বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড)/২৯

উইকিসংকলন থেকে

সংযোজন

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৯। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর তৎপরতার আরও বিবরণ ‘দৈনিক বাংলা’
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭২
১৯৭১

ছোট ছোট বিমান দিয়েও প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল বাংলাদেশের বৈমানিকরা
ক্যাপ্টেন আবদুস সাত্তার

 মে মাসের মাঝামাঝি আমি আগরতলায় মিলিত হই মরহুম ক্যাপ্টেন খালেক, বর্তমান বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন ও ক্যাপ্টেন সরফুদিনের সাথে। ক্যাপ্টেন খালেক ছিলেন পিআইএ’র ট্রাইডেণ্ট বিমানের একজন কমাণ্ডার। পিআইএতে বাঙ্গালীদের অভাবঅভিযোগের একজন প্রবক্তা হিসাবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন।

 অল্প কয়েকদিনের মধ্যে মধ্যে আগরতলায় আমাদের দলে যোগ দিলেন ক্যাপ্টেন মুকিত। ক্যাপ্টেন মুকিত আদিতে ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলট। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে তিনি বিমান বাহিনী ছেড়ে পিআইএতে যোগদান করেন। মুকিতের যোগদানের ফলে আমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। তখন থেকে আমাদের একমাত্র ধ্যান-ধারণা ও প্রচেষ্টা ছিল কেমন করে একটা ছোট বিমান বাহিনী গড়ে তোলা যায়।

 জুলাই মাসের দিকে পাকিস্তান বৃক্ষ বিভাগের পাইলট আকরাম আহমেদ ও ঢাকা ফ্লাইং ক্লাবের সদস্য আহমেদুল আমিন আমাদের সাথে মিলিত হন। আকরাম আহমেদ ও আহমেদুল আমিনের আগরতলা গমনের ২/৩ দিনের মধ্যেই ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন ও আমাকে ভারতীয় বৈদেশিক দফতর দিল্লীতে ডেকে পাঠালেন। দিল্লীতে আমদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ছিল ভারতীয় বিমান বাহিনীর ও বৈদেশিক দফতরের উচ্চপদস্থ অফিসারদের অনুধাবন করানো যে ছোট ছোট দিয়েও কার্যকরী একটা বিমান বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব। বিমান বাহিনী প্রসঙ্গে আমাদের আরও পরিকল্পনা ছিল- ছোট ছোট বিমানে ফ্লোটিংর ডিভাইস সংযোজন করে শত্রুসৈন্যদের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা ও তাদের শক্ত ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আঘাত সজ্জিত ছোট বিমানে ভূমিতেই অবস্থানরত ১১ খানা নাইজেরীয় মিগ-১৯ বিমান ধ্বংস করার ঘটনা দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করলাম। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরে দিল্লীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা আমাদের সাথে একমত হলেন এবং তারা মুজিবনগরস্থ বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার কমোডর আবদুল করিম খোন্দকারের সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ স্থাপন করলেন। পরবর্তী পর্যায়ে এয়ার কমোডর খোন্দকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও নেতৃত্বে জন্মলাভ করল বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ তারিখে নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে আমরা বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের জন্মদিবস পালন করি।

 বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে তখন এর প্রতিষ্ঠাতা এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার ছাড়া আরও কয়েকজন বৈমানিক ছিলেন- মরহুম ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন সাত্তার (লেখক), ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন, ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন সরফুদ্দিন। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ছেড়ে যারা এসেছিলেন বদরুল আলম। আরও ছিলেন পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগকারী ৬৭ জন এয়ারম্যান। আমাদের বিমান ছিল ডাকোটা আটার ও এলুভেট হেলিকপ্টার।

 ডাকোটা বিমানকে পাঁচ হাজার পাউণ্ড বোমা বহন করার উপযোগী করা হলো এবং পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হলো ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন মুকিত ও আমাকে। অটার বিমানকে সজ্জিত করা হলো সর্বধুনিক রকেট, মেশিনগান ও বোমাবর্ষণের উপযোগী করে।

 পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হলো ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরাম ও মরহুম সরফুদ্দিন। হেলিকপ্টারকে সজ্জিত করা হলো রকেট ও ভারী মেশিনগান দ্বারা। পরিচালনার জন্য নির্বাচিত করা হলো স্কোঃ লিঃ সুলতান মাহমুদ, ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম এবং ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনকে।

 অতঃপর অক্টোবর মাসের প্রথম তারিখ থেকে এয়ার কমোডর খোন্দকার সাহেবের নেতৃত্বে আমাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও মহড়া শুরু হলো। নাগাল্যাণ্ড, মনিপুর, অরুনাচল, ত্রিপুরা ও আসামের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ী এলাকার কোন প্রকার পথ নির্ধারক ব্যতিরেকে শুধু কম্পাসের উপর নির্ভর করে রাত্রির পর রাত্রি আমরা অত্যন্ত নীচু দিয়ে উড্ডয়নের কৌশল আয়ত্ত করার অনুশীলন করতাম। শত্রুর রাডারকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন হয় অত্যন্ত নিচু দিয়ে বিমান চালনা করা এবং সত্যিকারের অভিযানকালে যাতে শত্রুর দৃষ্টিগোচর না হতে হয় সেজন্য প্রয়োজন ছিল রাত্রিতে সঠিক পথে বিমান চালনার অভ্যাস করা। রাত্রিবেলায় নীচু দিয়ে বিমান চালনা এবং প্রদীপবিহীন রানওয়েতে বিমান অবতরণের প্রক্রিয়া আয়ত্ত করার চেষ্টা ছাড়াও বিমান আক্রমণের অন্যান্য পদ্ধতিরও আমরা নিয়মিত অভ্যাস করতাম। এয়ার কমোডর খন্দকার সাহেবের তত্ত্বাবধানে আমাদের অনুশীলন যে কত নিখুঁত ভাবে পরিচালিত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে বিমান আক্রমণে আমাদের দারুণ সফলতার মধ্য দিয়ে। পরিকল্পনা মাফিক ঠিকমত আক্রমণ পরিচালনা করতে পারলে ছোট ছোট বিমানও যে অত্যাধুনিক জঙ্গী বিমানের সমকক্ষ হতে পারে তা আমাদের বৈমানিকগণ দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমাদের বৈমানিকদের দক্ষতা দেখে ভারতীয় বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসাররা বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছেন।

 আমাদের দক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্তঃ ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাত্রিতে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ ও ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানী বিমান জ্বালানী ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ফ্লাঃ লেঃ শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম আহমদ ঐ একই সময়ে চট্টগ্রামে এক ব্যাপক বিমান আক্রমণ পরিচালনা করেন। চট্টগ্রামের অভিযানের পরে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আকরাম মরহুম সরফুদ্দিনকে নিয়ে ১২ বারেরও বেশী বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাক দুশমনদের শক্ত ঘাঁটি ও কনভয়ের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে তাদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। আমার মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে ডাকোটা, অটার ও হেলিকপ্টার এই তিন গ্রুপের মধ্যে শুধু একটি বিষয়েই প্রতিযোগিতার মনোভাব ছিল, তাহলো কোন গ্রুপ কত বেশী বিপজ্জনক অভিযানের দায়িত্ব লাভ করতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করবো। ডাকোটা বিমান নিয়ে বাংলাদেশের একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বোমাবর্ষণের জন্য একটি দিন স্থির করা হয়। অভিযানটি ছিল ভয়ানক বিপদসংকুল। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনের মাত্র একদিন পূর্বে যখন বিশেষ কারণে এই অভিযান পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল তখন ক্যাপ্টেন খালেক ও ক্যাপ্টেন মুর্কিত অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে যান।

 বিমান আক্রমণ পরিচালনাকালে আমাদের বৈমানিকগণকে অনেকবার মারত্মক বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। যেমন ৭ই ডিসেম্বর পরিকল্পনা অনুযায়ী সিলেট শহর শত্রুমুক্ত হয়েছে কিনা জানার জন্য ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন হেলিকপ্টারযোগে সিলেট বিমান বন্দরে অবতরণ করতে যান। সিলেট শহর তখনও শত্রুমুক্ত হয়নি। তাই অবতরণকালে হেলিকপ্টারটি আক্রান্ত হয়। মেশিনগানের বেশ কয়েক রাউণ্ড গুলি হেলিকপ্টারটিকে বিদ্ধ করে কিন্তু ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন সফলতার সাথে কৈলাশহর বিমান ঘাঁটিতে ফিরে যান। আবার ১০ই ডিসেম্বর সিলেটের অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শনকালে ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনের হেলিকপ্টারের টেইল রোটার ভূমি থেকে নিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে ভারসাম্য যদিও ব্যস্ত হচ্ছিল তবু এবারেও ক্যাপ্টেন শাহবুদ্দিন আশ্চর্য পারদর্শিতার সাথে ঘাঁটিতে ফিরে গিয়ে নিরাপদে অবতরণ করেন।  আর একদিনের ঘটনা ফ্লাঃ লেঃ বদরুল আলম ও ক্যাপ্টেন শাহবুদ্দিন কুমিল্লা এলাকায় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীকে এয়ার সাপোর্ট দিতে থাকাকালে তাদের হেলিকপ্টারের জ্বালানী ফুরিয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তারা কুমিল্লা বিমান বন্দরে জরুরী অবতরণ করেন। ময়নামতি ক্যাণ্টনমেণ্ট তখনও শত্রুকবলিত। সেখান থেকে শত্রু হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে মর্টার ও ভারী কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এত বিপদের মাঝেও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় বদরুল আলম এবং শাহাবুদ্দিন বিমানের জ্বালানী সংগ্রহ করে নিরাপদে ফিরে আসেন। এমনি আরো বহুতর বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল আমাদের এই ছোট্ট এয়ার ফোর্সের প্রত্যেকটি বৈমানিককে কিন্তু তাই বলে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য নিবেদিতপ্রাণ এই সকল বৈমানিকের কেউই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হননি।