বিদায়-আরতি/সিঞ্চলে সূর্য্যোদয়
সিঞ্চলে সূর্য্যোদয়
দুধে ধুয়ে আঁধার-গ্লানি দৃষ্টি যে চাঁদ দিল নিশার চোখে,—
মিলিয়ে দিল পুষ্প-কলির প্রাণ-কুহরের কুহক জ্যোস্নালোকে,—
উপল বহু উচল পথে স্নিগ্ধ-উজল জ্বালিয়ে রতন-বাতি
যাত্রীদলের সাথে সাথে মৌন পায়ে চলছিল যে সাথী,—
পথের শেষে থম্কে হঠাৎ চম্কে দেখি মাঝ-গগনের কাছে
রাত্রি-দিবার সন্ধি-রেখার অবাক্-চোখে সে চাঁদ চেয়ে আছে—
চেয়ে আছে তুষার-রুচি শ্বেত-ময়ূরের পারা,—
হিমে-হানা, কুষ্ঠিত-কায়, শীর্ণ-শিথিল পাখনা, পেখম-হারা।
মিলিয়ে গেছে মুখর জগৎ,—তলিয়ে গেছে অতল মৌনতাতে,
পেয়েছে লোপ দৃষ্টি-বাধা,—সকল বাধা সকল সীমার সাথে,
সীমার সমাধ আকাশ অগাধ ডিম্ব হেন বিশ্ব-ভুবন ঘিরে
সুপ্তি ঘেরা জন্ম-কোষে ভ্রাণ-গরুড় পোষে হিমাদ্রিরে!
হারিয়ে গেছে হাওয়ার চলা, নিশাস ফ্যাল ফুরিয়ে সেছে যেন,
সঞ্চরে প্রাণ-বায়ু-বিতান গর্ভ-শয়ান শিশুর নিশাস হেন,
বিস্ময়েরি নূতন বিশ্ব স্বপ্নে মৃদু হাসে।
সকল আঁখি পূর্ব্বমুখী অপূর্ব্বেরি অভ্যুদয়ের আশে।
উষার আভাস জাগল কি রে?—দিনমণির খুল্ল মণি-কোঠা?
শুকতারাটির শিউলি-ফুলে লাগল ফিরে অরুণ-রঙের বোটা?
পূব-তোরণে চিড়্ খেল কি দিগ্বরণের নিবিড় দন্তাঘাতে?
ধূৎরো-ফুলের ডালি মাথায় তুষার-গিরি জাগ্ছে প্রতীক্ষাতে!
মুক্তা-ফলের লাবণ্য কি আমেজ দিল মুক্ত নীলাম্বরে?
দিগ্বধূরা চামর করে আকাশ-আলোর বিরাট্ হরিহরে?
অলখ্ পরী উষারতির রত্ন-প্রদীপ মাগে,
আলোক-গঙ্গা-স্নানের লাগি’ জহ্ন, কুবের কনকজঙ্ঘা জাগে।
সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দে রে, এ-নিদ্-মহল কার আছে তজ্বিজে?
বিভাবরীর নীলাম্বরীর আঁচল ওঠে মোতির আভায় ভিজে?
হোরার কালোচুলের রাশে কোথায় থেকে ধূপের ধোঁয়া লাগে।
বন্-কপোতের গ্রীবার নীলে জাফরাণী নীল মিলায় অনুরাগে!
পাশ্-মোড়া দ্যায় স্বপ্নে উষা আধ-খোলা আধ-ফোটা ফুল পারা
সোন-মুখের হাই লেগে হয় মুহুর্মূহু আকাশ আপন-হারা!
বরণ গলে, মেঘ-মহলে দোলে কমল-মালা,
ছোপ রেখে যায় সোনার ধোয়াট্,নীল ফটিকের বিরাট্ তোরণ-আলা!
সাগর-বেলায় ছোট্ট ঝিনুক যেমন রঙে সদাই সেজে আছে—
ফুলের ফোটায় ঢেউয়ের লোটায় যে রঙ ধরা দ্যায়না তুলির কাছে—
ফিরোজ-মোতি-গোমেদ্ চুনী-প্রবাল-নীলার নিশাস চয়ন ক’রে
আমেজ দিয়ে,আভাস দিয়ে,আব্ছা দিয়ে আকাশকে দ্যায় ভ’রে—
ইন্দ্রলোকে রামধনুকে কবির শ্লোকে যত রঙের মেলা
ভুবন ভ’রে নয়ন ভ’রে তেম্নি-ধারা লক্ষ রঙের খেলা!
নিসর্গ আজ আচম্বিতে হয়েছে স্বর্গীয়!
অলখ্ তুলি সেচন করে, লোচন হেরে অনির্ব্বচনীয়!
পারিজাতের দল ছিঁড়ে কে ছোট্ট মুঠায় ছড়ায় গগন হ’তে
দেও-ডাঙাতে টিপ রাঙাতে আনন্দে দুধ-গঙ্গাজলের স্রোতে,
কোন ব্রত আজ গৌরী করেন রজতগিরির ভালে সিঁদুর দিয়ে,
হেম হ’ল গা শঙ্করের ওই হৈমবতীর পরশ-পুলক পিয়ে!
আড়াল করে মেঘের মালা গিরিবালার ভরম দিতে ঢেকে,
আড়াল করে যবনিকায় মহ যোগীর মনের বিকার দেখে।
জ্বলে নেভে তুষার-ভালে আলে। ক্ষণে ক্ষণে,
সেই আলোকে স্নান করে আজ বসুন্ধরার উচ্চতমের সনে।
প্রবাল-বাঁধা ঘাটের পারে তরল পদ্মরাগের নিলয় চিরে—
কে জাগে? উদ্ভিন্ন ক’রে কমল-যোনির জন্ম-কমলটরে!
কে জাগেরে অরুণ-রাগে ব্যগ্র তাথির পুরিয়ে বাঞ্ছা যত—
বাঘের চোখের আলোয় ঘেরা বরণমালা তুলিয়ে লক্ষ শত!
একি পুলক দ্যুলোক-ভরা! আলিঙ্গিছে হর্ষে অনিবার
আমার চোখের চমৎকারে তোমার আলোর চির-চমৎকার!
রোমে রোমে হর্ম জাগে, জগং ওঠে গেয়ে,
চির-আলোর সাগর দোলে চোখের আলোর সঙ্গটুকুন পেয়ে।