বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)/৩৯

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশ প্রশ্নে নিরপেক্ষ দেশগুলির প্রতি ভূমিকা গ্রহণের আহ্বানঃ রাষ্ট্রসংঘে পররাষ্ট্র সচিবের বিবৃতি দৈনিক আনন্দবাজার ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

বাংলাদেশের ব্যাপারে নিরপেক্ষ দেশগুলিকে সোচ্চার হতে হবেঃ

রাষ্ট্রপুঞ্জে শ্রী টি এন কল

 রাষ্ট্রপুঞ্জ, ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শ্রী টি এন কল রাষ্ট্রপুঞ্জে নিরপেক্ষ গোষ্ঠীকে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে শোচনীয় মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে যদি এই গোষ্ঠী সুস্পষ্ট মতামত জানাতে না পারেন তাহলে ঐ সব নিরপেক্ষ দেশের মন্ত্রী সম্মেলনে ভারত যোগদান করতে পারে নাও করতে পারে। আগামী সপ্তাহে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগোষ্ঠীর মন্ত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।

 গতকালের সভায় এক জোরালো বক্তৃতায় শ্রী কল বলেন, নিরপেক্ষ দেশগুলি যদি বাস্তব অবস্থাকে উপেক্ষা করে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রস্তাব দেবারও সাহস না দেখাতে পারে তা হলে সারা বিশ্বের কাছে তারা নিন্দিত হবে ও নিরপেক্ষতার মৌল ধারণাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

 আজ রাত্রে নিরপেক্ষ দেশগুলির দ্বিতীয় অধিবেশন বসলে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কঠোর মনোভাব জানাবার জন্য পররাষ্ট্র সচিব এই আলোচনায় অশংগ্রহণ করেন।

 নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর প্রস্তাবিত যুক্ত ইস্তাহারে বাংলাদেশ সমস্যার “রাজনৈতিক মীমাংসার’ কথা বাদ দেওয়া উচিত বলে মরক্কোর প্রতিনিধি প্রস্তাব করেন। তারপরই শ্রী কল বক্তৃতা প্রসঙ্গে ওই কথা বলেন। অবশ্য মরক্কোর ওই প্রতিনিধি বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের দেখাশুনা করার ব্যাপারে ভারত যে বিপুল দায় নিয়েছে তার জন্য সহানুভূতি জনান।

 নাইজেরিয়া মরক্কোর এই বক্তব্য সমর্থন করে।

 আলজিরীয় প্রতিনিধি ভারতের প্রতি তাঁর দেশের সৌহার্দ প্রকাশ করেন এবং শরণার্থী সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। এশিয়ার দুটি বিরাট দেশ পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হবে সেজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, এর মীমাংসার জন্য নিরপেক্ষ দেশগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে।

 রাষ্ট্রপুঞ্জে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী আগা শাহী এর আগে ভারত ছাড়া অন্যান্য সব নিরপেক্ষ দেশগুলির কাছে এক পত্রে বলেছেন যে, খসড়া ইস্তাহারে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা যেন না থাকে। কেননা, তাঁর মতে, এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

 নিরপেক্ষ দেশগুলির আলোচনাচক্রে বাংলাদেশের বিষয়ে আলোচনার চেষ্টা হওয়ায় রাষ্ট্রপুঞ্জে পাকিস্তানের প্রাক্তন সহকারী প্রতিনিধি এবং বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি শ্রী এস এ করিম স্বাগত জানান। শ্রী করিম তাঁর পত্রে বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ মুক্তিসংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। পরতুগালের বিরুদ্ধে এঙ্গোলা ও মোজামবিকের জনগণের সংগ্রাম থেকে এ সংগ্রাম পৃথক নয়। পাকিস্তানের মত তারাও আঞ্চলিক সংহতির নামে ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

 শ্রী কলের সোজা ভাষায় বক্তৃতার পর সভাপতি ও জামবিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী ভারনন জনসন সোয়াঙ্গা যুক্ত ইস্তাহারে বাংলাদেশ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদে ঐকমত্য স্থাপনে তাঁর প্রভাব বিস্তার করেন।

 বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার শ্রী কল এটা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, এটা আভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, আন্তর্জতিক সমস্যা। তিনি বলেন, সেক্রেটারী জেনারেল উ থানট গত ১৪ সেপ্টেম্বর তার সাংবাদিক বৈঠকে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের মৌল সমস্যাই হল রাজনৈতিক।

 শ্রী কল বলেন, নিরপেক্ষ গোষ্ঠীর একই নীতি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের জন্য ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রয়োগ করা উচিত নয়। তিনি বলেন, ভারত দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং প্যালেসটেনিয়ান শরণার্থীদের নিজেদের দেশে প্রত্যাবর্তনের অধিকার সমর্থন করে এসেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই একই নীতি প্রযোজ্য হওয়া উচিত। অথচ এই বাংলাদেশের ঘটনা ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ৯ মাসে ৯০ লক্ষ শরণার্থীর আগমন ইতিহাসে কোন সময়ে ঘটেছে কিনা সন্দেহ।

 বক্তৃতার উপসংহার শ্রী কল বলেন, ১০ ডিভিশন পাক সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোককে কখনই চেপে রাখতে পারবে না।