বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (প্রথম খণ্ড)/৯৩

উইকিসংকলন থেকে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলা একাডেমীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আবু হোসেন সরকারের ভাষণ পাকিস্তান সরকার ডিসেম্বর, ১৯৫৫

বাংলা একাডেমীর উদ্বোধীন অনুষ্ঠানে

উজীরে আলা

জনাব আবু হোসেন সরকারের

ভাষণ

সমাগত সুধীজন,

 একুশ দফা কার্যসূচীতে পূর্ববাংলার জনগণের কাছে আমরা যে সব প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, আজ তাহারই একটি ওয়াদা পালনের জন্য আমরা এখানে সমবেত হইয়াছি। সাড়ে চার কোটি পূর্ববঙ্গবাসীর মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা এবং তাহাকে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার যে সার্বজনীন দাবী, মূলতঃ তাহা হইতেই বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা জন্ম লইয়াছে। কাজেই বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা পূর্ব বাংলার ভাষার শাশ্বত দাবী ও ঐতিহাসিক আন্দোলনেরই প্রথম বাস্তব স্বীকৃতি। যাঁহাদের মহান ত্যাগে এই দাবী প্রতিরোধ্য হইয়া উঠিয়াছে, আজিকর এই দিনে সকলের আগে আমরা তাঁহাদের স্মরণ করিতেছি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। বাংলা একাডেমী স্থাপনের উদ্যোগ-আয়োজন আমাদের প্রথম যুক্তফ্রণ্ট সরকার ক্ষমতালাভের অব্যবহিত পরেই করিয়াছিলেন। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী জনাব সৈয়দ আজিজুল হক সাহেব এই ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থাও অবলম্বন করিয়াছিলেন। কিন্তু কি কারণে সে আয়োজন তখন স্থায়ী ও বাস্তবরূপ গ্রহণ করিতে পারে নাই, তাহা আপনারা ভাল করিয়াই জানেন। যাহা হউক আমরা এখন সেই ওয়াদা পালনের সুযোগ পাইয়ছি; এজন্য কোন কৃতিত্বের দাবী আমরা করিতে পারি না-কৃতিত্ব তাঁহাদেরই, যাহাদের বিপুল ত্যাগের বুনিয়াদে জাতীয় গর্বের বস্তু এই বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হইতেছে।

বাংলা ভাষার ঐতিহ্য

 বাংলা ভাষা সাধারণ মানুষের ভাষা। কোন কোন মহল হইতে বলা হইয়া থাকে যে, সংস্কৃত হইতে বাংলার জন্ম এবং ইহা পৌত্তলিক ভাষা। বলাবাহুল্য, এই কথা মিথ্যা ও অজ্ঞানতাপ্রসূত। ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে আমার যে সামান্য ধারণা আছে তাহা হইতে আমি বলিতে পারি যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য কোন বিশেষ ভাষা হইতে উদ্ভুত নয়। পালি, প্রাকৃত, ব্রজভাষা প্রভৃতি হইতে বহু স্তর অতিক্রম করিয়া বহু মিশ্রণের ভিতর দিয়া বাংলার উদ্ভব। এই ভাষা একান্তই এ দেশের ‘প্রাকৃতজন’ তথা সাধারণ মানুষের ভাষা। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খৃষ্টান, সকলেই সমবেত প্রচেষ্টা ইহার সমৃদ্ধির মূলে কাজ করিয়াছে। আমার এই মতামত ঐতিহাসিক সত্যকে ভিত্তি করিয়াই গড়িয়া উঠিয়াছে। মধ্য যুগের বাংলার নৃপতি হোসেন শাহ্ বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করিয়া ইহার মানোন্নয়নে যে সহায়তা করিয়াছিলেন তাহা বাংলা সাহিত্যে এক সোনালী অধ্যায়। এই আসল বাংলা পদ্য সাহিত্যের এবং পুঁথি সাহিত্যের যে ক্রমবিকাশ শুরু হয়, তাহা দেশের মানুষের হৃদয়ের বস্তু হইয়া উঠে। ইহার সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের নাড়ী ও রক্তের সম্পর্ক আছে। নৃপতি হোসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতার কাল হইতে শুরু করিয়া এই বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলমানদের যে দান তাহা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে অভূতপূর্বরূপে সমৃদ্ধ করিয়াছে। শঙ্করাচার্য্যের আন্দোলনের পরে যে সমস্ত বৌদ্ধরা পূর্ববঙ্গে আসিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাদের দানেও এই ভাষা সমৃদ্ধ হইয়াছে। শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণববাদ, আমার মতে, এক বিশেষ শ্রেণীর গরীব সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রসার লাভ করিয়াছে। তাঁহারাও বাহন ছিল এই সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা সাহিত্যের খৃষ্টান সমাজেও দান অপরিসীম। উইলিয়াম কেরী, মার্শম্যান, এণ্টনী এবং আরও বহুজনের দানে এই ভাষা আরও গতিশীল এবং সমৃদ্ধ হইয়াছে। প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থের রচয়িতা বলিয়া উইলিয়াম কেরীর খ্যাতির কথা সর্বজনবিদিত। আমি মোটামুটিভাবে এই সত্যটির কথা বলিতেছি যে, সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের দানে এই ভাষা গড়িয়া উঠিয়াছে এবং বর্তমানকালে ইহার খ্যাতি দুনিয়ার সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে। আজা বাংলা একাডেমীর উদ্বোধন দিবসে আমি তাই সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকেই ইহাকে আরও সমৃদ্ধ করিয়া তুলিতে আহ্বান জানাইতেছি।

বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদা

 আমরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিতে সঙ্কল্প করিয়াছি তাহা আমরা করিবই। ইহাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। আমি আমাদের প্রিয় নেতা জনাব ফজলুল হক সাহেবের কথাতেই বলিব যে, যে-শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হইবে না, তাহা আমরা কিছুতেই গ্রহণ করিব না। তাই এখন সেই মর্যাদা দানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কতকগুলি কর্তব্য ও দায়িত্বের দিকেও দৃষ্টি দিতে হইবে।

ভাষার সমৃদ্ধি-সাধন

 বাংলা ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ ও পরিণত করিতে হইবে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে সন্দেহ নাই কিন্তু পূর্ব হইতে এই ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করিলে যত উন্নত হইত, তাহা হইতে পারে নাই। আমদের পরিভাষা প্রণয়ন, অভিধান প্রণয়ন, ব্যাকরণ-গবেষণা, বর্ণমালার উন্নতি বিধান, মুদ্রণ কার্যকে সহজতর করা সাহিত্যকে উন্নত ও সমৃদ্ধতর করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি প্রভৃতি বহু কর্তব্য বাকী আছে। যে সব প্রবাদ ব্যক্তিগত জীবনের দর্শন হিসাবে মুখে মুখে হাটে-মাটে-ঘাটে ছড়াইয়া আছে তাহার মধ্যে দেশ সংস্কৃতির ও চারিত্রের যে রূপ তাহা উদ্ধার করিবার দায়িত্বও উপেক্ষণীয় নয়। আমি আশা করি এই বাংলা একাডেমী এই অভাব পূরণ করিবে।

পূর্ববঙ্গের ভাষার স্বাতন্ত্র্য

 তাহা ছাড়া পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার একটি স্বাতন্ত্র্য আছে। রংপুর হইতে চট্টগ্রামে, যশোহর হইতে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চলে নানারকম কথ্য ভাষা আছে। কিন্তু সারা পূর্ব বাংলায় কোন ষ্ট্যাণ্ডার্ড বা সাধারণ কথ্যভাষা এখনও গড়িয়া উঠে নাই। ইহা সম্ভব কি না, তাহা ভাষাতত্ত্ববিদরাই বলিবেন। যদি সম্ভব হয়, তাহা হইলে এই ব্যাপারেও বাংলা একাডেমীর বিশেষ দায়িত্ব আছে বলিয়া আমার বিশ্বাস। আমি স্বীকার করি, যে-কোন ষ্টাণ্ডার্ড ভাষা উপর হইতে চাপাইয়া দেওয়া যায় না। ভাষা আপনা হইতে উৎপত্তি লাভ করে, কিন্তু একেবারে আপনা আপনিই উৎপত্তি লাভ করে- তাহা আমি স্বীকার করি না। সব কিছুর মত ভাষার রূপ রূপান্তর, গতিধারাও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। জনগণের প্রয়োজনের দিক হইতে আমাদের ভাষার একটা ষ্ট্যাণ্ডার্ড রূপ গ্রহণের অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টির ব্যাপারে বাংলা একাডেমী অনেক কিছু করিতে পারে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজের যাহা কিছু এখনও অবশিষ্ট রহিয়াছে, তাহা দূর করিয়া একটা শোষণমুক্ত সমাজ গড়িয়া তুলিবার জন্য আমরা কাজ করিয়া যাইতেছি; আমাদের ভাষা ও সাহিত্যক তাহার আনুকূল্য করিতে হইবে। সুতরাং বাহির হইতে প্রয়োজন অনুসারে আহরণ করিয়া এই ভাষা সমৃদ্ধতর করিলেও আমাদের বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তাকে আমরা কিছুতেই নষ্ট হইতে দিব না।

 আমাদের জাতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সার্থক বাহন হিসাবে এই ভাষা ও সাহিত্য জগৎ সভায় মর্যাদার আসন পাইবে।

সাহিত্যের প্রচার ও প্রসার-সাধন

 আমার কর্মব্যস্ততার মধ্যেও আমি আমাদের কবি সাহিত্যিকদের লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ কিছু কিছু পড়িয়া থাকি। ইহার ভিতর বহু মূল্যবান রচনাও আমার চোখে পড়িয়াছে। কিন্তু বাহিরের দুনিয়ার এইগুলি উপযুক্ত আদর পাইতেছে না। এমনকি দেশের ভিতরেও অনেক সময় এইগুলি ব্যাপক প্রকাশ ও প্রচারের সুযোগ লাভ করে না। শক্তিশালী সাহিত্যিকদের রচনা প্রকাশের বাধ্যবিপত্তি এই সব সম্পদ অনেক ক্ষেত্রে নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। শুধু দেশেই ইহার প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করিলে চলিবে না, দুনিয়ার সর্বত্র অনুবাদ পৌঁছাইয়া দিতে হইবে। এই সকল অনুবাদ গ্রন্থ আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও জীবনের দূত হিসাবে আমাদের প্রাণের কথা দুনিয়ার সর্বত্র বহন করিয়া লইয়া যাইবে।

 আমাদের দেশের কবি ও সাহিত্যসেবীদের দুরবস্থা সম্পর্কে আমি খুবই সচেতন। যে পৃষ্ঠপোষকতা শিল্প ও সাহিত্যের প্রাণসঞ্চার করে, তাহার খুবই অভাব আছে বলিয়া আমার মনে হয়। কেবল উপযুক্ত প্রকাশক প্রতিষ্ঠানই নহে যথেষ্টসংখ্যক পাঠকেরও অভাব আছে। সাহিত্যিকদের শোষণ করিয়া অন্যে লাভবান হন, এমন নজিরেরও অভাব নাই। এই শোষণ বন্ধ করিয়া সাহিত্যিকদের মর্যাদা বৃদ্ধি ও সাহিত্যের মানোন্নয়নের কাজ করিতে হইবে। বাংলা একাডেমী এই বিষয়ে সক্রিয় থাকিবে।

একাডেমীর কর্তব্য ও জনগণের সহযোগিতা

 এই একাডেমীর কর্তব্য বহুবিধ। আমি সংক্ষিপ্তবাবে তাহার কয়েকটি উল্লেখ করিলাম। কিন্তু এইসব কর্তব্য পালনের জন্য জনসাধারণের সহযোগিতা অপরিহার্য। আমি আশা করি, দেশের সকল সাহিত্যিক, কর্মী এবং জনসাধারণের সহযোগিতার ফলে এই একাডেমী দুনিয়ার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ একাডেমী বলিয়া স্বীকৃতি লাভ করিবে। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের মাধ্যমে এই একাডেমী দুনিয়াকে যেমন আমাদের নিকটতর করিবে, তেমনি এই একাডেমীর কর্মের মারফত আমরা বহির্জগতে নিকটতর হইব। আমি বিশ্বাস করি, ভাষা ও সাহিত্যসেবীরা এই একাডেমীকে কেন্দ্র করিয়া এমন এক মধুচক্র রচনা করিবেন-

বঙ্গজন যাহে-
‘আনন্দে করিবে গান
সুধা নিরবধি’।

 আপনাদের সকলের প্রতিই এই আহ্বান জানাইয়া আমি এই বাংলা একাডেমীর উদ্বোধন করিতেছি।