না।
বাঁশবী
বুঝিয়ে বলছি। লেখবাব বেলায় নলিনাক্ষের দল বলে যাদের দাগা দিয়েছ তাদের সামনে এলেই দেখি তোমার মন যায় এতটুকু হয়ে। মনে মনে চেঁচিয়ে নিজেকে বোঝাতে থাক— ওরা তো ডেকোরেটেড্ ফুল্স্। কিন্তু সেই স্বগতোক্তিতে সংকোচ চাপা পড়ে না। সাহিত্যিক আভিজাত্যবোধকে অন্তরের মধ্যে ফাঁপিয়ে তোল তবু নিজেকে ওদের সমান বহরে দাঁড় করাতে পার! সেই চিত্তবিক্ষেপ থেকে বাঁচাবার জন্য নলিনাক্ষদলের দিন আরম্ভ হবার পূর্বেই তোমাকে ডাকিয়েছি। সকাল বেলায় অন্তত ন’টা পর্যন্ত আমাদের এখানে রাতের উত্তরাকাণ্ড। আপাতত এ বাড়িটা সাহারা মরুভূমির মতো নির্জন।
ক্ষিতীশ।
ওয়েসিস্ দেখতে পাচ্ছি এই ঘরটার সীমানায়।
বাঁশরী
ওগো পথিক, ওয়েসিস্ নয়, ভালো করে যখন চিনবে তখন বুঝবে মরীচিকা।
ক্ষিতীশ
আমার মাথায় আরও উপমা আসছে বাঁশি, আজ তোমার সকালবেলাকার অসজ্জিত রূপ দেখাচ্ছে যেন সকালবেলাকার অলস চাঁদের মত।
বাঁশরী
দোহাই তোমার, গদগদ ভাবটা রেখে দিয়ে একলা ঘরের বিজন বিরহের জন্য। মুগ্ধ দৃষ্টি তোমাকে মানায়। কাজের জন্য ডেকেছি, বাজে কথা স্ট্রীক্ট্লি প্রোহিবিটেড্।
ক্ষিতীশ
এর থেকে ভাষার রেলেটিভিটি প্রমাণ হয়। আমার পক্ষে যা মর্মান্তিক জরুরী তোমার পক্ষে তা ঝেটিয়ে ফেলা বাজে।
বাঁশরী
আজ সকালে এই আমার শেষ অনুরোধ, গাঁজিয়ে ওঠা রসের ফেনা দিয়ে তাড়িখানা বানিয়ে না নিজের ব্যবহারটাকে। আর্টিস্টের দায়িত্ব তোমার।
ক্ষিতীশ
আচ্ছা তবে মেনে নিলুম দায়িত্ব।
বাঁশরী
সাহিত্যিক, হতাশ হয়ে পড়েছি তোমার অসাড়তা দেখে। নিজের চক্ষে দেখলে একটা আসন্ন ট্র্যাজেডির সংকেত— আগুনের সাপ ফণা ধরেছে, এখনো চেতিয়ে উঠল তোমার কলম, আমার তো কাল সারারাত্রি ঘুম হল না। এমন লেখা লেখবার শক্তি কেন আমাকে দিলেন না বিধাতা যার অক্ষরে অক্ষরে ফেটে পড়ত রক্তবর্ণ আগুনের ফোয়ারা? দেখতে পাচ্ছি আর্টিস্টের চোখে, বলতে পারছি নে আর্টিস্টের কণ্ঠে। ব্রহ্মা যদি বোব হতেন তা হলে অসুস্ট বিশ্বের ব্যথায় মহাকাশের বুক যেত ফেটে।
ক্ষিতীশ
কে বলে তুমি প্রকাশ করতে পার না বাঁশি, তুমি নও আর্টিস্ট! তুমি যেন হীরেমুক্তোর হরির লুঠ দিচ্ছ। কথায় কথায় তোমার শক্তির প্রমাণ ছড়াছড়ি যায় দেখে ঈর্ষা হয় মনে।
বাঁশরী
আমি যে মেয়ে, আমার প্রকাশ ব্যক্তিগত। বলবার লোককে প্রত্যক্ষ পেলে তবেই বলতে পারি। কেউ নেই তবু বলা সেই বলা তো চিরকালের। আমাদের বলা নগদ বিদায় হাতে হাতে দিনে দিনে। ঘরে ঘরে মুহূর্তে মুহূর্তে সেগুলো ওঠে আর মেলায়।
ক্ষিতীশ
পুরুষ আর্টিস্ট্কে এবার মেরেছ ঠেলা, আচ্ছা বেশ, কাজ আরম্ভ হোক। সেদিন বলেছিলে একটা চিঠির কথা।
বাঁশরী
এই সেই চিঠি। সন্ন্যাসী বলছেন— প্রেমে মানুষের মুক্তি সর্বত্র। কবিরা যাকে বলে ভালোবাসা সেইটাই বন্ধন। তাতে একজন মানুষকেই আসক্তির দ্বারা ঘিরে নিবিড় স্বাতন্ত্র্যে অতিকৃত করে। প্রকৃতি রঙিন মদ ঢেলে দেয় দেহের পাত্রে, তাতে যে মাৎলামি তীব্র হয়ে ওঠে তাকে অপ্রমত্ত সত্যবোধের চেয়ে বেশি সত্য বলে ভুল হয়। খাঁচাকেও পাখি ভালোবাসে যদি তাকে আফিমের নেশার বশ করা যায়। সংসারে যত দুখ, যত বিরোখ, যত বিকৃতি সেই মায়া নিয়ে যাতে শিকলকে করে লোভনীয়। কোন্টা সত্য কোন্টা মিথ্যে চিনতে যদি চাও তবে বিচার করে দেখো কোন্টাতে ছাড়া দেয় আর কোন্টা রাখে বেঁধে। প্রেমে মুক্তি, ভালোবাসায় বন্ধন।
ক্ষিতীশ
শুনলেম চিঠি, তার পরে?
বাঁশরী
তার পরে তোমার মাথা! অর্থাৎ তোমার কল্পনা। মনে মনে শুনতে পাচ্ছ না শিষ্যকে বলছেন, ভালোবাসা আমাকে নয়, অন্য কাউকেও নয়? নির্বিশেষ প্রেম, নির্বিকার আনন্দ, নিরাসক্ত আত্মনিবেদন, এই হল দীক্ষামন্ত্র।
ক্ষিতীশ
তা হলে এর মধ্যে সোমশংকর আসে কোথা থেকে?
বাঁশরী
প্রেমের সরকারী রাস্তায়, যে প্রেমে সকলেরই সমান অধিকার খোলা হাওয়ার মতো। তুমি লেখক-প্রবর, তোমার সামনে সমস্যাটা এই যে, খোলা হাওয়ায় সোমশংকরের পেট ভরবে কি?
ক্ষিতীশ
কী জানি! সুচনায় তো দেখতে পাচ্ছি শূন্যপুরাণের পালা।
বাঁশরী
কিন্তু শূন্যে এসে কি ঠেকতে পারে কিছু? শেষ মোকামে তো পৌঁছল গাড়ি, এ পর্যন্ত রথ চালিয়ে এলেন সন্ন্যাসী সারথি! আড্ডা-বদলের সময় যখন একদিন আসবে তখন লাগাম পড়বে কার হাতে? সেই কথাটা বলোনা রিয়লিস্ট্!
ক্ষিতীশ
যাকে ওরা নাক সিট্কে প্রকৃতি বলেন সেই মায়াবিনীর হাতে। পাখা নেই অথচ আকাশে উড়তে চায় যে স্থূল জীবটা তাকে যিনি ধপ করে মাটিতে ফেলে চট্কা দেন ভাঙিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে লাগিয়ে দেন ধুলো।
বাঁশরী
প্রকৃতির সেই বিদ্রূপটাকেই বর্ণনা করতে হবে তোমাকে। ভবিতব্যের চেহারাটা জোর কলমে দেখিয়ে দাও। বড় নিষ্ঠুর। সীতা ভাবলেন, দেবচরিত্র রামচন্দ্র উদ্ধার করবেন রাবণের হাত থেকে, শেষকালে মানবপ্রকৃতি রামচন্দ্র চাইলেন তাঁকে আগুনে পোড়াতে। একেই বলে রিয়ালিজ্ম, নোঙরামিকে নয়। লেখো লেখো, দেরি কোরো না, লেখো এমন ভাষায় যা হৃৎপিণ্ডের শিরাছেঁড়া ভাষা। পাঠকেরা চম্কে উঠে দেখুক এতদিন পরে বাংলার দুর্বল সাহিত্যে এমন একটা লেখা ফেটে বেরোল যা ঝোড়ো মেঘের বুকভাঙা সূর্যাস্তের রাগী আলোর মত।
ক্ষিতীশ।
ইস্, তোমার মনটা নেমেছে ভল্ক্যানোর জঠরাগ্নির মধ্যে। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি— ওদের অবস্থায় পড়লে কী করতে তুমি?
বাঁশরী
সন্ন্যাসীর উপদেশ সোনার জলে বাঁধানো খাতায় লিখে রাখতুম। তার পরে প্রবৃত্তির জোর কলমে তার প্রত্যেক অক্ষরের উপর দিতুম কালীর আঁচড় কেটে। প্রকৃতি জাদু লাগায় আপন মন্ত্রে, সন্ন্যাসীও জাদু করতেই চায় উল্টো মন্ত্রে; ওর মধ্যে একটা মন্ত্র নিতুম মাথায় আর-একটা মন্ত্রে প্রতিদিন প্রতিবাদ করতুম হৃদয়ে।
ক্ষিতীশ
এখন কাজের কথা পাড়া যাক। ইতিহাসের গোড়ার দিকটায় ফাঁক রয়েছে। ওদের বিবাহসম্বন্ধ সন্ন্যাসী ঘটাল কী উপায়ে?
বাঁশরী
প্রথমত সেনবংশ যে ক্ষত্রিয়, সেনানী শব্দ থেকে তার পদবীর উদ্ভব, ওরা যে কোনো-এক খৃস্ট-শতাব্দীতে এসেছিল কোনো-এক দক্ষিণপ্রদেশ থেকে দিগ্বিজয়ীবাহিনীর পতাকা নিয়ে বাংলার কোনো-এক বিশেষ বিভাগে, সেইটে প্রমাণ করে লিখল এক সংস্কৃত পুঁথি। কাশীর দ্রাবিড়ী পণ্ডিত করলে তার সমর্থন। সন্ন্যাসী স্বয়ং গেল সোমশংকরদের রাজ্যে, প্রজারা হাঁ করে রইল ওর চেহারা দেখে, কানাকানি করতে লাগল কোনো-একটা দেব-অংশের ঝালাই দিয়ে এর দেহখানা তৈরি। সভাপণ্ডিত মুগ্ধ হল শৈবদর্শনব্যাখ্যায়। রাজাবাহাদুরের মনটা সাদা, দেহটা জোরালো, তাতে লাগল কিছু সন্ন্যাসীর মন্ত্র, কিছু লাগল প্রকৃতির মোহ। তার পরে এই যা দেখছ।
ক্ষিতীশ
হায় রে, সন্ন্যাসী কি আমাদের মতো অভাজনদের হয়ে স্কুল প্রকৃতির তরফে ঘটকালি করেন না।
বাঁশরী
রাখো তোমার ছিব্লেমি। ভুল করেছি তোমাকে নিয়ে যে মানুষ খাঁটি লিখিয়ে তার সামনে যখন দেখা দিয়েছে সৃষ্টিকল্পনার এমন একটা জীবন্ত আদর্শ দব দব্ করছে যার নাড়ি, তার মুখ দিয়ে কি বেয়োয় খেলো কথা? কেমন করে জাগাব তোমাকে? আমি যে প্রত্যক্ষ দেখছি একটা মহারচনার পূর্বরাগ, শুনছি তার অন্তহীন নীরস কান্না। দেখতে পাচ্ছ না অদৃষ্টের একটা নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ? থাক্ গে, শেষ হল আমার কথা। তোমার খাবার পাঠিয়ে দিতে চললুম। (প্রস্থানোদ্যম)
ক্ষিতীশ
(ছুটে গিয়ে হাত চেপে ধরে) চাই নে খাবার। যেয়ো না তুমি।
বাঁশরী
(হাত ছিনিয়ে নিয়ে উচ্চহাস্যে) তোমার ‘বেমানান’ গল্পের নায়িকা পেয়েছ আমাকে! আমি ভয়ংকর সত্যি।
ড্রেসিংগাউন-পরা সতীশের প্রবেশ
সতীশ
উচ্চহাসির আওয়াজ শুনলুম যে।
বাঁশরী
উনি এতক্ষণ স্টেজের মুনুবাবুর নকল করছিলেন।
সতীশ
বাঁশরী
আসে বৈ কি, ওঁর লেখা পড়লেই টের পাওয়া যায়। তুমি এঁর কাছে একটু বোসো, আমি ওঁর কষ্ট খাবার পাঠিয়ে দিই গে।
ক্ষিতীশ
দরকার নেই, কাজ আছে, দেরি করতে পারব না।
প্রস্থান
বাঁশরী
মনে থাকে যেন আজ বিকেলে সিনেমা তোমারই পদ্মাবতী।
নেপথ্য হতে
সময় হবে না।
বাঁশরী
হবেই সময়, অন্য দিনের চেয়ে দু ঘণ্টা আগে।
সতীশ
আচ্ছা বাঁশি, ঐ ক্ষিতীশের মধ্যে কী দেখতে পাও বলল তো।
বাঁশরী
সতীশ।
এমন ফেল-করা জিনিস নিয়ে করবে কী।
বাঁশরী
ডান হাত ধরে ওকে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করে দেব।
সতীশ
তার পরে বাঁ হাত দিয়ে প্রাইজ দেবার প্ল্যান আছে না কি?
বাঁশরী
দিলে পরের ছেলের প্রতি নিষ্ঠুরতা করা হবে।
সতীশ
ঘরের ছেলের প্রতিও। এ দিকে ও মহলের হাল খবরটা শুনেছ?
বাঁশরী
ও মহলের খবর এ মহলে এসে পৌছয় না। হাওয়া বইছে উল্টো দিকে।
সতীশ
কথা ছিল সুষমার বিয়ে হবে মাসখানেক বাদে, সম্প্রতি স্থির হয়েছে আসছে হপ্তায়।
বাঁশরী
সতীশ
ওদের হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠেছে দ্রুতবেগে, হঠাৎ দেখেছে তোমাকে রণরঙ্গিণী বেশে। তোমার তীর ছোটার আগেই ছুটে বেরিয়ে পড়তে চায়— এইরকম আন্দাজ।
বাঁশরী
আমার তীর! আধমরা প্রাণীকে আমি ছুঁই নে। বনমালী, মোটর ডাকো।
বাঁশরীর প্রস্থান। শৈলর প্রবেশ: বয়স বাইশ কিন্তু দেখে মনে হয় যোললা থেকে আঠারোর মধ্যে; তনু দেহ শ্যামবর্ণ, চোখের ভাব স্নিগ্ধ, মুখের ভাব মমতায় ভরা।
সতীশ
কী আশ্চর্য! ভোরের স্বপ্নে আজ তোমাকেই দেখেছি, শৈল। তুমিও আমাকে দেখেছ নিশ্চয়।
শৈল
না, দেখি নি তো।
সতীশ
আঃ, বানিয়ে বলল-না কেন। বড়ো নিষ্ঠুর তুমি। আমার দিনটা মধুর হয়ে উঠত তা হলে।
শৈল
তোমাদের ফরমাশে নিজেকে স্বপ্ন করে বানাতে হবে। আমরা যা শুধু তাই নিয়ে তোমাদের মন খুশি হয় না কেন?
সতীশ
খুব হয়, এই যে সাক্ষাৎ এসেছ এর চেয়ে আর কিসের দরকার?
শৈল
আমি এসেছি বাঁশরীর কাছে।
সতীশ
ঐ দেখো, আবার একটা সত্য কথা। সদ্য বিছানা থেকে উঠেই দু-দুটো খাঁটি সত্য কথা সহ্য করি এত মনের জোর নেই। ধর্মরাজ মাপ করতেন তোমাকে, যদি বলতে আমারই জন্য এসেছ।
শৈল
ব্যারিস্টার মানুষ, তুমি বড্ড লিটরল্। বাঁশরীর কাছে আসতে চেয়েছি বলে তোমার কাছে আসবার কথা মনে ছিল না এটা ধরে নিলে কেন?
সতীশ
খোঁটা দেবার জন্যে। বাঁশির সঙ্গে কথা আছে কিছু? আমাদের লগ্ন স্থির করবার পরামর্শ?
শৈল
না, কোনো কথা নেই। ওর জন্য বড় মন খারাপ হয়ে থাকে। মনের মধ্যে মরণবাণ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে অথচ কবুল করবার মেয়ে নয়। ওর ব্যথায় হাত বুলোতে গেলে ফোঁস্ করে ওঠে, সেটা যেন সাপের মাথার মণি। তাই সময় পেলে কাছে এসে বসি, যা-তা বকে যাই। পশু দিন সকালে এসেছিলুম ওর ঘরে। পায়ের শব্দ পায় নি। ওর সামনে এক বাণ্ডিল চিঠি। ডেস্কে ঝুঁকে পড়ছিল বসে, বেশ বুঝতে পারলুম চোখ দিয়ে জল পড়ছে। যদি জানত আমি দেখতে পেয়েছি তা হলে একটা কাণ্ড রাধত। বোধ হয় আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যেত। আস্তে আস্তে চলে গেলুম। কিন্তু সেই ছবি আমি ভুলতে পারি নে। বাঁশি গেল কোথায়?
খানসামা চায়ের সরঞ্জাম রেখে গেল।
সতীশ
বাঁশি এইমাত্র বেরিয়ে গেছে, ভাগ্যিস্ গেছে।
শৈল
ভারি স্বার্থপর তুমি।
সতীশ
অত্যন্ত। ও কী, উঠছ কেন? চা তৈরি শুরু করে।
শৈল
সতীশ
তা হোক-না, আমি তো খাই নি। বসে খাওয়াও আমাকে। কবিরাজী মতে একলা চা খাওয়া নিষেধ, ওতে বায়ু প্রকুপিত হয়ে ওঠে।
শৈল
মিথ্যে আব্দার কর কেন?
সতীশ
সুযোগ পেলেই করি, তোমার মতো খাঁটি সত্য আমার ধাতে নেই। ঢালো চা, ও কী করলে, চায়ে আমি চিনি দিই নে তুমি জান।
শৈল
ভুলে গিয়েছিলুম।
সতীশ
আমি হলে কখনো ভুলতুম না।
শৈল
আমাকে স্বপ্ন দেখে অবধি তোমার মেজাজের তো কোনো উন্নতি হয় নি। ঝগড়া করছ কেন?
সতীশ
শৈল
আচ্ছা থামো, তোমার চা খাওয়া হল?
সতীশ
হলেই যদি ওঠ তা হলে হয় নি।
ভৃত্যের প্রবেশ
ভৃত্য
হরিশবাবু দলিলপত্র নিয়ে এসেছেন।
সতীশ
বলো ফুরসত নেই।
ভৃত্যের প্রস্থান
শৈল
ও কী ও, কাজ কামাই কববে?
সতীশ
করব, আমার খুশি।
শৈল
আমি যে দায়ী হব।
সতীশ
তাতে সন্দেহ নেই, বিনা কারণে কেউ কাজ কামাই করে না।
নেপথ্য থেকে
সতীশ
ঐ রে! এল ওরা! বাড়িতে নেই বাবার সময় দিলে না।
সুধাংশুর সঙ্গে একদল লোকের প্রবেশ
অলক্ষুণের দল, সকালবেলায় মুখ দেখলুম, উননের উপর হাঁড়ির তলা যাবে ফেটে।
সুধাংশু
মিস্ শৈল, ভীরু তোমার আশ্রয় নিয়েছে কিন্তু আজ ছাড়ছি নে!
সতীশ
ভয় দেখাও কেন? চাও কী?
শচীন
চাই লক্ষ্মীছাড়া ক্লাবের চাঁদা। প্রথম দিন থেকেই বাকি।
সতীশ
কী! আমি তোমাদের দলে! ভিগরস্ প্রোটেস্ট্ জানাচ্ছি, বলবান অস্বীকৃতি।
নরেন
দলিল দেখাও।
সতীশ
সুধাংশু
শৈলদেবী, এই বুঝি! বে-আইনী প্রশ্রয় দেন পলাতকাকে।
শৈল
কিছু প্রশ্রয় দিই নে, নিন-না আপনাদের দাবি আদায় করে।
সতীশ
শৈল, যত তোমার সত্য আমার বেলায়, আর এদের সামনে সত্যের অপলাপ। প্রশ্রয় দেও না বলতে চাও!
শৈল
কী প্রশ্রয় দিয়েছি?
সতীশ
এইমাত্র মাথার দিব্যি দিয়ে আমাকে চা খাওয়াতে বস নি? শ্রীহস্তে অজীর্ণরোগেব পত্তন আরম্ভ, তবু আমাকে বলে লক্ষ্মীছাড়া!
শচীন।
সতীশ
আচ্ছা তবে বলি শোনো। চাঁদা পাবা মাত্র যদি পাড়া ছেড়ে দৌড় মার, তা হলে এখনি বাকি বকেয়া সব। শোধ করে দিই।
শচীন
শুধু চাঁদা নয়। আমাদের ঘরে নেই চা ঢেলে দেবার লোক, যাদের ঘরে আছে সেখানে পালা করে চা খেতে বেরোই, তার পরে কিছু ভিক্ষে নিয়ে যাই আজ এসেছি বাঁশরী দেবীর করকমল লক্ষ্য করে।
সতীশ।
সৌভাগ্যক্রমে সেই দেবী তার করকমলসুদ্ধ অনুপস্থিত। অতএব ঘড়ি ধরে ঠিক পাঁচ মিনিটের নোটিশ দিচ্ছি, বেরোও তোমরা-ভাগো।
শৈল
আহা, ও কী কথা! না খেয়ে যাবেন কেন? আমি বুঝি পারি নে খাওয়াতে? একটু বসুন, সব ঠিক করে দিচ্ছি।
শৈলের প্রস্থান
সতীশ
সুধাংশু
কিংখাবের দোকানে আমাদের সমবেত দেনা আছে, আজ সমবেত চেষ্টায় শোধ করতে হবে।
সতীশ
কিংখাব! ভাবী লক্ষ্মীর আসন-রচনা?
শচীন
ঠিক তাই।
সতীশ
আশ্চর্য দূরদর্শিতা-
শচীন
না হে, অদূরদর্শিতা প্রমাণ করে দেব অবিলম্বে।
শৈলের প্রবেশ
শৈল
সব প্রস্তুত, আসুন আপনারা।