বিদ্যাসাগর/ত্রয়োদশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে


ত্রয়োদশ অধ্যায়।

সাহিত্যাধ্যাপকতা, কৈফিয়ৎ, তর্কালঙ্কারের পত্র,

রিপোর্ট ও জীবন-চরিত।

 ১২৫৭ সালে ২৫শে অগ্রহায়ণ বা ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে ৯ই ডিসেম্বর সোমবার বিদ্যাসাগর মহাশয় সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যাধ্যাপকপদ প্রাপ্ত হন। এই পদের বেতন ছিল ৯০৲ নব্বুই টাকা। তিনি ৮ই ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের “হেড রাইটারী” পদ পরিত্যাগ করেন। শিক্ষা-সমাজের অধ্যক্ষ মার্সেল সাহেবের অনুরোধে তিনি সংস্কৃত কলেজের পদগ্রহণে সম্মত হন। ইহার পুর্ব্বে মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকতা করিতেন। তিনি মুরশিদাবাদের জজপণ্ডিত হওয়ায় এই পদ শূন্য হয়।[১]বিদ্যাসাগরের অনুরোধে তাঁহার প্রিয় শিষ্য ও সোদরসম মিত্র রাজকৃষ্ণবাবু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের “হেড রাইটর” পদে নিযুক্ত হন। ইহার পুর্ব্বে রাজকৃষ্ণ বাবু জডিন কোম্পানীর বাড়ীতে “খাজাঞ্চি” ছিলেন।

 বিদ্যাসাগর মহাশয যখন সাহিত্যাধ্যাপক পদে নিযুক্ত হইবার জন্য অনুরুদ্ধ হইয়াছিলেন, তখন তিনি স্পষ্টই বলিয়াছিলেন, “আমাকে যদি শীঘ্রই কলেজের অধ্যক্ষপদে নিযুক্ত করা হয়, তাহা হইলে এ পদ গ্রহণ করিব।” শিক্ষা-সমাজের অধ্যক্ষ মওয়েট পাতা:বিদ্যাসাগর (বিহারীলাল সরকার).pdf/২৩৯ পাতা:বিদ্যাসাগর (বিহারীলাল সরকার).pdf/২৪০ হে! কি বলিব ও কি লিখিব; আমি এই সবডিভিজনে আসিয়া অবধি যেন মহা অপরাধীর ন্যায় নিতান্ত ম্লান ও স্ফুর্ত্তিহীনচিত্তে কর্ম্ম-কাজ করিতেছি। অথবা আমার অসুখের ও মনোগ্লানির পরিচয় আর কি মাথা-মুণ্ড জানাইব, আমার বাল্যসহচর, একহৃদয়, অমায়িক সহোদরাধিক পরম বান্ধব বিদ্যাসাগর আজি ছয় মাস কাল হইতে আমার সঙ্গে বাক্যালাপ করে নাই। আমি কেবল জীবন্মতের ন্যায় হইয়া আছি। শ্যাম! তুমি আমার সকল জান, এই জন্যে তোমার নিকট এত দুঃখের পরিচয় পাড়িলাম।”

 তর্কালঙ্কার মহোদয়ের জামাতা ও তদীয় চরিতাখ্যায়ক শ্রীযুক্ত পণ্ডিত যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয় এই পত্রকে অপ্রামাণিক পত্র বলিয়াছেন।

 আমরা বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হইয়াছি, “এডুকেশন কৌন্সিলের” সেক্রেটারী ময়েট্ সাহেবের নির্ব্বন্ধতাতিশয্যেই বিদ্যাসাগর মহাশয়, সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যাধ্যাপক পদ গ্রহণ করেন। পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন মহাশয় ও তাঁহার “বাঙ্গালী ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক"প্রস্তাবে এই কথাই লিথিয়াছেন।

 সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যাধ্যাপক হইয়াই কলেজের শিক্ষাপ্রণালী সম্বন্ধে “রিপোর্ট” লিখিবার জন্য বিদ্যাসাগর মহাশয় ময়েট্ সাহেব কর্ত্তৃক অনুরুদ্ধ হন। শিক্ষা-বিভাগের কর্তৃপক্ষেরা এই সময সংস্কৃত কলেজের অচির-অস্তিত্বলোপের আশঙ্কা করিয়াছিলেন। এইরূপ আশঙ্কার কারণও ছিল। সংস্কৃত কলেজে পূর্ব্বের ন্যায় ছাত্র ভর্ত্তি হইত না। ক্রমেই ছাত্রসংখ্যা কম হইয়া আসিতেছিল। ছাত্রসংথ্যা হ্রাসের বলবৎ কারণও উপস্থিত হইযাছিল। সংস্কৃত কলেজের পাঠ-সমাপনে অনেক সময় লাগিত; পরন্তু সেই সময় ইংরেজি-বিদ্যার বেগও অধিকতর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছিল।

 ইংরেজি-বিদ্যাব প্রসার বাড়াইবার জন্য তখন শিক্ষণবিভাগের কর্ত্তৃপক্ষেরা ও অধিকতর যত্নশীল হইয়াছিলেন। ১৮৪২ খৃষ্টাব্দে “এডুকেশন কৌন্সিলের” উপর শিক্ষা-বিভাগের ভার পড়িয়াছিল। কৌন্সিল উচ্চশ্রেণী ইংরেজি ও বাঙ্গলা শিক্ষার উৎকর্ষসাধনে বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন। এতদর্থে তাঁহারা পরীক্ষা ও বৃত্তির যথোচিত ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। যাহার বেশ কৃতকার্য্য হইত, তাহাদিগের সরকারী কর্য্যে প্রবিষ্ট হইবারও বেশ সুবিধা হইত। ইংরেজি শিক্ষার জন্য পাঠ্যনিৰ্দ্ধারণ, পরীক্ষা-গ্রহণ, শিক্ষক. নিয়োজন প্রভূতি কর্য্যে কৌন্সিল কোনকপ ক্রটি করিতেন না। ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে ২৮টী স্কুল ছিল। ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দে কৌন্সিলের যত্নে ও চেষ্টায় ১৫১ট হইয়াছিল। ছাত্র ছিল, ৪,৬৩২টী; হুইয়াছিল ১৩, ১৬৩টী। শিক্ষক ছিল, ১৯১টী; হইয়াছিল ৪৫ টী। যাহার ভাল ইংরেজি লেখা পড়া শিখিত,তাহারা সহজেই চাকুরী পাইত। ইংরেজী বিদ্যা অর্থকরী বিদ্যা হইয়াছিল; সংস্কৃত বিদ্যা তো আর তাহা ছিল না; পরন্তু সংস্কৃত পাঠ-সমাপনে অনেক সময় লাগিত। কাজেই সংস্কৃত পড়িবার প্রবৃত্তিও লোকের কম হইয়াছিল। ক্রমেই সংস্কৃত কলেজের ছাত্র কমিতে আরম্ভ হয়। এই জন্য কৌন্সিলের কর্তৃপক্ষরা সংস্কৃত কলেজের লোপাকাঙ্ক্ষা করেন। তাঁহারা সংস্কৃত কলেজটী উঠাইয়া দিবারও এক রূপ সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। তবে কলেজটী একেবারে না উঠাইয়া কোনরূপ ইহার সংস্কার হইতে পারে কি না, ইহাও তাঁহাদের আলোচ্য হইয়াছিল। তাঁহারা ভাবিয়ছিলেন, কলেজের শিক্ষা-প্রণালী কোনরূপে সহজ করিতে পারিলে ও, কোনরূপে ইহাতে ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন করিতে পারিলে, অনেকের সংস্কৃত কলেজে পড়িবার প্রকৃতি হইতে পারে। এই সব ভাবিয়া, তাঁহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে ইহার একটী বিপোর্ট লিখিতে বলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় এ সম্বন্ধে দক্ষ, তাঁহাদের এইরূপই ধারণা ছিল।

 কৌন্সিলের কর্ত্তৃপক্ষ কি অভিপ্রায়ে রিপোর্ট লিখিতে বলিয়াছিলেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহা বেশ হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন। কি উপায়ে সংস্কৃত কলেজে সহজ শিক্ষাপ্রণালী প্রবর্ত্তিত হইতে পারে, তাহাই তাঁহার একমাত্র চিন্তার বিষয় হইল। সহজ প্রণালীর উদ্ভাবন করিতে না পারিলে যে সংস্কৃত কলেজ থাকা ভার হইবে, তিনি তাহা বুঝিয়াছিলেন। সেই সহজ প্রণালীর উদ্ভাবনা করিয়া, কৌন্সিলের অনুমত্যানুসারে তিনি প্রকাণ্ড রিপোর্ট লিখিয়াছিলেন। এইখানে বাঙ্গালায় তাহার মর্ম্মানুবাদ করিয়া দিলাম।

এফ, জে, ময়েট্,

কৌন্সিল অব্ এডুকেশন,

(শিক্ষা-সমিতির) সম্পাদক

যহাশয় সমীপেষু।

  মহাশয়!

 কৌন্সিল অব এডুকেশনের অবগতির জন্য আমি সংস্কৃত কলেজের শিক্ষা সম্বন্ধে একটী রিপোর্ট দিতেছি।

ব্যাকরণ-বিভাগ।

 বর্তমান-পদ্ধতি অনুসারে এই বিভাগ পাচটী শ্রেণীতে বিভক্ত।

 (১)১৮২৪ খৃষ্টাব্দে সংস্কৃত কালেজ প্রতিষ্ঠিত হইবার পর দুইটি মাত্র ব্যাকরণের শ্রেণী ছিল। একটা মুগ্ধবোধ শ্রেণী ও অপরটী পাণিনি। দ্বিতীয় মুগ্ধবোধ বানান শ্রেণী ১৮২৫ খৃঃ জানুয়ারি মাসে খোলা হয়। তৃতীয়টী ১৮২৫ খৃঃ নবেম্বর, চতুর্থটী ১৮৪৬ খৃঃ মে, পঞ্চমটী ১৮৪৭ খৃঃ জানুয়ারি। পাণিনি শ্রেণী ১৮২৮ খৃঃ উঠিয়া যায়। নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি পঠিত হইয়া থাকে। মুগ্ধ বোধ, ধাতুপাঠ, অমরকোষ ও ভট্টিকাব্য। পঞ্চম শ্রেণীতে মুগ্ধবোধের ১৭ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পঠিত হয়। চতুর্থ শ্রেণীতে উক্ত পুস্তকের ৪২ পৃষ্ঠা পর্ষ্যন্ত পাঠ হয়। তৃতীয় শ্রেণীতে ১০০ শত পৃষ্ঠা ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে উক্ত পুস্তকের অবশিষ্ট ৯১ পৃষ্ঠা ও ধাতুপাঠ। প্রথম শ্রেণীতে ভট্টিকাব্যের কয়েক সর্গ ও অমরকোষেব কিয়দংশ অধীত হয়। এই বিভাগে অধ্যয়ন করিতে চার বৎসর কাল নিৰ্দ্ধারিত হইয়াছে। কিন্তু উপরোক্ত পঞ্চ বিভাগে অধ্যয়ন করিতে হইলে পাঁচ বৎসর সময় অতিবাহিত করা প্রয়োজনীয় বোধ হয়। অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট প্রণালীর অভাবে, ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, বালকের এই বিভাগে পাঠকালে যে সময় অতিবাহিত করে, সময়ের সহিত তুলনা করিলে, তাহাদিগের শিক্ষা যৎসামান্য বলিতে হইবে। মুগ্ধবোধ অতি সংক্ষিপ্ত ব্যাকরণ। ইহার প্রণেতা বোপদেব, সংক্ষিপ্ততার প্রতি সবিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছেন বলিয়া বোধ হয়। তাঁহার এরূপ অভিপ্রায় থাকতে তিনি তাঁহার পুস্তককে অতিশয় দুরূহ করিয়াছেন। একে সংস্থত ভাষা অতিশয় কঠিন, তাহাতে একখানি দুরূহ ব্যাকরণ সহকারে ইহার শিক্ষা সুরু করা, আমার বিবেচনায় সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। এতাদৃশ ব্যাকরণে প্রবেশ লাভ করিতে হইলে যেরূপ কষ্ট পতিত হইতে হয়, তাহা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই অবগত আছেন। সুকুমার-মতি বালকবৃন্দ সংস্কৃত শিক্ষার আরম্ভকালে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের কঠিন্যপ্রযুক্ত তাহা দিগের শিক্ষকগণের উচ্চারিত কথাগুলি কেবল মুখস্থ করিয়া রাখে। তাহারা যে পুস্তক পাঠ করে, তাহার বিন্দুবিসর্গও নিজে নিজে বুঝিতে পারে না। এরূপে কেবল ব্যাকরণ অধ্যয়নেই পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হয়। কিন্তু ভাষায় কিঞ্চন্মাত্রও প্রবেশাধিকার জন্মে না। ইহা নিতান্তই বিস্ময়কর যে, এক ব্যক্তি ক্রমাগত ভাষাশিক্ষায় পাঁচ বৎসর কাল ব্যয় করিল, অথচ তাহার বিন্দুমাত্র ও বুঝিতে সমর্থ হইল না। বিশেষতঃ মুগ্ধবোধের বৃহদাকার টীকা টিপ্পনি সত্বেও উহা নিতান্তই অসম্পূর্ণ গ্রন্থ। সুতরাং বর্ত্তমান পদ্ধতি অনুসার সংস্কৃত কলেজের ছাত্রের প্রথম পাঁচ বৎসর বৃথা ব্যয় হয়। তাহার সমস্ত পরিশ্রম ও কষ্টের ফল এইমাত্র হয় যে, ব্যাকরণ শাস্ত্রে তাহার অধীত-বিদ্যা নিতান্তই অসম্পূর্ণ। এই বিভাগে ধাতুপাঠ নামে ধে অপর পুস্তক অধীত হয়, তাহার ছন্দোবদ্ধ সংস্কৃত ধাতুস’গ্রঙ্গম অমবকোষ একখানি ছন্দোনিবন্ধ অভিধান। আমি স্বীকাল করি যে, এই দুই গ্রন্থ সমাকৃরূপে আয়ত্ত হইলে সাহিত্য-শাস্ত্র অধ্যয়ন-কালে কিছু সুবিধ হইতে পারতে পারে; কিন্তু উক্ত গ্রন্থদ্বয় মুখস্থ করিতে যে সময় ও পরিশ্রম বায়িত হয়, তাহার তুলনায় প্রাপ্ত উপকার অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হয়। বিশেষতঃ ...... টীকাকার মল্লিনাথের অত্যুৎকৃষ্ট ব্যাখ্যায় অলঙ্কৃত; সুতরাং উক্ত পুস্তকদ্বয়ের অধ্যয়ন নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বলিয়া বোধ হয়।

 এস্থলে ইহার উল্লেখ আবশ্যক যে, উপরোক্ত টীকাকার তাঁহার অন্যান্য সহোযোগীর ন্যায় নহেন। তাঁহারা গ্রন্থের দুরূহ অংশগুলি পরিত্যাগ করিয়া অপেক্ষাকৃত সরল অংশগুলি বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করেন। এই সকল বিষয় সবিশেষ পর্য্যালোচনা করিয়া দেখিলে বিশেষ প্রতীতি হইবে যে, মুগ্ধবোধ, ধাতুপাঠ ও অমর কোষ পাঠে পাঁচ বৎসর কাল অতিবাহিত করা নিতান্ত যুক্তি-বিরুদ্ধ। এই বিভাগে অপর পাঠ্যপুস্তক ভট্টিকাব্য। ইহা রাম ও তাঁহার কার্য্য-কলাপসমন্বিত একথানি পদ্যগ্রন্থ। এই পুস্তকখানি ব্যাকরণশাস্ত্রের সূত্রসকলের উদাহরণ প্রদর্শনাভিপ্রয়েই লিখিত হইয়াছে। ইহা ব্যাকরণবিভাগের নিতান্ত অনুপযোগী বলিয়া বোধ হয় না।

 এক্ষণে ব্যাকরণবিভাগে প্রচলিত শিক্ষাপ্রণালীর সংস্কার করিতে ইচ্ছা করি। আমার সামান্য বিবেচনায় ইহা যুক্তি-সঙ্গত বলিয়া বোধ হয় যে, যে চারি বৎসর ব্যাকরণ বিভাগে অতিবাহিত করা নিৰ্দ্ধারিত আছে, উক্ত সময়ের মধ্যে যে ছাত্রেরা কেবল ব্যাকরণেই পারদর্শিতা লাভ করিবে, তাহা নহে; তাহার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ সাহিত্যেও কিঞ্চিৎ প্রবেশাধিকার লাভ করিতে পরিবে। এক্ষণে তাহারা সাহিত্য বিভাগে যে ক্লেশ অনুভব করে, তাহাদিগকে আদৌ তাহা করিতে হইবে না। একখানি অসম্পূর্ণ ব্যাকরণ অধ্যয়নানন্তর তাহাদিগকে সাহিত্যবিভাগে প্রবেশ করিতে হয় এবং ভাষায় তাহাদিগের কিঞ্চিম্মাত্রও জ্ঞান জন্মে না।  আমি যে প্রণালী প্রচলনের পক্ষপাতী, তাহা নিম্নে বিবৃত হইতেছে। প্রথমতঃ বালকেরা সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ব্যাকরণ পাঠ করিবার পরিবর্ত্তে এ দেশীয় ভাষায় রচিত ব্যাকরণের প্রধান প্রধান নিয়ম ও সূত্রগুলি পাঠ করিবে। তৎপরে তাহারা দুই কিংবা তিন খানি সংস্কৃত পাঠ্য অধ্যয়ন করিবে। এই সকল গ্রন্থে হিতোপদেশ, পঞ্চতন্ত্র, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ হইতে বালকদিগের পাঠোপযোগী উদ্ধৃত অংশ থাকিবে। এই সমস্ত পাঠে ছাত্রদিগের দুই বৎসরকাল অতিবাহিত হইবে। তৎপরে তাহারা সিদ্ধান্ত-কৌমুদী আরম্ভ করিবে ও তাহা ব্যাকরণ-বিভাগে উচ্চতম শ্রেণী পর্য্যন্ত অধ্যয়ন করিবে। সমস্ত সংস্কৃত ব্যাকরণের মধ্যে এইখানি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ও ব্যাকরণশাস্ত্রে একমাত্র সর্ব্বোৎকৃষ্ট পুস্তক। ইহা যেরূপ সম্পূর্ণ, তাদৃশ সরল। সিদ্ধান্ত-কৌমুদীর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রেরা রঘুবংশ ও ভট্টিকাব্য হইতে উদ্ধৃত অংশ ও দশকুমারচরিত পাঠ করিবে। আমার প্রস্তাব এই যে, পাঁচটী শ্রেণীর পরিবর্ত্তে চারিটীমাত্র শ্রেণী থাকিবে ও পঞ্চমটী চতুর্থ শ্রেণীর একটী বিভাগ বলিয়া গণ্য হইবে। উভয় বিভাগেই একই পুস্তক অধীত হইবে। এই বন্দোবস্ত দ্বারা একটী বৎসর বাঁচিয়া যাইবে এবং ব্যাকরণ-বিভাগে পাঁচ বৎসরের পরিবর্ত্তে চারি বৎসর নির্দ্ধারিত হইবে।

সাহিত্য-বিভাগ।


 ব্যাকরণ বিভাগ হইতে ছাত্রেরা এই শ্রেণীতে উন্নীত হইলে তাহাদিগকে এখানে দুই বৎসর কাল পাঠ করিতে হয়। তাহারা এখানে নিম্নলিখিত পুস্তকগুলি অধ্যয়ন করে। (১) রঘুবংশ, (২) কুমার-সম্ভব, (৩) মেঘদূত, (৪) কিরাতার্জ্জুনীয়, (৫) শিশুপালবধ, (৬) নৈষধ-চরিত (৭) শকুন্তলা, (৮) বিক্রমোর্ব্বশী, (৯) রত্নাবলী, (১০) মুদ্রারাক্ষস, (১১) উত্তর চরিত, (১২) দশকুমার চরিত ও (১৩) কাদম্বরী।

 তাহারা এখানে বাঙ্গালা হইতে সংস্কৃত ও সংস্কৃত হইতে বাঙ্গালা ভাষায় অনুবাদ করিতে অভ্যাস করে ও গণিত শ্রেণীতে অধ্যয়ন করে। উপরোক্ত ত্রয়োদশখানি পুস্তকের মধ্যে ছয়খানি প্রসিদ্ধ পদ্য-গ্রন্থ। সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ নাটক; অবশিষ্ট দুখানি গদ্য। রঘুবংশ একখানি ঐতিহাসিক পদ্য-গ্রন্থও ঊনবিংশ সর্গে বিভক্ত। রামচন্দ্র, তাঁহার উপরিতন তিন পুরুষ ও তাঁহার সন্তান-সন্ততিগণের কার্য্যকলাপ রঘুবংশের বর্ণিত বিষয়। ইহাতে রাজা অগ্নিবর্ণের বৃত্তান্ত পর্য্যন্ত সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।

 “কুমার-সম্ভব” এই নামকরণেই ইহা প্রতীয়মান হয় যে, কার্ত্তিকেয়ের জন্মবৃত্তান্ত ইহার বর্ণিত বিষয়। কিন্তু ইহার প্রচলিত সাতসর্গ পাঠে দৃষ্ট হইবে যে, ইহাতে বর্ণিত বিষয়ের কিয়দংশ সন্নিবিষ্ট হইয়াছে বটে, কিন্তু কার্ত্তিকেয়ের মাতা পার্ব্বতীর জন্ম, শিব কর্ত্তৃক কামদেব ভস্ম, পার্ব্বতীর তপস্যা ও তাঁহার সহিত শিবের বিবাহ প্রভৃতি ব্যাপারও ইহাতে বর্ণিত আছে।

 মেঘদূত ১১৮ শ্লোকে রচিত একখানি পদ্য গ্রন্থ। কোন যক্ষ তাঁহার প্রভু ধনাধিপতি কুবেরের কোনও কারণে ক্রোধভাজন হওয়াতে তাহার প্রভু কর্ত্তৃক অভিশপ্ত হইয়া, সুদূরবর্ত্তী প্রদেশে প্রিয়াবিরহিত হইয়া, পূর্ণ এক বৎসরকাল বাস করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। প্রণয়ী যক্ষ এই বিপৎপাতে নিতান্ত ক্লিষ্ট হইয়া, নিজ প্রিয়ার নিকট তাঁহার বার্ত্তাবহনের জন্য একখণ্ড মেঘকে কুবেরের রাজধানী অলকা-নগরীতে যাইতে অনুরোধ করিয়াছিলেন।

 শকুন্তলা ও বিক্রমোর্ব্বশী দুইখানি নাটক। প্রথমখানি কণ্বঋষি-প্রতিপালিতা শকুন্তলা ও রাজা দুষ্মন্তের প্রণয়-ব্যাপার অবলম্বনে লিখিত; দ্বিতীয়খানি রাজা পুরু ও উর্ব্বশীর বৃত্তান্তঘটিত ব্যাপারে পরিপূর্ণ। এই সমস্ত অতি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ অমর কবি কালিদাসের রসময়ী লেখনী-প্রসূত। প্রত্যেক গ্রন্থে তাঁহার অলৌকিক প্রতিভার সুস্পষ্ট পরিচয় দেদীপ্যমান আছে। শিশুপালবধ, কিরাতার্জ্জুনীয় ও নৈষধ-চরিত বীররসপ্রধান কাব্য। প্রথমখানি মহাকবি মাঘ-রচিত ও বিংশ সর্গে বিভক্ত। দ্বিতীয়, কবি ভারবি-রচিত ও সপ্তদশ সর্গে বিভক্ত। তৃতীয় খানি শ্রীহর্ষরচিত ও দ্বাবিংশ সর্গে বিভক্ত। শ্রীকৃষ্ণের হস্তে শিশুপালের মৃত্যু কবি মাঘের পদ্য-গ্রন্থের বর্ণিত বিষয়। কিরাতার্জ্জুনীয় গ্রন্থের বর্ণিত বিষয়, অর্জ্জুনের তপস্যা। ছদ্মবেশধারী কিরাতরূপী শিবের সহিত তাঁহার যুদ্ধ ও অবশেষে তাঁহার বীরত্বের পারিতোষিক স্বরূপ মহাদেবের নিকট হইতে তাঁহার পাশুপত অস্ত্রলাভ। রাজা নলের কার্য্য-কলাপ নৈষধ-চরিতের বর্ণিত বিষয়। উপরোক্ত প্রথম দুইখানি পুস্তকে উৎকৃষ্ট বীররসাত্মক কাব্যের সমস্ত গুণ লক্ষিত হয়। কেবল মধ্যে মধ্যে ক্লেশকর দুই একটী স্থান দৃষ্ট হয়। শিশুপাল-বধের সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ সর্গ উন্নত ভাবগর্ভ কবিতায় পরিপূর্ণ; কিন্তু উহাতে ও কিরাতার্জ্জুনীয়ের স্থানে স্থানে অশ্লীল শ্লোক দৃষ্ট হয়। নৈষধ-চরিত আরম্ভ হইতে শেষ পর্য্যন্ত শব্দাড়ম্বর ও অত্যুক্তি বর্ণনায় পরিপূর্ণ। ইহার ভাষা বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল নহে, কিন্তু মধ্যে মধ্যে শ্লোকসকল সুন্দরভাবে পরিপূর্ণ। ভবভূতিপ্রণীত উত্তরচরিত একখানি নাটকবিশেষ। ইহাতে রামচন্দ্রের জীবনের শেষ অংশ বর্ণিত আছে। রত্নাবলী একখানি নাটক। দক্ষ ইহার গ্রন্থকর্ত্তা। রাজা শ্রীহর্ষ কর্ত্তৃক অর্থদানে পুরস্কৃত হইয়া তিনি উক্ত পুস্তকখানি প্রণয়ন করেন, তিনি ঐরূপ আর একখানি রচনা করিয়া উভয় পুস্তক রাজা শ্রীহর্ষরচিত বলিয়া প্রচারিত করেন। রাজা উদয়ন ও রত্নাবলী ঘটিত প্রণয়-কাহিনী অবলম্বনে উক্ত নাটকখানি রচিত। এই উভয় পুস্তক সর্ব্ববিধায়ে অতি উৎকৃষ্ট। বিশাখদত্তপ্রণীত মুদ্রারাক্ষস একখানি রাজনৈতিক নাটক নামে অভিহিত হইতে পারে। ইহাতে আমরা দেখিতে পাই যে, গ্রীকদিগের বর্ণিত চান্দ্রকোটাসের (চন্দ্রগুপ্তের) প্রধান মন্ত্রী চাণক্য স্বীয় প্রভুর নূতন অধিকৃত রাজ্যের দৃঢ়তা সম্পাদনের জন্য কূটনীতিপূর্ণ কৌশলপ্রয়োগ দ্বারা নন্দবংশোদ্ভব শেষ রাজার প্রভুভক্ত প্রধান মন্ত্রী রাক্ষসের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দিতেছেন। ইহাও একখানি সুকৌশলসম্পন্ন সুন্দর গ্রন্থ। দশকুমারচরিত ও কাদম্বরী গ প্রথমোক্ত গ্রন্থে কতকগুলি বন্ধু নিজ নিজ ইতিহাস বর্ণন করিতেছে। ভাষা বিশুদ্ধ ও সুন্দর; কিন্তু ইহাতে স্থানে স্থানে দোষপূর্ণ অংশ আছে। দণ্ডী ইহার গ্রন্থকর্ত্তা। কাদম্বরী একখানি উপন্যাস বা গদ্য-রসাত্মক কাব্য। ইহা দুই অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশ সংস্কৃত রচনার একখানি আদর্শ-গ্রন্থ। গ্রন্থকর্ত্তা বাণভট্ট এই সর্ব্বজন প্রশংসনীয় পুস্তকখানি সম্পূর্ণ করিবার পূর্ব্বে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় ভাগ রচনা করেন। পুত্রের রচনা পিতার অপেক্ষা সর্ব্বতোভাবে নিকৃষ্ট। এ সম্বন্ধে আর অধিক বক্তব্যের প্রয়োজন নাই।

   ২৮  গণিত-শিক্ষা-সম্বন্ধে আমার বক্তব্য, জ্যোতিষ শিক্ষা প্রকরণে প্রকাশ করিব।

 আমি ষে পরিবর্তনের প্রস্তাব করি, তাহা এই। ব্যাকরণবিভাগ-সংক্রান্ত রিপোটে আমি উল্লেখ করিয়াছি, রঘুবংশ প্রথম ব্যাকরণ শ্রেণীতে অধীত হউক ও দশকুমারচরিতের উদ্ধৃত অংশসকল অপর একটী ব্যাকরণবিভাগে পঠিত হউক এবং শিশুপালবধ, কিরাতার্জ্জনীয় ও নৈষধ-চরিতে অনেক অশ্লীল শ্লোক থাকাপ্রযুক্ত সমস্ত পঠিত হইবার পরিবর্ত্তে উহার উদ্ধত অংশসমূহ পঠিত হউক। ক - রীব পূর্ব্বভাগ পাঠ্যপুস্তকরূপে গণ্য হউক। অন্যা্ন্য সমুদয় গ্রন্থ সমস্তই পঠিত হউক। আমি ইহাও প্রস্তাব করিতেছি যে, বীরচরিত ও শান্তিশতক এই শ্রেণীতে পাঠ্যপুস্তকরূপে গৃহীত হউক। বীরচরিত ও উত্তরচরিত একখানি নাটকরূপে পরিগণিত হইতে পারে। তন্মধ্যে বীরচরিত পুর্ব্বার্দ্ধ ও উত্তরচরিত অপরার্দ্ধ। বীর-চরিতও উত্তর-চরিত অপেক্ষা কোন অংশে নিকৃষ্ট নহে। শান্তিশতক একখানি সুন্দর নীতিপূর্ণ পদ্য-গ্রন্থ। ছাত্রেরা এ সময় অনুবাদ ও সংস্কৃত বঙ্গভাষায় প্রবন্ধাদি লিখিতে অভ্যাস করিবে।

অলঙ্কার শ্রেণী।

 সাহিত্যচর্চর পর ছাত্রেরা এই শ্রেণীতে আসে ও এথানে দুই বৎসর কাল অধ্যয়ন করে। তাহারা এই শ্রেণীতে অলঙ্কারসম্বন্ধে নিম্নলিপিত পুস্তকগুলি অধ্যয়ন করে।  (১) সাহিত্য-দর্পণ।   (৩) কাব্য-দর্শন।

 (২) কাব্য-প্রকাশ।   (৪) রসগঙ্গাধর।

 সাহিত্য-শ্রেণীতে যে সমস্ত পদ্য-গ্রন্থ পাঠ করিবার তাহাদিগের অবসর থাকে, এস্থলে তাহারা সেই পদ্য-গ্রন্থসমূহ পাঠ করে। এতদ্বব্যতীত তাহাদিগকে অনুবাদ ও রচনা শিক্ষা করিতে হয়। তাহাদিগকে আবার গণিতশ্রেণীতে গমন করিতে হয়। এই গণিত শ্রেণীসম্বন্ধে আমি নিন্মলিখিত পরিবর্ত্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। অলঙ্কার সম্বন্ধে কাব্যপ্রকাশ ও দশরূপক অতি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ। কিন্তু সচরাচর সাহিত্যদর্পণই পঠিত হইয়া থাকে। কিন্তু আমি নিম্নলিখিত কারণে কাব্যপ্রকাশ ও দশরূপক গ্রন্থদ্বয়কে অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট বলিয়া স্বীকার করি।

কাব্যপ্রকাশ, সাহিত্যদর্পণ অপেক্ষা সর্ব্ববিষয়ে গাম্ভীর্য্যপূর্ণ গ্রন্থ। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিবেন যে, অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ে ইহা একখানি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। মল্লিনাথের ন্যায় উৎকৃষ্ট টীকাকারগণ তাঁহাদিগের ব্যাখ্যায় পুনঃ পুনঃ ইহার উল্লেখ করিয়াছেন; কিন্তু কাব্যপ্রকাশে নাটকরচনা সম্বন্ধে কোন উল্লেখ নাই। দশরূপকে অলঙ্কারশাস্ত্রের উক্ত বিভাগে সবিশেষ আলোচনা করা হইয়াছে। বিশেষতঃ নিজ বিভাগে ইহা অতি শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত। সাহিত্যদর্পণ অপেক্ষা কাব্যপ্রকাশ ও দশরূপক, অপেক্ষাকৃত অল্পসময়ে পঠিত হইতে পারে। তন্নিমিত্ত কাব্যপ্রকাশ ও দশরূপক, সাহিত্যদর্পণের স্থান অধিকার করিতে পারে। উক্ত গ্রন্থদ্বয় পাঠ করিবার পরে অপরটী অধ্যয়ন করা কেবল সময় নষ্ট মাত্র। যদি ব্যাকরণশ্রেণী-সংক্রান্ত আমার বক্তব্যগুলি গৃহীত হয়, তবে অলঙ্কারশ্রেণীতে কেবল সাহিত্যবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠের আবশ্যকতা থাকে না। এ কারণে যে সময় উদ্বৃত্ত থাকিবে, তাহা গণিত ও অন্যান্য বিষয়ে নিয়োগ করা যাইতে পারে। তাহার উল্লেখ পরে করিব।[২]

জ্যোতিষ ও গণিতশ্রেণী।

 সাহিত্য ও অলঙ্কার শ্রেণীর ছাত্রেরা এই শ্রেণীতেও অধ্যয়ন করে। এখানে তাহারা লীলাবতী ও বীজগণিত পাঠ করে। লীলাবতী ভাস্করাচার্য্য প্রণীত একখানি অঙ্ক ও পরিমিতি-বিষয়ক গ্রন্থ। বীজগণিত উক্ত গ্রন্থকার প্রণীত। উভয় গ্রন্থই অতি সংক্ষিপ্ত। পুস্তকদ্বয়ে কোন প্রকার শৃঙ্খলা নাই ও ইংলণ্ডীয় ভাষায় রচিত তৎসদৃশ পুস্তকের ন্যায় উহাতে কিছুই নাই। তাহা অকারণে অতিশয় কঠিন করিয়া রচিত হইয়াছে। প্রশ্নাবলী ছন্দে নিবদ্ধ। এই পুস্তক শিক্ষা করিতে ছাত্রগণের দুই বৎসর লাগে। অধ্যয়ন বিভাগের এই স্থানে সবিশেষ পরিবর্ত্তনের আবশ্যক। ইংলণ্ডীয় গ্রন্থকারগণের পুস্তক হইতে অঙ্ক, বীজগণিত ও জ্যামিতি সম্বন্ধে পুস্তকাদি সংগ্রহ হওয়া উচিত। এই সকল পুস্তক অধ্যয়নের পর বালকেরা অতি সহজে লীলাবতী ও বীজগণিত পুস্তক শিক্ষা করিতে পারিবে। গণিতবিদ্যার উচ্চ শাখাসমূহ অনুবাদিত ও পাঠ্যপুস্তকরূপে গণ্য হওয়া উচিত। মার্শেল সাহেব কৃত জ্যোতিষশাস্ত্রের ন্যায় পুস্তক বাঙ্গালাভাষায় অনুবাদ হওয়া উচিত ও গণিত শ্রেণীতে তাহার পঠনা হওয়া আবশ্যক। ঐ সমস্ত পুস্তক ইংরেজী ভাষাতেই পাঠ্য হইতে পারে; কিন্তু বঙ্গভাষায় অনুবাদিত হইলে, বাঙ্গালা বিদ্যালয়ের বিশেষ উপযোগী হইবে। সাহিত্য ও অলঙ্কার শ্রেণীর ছাত্রগণ ব্যতীত স্মৃতি ও ন্যায় শ্রেণীর ছাত্রদিগেরও গণিতাধ্যাপকের উপদেশ শ্রবণ করা উচিত। এস্থলে সংস্কৃত কলেজের নিম্নশ্রেণী কাব্যের শেষ হইল, ইহা বিবেচিত হইতে পারে। এই বিভাগের শ্রেণীসমূহে মনোহর অথচ প্রয়োজনীয় বিষয়সংবলিত বঙ্গভাষায় রচিত পুস্তক সকল অধীত হইবার প্রয়োজনীয়তা আমি অনুভব করি; সুতরাং এই প্রস্তাব করি যে উক্ত পুস্তকসমূহে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি সন্নিবিষ্ট থাকে।

 ব্যাকরণের চতুর্থ শ্রেণীর জন্য - পশুসংক্রান্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গল্প।

 তৃতীয় শ্রেণীর জন্য - রুডিমেণ্টস্‌ অব্‌ নলেজ ও চেম্বার্স সাহেব কৃত গ্রন্থাবলী।

 দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য চেম্বার্স সাহেব কৃত মরাল-ক্লাস বুক।

 প্রথম শ্রেণীর জন্য বিবিধ বিষয়। যথা - মুদ্রাঙ্কণ, চুম্বকাকর্ষণ, নৌ-বিদ্যা, ভূমিকম্প, পিরামিড, চীনদেশীয় প্রাচীর, মধুমক্ষিক ইত্যাদি।

 সাহিত্য শ্রেণীর জন্য চেম্বার্স সাহেব কৃত জীবনচরিত ও অন্যান্য মনোহর ও প্রয়োজনীয় বিবিধবিষয়ক প্রবন্ধ। যথা - টেলিমেক্‌স, রাসেলাস্‌ মাহাভারত প্রভৃতি গ্রন্থ হইত উদ্ধৃত অনুবাদসমূহ।

 অলঙ্কার-শ্রেণীর জন্য, - নৈতিক, রাজনীতিক ও সাহিত্যবিষয়ক পুস্তকাবলী ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানবিষয়ক পুস্তকাদি।

 যদি এডুকেশন কৌন্সিলের অধ্যক্ষ এই সকল ভাষায় রচিত গ্রন্থ পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্দ্দিষ্ট করেন, তবে সংস্কৃত কলেজের ছাত্রেরা অল্পায়াসে বঙ্গ ভাষায় সুন্দর পারদর্শিতা লাভ করিতে পারিবে ও ইংরেজি ভাষাশিক্ষা আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে অনেক প্রয়োজনীয় জ্ঞান উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হইবে ও চিত্তবৃত্তির বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করিবে।

 পূর্ব্বোক্ত বাঙ্গালা গ্রন্থের মধ্যে জীবনচরিত মুদ্রিত হইয়াছে। বোধাদয় ও নীতিবোধ মুদ্রিত হইতেছে এবং অন্যান্ত পুস্তকগুলি প্রস্তুত হইতেছে। এই সমস্ত পুস্তক প্রচলনের জন্য কৌন্সিলকে কোন অতিরিক্ত ব্যয় গ্রহণ করিতে হইবে না। এই স্থলে ইহা উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গভাষায় রচিত সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও সংস্কৃত ভাষায় লিখিত সঙ্কলনগুলি প্রস্তুত করিতে কোন আর্থিক আনুকূল্যের প্রয়োজন হইবে না।

 সংস্কৃত কলেজের গণিত-শ্রেণীর ব্যবহারের জণ্ঠ গ্রন্থাবলী। যথা,—অঙ্কবিদ্যা, বীজগণিত, জামিতি ও জ্যোতিষ শাস্ত্র। এই সকল গ্রন্থ রচনা করিবার জন্য কৌন্সিল অব এডুকেশনের সাহায্য নিতান্ত আবশ্যক ও কৌন্সিলের সঞ্চিত অর্থ হইতে এ বিষয়ে সহজেই সাহায্য করা যাইতে পারে।

স্মৃতি বা আইন-শ্রেণী।

অলঙ্কার-শ্রেণী হইতে ছাত্রের এই শ্রেণীতে উন্নীত হয় ও এখানে তিন বৎসর কাণ অধ্যয়ন করে। পাঠ্যপুস্তকগুলি এই,—মসু- সংহিতা, মিতাক্ষরা দ্বিতীয় অধ্যায়, বিবাদচিস্তামণি, দায়ভাগ, দত্তকমীমাংস, দত্তকচন্দ্রিকা, অষ্টাবিংশতি তত্ত্ব, হিন্দু আইন সম্বন্ধে মনুসংহিতাই সব্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। ইহাতে সামাজিক, নৈতিক, রাজনীতিক, ধর্মসংক্রান্ত ও অর্থশাস্ত্রবিষয়ক নিয়মাবী সন্নিবিষ্ট আছে। প্রাচীনকালের আদর্শ হিন্দু-সমাজের বিষয় ইহাতে বর্ণিত আছে। বিজ্ঞানেশ্বরচিত মিতাক্ষরা মহসি যাজ্ঞবল্ক্য প্রণীত এন্তের টাকা মাত্র। দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেওয়ানী ও ফৌজদারী দায়সম্বন্ধীয় আইন-কানুন বিবৃত আছে। পশ্চিমোত্তরাঞ্চলে মিতাক্ষরা একখানি সর্ব্বসম্মত প্রমাণ-গ্রন্থ।

 বিবাদ-চিন্তামণি বাচস্পতিমিশ্র প্রণীত। ইহাত দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিধি বিধৃত। বিহারে ইহা প্রমাণ-গ্রন্থ। জীমূত বাহন দায় ভাগের প্রণেতা। উত্তরাধিকারিত্ব ইহার প্রতিপাদ্য বিষয়। ইহা বাঙ্গালায় সর্ব্বসম্মত প্রমাণ এন্থি। পোষ্যপুত্র গ্রহণ ও তাহাদের দেওয়ানি অধিকার বিষয় ধাইয়া দত্তক-মীমাংসা ও দত্তকচন্দ্রিকা। মীমাংসা পশ্চিমোত্তরাঞ্চলে এবং চন্দ্রিকা বাঙ্গালয় প্রমাণ-গ্রন্থ।

 দায়তত্ত্ব, ব্যবহার তত্ত্ব এবং অন্যান্যবিষয়ক ছাব্বিশখানি গ্রন্থ লইয়া অষ্টাবিংশতিত্ব। ইহা রঘুনন্দন-প্রণীত, প্রথমোক্তখানি দায়সম্বন্ধে, দ্বিতীয়খানি আদালতের কার্য্যবিধি সম্বন্ধে। অন্য ছাব্বিশখানি ধর্ম্মানুষ্ঠানসংক্রান্ত। এই শ্রেণীসম্বন্ধে আমার বক্তব' এই যে, অষ্টাবিংশতি তত্ত্বের অধ্যাপনা বন্ধ হওয়া উচিত। ইহা যাজনব্যবসায়ী ব্রাহ্মণ-পুরোহিতদিগের শিক্ষোপযোগী। ওরুপ গ্রন্থাদি বিদ্যালয়ে অধীত হইবার সম্পূর্ণ অনুপযোগী। 'অপর পুস্তকগুলিপীঠে কোন প্রতিবন্ধক নাই ও প্রচলিত থাকিতে পারে। উক্ত গ্রন্থাদির অনুশীলনে ভাবতবর্ষস্থ যাবতীয় প্রদেশের হিন্দু-আইন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা জন্মে।

ন্যায়-শ্রেণী।

 তর্কশাস্ত্র ও দর্শন-বিদ্যাঘটিত ব্যাপার লইয়াই ন্যায়শাস্ত্র। মধ্যে মধ্যে রসায়ন, দৃষ্টিবিজ্ঞান, গতিবিজ্ঞান প্রভৃতি সম্বন্ধেও উল্লেখ আছে। মীমাংসা ও পাতঞ্জল ব্যতীত অন্যান্য শাস্ত্রসম্বন্ধেও ঐরূপ বলা যাইতে পারে। মীমাংসা ও পাতঞ্জলে ধর্ম্মানুষ্ঠান ও ঈশ্বর সম্বন্ধে চিন্তার বিষয় উল্লিখিত আছে। চারিবৎসর কাল অধ্যয়ন করিতে হয়। নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্দিষ্টভাষা-পরিচ্ছেদ, সিদ্ধান্তমুক্তাবলী, ন্যায়সূত্র, কুসুমাঞ্জলি, অনুমান-চিন্তামণি, দীধিতি, শব্দশক্তিপ্রকাশিকা, পরিভাষা, তত্ত্ব-কৌমুদী, খণ্ডনা ও তত্ত্ববিবেক। ভাষা-পয়িচ্ছেন বিশ্বনাথ-পঞ্চানন প্রণীত। ইহা ন্যায়শাস্ত্রের সকল শাখাসম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ। গ্রন্থকার স্বরচিত ভাষাপরিচ্ছেদ সম্বন্ধে একখানি টীকা সঙ্কলন করিয়াছিলেন। তাহার নাম সিদ্ধান্তমুক্তাবলী। ন্যায়সূত্র গৌতমঋষি প্রণীত। কুসুমাঞ্জলি গ্রন্থে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও পরকাল সংক্রান্ত বিষয় উল্লিখিত আছে। ইহাতে যে তর্ক প্রণালী অনুসরণ করা হইয়াছে, তাহা প্রধানতঃ আধুনিক ইউরোপীয়গণের প্রণীত গ্রন্থাবলীতে অবলম্বিত তর্কপ্রণালী তুল্য। ইহার গ্রন্থকর্তার নাম উদয়না। অনুমানচিন্তামণি বর্তমান ন্যায়শাস্তুসম্প্রদায়সম্মত একখানি উপপত্তি (Dcduction) বিষয়ক গ্রন্থ। ইহার গ্রন্থ কর্তার নাম গঙ্গেশ উপাধ্যায়। ইউরোপের মধ্যযুগের পণ্ডিতদিগের অবলম্বিত বিচার প্রণালী সদৃশ এই গ্রন্থকর্তার বিচার প্রণালী। যাহাকে বেকন “বিদ্যার উর্ণনাভ জলি” বলিয়াছেন, উক্ত গ্রন্থ সেইরূপ।

 এই গ্রন্থের অধ্যয়নকালে বিস্তর কষ্ট অনুভব করিতে হয়। বর্তমান ন্যায়সম্প্রদায়ের অধিনায়ক রঘুনাথ শিরোমণি-প্রণীত অনুমানদীধিতি নামে ইহার একখানি টকা আছে। শব্দশক্তি প্রকাশিকা বাক্যের অর্থসংক্রান্ত একখানি গ্রন্থ। ধর্মরাজ প্রণীত "পরিভাষা” গ্রন্থখানি বৈদান্তিক মতের সমর্থনকারী। বাচস্পতি- মিশ্র পণীত তত্ত্বকৌমুদী গ্রন্থখানি সাংখ্যদর্শন সম্বন্ধে একখানি বিস্তীর্ণ পুশুক। শ্রীহর্ষ প্রণীত গ্রন্থের নাম খণ্ডনা গ্রন্থকার অভিপ্রায় এই যে, অন্যান্য সমুদয় দর্শনসম্প্রদায়ের মণ্ডগুলি খণ্ডন করিয়া নিজের প্রিয় বৈদান্তিক মতের প্রতিষ্ঠা করা। গ্রন্থখানি বিশেষ প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছে। গ্রন্থকর্ত্তা বর্ণিত বিষয় অভি দুর্ব্বোধ ভাষায় অবতারণা করিয়াছেন। উদয়নাচার্যপ্রণীত বিবেকে নাস্তিকতার বিরুদ্ধে তর্কসকল উত্থাপিত ও সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডের এক জন সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজনীতা সম্বন্ধে বিচার করা হইয়াছে। এই গ্রন্থের ভাষা যেরূপ দুরূহ, তেমনই অসংলগ্ন।

 এক্ষণে আমার নিবেদন এই যে, উক্ত শ্রেণীকে ন্যায়-শ্রেণী নামে অভিহিত না করিয়া, দর্শন-শ্রেণী নামে অভিহিত করা উচিত। অনুমান-চিন্তামণি, দীধিতি, খণ্ডনা ও তত্ববিষেকের অধ্যাপনা বন্ধ হউক ও তাহার পরিবর্তে মীমাংসা ও ধর্মানুষ্ঠান সম্বলিত নিম্নলিখিত দর্শনশাস্ত্রসম্বন্ধীয় গ্রন্থগুলি অধীত হউক,—

(১) সাঙ্খ্যপ্রবচন।
(৩) পঞ্চদশী।
(২} পাতঞ্জলসূত্র।
(৪) সর্ব্বসারসংগ্রহ
 সংস্কৃত কলেজের শিক্ষার কাল ১৫ পনের বৎসর মাত্র। তাহাতে এরূপ আশা করা যাইতে পারে যে এক ব্যক্তি এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে সংস্কৃত বিদ্যায় উত্তম পারদর্শিতা লাভ করিতে পারে। ভারতবর্ষে প্রচলিত সমস্ত দর্শনশাস্ত্রে জ্ঞানলাভ করিতে পারিলে, কেহই সংস্কৃত বিদ্যায় পাণ্ডিত্য লাভ করিয়াছেন বলি গণ্য হইতে পারে না। ইহা অতি সত্য কপ যে, হিন্দুদর্শন-শাস্ত্রের অধিকাংশের সহিত আধুনিক সময়ের উন্নত চিন্তার সৌসাদৃশ্য অল্পই লক্ষিত হয়। তথাপি ইহা কখনই অস্বীকার করা যাইতে পারে না যে, এক জন সংস্কৃতিজ্ঞের পক্ষে উক্ত দর্শন- শাস্ত্রের জ্ঞান নিতান্তই প্রয়োজনীয়। ইংরেজী বিভাগসম্বন্ধে আমার মন্তব্যগুলি রিপোর্টের স্থানান্তরে উল্লেখ করিব। যদি কৌন্সিল অব এডুকেশন আমার মন্তব্যগুলি গ্রহণ করেন, তাহা হইলে যে সময়ের মধ্যে ছাত্রের দর্শন শ্রেণীতে উন্নীত হইবে, সেই সময়ের মধ্যে তাহাদিগের শিক্ষিত ইংরেজী ভাষাজ্ঞান অনায়াসেই, তাহাদিগকে ইউরোপখণ্ডের দর্শনশাস্ত্রের জটিল বিষয়সমূহ প্রণিধান করিতে সমর্থ করিবে। তাহারা পাশ্চাত্য দর্শনশাস্ত্রের সহিত তাহাদিগের স্বদেশীয় দর্শনশাস্ত্রের তুলন করিতে সহজেই পারগ হইবে। যুবকেরা এই পদ্ধতি অনুসারে শিক্ষিত হইলে সহজেই প্রাচীন হিন্দু-দর্শনশাস্ত্রের ভ্রম-প্রমাদাদি প্রদর্শন করিতে সমর্থ হইবে; কিন্তু যদি তাহাদিগকে হিন্দু-দর্শন- শাস্ত্রের চান ইউরোপীয়দিগের নিকট শিক্ষা করিতে হয়, তবে উপরোক্ত সুবিধা তাহাদিগের কখনই ঘটিয়া উঠিবে না। ভারতবর্ষে প্রচলিত যাবতীয় দর্শনশাস্ত্র শিক্ষার ফলে ছাত্রের। সহজেই অনুভব করিতে পারিবে যে, ভিন্ন ভিন্ন দর্শনশাস্ত্র সম্প্রদায়ের প্রবর্তকগণ পরস্পরের ভ্রমপ্রমাণাদি প্রদর্শন করিবার ক্রট করেন নাই। ছাত্রের পক্ষে এ সম্বন্ধে স্বাধীনভাবে বিচার করিয়া তথ্য নির্ণয় করিবার যথেষ্ট সুবিধা রহিয়াছে। তাহার ইউরোপীয় দর্শনশাস্ত্রজ্ঞান, বিভিন্ন দর্শন-সম্প্রদায়ের দোষগুণ বিচারের পক্ষে প্রকৃষ্ট পথপ্রদর্শক হইবে।

ইংরেজী বিভাগ।*

 যে পদ্ধতি অনুসারে এই বিভাগটা অধুনা গঠিত, তাহা অতীব অসন্তোষকর। এ বিভাগে কি শিক্ষা করিতে হইবে, তাহা ছাত্রের ইচ্ছাধীন। যখন ইচ্ছা সে তাহার পাঠ আরম্ভ ইচ্ছানুসারে তাহা পরিত্যাগ করে। ছাত্র বিদ্যালয়ে ভর্তি হইবার,পরেই ক্যাকরণ শ্রেণীতে পাঠের সঙ্গে সঙ্গেই ইংরেজী শিক্ষা করিতে আরম্ভ করে। কিন্তু একেবারে দুইটী নুতন ভাষা শিক্ষা করিতে তাহাদিগকে বিশেষ ক্লেশ স্বীকার করিতে হয়, সুতরাং অল্প দিনের মধ্যেই অধিকাংশ ছাত্রই, হয় ইংরেজী কিংবা সংস্কৃত ভাষা শিক্ষায় অবহেলা প্রদর্শন, করে; প্রায়ই পরীক্ষার পূর্ব্বে অধিকাংশ ছাত্র ইংরেজী বিভাগ হইতে পলাইয়া আইসে। সেই ছাত্রেরাই আবার পর বৎসরের প্রারম্ভে ভর্তি হইতে আইসে। অন্য একটা কারণে বিশেষ গোলযোগ উপস্থিত হয়।

 একটা ইংরেজী বিভাগের শ্রেণীতে অনেক সংস্কৃত বিভাগের শ্রেণীর ছাত্রেরা অধ্যয়ন করে। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রগণের বিষয় দেখা যাউক। তৃতীয় শ্রেণীতে এয়োদশটা ছাত্র পাঠ করে। তন্মধ্যে চারিটী স্মৃতি শ্রেণীর ছাত্র, একটী ন্যায়শ্রেণীর একটী অলঙ্কার- শ্রেণীর, তৃতীয় ব্যাকরণ-শ্রেণীর তিনটা ও অবশিষ্ট চারটী চতুর্থ

 * ইংরেজী বিভাগ প্রথমতঃ ১৮২৭ খৃষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। ১৮৩৫ খৃঃ নবেম্বর মাসে সাধারণ শিক্ষার জেনারেল-কমিটীর আদেশানুসারে ইহা ঠিক যায়। পুনরায় ১৮৪২ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে উক্ত কমিটীর আদেশানুসারে ইহা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাকরণ শ্রেণীর ছাত্র। চতুর্থ শ্রেণীতে ৩৩টা বালক অধ্যয়ন করে। তন্মধ্যে ২টী অলঙ্কার শ্রেণীর, ৫টী সাহিত্য শ্রেণীর, ২টী প্রথম ব্যাকরণ শ্রেণীর, ৬টী দ্বিতীয়, ১০টী তৃতীয়, ৬টী চতুর্থ এবং ২টী পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র।

 বিভিন্ন সংস্কৃত শ্রেণী হইতে ছাত্রের ইংরেজী বিভাগে পাঠ করিতে আইসে। ইহাতে এই কু-ফল উৎপন্ন হয় যে, ছাত্রগণ উক্ত সংস্কৃতশ্রেণীতে নিয়মমত উপস্থিত হইতে পারে না, বিশেষতঃ ইংরেজী শিক্ষা ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করিতেছে; সুতরাং সংস্কৃত শ্রেণীর অতি অল্পসংখ্যক ছাত্রই ইংরেজী বিভাগে অধ্যয়ন করে।

 এই ছাত্রগণ, বিশেষত নিম্নশ্রেণীর ছাত্ররা উভয়বিধ শিক্ষায় এক সময়ে মনোযোগ দিতে অক্ষম; সুতরাং শিক্ষাবিষয়ে তাহা-দিগের তাদৃশ উন্নতি দৃষ্ট হয় না।

 যদি ইংরেজী বিভাগ বর্তমান নিয়মে পরিচালিত হয়, তবে ইহার ফল যে নিতান্তই অসন্তোষজনক হইবে,তদ্বিষয়ে আর সংশয় নাই। ইংরেজী বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়া অবধি ঈদৃশ নিয়মে পরিচালিত হওয়াতেই উহা নিতান্ত মন্দ ফল উৎপন্ন করে ও অব- শেষে সাধারণ শিক্ষার জেনারেল কমিটির আদেশে একেবারে উঠিয়া যায়। যদি অপেক্ষাকৃত সুবন্দোবস্ত না করা হয়, তবে পূর্ব্বের ন্যায় ইহা হইতে মন্দ ফল ফলিবে। তন্য আমি যে কয়েকটা বন্দোবস্তের অবতারণা করিতেছি, তাহা কার্য্যে পরিণত ইলে নিশ্চয়ই সু-ফল উৎপন্ন হইবে। আমার মন্তব্যগুলি এই,—

 ছাত্রের। সংস্কৃত ভাষায় কিছু পারদর্শিতা না দেখাইতে পারিলে তাহাদিগকে ইংরেজী ভাসা-শিক্ষা আরম্ভ করিতে দেওয়া উচিত নয়। সংস্কৃত শ্রেণীর ছাত্রেরা সেই সঙ্গে তাহাদিগের নিজের শ্রেণীতে ইংরেজী ভাষা ও শিক্ষা করিবে। ইংরেজী শিক্ষা ইচ্ছা- ধীন না হইয়া অন্যান্য পাঠের ন্যায় অবশ্যপাঠ্য হইবে। কোন ছাত্র যদি ইংরেজী শিক্ষা করিতে নিতান্তই অনিচ্ছা প্রদর্শন করে, তবে তাহার পক্ষে এই নিয়ম বলবান হইবে যে, পরে কোন সময়েই সে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষাকালীন ইংরেজী শিক্ষা আরম্ভ করিতে পারিবে না। তাহার জন্য অন্য একটি ইংরেজী শিক্ষার শ্রেণী সৃষ্টি করা একেবারে অসম্ভব। সংস্কৃত শিক্ষার প্রস্তাবিত প্রণালী অনুসারে সাহিত্যশ্রেণীর ছাত্রগণ সংস্কৃত ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তিলাভ করিতে সমর্থ হইবে। আমি তজ্জন্য প্রস্তাব করি- তেছি যে, অলঙ্কার-শ্রেণীতেই ইংরেজী শিক্ষার আরম্ভ হউক। তাহা হইলে, ছাত্রগণ ইংরেজী বিদ্যা শিক্ষা করিতে অন্যূন দ্বিগুণ সময় প্রদান করিতে সমর্থ হইবে এবং তাহাদিগের চিত্ত এক্ষণে সুমার্জিত হওয়াতে তাহাদিগকে সামান্য বিষয় হইতে আরম্ভ করিতে হইবে না। অলঙ্কার-শ্রেণী হইতে কলেজের শ্রেষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ করিতেখাইলে ৭৮ বৎসর লাগে। সুতরাং উক্ত সময়ের মধ্যে একজন বুদ্ধিমান্ ও শ্রমশীল ছাত্র অনায়াসেই ইংরেজী ভাষায় ও সাহিত্যে যথেষ্ট পারদর্শিতা লাভ করিতে পারিবে।

 আমি আর একটা বিশেষ ঘটনা কৌন্সিলের সমক্ষে আনয়ন করিতে ইচ্ছা করি। ব্যাকরণের পঞ্চম অধ্যাপক পণ্ডিত শ্রীযুক্ত কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন তাঁহার শ্রেণীতে অধ্যাপনা করিতে বিশেষ সমর্থ বলিয়া বোধ হয় না। তিনি অতিশয় বৃদ্ধ হইয়াছেন। সুতরাং নিজের কর্তব্য কর্ম্মগুলি সুচারুরূপে সম্পাদন করিতে অপারগ। অল্পবয়স্ক বালকগণের শ্রেণীতে সুন্দররূপে কাব্য পড়াইতে হইলে যে কার্য্যতৎপরতা ও দৃঢ়তার প্রয়োজন, তারা তাঁহার নাই। প্রাচীন বলিয়া তিনি কাহারও উপদেশের বশবর্ত্তী হইয়া চলিতে অনিচ্ছুক, সুতরাং তাঁহার শ্রেণীতেই বিশেষ গোলযোগের প্রভাব। তন্নিমিত্ত আমি প্রস্তাব করিতেছি যে, তাঁহার বর্ত্তমান বেতন মাসিক ৪০ টাকা দিয়া তাহাকে লাইব্রেরি ভার দেওয়া হয় ও লাইব্রেরি বর্ত্তমান অধ্যক্ষ, এই বিদ্যালয়ের একজন প্রসিদ্ধ ছাত্র যুক্ত পণ্ডিত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে ৩০, টাকা বেতনে ব্যাকরণের পঞ্চম শ্রেণীর অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করা হয়। পরি-শেষে সুবিধা ঘটিলে তাহার বেতন ৩০ টাকা হইতে ৪০ টাকায় বৃদ্ধি করিয়া দেওয়া হয়।

শ্রেণী হইতে অন্য শ্রেণীতে উন্নয়ন।

 বালকগণের এক শ্রেণী হইতে অন্য শ্রেণীতে উন্নয়ন সম্বন্ধে কলেজের বর্তমান পদ্ধতি এই যে, তাহারা নির্দিষ্ট সময় পর্যান্ত এক শ্রেণীতে পাঠ করে। পরে সময় অতীত হইলেই, তাহা- দিগের বিদ্যার পারদর্শিতা লাভ হইল কি না, সে বিষয় দৃষ্টি না করিয়া তাহাদিগকে অন্য শ্রেণীতে উন্নীত করা হয়। এই পদ্ধতি হইতে এই কু-ফল উৎপন্ন হয় যে, কোন শ্রেণীতে কেই পাঠ শেষ করিলেও তাহাকে নির্দিষ্ট সময় অতীত না হইলে উপকার শ্রেণীতে উঠিতে দেওয়া হয় না। কিন্তু যদি অপর কোন ছাত্র, সকল বিষয়ে অনুপযুক্ত হইয়াও কোন শ্রেণীতে নির্দ্দিষ্ট সময় সমাপ্ত করে, তবে তাহাকে উপরকার শ্রেণীতে পাঠ করিতে দেওয়া হয়। আমি তজ্জন্য প্রস্তাব করি যে, গুণানুসারে উঠাইয়া দিবার ব্যবস্থা করা হউক। আর এই নিয়ম প্রচলিত হউক যে, বৃত্তিসংক্রান্ত নিয়মানুযায়ী সময়ের অতিরিক্ত কাল কেহই কলেজে পাঠ করিতে পারিবে না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, এরূপ বন্দোবস্ত প্রচলিত হইলে, মধ্যবিৎ ছাত্রাপেক্ষা অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান্ ছাত্রেরা নির্দিষ্ট সময়ের কমেও নিজ নিজ পাঠ শেষ করিতে সমর্থ হইবে।

 বর্ত্তমান সময়ে বিদ্যালয়ে সুবন্দোবস্তের অভাব সকলেরই বিশেষ পরিচিত। বালকগণের উপস্থিতি, সামান্য কারণে শ্রেণী পরিত্যাগ করিয়া বাহিরে যাওয়া ও অনাবশ্যক গোলমাল ও কথা- বার্ত্তা এবং সর্ব্বপ্রকার গোলযোগ সম্বন্ধে আমাদিগের বিশেষ দৃষ্টি রাখা কর্ত্তব্য। অন্যান্ত ইংরেজী বিদ্যালয়ে যেরূপ নিয়মাদি ও সুশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, এই বিদ্যালয়ে কেন যে তাহা প্রবর্ত্তিত হইবে না, তাহার কারণ বুঝিতে পারি না, সেইরূপ প্রণালী এ বিদ্যালয়েও প্রতিষ্ঠিত হওয়া নিতান্ত উচিত।

 অবশেষে নিবেদন এই যে, কলেজের সুবন্দোবস্তের নিমিত্ত আমি যে প্রস্তাবের অবতারণা করিয়াছি, তাহা বহু দিবসের প্রগাঢ় চিন্তা ও বিবেচনার ফল। আমার বিবেচনায় যে প্রণালীর অনুষ্ঠান বিদ্যালয়ের উন্নতিকল্পে নিতান্তই প্রয়োজনীয়,আমি কেবল তাহারই উল্লেখ করিয়াছি ও আশা করি যে, যদি কৌন্সিল আমার প্রস্তাবিত পরামর্শগুলি কার্য্যে পরিণত করেন, তবে অল্পদিনের মধ্যেই অতি সু-ফল উৎপন্ন হইবে ও বিদ্যালয়টা পবিত্র ও প্রকৃত সংস্কৃত বিদ্যার আগার স্বরূপ হইবে। বিশেষতঃ ইহা হইতে জাতীয় সাহিত্যের উৎপত্তি ও সুশিক্ষকের সংঘটন হইতে থাকিবে ও এই বিদ্যালয় হইতে সুশিক্ষা প্রাপ্ত হইয়া সুদক্ষ শিক্ষকগণ সাধারণের মধ্যে জাতীয় বিদ্যা প্রচার করিয়া দেশের সর্ব্বতোভাবে মঙ্গলসাধন করিতে থাকিবেন।

সংস্কৃত কলেজ
১৬ই ডিসেম্বর
১৮৫৮ সাল

(স্বাক্ষর) ঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা

 রিপোর্টে কেবল সহজ শিক্ষা প্রণালী উদ্ভাবিত নহে; সংস্কৃত কলেজের সমগ্র সংস্কৃত পাঠ্য সংক্ষেপে সমালোচিত হইয়াছে। একাধারে এক সংস্কৃত পাঠ্যের এরূপ সমালোচনা আর কোথাও পাওয়া যাই না। ধর্ম্মশাস্ত্র পাঠ বিরতির প্রস্তাবে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ধর্ম্মপ্রবৃত্তিরও একটা গতিনির্ণয় হয়। রিপোর্টের ইংরেজী সহজ, সরল ও সংযত। প্রয়োজনীয় কথাগুলি বিনা- বাক্যাড়ম্বরে সাজাইয়া গুছাইয়া বলা হইয়াছে।

 রিপোটপঠে শিক্ষা বিভাগের কর্ত্তৃপক্ষের পরম প্রীতি লাভ করিয়াছিলেন। সংস্কৃত কলেজের লোপাশঙ্কা তাঁহাদের অনেকটা কমিয়া আসিয়াছিল। বস্তুতঃ রিপোর্ট লেখার, গুণে বিদ্যাসাগর মহাশয় শিক্ষাবিভাগে যথেষ্ট যশোলাভ করিয়াছিলেন। তাহার পর এক ভূদেব বাবু ভিন্ন রিপোর্ট লিখিয়া শিক্ষাবিভাগে এতাদৃশ যশস্বী কেহই হন নাই। বিশ্যাসাগর মহাশয় ও ভূদেব বাবুর চরিত্রে ও কর্ম্মে বৈচিত্র্য যতই থাকুক, নানা গুণে তাঁহারা উভয়েই বাঙ্গালায় বরণীয়; পরন্তু শিক্ষাবিভাগেরও চিরস্মরণীয়। আর কোন কারণ না থাকিলেও, তাঁহারা এক শিক্ষা তত্ত্ব সম্বন্ধে ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করিতেন। রিপোর্ট লেখার গুণে উভয়েই পদ, সম্পদ, সম্মান, সম্বম,—এই সকল বিষয়েরই পথ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এক রিপোর্ট-ফলে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের চরম পদোন্নতি। সাংসারিক সুখ-শ্রবৃদ্ধির মূলাধার ইহাই। তিনি রিপোর্টে শিক্ষাপ্রণালীর পথাবলম্বন স্বরূপ যে বাঙ্গালা পাঠের উল্লেখ করিয়াছিলেন, তাহাবই অধিকাংশ স্বয়ং প্রণয়ন করবেন বলিয়া তাঁহার সংকল্প ছিল। কেবল শিক্ষা বিভাগের কর্ত্তৃপক্ষগণে অনুমোদন মাত্র অপেক্ষা ছিল। উল্লিখিত পুস্তকগুলি একে একে পরে প্রকাশিত হইছি। ইহার পূর্ব্বে তিনি কেবল পাঠ্যসঙ্কল্পে জীবন-চরিত নামক পুস্তক প্রকাশ করিয়াছিলেন।

 ১৮৪৯ খীষ্টাব্দে ১০ সেপ্টেম্বর বা ১২৫৬ সালের ২৬শে ভাদ্র সোমবার জীবন চরিত প্রকাশিত হইয়াছিল। রবার্ট ও উইলিয়ম চেম্বর্স সাহেব কর্ত্তৃক সঙ্কলিত জীবন-চরিতের কতিপয় চরিত্র লইয়া “জীবন চবিত” লিখিত। এই জীবন-চরিতে কোপর্ণিকস গালিলেও, নিউটন, হর্শল, গ্রোসিয়স, লিনীয়স, ডুবাল, জেঙ্কিস, জোন্স, এই কয়টি চরিত অনুবাদিত হইয়াছে।

 অনুবাদে কৃতিত্ব পূর্ব্ববত। তবে অনুবাদে কোন কোন শব্দের বাঙ্গালা ভাষায় অসঙ্গতি আছে, বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বয়ং এ কথা স্বীকার করিয়াছেন; নহিলে ভাষা তেজস্বিনী ও হৃদয়গ্রাহিণী হইত না।

 জীবন চরিতে যে সকল বিজাতীয় ও বিদেশীয় চরিত্রের অব- তারণা হইয়াছে, তাহাতে শিক্ষণীয় গুণ থাকিতে পারে। ফলে কিন্তু অলক্ষ্যে ইহাতে কেমন একটা কু-শিক্ষা অসিয়া পড়ে। জীবনচরিতের বিষয়ীভুত চরিত্রপ'ঠে ধারণা জন্মে, তাঁহারা মনুষ্যের আদর্শ; সুতরাং তাঁহাদের অন্যান্য আচার, ব্যবহার, শিক্ষা, দীক্ষা প্রভৃতিও অনুকরণীয়। কাজেই সেই সকলের অনুকরণেই প্রবৃত্তি সহজে ধাবিত হয়। মনে হয়, এই সকলের অনুকরণেই সেইরূপ আদর্শে উপস্থিত হওয়া যায়। সত্য সত্য সে সব কিছু আর হিন্দু- সন্তানের শিক্ষণীয় বা অনুকরণীয় নহে। হিন্দুর তাহাতেই অধঃ- পতন। হিন্দুর অধুনাতন অধঃপতনও ত এইরূপ কারণে। অকাজের অনুকরণ করিতে অশীতিবর্ষীয় বৃদ্ধেরও সহজেই প্রবৃত্তি হয়; সুকুমারমতি বালকদিগের ত কথাই নাই। স্বধর্ম্মপরায়ণ হিন্দুর অথবা পুরাণান্তৰ্গত পুণ্যশ্লোক পবিত্র চরিত্রাবলীর যে কোন গুণ যে কোন আকারে প্রকটিত হউক না কেন, তাহা হিন্দু- সন্তানের শিক্ষণীয়। সেই প্রকটিত গুণানুসরণ, হিন্দুসন্তান চরিত্রসৃষ্টির যেখানে গিয়া উপস্থিত হউক না,দেখিবে, হিন্দুর চরিত্র গঠনোপদোগী উপকরণ তথায় জাজ্বল্যমান। সংস্কৃতভাষা পারদর্শী ও বহুশাস্ত্রজ্ঞ বিদ্যাসাগর মহাশয় যে এইরূপ চরিত্র সংগ্রহে সমর্থ ছিলেন, তাহাতে আর সন্দেহ কি? তাহা হয় নাই; শুদ্ধ দেশের দুরদৃষ্টদোষে। শিক্ষার স্রোত তখন বিপথে ধাবিত হইয়াছিল।

 শোভাবাজার-রাজ ৺রাধাকান্ত দেবের দৌহিত্র সুপ্রসিদ্ধ বিদ্বান্ ও বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ইংরেজির শিক্ষাগুরু শ্রীযুক্ত আনন্দ- কৃষ্ণ বসুজ মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়কে স্বদেশীয় লোকের জীবনী লিখিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাহাতে সম্মতও হইয়াছিলেন। একবার তিনি এ দেশীয় ব্যক্তি গণের জীবনী লিখিবার জন্য সবিশেষ উদ্যোগ করিয়াছিলেন। এতৎ সম্বন্ধে অনেক পুস্তকও তিনি সংগ্রহ করিয়াছিলেন। দুর্ভাগ্য- বশতঃ কার্ম্যে তাহা ঘটে নাই। ডাক্তার ৺ অমুল্যচরণ বসু এম, বি, মহাশয়ের মুখে আমরা এই কথা শুনিয়াছি। জীবনচরিত লিখিবার জন্য অমূল্য বাবুই পুস্তক সংগ্রহ করিয়া দিয়াছিলেন।

  1. * “জজপণ্ডিতি” পদ প্রাপ্ত হইবার কয়েক মাস পর তর্কালঙ্কার মহাশয় ডিপুট ম্যজিষ্ট্রেট হন।
  2. পূর্ব্বে এই অলঙ্কার শ্রেণীতে এক বৎসর পড়িতে হইত। ১৮৪৬ খৃঃ অব্দে ২৮শে নভেম্বর দুই বৎসর পড়িবার নিয়ম হয়।