বিষয়বস্তুতে চলুন

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)/১১১

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নঃ ভারত সরকারের এত দ্বিধা, এত ভয় কেন? বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় লিখিত নিবন্ধ দৈনিক যুগান্তর ২৩ এপ্রিল, ১৯৭১

ভারত সরকারের এত দ্বিধা, এত ভয় কেন?

-বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়

 আমাদের চোখের সামনে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এক আশ্চার্য নাকট অভিনীত হইতেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ধাপ্পাবাজী, শঠতা এবং গণতন্ত্র হত্যার বর্বরতার অবসান হইতে চলিয়াছে। জাতি-বিদ্বেষ ও সম্প্রদায় বিদ্বেষে অন্ধ রাওয়ালপিণ্ডি যে শয়তানি চক্র একদিকে ভারতবর্ষ এবং অন্যদিকে বাঙালির জাতীয় সত্ত্বা ও স্বাধীনতাকে ধ্বংস করিবার জন্য গত ২৪ বৎসর ধরিয়া নিরন্তর শত্রুতা করিয়া আসিতেছিল, আজ তার প্রতিরোধের পালা শুরু হইয়াছে। আজ ইতিহাসের ঢাকা বিপরীত দিকে ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ঘাত প্রতিঘাত সম্পর্কে যারা অজ্ঞ, উদাসীন একমাত্র তারা ছাড়া আর সকলেই উপলদ্ধি করিতেছেন যে, দক্ষিণ এশিায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের তরঙ্গ শুরু হইয়াছে, আসন্ন দিনগুলিতে সেই তরঙ্গ উত্তাল হইয়া সমগ্র মহাদেশে নতুন প্লাবন ডাকিয়া আনিবে। গত ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরের আম্রকুঞ্জে এক অনাড়ম্বর উৎসবের মধ্যে স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রী বাংলা রাষ্ট্রের যে উদ্বোধন অনুষ্ঠিত হইয়াছে, সংশয়বাদীরা তাকে তাচ্ছিল্য করিতে পারেন, অতি বুদ্ধিমানেরা তাকে উপহাস করিতে পারেন। কিন্তু অগ্নিগর্ভ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে তাকাইয়া আমরা বলিতে পারি যে, রাষ্ট্র স্বাধীনতার যে বীজ মুজিবনগরে উপ্ত হইয়াছে, আজ থেকে কাল থেকে পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে কিম্বা তার আগেই সে বিরাট মহীরুহে পরিণত হইবে। কামান, বন্দুক, ট্যাঙ্ক, বোমারুর দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জয়যাত্রাকে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী হানাদারেরা ঠেকাইয়া রাখিতে পারিবে না। কারণ যে স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মলাভ করিতেছে সাত কোটি বাঙালি তাকে বুকের রক্ত দিয়া রক্ষা করিবে। জননীর মমতা এবং জনকের শক্তি দিয়া এই নবজাতকে জীবনের পথে অগ্রসর করিয়া দেওয়া হইবে। এই বিষয়ে কাহারও সন্দেহ ও সংশয় থাকা উচিত নয়। এই পুরানো পৃথিবী ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে এই সেই ধ্বংস, হত্যাকাণ্ড ও রক্ত হইতে নতুন পৃথিবী জন্মলাভ করিতেছে। ভুট্টো-ইয়াহিয়া খান এবং ধনিক-বণিক-সামরিক চক্র অবশ্যই ক্ষেপা কুকুরের মতো যত্রতত্র কামড় বসাইবে, কিন্তু ইতিহাস এই ক্ষিপ্ত জানোয়ার আগাইয়া যাইবে।

 বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র পল্লীর এক নিভৃত ভূমিতে জন্মলাভ করিয়াছে। গ্রামময় বাংলাদেশের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। নিভৃত পল্লীর এই দীপশিখা ইতোমধ্যেই জ্বলন্ত মশালের রূপ ধারণ করিতে চলিয়াছে। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলার রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিসভা এবং সশস্ত্র বাহিনী নতুন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করিয়াছেন। দেশ-বিদেশে এই বার্তা সংবাদপত্র ও রেডিও মারফৎ ছড়াইয়া পড়িয়াছে। সর্বত্র নিদারুণ ঔৎসুক্য ও উত্তেজনা। এই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম বিদেশী দূতাবাস ভারতবর্ষ-এই কলিকাতায় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। গত ১৮ই এপ্রিল কলিকাতায় পাক-ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামাইয়া ফেলা হইয়াছে এবং স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের নতুন জাতীয় পতাকা উড্ডীন হইয়াছে। ডেপুটি হাইকমিশনার জনাব হোসেন আলী এবং তার সহকর্মী বাঙালি অফিসারবৃন্দ নতুন বাংলা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করিয়াছেন। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা সরকারের কূটনৈতিক প্রধানরূপে জনাব হোসেন আলী তাঁর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের কথা ঘোষণা করিয়াছেন। ইতিপূর্বেই নয়াদিল্লীর পাকিস্তানী হাইকমিশন থেকে দুইজন বিশিষ্ট বাঙালি কুটনীতিক পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া ভারতবর্ষে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছেন এবং নতুন বাংলা রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করিয়াছেন। পাকিস্তানের অন্যান্য বাঙালি অফিসার এবং কর্মীরা, নাবিক ও লস্কররাও একে একে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিতেছেন। ওদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ সার্বভৌম অধিকার সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে এক নূতন রাষ্ট্রিক ঐক্যের মধ্যে সংহত করিতে চলিয়াছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধিবাসীর অন্ততঃ শতকরা ৯৫ জন এই নূতন রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। তারা পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীকে এবং তার নৃশংস নরঘাতী শাসনকে অপরিসীম ঘৃণায় উপক্ষো ও অগ্রাহ্য করিয়াছেন। অর্থাৎ এতটি সংহত স্বাধীন নতুন রাষ্ট্রের রূপরেখা বাস্তব মূর্তি ধারণ করিয়াছে।

 উপরে পর পর এই নাটকীয় ঘটনাবলীর কথা আমরা উল্লেখ করিলাম এই জন্য যে, একটি নতুন সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে, যে অবস্থার উদ্ভব প্রয়োজন, সীমান্তের গুলি দেখা গিয়াছে। সুতরাং ভারত সরকার কেন অবিলম্বে এই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতেছে না, এটাই আমাদের সবচেয়ে জরুরী জিজ্ঞাস্য। নয়াদিল্লীর কর্তারা কি এখনও তীরে দাঁড়াইয়া আরব সাগরের ঢেউ গুনিবেন? বাংলাদেশে যখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে খুন করা হইতেছে, নারী-শিশু-বৃদ্ধ এবং বুদ্ধিজীবী নির্বিশেষে পাইকারি নরঘাতন পর্ব চলিতেছে এবং মুক্তিফৌজ যখন অমিত বিক্রম সত্ত্বেও শহরে শহরে মারণাস্ত্র সজ্জিত মডার্ন আর্মকে ঠেকাইয়া রাখিতে পারিতেছেন না, তখন যদি ভারত সরকার কেবল দ্বিধা দ্বন্ধ এবং সংকোচ ও ভয় নিয়া কালহরণ করিতে থাকেন, তবে সীমান্তের বিপদ আরও ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিবে। ভারত সরকার এবং বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেন মনে রাখেন যদি বাংলাদেশ এই জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে চূড়ান্ত পরাজয় মানিয়া লইতে বাধ্য হয়, তবে আগামী একশ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর কোনদিন মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিবে না। সেখানে সমস্ত গণতন্ত্রবাদী অসাম্প্রদায়িক মানুষের এবং বিশেষভাবে মাইনরিটিরা একেবারে শেষ হইয়া যাইবে এবং তারপর পকিস্তান ও চীন একজোট হইয়া ভারতবর্ষের ঘাড় মটকাইবার চেষ্টা করিবে-যে চেষ্টা চলিতেছে গত এক যুগ ধরিয়া। এই নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিভাবে উপেক্ষা করিতে পারেন এবং কিভাবেই বা ভুলিয়া যাইতে পারেন যে, গত ১৯৪৬ সাল হইতে যে ভায়বহ সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব চলিতেছে, যার ফলে ভারতবর্ষকে কাটিয়া দুই টুকরা করিতে হইল এবং তারপর থেকে ২৪/২৫ বছর ধরিয়া আমরা নিরন্তর যে যন্ত্রণায় ভুগিতেছি, আজ সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তানী যন্ত্রণা ও বর্বরতার পাল্টা লইতেছেপ্রায় নিরস্ত্র, একক প্রতিরোধ শক্তির দ্বারা। আর আমরা কি এই পাকিস্তানী উৎপাত ও শয়তানীকে বধ করিবার জন্য বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজের প্রতি হাত বাড়াইয়া দিব না-সেই শক্ত হাতে কি আমরা কামান, বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্র তুলিয়া দিব না? কিসের ভয়, কিসের দ্বিধা, কিসের এত সংকোচ? আজ যদি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারত সরকার নূতন বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেন, তবে আগামীকাল সোভিয়েট রাশিয়া অগ্রসর হইয়া আসিবে কিন্তু ভারত সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কি আশা করেন যে, আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব আমরা পালন করিব না কিন্তু আশা করিব যে সোভিয়েট রাশিয়া ও আমেরিকা আসিয়া আমাদের উদ্ধার করিবে? যে সাহসী, যে বীর তাকেই পৃথিবীর লোকে সম্মান করে। আজ আন্তর্জাতিক জগতে ভারতবর্ষের চেহারা নিষ্প্রভ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু ভারত সরকার যদি বাংলাদেশের পাশে আজ সাহসের সঙ্গে দণ্ডায়মান হন তবে সেই শক্তিমান ও সাহসী ভারতবর্ষকে পৃথিবীর লোকে আবার সম্মান করিবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার সরণ সিং যেন মনে রাখেন তার এই দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির গোজালি কোথাও শ্রদ্ধা উদ্রেক করিতেছে না। আজ যদি তিনি ও তার দপ্তর বাংলাদেশের সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেন তবে কালই আফ্রো-এশীয় দেশগুলিতে ভারতবর্ষ সম্পর্কে নতুন মমত্ববোধ শুরু হইবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র পরিস্থিতি সহানভূতির সঙ্গে বিবেচনা করিবে। আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী বগজীবন রামের উদ্দেশ্যে বলিতেছি-পার্টিশনের পর থেকেই ভারতবর্ষ দুই ফ্রণ্টের বেকায়দায় পড়িয়াছে। একদিকে পাকিস্তানী এবং অন্যদিকে চৈনিক আক্রমণের আশঙ্কা (তাঁরা নিজেরাই মাঝে মাঝে এজন্য হাঁক-ডাক ছাড়িতেছেন)-এই দুই ফ্রণ্টের বিপদ কাটিয়া যাইবে যদি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। পাকিস্তান ও চীনের একত্র যোগসাজশে ভারতবর্ষের উপর বিষম চাপ সৃষ্টি হইতেছে এবং হাজার কোটি টাকা মিলিটারি বাবদ ব্যয় হইতেছে। এই নুইসেন্স এবং এই সামরিক বিপদ হইতে উদ্ধার পাওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় স্বাধীন বাংলাদেশের নিজের পায়ে দাঁড়াইতে সাহায্য দেওয়া-যে সাহায্য কূটনৈতিক এবং সামরিক উভয় প্রকার।

 সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরণ সিং এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের উদ্দেশ্যে জনসাধারণের পক্ষ থেকে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার নামে যে গণতন্ত্র স্বাধীনতাকে বর্বরেরা আজ নির্মমভাবে হত্যা করিতেছে আমরা আবেদন জানাইতেছি অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দল, সমস্ত আইনসভা এবং সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সমস্বরে ওই দাবি উত্থাপন করিতেছেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নামে ভারতীয় জনতার নিকট শপথ গ্রহণ করিয়াছেন এবং ভারতীয় জনতা তাহাকে বিশ্বাস করিয়া নির্বাচনে জয়মাল্য অর্পণ করিয়াছেন। ইন্দিরাজী কি সেই শপথ পালন করিবেন না? তিনি যেন মনে রাখেন রাষ্ট্রচালনা ও রক্ষা করতে হইলে কূটনৈতিক বুদ্ধি ও চাতুর্থ যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সাহসের এবং কঠিন সংকল্পের। সেই কূটনৈতিক বুদ্ধি ও সাহস মুহূর্ত আজ উপস্থিত। এক শতাব্দীর মধ্যেও এমন সুযোগ আর আসিবে না- রাওয়ালপিণ্ডির ফ্যাসিস্ট দুশমনদিগকে ঘায়েল করিতে হইবে। শত্রুর শেষ রাখিতে নাই, প্রাচীন কূটনৈতিক মন্ত্রী মহোদয় যেন এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে ভুলিয়া না যান। সুতরাং ভীতি ও সংকোচ তারা কাটাইয়া উঠেন।

 নয়াদিল্লী প্রভুদের উদ্দেশ্যে আর একটি কথাও সবিনয়ে নিবেদন করিতে পারি। চীন ইয়াহিয়া খানের পক্ষ হইয়া যত তর্জন-গর্জনই করুক না কেন শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতির স্বাধীনতাকে হাতে-কলমে দমন করিবার জন্য তারা হিমালয় পার হইয়া সমতল ভূমিতে নামিয়া অস্ত্র ধারণ করিবে না।