বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)/১৫৭

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশের সংগ্রামকে সহয়তা করার জন্য ‘সর্ব আসাম বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি'র আহবান পুস্তিকা জুলাই, ১৯৭১

বংলাদেশের সংগ্রামকে সহায়তা করুন
সর্ব আসাম বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি

সভাপতি শ্রী শরৎ সিংহ
উপ-সভাপতি ডঃ ঘনশ্যাম দাস

-শ্রী ফনী বরা

সাধারন সম্পাদক-

শ্রী ধীরেশ্বর কলিতা
শ্রী বিশ্ব গোস্বামী
শ্রী দেবেন্দ শর্মা

শ্রী বিশ্ব গোস্বামী কর্তৃক প্রকাশিত
প্রথম প্রকাশ জুলাই, ১৯৭১
বাংলাদেশের সংগ্রামকে সহায়তা করুন
সর্ব আসাম বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির আহবান

 সামরিক শাসকের অত্যাচার এবং ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ বিদ্রোহ করেছে। সারা বিশ্বের প্রগতিশীল জনগণ বাংলাদেশের জনগনের সহায়তার জন্য সহানুভূতির সাথে এগিয়ে এসেছে। ভারত সরকার সকল রাজনৈতিক দল এবং ভারতের জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে কিন্তু এই সহায়তা ও সহানুভূতি যথেষ্ট হয়নি।

 বাংলাদেশের পরিস্থিতি লাখ লাখ উদ্বাস্তুকে দেশত্যাগ করে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, পশ্চিম বঙ্গসহ সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। উদ্বাস্তুর স্রোত আমাদের রাজ্য আসামকেও নাড়া দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিন্দু এবং মুসলমান উভয়ই বর্তমান পরিস্তিতিতে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশের জনগণকে এ ব্যাপারে সজাগ ও সচেতন হবে। তদুপরি আরো কিছু মানুষ রয়েছে যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তাৎপর্য এবং তার বিজয়ের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারছে না।

 এই আলোকেই আমরা এই পুস্তিকার দ্বারা আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন এবং তার বিজয়ের সাথে উদ্বাস্তুসহ আমাদের দেশের সমস্যা কি ভাবে জড়িত তা ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছি।

 আমরা আশা করবো যে এই পুস্তিকা বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে আমাদের দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবে বিভেদ সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িক আর বিদেশী শত্রুকে উৎখাত করতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ

 উনিশশ একাত্তর সনের ২৫ শে মার্চ বাংলাদেশের জনগণের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী অমানুষিক গণহত্যা অভিযান শুরু করে। এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের সকল জনবসতি, স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাস, অধ্যাপক, শিক্ষক, উকিল এবং ডাক্তারগনসহ বুদ্ধিজীবীরা। লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়েছে গৃহহারা, অত্যাচারের মুখে এক বিশাল জনস্রোত প্রবেশ করেছে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং পশ্চিম বঙ্গে।

 সভ্যতার ইতিহাসে এই অত্যাচারের তুলনা নেই। চেংগিসখান আর হিচলারের বীভৎস হত্যাকাণ্ড ও ইয়াহিয়ার কাছে ম্লান হয়ে গেছে। এই বর্বরতার উদ্দেশ্য হলো পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে চিরকালের জন্য উৎখাত করা। হিন্দু মুসলমান সকল সম্প্রদায়ের ছাত্র যুবক বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ণাঙ্গ উপনিবেশে পরিণত করাই ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য। পশ্চিম পাকিস্তানী জমিদার সামরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সামন্তবিরোধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে ধবংস করতে পারলে পাকিস্তানের বালুচি সিন্ধি আর পাখতুনদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করাও সহজ হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া চক্র অসাধ্য সাধনের চেষ্টা করছে, ইতিহাসের চাকাকে পেছনে ঘোরানো যায় না। পাকিস্তানী শাষক গোষ্ঠীর চব্বিশ বছরের অনুসৃত নীতির ঐতিহাসিক পরিণতিই বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তি সংগ্রাম। পাকিস্তানের ধ্বংসের বর্তমান পর্যায়ের জন্য দায়ী ইয়াহিয়া চক্র এবং তার সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী মিত্ররা। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার স্বীকার না করে পাকিস্তান রক্ষা করা সম্ভব নয়।

মুক্তিযুদ্ধ সকলের সংগ্রাম

 পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর এই অকথ্য অত্যাচারের মুখে বাংলাদেশের জনগণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। প্রথম অবস্থা ইস্ট বেঙ্গল রাইফেল, বেঙ্গল রেজিমেণ্ট আর পুলিশ বাহিনী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করে। বর্তমানে হাজার যুবক মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করে ইতিমধ্যেই যুদ্ধ নেমে গেছে। তাদের পেছনে আছে ব্যাপক জনগণের সমর্থন। পাকিস্তানী বাহিনী জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ভিয়েতনামে মার্কিনী এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারী সৈন্যদের মতো তাদের অবস্থা মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যেই গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে রাজধানী ঢাকার ওপর আঘাত হানা শুরু করেছে। তারা এখনো চূড়ান্ত আঘাত হানতে পারেনি এই জন্য যে মুক্তিবাহিনীর সেনারা নতুন এবং অনভিজ্ঞ, অন্যদিকে পাকিস্তানী বাহিনী আমেরিকা ও চীনের সাহায্যপুষ্ট এবং আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত। কিন্তু জনগণের সক্রিয় সমর্থনে মুক্তিবাহিনী যে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সুফল

 বাংলাদেশের জনগন আজ আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত এক পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্য সম্ভব হয়েছে এ জন্য যে আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলসমূহ পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর হীন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে হিন্দু মুসলীম অসাম্প্রদায়িক ঐক্য গড়ে তুলতে পেরেছে। এই সংগ্রামী ঐক্য ফাটল ধারানোর জন্য ইয়াহিয়া চক্র মুসলীম লীগ ও জামাত-ই-ইসলামীসহ সাম্প্রদায়িক দলসমূহকে দিয়ে প্রচষ্টা ব্যর্থ হয়েছে সে জন্য ইয়াহিয়া খান নতুন করে দালাল সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতকে উস্কানি দিয়ে পৃথিবীর জনমতকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সীমান্তের সংঘর্ষ সৃষ্টি করছে।

 এই পরিস্তিতিতে আমাদের ওপর গুরুদায়িত্ব এসে পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার ও শোষণের কবল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণও গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার ও শোষণের কবল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের দেশের জনগণও গণতন্ত্র রক্ষা এবং শোষনহীন সমাজের জন্যে সংগ্রাম করে আসছে। তাই বাংলাদেশের সংগ্রাম সফল হলে তা আমাদেরও সহায়তা করবে। মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক আর প্রতিক্রিয়ার শক্তি পরাজিত হবে, গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ফলে আমাদের দেশেও সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়ার শক্তি দুর্বল হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংগ্রাম পরাজিত হলে উভয় দেশেই সাম্প্রদায়িক আর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং ফলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিপন্ন হবে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের অলীক কল্পনা চিরকালের জন্য বিলুপ্ত হবে।

 গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের জন্ম হলে ভারতের সাথে উন্নত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে। দুই দেশের মাঝে বাণিজ্যিক প্রসার ঘটবে। দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর ভারতবিরোধী মনোভাবের ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। আগে পূর্ব বঙ্গ থেকে আমদানীর ফলে মাছ ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য আসামে অনেক যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আসাম ও মেঘালয় রাজ্যদ্বয় বিশেষভাবে লাভবান হবে। উদ্বাস্তুরাও সকলে ফিরে যাবে।

 বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম জয়যুক্ত হলে আমেরিকার যুদ্ধজোট আর চীনের চক্রান্ত ব্যর্থ হবে আমাদের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ হবে বন্ধুরাষ্ট্র এবং ফলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি আরো সফল হবে।

উদ্ধাস্তু সমস্যা

 পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর অকথ্য অত্যাচারের মুখে লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। আসাম আর মেঘালয়েই এসেছে কয়েক লক্ষ। এদের মধ্যে শিশু, নারী আর বৃদ্ধের সংখ্যাই বেশী। এই ছিন্নমূল সর্বস্বান্ত মানুষদের আশ্রয় ও সকল প্রকার সহযোগিতা করা আমাদের মানবিক কর্তব্য।

 এই লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু স্থায়ীভাবে থাকলে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে আসাম ও মেঘালয়ের জনগণের মাঝেঝ এমনিতর ধারণা বদ্ধমূল হতে চলেছে। কিন্তু ভারত সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে উদ্বাস্তুদের সাময়িকভাবে রাখা হবে। বাংলাদেশ হলেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। উদ্বাস্তু সমস্যা এক জাতীয় সমস্যা। এ কথা বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম জয়যুক্ত হলেই কেবল তাদের ফেরত পাঠানোর মতো পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

 পরিস্তিতি আমাদের ওপর দুটি দায়িত্ব এনে দিয়েছে। একদিকে উদ্বাস্তুদের রক্ষণাবেক্ষণ ও সাহায্য শুশ্রূষা করা এবং অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র ও সমর্থন যোগানো, যাতে তারা সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারে। ইতিমধ্যেই তারা বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের সক্রিয় সমর্থন পেলে তারা নিশ্চিতভাবেই বিজয়ী হবে। এ জন্যই আমাদের সকলকে এই সংগ্রামের সাফল্যের জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন আমাদের মধ্যে ঐক্য ও শান্তি বজায় রাখা। আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলে ইয়াহিয়া চক্রই লাভবান হবে। তাই সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।

 আমাদের সমর্থন ও সহযেগিতায় বাংলাদেশের সংগ্রামের অগ্রতির সাথে আন্তর্জাতিক সমর্থনও এগিয়ে আসবে। ইতিমধ্যেই প্রগতিশীল বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশের জনগণের সমর্থণে এগিয়ে এসেছে। মার্কিনীরা ইয়াহিয়া চক্রকে সামরিক সাহায্য ও সমর্থন দিয়ে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীকে ইন্ধন যোগাচ্ছে। চীন সরকারও ইয়াহিয়া চক্রকে সমর্থন দিয়ে মুক্তি সংগ্রামের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। কিন্তু আমেরিকা ও চীনের এই চক্রান্ত সত্ত্বেও মুক্তিসংগ্রামের বিজয় সুনিশ্চিত। এই সংগ্রাম পাকিস্তানের ইতিহাসের এক অবধারিত পরিণতি। আর এর জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী পাকিস্তানের শাষকগোষ্ঠী।

 বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সমগ্র এশিয়ার জন্য এক ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এই সংগ্রাম স্বাধীনতা, গণতন্ত্র আর শোষন মুক্তির সংগ্রাম। এর বিজয় সুনিশ্চিত। এই বিজয় যত শীঘ্র হবে ততই আমাদের উভয় দেশের জন্যই মঙ্গল। আসুন, আমরা সকলে এই সংগ্রামকে সফল করার জন্য সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করি।

(অসমীয় ভাষায় প্রকাশিত মূল গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে অনূদিত)