বিদায় ভোজ/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 অধিক রাত্রি জাগরণ বশতঃই হউক বা রবিবার বলিয়াই হউক, সেদিন যখন শয্যাত্যাগ করিলাম, তখন ছয়টা বাজিয়া গিয়াছে। সত্বর প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া দুইজন বিশ্বাসী কনষ্টেবল লইয়া সুশীলের বাড়ীতে গমন করিলাম।

 বিলম্ব দেখিয়া সুশীলের মাতাঠাকুরাণী ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি পুত্রকে বরম্বার আমার নিকটে যাইতে আদেশ করিতেছিলেন; কিন্তু সুশীল তাঁহাকে মিষ্টবাক্যে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করিতেছিল, এমন সময়ে আমি তথায় গিয়া উপস্থিত হইলাম।

 আমাকে দেখিবামাত্র সুশীল দাঁড়াইয়া উঠিল এবং সাদর সম্ভাষণ করিয়া তাহার মাতাঠাকুরাণীর নিকট লইয়া গেল। আমাকে দেখিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। পরে বলিলেন, “আসিয়াছ বাবা! এতক্ষণ আমি কতই ভাবিতেছিলাম। একবার দেখ বাবা! অংটীটা যদি বাহির করিতে পার, তাহা হইলে যাবজ্জীবন তোমার কেনা হইয়া থাকিব।”

 আমি শশব্যস্তে বলিলাম, “অমন কথা বলিবেন না। আমি প্রাণপণে চেষ্টা করিব।”

 এই বলিয়া সুশীলের দিকে চাহিলাম। পরে বলিলাম, “আমার সহিত দুইজন লোক আসিয়াছে। আমি তাহাদিগকে বাড়ীর দরজায় অপেক্ষা করিতে বলিয়া আসিয়াছি। তুমি তাহাদিগকে বাড়ীর ভিতরে ডাকিয়া আন। একবার সকলে মিলিয়া ভাল করিয়া অন্বেষণ করা যাউক।”

 সুশীল তখনই আমার আদেশ পালন করিল। কনষ্টেবল দুই জন আমার নিকটে আসিলে আমি তাহাদিগকে লইয়া সুশীলের সহিত ভিতরের দালানে গমন করিলাম এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সকল স্থান অন্বেষণ করিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ আংটীটার কোন নিদর্শন পাওয়া গেল না।

 প্রায় দুই ঘণ্টা কাল যৎপরোনান্তি পরিশ্রমের পর আমরা পুনরায় বাহির-বাটীতে আগমন করিলাম। সুশীলের মাতাঠাকুরাণী তখনই আমাদের নিকট উপস্থিত হইয়া আংটীর কথা জিজ্ঞাসা করিলেন এবং আমার উত্তর শুনিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করত বলিলেন, “এখন উপায় কি বাবা! আংটীটা কি আর পাওয়া যাইবে না?”

 সুশীলের মাতার সেই বিমর্ষ মুখমণ্ডল দেখিয়া ও তাঁহাকে ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিতে অবলোকন করিয়া আমি আন্তরিক দুঃখিত হইলাম। সহসা তাঁহার প্রশ্নের কি উত্তর দিব তাহা ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর বলিলাম, “বাস্তবিকই বড় আশ্চর্য্য কথা! যখন সেখানে সমস্ত আত্মীয় স্বজন উপস্থিত ছিলেন, তখন তাঁহাদের মধ্যে যে কেহ সেই আংটীটা চুরি করিবেন এমন ত বোধ হয় না। কিন্তু সকল স্থানই ত তন্ন তন্ন করিয়া অন্বেষণ করিলাম। এখন আমার বড় ভাল বোধ হইতেছে না। পূর্ব্বে ভাবিয়াছিলাম, আংটীটা কোথাও পড়িয়া আছে কিন্তু এখন আমার আর সে ধারণা নাই। নিশ্চয়ই কোন লোক উহার লোভ সম্বরণ করিতে পারে নাই।”

 আমার কথায় বাধা দিয়া সুশীলের মাতা জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে কি আর উহাকে ফিরিয়া পাইবার আশা নাই?”

 কিছুক্ষণ ভাবিয়া আমি বলিলাম, “আর একবার চেষ্টা না করিয়া আপনার কথার উত্তর দিতে পারিব না।”

 ঈষৎ হাসিয়া তিনি বলিলেন, “সমস্ত স্থানই ত অনুসন্ধান করা হইয়াছে, আবার কোথায় খোঁজ করিবে বাবা?”

 আ। না—আমি খুঁজিবার কথা বলি নাই। এখন আমার দৃঢ়বিশ্বাস হইতেছে যে, আংটীটা কেহ চুরি করিয়াছে। কিন্তু কে যে চুরি করিয়াছে তাহা জানিতে হইবে। আমি আপনাকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করিব। আপনি তাহার যথাযথ উত্তর দিন।

 সুশীলের মাতাঠাকুরাণী দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি বলিবে বল বাবা?”

 আ। আংটীটা প্রথমে কে দেখিতে চাহিয়াছিল?

 সু-মা। আমি—আমার দেখা হইলে পর আমার পার্শ্বস্থ প্রতিবেশীর এক কন্যার হাতে দিয়াছিলাম।

 আ। তিনি এখন এখানে উপস্থিত আছেন?

 সু-মা। হাঁ বাবা, আছে।

 আ। তাঁহার বয়স কত?

 সু-মা। প্রায় ত্রিশ বৎসর—বিধবা।

 আ। একবার তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করুন, তিনি কাহার হস্তে আংটীটী প্রদান করিয়াছিলেন।

 সুশীলের মাতাঠাকুরাণী তখনই গাত্রোত্থান করিলেন এবং সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। কিছুক্ষণ পরে পুনরায় প্রত্যাগমন করিয়া বলিলেন, “সুরমা তাহার ভ্রাতৃবধুর হাতে দিয়াছিল। সে আবার আমার বেয়ানের হাতে দেয়।

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার বেয়ান কাহার হাতে দিয়াছিলেন?”

 সুশীলের মাতা কিছুক্ষণ কি ভাবিয়া বলিলেন, “আমি ত বাবা সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। স্বচক্ষে কিছুই দেখি নাই। তবে বেয়ান ও বেহাই ছাড়া আর সকলেই এখানে উপস্থিত আছে। একবার তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখি—কি বলে।”

 এই বলিয়া সুশীলের মাতা পুনরায় সেই স্থান হইতে চলিয়া গেলেন এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “বেয়ান আংটীটা দেখিয়া বেহাইএর হাতে দিয়াছিলেন। কিন্তু বেহাই উহা কাহাকেও দিয়াছিলেন কি না সেকথা কেহই বলিতে পারে না।”

 আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কোন লােক কি উহা লক্ষ্য করিয়াছিল? যাঁহার আংটী তিনি এ বিষয়ে কি বলেন? অত টাকার জিনিষটা অপরের হস্তে দিয়া তিনি কেমন করিয়া নিশ্চিন্ত রহিলেন?”

 সৌভাগ্য বশতঃ আংটীর অধিকারিণী নিকটেই ছিলেন। সুশীলের মাতা তাহার নিকট গিয়া ঐ কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। পরে তাহার উত্তর পাইয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “না বাবা! তাহা লক্ষ্য করে নাই। বিশেষতঃ তাহার মনে কোন প্রকার সন্দেহ ত হয় নাই। যদি হইত, তাহা হইলে অবশ্যই লক্ষ্য করিত।”

 আমি তখন জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনার বেয়ান ও বেহাই ত এ দেশ ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং তাঁহাদের সহিত ত এখন আর সাক্ষাৎ হইবার কোন সম্ভাবনা নাই, তাঁহারা কি সত্য সত্যই কাশীধামে গমন করিয়াছেন?”

 ঈষৎ হাসিয়া সুশীলের মাতাঠাকুরাণী উত্তর করিলেন, “তুমি ত সকলই জান বাবা! তাঁহাদের কথা তোমাকে আর নূতন করিয়া কি বলিব? তবে যখন সমস্ত উদ্যোগ করিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছেন, তখন বোধ হয় এবার সত্য সত্যই কাশীধামে গমন করিবেন।”

 আ। আরও দুইবার ত তাঁহারা এইরূপ করিয়াছিলেন।

 সু-মা। হাঁ বাবা, তাঁহাদের মনের কথা বোঝা ভার।

 আ। তবে এবারও যদি সেই মত হয়?

 সু-মা। এবার শুনিলাম, তাঁহারা এখান হইতেই হাওড়া যাইবেন, আর বাড়ীতে যাইবেন না, এই রকম কথা ছিল।

 আ। এখানকার কোন লোক তাঁহাদের সঙ্গে গিয়াছিল?

 সু-মা। না বাবা! আমি সঙ্গে যাইতে বলিয়াছিলাম, কিন্তু বেহাই তাহাতে রাজী হইলেন না। আমার ইচ্ছা ছিল, বাড়ীর চাকর তাঁহাদিগকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া আসে। বেয়ান রাজী ছিলেন বটে কিন্তু কর্ত্তা মত করিবেন না।

 আ। এখান হইতে কখন রওনা হইয়াছেন?

 সু-মা। আজ বেলা নয়টার সময়।

 আ। অবশ্য গাড়ী করিয়াই ষ্টেশনে গিয়াছেন?

 সু-মা। হাঁ বাবা!

 আ। কে গাড়ী ডাকিয়া আনিয়াছিল?

 সু-মা। বাড়ীর চাকর।

 ঠিক সেই সময় সেইভৃত্য তথায় উপস্থিত হইল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সদা! কোথা হইতে গাড়ী ভাড়া করিয়া আনিয়াছিলি?”

 সদানন্দ উত্তর করিল, “আজ্ঞে—আমাদের গলির মোড়ে তখন একখানি খালি গাড়ী ছিল। আমি সেই গাড়ীই ভাড়া করিয়াছিলাম।”

 আ। কেন? নিকটেই ত আস্তাবল ছিল?

 স। সেখানে তখন একখানিও গাড়ী ছিল না।

 আ। গাড়ীখানার নম্বর জানিস?

 সদানন্দ ওরফে সদা ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে—অমি ত ইংরাজী পড়িতে জানি না, তবে সেই কোচমানের সহিত আমার আলাপ আছে।”

 আমি ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তাহার আস্তাবল কোথায়?”

 সদানন্দ কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, “আজ্ঞে সে কথা ঠিক বলিতে পারিলাম না। তাহার নাম করিমবক্স এই পর্য্যন্ত জানি।”

 আ। তোর সহিত কেমন করিয়া আলাপ হইল?

 স। আজ্ঞে, এক দেশে বাড়ী।

 আ। তোদের বাড়ী কোথায়?

 স। মেদিনীপুরে।

 আ। গাড়ীখানি কি তাহার নিজের?

 স। আজ্ঞে হাঁ।

 আর কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি গাত্রোত্থান করিলাম। আমাকে প্রত্যাগমনে উদ্যত দেখিয়া সুশীল অতি নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কি ভাই, আংটীটা পাইবার আর আশা আছে কি?”

 কি উত্তর দিব স্থির করিতে না পারিয়া, আমি কোন কথা বলিলাম না। সুশীল আর কোন প্রশ্ন করিতে সাহস করিল না। কিন্তু তাহার মাতাঠাকুরাণী অতি বিমর্ষভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন কি করিবে বাবা! আংটীটা কি আর পাওয়া যাইবে না? যদি তাহাই হয় তাহা হইলেই সর্ব্বনাশ! শুনিয়াছি, তেমন আংটী সহরে নাই। আংটীটা নাকি বিলাত হইতে আনান হইয়াছিল।”

 সুশীলের মাতার কথা শুনিয়া আমি আন্তরিক দুঃখিত হইলাম। কিছুক্ষণ ভাবিয়া বলিলাম, “একেবারে হতাশ হইবেন না। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ, আমি আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখি, তাহার পর আপনার কথার উত্তর দিব।”

 এই বলিয়া আমি সুশীলের নিকট বিদায় লইলাম, সুশীল আমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীর সদর দরজা পর্য্যন্ত আসিল। পরে আমাদিগকে গাড়ীতে আরোহণ করিতে দেখিয়া কোচমানকে শকট চালনা করিতে আদেশ করতঃ পুনরায় বাড়ীর ভিতরে গমন করিল।