বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)/১৭০

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গ জমিয়তে উলামার বক্তব্য কম্পাস ২৮ আগষ্ট, ১৯৭১

বাংলাদেশ ও জমিয়ত উলামা

অমর রাহা

 খিশত্ আউয়াল চুম নেহাদ মেহমার কাঘ তা সুবাইয়া মীর রহওয়াদ দিওয়ারকাঘ, অর্থাৎ ভিত যার বাঁকা তার চুড়া আকাশচুম্বী হলেও বাঁকা থাকবেই- বলেছেন শেখ সাদী। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত পশ্চিম বঙ্গ জমিয়তে উলামার, কনভেনশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মওলানা মোহাম্মদ তাহের সাহেব বলেছেনঃ গোড়ায় যার গলদ রহিয়াছে, তাহার শেষ শোধরান সহজ নয়, সমাপ্তি তার সুন্দর হতে পারে না। এ কথা মওলানা বলেছেন পাকিস্তানের জন্ম ও ইতিহাস মনে করে এবং তারই ভাষায়ঃ “একদা যে স্বার্থন্ধতা ও ক্ষমতা লিপ্সা সাম্প্রদায়িকতার নামে দেশ বিভাগ এবং পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল, আজ সুদীর্ঘ তেইশ বৎসর যাবৎ পাকিস্তানের ইতিহাসে তাহা বারে বারে নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সেই উগ্র ক্ষমতালিপ্সা এবং স্বার্থপরতারই ক্রমপরিণতি।”

সোনর বাংলা শ্মশান কেন?

 ‘……ধর্মের নামে, ইসলামের নামে, দেশের ঐক্য সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার নামেই এই শোষণ এবং অবিচার চালিয়েছে। অথচ যে পবিত্র ইসলাম এবং ধর্মের নাম দিয়ে এই শোষণ সেই পবিত্র ইসলাম ধর্মে কিন্তু ইহার অবকাশ মাত্র নাই। ……প্রিয় নবী (দঃ) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করিয়াছেনঃ যে রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সরকার তাহার প্রজা সাধারণের কল্যাণ প্রচেষ্টা করেন না, তাহাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন, নরকের আগুনেই তাহার নিশ্চিত ঠাঁই।

তাই প্রতিবাদ

রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ

অন্যায় যে করে, আর অন্যয় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।

 তাহের সাহেব তাই হাদীস শরীফ উল্লেখ করে বলেনঃ অত্যাচার, অবিচার চুপ করিয়া সহ্য করিতে নাই, অত্যাচার অবিচারের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করিতে নাই, ইহাতে সমগ্র সমাজের সর্বনাশ অবশ্যম্ভাবী।

 ……অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ কাপুরুষতা প্রদর্শন না করিয়া যাহাতে সৎ সাহসে আগাইয়া আসে তজ্জন্য উৎসাহ দান হুজুর (দঃ) ঘোষণা করিয়াছেন; “জালিম রাষ্ট্রনায়কের সম্মুখে সত্য কথা ঘোষণা শ্রেষ্ঠতম জেহাদ।”

 তাই দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী হতে ১৯৬৯ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত নানাভাবে এবং জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় এবং ঘোষিত বা অঘোষিত জেহাদ। আর শেষতঃ ২৩ বছর পর সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ রায় দিলো ছয় দফার পর। শেখ মুজিব নেতৃত্ব হোল এই দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতীক।

 ইসলামাবাদ চক্র প্রতিনিধি জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ভাষাকে এবং রায়কে পদদলিত করবার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দলনায়কদের সঙ্গে পরামর্শ মাত্র না করিয়া’ জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দিলেন। তাছাড়া ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুরকে প্রধানমন্ত্রিত্বের টোপ দিয়া ছয়দফা দাবী হইতে বিচ্যুত করিতে টেষ্টা করিলেন কিন্তু, ‘জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করিয়া তিনি স্পষ্ট জবাব দিলেন? জাতি আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য ভোট দেয় নাই, তাহারা ছয় দফা দাবীতেই ভোট দিয়াছে; আমি তাহা বিসর্জন দিয়া জাতির সংগে বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারিব না।’

 তাহের সাহেব তাই বললেনঃ ইহাতেই শোষকের আঁতে ঘা পড়ে; তাহারা ভাবে ব্রিটিশ সরকারকেও একদা যে অসহযোগ আন্দোলনের অস্ত্র শেষ পর্যন্ত ঘায়েল করিয়াছে, ভারতছাড়া করিয়াছে, শোষিত বাঙ্গালীরা যদি সেই অস্ত্র ব্যবহার করে তবে আর রক্ষা নাই, ইহাতেই জোকের মুখে চুন পড়িবে……। অতএব সূচনাতেই সামাল দাও; এই শোষিত অবাধ্য বাঙ্গালী জাতিকে ডাণ্ডা মরিয়া ঠাণ্ডা করিয়া দাও……… তাহাদের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া দাও।……এবং বাঙ্গালী নিধনের নির্দেশ দিয়া ইয়াহিয়া ঢাকা হইতে করাচী যাত্রা করেন।

সবই চলে ধর্মের বাদে

 ইসলাম ধর্ম………রক্ষা নামেই ইয়াহিয়া সবকিছু করিতেছে। শিশু হত্যা ধর্ষণ, নিরাপরাধ জনতা নিধন, বাঙ্গালী নিধনের নামেই সবই চলিতেছে। “তাহারা মযলুমকে ঠাণ্ডা এবং জগৎকে ধোঁকা দিবার জন্য একই সঙ্গে বন্দুকের গুলি এবং ধর্মের বুলি ব্যবহার করতঃ মযলুমের শোণিত রক্তের হোলি খেলিতেছে। বাংলাদেশের সর্বত্র চলছে তাহাদের এই পৈশাচিক নৃত্য।

জেহাদ ও মুক্তিবাহিনী

 প্রায় ২৩ বছর ধরে যে অব্যক্ত ও জেহাদ চলে আসছিল তাই ২৫শে মার্চের রাতে রূপ নিল ভিন্নভাবে।

 ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতার ও বুলেটের গুলীতে পরিবেশে জন্ম নিল মুক্তিবাহিনী। বাধ্য হোল মানুষ জবাব দিতে। তাহারা যে যেখানে পারল শোষক সরকারের জালেম সেনাদের প্রতিরোধে প্রাযস পাইল তাই তাহাদের প্রত্যুত্তর সুসংঘবদ্ধ ছিল না। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না; ক্রমে মাস দুই পরে তাহারা সুপরিকল্পিতভাবে তাহাদের অভিযান চালাইতে থাকে।”

 এই মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যে তাহের সাহেব হাদীস শরীফ হতে উল্লেখ করে বলেনঃ “নিজেদের প্রাণ, ধন-মান রক্ষায় যে নিহত হয় তাহার মৃত্যু শহীদের মৃত্যু”।

 এই কনভেনশনে সভাপতি হিসেবে আজাদ হিন্দ বাহিনীর জেনারেল শাহ নওয়াজ খান, সারা ভারত জমিয়তে উলামার সাধারণ সম্পাদক সদস্য মওলানা আসাদ মাদানী প্রভৃতিও একটি ঐশ্লামিক রাষ্ট্রের স্বরূপ নিয়ে যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনসাধারণকেও অভিনন্দন জানান। আর সকলেই তাহের সাহেবের “আমেরিকা, চীন প্রভৃতির নিজ স্বার্থে জালিম ইয়াহিয়া খান ও তার সরকারের সাহায্য যদি দোষের না হয়, তবে নির্যাতিত মযলুম বাংলাদেশবাসীর সাহায্য সহায়তায় হিন্দুস্তানের অপরাধ কি? উক্তির সমর্থনে নিজেদের কথাও বলেন।

শেষতঃ এই কনভেনশন প্রস্তাব গ্রহণ করে

 নিঃশর্ত সমর্থন জানান বাংলাদেশের সংগ্রামকে; (২) ঘৃণা প্রকাশ করে ইসলামাবাদ চক্রের ফাঁসিস্ত পদ্ধতিকে; (৩) দাবী করে মুজিবের মুক্তি এবং ঐ সংগে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন করে ইসলামাবাদ সামরিক চক্রের বিচার, এবং আশা প্রকাশ করে যে ভারত সরকার সময়মত স্বীকৃতি দেবে প্রজাতন্ত্রিক বাংলাদেশকে।