বিদ্যাসাগর/চতুশ্চত্বারিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

চতুশ্চত্বারিংশ অধ্যায়।

শোক।

 ক্রমে শোকময় সংবাদ সহরময় রাষ্ট্র হইল। ভারতের ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রসমূহে এ শোকময় সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল। যিনি যে ভাবে বিদ্যাসাগরের মহত্ত্ব বুঝতেন, তিনি সেই ভাবে সেই মহত্ত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন।

 এলাহাবাদে পাইওনিয়র লিখিয়াছিলেন,—“He was a brilliant educationalist, and well-known for his labours in the promotion of Hindu Widow-remarriage.” 29th July, 1891.

 ইংলিশম্যান লিখিয়াছিলেন,—“A man of rare gifts and broad sympaties.” 30th July, 1891.

 ডেলিনিউস্ লিখিয়াছিলেন,—"Death has again this week carried away another of the brightest jewells of India.” 30th July, 1891.

 ষ্টেটস্‌ম্যান লিখিয়াছিলেন,—"Another of the foremost men of Bengal has gone over to the majority.” 29th July, 1891.

 ইংলণ্ড ও আমেরিকার প্রসিদ্ধ পত্রসমূহে এতৎসম্বন্ধে স্বল্পবিস্তর পরিমাণে লিখিত হইয়াছিল। আমেরিকার কোন পত্র, বিদ্যাসাগরকে গ্লাডষ্টোনের সহিত তুলনা করিয়াছিলেন।

 ক্রমে ক্রমে ভারতের গ্রাম, পল্পী, নগর, সহর সর্ব্বত্রই এই শোকময় সংবাদ প্রচারিত হইল। সহর মফঃস্বলের বেসরকারী স্কুল-কলেজ বন্ধ হইয়াছিল। কলিকাতায় মেট্রপলিটনের ছাত্রগণ পাদুকা পরিত্যাগ করিয়াছিল। কলিকাতার পুস্তক বিক্রেতৃগণ, কোম্পানীর কাগজের দালালগণ ও রাধাবাজারের দোকানদারগণ দোকানপাট ও অফিসাদি বন্ধ করিয়াছিলেন। মেট্রপলিটন, প্রেসিডেন্সি, সংস্কৃত কলেজ, হাবড়া স্কুল প্রভৃতি কলেজ-স্কুলে শোক-প্রকাশের জন্য সভা হইয়াছিল। সংস্কৃত কলেজে নবদ্বীপের খ্যাতনামা পণ্ডিত ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন, মেট্রপলিটনে শ্রীযুক্ত মাননীয় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের মাননীয় অধ্যাপক টনি সাহেব সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। এতদ্ভিন্ন, কত স্থানে কত সভাসমিতি যে আহূত হইয়াছিল, তাহার সংখ্যা হয় না। মফঃস্বলে বর্দ্ধমান, হুগলী, শ্রীরামপুর, ঢাকা, আসাম-গৌহাটী, বরিশাল, ত্রিপুরা, কুচবিহার প্রভৃতি ছোট বড় সহরে এবং অন্যত্র হায়দারাবাদ পর্যন্ত নানা স্থানে শোকপ্রকাশ এবং স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করিবার উদ্দেশে সভাসমিতি হইয়াছিল। ঢাকার সভায় ভূতপূর্ব্ব বান্ধবসম্পাদক এবং স্বর্গীয় ভাওয়ালরাজের প্রধান মন্ত্রী মনস্বী কালী প্রসন্ন ঘোষ বাহাদুর মহাশয়, সভাপতির আসন গ্রহণ করিয়াছিলেন। ভাওয়ালাধিপতি রাজা রাজেন্দ্রনারায়ণ বাহাদুর বিদ্যাসাগরের স্মৃতি-চিহ্ন রাখিবার অভিপ্রায়ে ঢাকা কলেজে তিন সহস্র টাকা দিবার প্রস্তাব করেন। বন্দোবস্ত এইরূপ হয়, যদি কোন ছাত্র প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া বৃত্তি না পায়, অথচ সংস্কৃত পরীক্ষায় সর্ব্বোচ্চ হয়, তাহা হইলে তাহাকে মাসিক ১০৲ দশ টাকা হিসাবে, পাঁচ বৎসর কাল এই টাকার সুদ হইতে বৃত্তি দেওয়া হইবে। কালীগঞ্জের স্কুলে একটি সভা হইয়াছিল। যে ছাত্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের একখানি সুন্দর জীবনী লিখিতে পারিবে, তাহাকে “বিদ্যাসাগর” নামক একটি পদক পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব হইয়াছিল। এতদ্ভিন্ন আরও বহু স্থানে বহুবিধ পুরস্কার-পদকাদি দিবার সঙ্কল্প সিদ্ধান্ত হইয়াছিল। নানা স্থানে লাইব্রেরী, চিকিৎসালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর পর সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক প্রভৃতি বহু পত্রেই তাঁহার স্মৃতিসম্মানসূচক শোক-কবিতা প্রকাশিত হইয়াছিল। উহার মধ্যে কবিবর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ রায় এবং শ্রীমতী ভূপেন্দ্রবালা দেবীর লিখিত তিনটী কবিতা হইতে কিছু কিছু উদ্ধৃত করিতেছি। এই তিনটী কবিতাই হিতবাদী পত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল।

“বিদ্যাসাগর।

ফুরাল বঙ্গের লীলা মাহাত্ম্য সকলি,—
হরিল বিদ্যাসাগরে কাল মহাবলী।
হারালে মা বঙ্গভূমি, পুত্ররত্নে আজ,
বিশীর্ণ বিমর্ষ দুঃখে বঙ্গের সমাজ!
কি মহা পরাণ লয়ে জন্মেছিল ধীর,
কিবা বিদ্যা, বুদ্ধি প্রভা, করুণা গভীর;
বিদ্যার সাগর খ্যাতি—আরো মনোহর;
বিশাল উদার চিত্ত দয়ার সাগর;—
তেমন সন্তান মাগো, কে আর তোমার!
কাঁদিছে, হের গো, তারে করিয়া স্মরণ,

দরিদ্র কাঙ্গাল দুঃখী কত শত জন,
কেবা অন্ন দিবে আর, কে ঘুচাবে দুঃখ,
দরিদ্র কাঙ্গালে দেখে কে চাহিবে মুখ;
কত রাজা রাণী আছে এ রাজ্য ভিতর—
কাঙ্গালে হেরিয়া কেবা করে সে আদর।
মানব দেহেতে সেই দয়া মুর্ত্তিমান্,—
প্রাতে স্মরণীয় নিত্য যাঁর গুণগান!

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।”


“ঈশ্বর বৈকুণ্ঠে।

আমার ঈশ্বর প্রভু,
আমার প্রাণের প্রাণ,
আমার গুরুর গুরু, জ্ঞানের জ্ঞেয়ান;
অপার দয়ায় সিন্ধু,
অসংখ্য দীনের বন্ধু,
ভাষার ভাস্কর-ইন্দু, দেবতা মহান্।
বিধবার কাতরতা,
অনাথের প্রাণব্যথা,
ছাত্রের জীবন গুরু ঈশ্বর আমার;
বিদ্যার সাগর ধীর,
সত্যের তেজস্বী বীর,
অন্যায়ের মহাবৈর ন্যায়-অবতার।

গাম্ভীর্য্যের মহা মূর্ত্তি,
রহস্যের মহাস্ফূর্ত্তি,
শিষ্টের পালন প্রভু দুষ্টের দমন;
অমর ঈশ্বর মোর,
অমরগণের সনে
হৃদয়-বৈকণ্ঠে মোর বিরাজে কেমন।
মোর মত শত শত
লক্ষ লক্ষ হৃদয়েতে
এতদিনে পূর্ণরূপে ঈশ্বর-বিকাশ;
একটি বৈকুণ্ঠ নয়,
লক্ষ লক্ষ—ততোহধিক
হৃদয়-বৈকুণ্ঠ এবে ঈশ্বর নিবাস।
কেন তবে কাঁদ সবে,
‘জয়েশ্বর’ উচ্চ রবে
তোল সুর বহু দূর আকাশ ভেদিয়া;
পৃথিবীর যে যেথায়,
শুনুক সে উচ্চ সুর,
কোটি কোটি চক্ষু মেলি দেখুক চাহিয়া,—
বাঙালীর ঘরে ঘরে,
লক্ষ লক্ষ ছয় কোটি
হৃদয়-বৈকুণ্ঠ মাঝে দয়ার সাগর
ঈশ্বর—ঈশ্বর—গুরু অমর ঈশ্বর।

রাজকৃষ্ণ রায়।”

“কে বলে ঈশ্বর নাই?

কে বলে ঈশ্বর নাই?
ঈশ্বর জীবনে ঈশ্বরের কার্য্য
জ্বলিছে দেখিতে পাই।
মৃত লোকে ভরা, স্বার্থপর ধরা
ঈশ্বরে হারায়ে আজ,
মৃত শোক ভরে, কাঁদিতেছে সবে
ধরিয়া শোকের সাজ।
বুঝে না তাহারা, অমর ঈশ্বর—
মরণ তাঁহার নাই;
নিঃস্বার্থ প্রেমের, অমৃতের ছবি
সংসারে রহিল তাই।
এ ছবি দেখিয়া কত মৃত প্রাণ
নূতন জীবন পাবে।
পরবর্ত্তী কত  নূতন জীবন
আদর্শে গঠিত হবে।
অমৃতের পুত্র, অমর ঈশ্বর
অমর-ভবন-বাসী,
প্রেম বিলাইয়া, অনন্ত প্রেমেতে
গিয়াছেন শেষে মিশি।
অমৃতের পুত্র, অমর ঈশ্বর
তাঁহার বিরহে আজ—

কাঁদিতেছে লোক, অমৃত ভাষায়
দেখে হৃদে পাই লাজ!
অমর বিরহে, কাঁদিবার তরে
চাই গো অমর ভাষা।
মৃত লোক তোরা,  তুলেছিস্ কেন
তোদের এ মৃত ভাষা?
অমৃতের পুত্র অমর যাহারা
এসো অগ্রসর হ’য়ে
অমর ভাষায় বিরহ সঙ্গীত
উঠ গো তোমরা গেয়ে।
সে সঙ্গীত গিয়ে, প্রতি মৃত প্রাণে
ঢালুক অমৃতধারা,
মুহূর্ত্তের তরে, সজীব হইয়া
হউক আপনাহারা।

শ্রীমতী ভূপেন্দ্রবালা দেবী।”

 ১৮৯১ খৃষ্টাব্দের ২৭শে আগষ্ট বা ১২৯৮ সালের ১১ই ভাদ্র টাউনহলে রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুজন্য শোক-প্রকাশে এবং তাঁহাদের স্মৃতি-চিহ্ন-সঙ্কল্পে এক বিরাট সভা হইয়াছিল। বঙ্গের স্যর চার্লস্ ইলিয়ট্ সভাপতি হইয়াছিলেন। হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি পেথরাম সাহেব, শ্রীযুক্ত রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়, অনারেবল গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রভৃতি উপস্থিত ছিলেন।  এই সভায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্থায়ী স্মৃতিচিহ্ন রাখিবার সঙ্কল্প হইয়াছিল। কলিকাতার সংস্কৃত কলেজে তাঁহার প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাঙ্গালীর কতক সৌভাগ্যের পরিচয় বটে। কিন্তু ইহাও প্রায় ঘটে না। আমরা বুঝি, কীর্ত্তিমানের কীর্ত্তিই অনন্তু অক্ষয় স্মৃতিস্তম্ভ। ধাতু প্রস্তর নির্ম্মিত প্রতিমূর্ত্তি বা পটাঙ্কিত প্রতিকৃতি পদে পদে প্রতিকৃতির অধীন। দুই দিনে তাহার লয় সম্ভাবনা; প্রলয়ে কীর্ত্তির বিলোপ নাই। কীর্ত্তি অবিনশ্বর ও অনন্ত-ভাস্বর। যাঁহার স্মৃতিচিহ্ন স্থাপনের সংকল্প করিয়া, সিদ্ধ করিতে পারেন না, তাঁহাদের জন্য আমাদের বাস্তবিক আন্তরিক কষ্ট হয়। সভা করিয়া বাগাড়ম্বরে শোক প্রকাশ করিবার প্রথা বাঙ্গালীর সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। প্রথার পরম গুরু, বিলাতী সাহেব সম্প্রদায়। তবে সাহেব সম্প্রদায়, আধুনিক শিক্ষিত বাঙ্গালীর মত পলে পলে প্রতিজ্ঞাভঙ্গে পটু নহেন। বাঙ্গালীর এ গৌরববাদ অধুনা বিশ্ব-বিসর্পিত। সাহিত্যের রুচির চিত্রপটে ভাষার ললিত বর্ণলাবণ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ, বাঙ্গালী চরিত্রের এই অংশের একটি উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত করিয়াছেন। এমারেল্ড থিটোরে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের স্মরণ জন্য ১৩০২ সালের ১৩ই শ্রাবণ যে সভা হইয়াছিল, তাহাতে রবীন্দ্র বাবুর পঠিত “বিদ্যাসাগর চরিত” প্রবন্ধের একস্থলে এই কথা লেখা ছিল,—“আমরা আরম্ভ করিয়া শেষ করি না। আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না। যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভূরি পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি; তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না।”

 এই সভায় সভাপতি মাননীয় গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় এই স্মৃতিচিহ্ন প্রতিষ্ঠার অকৃতকার্য্যতা স্মরণ করিয়া যেন আত্মচিত্ত প্রসাদকল্পে বলিয়াছিলেন,—“কীর্ত্তি-চিহ্ন প্রতিষ্ঠিত না হউক, বিদ্যাসাগর বাঙ্গালীমাত্রেরই হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত!” এ স্তোক-বাণী নিশ্চিতই বিক্ষত বক্ষের স্নিগ্ধ প্রলেপ।