বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড)/৮৯

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
পূর্বাঞ্চলের পাঁচজন মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানঃ শরণার্থী প্রশ্নকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে গন্য করা হোক দৈনিক আনন্দবাজার ৯ মে, ১৯৭১

শরণার্থীদের প্রশ্নকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে গণ্য করা হোক

কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীদের আবেদন

(স্টাফ রিপোর্টার)

 শনিবার মহাকরণে পূর্বাঞ্চলের পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের জরুরী বৈঠকে স্থির হয় যে, কেন্দ্রকে তাঁরা এই অনুরোধ জানালেন যে, বাংলাদেশ থেকে আগত শরনার্থীদের শুধু সংশিষ্ট রাজ্যগুলির সমস্যা বলে গণ্য না করে জাতীয় সমস্যা বলে গণ্য করা হোক।

 দলে দলে আগত এই আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্যরক্ষা ইত্যাদি গুরুদায়িত্ব বহনে অংশগ্রহণের জন্য মুখ্যমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এবং সব স্বাধীন রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানাতে মনস্থ করেন।

 জানা গিয়েছে যে পশ্চিম বংগে বিধান সভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের দাবী জানিয়ে গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় সরকারকে পাঠানো হচ্ছে।

 এদিন রাত্রে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সংগে ওই সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়ার প্রাক্কালে পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একত্রে মিলিত হয়ে একটি সর্বসম্মত বক্তব্য প্রণয়ন করেন। এই বৈঠকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী কর্পুরী ঠাকুর, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্রলার সিংহ, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী ইলিয়মসন সংমা এবং পশ্চিম বংগের উপ-মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিজয় অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় প্রায় দু ঘণ্টা ধরে আলোচনা করেন। এছাড়া বৈঠকে পশ্চিম বংগের উপ-মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বিজয় সিংহ নাহার রাজ্য মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ সাব-কমিটির সদস্য হিসেবে শ্রী সন্তোষ রায় এবং ডাঃ জয়নাল আবেদিনও উপস্থিত ছিলেন।

 বৈঠকে কেন্দ্রের কাছে এইরূপ আবেদন করা হবে বলে স্থির হয় যে, এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে এই শরনার্থীরা আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারে এবং সেই জন্য কেন্দ্রকে অবিলম্বে উদ্যোগী হতে হবে। আরও বলা হয় যে, শরনার্থীদের ভরতের অন্যান্য রাজ্যেও পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতি বিপর্যস্ত না হয়ে পড়ে।

আরও নিরাপত্তা ও পুলিশ ব্যবস্থার দাবী

 বেঠকের পর পশ্চিম বংগের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী মুখার্জি সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য যা অর্থ লাগে সবই দেবেন বলেছেন। কিন্তু এছাড়া আইন শৃংখলা রক্ষা ইত্যাদি আরও নানা প্রশ্ন ও সমস্যা আছে। এদিনের বৈঠকে মোটামুটি ঠিক হয়েছে তাঁরা সীমান্তের আরও নিরাপত্তা ও পুলিশী ব্যবস্থার জন্য যে অর্থ লাগে তাও কেন্দ্রকে দিতে বলবেন।

 মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, সীমান্তের অস্থায়ী শিবিরগুলিতে বড় জোর পাঁচ লক্ষ শরণার্থীদের সামরিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা আছে। এর উদ্বৃত্তের সংগে সংগে অন্যান্য রাজ্যে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থার ভার কেন্দ্রকে নিতে হবে।

 উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনীধিরূপে শ্রী রাম নারায়ণ ত্রিপাঠিও এদিন অজয় বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের শরণার্থীদের ব্যাপারে তাঁরা কীভাবে সাহায্য করতে পারেন তা জানতে চান। ইউপি সিটিজেনস কাউনসিলের সাধারণ সম্পাদক শ্রী ত্রিপাঠি রবি ও সোমবার কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন।

বৈঠকে আলোচনা ও আবেদন

 বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীদের অভূতপূর্ব ভিড়ের চাপ যে অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তা আলোচনা করেন। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা আঠারো লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাঁরা এভাবে আসতে থাকলে অবিলম্বে এই সংখ্যা বিশ লক্ষের উপরে উঠে যাবে।

 বৈঠকে এই মত প্রকাশ করা যে, শুধু সংশ্লিষ্ট রাজ্যেগুলির বহন করার পক্ষে এ সমস্যা অত্যন্ত গুরুভার। বহু জায়গায় এই শরণার্থীদের মাথার উপর কোন আচ্ছাদন নাই। কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় যে খাদ্যশস্য মঞ্জুর করছেন তার সরবরাহও অনিয়মিত। লবণ, চিনি, কেরোসিন, বাসনপত্র এবং কাপড়চোপড়ের সরবরাহও সর্বদাই প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। যানবাহনের ঘাটতির ফলে পাঠাবার ব্যবস্থাও ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা সম্পর্কে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কলেরা দেখা দিচ্ছে বলে খবর আসছে।

 মুখ্যমন্ত্রীরা আশা করেন তাঁদের আবেদনে ভারতের সব রাজ্য এই গুরু দায়িত্ব বহন করতে এগিয়ে আসবেন। বাংলদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দিকে দিকে স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভুতির প্রকাশ হয়েছে। বংলাদেশের জংগী নির্যাতনের কবল থেকে যাঁরা দলে দলে ছলে আসছেন অবিলম্বে তাঁদের খাদ্য, আশ্রয় ও স্বাস্থ্যরক্ষার ব্যাপারে এই সহানুভূতিকে সক্রিয় করে তোলা প্রয়োজন।

 মানবিকতার প্রশ্নে ভারতের এই দায়িত্ব বহনে অংশগ্রহণের জন্য মুখ্যমন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি এবং সব স্বাধীন রাষ্ট্রকেও অনুরোধ জানাতে মনস্থ করেন।