বীরবাণী (১৯০৫)/সখার প্রতি

উইকিসংকলন থেকে



সখার প্রতি।

আঁধারে আলোক অনুভব, দুঃখে সুখ, রোগে স্বাস্থ্যভান;
প্রাণ-সাক্ষী শিশুর ক্রন্দন,[১] হেথা সুখ ইচ্ছ’ মতিমান?
দ্বন্দ্বযুদ্ধ চলে অনিবার, পিতা পুত্রে নাহি দেয় স্থান;
‘স্বার্থ’, ‘স্বার্থ’ সদা এই রব, হেথা কোথা শাস্তির আকার?
সাক্ষাৎ—নরক-স্বর্গময়,[২]—কেবা পারে ছাড়িতে সংসার?
কর্ম্ম-পাশ গলে বাঁধা যার—ক্রীতদাস বল কোথা যায়?
যোগ-ভোগ, গৃহস্থ সন্ন্যাস, জপতপ ধন উপার্জ্জন,
ব্রত ত্যাগ তপস্যা কঠোর, সব মর্ম্ম দেখেছি এবার;
জেনেছি সুখের নাহি লেশ, শরীর ধারণ বিড়ম্বন;
যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিহ নিশ্চয়।
হৃদিবান নিঃস্বার্থ প্রেমিক! এ জগতে নাহি তব স্থান;
লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্ম্মর মূরতি তাকি সয়?
হও জড়প্রায় অতিনীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল—
সত্যহীন স্বার্থপরায়ণ, তবে পাবে এ সংসারে স্থান।
বিদ্যাহেতু করি প্রাণপণ, অর্দ্ধেক করেছি আয়ুক্ষয়—
প্রেমহেতু উন্মাদের মত, প্রাণহীন ধরেছি ছায়ায়;
ধর্ম্মতরে করি কতমত, গঙ্গাতীর শ্মশান আলয়;
নদীতীর পর্ব্বতগহ্বর, ভিক্ষাশনে কতকাল যায়।

অসহায় ছিন্নবাস ধরে, দ্বারে দ্বারে উদর পুরণ—
ভগ্নদেহ তপস্যার ভারে, কি ধন করিনু উপার্জ্জন?
শোন বলি মরমের কথা, জেনেছি জীবনে সত্য সার—
তরঙ্গ আকুল ভবঘোর, একতরি করে পারাপার—
—মন্ত্র, তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মন, মতামত, দর্শন বিজ্ঞান,
ত্যাগ-ভোগ বুদ্ধির বিভ্রম 'প্রেম' 'প্রেম,'—এই মাত্র ধন।
জীব, ব্রহ্ম, মানব, ঈশ্বর, ভূত প্রেত আদি দেবগণ,
পশু-পক্ষী, কীট, অণুকীট, এই প্রেম হৃদয়ে সবার।
‘দেব,’ ‘দেব’ বল আর কেবা? কেবা বল সবারে চালায়?
পুল্র-তরে মায়ে দেয় প্রাণ, দস্যু হয়ে! প্রেমের প্রেরণ!!
হয়ে বাক্য মন অগোচর, সুখ দুঃখে তিনি অধিষ্ঠান,
মহাশক্তি কালী মৃত্যুরূপা, মাতৃভাবে তাঁরি আগমন।
রোগ, শোক, দারিদ্র-যাতনা, ধর্ম্মাধর্ম্ম, শুভাশুভ ফল,
সব ভাবে তাঁরি উপাসনা, জীবে বল কেবা কিবা করে?
ভ্রাস্ত সেই যেবা সুখ চায়, দুঃখ চায় উন্মাদ সে জন—
মৃত্যু মাঙ্গে সেও যে পাগল, অমৃতত্ব বৃথা আকিঞ্চন।
যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্ত্তন।
পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার—
বারম্বার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম—অগ্নি শিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জ্জন।
ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?

দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনস্তের তুমি অধিকারী, প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
“দাও, দাও”, যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান
ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু, সর্ব্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর অর্পণ, কর সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।


  1. যেখানে ক্রন্দনটাই শিশুর জীবনের অস্তিত্বের প্রমাণ স্বরূপ, সেখানে বুদ্ধিমান্‌ কখনও সুখ প্রত্যাশ করেন না। এই সংসার মায়ার রাজ্য কি না, তাই সমস্ত বিপরীত দেখি—যথা দুঃখে সুখ অনুভব ইত্যাদি। এখানে মন্দ বস্তুকে ভাল বলিয়া বোধ হয়।
  2. নরক, কদর্য্য স্থান, দুঃখের আলয় হইলেও, তাহা স্বর্গ, সুন্দর স্থান, আনন্দভূমি বলিয়া বোধ হয়। সেই একই ভাব,—‘দুঃখে সুখ’ ইত্যাদি।