বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/২০

উইকিসংকলন থেকে

জয় গোবিন্দ ভৌমিক

 ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। আমি তখন ঢাকায় জেলা ও দায়রা জজের দায়িত্বে নিয়োজিত। আমার কোয়ার্টারটা ছিল পুরানো সার্কিট হাউস চত্বরে। আমার বাসার কাছেই কাকরাইলে অবস্থিত সেণ্ট্রাল সার্কিট হাউস। সেখানে স্থাপিত হল পাক বাহিনীর আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার। মিলিটারীর খট্ খট্ পায়ের শব্দে আর বন্দুকের আস্ফালনে বুক কেঁপে কেঁপে ওঠে।

 ২৬শে মার্চ রেডিও মারফত ফরমান এলো থানায় বন্দুক জমা দাও। পায়ে হেঁটে কাঁপতে কাঁপতে বন্দুক হাতে নিয়ে গেলাম রমনা থানায়

 ২৮শে মার্চ সবাইকে ১০টায় নিজ নিজ অফিসে অবশ্য হাজির হতে হবে। পুরানো সার্কিট হাউস চতুর থেকে ঢাকা কোর্টের দুরত্ব আনুমানিক ৪/৫ মাইল। গাড়ী ঘোড়া চলছে না। লোকজন প্রাণের ভয়ে গ্রামাঞ্চলে পায়ে হেঁটে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পায়ে হেঁটে জীবনকে হাতে নিয়ে আমিও চললাম পুরানো ঢাকার জর্জ কোর্ট চত্বরে অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করতে। আমার সঙ্গে ছিলেন আমারই ব্যাচমেণ্ট তৎকালীন ঢাকাস্থ এডশনাল জেলা জজ আতিয়ার রহমান সাহেব। আমরা আদালত প্রাংগনে প্রবেশ করতে সংক্ষম হয়েছিলাম বহু কষ্টে কারণ, দারোয়ান বা নাইট গার্ডরা প্রাণভয়ে কোথায় যে পালিয়েছে তার ঠিকানা নেই। তৎকালীন নেজারত থানায় আগুন লাগান হয়েছে। ফলে অনেক মূল্যবান দলিল পুড়ে গেছে। পশ্চিম দিকের তিন তলা ইমারতটি, যেখানে কিছুদিন আগেও সাময়িকভাবে জজ সাহেবের এজলাস বসত, সেখানে নীচতলায় মিটি মিটি আগুন জ্বলছিল। আমরা বহুকষ্টে মূল্যবান মামলার রেকর্ডগুলি সরিয়ে এসে একটা টেবিলে জমা করি। কোন ঘরে আমরা প্রবেশ করতে পারিনি, কারণ দারোয়ানরা তালা লাগিয়ে পালিয়েছে। পরে বহু চেষ্টায় কাচের জানালা ভেঙ্গে দু'একটি অফিস কক্ষে প্রবেশ করি। মুন্সেফ, সাব জজ, এডিশনাল জজ সাহেবরা সকলে একটি কাগজে তাদের নাম লিখে আমার হাতে দিয়ে অফিসের হাজিরার দায়িত্ব পালন করেন।

 এমনিভাবে কয়েকদিন কাটিয়ে দিলাম। পথের হয়রানি লেগেই আছে। পাকসৈন্যরা সবা কাছে পরিচয়পত্র চায়-আমরা পাকিস্তানের দুশমন কিনা জানতে চায়। তাই সবার নামে একটি করে ‘আইডেণ্টিটি কার্ড’ প্রদান করতে হল যাতায়াতে যাতে করে বিঘ্ন না ঘটে। কিন্তু প্রধান হিসেবে আমার নাম দস্তখত করলাম অস্পষ্টভাবে, পাক সেনারা যাতে জানতে না পারে যে আমি একজন হিন্দু। কারণ তাদের ধারণা হিন্দুরা কাফের এবং তারাই যত অনিষ্টের মূল। কোর্ট কাচারী তখন নামেই চলছিল। মক্কেল নেই, লোকজন প্রাণের ভয়ে কোর্টে আসত না। আমার ছোট একটা ফিয়েট মটর কার ছিল। ঐটায় তখন কোনমতে কোর্টে আর বাসায় যাতায়াত করতাম। গাড়ীর ভেতর রাখতাম ‘জিন্নাহ ক্যাপ’ যাতে করে কেউ টের না পায় আমি একজন হিন্দু জজ। আর কাগজে লিখে নিয়ে তিন-চারটা কলেমা মুখস্থ করে আওড়াতাম যাতে আমি পাক-সেনাদের বুঝাতে পারি একজন সাচ্চা মুসলমান।

 পাক-সেনা পরিবেষ্টিত হয়ে প্রতিনিয়ত মৃত্যুভয়ে ভীত অবস্থায় কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিলাম কোন মতে। এর মধ্যে একদিন তৎকালীন জুনিয়র এডভোকেট জনাব বি, এ, খান এস বলেন, 'স্যার শীঘ্র ঢাকা থেকে অন্য চলে যান। আপনার নাম মিলিটারী জান্তার তালিকায় ৩ নং এ দেখলাম। ওরা ‘কম্বিং অপারেশন' শুরু করতে যাচ্ছে।

 সংবাদটা বড়ই করুণ। বুকটা কেঁপে উঠলো। ঢাকা ছেড়ে কোথায় যাব? ঢাকা জেলার না চিনি গ্রামগঞ্জ, না চিনি পথঘাট। চারিদিকে মিলিটারী আর মিলিটারী। মৃত্যুর দিন গুনছিলাম। ঠিক এই সময় এডভোকেট আলী আমজাদ সাহেবের শ্যালক এম. এ সরোয়ার (খোকন) এসে হাজির। তিনি আমাদের অতি পরিচিত, ছেলেমেয়েদের খোকন ভাই। তিনি বললেন কোন ভয় নেই, গাড়ী রেডী আছে, পথঘাট সব ঠিক আছে, বৈদ্যের বাজার দিয়ে কুমিল্লা হয়ে আগরতলায় পৌঁছাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার, বেলা ১০ টায় রওয়ানা হলে সন্ধ্যার আগেই আমরা পৌঁছে যাচ্ছি, অতি সহজ ভাষায় বলে ফেললেন। আমিও তার কথা সহজভাবেই বিশ্বাস করে মুক্তি পথ খুঁজে পেলাম।

 কয়েকটা হাতব্যাগের মধ্যে সোনাদানা, টাকা পয়সা, কয়েকটা মূল্যবান জামা কাপড় পরে নিয়ে ২/৩ দিনের মধ্যে ঢাকা ছাড়ার সংকল্প করলাম। আশপাশের অফিসাররা জানতে পারলে সমূহ বিপদ হবে। তাই কাউকে কিছু বলিনি। খোকন মিয়ার প্ল্যান অনুযায়ী আমি বেলা ১০টার আগেই আমার মটর কারে জজ কোর্টে চলে গেলাম। আমার পরিবারবর্গ খোকন মিয়ার কোন বন্ধুর গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ১০-১৫ মিঃ-এর মধ্যে অপর একটি মটর কার এসে হাজির যেটি তাদেরকে ডেমরা ঘাটের নিকট পৌঁছে দিল। আর আমি ১০-৩০ মিঃ মধ্যে ঢাকা জজ কোর্ট হয়ে রওয়ানা হলাম ডেমরা ঘাটের দিকে। ড্রাইভার সাহাবুদ্দিনকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে খোকন মিয়ার সাহায্যে আমার গাড়ী নিয়ে ডেমরার দিকে ছুটলাম। অফিসে রেখে গেলাম একটা ৬ দিনের ‘ক্যাজুয়াল লীভ'-এর দরখাস্ত। প্ল্যান মত ডেমরায় গিয়ে পরিবারবর্গের সংগে মিলিত হলাম। গাড়ী দুটিকেই ফিরিয়ে দিলাম।

 বহু কষ্টে স্কুটার করে আমরা গিয়ে বৈদ্যের বাজার পৌঁছাই। তখন বেলা প্রায় ৪টা। খোকন মিয়ার কথানুযায়ী কোথায় সন্ধ্যার আগেই গিয়ে ভারতের আগরতলায় পৌঁছাব, তা না হয়ে বৈদ্যের বাজারেই পড়ে রইলাম বিকাল অবধি। চিন্তায় অধীর হয়ে পড়লাম। সমূহ বিপদের ঘনঘটা দেখতে পেলাম। এখন উপায়?

 অসুস্থ স্ত্রীকে সঙ্গে এনেছি। প্রায় না খেয়েই রওয়ানা দিয়েছি কোন সকালে। ছেলেমেয়েরা ক্ষুধায় ছটফট করছে। খাবার জিনিসের মধ্যে পেলাম কিছু লিচু। তাই কিনে নিলাম। বেলা ৫টার দিকে দেখলাম, দূর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড একটা লঞ্চ আসছে। তাতে লোক ভর্তি, স্থান হবে না। লঞ্চটি তীরে ভিড়লো না। আমরা একটা ছোট ডিঙ্গিতে উঠে আস্তে আস্তে লঞ্চের কাছে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে কোন মতে শরীরকে ঢুকিয়ে দিয়ে ক্যাবিনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। রাত ৮-৩০ মিনিট নাগাদ যখন কুমিল্লা জেলার রামচন্দ্রপুর আসলাম, তখন লঞ্চের সারেং বলে উঠলো, যারা হিন্দু আছেন তারা যেন সেখানে নেমে যান। তাদেরকে আর নেয়া যাবে না। তখন অনেকে সেখানে নেমে গেল। আমরা নামলাম না, কারণ আমরা তো হিন্দুর পরিচয় দিচ্ছি না। যখন রামকৃষ্ণপুর পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে ন'টা। একটি বন্দরের মত জায়গা। সর্বত্র গভীর নিঝুম অন্ধকার। দু’একটা কুপি বাতি দোকানের মাঝখান থেকে জ্বলছে। আমরা নেমে পড়লাম। খোকন মিয়া আমাদেরকে গাইড করছেন। আমরা সবাই ভয়ে কাঁপছি। কিন্তু খোকন মিয়া আশ্বাস দিয়ে বলে উঠলেন, কোন ভয় নেই। একটা বুড়ো মাঝিকে ডেকে বললেন ‘এই মাঝি, কামাল্যা গ্রাম চেনো? ঐ গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে যাব, তাদের ইষ্টি কুটুম ঢাকা থেকে এসেছেন।’ সে কুমিল্লা জিলার কামাল্যা গ্রামের চৌধুরী বাড়ী চেনে।

 আমাদের নৌকার ছৈ-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে মাঝি নৌকা বেয়ে চললো। সামনে একটা কুপি বাতি জ্বলছে টিপ টিপ্ করে। ভয়ে আমরা জড়সড়। কখন যে ডাকাতের পাল্লায় পড়ি। দু'একটা হাঁকডাকও কানে গেলো। কিন্তু আমরা নিশ্চুপ।

 যখন কামাল্যা গ্রামে এসে পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ১টা। ক্ষিধেয় আধমরা হয়ে গেছি। চৌধুরী বাড়ী গিয়ে উঠলাম। খোন মিয়া কানে কানে বলে দিল, ঢাকার জজ সাহেব। একটা অল্প বয়সী ভদ্রমহিলা সেই রাতেই আমাদের জন্য দুটো ডাল-ভাত রেঁধে দিলেন। আমরা পরম তৃপ্তির সাথে তা খেলাম। রাত ভোর হতে বেশী বাকী ছিল না। আমরা একটা ভাংগা বেড়ার ঘরে আশ্রয় নিলাম এবং কোন মতে একটু চোখ বুজলাম। পরদনি যাব, কিন্তু কোন নৌকা মিললো না। তাই সেদিন কামাল্যা গ্রামেই থাকতে হল। খুব ভোরে রওয়ানা হব। কিন্তু খোকন মিয়ার তাগিদ নেই। তিনি গ্রামে কানাঘুষা শুনেছেন, আমরা হিন্দু, কয়েক সের সোনাদানা এবং বহু টাকা পয়সা নিয়ে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছি। কিন্তু এ খবর তিনি চেপে গেছেন, যাতে আমরা ঘাবড়িয়ে না যাই। তিনি শুধু বলে উঠছেন, চা নাস্তা না খেয়ে যাচ্ছি না। যাক, বেলা ৭-৩০ মিঃ দিকে নৌকাযোগে রওয়ানা হলাম আগরতলার দিকে। কিন্তু দু'মাইল পথ না যেতেই আলগি গ্রামে একদল দুষ্কৃতকারী শোরগোল করে ছুটে এলো নৌকার দিকে লাঠি হাতে। আমাদের কাছে যা কিছু টাকা পয়সা সোনাদানা ছিল তা প্রায় লুট হয়ে গেল। এখন উপায়? ঢাকায় ফিরলেও মৃত্যু অবধারিত। তাই এগিয়েই চললাম, সামান্য কিছু পথের সম্বল নিয়ে যা আমার স্ত্রীর কাছে একান্ত গোপনে রাখা ছিল।

 নৌকার মাঝি ৪/৫ মাইল যাবার পর এগাতে সাহস পেল না। সামনে নাকি পাক সেনার আস্তানা। কুমিল্লার একটা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার নিকট নামিয়ে দিল। কিছুই চিনি না। জানলাম, সেখান থেকে মুরাদনগর থানার অধীন বাংগুরা গ্রাম নাকি বেশী দূরে নয়। তখন খোকন মিয়া একই কায়দায় সাহস দিয়ে বলে দিল, কোন ভয় নেই। বাংগুরার চেয়ারম্যান যে তার এক আত্মীয় কতাটা আদৌ হয়তা সত্য নয়। তবু ভরসা পেলাম। তারপর সেখান থেকে ৩/৪ মাইল পথ বহুকষ্টে পায়ে হেঁটে গিয়ে উঠলাম বাংগুরা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের বাসায়। সেখানে আমার পরিচয় গোপন রাখলাম। চেয়ারম্যান সাহেব বয়স্ক মুসলিম লীগ নেতা। তিনি সর্বদা পাকিস্তানের খবর শুনছেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আতিথেয়তার ত্রুটি করেননি বিন্দুমাত্র। তাঁর এক ছেলে সেখানকার হাই স্কুলের শিক্ষক। তিনি একটা নৌকা ঠিক করে দিলেন এবং একজন শশ্মশ্রুমণ্ডিত মুরুব্বিমত লোককে সঙ্গে দিয়ে দিলেন যাতে পথে কোন অসুবিধে না হয়।

 সেখানে রাত কাটিয়ে ভোরে রওয়ানা হলাম। কিছুদূর যাবার পর আবার একদল গুপ্তা দ্বারা আক্রান্ত হলাম। কিন্তু ঐ মুরুব্বি লোকটা চেয়ারম্যানের লোক বলায় কোনমতে রক্ষা পেলাম। এমনিভাবে দুর্গম বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে আমরা কোনমতে পাহাড়ী পথ ধরে ভারত ভূমিতে প্রবেশ করলাম। দেখলাম বহুলোক পায়ে হেঁটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে ভারতে প্রবেশ করছে। ঐ ভারত সীমন্তে আমার পরিচয় দিয়ে নাম শরণার্থীদের তালিকাভুক্ত করে জীপযোগে রওয়ানা হলাম আগরতলায়, সেখান থেকে ১০/১২ মাইল দূরে। আগরতলায় বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য ক্যাম্প খোলা হয়েছে। অনেক পরিচিত নেতা এবং অফিসারের সাথে দেখা হল। মনে কিছুটা সান্ত্বনা অনুভব করলাম।

 প্রায় ৩ দিন ৩ রাত আগরতলায় ‘বিবেকানন্দ’ হোটেলে কাটিয়ে সকালে রওয়ানা হলাম ধর্মনগরের দিকে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ ধরে বাসযোগে প্রায় ১২৫ মাইল পথ অতিক্রম করে এসে পৌঁছলাম ধর্মনগর রেল স্টেশনে। সেখানে জয়বাংলার লোকে লোকারণ্য। সবাই ট্রেনের অপেক্ষায় আছে। রাত ৮টায় ট্রেন ছাড়ে। কোন মতে এক দালালের সাহায্যে জানালার ফাঁক দিয়ে একটা দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় প্রবেশ করলাম। বসবার কোন স্থান নেই। লোকের চাপে জীবন প্রায় যায় যায়। তবু জীবন যায়নি। ঐ ট্রেনে চেপে এগোতে লাগলাম। ‘জয় বাংলা'র কোন লোকই টিকিট কাটে না। আমরাও বিনা টিকিটেই রওয়ানা হলাম। কেউ আমাদের কাছে টিকিট চায়নি। লামডিং ও শিলিগুড়িতে ট্রেন বদল করলাম। ধর্মনগর রেল ষ্টেশন থেকে রওয়ানা হয়ে, তিন দিন তিন রাত ট্রেনে কাটিয়ে অবশেষে এসে পৌঁছালাম শিয়ালদহ স্টেশনে। মনে হল জীবন ফিরে পেয়েছি। পরে লোকাল ট্রেন ধরে কৃষ্ণনগরে এক আত্মীয়ের বাসায় এসে আশ্রয় নিলাম।

 কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে কলকাতায় এসে আমাদের হাইকমিশন ভবনে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, জয়বাংলার লোকের সমাগম। একজন পরিচিত ভদ্রলোক বললেন, স্যার এসেছেন, শীঘ্র আপনার বায়োডাটা ফরমটা পূরণ করুন। দেখলাম দলে দলে লোক বায়োডাটা ফরম পূরণে ব্যস্ত। আমিও আমার জীবনের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত ঐ ফরম পূরণের মাধ্যমে রেকর্ড করলাম। পরে আমার পরিচিত খন্দকার আসাদুজ্জামান (প্রাক্তন সি,এস,পি) ও আরও কয়েকজন পদস্থ অফিসার ও এমপি-র সাথে দেখা হল। তাঁরা আমার আগেই এসে মুজিবনগর সরকারের কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। আমাকে দেখে তাঁরা খুব খুশী হলেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের সংকল্প দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করে সে দিনের মত বিদায় নিলাম।

 এক সপ্তাহ পর আবার কলকাতায় আসলাম বাংলাদেশ হাইকমিশন চতুরে। অনেক চেনা মুখ পেলাম এবার। আমাদের দেশের অনেক অফিসার, ডাক্তার, উকিলের সমাগম। সবাই প্রাণের ভয়ে দেশ ত্যাগ করে এসেছেন, অনেকেই চাকুরির আশায় সেখানে ঘোরাফেরা করছেন। একজন ভদ্রলোক আমকে ডেকে বললেন, শীঘ্র আমাদের ট্রেজারী অফিসার জনাব মাখনলাল মাঝির (তৎকালীন ই,পি,সি,এস) সাথে দেখা করুন, আপনি কিছু এলাউন্স পাবেন। পকেট শূন্য। কিছু প্রাপ্তি যোগের কথা শুনে মনটা মেতে উঠলো। গেলাম মাখনলাল মাঝির সাথে দেখা করতে। তিনি বললেন, আমার নাকি ২৫০ টাকা প্রাপ্য। যারা মুজিবনগরে সরকারী চাকুরীতে নিয়োজিত নাই অথচ ‘পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী চাকুরীতে নিয়োজিত ছিলেন তারা সর্বোচ্চ ৫০০ টাকার অর্ধেক (অথবা পূর্বে ৫০০ টাকর কম বেতন পেলে তার অর্ধেক) এলাউন্স হিসেবে পাবেন। তাই তিনি ২৫০ টাকা গুনে আমার হাতে তুলে দিলেন। টাকাগুলি কিন্তু সব পাকিস্তানী মুদ্রায় দেয়া হল। ঐ গুলি ভারতীয় মুদ্রায় বদল করে নিতে হবে। পাকিস্তানী মুদ্রা ও ভারতীয় মুদ্রার হার তখন প্রায় এক পর্যায়েই ছিল। টাকাগুলি ভাংগিয়ে নিয়ে আনন্দিত মনে ফিরে এলাম কৃষ্ণনগরে, যেখানে আমরা আশ্রয় নিয়েছি।

 এখানে বলা প্রয়োজন যে, মুজিবনগর সরকারের হাতে অনেক পাকিস্তানী মুদ্রা জমা পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য। অনেক অফিসার ও সংগ্রামী জনতা পূর্ব পাকিস্তানের অনেক ব্যাংক, ট্রেজারী থেকে বেশ কিছু টাকা নিয়ে গিয়ে ঐ সরকারের হাতে জমা দেয়। সেই জমাকৃত টাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে কিছুদিন অফিসারদেরকে এলাউন্স হিসেবে দেয়া হতো। তারপর মে মাসের মাঝামাঝি কি জুনের প্রথম দিকে, পাকিস্তান সরকার ১০০ ও ৫০০ টাকার পাকিস্তানী নোট অচল ঘোষণা করেন। ফলে মুজিবনগর সরকারের নিকট জমাকৃত প্রচুর নোট অকেজো হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সনের মে মাসের শেষের দিক। মুজিবনগর সচিবালয় থেকে একটা আর্জেণ্ট টেলিগ্রাম এলো আমার নামে, বায়োডাটায় দেয়া কৃষ্ণনগরের ঠিকানায়। আমাকে অতি শীঘ্র সচিবালয়ে দেখা করতে বলা হয়েছে। সেই মতে পরদিনই কলকাতায় চলে আসলাম। ৮নং থিয়েটার রোডে অবস্থিত মুজিবনগর সচিবালয়। সেখানে গিয়ে দেখি তৎকালীন সচিবালয়ের সচিব জনাব নূরুল কাদের খান আগরতলায় ট্যুরে গেছেন এবং তাঁর অবর্তমানে অর্থ ও স্বরাষ্ট্র (ইণ্টিরিয়ার) সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান সাহেব সংস্থাপন বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর নিকট থেকে জানলাম তৎকালীন মন্ত্রীবর্গের ক্যাবিনেট মিটিংয়ের সিদ্ধান্তের কথা। আমার মতামত পেলে তাঁরা আমাকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগদান করবেন। আমি এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে, সানন্দে মত দান করলাম। কয়েকদিন পর, ভারতীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে এবং সমগ্র রিলিফ অপারেশন প্রত্যক্ষভাবে দেখাশুনার সুবিধার্থে পদটিকে সচিব হিসেবে আখ্যায়িত না করে রিলিফ কমিশনার হিসেবে নিয়োগদান করেন। ফলে রিলিফ কমিশনারকে একদিকে যেমন সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হতো, অন্যদিকে আবার রিলিফ অপারেশনের দিকটাও দেখতে হতো।

 পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচারে বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল ভারতে। এই এক কোটি জনগোষ্ঠীর ত্রাণকার্য পরিচালনা করা সহজসাধ্য নয়। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ প্রচেষ্টায় এই লোকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে খাদ্য বস্ত্র কম্বল প্রভৃতি ত্রাণ সামগ্রী এসেছে। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রিলিফ কমিশনার হিসেবে আমার প্রধান দায়িত্ব ছিল ভারত সরকারের সাথে সংযোগ রক্ষা করা এবং ত্রাণ সামগ্রী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলিতে যাতে যথাযথভাবে পৌঁছে যায় এবং তা সুষ্ঠুভাবে বণ্টিত হয় তার দিকে লক্ষ্য রাখা। এ ব্যাপারে আমাকে বিভিন্ন ক্যাম্প (শিবির) পরিদর্শন করতে হয়েছে। তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত উদ্ভূত সমস্যাবলী নিয়ে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বৈঠকে বসতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সচিব মিঃ কলহান ও অতিরিক্ত সচিব মিঃ লুথরা-র নাম উল্লেখ করতে চাই।

 অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও অসহায় শরণার্থীকে তাৎক্ষণিক বিপদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য তৎকালীন বিপ্লবী সরকারের মন্ত্রী জনাব এ এইচ এম কামরুজ্জামানের পরামর্শক্রমে কিছু কিছু আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়েছে।

 জনাব মো: হোসেন আলী সাহেব ছিলেন তৎকালীন কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার। তিনিই সর্বপ্রথম পাকিস্তান দূতাবাস কর্মীদের মধ্যে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং তিনিই বাংলাদেশের প্রথম হাইকমিশনার হিসেবে কলকাতায় নিয়োজিত হন।

 প্রথম অবস্থায় তাঁরই সহায়তায় মুবিজনগর সচিবালয়ের পত্তন হয় কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে। অল্প কিছুদিন পরই সচিবালয়টি স্থানান্তরিত করা হয় ৮নং থিয়েটার রোডের একটা বড় বাড়িতে। প্রধানত এখান থেকেই মুজিবনগর সচিবালয়ের কাজ পরিচারিত হতো। এখানেই বসতেন তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, অর্থমন্ত্রী সৈয়দ মনসুর আলী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং ত্রাণ, পুনর্বাসন ও স্বরাষ্ট্র (ইণ্টিরিয়ার) মন্ত্রী এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান সাহেব। শেষ পর্যায়ে সচিবালয়ের কর্মচারীর সংখ্যা বেশ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় স্থান সংকুলানের জন্য সচিবালয়ের অধিকাংশ বিভাগ স্থানান্তরিত করা হয় বালিগঞ্জ এলাকায় শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় রোডে একটি বড় বাড়ীতে।

 মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীর সন্তানদের প্রতিদিনের কৃতিত্বের কথা আমাদের সচিবালয়ে নিয়মিত সরবরাহ করা হতো। মাঝে মাঝেই ক্যাবিনেট মিটিং বসতো এবং মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল নিয়ে আমরা পর্যালোচনায় বসতাম। এদিকে আমাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বর্গীয় তাজউদ্দিন আহমদ এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি স্বর্গীয় সৈয়দ নজরুল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড ইসলাম ঐ সময় দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও অন্যান্য ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সংগে কয়েকদফা উচ্চ পর্যায়ের আলোচনায় বসেন এবং পরে পরস্পরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চুক্তিতে উপনীত হন।

 যখন ভারত সরকার ১৯৭১ সনের নভেম্বর মাসের মধ্যেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেন না তখন অনেকের মধ্যেই হতাশা ও বেদনার সুর লক্ষ্য করেছি। তারপর ৬ই ডিসেম্বর সত্য সত্যই যখন ভারত সর্ব প্রথম বাংলাদেশ স্বীকৃতি দান করে তখন আমরা সবাই আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ি।

 এরপর সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য ১৬ ডিসেম্বর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটা উচ্চ পর্যায়ের জরুরী বৈঠক ঢাকা হয় সকাল ১০ টায়, কলকাতাতে। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন একজন ঊর্ধ্বতন সিনিয়র সিভিল সার্ভেণ্ট মিঃ আর গুপ্ত। সেখানে আরও উপস্থিত ছিলেন ভারত সরকারের বহু ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন সর্বজনাব রুহুল কুদ্দুস, নূরুল কাদের খান, খন্দকার আসাদুজ্জামান, আমি নিজে এবং আরও কয়েকজন। সভা চলাকালীন আনুমানিক বেলা ১২টার দিকে হঠাৎ বৈঠক কক্ষের টেলিফোনটি বেজে উঠলো।

 মিঃ গুপ্ত টেলিফোনটি ধরলেন এবং সবার সামনে টেলিফোনের বার্তা জানিয়ে দিলেন-বললেন, আপনাদের জন্য শুভ সংবাদ, পাক বাহিনী আত্মসমর্পন করেছে। এ সংবাদে আমরা সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। এই পরিস্থিতিতে আমরা বাংলাদেশ গিয়ে কি কার্যক্রম গ্রহণ করব সেই বিষয় নিয়ে অল্প কিছু সময় আলোচনার পর বৈঠক সমাপ্ত হয়।

 এই বৈঠকের পরপরই আমরা তৎকালীন প্রধানন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সাহেবের সংগে সচিবালয়ে তাঁর কক্ষে গিয়ে মিলিত হই। আমাদের পক্ষে পাক আর্মির আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য কাকে ঢাকায় পাঠানো যায় এই নিয়ে জল্পনা হলো। আমাদের মধ্যে থেকে একজন বলেন উঠলেন, 'স্যার, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনারই উপস্থিত থাকা উচিত। পরে সিদ্ধান্ত হল সেনাবাহিনীর এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমাদের পক্ষে উপস্থিত থাকা উচিত একজন মিলিটারী অফিসারের। তখন জেনারেল ওসমানীকে পাঠানোর কথা উঠলো। কিন্তু তিনি যে তখন কলকাতার বাইরে। তৎক্ষণাৎ আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেকেণ্ড-ইনকমাণ্ড জনাব এ কে খন্দকার এয়ারভাইস মার্শাল সাহেব বলে উঠলেন, “স্যার আমি প্রস্তুত আছি'।

 তারপর তাঁকেই দুপুরের এক বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় পাঠান হলে আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য।

 ৩০ শে ডিসেম্বর ১৯৭১। ভারতীয় একটি বিমানযোগে আমাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ-এর স্ত্রী জহুরা তাজউদ্দিন ও অন্যান্যসহ আমি দমদম বিমানবন্দর থেকে বহু আকাঙ্খিত স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী অভিমুখে রওয়ানা হলাম।

 ১লা জানুয়ারী ১৯৭২ সনে আমি ঢাকায় এসে সচিবের মর্যাদায় বাংলাদেশের রিলিফ কমিশনার হিসেবেই কাজে যোগদান করি।

 মুজিব নগর সচিবালয়ে যাঁরা মুখ্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁদের প্রধান কয়েকজনের নাম হলোঃ

 জনাব নূরুল কাদের খান, সেক্রেটারী জেনারেল, এডমিনিস্ট্রেশন; জনাব খন্দকার আসাদুজ্জামান; সচিব, অর্থ ও স্বরাষ্ট্র (ইণ্টিরিয়ার) মন্ত্রণালয়, বাবু জয় গোবিন্দ ভৌমিক, রিলিফ কমিশনার; জনাব আবদুস সামাদ, সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়; জনাব তৌফিক ইমাম; সচিব, মন্ত্রী পরিষদ; জনাব ড. টি হোসেন, সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়; জনাব হান্নান চৌধুরী, সচিব, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়; জনাব আবদুল খালেক, পুলিশের আই,জি; জনাব ওয়ালিউল ইসলাম, ডি এস, জেনারেল এডমিনিস্ট্রেশন; জনাব কামাল উদ্দিন আহমেদ, ডি এস, জেনারেল এডমিনিস্ট্রেশন; জনাব মামুনুর রশিদ, ডেপুটি রিলিফ কমিশনার; জনাব সাদত হোসেন, পি এস, ফাইন্যান্স মিনিস্টার; জনাব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, পি এস, ফরেন মিনিস্টার; জনাব কাজী লুৎফুল হক, পি এস, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি; জনাব খায়রুজ্জামান চৌধুরী, ডি, এস, ফাইন্যান্স; জনাব আকবর আলী, ডি, এস; জনাব আহমদ আলী, ডি, এস স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জনাব মাখন লাল মাঝি, ট্রেজারী অফিসার; ধীরাজ নাথ, পি, এস, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী; জনাব শিলাব্রত বড়ুয়া, অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি, (আরও অনেকে)।

 শেষ পর্যায়ে জনাব রুহুল কুদ্দুস সাহেব (প্রাক্তন সিনিয়র সি, এস, পি,) মুজিবনগর সচিবালয়ে যোগদান করেন। কিছু দিনের মধ্যে সেক্রেটারী জেনারেল পদটি তুলে দিয়ে তাঁকে প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তখন নূরুল কাদের খান সাহেব শুধু সংস্থাপন বিভাগের সচিব থাকেন।

 জোনাল এডমিনিস্ট্রেশনে যারা বিভিন্ন জোনে মুখ্যপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁদের কয়েকজনের নাম হলঃ জনাব ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ, জনাব এস, এ, সামাদ, জনাব সামছুল হক, জনাব কাজী রফিক উদ্দিন, জনাব বিভূতিভূষণ বিশ্বাস, জনাব আবদুল মোমেন, (আরও অনেকে)।

 সবশেষে একটা কথা বলা প্রয়োজন মনে করি। অনেককেই মন্তব্য করতে শুনি যে, যারা মুজিবনগরে গিয়ে সরকারের চাকুরীতে নিয়োগ লাভ করেছেন তারা মহাসুখে দিন কাটিয়েছেন। কথাগুলি মোটেই সঠিক নয়। তাদের অধিকাংশই নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। তাদের না ছিল সুস্থ থাকার পরিবেশ, না ছিল আর্থিক সংগতি। মন্ত্রী থেকে প্রথম শ্রেণীর অফিসার পর্যন্ত সবাইকে দেয়া হোত সর্বমোট ৫০০/- টাকা, মাসিক এলাউন্স হিসেবে। তাই দিয়ে অফিসারগণ কোন মতে তাদের পরিবারসহ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিতেন। মন্ত্রীবর্গ ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির জন্য অবশ্য থাকা-খাওয়ার অন্য ব্যবস্থা ছিল। সবার সঠিক খবর বলা কঠিন। তবে একান্ত ব্যক্তিগত হলেও আমি বলতে চাই বাংলাদেশের রিলিফ কমিশনার হিসেবে নিয়োজিত থাকাকালীন আমি আমার এক পুত্র সমেত ৯৩/১এ বৈঠকখানা রোডে এক মেসে এক সিটে থাকতাম। মাসিক ভাড়া ৮ টাকা। কোনমতে কলকাতার মত স্থানে নিজেকে চালিয়ে বাকী টাকা পরিবারের জন্য পাঠাতে হতো। কষ্ট করেছি কম নয়। তবু এ কথা বলব, আমরা অনেকের চেয়েই ভালো ছিলাম। আমাদের মনে বুকভরা আনন্দ ছিল। দেশকে স্বাধীন করবো। স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ কজনের ভাগ্যে জোটে। তাই আমরা ধন্য।

জয় গোবিন্দ ভৌমিক
জুন, ১৯৮৪।