বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)/১৬০

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
‘বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে সবাই একমত, তবু সরকার নীরব কেন? মিঃ সমর গুহ, এম, পির প্রবন্ধ আনন্দবাজার ১২ জুলাই, ১৯৭১

বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে সবাই একমত, তবু সরকার নীরব কেন?

 বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে ভারতের জাতীয় জনমত প্রায় সর্বসম্মতভাবে এক। ভারতের অধিকাংশ বিধানসভা, প্রতিটি বিরোধী দল, উচ্চ সারির আইনজীবী এবং অগণিত জনসভা বাংলাদেশের আশু স্বীকৃতি দাবী করছে। একমাত্র মুসলিম লীগ এবং মজলিস- ই মাসারওয়াত ছাড়া প্রতিটি মুসলিম সংগঠন এবং রাজ্য বিধান সভা ও পার্লামেণ্টের মুসলিম সদস্যরাও এই দাবী সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব নিয়ে সম্প্রতি পার্লামেণ্টে যে বিতর্ক হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস পার্লামেণ্টারি দলে পরপর তিনদিন যে আলোচনা হয়েছে, তাতে সব বক্তাই শুধু যে স্বীকৃতি দাবী করেছেন তাই নয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ও সরকারের কাছে তীব্রভাবে অনেক দাবী জানিয়েছেন। পার্লমেণ্টের দুদিনের বিতর্কে প্রায় প্রতিটি সদস্য আশু স্বীকৃতি দানের প্রস্তাব সমর্থন করেছেন। ফ্রী ভোট হলে প্রস্তাবটি ভোটাধিক্যে গৃহীত হত। অর্থাৎ সারাদেশ এবং রাজনীতিকেরা প্রায় সবাই একমত। শুধু সরকার আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সরকার ও জাতীয় জনমতের এমন পার্থক্য অত্যন্ত অসংগত।

বাংলাদেশ ও বিশ্বজনমত

 বাংলাদেশের উপরে ইয়াহিয়াশাহীর গণহত্যার বর্বর অভিযানের বিরুদ্ধে এবং বাঙ্গালীর স্বাধিকারের সমর্থনে আজ বিশ্বের সংবাদপত্র এবং জনমত সোচ্চার-এমন আন্তর্জাতীয় ঘটনা, যুদ্ধোত্তর বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশী ঘটেনি।

 ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, ভারত ছাড়া বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই বাংরাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজী নয়। কিন্তু শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ ৪৮ দিন ১৮ টি বিদেশী রাষ্ট্র সফর করে বলেছেন যে, ভারত স্বীকৃতি দিলে অবিলম্বে অন্তত বিশ্বের চার-পাঁচটি রাষ্ট্রও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। ভারতের মস্কো মিশন নয়াদিল্লীকে জানিয়েছে, ‘রাশিয়া বাংরাদেশের অস্তিত্ব বাস্তব ঘটনা বলে মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নে ভারতীয় কমুনিস্ট পার্টির সোচ্চার ধবনি শুনেও নিশ্চিন্তে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, রাশিয়া এরূপ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরোধী নয়। বিদেশের বহু রাষ্ট্রবিদ বলেছেন যে, বাংলাদেশকে যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে পথ দেখাতে হবে ভারতকে।

সরকারী আপত্তি কেন?

 নীতিগতভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিরোধী নন ভারত সরকার। তবে ভারত সরকার মনে করেন যে, এখন স্বীকৃতি দিলে বাংলাদেশের পক্ষে সহায়ক হবে না, ক্ষতি করা হবে। অর্থাৎ সরকারী ভাষার ‘হেলপফুল হবে, না হার্মফুল হবে।” এদিকে বাংলাদেশের জাতীয় সরকার এবং সমগ্র জাতীয় দল বার বার বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন জানাচ্ছেন। বাংলাদেশের পক্ষে কোনটা স্বার্থসম্মত এবং কোন কাজ ক্ষতিকর সেই বিচারের প্রধান যোগ্যতা এবং অধিকার যে বাংলাদেশের সরকারের,—এই মূল কথাটি স্বীকার করে নিয়ে ভারত সরকারের বরং স্পষ্ট করে বলা উচিত যে ভারতের স্বার্থে ভারত সরকারের পক্ষে এখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়- যদিও, ভারত মনে করে যে বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি দেওয়াই ভারতের পক্ষে স্বার্থসম্মত। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সম্বন্ধে বলেছেন ‘রাইট টাইমে রাইট ডিসিশন’ নেওয়া হবে। এই সঠিক সিদ্ধান্তের ঠিক সময়টি কখন আসবে? ঠিক সময় ও ঠিক সিদ্ধান্তের নিয়ামক বা নির্ণায়ক অথবা পারিপার্শ্বিকতার সূচকই বা কি?

সরকারী ধারনা নির্ভুল নয়

 বাংলাদেশের গণঅভ্যূত্থানের পরে ভারত সরকার মনে করেছিলেন যে, পিণ্ডি সরকার পশ্চিম পাক সীমান্ত থেকে পূর্ব বাংলায় ফৌজ পাঠাতে সাহসী হবে না। প্রধানমন্ত্রীর সংগে বিরোধী দলের নেতাদের বৈঠকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রমা বলেন যে, ৩০ লক্ষের বেশী শরণার্থী ভারতে আসবেনা। ভারত সরকারের আরও ধারণা হয়েছিল। সামরিক খরচ এবং পূর্ব বাংলার বিপর্যয়ের কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে। ভারত সরকারের এই তিনটি ধারণার একটি ধারণাও সঠিক প্রমাণিত হয়নি।

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের বিকল্প

 পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ পরিহারের একমাত্র রাজনৈতিক বিকল্প পন্থা হলো বাংলাদেশের আশু স্বীকৃতি দান। বাংলাদেশের সরকার স্বীকৃতি লাভ করলে যে রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্যমের স্বাধীনতা লাভ করবে তার সুযোগে শুধু ভারতের কাছ থেকেই নয় বিশ্বের আরও কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ যে সামরিক ও রাজনৈতিক এবং আর্থিক সহযোগিতা লাভ করবে তার সংবাদ ভারত সরকারেরও অজানা নয়।

 স্বীকৃতি লাভ করলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ভারতে আগত উদ্বাস্তুদের ভিতর থেকে এক লক্ষ শক্তির গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলাও অসম্ভব হবে না। স্বীকৃতি লাভ করে যে প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ সাহায্য লাভের সুযোগ বাংলাদেশ সরকার পাবে, সেই সুযোগ গ্রহণ করে মুক্তিফৌজের পক্ষেই পাক ফৌজের কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে।