বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড)/৪২

উইকিসংকলন থেকে

ডঃ অজয় রায়

 ২৫ শে মার্চের কাল রাত্রিতে ইয়াহিয়ার সামরিক চক্রের চাতুরিতে ঢাকায় শিল্পী কামরুল হাসান অঙ্কিত ইয়াহিয়ার জানোয়ার মুখ উন্মোচিত হল। শুরু হল অপারেশন সার্চলাইট, হল নয় মাসব্যাপী গণহত্যাযজ্ঞের উদ্ধোধন- বাংলার রক্তে, বাঙালীর রক্তে।

 কামান, মর্টার আর মেশিনগানের বিকট কানফাটা গর্জনে সে রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গিয়িছিল। প্রচণ্ড শব্দে ভেঙ্গে গিয়েছিল জানালার কাঁচ। আর্ত মানুষের অসহায় চীৎকারকে ছাপিয়ে সারারাত ধরে শুনছিলাম আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ, ট্রাক ও ট্যাঙ্কের পদাচরণ ধ্বনি। শঙ্কিত চিত্তে আমরা অপেক্ষা করছিলাম যে কোন মুহুর্তে পৈশাচিক বাহিনীর উপস্থিতি। বুঝতে কষ্ট হয়নি সারারাত ধরে কিসের হোলি উৎসব- কাদের রক্তে ঢাকার রাজপথ পরিণত হচ্ছে রক্ত নদীতে।

 যা আমরা আশঙ্কা করেছিলাম অবেশেষে তাই ঘটল। সারাদেশের সাথে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও অপেক্ষা করছিলাম উদ্বেগব্যাকুল চিত্তে ইয়াহিয়া মুজিবের আলোচনার ফলাফল। অসহায়ভাবে লক্ষ্য করছিলাম ইয়াহিয়া সরকারের সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি। আমরা আশঙ্কা করছিলাম এ ধরেনের এক ভয়ংকর পরিস্থিতি, অনুমান করেছিলাম আসন্ন গণহত্যার পূর্বাভাষ। তাই মার্চের ২২/২৩ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও দেশের বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে গণহত্যার পূর্বাভাষ জানিয়ে আমরা প্রেরণ করেছিলাম জরুরী বার্তা ইউ, এন ও-র সেক্রেটারি জেনারেল ও বিশ্বের অন্যান্য নেতৃবর্গের কাছে। আমাদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না।

 সে রাত্রে পাকিস্তানের বীর জোয়ানেরা কত বাংগালীকে হত্যা করেছিল তার সংখ্যা হত্যাকারীরা ও বলতে পারবে না। শুধু এটুকু জানি- রাজারবাগে শত শত পুলিশ প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে নীলক্ষেত কমলাপুর এলাকার শত শত বস্তিবাসী, আত্মাহুতি দিয়েছে জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলের অসহায় ছাত্ররা, রাস্তার অসহায় নিরস্ত্র মানুষ আর রাস্তায় রাস্তায় বেরিকেড তৈরীরত শত শত সাধারণ মানুষ ও অকুতোভয় শ্রমিকেরা।

 সব রাতের শেষ আছে। ২৫ শে মার্চের কালরাত্রিও এক সময় পোহাল। দূরাগত আজানের ধ্বনি ভেসে আসল। না- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ থেকে সেদিন আজানের ধ্বনি উচ্চরিত হয়নি সাহস পাননি নামাজের আহ্বান জানাতে ধর্মপ্রাণ মুয়াজ্জিন। যেন মনে হল দূরাগত ঐ আজানের ধ্বনি মধ্যে সারা বাংলাদেশের কান্না ঝরে পড়ছে। এমন বিষদ আর ক্রন্দনময় আজান ধ্বনি জীবনে শুনিনি।

 রাত পোহাল, সকাল হল, ২৬শে মার্চের সকাল। সূর্যদেব কি সেদিন আমাদের সাথেও কেঁদেছিল, না রোষে গর্জন করে ছড়িয়েছিল দাবাগ্নি! পর্দা সরিয়ে দেখলাম আমাদের এলাকায় বেশ কিছু সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের উপস্থিত। দেখলাম মাঠের এককোণে জড় করা কয়েকটি মৃতদেহ, চোখের সামনে টেনে নিতে দেখলাম পাশের ভবনে একতলার অধিবাসী মুকতাতিদরের মৃতদেহ। কর্কশ কণ্ঠে নির্দেশ এল এলাকাবাসীদের প্রতি- অবিলম্বে কালপতাকা আর বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে ফেলার। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম জনৈক সৈনিক আমাদের ভবন শীর্ষ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। ভবনটি কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেল আমাদের ভবন শীর্ষেও বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে, ছেলেরা ২৩ মার্চ তারিখে উত্তোলন করেছিল আর নামায়নি। অতি সন্তর্পণে মিলিটারীর চক্ষু এড়িয়ে ছাদে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে পতাকাকে ধীরে নামিয়ে আনলাম। মুহুর্তে চিত্ত বেদনায় উদ্বেলিত হয়েছিল। ভেবেছিলাম এই পতাকা কি আবার কোনদিন তুলতে পারব।

 দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ডঃ মুর্তজাকে দিয়ে ও আরও কয়েকজনকে দিয়ে আমাদের ভবনের দিকে এল। আতঙ্কে অপেক্ষা করছিলাম যে কোন মুহুর্তে মৃত্যুদূতের আগমন। নীচের তলায় লোকজন ছিল না কিছুক্ষণ দরজায় লাথি মারল, সৌভাগ্য ওরা চারতলা পর্যন্ত উঠে এল না। একটু পরে লাশগুলি নিয়ে আমাদের উদ্দেশে পুনর্বার সাবধানবাণী উচ্চারণ করে ওরা স্থান ত্যাগ করল। আমরা বাঁচলাম।

 রেডিওতে ঘোষিত হল, অবাঙালী কণ্ঠে, কর্কশ আর ভাংগা বাংলায়, সারাদেশ কঠোরভাবে সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়েছে, রাস্তায় বা ঘরের বাইরে দেখা মাত্র গুলি করা হবে। পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী প্রতিরোধ আন্দোলনকে ভেংগে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ম্লান মুখে সহধর্মিণী পাশে এসে দাঁড়াল। উদ্বেগ ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল ‘বঙ্গবন্ধুর’ খবর কি? কি জবাব দেব! আমি ও ভাঁবছিলাম তার কথা। পেরেছেন কি নিজেকে বাঁচাতে? নিরাপদ স্থানে সরে গিয়েছেন কি! ভাবছিলাম অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কথা, ছাত্র নেতাদের কথা। পরে সন্ধ্যায় শুনলাম পাকিস্তানের প্রেসিডেণ্ট ইয়াহিয়ার রেডিও ভাষণ- সমগ্র পরিস্থিতির জন্য বাংগালী, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করে কুৎসিৎ ও অশালীণ ভাষায় আক্রমণ করলে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে স্বয়ংসিদ্ধ প্রেসিডেণ্ট কর্কশ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, “The man and his party are cncmics of Pakistan IIc had attacked the solidarity and integrity of Pakistan this crime will not go unpunished.” সেই কণ্ঠ এতদিন পরে আজ ও আমার কর্ণে ধ্বনিত হয়।

 এত নিরাশার মধ্যেও আশার আলোর ঝলকানি বয়ে আনল ‘আকাশবাণী’- ভেসে এল রেডিও তরংগে মধুর আশ্বাসবাণী “সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি”। আকাশবাণী জানাল পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ঢাকার আশেপাশে, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, য়শোর, চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে বাঙালী মুক্তিফৌজের যুদ্ধ চলছে। রাত্রে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা ও শোনাল একই বার্তা। এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ও আশ্বস্ত হলাম, না, বাঙালী রুখে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

 পরদিন ২৭শে মার্চ। কয়েক ঘণ্টার জন্য সান্ধ্য আইন শিথিল। ভীতসন্ত্রস্ত চিত্তে ছুটে গেলাম জগন্নাথ হলে ছোট ভাই বাবুর খোঁজ। বাবু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-ছাত্র লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। সারা হল এলাকা জনশূন্য-হল ভবনগুলি বিধ্বস্ত, অগ্নিদগ্ধ, রক্তাপ্লুত। নরমেধযজ্ঞের সাক্ষ্য হিসাবে তখন ও সিঁড়িতে, ছাদে, বিভিন্ন কক্ষে এখানে সেখানে পড়ে রয়েছে গুলিবিদ্ধ, বেয়োনেটবিদ্ধ অসংখ্য ছাত্রদের লাশ। রক্ত, মৃতদেহ আর বারুদের গন্ধে বাতাস ভরপুর। সামনে মাঠে সদ্যখাদিত এক গণকবর- অনেকেরই হাত পা বেরিয়ে রয়েছে। তখনকার মনোভাব আজ আর বুঝাতে পারবো না কেমন একটা আচ্ছন্ন ও মোহগ্রস্ততার মধ্য দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম বাবুর দোতালার ঘর পর্যন্ত। সারা ঘর বিপর্যস্ত রক্তাক্ত। পেলাম না তার মৃতদেহ সন্ধান। বুঝলাম বাবু আর ও অনেকের সাথে গণকবরের অভ্যন্তরে শায়িত।

 দেখা করলাম তখন ও জীবিত গৃহ শিক্ষকদের সাথে- রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক গোপাল কৃষ্ণ নাথ, জগন্নাথ হলের নরমেধযজ্ঞের একজন নীরব সাক্ষী, দেখা হল সংস্কৃতির অধ্যাপক রবীন্দ্র ঘোষ ঠাকুরের সাথে। মুখে কার ও কথা নেই, এরা সবাই দিশেহারা, স্তব্ধ, জীবন্বৃত। দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলে পথে নেমে পড়লাম। ঐ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা- জগন্নাথ হল মিনার এলাকা, ইকবাল হল, নীলক্ষেত এলাকা ঘুরে দেখলাম। খবর সংগ্রহ করলাম যথাসাধ্য। সব এলাকা অত্যাচারক্লিষ্ট। রমনা কালীবাড়ী, আনন্দময়ী আশ্রয়, শিববাড়ী, কোন এলাকাই রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি রোকেয়া হল সংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর আবাস এলাকাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব ভবন ও শক্তির দাপটের সাক্ষ্য বহন করেছে।

 পথে পথে মিলিটারী- চোখ চোখ তাদের দানবীয় দৃষ্টি। দৃষ্টিতে ঝরে পড়েছে ঘৃণা। তার মধ্য দিয়ে ক্লান্ত-ম্লান বিষণ্ন মুখে ফিরে এলাম বাসায়। এলাকা প্রায় জনশূন্য। সহকর্মীরা চলে গেছেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। উদ্বিগ্ন মাতা, উৎকণ্ঠিতা স্ত্রী জানতে চাইলেন আমরা কোথায় যাব? বুঝতে পারছিলাম নিরাপত আশ্রয়ে চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু কোথায় যাব? ঢাকার, বাংলাদেশের কোন স্থান আজ নিরাপদ? একবার ভাবলাম নদীর ওপারে জিঞ্জিরার দিকে যাওয়ার, যেদিকে সবাই যাচ্ছে। কিন্তু মিলিটারী চক্রব্যূহ ভেদ করে হাঁটাপথে সদরঘাট পর্যন্ত যাওয়ার ঝুঁকি অনেক, আর সেদিকের ও যেকি অবস্থা কে জানে। পরে শুনেছিলাম পলায়নপর নিরস্ত্র জনতার ওপর সদরঘাট এলাকায় নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে অসংখ্য নরনারী- এই পিশাচ বাহিনী।

 বেলা বারোটার দিকে এলেন সহকর্মী অধ্যাপক রফিকুল্লাহ আমাদের খোঁজে। জানালেন তারা আশ্রয় নিয়েছে ওর বড় ভাইয়ের ওখানে আমাদেরকেও সেখানে নিয়ে যেতে এসেছেন। আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই পুনরাই কার্ফিউ জারী হবে, অতএব আর দ্বিধা না করে একরকম এক বস্ত্রেই গৃহত্যাগ করলাম।

 সেই কাল রাত্রিতে ও পরদিন জগন্নাথ হল ও তার আশেপাশের এলাকায় যে নির্মমতম হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তার প্রত্যক্ষদর্শী জগন্নাথ হলের তৎকালীন ছাত্র কালীরঞ্জন শীল হলে থেকে ও সেদিন অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন।

 শ্রী শীল সেই রাত্রে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হলে ও পরদিন সকালে মিলিটারীর হাতে ধরা পড়ে যায়। তাকে ও অন্যান্য অনেককে দিয়ে জগন্নাথ হল ও আশেপাশের এলাকা থেকে লাশ বহন করানো হয়েছিল। মিলিটারীর আনাগোনা কমলে তিনি সুইপারদের বস্তিতে একটি বাথরমে লুকিয়েছিলেন। পরে জনৈক ব্যক্তি সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে বুড়িগংগার তীরে পৌঁছে দেয়। জগন্নাথ হলে আক্রমণের আর একজন সাক্ষী ঐ হলের গৃহশিক্ষক শ্রী গোপাল কৃষ্ণনাথ।

 সেদিন পঁচিশে মার্চের রাত্রিতে ‘অপারেশন সার্চ লাইটের’ মেঠোকর্মিরা ও অধিনায়কগণ অপারেশন সম্পর্কে অয়ারলেসের মাধ্যমে কথোপকথন করেছিলেন তা জনাব জামিল চৌধুরী (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় সম্প্রচার একাডেমীর পরিচালক) ও আর ও কয়েকজন রেকর্ড করেন।

 ২৭ শে মার্চ থেকে শুরু হল আমার পলাতক জীবন, আত্মগোপনের পালা। ঢাকার নানা স্থানে কখনও সপরিবারে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালিয়ে বেড়িয়েছি। পরে জেনেছি বিশ্ববিদ্যালয় আবাসে একাধিকবার মিলিটারী আমার সন্ধানে গিয়েছিল। বহুবার বিপদের মধ্যে পড়েছি। তবু সাহস করে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি সে সময় দেখেছি ওদের অত্যাচারের নানা রূপ অসহায়ভাবে। ওদের নারকীয় কাণ্ডকারখানা আর অত্যাচার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছি। সেই দুঃসময়ে ঢাকার আত্মগোপনে যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও আমাকে এবং আমার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছিল, নানাভাবে সাহায্য করেছিল তাদের কথা কোনদিন ভুলব না। ভুলব না ডঃ আজাদের কথা, ডঃ ওবাইদুল হকের কথা, ডঃ মুর্তজার কথা, অধ্যাপক এ, বি এম হবিবুল্লাহর কথা।

 অনেকবার বিপদের মধ্যে পড়েছি। একদিনের কথা বলি- দিনটি ছিল ১১ই এপ্রিল। ধানমণ্ডী আবাসিক এলাকায় এক পরিচিত বন্ধু পাট ব্যবসায়ীর ওখানে সপরিবার আশ্রয় নিয়েছিলাম কয়েক দিন আগে। বিকাল সাড়ে তিন বা চারটার দিকে একটি মিলিটারী জীপ কয়েকজন সেপাই ও অফিসারসহ বাসায় এল। আমরা উৎকণ্ঠিত ও শঙ্কাকুল চিত্তে অন্দরমহলে অপেক্ষা করছি। এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণপরে পরে ওরা চলে গেল। গৃহকর্তা জানালেন ওরা জানতে চাইল এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অধ্যাপক আশ্রয় নিয়েছে কিনা।

গৃহকর্তা অনেক কষ্টে তাদের বিদায় করতে সমর্থ হয়েছেন অন্ততঃ সাময়িকভাবে। তিনি আরও জানালেন আমাদের সেখানে আর থাকাটা নিরাপদ নয়। ভাবলাম আবার যদি তারা ফিরে আসে তবে সবাই বিপদে পড়ব। এদিকে বিকেল ৫টায় আবার কার্ফিউ বলবৎ হবে, নতুন আশ্রয় স্থল খোঁজার সময় নেই। বন্ধুকে জানালাম যে আজ রাতের জন্য আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসই হবে সবচাইতে নিরাপদ স্থান,কেননা, যদি ওরা আমরা সন্ধানেই এসে থাকে তাহলে নিশ্চয় তারা ওখানে প্রথম খোঁজ করে এসেছে। ৫টার একটু আগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বাসায় এসে আশ্রয় নিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তখন শ্মশানের নীরবতা, জন প্রাণী নেই, দু’একটা কুকুর কেবল ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন বাতি না জ্বালিয়ে সেই রাতে আমরা কাটালাম ভয়ে ভয়ে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ কোন বিপদ ঘটেনি। পরদিন আবার নতুন আশ্রয়ের সন্ধনে বেরিয়ে পড়লাম। আর একদিনের কথা- আজিমপুর এলাকায়। একটি গলির ভেতর একটি মেসে আশ্রয় নিয়েছি একা। রাতে এগারটার দিকে বেশ হৈ চৈ- চারদিকে চুটাছুটি, বন্দুকের গুলি। কিছুক্ষণ পর বুঝা গেল সমস্ত এলাকা মিলিটারী কর্ডন করেছে। ঘরে ঘরে তল্লাসী চলছে। মেসের অধিবাসী আমরা ক’জন আতঙ্কিত হয়ে অপেক্ষা করছি। কখন দুশমনদের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু আমাদের মেসে ওদের পদার্পণ ঘটেনি। পরদিন সকালে জানা গেল আশেপাশে এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন যুবক ও ছাত্রকে তারা ধরে নিয়ে গেছে। ভাবলাম এদের মধ্যে ক’জন জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারবে!

 ২৭শে মার্চ সন্ধায় বিবিসি রেডিও অস্ট্রেলিয়ার বরাত দিয়ে জানাল যে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং তিনি চট্টগ্রাম রয়েছেন। অপরদিকে রেডিও পাকিস্তান ক’দিন ধরেই বলে চলেছে শেখ সাহেবকে ২৬শে মার্চ তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২৮শে মার্চ বিকেল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার কথা (শেখ সাহেবের পক্ষে) আমরা শুনলাম। এই দু’টি ঘোষণাই আমাদের বন্দী অসহায় জীবনে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল বলাই বাহুল্য।

 প্রায় প্রতিদিন কোন কোন এলাকায় নরহত্যা সংঘটনের খবর পেতে থাকলাম। শুনলাম ২৯শে মার্চ রাত্রে শাঁখারী বাজার ও তাঁতী বাজার এলাকায় হিন্দু নরনারীদের শেয়াল কুকুরের মত হত্যা করা হয়েছে। এপ্রিলের মাঝামাঝিতে একদিন সাহস করে একা একা তাঁতী বাজার গেলাম। সেখানে আমার পূর্বপরিচিত জগন্নাথ কলেজের প্রধান ইতিহাসের অধ্যাপক নারায়ণ সাহা থাকেন তাঁর সন্ধানে। দেখলাম সারা এলাকা নিস্তব্ধ। ওর বাড়ী ফাঁকা। গলির মোড়ে এক পান বিড়ির দোকানে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম ওদের কথা। জানাল ওরা জিঞ্জিরায় চলে গেছে। নদীর ওপারে। সে আরও জানাল যে, তাঁতী বাজার আর শাঁখারী বাজার এলাকা এখন অবাঙালীরে দখলে, অধিকাংশ হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়ী ওদের দখলে। আমাকে ওদিকে যেতে নিষেধ করল। শাঁখারী বাজার এখন ‘টিক্কা খান রোড'।

 ২৮ শে মার্চ রাত্রে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে তোপ দেগে গুঁড়িয়ে দেয় হল। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতীক আমাদের সংগ্রামের প্রতীক এখন মসজিদে রুপান্তরিত। রিক্সা করে একদিন ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার কালে দেখলাম কারা যেন সবুজ রঙে বাংলা ও উর্দু বড় বড় হরফে লিখে রেখেছে “মসজিদ-মসজিদ”। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক রাত্রে ডিনামাইট দিয়ে ঐতিহাসিক রমনা কালী মন্দির উড়িয়ে দেয় হল ধূলিস্যাৎ করা হলেআনন্দময়ী আশ্রম। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে খবর পেলাম মোহাম্মদপুর এলাকার অনেক বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে। শোনা যেতে লাগল প্রতি রাত্রেই কোন না কোন অঞ্চল থেকে লোক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে- এর সাথে চলছে লুটপাট, আর নারী নির্যাতন। শিশুরা ও বাদ পড়ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ-স্কুলের ছাত্রীরাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সারা ঢাকা শহর ক্রমশঃ পরিণত হচ্ছে একটি বন্দিশালায়।

 এর মধ্যে আর একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছিল। অবাঙালীদের পাশাপাশি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলসমূহ প্রতিদিনই মিছিল ও শোভাযাত্রা বের করতে শুরু করেছে পাক বাহিনী ও সরকারের সমর্থনে। এদের অনেকেই চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে সংঘটিত নৃশংসভাবে তথাকথিত অবাঙালী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশন ও বক্তৃতা, বিবৃতি দিতে শুরু করল। এর প্রতিক্রিয়া ঢাকাতে অনুসৃত হল আরও বাঙালী নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। শোনা যাচ্ছিল নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদীতে, ঢাকায় বুড়িগংগা নদীতে প্রতিদিনই অসংখ্য লাশ একত্রে বাঁধা অবস্থা ভেসে যায়। ঢাকা অবরুদ্ধ, বাংলাদেশ বাইরের জগতে থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। স্থির করলাম বাংলাদেশের প্রকৃত শাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সম্পর্কে, গণহত্যা সম্পর্কে বহির্বিশ্বকে যে করেই হোক জানাতে হবে। নরহত্যা ও নির্যাতন সম্পর্কে সংগৃহীত তথ্যের একটি প্রতিবেদন তৈরি করলাম উপরোক্ত মেসের একজন রুমমেটকে দিয়ে। তার অফিস থেকে গোপনে কয়েক কপি টাইপ করলাম। যে করেই হোক এই প্রতিবেদন বাইরে পাঠাতে হবে। ডঃ আজাদের সাথে যোগাযোগ করলাম তাঁর প্রতিষ্ঠানে তখন ও ২/১ জন বিদেশী রয়েছন যারা এখনও ঢাকা ত্যাগ করেননি, তবে শীঘ্রই করবেন। একদিন বিকেলে ওদের একজনের সাথে ডঃ আজাদসহ দেখা করলাম। সবকিছু জানালাম এবং এ ব্যাপারে তার সহয়তা কামনা করলাম। তিনি সানন্দে রাজী হলেন এবং কিছু ছবিও তুলেছেন। এ সবই তিনি আমেরিকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন এবং যাওয়ার সময় আরও তথ্য প্রদান করলে নিয়ে যাবেন সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির সহায়তায়। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আমাদের প্রথম কাজ শুরু হল। তিনিও জানালেন যে তিনি চলে গেলে ও একজনকে বলে যাবেন আমাদের সাথে যোগযোগ স্থাপনের জন্য।

 এদিকে ২৬ শে মার্চ থেকেই নরহত্যার পাশাপাশি বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধে প্রাথমিক পর্ব শুরু হয়ে গেছে। ঢাকা ছাড়া বাংলাদেশর সর্বত্র পাক বাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। ইপিআর, পুলিশ, ইবিআর,প্রাক্তন সৈনিক, ছাত্র,জনতার মধ্য থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থানীয়ভাবে মুক্তিফৌজ গড়ে উঠেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার মারফত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম ও পারিপার্শ্বিক এলাকায় মেজর জিয়াউর রহমান ও ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা মেহের পুর সীমান্তে মেজর ওসমানের নেতৃত্বে;ময়মনসিংহে মেজর শফিউল্লিাহর নেতৃত্বে;ব্রাক্ষণবাড়িয়া, আখাউড়া এলাকায় মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে; সিলেট অঞ্চলে মেজর দত্তের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। এই নামগুলি সেদিন অবরুদ্ধ ঢাকাবাসীর ছিল প্রেরণার উৎস।তখনই স্থির করেছিলাম পাকিস্তানী অধিকৃত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর চাকুরী নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে কোন কাজ করাই হবে পবিত্রতম কর্তব্য। প্রথম দিকে স্থির করেছিলাম ঢাকাতেই আত্মগোপন করে অবস্থান করে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে কাজ কারার চেষ্টা করব সীমিত সাধ্য নিয়ে। কেননা এটি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে আমাদের প্রাথমিক প্রতিরোধ টিকবে না, ভেঙ্গে পড়বে। গেরিলা যুদ্ধই হবে আমদের ভরসা, আর এজন্য প্রয়োজন দেশের অভ্যন্তরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও থেকে যাওয়া। তাই সেই দুর্যোগকালে ও কয়েকজন সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম ঢাকায় থেকে প্রতিরোধের সপক্ষে কোন কিছু করা যায় কিনা। কিন্তু অবস্থা ক্রমশঃ খারাপ হতে লাগল। কার ও সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। ঢাকায় অবস্থান করাও অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। প্রতিরাতেই ঢাকার কোন কোন এলাকা পাকিস্তানী হামলার শিকার হচ্ছিল।

 বুঝতে পারছিলাম সপরিবার ঢাকায় আর থাকা নিরাপদ নয়। শুভানুধ্যায়ীরা বিশেষ করে ডঃআজাদ পরামর্শ দিলেন ঢাকা ছেড়ে মুক্তাঞ্চলে চলে যাওয়ার। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অসুস্থ স্ত্রী আর বৃদ্ধামাতাকে নিয়ে। ১১ই এপ্রিল আকাশবাণীর মারফৎ জানলাম মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার কথা। ইতিমধ্যে স্বাধীনতার কথা ঘোষিত হয়েছে— যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। পরে আগরতলায় আমার এক ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা সঞ্জয়ের সাথে দেখা হওয়ায় তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা নোয়াখালী শহরে কিভাবে স্বাধীনতার কথা জানতে পারে। সে আমায় জানিয়েছিল যে, ২৭শে মার্চ সকাল থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এ সম্পর্কে মাইকযোগে প্রচার করতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধুর বাণী সম্বলিত একটি হ্যাগুবিল জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তার মতে বঙ্গবন্ধুর এই বাণীটি টেলিগ্রাফ অফিসের কর্মচারীরা পান এবং তারা নেতৃবৃন্দকে জানান। এ ঘটনা থেকে আমার মনে হয় বঙ্গবন্ধুর বাণীটি চট্টগ্রামে ধৃত হওয়ার পর টেলিগ্রাফ ও অয়ারলেসের কর্মচারীবৃন্দ বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করেন। তারা আবার অন্যান্য স্থানের সাথে যোগাযোগ করে। এই বাণী এভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচারিত হয়। আরও অনেকর কাছ থেকে একই ধরনের কথা শুনতে পাই।

 ২২শে এপ্রিল। অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ যোগাযোগ করলেন একটি দুঃস্থ অসহায় হিন্দু পরিবারের জন্য আশ্রয় খুঁজতে হবে। ভদ্রলোক একজন সরকারী চাকুরে। তাঁকে কয়েকদিন হল মিলিটারী ধরে নিয়ে গেছে। আর ফিরে আসেননি। সকন্যা মহিলা বিপদে পড়েছেন। কন্যাটির প্রতি মিলিটারীর নজর পড়ছে। মিলিটারীর লোকজন প্রতিদিন আগাগোনা করছে, আর ভয় দেখাচ্ছে। টাকা দাবী করছে বাবাকে ছেড়ে দেবে এই বাবদে। মিসেস আব্বাসের সাথে যোগাযোগ করে ওদের একটি আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলাম। আজিমপুরায় আমার এক পরিচিত হিন্দু সরকারী কর্মচারী পালাতে পারেননি, সরকারী নির্দেশে আবার কাজে যোগ দিয়েছেন। কয়েকজন অবাঙ্গালী তাকে ভয় দেখাচ্ছে, তারা বৈকালিক চা-পানের উদ্দেশ্যে। খবর পাঠিয়েছেন মেয়েটির জন্য কিছুদিনের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সুলতানার সাথে যোগাযোগ করলাম। ও রাজী হল মেয়েটির একটি সুব্যবস্থা করার। আজিমপুরায় যে মেসে থাকতাম সেখানকার একজন একদিন সন্ধ্যায় জানালেন- তাকে তার অফিসে জনৈক অবাঙ্গালী কর্মচারী ভয় দেখাচ্ছে যে তিনি মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগাযোগ রাখছেন- টাকা চাইছে। স্থির করেছেন মুক্তাঞ্চলে চলে যাবেন, মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবেন। সব ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। পরদিন সকালেই চলে যাবেন। সকালে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলাম। তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

 স্থির হয়েছিল এপ্রিলের শেষে ঢাকা ত্যাগ করব। পুরানো এক রাজনৈতিক কর্মীবন্ধু মেসেজ পাঠিয়েছেন অবিলম্বে মুক্তাঞ্চলে সরে যাওয়ার জন্য। আমার জন্য ঢাকায় থাকা আর কিছুতেই নিরাপদ নয়। বার্তাবাহক সব ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু উদ্যোগ ব্যর্থ হল। মিলিটারী ব্যূহ ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হল না। অর্ধপথ থেকে ফিরে এলাম আবার ঢাকায়। এবার অন্য সূত্র ধরলাম।দাউদকান্দি থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে ভিতরে এক গ্রামে আমার স্ত্রীর দূর সম্পর্কের এক মামা থাকেন। সেখানে যাওয়া স্থির করলাম। ডঃওবাদুল হকের অফিসে ঐ অঞ্চলের কর্মচারীর সন্ধান পাওয়া গেল।সে খবর নিয়ে জানাল আমাদের আত্মীয়রা গ্রামে আছেন ওদিকে মিলিটারীর দৌরাত্ম্য নেই।মুক্তাঞ্চল বলা চলে।সে আমাদের ওখানে নিয়ে যেতে রাজী হল।ওর নাম নুরুল ইসলাম। স্থির হল নারায়ণগঞ্জথেকে লঞ্চ বা নৌকায় আমরা ঐ গ্রামের দিকে যাব।ডঃআজাদ পরামর্শ দিলেন হিন্দু পরিচয়ে কিছুতেই যাওয়া যাবেনা। যেতে হলে মুসলমান পরিচয়ে।কিন্তুবিপত্তি হল মাকে নিয়ে। মা কিছুতেই প্রথম জিজ্ঞাসাতে মুসলমান নাম বলতে পারেন না, মুখ দিয়ে আসল নাম বেরিয়ে আসে। অতএব স্থির হল আমরা রাস্তায় জিজ্ঞাসাবাদের পাল্লায় পড়লে নেটিভ ক্রিশ্চিয়ান পরিচয় দেব। নাম স্থির করার প্রয়োজন নেই। ক্রিশ্চিয়ানরা বাংলা নামেই পরিচয় দেয়। হলিক্রস কলেজের পরিচিত এক সিষ্টারের কাছ থেকে ‘ক্রশ’, কিছু বাংলা ও ইংরেজী বাইবেল ও অন্য পুস্তুক যোগাড় হল। মা ও স্ত্রী ‘ক্রশ’ঝুলালেন গলায়। স্থির হল ১৫ই মে আমরা ঢাকা ত্যাগ করব। ডঃ আজাদ ওর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী হিসাবে পরিচয় পত্র জোগাড় করে দিলেন।

 ঢাকা ত্যাগের কয়েকদিন আগে চক্ষু চিকিৎসক ডঃআলিম চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি পূর্ব পরিচিতি অসহায় আন্দোলনের সময়েই তার সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। তাঁকে সব জানালাম। তিনি সেদিন বলেছিলেন যে তাঁর প্রকাশ্য রাজনৈতিক কোন পরিচয় নেই উপরন্তু তিনি চিকিৎসক, কাজেই ঢাকায় থাকা তাঁর জন্য অতটা বিপদজনক নয়। স্থির হল তিনি ঢাকায় আগত গেরিলাদের যোগাযোগকারী ব্যক্তি হিসাবে কাজ করবেন। তাদের আশ্রয়, প্রয়োজনে চিকিৎসা ঔষধ পত্রাদি যোগানোর ব্যাপারেঅন্যান্যদের সহায়তায়। ডঃআজাদের সাথে যোগাযোগ রাখার কথাও তাঁকে বললাম। আর ও কয়েকজনের সাথে এ ব্যাপারে দেখা করলাম। সরকার ঘোষণা করেছে ১লা জুলাইর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য। যাওয়ার কয়েকদিন আগে বিভাগীয় প্রধান ইন্নাস আলীর সাথে দেখা করলাম তাঁর আজিমপুরস্থ অস্থায়ী বাসভবনে। তিনি পাকিস্তানীদের গুলিতে আহত হয়েছিলেন, তখন নিরাময়ের পথে। সাশ্রুনেত্রে বিদায় জানালেন, মাথায় হাত রেখে আশীর্বাণী উচ্চারণ করলেন।

 বিদায়ের মুহুর্ত এগিয়ে এল। ডঃআজাদ ও ডঃহক নিবিড় আলিঙ্গনে বিদায় জানাল- আশার বাণী উচ্চারণ করল আবার দেখা হবে- হয়তো মুক্তদেশে। ডঃআজাদকে আর একটি প্রতিবেদন হস্তান্তরিত করলাম বাইরে পাঠাবার জন্য। দেশ মুক্ত হবার পর অনেকের সাথে দেখা হয়েছিল কিন্তু এই নীরব দেশকর্মীর সাথে আর দেখা হল না। চিরতরে তিনি হারিয়ে গেলেন। পথে কোন বিপদ হয়নি। কেবল পাগলার ওখানে আমাদের গাড়ী আটকিয়ে জনৈক মিলিটারী অফিসার আমার পরিচয় ও কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করেছিল। মাকে দেখিয়ে বলেছিলাম ওঁকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনিয়েছিলাম গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। আমরা মুক্তি পেলাম। নদীর ধারে গেলাম অসংখ্য লাশ পড়ে রয়েছে। চারদিকে শকুনের উল্লাস। অনেকগুলি নারায়ণগঞ্জ অভিমুখি বাস আটকানো- যাত্রীদের পথের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। শেষ পর্যন্ত ওদের কি হয়েছিল জানি না।

 অবশেষে নারায়ণগঞ্জ থেকে লঞ্চ ও নৌকাযোগে আমরা আমাদের উদ্দিষ্ট গ্রামে পৌঁছালাম নূরুল ইসলামের সহয়তায়। আসবার সময় শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে ভেসে যেতে দেখলাম অসংখ্য মৃতদেহ নূরুল ইসলাম জানাল দিন কয়েক আগে নারায়ণগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকায় মিলিটারী অপারেশন হয়েছে- এ তারই ফলশ্রুতি।

 আমাদের আত্মীয়রা আমাদের গ্রহণ করল সাদরে। অনেকদিন পর মার মুখে দেখলাম আশ্বস্তির ঝিলিক। দাউদকান্দি থেকে বেশ কয়েক মাইল গভীরে গ্রামটি। যাতায়াতের সুবিধা নেই তাই আপাতদৃষ্টিতে নিরাপদ। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের একটি ভাল আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।গ্রামবাসীদের অনেকে এবং আশেপাশের গ্রামসহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ থেকে পলাতক এবং স্থানীয় ছাত্র আমার সাথে যোগাযোগ করল- ঢাকার অবস্থা জানতে চাইল। ওরা জানাল যে আশেপাশের গ্রাম মিলে ওরা একটি ছোটখাটো মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের বড্ড অভাব। পরামর্শক্রমে ঠিক হল আপাততঃ সশস্ত্র প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এখন কেবল সংগঠন গড়ে তোলা আর চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা বিশেষ করে দাউদকান্দিতে ঘাঁটি স্থাপন করা পাক বাহিনীর গতিবিধির ওপর। স্থির হল ১০/১২ জনের একটি দল ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে চলে আসবে। ওরা ফিরে এলে আর একটি দল যাবে এবং ক্রমান্বয়ে এই প্রক্রিয়া চলবে যতদিন না স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়।

 কয়েকদিন গ্রামে কাটালাম। একদিন রাতে দাউদকান্দি কুমিল্লা মহাসড়কের দুপাশে কয়েকটি গ্রামে মিলিটারী অপারেশন চালাল। এর ঢেউ আমাদের গ্রামেও এসে লাগল। গ্রামবাসীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। বিশেষ করে হিন্দু জনসাধারণ। আমার আত্মীয়রাও স্থির করল ওরা ভারতে চলে যাবে কিছু দিনের মধ্যেই। তাই স্থির করলাম ভারতে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার। স্থির হল ২২শে মে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করব। স্থানীয় মুক্তিবাহির একটি ছোট দল আমাদের সাথে যাবে তবে ওরা ভিন্ন পথে, আমরা মিলিত হব সি এণ্ড বি রোড পার হয়ে গোমতী নদীর ওপারে। গভীর রাত্রে একজন পথ প্রদর্শক সাথে নিয়ে আমরা আবার পথে নামলাম। দীর্ঘপথ কখনও হেঁটে, কখনও নৌকাযোগে পেরিয়ে আশ্রয় নিলাম চান্দিনার কাছে এক গরীব নাপিতের বাসায়। পরদিন রাত্রে আমরা অতিক্রম করলাম সবচাইতে বিপজ্জনক পথ চান্দিনা কুমিল্লা রোড এবং পরে সি এণ্ড বি রোড। অতিক্রম করলাম গোমতী নদী, ওপারে মুক্তিবাহিনীর দলটির সাথে দেখা হল। আমরা সেখান থেকে বুড়িচং হয়ে নয়নপুরের কাছ দিয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করলাম। প্রণাম জানালাম দেশের মাটিকে। চোখে জল এল। ভাবছিলাম আবার কি ফিরে যেতে পারব জন্মভূমির কোলে। দুপুরে আমরা পৌঁছালাম সীমান্ত শহর সোনামুড়ায় ২৪শে মে। ছোট শহরে ভরে গেছে বাংলাদেশ থেকে আগত হাজার হাজার শরণার্থীতে। আপাততঃআশ্রয় পেলাম স্ত্রীর দূর সম্পর্কের বোনের বাসায়। দেখা হল আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সংসদ সদস্য অধ্যাপক খুরশীদ আলমের সাথে। তিনি পূর্বপরিচিত। মুক্তিবাহিনীর ছোট দলটির আগমনের উদ্দেশ্য ওকে জানালাম, ওরা আশ্রয় পেল যুবশিবিরে। কয়েকদিন অধ্যাপক আলমের সাথে কাজ করলাম রিক্রুটিং সেণ্টারে। দলে দলে যুবকরা আসছে সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। এদের রাজনৈতিক মতবাদ ভিন্ন, কিন্তু মাতৃভূমি উদ্ধারে দৃপ্ত শপথে সকলেই বলীয়ান। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সদাসতর্ক যেন উদ্বাস্তুদের সাথে পাকিস্তান চর বা গোয়েন্দা অনুপ্রবেশ না করতে পারে। একদিনের ঘটনা- বিকেলে থানা থেকে জনৈক পুলিশ এসে আমাকে জরুরী প্রয়োজনে থানায় নিয়ে এল থানা অফিসার জানালেন যে তারা গোয়েন্দা সন্দেহে কয়েকজনকে আজ আটক করেছে- সবাই পরিচয় দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে। আমি সনাক্ত করতে পারি কি না। সন্দেহের কারণ ওদের সাথে রয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের রাস্তা ঘাট ও নদীপথের মানচিত্র। আমার সাথে ও ধরনের কিছু ম্যাপ ও কাগজপত্র ছিল। ডঃআজাদ অন্যান্যদের সহযোগিতায় জোগাড় করে ঢাকা ত্যাগের সময় আমাকে দিয়েছিলেন মুক্তিবাহিনীর লোকজনদের কাজে লাগাতে পারে এই ভরসায়। ছাত্রদের সাথে থানা হাজতে কথা বলে সন্দেহমুক্ত হলাম, ওরা প্রকৃতই ছাত্র। কয়েকজন আমাকে চিনতে ও পারল। ওরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে এসেছে। অফিসারকে বলায় ওরা মুক্তি পেল কিছুক্ষণ পরে।

 মুক্তিযুদ্ধে আরো সক্রিয়ভাবে কাজ করতে চাই। তাই পরদিন আমরা এলাম আগরতলায়। সপরিবারে আশ্রয় নিলাম আগরতলায় কলেজের উদ্বাস্তু শিবিরে। কলেজের হোষ্টেলের একটি কামরায় আমাদের স্থান করে দিলেন সুপার শ্রী ভট্টাচর্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নানা ভাবে এবং উদ্বাস্তুদের দেখাশুনার ব্যাপারে শ্রী ভট্টাচার্য যে অমূল্য অবদান রেখেছেন তা আমি আজ ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। হাজার হাজার শরণার্থী- সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক। দেখা হল ছাত্রনেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন সহ বেশ ক'জন ছাত্রনেতার সাথে, দেখা হল জনাব জিল্লুর রহমান ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে। নেতাদের জানালাম যে আমি ভারতে এসেছি উদ্বাস্তু হিসাবে থাকার জন্য নয়, মুক্তিযুদ্ধে কাজ করতে।

 সেদিন বিকেলে ভারতীয় চলচ্চিত্র, ডকুমেনটেশন বিভাগ আমার একটি সাক্ষাৎকার চিত্রায়িত করল। ঢাকা ও বাংলাদেশের যে গণহত্যা চলেছে তার একটি বিশদ বিবরণ দিলাম। এই চিত্রায়ন পরে ভারতের নানা স্থানে প্রদর্শিত হয়েছিল। পরদিন ছিল নজরুল জয়ন্তী, সত্যবাবুর উদ্যোগে উদ্বাস্তু ও যুবশিবিরের ছাত্ররা অনুষ্ঠান করল। আমরা অনেকেই বক্তৃতা করলাম। দেখা হল চট্টগ্রামের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীর সাথে। তাঁকে সব জানালাম। তিনি পরামর্শ দিলেন কোলকাতায় চলে যাওয়ার জন্য। সেখানে মুজিব নগরস্থ বাংলাদেশ সরকার ও ডঃ এ আর মল্লিকের সাথে দেখা করার জন্য। সেখানে আমাদের মত লোকের নাকি বিশেষ প্রয়োজন।

 স্থির করলাম কোলকাতা চলে যাওয়ার। কয়েকদিন শরণার্থী শিবির ও যুবশিবির ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশ থেকে আগত বিভিন্ন অঞ্চলের লোকজনদের কাছ থেকে বাহিনীর অত্যচার সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করলাম। দেখা হয়েছিল দেবদাস চক্রবর্তী ও ডঃ এস আর বোসের সাথে। সমস্যা দেখা দিল অসুস্থ স্ত্রী ও মাকে নিয়ে। ওঁদের চিকিৎসা ও বিশ্রামের প্রয়োজন। স্থির হল আসামে শিবসাগরে কর্মরত বড় ভইয়ের কাছে মা ও স্ত্রীকে রেখে আমি কোলকাতায় চলে যাব। চিঠি লিখলাম কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনে ডঃ এ আর মল্লিকের কাছে আমার আসামের ঠিকানা জানিয়ে। প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় আসামে পৌঁছলাম কয়েকদিন পরে। কিন্তু আসামে এসে বিপদে পড়লাম আসাম কর্তৃপক্ষ আদেশ জারী করেছেন উদ্বাস্তুদের সব রকম চলাচল নিষিদ্ধ করে। বড় ভাই চেষ্টা করতে লাগলেন আমার কোলকাতা যাওয়ার অনুমোদন লাভের। দেরী হচ্ছিল। এরই মধ্যে ডঃ আনিসুজ্জামান এবং ডঃ মল্লিকের পক্ষ থেকে তার কন্যা আমার ছাত্রী সেলিনার চিঠি পেলাম। ত্বরিত কোলকাতা যাওয়ার কথা দু'জনেই লিখেছেন। অনেক নাকি কাজ। আসাম সরকারেরও অনুমতি পাওয়া গেল।

 কোলকাতার পথে গৌহাটিতে একদিন অবস্থান করলাম। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালী শিক্ষকদের সাথে দেখা করলাম। ওদের আসামে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টির প্রয়াসে কাজ করার আবেদন জানালেন। তড়িঘড়ি করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওরা একটি সভারও আয়োজন করল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বক্তব্য রাখলাম, আসামবাসীদের সহযোগিতা কামনা করলাম। আসাম থেকে এলাম উত্তরবংগে। শিলিগুড়ি, রামগঞ্জ প্রভৃিতি সীমান্তে অবস্থিত শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ইত্যাদি ঘুরে দেখলাম। যতদুর পারি বিভিন্ন অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহ করতে চেষ্টা করলাম। বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ঘুরে খেলাম আর একটি উদ্দেশ্য ছিল পিতৃদিবের সন্ধান। মুক্তিযুদ্ধে আরম্ভ হওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২৫শে মার্চে তিনি ছিলেন দিনাজপুর, আর আমারা ঢাকায়। কোথাও তার সন্ধান মিলল না। আবশেষে দিনাজপুর সীমান্তের কাছাকাছি মুক্তিযোদ্ধাদের এক শিবিরে তার সন্ধান পেলাম। দিনাজপুর শহরের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জানাল যে বাবা গ্রামের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা আরো জানাল যে সেই গ্রামটি বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ভাল আশ্রয়স্থল বাবা মুক্তিযোদ্ধদের নিরাপদ আশ্রয় দান ইত্যাদি কাজে ব্যাপৃত রয়েছেন।

 অবশেষে কোলকাতা পৌছলাম জুন মাসের মাঝামাঝিতে। আশ্রয় পেলাম মাসীমার ভবানীরপুরস্থ বাসায়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সাথে দেখা করলাম তিনি আমাকে বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং সেলের সাথে যুক্ত থেকে কাজ করার নির্দেশ দিলেন। যোগাযোগ হল ডঃ এ আর মল্লিক ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ খান সারওয়ার মুর্শিদ, আধ্যাপক আলী আহসান ও আন্যান্য আনেকের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের কাজে সর্বাত্বকভাবে নেমে পড়লাম। ডঃ আনিসুজ্জামান সরকারের বিশেষ কাজে জড়িয়ে পড়ায় মে মাসে গঠিত বাংরাদেশ শিক্ষক সমিতির সম্পাদকের দায়িত্ত আমার উপর বর্তাল।

 অবরুদ্ধ ঢাকয় অবস্থানকালে ও বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নারকীয় হত্যার আকটি প্রতিদেন আমরা তৈরী করেছিলাম। তার সংক্ষিপ্তসার এখানে উল্লেখিত হল। এই প্রতিবেদনে আমরা পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ বহু ব্যাক্তি, সংঠন ও সরকারের কাছে প্রেরণ করি।


 ঢাকর ঘটনাঃ ২৫শে মার্চ জগন্নাথ হল ও তৎপপার্শ্ববর্তী এলাকায় সংগঠিত হয় সবচাইতে বড় নরহত্যা। জগন্নাথ হলের যে সব নিহত ছাত্র ও কর্মচারির নাম সংগ্রহ করা হয়েছিল- সর্বশ্রী স্বপন চৌধুরী (ছাত্রনেতা গণপতি হালদার, সুশীল দাশ (সহ-সাধারন সম্পাদক), রমণীমোহন ভট্টাচার্য, রণদা রায়, সুভাষ চক্রবর্তী, প্রবীর পাল, কিশোর মোহন সরকার, ভবতোষ ভৌমিক, বরদা কান্ত তরদার, সত্যদাস, কার্তিক শীল পল্টনদাস, কেসব চন্দ্র হালদার, নির্মল কুমার রায়, সুজিত দত্ত, রবীন্দ্র রায়, বিধান ঘোষ, মৃনাল বোস, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, অজিত রায় চৌধুরী, সত্যনাগ, রুপেন্দ্র সেন, মুরারী বিশ্বাস, বিমল রায়, প্রদিপ নারায়ণ রায় চৌধুরী, নিরঞ্জন চন্দ্র, সুব্রত সাহা, প্রিয়নাথ (৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারী), দুখী রাম (৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী), সুনিল দাস (৪থ শ্রেণীর কর্মচারী), শংকর মোদক (৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী) খগেন্দ্র চন্দ্র দে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী, মতিলাল দে (৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী), রাজভর (৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী), লতিফুর রহমান (অতিথি ছাত্র), বদরুদোজ্জা (অতিথি ছাত্র), মহতাব উদ্দিন (অতিথি ছাত্র), এবং আরও বহু ছাত্র যাদের নাম সংগ্রহ করা আর কোনদিনই হয়ত সম্ভব হবেনা।

 এছাড়া ইকবাল হলেও বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী এবং আশ্রয়প্রার্থী বস্তি এলাকার অসংখ্য নরনারী।

 এই গনহত্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও যে সব কর্মচারী নিহত তারা হলেন: মধুদে- সকলের মধু দা, বিশ্বদ্যিালয়ের ক্যাণ্টিনের মালিক ও তার স্ত্রী, বড় ছেলে এবং পুত্রবধু, ননীরাজভর, রোকেয়া হলের দারোয়ান ও স্ত্রী ও সকল সন্তানসন্ততি, খগেন দে, দর্শন বিভাগের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী, শামসুল মোল্লা ইকবাল হলের দারোয়ান, রোকেয়া হলের দারোয়ান মইনুদ্দিনের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও পুত্রবধু, চুন্নু মিয়া, রোকেয়া হলের মালী আব্দুল খালেক, রোকেয়া হলের মালী, পিয়ার মোহাম্মদ, রেজিস্ট্রার অফিসের পিয়ন ২৭ শে মার্চ ঢাকা থেকে পালাতে গিয়ে রাস্তয় নিহত হয়।

 এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব ভবনে পাঁচটি মৃতদেহ পাওয়া যায়। এদের ৪ জন হল ক্লাবের বেয়ারার, অন্যজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি- সম্ভবত ওদের কারও অতিথিঃ আব্দুল মজিদ, সিরাজুল হক, সোহরাব হোসেন, আলী হোসেন।

 ২৫শে মার্চ থেকে ২৯ শে মার্চের মধ্যে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা বা আহত করা হয়েছিল:

 প্রফেসর গোবিন্দ চন্দ্র দেব, উপমহাদেশের প্রখ্যাত দার্শনিক ও দর্শন বিভাগের পধান। ২৬ শে মার্চ প্রাতঃকালে প্রার্থনারত অবস্থায় প্রথমে বন্দুকের গুলিতে পরে সঙ্গিনের খোঁচায় হত্যা করা হয়। তার মুসলিম পরক পুত্রকে ও হত্যা করা হয় একই সাথে। মুহাম্মদ মুনিরুজ্জমান, পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান, তকে তার ভই, এক ছেলে ও ভইপোসহ ২৬ শে মার্চের সকালে হত্যা করা হয়। মুহাম্মদ মুকতাদির, ভূতত্ত্ব বিভাগের সিনিয়র লেকচারার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড আবাসিক এলাকায় তার বাসভবনে ২৬ শে মার্চ সকালে হত্যা করা হয়। শ্রী অদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্চ, লেকচারার পলিত পদার্থবিদ্যা বিবাগের গৃহশিক্ষক জগন্নাথ হল। হলের মধ্যে তার বাস ভবনের বাথরুমের লুকিয়ে ছিলেন ২৫ শে মার্চ রাতে সেনবাহিনীর লোকজন ওখোনে তাঁকে হত্যা করে। ডক্টর জোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রীডার ইংরেজী বিভাগ, প্রোভস্ট জগনাথ হল; ২৬ শে মার্চ সকালে হত্যা করা হয়। শ্রী অনুদ্বৈপায়ন ভট্টচার্য অধ্যাপক রাজ্জাক ও মিসেস গুহঠাকুরতা তাবেবাসায় য়য়ে আসেন। ২৭ শে মার্চ সকালে হাসপাত নিয়ে যাওয়া হয়, ২৯শে মার্চ হাসপাতালে মারা যান। মুহাম্মদ সাদেক, ডাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী স্কুলের শিক্ষক, ফুলার রোড এলাকায় তার বাসভবনে তাকে হত্যা করা হয়। ২৭ শে মার্চ সকালে তাকে বাসভবনের পিচনের মঠে কবরস্থ করা হয়। ড. ফজলুর রহমান, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র ললেকচারার, তাকে এবং তার এক ভাইপোকে নীলক্ষেত এলাকায় তার বাসভবনে হত্যা করা হয়। একই সাথে এ ভবনের ছাদে আশ্রয় নেয়া অসংখ্য বস্তিবাসীকেও হত্যা করা হয়। ঐ সব লাশ দীর্ঘদিন ধরে ছাদে পড়ে ছিল। জনাব এ আর খান খাদিম, পদার্থবিদ্যা বিভাগের লেকচারার, ঢাকা হল (শহীদুল্লাহ হল) সংলগ্ন কর্মচারীদের আবাসস্থলের তাকে ২৬শে মার্চ হত্যা করা হয়। জনাব শরাফত আলী লেকচারার গণিত বিভাগ, একই স্থানে একই সময় তাকে ও হত্যা করা হয়। এছাড়া এই স্থানে আরও তিনজকে হত্যা করা হয় যাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ড. মুহাম্মদ শহাদত আলী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনষ্টিটিউট সিনিয়র লেকচারার ২৬শে এপ্রিল ডাকা থেকে তার বাড়ী নরসিংদী যাওয়ার পথে পাক ফৌজের হাতে নিহত হন।

 ঐ কাল রাত্রিতে এবং তৎপরবর্তী নিম্নলিখিত শিক্ষকগণ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিলেন:

 প্রফেসর এম ইন্নাস আলী, পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী। আধ্যাপক ও তদীয় পুত্র ফিরোজ আলীকে পাক বাহিনীর একটি দল ২৫শে মার্চ রাত্রে নীলক্ষেতস্ত বাসভবনে প্রবেশ করে তাদের প্রতি লক্ষ করে গুলি করে। এর ফলে তারা ইভয়েই আহত হন। পরে তাদের হাসপাতপলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সেখানে আরোগ্য লাভ করেন। অধ্যাপক এ কে রফিকুল্লাহ রীডার পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ৩১ শে মার্চ জিঞ্জিরা থেকে সপরিবারে নৌকাযোগে পলায়ন কালে পাক বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। প্রফেসর এম এন হুদা অর্থনীতির অধ্যাপক, ২৫শে মার্চ রাত্র জগন্নাথ হলের নিকট তার বাসভবনে ঢুকে তার প্রতি গুলি ছোড়া হয়- সৌভাগ্যবশত তিনি রক্ষা পান। প্রফেসর মফিজুল্লাহ কবীর, ইতিহাসের অধ্যাপক ও সলিমুল্লাহ হলের প্রভোষ্ট, শহীদ মিনারের নিকট তার বাসভবনে ২৫ শে মার্চ গভির রাত্রে আত্মগোপন করে রক্ষা পননি। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, রাষ্ট্রবিজ্ঞাণ বিভাগের অধ্যাপক ২৫ শে মার্চ রাত্রে শহীদুজ্জামনের নিকটস্থ তার বাসভবনের একটি কক্ষে আত্মগোপন করে অলৌকিকভাবে রক্ষা পান।

 সে সময় ঢাকায় আর যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেনঃ কমাণ্ডার মোয়াজ্জম হোসেন, তথাকথিত আগরতলা মামলা ২নং আসামী। ২৫শে মার্চ রাত্রিতে তাকে তার বাসভবনে থেকে টেনে বের করে এনে উন্মুক্ত রাজপথে গুলি করে মারা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা উদ্দীপনায় কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের অবদান অমুল্য। অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, বিখ্যাত সধনা ঔষদালয়ের প্রতিষ্ঠাতা; ৩১ শে মার্চ গেণ্ডারিয়ায় তার বাসভবনে এই অশীতিপর বৃদ্ধকে নৃসংশভাবে হত্যা করা হয়। ড. এস দে বিসিএসআইআর প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী; এপ্রিল মাসে গেণ্ডারিয়ার বাসভবনের কাছে তাঁকে হত্যা করে তাঁর মৃতদহ লোহার পুলের কাছে ফেলে রাখা হয়। ড.শৈলেন ভদ্র, শল্যচিকিসক, শাখারী বাজারের নিকটে তার বাসভবনে ৩১ শে মার্চ পাক বাহিনী তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা মির্জাপুর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা, সম্ভবত এপপ্রিল মাসের মাঝমাঝি সময়ে তাঁকে ও তাঁর পুত্রকে গভর্নর ভবনে ডেকে আনা হয় সেখান থেকে বের হবার পর সেনাবাহিনীর লেকজন ওদের ধরে নিয়ে যায়- সম্ভবত ক্যাণ্টনমেনটে পিতা পুত্র উভয়কে হত্যা করে। শহীদ সাহেবের, সাংবাদিক ও সাহিত্যিক কিছুদিন যাবৎ মানসিক রোগে ভুগছিলেন। ৩১ শে মার্চ সকালে সংবাদ অফিস ভবনে অগ্নিসংযোগ করে পাক বাহিনী সদস্যরা তাকে পুড়িরে মারে। জহিরুল আসলাম, ঔপন্যাসিক ও সাংস্কৃতিক, সংগঠক, জিঞ্জিরায় ২রা এপ্রিল তারিখে পাক বাহিনী যে বর্বর নরহত্যাকাণ্ড চালায় তাতে তিনি অন্য অনেকের সাথে নিহত হন। মেহেরুন্নেছা, কবি ও রেডিও মেকানিক, ২ মে মার্চ তাকে বর্বর পাক বাহিনীর সদস্যরা মা ও ছোট ভাইসহ নির্মম অত্যাচারের পর হত্যা করে। আবু তালিব দৈনিক ইত্তিফাকের সাংবাদিক, ২৯শে মার্চ মিরপুর এলাকায় পাক বাহিনীর কতিপয় অবাঙ্গালী অনুচরদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। ডা. আজহার আলী, রেডিওলজিস্ট, নভেম্বরের মাঝামঝি সময়ে খুব সম্ভব ১৬ই নভেম্বর তাকে পাক বাহিনীর অনুচরেরা বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। তার মৃতদেহ ফকিরাপুলের কাছে পাওয়া যায়। ডা. হুমায়ুন কবীর, সদ্য পাশ করা ডাক্তার, ডা. আজহার আলীর সাথে একই সময়ে তাঁকে হত্যা করা হয়। এ দুটি হত্যার খবর আমরা কলকাতয় পাই- ডাকায় যোগাযোগ রক্ষাকারী গেরিলা ইউনিটের কাছ থেকে নভেম্বারের শেষে। ২৮শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চের মধ্যে ইত্তেফাক,পিপলস ও সংবাদ অফিস ভবন পাক বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। বেশ কজন লোক এইসব অফিসে নিহত হয়। ঢাকা থেকে আগত লোক মারফত খবর পাওয়া গেল নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঘোড়াশাল ন্যাশনাল জুট মিলের বেশ ক'জন বাঙালী কর্মচারীকে পাকিস্তানী সৈন্যরা গুলি করে মেরেছে।

অন্যান্য অঞ্চলে অনুষ্ঠিত গণহত্যার স্বাক্ষর

 নানা সূত্র থেকে আমরা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে অনুষ্ঠিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সংবাদ সংগ্রহ করি:

 চট্টগ্রাম ও আশপাশের অঞ্চলঃ শ্রী পিসি বর্মন, লোকহিতৈষী চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসী, চট্টগ্রামে মাচের শেষের দিকে সশস্ত্র সংগ্রামের সময় তার বাসভবনে পাক বাহিনী তকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর পুত্রও সম্ভাবত নিহত হয়। জনাব আলী ইমাম, চট্টগ্রাম স্টেট ব্যাংক শাখার কর্মচারী; মার্চ এপ্রিলে পাক বাহিনীর হাতে নিহত হন। কাজী হাসান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছত্র; প্রতিরোধ যুদ্ধকালে লালখা ঁবাজারে স্বীয় বাসভবনে পাক হানাদারদের হাতে মৃত্যুবরন করেন। শ্রী নতুন চন্দ্র সিংহ, কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, একই সময়ে স্বীয় প্রতিষ্ঠনে এই সত্তুর বছর বয়স্ক বৃদ্ধকে বর্বরভাবে হত্যা করা হয়। কাওসার আহমেদ, চট্টগ্রাম পিআইএ অফিসের তরুণ কর্মচারী। বর্বর পাক বাহীনীর সদস্যরা বিমান বন্দ থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। সঠিক সময় জানা যায়নি। শ্রী বীরেন্দ্র লাল চৌধুরী, প্রবর্তক সংঘের নিবেদিতপ্রাণ বৃদ্ধ পুরুষ; এপ্রিল -মে মাসে এই সংসারত্যাগী বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে পাক বাহিনীর জল্লাদেরা নির্মমভাবে হত্যা করে। শ্রী শান্তিময় খাস্তগীর, কানুনগোপাড়া কলেজের অধ্যক্ষ; কলেজের অফিসে কর্মরত অবস্থায় পাক বাহিনীর নির্মম জল্লাদের গুলিতে শহীদ হন। ঘটনাটি ঘটে ৩১শে জুলাই শ্রী অবণীমোহন দত্ত, চট্টগ্রাম সরকারী কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অবরুদ্ধঅবস্থায় চট্টগ্রাম শহরে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। পালাননি বা পালিয়ে যেতে পারেননি। বাসা থেকে তাকে ও তার ভাইপোকে জল্লাদেরা ধরে নিয়ে যায়, আর ফিরেত পারেননি। চিরতরের জন্য হারিয়ে গেছেন।

শামসুদ্দিন আহমদ, ইঞ্জিনিয়ার কাপ্তাই জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান কর্মকর্তা, সম্ভবত জুলাই আগস্ট মাসে বর্বর পাক সৈন্যের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। জনাব শামসুল হক, চট্টগ্রামের এসপি; স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে তাকে পাক সৈন্যেরা হত্যা করে। শ্রী খগেন্দ্রনাথ সিংহ চট্টগ্রাম সিগনেট লাইব্রেরীর মালিক। এপ্রিল-মে মাসের দিকে তিনি পাক বাহিনীর ঘাতকদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। জনাব আব্দুল খালেক, চট্টগ্রাম কোতোয়ালীর তরূণ ওসি, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ইপিআর বাহিনী পশ্চাদপসারণ করলে তিনি চাচার বাসায় আশ্রয় নেন গ্রামে। সেখান থেকে ১৬ই এপ্রিল ধরে নিয়ে এসে অত্যাচারের মাধ্যমে তাঁকে ২২শে এপ্রিলের দিকে তাকে পাক বাহিনী ধরে নিয়ে যায়, আর কোন দিন ফিরে আসেননি। শামসুল আবেদীন, চট্টগ্রাম হাবিব ব্যাংক শাখার একজন অফিসার; তাঁকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল পাক বাহিনীর সৈন্যরা এপ্রিলমে মাসের দিকে। ফিরতে পারেননি। ডা. শফি, দন্তচিকিৎসক, মার্চ-এপ্রিলে পাক বাহিনীর জল্লাদেরা তার জীবন নির্বাপিত করে দেয় বন্দুকের গুলিতে।

 অবরুদ্ধকালে কুমিল্লা শহরে যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি পাক বাহিনীর হাতে নিহত হন তাদের মধ্যে সে সময় আমরা যাদের নাম সংগ্রহ করতে পেরেচিলাম তারা হলেনঃ

 শ্রী বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ; মার্চ মাসে তাঁকে কুমিল্লা ক্যাণ্টমেণ্টে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শ্রী অতীন্দ্র ভদ্র, শহরের বিশিষ্ট আইন ব্যবসায়ী; একই সময়ে তাকেও ক্যাণ্টনমেণ্টে নিয়ে হত্যা করা হয়। শ্রী অসীম রায় কুমিল্লা ভিক্টরীয়া কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের ল্যাব শিক্ষক, প্রবীণ রাজনীতিবিদ অতীন রায়ের পুত্র, একই সময়ে পাক বাহিনীর হাতে ধৃত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শোনা গিয়েছে কুমিল্লার তৎকালীন পুলিশ সুপার ও ডিসি নিহত হন সে সময়ে।

 অন্যান্য অঞ্চলে নিহত বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গঃ অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যারয়ের গনিত বিভাগের প্রধান, ১৬ই এপ্রিল তাঁকে সেনাবাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে যায়। আর ফিরে আসেননি। শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার, সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ই এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীয় বাসভবন থেকে তাঁকে চিরকালের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় জনাব মামুন, ডিআইজি, রাজশাহী, ২৬শে মার্চ তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পরে পাক জল্লাদ বাহিনী তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জনাব নজরুল হক সরকার, রাজশাহী বারের এডভোকেট, জেলা আওয়ামিলীগের সভাপতি, ২৫শে মার্চের পরে কোন এক সময় পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নিহত হন। লেঃ কঃ মঞ্জুরুর রহমান অধ্যক্ষ ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ’ ১৮ই এপ্রিল তাঁরিখে তাঁর কলেজের বাংলোর সামনে মাঠে তাকে বর্বর পাক বাহিনী হত্যা করে। জনাব হালিম খান, অধ্যাপক ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ; একই তারিখে একই স্থানে এই অধ্যাপককেও হত্যা করা হয়। এ সময় একই সাথে কলেজের কয়েকজন ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীকে হত্যা করা হয়। জনাব মাশুকুর রহমান, গনিতজ্ঞ, চট্টগ্রামে একটি বীমা কোম্পানীর পদস্ত অফিসার ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনকালে যশোরের বাড়ীতে চলে যান’ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামে শহীদ হন। জনাব আব্দুল জব্বার, বগুড়া শহরের এডভোকেট; ১৭ই মে তাঁকে পাক হানাদার বাহিনী তাঁর গ্রামের বাড়ীতে হত্যা করে। ডা.জিকরুল হক, সৈয়দপুর শহরবাসী, সংস্কৃতিবান, আওয়ামী লীগ সদস্য, এপ্রিল মাসে তাঁকে আরও কয়েকজন সহকর্মীর সাথে পাকহানাদার বাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসে বন্দী করে রাখে, ১২ই এপ্রিল এদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। লেঃ মোহাম্মদ আনোয়ারুল আজীম, উত্তরবঙ্গস্থ গোলাপুর সুগার মিলের প্রশসিক, ৫ই মে ঐ মিলে দ্বিশতাধিক শ্রমিক ও কয়েকজন অফিসারসহ তাকেও পাক বাহিনীর বর্বর সদস্যরা হত্যা করে। ডা. শামসুদ্দিন, সিলেট মেডিকেল কলেজের প্রফেসরঃ ৯ই এপ্রিল আরও কয়েকজন হাসপাতাল কর্মীর সাথে তাঁকে পাক বাহিনীর ঘাতকরা হত্যা করে। এঁদের মধ্যে ছিলেন ডা. শ্যামলকান্তি লালা। ডা. লেঃ কঃ জিয়াউর রহমান, সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ্য, জুলাই সাসের শেষ দিকে পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে তাঁর বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায়, আর ফিরে আসেননি। ডা. লেঃ কঃ নুরুল আবসার মো: জাহাঙ্গীর; ৩০শে মার্চ ঢাকা ক্যাণ্টনমেণ্টের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়, আর ফিরে আসেসননি। খুব সম্ভব তাঁকে কুমিল্লা ক্যাণ্টনমেণ্টে হত্যা করা হয়। মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া, রংপুর শহরবাসী, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সদস্য, ৩০শে মে আরও কয়েকজন পরিবারের সদস্যদের সাথে তিনি পাক বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন। এছাড়া এপ্রিল মাসে শহরের ১১ জন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে একত্রে বেধে হত্যা করে নরপিশাচেরা। জনাব মশিউর রহমান, যশোরের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা; ৪ঠা এপ্রিল তিনি পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। বেশ কিছুদিন তাঁকে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে অমানুষিক অত্যাচারের পর সম্ভবত ২৮/২৯ এপ্রিল নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যশোর শহরের পলিটেকনিক স্কুলের প্রিন্সিপালকে ৬/৭ই এপ্রিল হত্যা করে। একই সাথে তাঁর বন্ধু ডঃ ওবায়দুল হককেও গুলি করে মারে পাক জল্লাদরা। জেলা জজ সাহেবের নাজির; তাঁকে একই সময়ে পথিমধ্যে পাক বাহিনীর সৈন্যরা হত্যা করে। জনাব আহসানুল্লাহ, খেজুরা গ্রাম, সম্ভ্রান্ত কৃষক, এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঐ গ্রামে প্রবেশ করে পাক সৈন্যরা সস্ত্রীক আহসানুল্লাহকে হত্যা করে এবং তাঁর বাড়ী লুট করে। যশোরের কসবা এলাকায় পোষ্টাল সুপারিনটেণ্ডণ্টের পুত্রসহ সাতজনকে একই সাথে গুলি করে মারে পাক সৈন্যরা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে। জনাব এ করিম, সাব ইন্সপেক্টর অব পুলিশ, যশোহর; এপ্রিল মাসে তাঁকে কোর্টের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই সময়ে জনৈক বৃদ্ধ উকিলকেও নিহত করে পাক সেনারা। বসন্ত কুমার দাস, সাবজজ, যশোর; ১লা মে তারিখে আরও ১১ জন ব্যাক্তির সাথে পাক বাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেন তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া যশোর শহরের আরও ১৭ জন বিশিষ্ট নাগরিককে হত্যা করে এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে। জনাব আহসান আলী, জামালপুরবাসী, ন্যাপ নেতা ও সাংবাদিক, ২৮শে জুলাই মাসে পাক বাহিনীর কুখ্যাত অনুচর আলবদরের হাতে তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন, বাগেরহাট পিসি কলেজের অর্থনীতি অধ্যাপক, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২৮শে অক্টোবর নিহত হন পাক বাহিনীর অনুচরদের গুলিতে। অধ্যাপক ফজলুল হক, গণিতের অধ্যাপক, রাজশাহী সরকারী মহাবিদ্যালয়, ২৫শে এপ্রিল তাঁর নওগাঁর বাসভবনে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করেন। জল্লাদেরা একই সাথে তাঁর মা, বোন ও ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। জনাব আব্দুল কাইয়ুম মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নভেম্বর মাসে তাঁকে পাক হানাদার বাহিনীর নরপশুরা বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, দর্শনের অধ্যাপক, কুষ্টিয়া কলেজ; ২৮শে জুন তারিখে তাঁকে পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আর কোনোদেন ফিরে আসেননি। জনাব মহসীন আলী দেওয়ান, বগুড়া-শেরপুর কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ্য ৩রা জুন বগুড়ার বাসভবন থেকে বর্বর পাক সেনারা তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, আর ফেরেননি। শ্রী সুমঙ্গল কুণ্ডু, দিনাজপুর বারের এডভোকেট, ৯/১০ই এপ্রিল দিনাজপুর শহরে আরও কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের সাথে তাঁকে পাক বাহিনীর অনুচরেরা নির্মমভাবে হত্যা করে। এছাড়া দিনাজপুর শহরের আশেপাশে অনেক গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং অসংখ্য নারীপুরুষকে মেশিনগানের গুলিতে সারিবদ্ধভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের সর্বত্র হাজার হাজার লোক ঐ সময় পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর গুলির শিকার হয়েছেন, বহু নারী নির্যাতিতা ও ধর্ষিতা হয়েছেন। এই হিসাব হয়তো আর কোনাদিদনই পাওয়া যাবে না।

 বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির কর্ম তৎপরতা: “বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি” একাত্তরের মে মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালযের দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং এ সর্বস্তরের দেশত্যাগী শিক্ষদের সমাবেশে গঠিত হয়। সে সভায় একটি কার্যকরী সংসদও নির্বাচিত হয়। সভাপতিঃ ডঃ এ আর মল্লিক, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। কার্যকরী সভাপতিঃ জনাব কামারুজ্জামান, ঢাকা জুবিলি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং সংসদ সদস্য। সহসভাপতি: ড. ফারুক খলিল, অধ্যাপক গণিত বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যক্ষ দেওয়ান আহমেদ। সম্পাদক: ড. আনিসুজ্জামান, রীডার বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পরে জুলাই মাস থেকে ড. অজয় রায়, রীডার, পদার্থবিদ্যা বিভাগ, ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়, সহসম্পাদকঃ জনাব গোলাম মুর্শিদ, শ্রী রাম বিহারী ঘোষ ও জনাব এস এম আনোয়ারুজ্জামান। কোষাধ্যক্ষ: ড. খান সারওয়ার মুর্শেদ, অধ্যাপক ইংরেজী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সদস্য ১২ জন।

 এই সমিতি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিলঃ (১) মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে সর্বস্তরের শিক্ষক সমাজকে সংগঠিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন কার্যে নিয়োজিত করা। (২) ভারতবর্ষসহ দেশবিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা। (৩) মুক্তিযুদ্ধ ও বাংরাদেশ সম্পর্কিত তথ্যমুলক রচনা, পুস্তিকাদি প্রকাশ করা ও অন্য সংগঠনকে প্রকাশ করতে সহায়তা করা। (৪) শরণার্থী শিক্ষকদের অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা ও সম্ভাব্য আর্থিক অনুদান। (৫) প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সহায়তা দান এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনীয় বেসামরিক উপকরণ সংগ্রহ ও বিভিন্ন রনাঙ্গনে প্রেরণ করা। (৬) প্রচারনা ও মনস্তাত্বিক যুদ্ধে সহায়তা করা।

 ইতিপূর্বে এপ্রিল মাসে “কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি” কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের উদ্যোগে গঠিত হয়। এই সমিতির প্রধান কর্মকর্তারা ছিলেনঃ সভাপতিঃ আধ্যাপক সত্যেন্দ্র নাথ, উপচার্য, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কার্যকরী সভাপতি অধ্যাপক পিকে, বোস, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। কোষাধ্যক্ষঃ শ্রী এইচ এম মজুমদার, উপ-উপাচার্য (অর্থ সংক্রান্ত), কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্পাদকঃ অধ্যাপক দীলিপ চক্রবর্তী, অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ, সিটি কলেজ, কোলকাতা। এখানে উল্লেখ্য যে এই দুই সহযোগী প্রতিষ্ঠান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করে যায়। প্রায় একই সাথে সকল স্তরের বুদ্ধিজীবিদের সংগঠন বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইণ্টেলিজেণ্টশিয়া গড়ে তোলা হয়। এর সভাপতি ছিলেন ডঃ খান সারওয়ার মুর্শেদ, সম্পাদক সহসম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান ও ড. বেলায়েত হোসেন। এখানে উল্লেখ্য যে, এই সংগঠনের প্রযোজনায় জহির রায়হান 'Stop Genocide' ছবিটি নির্মাণ করেন। তরুণ লেখক ও সাংস্কৃতিসেবীদের উদ্যোগে গঠিত হয় “বাংলাদেশ সাংসাংস্কৃতিক সংগ্রাম শিবির প্রমুখ অনেকই এর সাথে যুক্ত ছিলেন। এই সংঠন মুলত কাজ করেছে- যেসব স্থানে শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সাথে স্থানীয় জনগণেরে শান্তি, সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িক ঐক্য বজায় রাখার লক্ষে, তারা নানা স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা প্রচার করত। এছাড়া গঠিত হয় সাংবাদিক সমিতি ‘চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি’ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি’ বাংলাদেশ ভলাণ্টিয়ার্স কোর প্রভৃতি।


 শিক্ষক সমিতি গঠিত হওয়ার সাথেই সমিতির প্রতিনিধিরা শরণার্থী শিবিরসমুহে ঘুরে এবং তালিকাভূক্ত হয়েছিলেন এদের মধ্যেঃ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ১৫০ কলেজ শিক্ষ ১০৫০; স্কুল শিক্ষক ৫০০০। সমিতি গঠিত হওয়ার সাথে সাথেই দুটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সরকার ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ কামনা করে সমিতির সভাপতি প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি প্রেরন করেন।

 ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারী প্রতিনিধিদল অন্তর্ভুক্ত ছিলেনঃ বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির পক্ষে ড. এ আর মল্লিক ও ড. আনিসুজ্জামান, আর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির পক্ষে ড. অনিরুদ্ধ রায়, অধ্যাপক অনিল সরকার, সৌরিন্দ্রঃ ড. এ আর মল্লিক, ড. আনিসুজ্জামন ও জনাব কামরুজ্জমান।

 বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের সহযোগিতা কামনা করে সমিতি একটি ছাপানো আবেদনপত্র বিভিন্ন দেশের শিক্ষকদের ও শিক্ষক সংগঠনের কাছে প্রেরণ করে। আবেদনটি ছিল নিম্নরুপঃ

BANGLADESH SIKSHAK SAMITI
(Bangladesh Teachers Association)
Darbhanga Building, Calcutta University, Calcuua-12. India

Dear Friend, July 1, 1971

 Perhaps you are aware that in face of unparalleled atrocities committed by the Pakistan Army on the people of Pakistan, now Bangladesh, a large number of teachers of all levels has crossed into India. Since the communities of teachers had played a significant role for over two decades in the movement for democracy. secularism and a just social order in for in the country, its members became naturally cnough a special target of the Pakistan Army, Many teachers have been killed, others who are trapped in the occupied Zone are being harassed and persecuted a few have been forced at gin point to issue statements in support of the action of Pakistan Army. As a result, members of this harassed community are trekking into India every day. The teachers from Bangladesh, now in temporary exile in India. have formed an association of their own, on whose behalf we are writing you today.

 About 100 University teachers, 1000 College teachers, and 3000 school teachers have registered their names with us, Several thousand others in different bordering state of India are yet to make contact with the Association. Most of these teachers have come with their families and all without any means to support themselves.

 Having regard to the contribution that this community has made in the past and their expectant role in the reconstruction of society as and when the country achieves freedom, it is felt that we make all efforts to save it from impending doom. We drawn up a number of schemes for providing the teachers with temporary academic occupation research Publication and teaching the evacuee children in the refugee camps. The execution of this programme will require financial assistance from non-Government sources, in addition to what the Government of India the Government of Bangladesh may be in a position to make.

 In the circumstances we appeal to you the members of the academic community the world over to contribution generously to the fund of our association. Contributions may be sent to the Bangladesh Sikshak Samiti, Darbhanga Building, Calcutta University, Calcutta 12 India.

Sincerely yours
Dr. A R. Mallik
Vice-Chancellor.
University of Chittagong
&
Bangladesh Shikshak Samiti.
 সমিতি বিভিন্ন সময়ে ভারতের নানা স্থানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও সহায়মা কামনায় বিভিন্ন প্রতিনিধী প্রেরণ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ জুন মাসে প্রেরিত উত্তর ভারত প্রতিনিধিদল। ড. এ আর মল্লিক, ড. আনিসুজ্জামান ও জনাব সুবিদ আলী এমপিএ। এই দলটি এলাহাবাদ, আলিগড়, দিল্লি-আগ্রা ও লক্ষণৌ প্রভৃতি অঞ্চল সফর করে। জুলাই মাসে প্রেরিত মধ্যপ্রদেশ প্রতিনিধিদলঃ মাজহারুল হক, ড.অজয় রায়, অধ্যাপক সামসুল আলম সায়িদ। এঁরা জববলপুর, ভূপাল, উজ্জয়িনী, রেয়া, রায়পুর প্রাভৃতি অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। সেপ্টেম্বর মাসে প্রেরিত মহারাষ্ট্র প্রতিনিধিদলঃ ডঃ এ আর মল্লিক ও অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বম্বে সহ মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন। এছাড়া ঐ মাসে অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম কেরালা ভ্রমণ করেন। এছাড়াও বাংলোদশ সম্পর্কিত নানা সভা ও সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক সমিতি প্রতিনিধি প্রেরণ করে। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে যে প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন এতে সমিতির ড. এ আর মল্লিক অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

শরণার্থী শিক্ষকদের অস্থায়ী পুনর্বাসনের জন্য সমিতি কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেঃ

(1) শিবিরসমুহে ক্যাম্প স্কুল স্থাপনঃ আগরতলাসহ মেঘালয়, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র সিমান্ত এলাকায় অবস্থিত শরণার্থী শিবির সমুহে সমিতি বেশ কিছু ক্যাম্প স্কুল স্থাপন করে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্কুল ও শিক্ষকের অস্থায়ী প্রতি এলাকায় একজন করে উপপরিচালক ও ছিলেন। সার্বিক দায়িত্ব ও সমন্বয় সাধনের জন্য একটি উপদেষ্টা কমিটি ছিল, যার সদস্য ছিলেন ডঃ অজয় রায়, জনাব নূর মোহাম্মদ মিঞা এবং শ্রীমতী সুচন্দ্রিমা রায়।
(2) যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ উদ্বাস্ত পুনর্বাসন প্রকল্পঃ এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল উদ্বাস্তদের সমস্যা সংক্রান্ত তথ্য আহরন ও যুদ্ধ শেষে উদ্বাস্তদের ত্বরিত পুনবসিনে সহয়তা দানের জন্য কর্মপন্থা নির্ধারণ। এই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন প্রফেসর মোশাররফ হোসেন।
(3) উদ্বাস্ত ও যুব শবিরসমুহে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গতিময়তা (Socio- Cultural Dynamics: এর পরিচালক ছিলেন ডঃ এ আর মল্লিক এবং উপপরিচালক ছিলেন শ্রী অনুপম সেন।
(4) ভাংলাদেশে স্কুল ও কলেজ স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষাদান সমস্যাঃ পরিচালক ছিলেন ড. অজয় রায়।
(5) উদ্বাস্ত শিবিরসমুহ থেকে লোকসাহিত্যের উপকরণ সংগহঃ পরিচালক ড.মাজহারুল ইসলাম।

 বাংলাদেশ সরকারের প্লানিং সেলের সহযোগিতায় এইসব প্রকল্প তৈরী করা হয়। এই সব প্রকল্পের মধ্য দিয়ে সমিতি বিপুলসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুল শিক্ষকদের অস্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করতে সক্ষম হয়। আমাদের এই সব কর্মসূচিতে আর্থিক ও উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করেছিল; ইণ্টারন্যাশনাল রেকিউ কমিটি (IRC) যার স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন শ্রী তরুণ মিত্র, শ্রী জয় কপ্রকাশ নারায়ণ, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, মধ্য প্রদেশের বিভিন্ন সংগঠন, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি সার্ভিসের ভারতীয় জাতীয় শাখা।

 এতদ্ব্যতীত সমিতি ভারতবর্ষে ও বিদেশে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষককে অস্থায়ীভাবে সগায়তা করে। সমিতি মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনায় বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা দানের জন্য বেশকিছু স্কুল ও কলেজরে শিক্ষকের নাম সরকারের কাছে প্রেরণ করে। এদের অনেককেই মুক্তাঞ্চলে গিয়ে প্রশাসনিক কার্যে অংশগ্রহণ করেছিল।

 দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিও বাংলাদেশ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সমিতি কতিপয় প্রকাশনা বের করে এবং অন্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশনার ব্যাপারে তথ্য সরবরাহ করে। এই সব প্রকাশনায় বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় অংশ গ্রহণ করে। কতিপয় প্রকাশনার নাম এখানে উল্লেখিত হল।

 (1) Bangladesh: A Reality (2) Report on Bangladesh, (৩) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। এই তিনটি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি কর্তৃক প্রকাশিত। (৪) Bangladesh - The Truth (৫) Conflict in east Pakistan (৬) মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ (৭) আমাদের বাঁচার দাবী ৬ দফা কর্মসূচী- শেখ মুজিবুর রহমান (৮) Bangladesh Throes of A New Life (9) Pakistanism and Bengali Culture (10) Bangladesh - Through the lens (১১) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। (১২) Bleeding Bangladesh (13) Bangladesh: The Background, পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক সমিতি প্রকাশিত; (১৪) রক্তাক্ত বাংলা, মুক্তধারা (স্বাধীনবাংলা সাহিত্য পরিষদ) কর্তৃক প্রকাশিত; (১৫) জাগ্রত বাংলাদেশু আহমদ ছফা, বাংলাধেশ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম শিবিরের উদ্যোগে মুক্তধারা কর্তৃক প্রকাশিত; (১৬) এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- গাজীউল হক, ইণ্ডিয়ান আসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং কোলকাতা, পাকশিত। এছাড়াও বিভিন্ন সমিবিবাংলাদেশ সম্পর্কিত তথ্য ও মুক্তিযোদ্ধের পরিস্থিতি ও গণহত্য সম্পর্কিত প্রতিবেদন বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, সঙবাদপত্র এত্যাদিতে প্রেরন করে। আমাদের এই কর্মতৎপরতার ফলে বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে।

 কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংরাদেশ সহায়ক সমিতির সক্রিয় সহযোগিতা উদ্যোগে আমরা কতিপয় প্রতিনিধিদল বিদেশেও প্রেরন করি বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে। এই দুই সমিতরি পক্ষ থেকে শ্রীযুক্ত ন্নিাথ ব্যানার্জী (১৯২২ সালে কাব লে ‘মকতবই হাবিবিয়ার শিক্ষক ছিলেন) আফগানিস্তান গমন করেন ‘৭১-এর অক্টোবর মাসে। তিনি সেখানের বাদশা খান ও তদীয় পুত্র ন্যাপ নেতা ওয়ারী খানের সাথে, আফগান পার্লামেণ্টের সদস্যদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন লাভে চেষ্টা করেন। এ ছাড়া তিনি কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সাথে আলোচনায় বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য ও মুক্তিযুদ্ধের প্রচরণার কাজে পরিভ্রমণ করেন। এছাড়া কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপীয় ভাষাসমুহের বিভাগের প্রধান ফাদার পি ফাঁলো (P. Fallon) আমাদের দুই সমিতির পক্ষ থেকে জুন মাসে ভ্যাটিকান শহরের মহামান্য পোপের সাথে সাক্ষা করে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পের্কে পোপকে জ্ঞাত করান ববেং আমাদের সমর্থনে বক্তব্য তুলে ধরেন। পরে তিনি একই উদ্দেশ্যে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। পরে তিনি একই উদ্দেশ্যে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ভ্রমন করেন।

 সমিতি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য, পুস্তক, দলিল ইত্যাদি সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ আর্কাইভস কমিটি গঠন করেন। বরে পরিচালক ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। এছাড়া কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির উদ্যোগে ও সহযোগিতায় আমাদের বাংলাদেশ তথ্য ব্যাংক গঠন করি। এই ব্যাংক দেশী-বিদেশী দৈনিক পত্রিকা, জার্নাল প্রভৃতি থেকে বাংরাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ও আনুষঙ্গিক তথ্য সংগ্রহ করার কাজে ব্যাস্ত থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের ১৪ জন ছত্র-ছত্রীকে এই কার্যে নিযুক্ত করা হয়েছিল এবং পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন জনাব জামিল চৌধুরী। পরে ড. এ আর মজুমদারকে এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এই প্রকল্পে আমরা প্রবিন ভারতীয় সাংবাদিক শ্রী দুর্গাদাস তরফদার এবং শ্রী রামরায়ের অকুণ্ঠ সহোযোগিতা পাই। যুদ্ধ শেষে ব্যাংক সংগৃহীত তথ্যাবলী ঢাকা যাদুগরে হস্তান্তর করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ আর্কাইভস সংগৃহীহ কাগজপত্রাদি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

 অন্যান্য সহযোগী সহায়ক সংগঠনের সহায়তায় আমরা মুক্তিযুদ্ধে তিন প্রকার সহায়তা দানের চেষ্টা করি।

 (১) সীমিত সাধ্যে কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক অনুদান। (২) মুক্তিযুদ্ধে প্রয়োজনীয় বেসামরিক উপকরণ যেমন কম্বল, শীতবস্ত্র, পোশাক, জুতা ইত্যদি ও বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা যুবশিবিরসমুহে প্রেরনের ব্যাবস্থা। (৩) যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধদের চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা প্রোয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী ঔষধপত্র ও চিকিৎসা সামগ্রী সংগ্রহ ও বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রেরণ। এ ব্যাপারে আমরা বাংলাদেশ ভলাণ্টিয়ার্স কোর- এর সাথে একসঙ্গে কাজ করেছি। এ প্রসঙ্গে ঐ সংগঠনের পরিচালক জনাব আমিরুল ইসলাম ও উপপরিচালক জনাব মামুনুর রশীদ কর্মতৎপরতার কথা স্মরণযোগ্য।

 কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির উদ্যোগে গঠিত মেডিকেল ইউনিট এ ব্যাপারে আমাদের সর্বাদিক সহায়তা করে। শ্রীমতি মৃন্ময়ী বোসের নেতৃত্বাধীন পরিচালক এই ইউনিট ভারতীয় রেড ক্রসের সহযোগিতায় এবং শ্রীমতি পদ্মজা নাইডুর ব্যক্তিগত প্রচেষাটা অব্যাহতভাবে ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। শিক্ষক সমিতির পক্ষে এই প্রচেষ্টার নিরলসভাবে কাজ করেন বেশ কিছু সদস্য এদের মধ্যে নিহত গোপাল সাহা, সকুমার বিশ্বাস, ইমরুল কায়সার প্রভৃতির নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছে।

 সমিতি গোপনে অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টাতে ও সহযোগিতা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপক লতিফ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক সমিতি যে অর্থ সংগ্রহ করে তা অস্ত্র সংগ্রহের কার্যে ব্যয় করার উদ্দেশ্যে আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। এই উদ্দেশ্যে ঐ সংগঠনের একজন প্রতিনিধি কোলকাতায় আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমরা মুক্তিবহিনীর প্রতিনিধির সাথে তার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেই এবং স্থির হয় যে, বাংলাদেশ সররকারের আমেরিকায় প্রতিনিধিদের সাথে আলাপ করে এ ব্যাপারে সঠিক কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ সরাসরি সহায়তা প্রদানের জন্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভর্সিটির ভারতীয় জাতীয় কমিটির কার্যকরী সম্পাদক শ্রী ভি এন থিয়াগ রাজন আমদের সাথে যোগাযোগড় ঘটিয়ে দেই। তিনি এ ব্যাপারে সর্বাত্মক ও কার্যকরী সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন।

 উপরিল্লিখিত কর্মতৎপরতা ও প্রচেষ্টায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ বিশ্ববিদ্যারয় ও কলেজ শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ সংগ্রাম সহায়ক সমিতি, ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি ফর বাংলাদেশ, শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু পরিচালিত বাংরাদেশ এইড কমিটি আমাদের সর্বত্মক সহযোগিতা প্রদান করে।

 শিবির কর্মাধ্যক্ষদের অনুরোধে শিক্ষ সমিতি মুক্তিযুদ্ধে আদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু স্কুল ও কলেজের শিক্ষ কে আমরা প্রেরণ করি। নিযুক্ত শিক্ষকগণ নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া মাঝে মাঝেই সমিতির প্রতিনিধিরা বিভিন্ন রণাঙ্গন পরিদর্শন করে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের কাজ ও করেছেন। এ ব্যাপারে অধ্যাপক আব্দুল হাকিমের নাম শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ্য। আমি নিজেও সমিতির সম্পাদক হিসেবে সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা শিবির পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করছি। একদিনের ঘটনা আমার বেশ মনে পড়ে। শিবিরটি মুর্শিদাবাদের লালগোলা সীমান্তে। আমরা ক’জন কিছু ঔষধ ও অন্যান্য বেসামরিক উপকরণ সরবরাহ করতে গিয়েছিলাম। দিনটি ছিল ২২শে নভেম্বর। শিবিরে শোকের ছায়া। রাজশাহীর নবাবগঞ্জ থেকে তিন মাইল দূরে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। আমরা হারিয়েছি ৭ জন মুক্তিযোদ্ধাকে আর বামাদের বাহিনী ২৫টি বাঙ্কার ধ্বংশ করেছে ও অসংখ্য পাক সৈন্যকে হত্যা করেছে, আর ১২জন রাজাকারকে ধরা হয়েছে। বন্দী রাজাকারদের দেখলাম। এর দিন কায়ক আগে নায়েক কাসেম শাস্তি কমিটির চেয়ারম্যানসহ দু’জন রাজাকারকে গ্রেফতার করে। ক্যাপ্টেন গিয়াস এই সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করছিলেন। নায়েক কাসেম ঐ দিনের বাঙ্কারে অবস্থিত পাক বাহিনীর একজন মেজর ও ক্যাপ্টেনকে ধরতে গিয়ে নিহত হন। এছাড়া ঐ দিনের যুদ্ধে আমাদের পক্ষে আর যারা শাহাদাত্ররণ করেছিলেন তারা হলেন- মোহর আলী (ইপিআর), জিল্লুর রহমান (মুজাহিদ), আব্দুল হক (ছাত্র) এবং আরও দুজন ছাত্র। বেশ ক'জন আহত হয়েছেন। আমরা আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম। একজন ছাড়া আরও মৃতদেহ নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আমরা অভিবাদন জানালাম সেই বীর শহীদদের।

 মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ও প্রচণা কাজের সাংগঠনিক দিকের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ড. বেলায়েত হোসেন এ কাজের সাংগঠনিক দিকের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

 সরাসরি মুক্তিযুদ্ধেও বেশ কিছু শিক্ষক যোগ দিয়েছিলেন। সে সময় আমরা যাদের নাম সংগ্রহ করেছলাম তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম মনে পড়ছে। অধ্যাপক আব্দুল মান্নান (কর্মাষ, ঢাকা বিশ্ববিধ্যালয়), নূরুন্নবী (ফার্মেসী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), মোয়াজ্জেম হোসেন (বাগেরহাট কলেজ), আবু বকর সিদ্দিক (আয়ুব ক্যাডেট কলেজ, রাজশাহী), হামিদুল হক (কচুয়া হাই স্কুল)। আবং অধ্যাপক হান্নান প্রমুখ। এদের মধ্যে মোয়াজ্জেম হোসেন ও জনাব আবু বকর সিদ্দিকী শাহাদাত্বরণ করেছিলেন আমরা সে সময় সংবাদ পেয়েছিলাম।

 মুক্তিযুদ্ধে ও সরকার পরিচালনায় সহায়তা দানের জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্ল্যানিং সেল মুখ্যতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবিদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এই সেলের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক)। অন্যান্য সদস্যরা হলেনঃ অধ্যাপক খান সারওয়ার মুর্শেদ (ইংরেজী বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,) অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন (অর্থণীতির অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ড. আনিসুজ্জামান (বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) ও ড. এস আর বোস। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে আমি সেলের শিক্ষা বিভাগের সথে সংযুক্ত ছিলাম। আমাদের বিভাগের (Education and Social Service Division) অন্তর্ভুক্ত ছিলঃ (1) Formation of Education policy for Secular democratic Socialist Bangladesh (2) Collection of data and views in connection with reform of the examination system (3) Preparation of a report on the problems of Primary and Secondary Education in Bangladesh (4) Preparation of a on the problems of Scientific and Technical Education in Bangladesh (5) Estimating the damage caused to educational institutions in Bangladesh and studying the Socio- Psychological Problems of educational restoration and rehabilitation (6) Studying the problems of demobilized freedom fighters, students, non-students and permanently disabled in the liberation war.

 আগষ্ট মাসে পাকিস্তানের কারাগারে অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই শিক্ষক সমিতি এবং বাংলাদেশ কাউন্সিল অব ইণ্টেলিজেণ্টশিয়া যৌথ উদ্যোগে কোলকাতায় এক জনসমাবেশ ও বিক্ষোভ তিছিলের আয়োজন করে (১৩ই আগস্ট)। সেদিন শহরের বেশ কিছু অংশ প্রদক্ষিন করে আমরা এই বিচার প্রহসন বন্ধকরার দাবীতে কোলকাতার সকল বিদেশী দূতাবাসে আমাদের স্মারকলিপি প্রদান করি। এর পর পরই পৃথিবীর নান স্থানে শেখ মুজিবের বিচারের বিরুদ্ধে বিক্ষাভ প্রদর্শিত হতে থাকে এবং পাকিস্তানী সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ হতে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন মহল থেকে।

 আগষ্ট মাসে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রকৃত অবস্থা জানতে ও উদ্বাস্তুদের অবস্থা পরিদর্শনের এলে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে ড.এ আর মলিকের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে একটি স্বারকলিপি প্রদান করে। এই স্বারকলিপিতে বাংলাদেশের অবস্থা জানিয়ে যুক্তরষ্টের জনগণ ও সরকারের সমর্থন কামনা করা হয়। এই স্মারকলিপির একটি প্রতিলিপি আমরা যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেসিডেণ্ট নিক্সনের কাছে প্রেরণ করি।

 সেপ্টেম্বর মাসে তদান্তীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দ্রা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত শরণার্থী শিবিরসমুহ পরিদর্শনে এলে আমরা পুনরায় তার সাথে সাক্ষাৎ করি এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য আহ্বান জানাই। শ্রীমতী গান্ধী আমাদের আশ্বাস দেন যে তা যতাসময়েই করা হবে।

 এছাড়া জুলাই-আগষ্ট মাসের দিকে ড. হেনরী কিসিঞ্জার দিল্লী আগমন করলে আমাদের প্রতিনিধি ড. মযহারুল হক দিল্লি গমন করে তাঁর সাক্ষাৎ কামনা করেন এবং আমাদের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বাংলাধেশ নীতি পরিবর্তনের দাবীতে একটি স্মারকলিপি তাঁকে প্রদান করেন।

 এতদসত্ত্বেও আমেরিকান সরকারের বাংরাদেশ বিরোধী নীতি অব্যাহত থাকে এবং পাকিস্তান সরকারকে নানাভাবে সহায়তা দান চলতে থাকে। এই নীতির প্রতিবাদে সমিতির পক্ষ থেকে আমরা পুনরায কোলকাতাস্থ যুক্তরাষ্টীয় কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে নিক্সন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

 নয় মাসব্যাপী যুদ্ধকালে বিভিন্ন শ্রেণীর বহু পরিদর্শক আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং নানাভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছেন।

 আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটি (International Rescue Committee); জুন মাসে এই কামিটির পক্ষে অ্যাম্বেস্যাডার অ্যাঞ্জিয়ার বিডল ডিউক (Ambassador Angier Biddle duke), মর্টন হামবুর্গ (Morton Hamburg, General Counsel- IRC) মিসেস লী থ (Mrs. Lee Thaw - Director, IRC), ড. দানিয়েল এল, ওয়ানডার (Dr. Daniel L. Wadner— prof. of Surgery, Albert Einst College of Medicine N.T) এবং মি: টমাস ডব্লিউ ফিশস (Mr. Thomas w. Phipps an author) আমাদের সাথে আলোচনায় মিলিত হন। ওজঈ আমাদের বিভিন্ন প্রকল্পে বিশেষ করে ক্যাম্প স্কুল প্রকল্পে সহায়তা দানে সম্মত হয়।

 জাপানে গঠিত ‘বাংলাদেশ সলিডরিটি ফ্রণ্ট- এর সাধারন সম্পাদক অধ্যাপক সেৎসুরে সুরুসিমা (Set sure Tsurushima) ‘জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেণ্ডশীপ অ্যাসোসিয়েশন’-এর কর্যকরী সংসদের একজন সদস্য মিঃ টি, সশিকে (T.susuki) এবং মিঃ তেসিকা (Temisuka- a TV/Cameraman) আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাদের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞাত করান হয়।

 ইতিহাসবিদ অধ্যাপক এ এল বাসাম (অ্যাসোসিয়েশন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি) জুনমাসের দিকে আমাদের সাথে আলোচনায় মিলিত হন এবং আমাদের সমস্যা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করান হয়। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।

 ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিষ্ট অ্যসোসিয়েশন- এর সভাপতি অধ্যাপক ন্যুড নেইলসন (Knud Neilson) এবং WSCE, (Geneva)- এর মিঃ ঝ্যাক ল্যাকশিক (Jack Laksirch) সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে আমাদের সাথে এক আলোচনায় মিলিত হন। তাঁদেরকে কয়েকটি শরণার্থী শিবির ঘুরিয়ে দেখান হয়।

 স্ক্যাণ্ডেনেভীয় দেশগুলির কয়েকজন সাংবাদিক এস এ নেলসন (ষ্টকহোম) এ এম স্কিপার (A.M. Skipper Denmark) ভিএসবি বলকার্ট (V.S. B Balkert - Denmark), এম আই ওয়জহা (M.I. Ojha-Sweden) আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চান। তাঁরা মুক্তাঞ্চল পরিদর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁদের একাত্মতা প্রকাশ করেন।

 মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় গঠিত Friends of the Bangladesh Movement- এর পক্ষ থেকে মিসেস এভেলিন চৈকিন (Evelyn Chaitkin) কোলকাতায় এলে তাঁকে আমাদের বিভিন্ন ক্যাম্প স্কুল ঘুরিয়ে দেখান হয়। তিনি এই প্রকল্পে আমাদের সহোযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।

 সুদীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে বহু সহায়ক সংগঠন আমাদের সাথে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেতাদের সকলের নাম লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়।

 স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও তার ভুমিকার কথা আজ সবারই জানা। শরণার্থী প্রায় সকল শিল্পীই এই কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষকরা ও এই কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছেন।

 অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরেঃ নানা অসুবিধার মধ্যে থেকে এবং বিপদকে মাথায় নিয়ে বুদ্ধিজীবিরা নানাভাবে দেশের অভ্যন্তরেও প্রতিরোধ সংগ্রামে অশং নিয়েছেন। বিভিন্ন গেরিলা ইউনিটের সহায়তায় আমরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে সচেষ্ট করেছি ও তথ্য সংগ্রহ করি।

 ঢাকায় ডঃ আজাদ ও আন্যান্যদের সাথে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। সংবাদ পচ্ছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের বেশ ক’জন শিক্ষক প্রতিরোধ আন্দোলনে যুক্ত রয়েছেন। শত বিপদের মধ্যেও তাঁরা একটি কাগজ গোপনে বের করেছেন। নাম ‘প্রতিরোধ’। ঢাকায় আমার আর একটি যোগাযোগ বিন্দু সুলতানা (ছদ্মনাম)। তিনি আমাদের লণ্ডন যোগাযোগ বিন্দুর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর নিয়মিত পাঠাতেন। থাঁর প্রেরিত খবরে ঝানা গিয়েছিল ১ লা জুলাই তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল শিক্ষককে যোগদান করতে বলা হলেও বেশকিছু শিক্ষক ঐ আদেশ উপেক্ষা করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র উপস্থিতি খুব কম। তাঁর মাধ্যমে ও অন্য সুত্র থেকে তখন যে খবর আমরা পেয়েছিলামঃ অনুপস্থিত শিক্ষকদের একটি তালিকায় শহীদাশক্ষকদেরও অনুপস্থিত হিসেবে দেখান হচ্ছে। ভারতে আশ্রয়প্রার্থী শিক্ষকদের তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখা গেল বেশ ক’জন শিক্ষক দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপন করে আছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেনঃ ডঃ আহম্মদ শরীফ, ডঃ মনিরুজ্জামান ও অধ্যাপক আকরাম হোসেন (বাংরা বিভাগ); শহীদুল হক মুন্সি; অধ্যাপক নূরন্নবী ও অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।

 নতুন উপাচার্য হয়েছেন ডঃ সাজ্জাদ হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিন চলছে গেরিলা অপারেশন। সাথে সাথে পাকিস্থানীদের অত্যাচার।

 রশীদুল হাসান ও আহসানুল হক (ইংরেজী বিভাগ), সালাউদ্দিন আহমদ (সমাজবিজ্ঞান), ডঃ আবুল খাযের (ইতিহাস), রফিকুল আসলাম (বাংরা), আ ন ম শহীদুল্লাহ (গনিত)- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ক‘জন শিক্ষক ও বেশ ক‘জন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হয়েছে। সরকারী পদস্থ অপিসারদের মধ্যে রয়েছেন লোমান হোসেন (টেলিফোন বিভাগ), জনাব ইউসুফ (শিক্ষা বিভাগ)। বহু শিক্ষ ও ডাকার বিশিষ্ট নাগরিককে পাকবাহিনীর অনুচরেরা প্রাণনাসের হুমকি দিয়ে চিঠি প্রদান করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নলিখিত কয়েকজন শিক্ষককে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছেঃ অধ্যাপক এাব এম হাবিবুল্লাহ (ইসলামের ইতিহাস); অধ্যাপক মহম্মদ এনামুর হক (অতিরিক্ত শিক্ষক (বাংলা বিভাগ)। আর নীচের কয়েকজন শিক্ষককে সাবধান করে দেয়া হয়েছেঃ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডঃ নিলীমা ইব্রাহীম (বাংলা) ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজী)। এছাড়া ১ লা জুলাই থেকে অনুপস্থিত সকল শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে।

 নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে তিনদিন তিনরাত্রি ধরে ঢাকার আশেপাশের গ্রামে বুড়িগঙ্গার ওপারে কামরঙ্গীরচর, নান্দাইল, কামার খাঁ, রুহিলা, বইৎপুর প্রভৃতি এলাকায় অসংখ্য নরনারী, শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় পাক সৈন্যরা ও তাদের অনুচর রাজাকার বাহিণী। সাথে সাথে চলে নারী নির্যতন ও ধর্ষণ। সংবাদদাতার মতে প্রায় হাজার খানেক নরনারীকে হত্যা করা হয়েছে।

 খবর পাওয়া গেল ঢাকাবাসীরা বিশেষ করে নিম্ন আয়ের জনগন পশ্চিম পাকিস্তনী দ্যব্য বর্জন করেছে, ঢাকায় জয়বাংরা বাজার বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছ।

 অন্যান্য অঞ্চল থেকে খবরঃ আমার নিয়মিতভাবে খবর পাচ্ছিরাম যে টাংগাইল এলাকায় বিরাট মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলেছে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনী। আগষ্টের যে খবর এল যে, এই বাহিনী সিরাজকান্দি ঘাটে একটি অস্ত্র জাহাজ দখল করেছে। আমরা জানতে পেরিছিলাম এই বাহিনীর সাথে অধ্যাপক নূরুন্নবী ছাড়াও আরও কয়েকজন অধ্যাপক সক্ষে রয়েছেন। এরা হলেন কাগমারী কলেজের অধ্যাপক নূরুল আমীনও অধ্যাপক রফিক আজাদ।

 বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা খবর পাচ্ছিলাম ষংখ্যারঘু নাগরিকদের ওপর আবার নতুন করে অত্যাচার শুরু হয়েছে তথাকথিত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরও। তথাকথিত ক্ষমা ঘোষনায় বিশ্বাস করে যেসব সংখ্যালঘু সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হচ্ছে।

এছাড়া যেসব সংখ্যালঘু বিশিষ্ট নাগরিক পালিয়ে আসতে পরেনি তাদের ওপর নানাবিধ অত্যাচার করা হচ্ছে, তাদের কছে থেকে টাক আদায় করা হচ্ছে, জমিজমা বাড়ীঘর দখল করা হচ্ছে, জোর করে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টাও চলছে। বিভিন্ন সুত্র থেকে খবর পাওয়া গেল যে নিম্নলিখিত কয়েকজন ব্যক্তি বাধ্য হয়েছেন সপরিবারে মুসলমান নাম গ্রহণ করতেঃ

 শ্রী জয়ন্ত চক্রবর্তী, অধ্যাপক (পদার্থবিদ্যা), ময়মনসিংহ এ এম কলেজ, শ্রী রবীন্দ্র চক্রবর্তী অধ্যাপক, শিক্ষক-প্রশিক্ষণ কলেজ, ময়মনসিংহ, শ্রী পূর্ণ চন্দ্র দত্ত, প্রভাষক (মনস্তত্ব), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শ্রী সুখেন্দু সোম, অধ্যাপক (গনিত), বরিশাল কলেজ, শ্রী নিত্যগোপাল, অধ্যাপক (বানিজ্য), নাসিরাবাদ কলেজ ময়মনসিংহ।

 খবর এল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দুজন শিক্ষ- জনাব মুজিবুর রহমান (গনিত) এবং জনাব সালেহ আহমেদ (সংখ্যাতত্ত্ব) কে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং মাসের পর মাস ধরে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালান হচ্ছে।

 ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদরে ভূমিকাঃ ২৩শে এপিল (১৯৭১) পর্যন্ত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ছিল স্বাধীন বাংলার পতাকা। সেদিন হানাদার বাহিনী রুখতে ছাত্র ও সৈনিকদর সাথে এগিয়ে এসেছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। উপাচার্য ডঃ কাজী ফজলুর রহমানের নতৃেত্বে তারা গড়ে তুলেছিলেন সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদ একদিকে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধে সহায়তা করেছে, অন্যদিকে অরক্ষিত অসহায় অবাঙ্গালী নাগরিকদের রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছ। সেদিন এই প্রতিরোধ যুদ্ধে ছাত্র ছাড়াও অরক্ষিত অবস্থায় অবাঙ্গালী নাগরিকদের রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছে। সেদিন এই প্রতিরোধ যুদ্ধে যেসব শিক্ষ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন ডঃ শামসুল ইসলাম, ডঃ আব্দুল ওয়াদুদ, মোস্তফা হামিদ হোসেন, ডঃ আব্দুল লতিফ মিঞা, জনাব শামসুদ্দিন খান; আর কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন, শরিয়তউল্লহ, চাঁন মিয়া, সৈয়দ নাজমুদ্দিন হোসেন। কিন্তু প্রতিরোধভেঙ্গে পড়ল- ২৩শে এপ্রিল পাক বাহিনী প্যবেশ করল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। হানাদার বাহিনী যেসব শিক্ষককে লাঞ্ছিত ও শরীরিকভাবে নির্যাতন করেছিল তাঁরা হলেনঃ ১। উপাচার্য ডঃ কাজী ফজলুর রহমান, ২। ডীন ডঃ শামসুল ইসলাম, ৩। ডঃ মুস্তফা হামিদ হোসেন, ৮। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক জনাব জাহিদুর রহিম, ৯। কর্মচরী জনাব জলিল ও মিঃ ডেভিড।

 আর অধিকৃত আমলে যেসব শিক্ষক ও কর্মচারী জল্লাদ বাহিনীর হাতে সেদিন নিহত হয়েছিলেন তাঁরা হলেনঃ

 জনাব আশরাফুল ইসলাম ভূঁইয়া, শিক্ষক মুহাম্মদ আক্কাস আলী, ছাত্রাবাস কর্মচারী মধুসূদন, মৎস্য বিভাগের কর্মচারী, মুহাম্মদ নূরুল হক, ছাত্রাবাস কর্মচারী, গাজী ওয়াহিদুজ্জামান, কর্মচারী, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন ১৫ই নভেম্বর, মুহাম্মদ হাসান আলী, কীটতত্ত্ব বিভাগের ল্যাব অ্যাসিস্টেণ্ট, গিয়াসউদ্দিন, ছাত্রাবাস কর্মচারী।

 কিন্তু এতেও পিছপা হননি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। গোপন সহযোতিা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন অবরুদ্ধ এলাকা থেকে। এর ফলে চাকরিচ্যুতির নির্দেশ আসে অনেক শিক্ষকের প্রতি। চাকরিচ্যুত হন। উপাচার্য স্বয়ং। শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক মোস্তফা হামিদ হোসেন (পদার্থবিদ্যা), জনাব আলী নেওয়াজ (বাংলা), জনাব শামসুজ্জামান খান (বাংলা), জনাব আব্দুরজ্জাক (বাংলা), আব্দুল বাকী (উদ্ভিবিদ্যা), আব্দুল হক (উদ্ভিদবিদ্যা), আব্দুল হালিম (কৃষি শিক্ষা), মুহাম্মদ হোসেন (পরীক্ষাসমুহের নিয়ন্ত্রক)।

 ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের গ্রেপ্তারের সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়লাম। ইণ্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটি (IRC) স্থানীয় প্রতিনিধি শ্রী তরুন মিত্র, আমেরিকান মহলের সাথে বেশ জানাশুনা তাঁর। তাঁর সাথে দেখা করে সহকর্মীদের নাম দিলাম। অনুরোধ করলাম আই সি-র কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ঢাকা কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে-অন্ততঃ তাদের জীবন যেন নিরাপদ থাকে। কথা দিলেন যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। মেসেজ ত্বরিত পাঠবেন আই আর সি-র হেড অফিসে। তাছাড়া যোগাযোগ করবেন আমেরিকান দূতাবাসের সংগেও। সমিতির সম্পাদক হিসেবে বিভিন্ন দুতাবাসে ও বিদেশের বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের কাছে (জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলসহ) জরুরী বার্তা পাঠালাম।

 জয়নুল আবেদীন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। ওঁর কাছ থেকে ঢাকার বিস্তারিত খবর পাওয়া গেলে। ঢাকায় গেরিল দের কর্মতৎপরতার কথা জানা গেল। খবরে পাওয়া গেল মুনীর চৌধুরীর, অধ্যাপক হাবিবুল্লাহর কবি শামসুর রহমনের, হাসান হাফিজুর রহমানের। তিনি আরও জানালেনঢাকার কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রতিরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন সাহসিকতার সাথে।

 ঢাকা থেকে আমার ছাত্র ও সহকর্মী ডঃ একরামুল ইসলমের কাছ থেকে বার্তা এসেছে। ও জামালপুরের একটি স্থানীয় গেরিলা ইউনিটের সাথে কাজ করছে। ঢাকা থেকে টাকা পয়সা, ঔষধপত্র সরবরাহ করতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অস্ত্রের বেশী পয়োজন। যথাস্থানে যোগাযোগের ব্যাবস্থা করে দেয়া হল।

 অবশেষে এল সেই দিন ৩রা ডিসেম্বর। সন্ধা সাতটায় এলগিন রোডে নেতাজীভবনে সম্বর্ধনা সভাউত্তর ইউরোপীয় কয়েকটি দেমের ডেমোক্রেটিক সোস্যালিষ্টিদের একটি প্রতিনিধিদলের আগমন উপলক্ষে। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করান হচ্ছে তাদের। হঠাৎ শিক্ষক সমিতির জকৈ কর্মী সভা থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে এল। জানাল, পাকিস্তানী বিমান ভারতের গভীরে নানস্থানে হামলা চালিয়েছে। আনমেদ চিৎ করে উঠছিলাম সেদিন। আমাদের স্বাধীনতা আসন্ন। যুদ্ধ শুরু হল। ভারতীয় বাহিনী যোগ দিলেন আমাদের সাথে মিত্র বাহিনীরূপে।

 তারপর সাফল্য আর সাফল্য। প্রতিদিনা পতন হতে লাগল বিভিন্ন শহরে। ঐস্বাধীনতা। ঢাকা আর কতধূর। যশোর মুক্ত। মুক্ত দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ। ঢাকা অবরুদ্ধ। মুক্তিবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে। গেরিলারা অভ্যনাতরে। বিজয় আসন্ন।

 কিন্তু এরই মধ্যে হৃদয়বিদারক খবর এল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১৩ ই ডিসেম্বর পাকসৈন্য ও তাদের অনুচরেরা হত্যা করেছে ৪০ জন বিশিষাট নাগরিককে। বিচলিত হয়ে পড়লাম, আসঙ্কা করলাম হয়তো ঢাকাতেও অনুরূপ ঘটেছে বা ঘটতে চলছে। কোলকাতায় মিত্র বাহিনীর সদর দপ্তরের সাথে বি, এস এফ এরসাথে যোদাযোগ করে আবেদন জানালাম যে করেই হোক, ঢাকাস্থ বুদ্ধিজীবিদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবন রক্ষা করতে হবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘন ঘন আবেদন জানন হলনাগিরিকদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার। কিন্তু আমাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। স্বাধীনতার প্রাকমুহুর্তে আমরা হারালাম শ্রেষ্ঠ সন্তানদের চরম মূল্য দিতে হল স্বাধীনতার।

 তবু এর মধ্য দিয়ে এল স্বাদীনতা। মুক্তি। বিজয়। আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানী বাহিনী, বিনাশর্তে, যৌথ কম্যাণ্ডের কাছে। দিনটি ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।

 বিনা দ্বিধায় স্বীকার করব মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিই ছিল আমার জীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল দিন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার যে সুযোগ ঈশ্বর আমায় দিয়েছিলেন সেজন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ। নানা স্মৃতিতে ভাস্বর এই দিনগুলুি কখনও মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি, কখনও হতাশায় ভুগেছি, আবার খখনও আনন্দে উদ্বেল চিত্তে শিহরিত হয়েছি। নানাজনের কাছে নানভাবে সহায়তা লাভ করেছি, এজীবনের জন্য নানাজনের কাছে কৃতজ্ঞ। নাম করতে গেলে তালিকা হবে দীর্ঘ, তাই কারও নাম কবর না, সকলের কাছে ক্ষমা চাইব। কিন্তু তবু চান্দিনার কাছে একটি ছোট খালের ধারে, ঝোপের আড়ালে অবস্থিত পর্ণকুটিরে যে বৃদ্ধা মহিলা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন মায়ের স্নেহে, নিঃশঙ্কোচে, তার কথা কি কোনদিন ভুলতে পারব?

ডঃ অজয় রায়