বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/৩৪

উইকিসংকলন থেকে

মোহাম্মদ হুমায়ুন খালিদ

 মেঘালয়ের তুরাতে এফ জে সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সেণ্টারে দীর্ঘ আট মাস মোটিভেশনের দায়িত্বে ছিলাম। এই কয়মাসে প্রায় ১৬ হাজার মুক্তিবাহিনীর সদস্য আমার হাত দিয়ে শপথ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ঢোকে। আমি নিজেও দীর্ঘ চার মাস গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করি। টাঙ্গাইলের গেরিলা নেতা কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে সর্বপ্রথম আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়। মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের ট্রেনিং গ্রহণ করার পর টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহের ভাল ভাল ছেলেদের সরাসরি কাদের সিদ্দিকীর নিকট পাঠিয়ে দেই।

 কাদের সিদ্দিকীর জন্য কিছু (উচ্চমানের) অস্ত্রশস্ত্র পাঠানোর ব্যাপারে আমি ভারতীয় উক্ত সেক্টরের বিগ্রেডিয়ার সাচ্চু সিংহের সঙ্গে দেনদরবার করি। এই খবর পাক বাহিনী পায়। ফলে আমার স্ত্রী-পুত্রপরিবারকে বন্দী করে তাদেরকে কঠোর ইণ্টারগেশন করে। অবশ্য অন্য কোন অত্যাচার না করে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। আমি এই খবর ভারতে থেকে পাই। আরো জানতে পারি যে পাক সেনারা আমার পালক পুত্র (কলেজের ছাত্র) সোহরাব হোসেনকে বন্দী করে টাঙ্গাইল জেলে রেখেছে।

 মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ আট মাসে মাইনকার চর, মহেন্দ্রগঞ্জ ও ডালুতে ঘুরে ঘুরে বেঙ্গল রেজিমেণ্ট, ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের সামনে বক্তৃতা করে উদ্বুদ্ধ করতাম। তারা বজ্রশপথে মাতৃভূমি উদ্ধারকল্পে বাংলাদেশে ঢুকতো। নাটিয়াপাড়া, বাঐখোলা, পাটখাগুড়ি, বাসাইল, হাতিবান্ধা ও মিরিকপুরে ১২ জন নিহত হয়। এদের সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গণহত্যার স্থান ছিল মিরিকপুর, বাসাইল। আমার পালিত পুত্রের বাবা খন্দকার শামসুর রহমানকে শুধু আমারই পালক পুত্রের বাবা হওয়ার অপরাধে ধরে এনে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসের সামনে নৃশংসভাবে জবাই করে হত্যা করা হয়।

 ৩রা এপ্রিল (যেদিন পাক বাহিনী টাঙ্গাইলে প্রথম ঢোকে) নাটিয়াপাড়াতে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তুমুল যুদ্ধ হয়। নাটিয়াপাড়া বাজার ও আশেপাশের বাড়িঘর পাক বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। আমার স্ত্রী বেগম রিজিয়া খালিদ পাক বাহিনীর হাতে থেকে মুক্তি পাওয়ার পর লজ্জায় অপমানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে চিকিৎসার জন্য তিনি ছদ্মনামে ঢাকা হলিফ্যামিলি হাসপাতালে ভর্তি হন। আমার প্রাক্তন ছাত্র (ডাঃ আবদুর রহমান) উক্ত হাসপাতালের ডাক্তার আমার স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেও রক্ষা করতে পারেননি। ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল শুক্রবার সকাল ন’টায় তিনি প্রাণত্যাগ করেন। মারা যাওয়ার প্রাক্কালে প্রকাশ পেয়ে যায় যে তিনি আমারই স্ত্রী এবং যখন তার লাশ টাঙ্গাইলে নেয়ার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়, পাক বাহিনীর কাছে তা অগ্রাহ্য হয়। ফলে একদিন পর ৪ঠা ডিসেম্বর আজিমপুর গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। সে সময় ঢাকায় ভীষণভাবে বোমাবর্ষিত হচ্ছিল। আমার স্ত্রীর এই অকালমৃত্যুর খবর আমি ঘাটাইলে পাই ১৩ই ডিসেম্বর, সর্বপ্রথম যখন আমি ভারত থেকে টাঙ্গাইলের দিকে আসছিলাম। কাদের সিদ্দিকীর উপস্থিতিতে ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে সর্বপ্রথম যে জনসভা হয় সেই সভায় আমি কোরান তেলাওয়াত করি এবং মর্মস্পর্শী বক্তৃতা দিই। এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম জনসভা। এই সভায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আমি মোনাজাত পরিচালনা করি তাতে সমস্ত জনসভা যেন কান্নার রোলে ফেটে পড়ে।

অধ্যক্ষ
এমসিএ (সাবেক এম এন এ)
টাঙ্গাইল