বিদ্যাসাগর/অষ্টাদশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

অষ্টাদশ অধ্যায়।

বর্ণপরিচয়, চরিতাবলী, বিশ্ব-বিদ্যালয়, হেলিডের নিকট

প্রতিষ্ঠা, ইয়ং সাহেবের সহিত মতান্তর

ও পদত্যাগ।

 বহু কঠোরতর কার্যে ব্যাপৃত থাকিয়াও বিদ্যাসাগর মহাশয় পাঠ্য-পুস্তক প্রণয়নে নিবৃত্ত ছিলেন না। ১২৬২ সালের ১লা বৈশাখ বা ১৮৫৫ সালের ১৩ই এপেল এবং ১২৬২ সালের (১৯১২ সংবতে) ১লা আষাঢ় বা ১৮৫৫ সালের ১৪ই জুন বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগ এবং দ্বিতীয় ভাগ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। বর্ণপরিচয়েও বিদ্যাসাগরের উদ্ভাবনা-শক্তির পরিচয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় বর্ণপরিচয়ের প্রথমভাগে বাঙ্গালা বর্ণবিচারে প্রবৃত্ত হন। এ বিচারে তিনি প্রথম। এ সম্বন্ধে আমাদের মতবিরোধ আছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলি, তিনি বাঙ্গালার স্বরবর্ণের দীর্ঘ “ঋ”র ব্যবহার করেন নাই। সংস্কৃত প্রয়োগানুসারে বাঙ্গালার দীর্ঘ “ঋ”র ব্যবহার হতে পারে। যথা——“পিতৄণ”। এ বর্ণবিচারসম্বন্ধে ঢাকার বান্ধব-সম্পাদক বহুযশস্বী স্বর্গীয় কালি প্রসন্ন ঘোষ মহাশয় ও ভট্টপল্লিনিবাসী পণ্ডিতপ্রবর যুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন মহাশয় ও শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি মহাশয় যে আলোচনা করিয়াছিলেন, তাহা পাঠ করা কর্ত্তব্য।

 প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ্ প্যারীচরণ সরকারের চোরবাগানস্থিত বাটীতে একদিন নির্দ্ধারিত হয় যে, প্যারীবাবু ইংজৌশিক্ষার প্রাথমিক পাঠাসমূহ এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় বাঙ্গালী পাঠ্যসমূহ প্রণয়ন করিবেন। প্রকৃত পক্ষে দুইজনই এই ভার লইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় মফঃস্বলে স্কুল-পরিদর্শনে যাইবার সময় পান্ধীতে বলিয়া বর্ণপরিচয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। প্রথম প্রকাশে বর্ণপরিচয়ের আদর হয় নাই। ইহাতে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিরাশ হন; কিন্তু ক্রমে ইহার আদর বাড়িতে থাকে।

 ১২৬৩ সালের মাঘ মাসে বা ১৯১৩ সংবৎ ১লা শ্রাবণ বা ১৫৮৬ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে চরিতাবলী মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। দরিদ্র ও হীন অবস্থা হইতে স্বকীয় অধ্যবসায়ে লোকে কিরূপে উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারে, তাহা প্রদর্শন করাই চরিতাবলী রচনার উদ্দেশ্য এই জন্যই এই গ্রন্থে ডুবাল, উইলিয়ম্ রস্কো প্রভৃতি বৈদেশিক খ্যাতনামা ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনাভাস প্রকটিত হইয়াছে। জীবন-চরিত-সম্বন্ধে আমাদের যে মত, চরিতাবলী সম্বন্ধেও সেই মত।

 ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় ইহার অন্ততম সভ্য হন। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয় হইতে সংস্কৃত শিক্ষা উঠাইবার প্রস্তাব হয়। বিদ্যাসাগর মহাশয় একাই সিনেটের অন্তান্ত সভ্যদিগের প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেন। অবশেষে তাঁহারই জয় হয়। বিন্যসাগর মহাশয় “সেণ্টাল কমিটির” সভ্য হইয়াছিলেন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া সিবিলিয়ানের কার্য্যে নিযুক্ত হইলে পর এই “সেণ্ট ল কমিটি”র নিকট এদেশীয় ভাষার পরীক্ষা দিতেন। এই কমিটি বড়লাট বাহাদুর লর্ড ডালহৌসী কর্ত্তৃক প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

 ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে “এডুকেশন কোন্সিলের” স্থানে বর্তমান “পবলিক ইনষ্ট্রকৃশান।” প্রতিষ্ঠা হয়। বর্ত্তমান ডাইরেক্টরের পদ-সৃষ্টিও এই সময় হইল। গর্ডন ইয়ঙ্ সাহেব প্রথম ডাইরেক্টরের পদে নিযুক্ত হন। ইয়ঙ সাহেব তখন নবীন সিবিলিয়ান। ছোটলাট হেলিডে সাহেবের অনুরোধে বিদ্যাসাগর মহাশয় মাস কয়েক ইহাকে শিক্ষাবিভাগের কার্য্য শিক্ষা দেন। ছোটলাট হেলিডে সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যথেষ্ট সম্মান করিতেন। এমন কি ছোটলাট বাহাদুর তাঁহাকে পরমাত্মীয় বন্ধু ভাবিতেন। প্রতি বৃহস্পতিবার বিদ্যাসাগর মহাশয় ছোটলাট বাহাদুরের বাটীতে গিয়া নানা বিষয়ের পরামর্শ করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় কোন কারণে নিৰ্দ্ধারিত দিনে যাইতে না পরিলে, হেলিডে সাহেব তাঁহাকে ডাকাইয়া পঠাইতেন। একবার হেলিডে সাহেবের সহিত রাজেন্দ্রলাল মল্লিক সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। সে দিন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যাইবার কথা ছিল, কিন্তু তিনি যাইতে পারেন নাই। হেলিডে সাহেব রাজেন্দ্র বা বাবুকে অনুরোধ করেন, সেই দিনই যেন তিনি বিদ্যাসাগরের নিকট যাইয়া তাঁহাকে পাঠাইয়া দেন। রাজেন্দ্র বাবু সেই দিন রাত্রিকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে হেলিডে সাহেবের অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় পরদিন হেলিডে সাহেবের সহিত সাক্ষাৎ করেন। এক দিন বহু সম্ভ্রান্ত লোক ছোটলাট বাহাদুরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যান। তাঁহারা যাইলে পর বিদ্যাসাগর মহাশয় তথায় গিয়া উপস্থিত হন। ছোটলাট বাহাদুর সর্বাগ্রেই তাহার সহিত সাক্ষাৎ করেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় চটিজুতা পায়ে এবং মোটা চাদর গায়ে দিয়া ছোটলাট বাহাদুরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতেন। ছোটলাট বাহাদুর তাঁহাকে চোগা, চাপকান ও পেণ্টলন পরিয়া যাইতে বলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাঁহার কথামতে দিন কয়েকমাত্র চোগা-চাপকান পবিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু ইহাতে তিনি লজ্জা ও কষ্টবোধ করিতেন। সেই জন্য তিনি সে বেশ পরিত্যাগ করেন। ইহার পর জীবনে তিনি আর এ পরিচ্ছদ বাবহার করেন নাই।

 ১২৬৪ সালে বা ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে বিদ্যাসাগর মহাশয়, হেলিডে সাহেবের আদেশে বহু স্থানে বহু বালিকাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সব বিদ্যালয়ের শিক্ষক-পণ্ডিত মাসিক বেতনের জন্য বিল করিয়া, বেতন প্রার্থনা করিলে, তদানীন্তন শিক্ষাবিভাগের ডাইরেক্টর ইয়ঙ্ সাহেব, তাহা মঞ্জুর করেন নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়, যখন ইনস্পেক্টর-পদে নিযুক্ত হন, তখন হইতেই, ইয়ঙ্ সাহেবের সহিত তাঁহার মতান্তর হওয়ায়, একটা মনোবাদ হয়। বর্তমান বিল নামঞ্জুরীসূত্রে সেই মনোবাদ প্রবলতর হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয়, ছোট লাট বাহাদুরকে এ কথা জানাইলেন। ছোট লাট বাহাদুর, নালিশ করিয়া টাকা আদায় করিতে বলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় নালিশের চিরবিরোধী; কাজেই তিনি স্বয়ং ঋণ করিয়া টাকা দেন।[১] ক্রমেই মনোেবদ গুরুতর হইয়াছিল। কাহারও কাহারও মতে মনোবাদের কারণ এইরূপ,—“বিদ্যাসাগর মহাশয় হুগলি, বর্দ্ধমান, নদীয়া, মেদিনীপুর এই চারি জেলার স্কুল-সমুহের স্পেসিয়াল ইনস্পেক্টর হইয়াছিলেন। জেলা চতুষ্ঠয়ের বিদ্যালয়গুলির তিনি যেরূপ উন্নতি অবলোকন করেন,তদন্তরূপ রিপোর্ট করিতেন। তন্নিবন্ধন তদানীন্তন ডিরেক্টর (শিক্ষাসমাজের কর্তা) বিদ্যাসাগরকে বলেন, “এতদপেক্ষা উৎকৃষ্ট রিপোর্ট করিবে অর্থাৎ গুছাইয়া লিখিবে; নচেৎ সাধারণের নিকট গৌরব দুষ্পাঠ্য না।” তিনি বলেন, “যেমন দুষ্পাঠ্য লেখা আমার কর্ম্ম নহে; দুষ্পাঠ্য হন, তাহা দুষ্পাঠ্য আমি কর্ম্মপরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত আছি। তেজস্বী বিদ্যাসাগরের পক্ষে ইহা অসম্ভবই বা কি?

 ইয়ঙ্ সাহেবের সহিত মনোবাদের আর একটা কারণ শুনিতে পাই। ইয়ঙ্ সাহেব সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধি করিতে চাহেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহার প্রতিবাদ করেন। ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দের ৩রা জুন বিদ্যাসাগর মহাশয় অতি সতেজ পত্র লিথিয় ইয়ঙ, সাহেবের প্রস্তাবের প্রতিবাদ করিয়াছিলেন। তিনি স্পষ্টই লিথিয়াছেন,—“সংস্কৃত কলেজের বেতন বাড়াইলে কলেজ থাকিবে না। ভারতের শিক্ষা-সম্বন্ধে ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দের বিলাত হইতে যে কাগজপত্র আসে, তাহাতে সংস্কৃত কলেজের বেতন-বৃদ্ধিসম্বন্ধে কোন উল্লেখ নাই। আমি সেই উপদেশ-পত্রের অনুসারে কাজ করিব। ইয়ঙ সাহেব কলেজের বেতন পাঁচ টাকা করিতে চাহিয়াছিলেন। ইহার পর ইয়ঙ, সাহেবের সহিত মতান্তর ঘোরতর হইয়াছিল। বিদ্যাসাগর মহাশয়, তেজস্বিতার সহিত ইয়ঙ্ সাহেবকে পত্র লিখিতেন। বাগ্মিবর রামগোপাল ঘোষ, পত্র-লেখা-সম্বন্ধে অনেকটা সাহায্য করিতেন। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রায়ই বিদ্রূপ করতেন, “সিবিলিয়ান্‌ সাহেবকে জোর করিয়া পত্র লেখা চালকলা-খেগে বামুনের কর্ম্ম নয়।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয় ইয়ঙ সাহেবের নামে ছোটলাট বাহাদুরের নিকট অনেক বারই অভিযোগ করিয়াছিলেন। ছোট লাট বাহাদুর, ডিরেক্টর মহাশয়ের সহিত সম্প্রীতি রাখিয়া তাঁহাকে কাজ করিতে পরামর্শ দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়, তৎপক্ষে চেষ্টাও করিয়াছিলেন; কিন্তু চেষ্টা ফলবতী হয় নাই। ইয়ঙ্ সাহেবের সহিত সম্প্রীতি হইল না, অথচ ছোট লাট বাহাদুরও কোন সদুপায় করিলেন না, অগত্যা রাগে—দুঃখে বিদ্যাসাগর মহাশয়, প্রিন্সিপাল ও ইন্‌স্পেক্টর পদ পরিত্যাগ করেন।

 তেজস্বী বিদ্যাসাগর, এক কথায় সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল এবং স্কুল-ইনস্পেক্টরের পদ পরিত্যাগ করেন। পাঁচ শত টাকা বেতনের মোহাকর্ষণ কার্য্য-বীরের সে অটুট দৰ্পের সুতীক্ষ কৃপাণাঘাতে মুহূর্তে খণ্ডবিথও হইয়া গেল।

 ইয়ঙ্ সাহেবের ব্যবহারে বিদ্যাসাগর মহাশয় দারুণ মনঃসংক্ষোভে মান্য ছোট লাট বাহাদুর হেলিডে সাহেবকে পদপরিহারকল্পে পত্র লিখেন। পত্র পাইয়া, বঙ্গেশ্বর বিস্ময়ান্বিত হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর সে সহসা ৫০০ টাকা বেতনের পদটা অম্লান বদনে পরিত্যাগ করিতে কৃতসংকল্প হইবেন, এটা কখনই তিনি ভাবেন নাই। বিদ্যাসাগর মহাশয়, তাঁহার নিকট ইয়ঙ্ সাহেব-সম্বন্ধে অনেক বারই অভিযোগ করিয়াছিলেন। ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে প্রেরিত শিক্ষাসম্বন্ধে “ডেসপ্যাচের” মর্ম্মার্থ লইয়া, ইয়ঙ্ সাহেবের সহিত বিদ্যাসাগরের কতকটা মনোবাদ চলিতেছিল, তাছাও তিনি জানিতে পারিয়াছিলেন। তবে সে মনোবাদ, পরিণামে যে এত ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিবে এবং তাহারই ফলে অবশেষে বিদ্যাসাগর যে পদপরিত্যাগে সংকল্প করিবেন, তাহা তিনি মনে করেন নাই।

 বিদ্যাসাগর, মহাশয়, ছোট লাটের নিকট অভিযোগ করিতেন;—“শিক্ষা-সংপ্রসারণ-সম্বন্ধে, বিলাত-প্রেরিত ডেসপ্যাচের যে মর্ম্ম, আমি সেই মর্ম্মানুসারে কার্য্য করি; কিন্তু ইয়ঙ্ সাহেব, তাহার বিপরীত মর্ম্মগ্রহণ করিয়া, পদে পদে আমার কার্য্যের প্রতিবাদ ও প্রতিবন্ধকতা করিয়া থাকেন। এরূপ অবস্থায় আমার চাকুরী করা দায়।” বিদ্যাসাগর মহাশয়ের অভিযোগ শুনিয়া, বঙ্গেশ্বর তাঁহাকে ইয়ঙ্ সাহেবের সহিত মিলিয়া মিশিয়া কাজ করিতে পরামর্শ দিবেন বলিয়া, আশ্বাস প্রদান করিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও,ছোট লাট বাহাদুরের আশ্বাসবাক্যানুসারে মিলিয়া মিশিয়া সদ্ভাবে সপ্রণয়ে কার্য্যনির্ব্বাহের চেষ্টা করিতেন। কিন্তু তিনি বুঝলেন যে, ছোট লাট বাহাদুরের নিকট পুনঃ পুনঃ অনুযোগেরই প্রয়োজন হয়, অথচ অনুযোগ করা বৃথা। ছোট লাট বাহাদুরের আশ্বাসনুসারে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াও, ইয়ঙ্ সাহেবের মতি-গতি-সম্বন্ধে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ধারণা অন্যরূপ হইল না। যে ইয়ঙ্ সাহেবকে তিনি হাতে করিয়া শিক্ষাবিভাগের সকল কাজ শিখাইয়াছেন, সেই ইয়ঙ সাহেবই তাঁহার সকল কার্যের বিরোধী এবং প্রতিবাদী, অথচ তৎ প্রতীকারেরও আর পথ নাই; এইরূপ ভাবিয়াই, তিনি ছোট লাট বাহাদুরকে পদ পরিত্যাগের পত্র লিখিয়াছেন।

 ছোট লাট বাহাদুর, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে যথেষ্ট ভালবাসিতেন নিশ্চিতই। তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে মিষ্ট বাক্যে সাস্তুনা করিবার জন্য চেষ্টিত হইয়াছিলেন; এৰং পত্র-প্রত্যাখান করিয়া লইবার জন্য ও সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ করিয়াছিলেন। পত্র প্রত্যাখ্যান করিয়া লইলে, বিদ্যাসাগর মহাশয় যে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠাভাজন হইবেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় ছোট লাট বাহাদুরের নিকট এ আশ্বাসও পাইয়াছিলেন।

 সে আশ্বাস-বাণীতে কিন্তু বিদ্যাসাগর বিচলিত হইলেন না। তথন ও তাহার হৃদয়, মর্ম্ম বেদনার প্রচণ্ড উগ্র তাপে জর্জরিত। তিনি পত্র-প্রত্যাখ্যানে বা পুনরায় পদগ্রহণে কিছুতেই সম্মত হইলেন না। তিনি হোলডে সাহেবকে স্পষ্টই বলেন—”সহিষ্ণুতার সীমা অতিক্রম করিয়াছি; আর ফিরিবার পথ দেখি না; ক্ষমা করুন। আমি আর চাকুরী করিব না; আমার আর তাহাতে প্রবৃত্তি নাই।” ছোট লাট বাহাদুর, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এইরূপ তেজস্বিতা দেখিয়া, বাস্তবিকই বিস্ময়াম্বিত হইয়াছিলেন। তিনি উপায়ান্তর না দেখিয়া, অগত্যা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পদ-পরিহরি মঞ্জুরু করেন।[২]

 বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পদ-পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া, তাঁহার মাতা, পিতা, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব—সকলেই সংক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। তৎকালে তাঁহাকে কোন স্কুল-ইনস্পেক্টর বলিয়াছিলেন,—“বিদ্যাসাগর! তুমি ভাল কাজ করিতেছ না। দেখ, আজকালিকার বাজারে পাঁচ শত টাকা বেতনের পদ দুর্লভ।বিশেষতঃ তোমার মত একজন বাঙ্গালী পণ্ডিতের পক্ষে আরও দুর্লভ। তুমি পদ পরিত্যাগ করিলে বটে; কিন্তু তোমার চলিবে কিসে?”

 বিদ্যাসাগর মহাশয়, এক্ষেত্রে হাসিয়া বলিয়াছিলেন,—“আমি জানি, মানুষের সম্ভ্রমই জগতে দুর্লভ। চলিবার কথা কি বলিতেছ? আমি যখন সংস্কৃত কলেজের সেক্রেটারীর পদ পরিত্যাগ করিয়াছিলাম, তখন আমার কি ছিল? এখন তবু ত আমার প্রণীত ও প্রকাশিত পুস্তকের কতক আয় আছে।”

 বিদ্যাসাগর মহাশয়ের এই পদ-পরিত্যাগে, তাঁহার পরিচিত সরকারী কর্মচারিবর্গ বড় ব্যথিত হইয়াছিলেন। সর্ব্বাপেক্ষা দুঃখিত হইয়াছিলেন, তৎকালিক সেক্রেটরী স্যার সিসিল বীডন্ সাহেব। বীডন্ সাহেব, বিপ্পাসাগর মহাশয়কে প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাস করিতেন। বাঙ্গালীর মধ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ন্যায়, আর কেহই বীভন সাহেবের বিশ্বাস-ভাজন ছিলেন না। তাহার একটী প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই,—বিধবা-বিবাহের আইন পাশ হইবার পর ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে লোমহর্ষণ সিপাহী-বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। কোন কোন অঞ্চলে বিধবাবিবাহের আইনটী এই সিপাহী-বিদ্রোহের কারণ বলিয়া নির্দ্দেশিত হইয়া থাকে। সে কথা লইয়া এখানে তর্ক-বিতর্কের প্রয়োজন নাই। ভগবৎ-কৃপায় সে বিদ্রোহ প্রশমিত হইলে পর, মহারাণীর অভয়বাণীর ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়। সেই ঘোষণাপত্র নানা ভাষায় অনুবাদিত হইয়াছিল। বীডন সাহেব, সেই ঘোষণা পত্র বাঙ্গালায় অনুবাদ করাইবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পত্র লিখিছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পদত্যাগ করিবার একমাস পূর্ব্বে বীডন সাহেব নিম্নলিখিত মর্ম্মে পত্র লেখেন,—“আমার ইচ্ছা, আপনি ঘোষণাপত্রটি, বাঙ্গালায় অনুবাদ করেন। আগামী কলা ১১টার সময় আফিসে আসিলে ভাল হয়। কাগজ-পত্র পাঠাইবার নিয়ম নাই; নতুবা পাঠাইতাম। এই চিঠির মর্ম্ম কাহাকেও বলবেন না। আপনি যে ইহার তর্জ্জমা করিতেছেন, এ কথা কেহই যেন জানিতে না পারে।” ১২৬৫ সালের ৭ই কার্ত্তিকে (১২৫৮ সালের ২২শে অক্টোবরে) এই পত্র লিখিত হয়।

 ইহাতে বুঝা যায়, বিদ্যাসাগর মহাশয়, বীডন্ সাহেবের কিরূপ বিশ্বাসভাজন ছিলেন।

  1. বিশ্বকোষ অভিধানে লিখিত আছে, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপনা সময়ে তৎকালীন গবর্নমেণ্ট সেক্রেটারী হলিডে সাহেবের সহিত বিদ্যাসাগরের আলাপ পরিচয় হয়। তিনি নানা বিষয়ে পরামর্শ করিবার জন্য প্রতি সপ্তাহে একদিন করিয়া বিদ্যাসাগরকে লইয়া যাইতেন। অনেক সময়ে তিনি বিদ্যাসাগরের সৎপরামর্শ গ্রহণ করিতেন। তাঁহারই যত্নে বিদ্যাসাগর 'স্কুল ইনস্পেক্টর' হইয়া ছিলেন। তৎকালে বাঙ্গালা বিভাগের চারিটী জেলার সর্ব্ব শুদ্ধ ২০ কুড়িটী মডেল স্কুল স্থাপিত ছিল। ঐ সময়ে কুড়িটী বিদ্যালয়ের পরিদর্শন-ভার, বিদ্যাসাগরের উপর ন্যস্ত হয়। এই সময়ে বীটন সাহেবের মৃত্যু হইলে, তৎপ্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয় গবর্নমেন্টের হস্ত্রে যাইল। ঐ সময়ে বিদ্যাসাগর, বীটল স্কুলের তত্বাবধায়ক ছিলেন। ইনি স্ত্রী শিক্ষা সম্বন্ধে বিশেষ যত্ন কবিতেন। এই সময় হলিডে সাহেবের উৎসাহ বাক্যে উৎসাহিত হইয়া, বাঙ্গালার স্থানে স্থানে প্রায় ৫০।৬০টী বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। কিন্তু দু:খের বিষয়, গবর্ণমেন্ট এই বৃহৎ কার্য্যে, মনোযোগ করিলেন না। কিছুদিন পরে বিদ্যাসাগর ঐ সমস্ত বালিকা বিদ্যালয়ের খরচ পত্রাদি বিল করিয়া পাঠাইলে, গবর্ণমেন্ট ঐ টাকা দিতে সম্মত হইলেন না। যাঁহার উৎসাহে ঐ সকল বিদ্যালয় স্থাপিত হইল, সেই হলিডে সাহেব তখন নিরুত্তর রহিলেন। তখন বিদ্যাসাগর নিজ হইতে ঐ সমপ্ত টাকা দিয়া বিদ্যালয়গুলি কিছুদিন চালাইয়াছিলেন।”
  2. শ্রীযুক্ত ক্ষেত্রমোহন সেনগুপ্ত বিদ্যারত্ন মহাশয়ের মুখে শুনিয়াছি,— “সিপাহী বিদ্রোহের সময় অনেকগুলি আহত সিপাহী সংস্কৃত কলেজে আশ্রয় লইযাছিল। এই জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয়, ডাইরেকটরের অনুমতি না লইয়াও সংস্কৃত কলেজ বন্ধ রাখিয়াছিলেন। সিভিলিয়ান্ ইয়ঙ্ সাহেবের সহিত মনোবাদের ইহাও একটী কারণ। কোথাও কোথাও এরূপ জল্পনা শুনা যায়, ইয়ঙ্ সাহেব, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপর বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে পদচ্যুত করিবার জন্য তাঁহার দোষান্বেষেণে প্রবৃত্ত হইযাছিলেন। শেষে তিনি এই দোষ পান যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় সহকারী 'লেফাফার' ভিতর আপনার পুস্তক পুরিয়া, স্থানান্তরে পাঠাইয়াছিলেন। এ কথা ছোট লাটকে অবগত করা হয়। বিদ্যা- সাগর মহাশয় এ কথা জানিতে পারি। আপনি পদত্যাগ করেন।” আমি বহু চেষ্টা করিয়াও এ কথার প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারি নাই, এই জঙ্ক এ কথায় আদৌ বিশ্বাস হয় না। বিশেষতঃ, বিদ্যাসাগর মহাশয় সম্বন্ধে ইহা একেবারই অবিশ্বাস্য। কি করিয়া এমন কথা উঠিল, ভগগানই জানেন।