বুদ্ধদেব/প্রার্থনা

উইকিসংকলন থেকে

প্রার্থনা

কামনায় কামনায় দেশে দেশে যুগে যুগান্তরে
নিরন্তর নিদারুণ দ্বন্দ্ব যবে দেখি ঘরে ঘরে
প্রহরে প্রহরে; দেখি অন্ধ মোহ দুরন্ত প্রয়াসে
বুভুক্ষার বহ্নি দিয়ে ভস্মীভূত করে অনায়াসে
নিঃসহায় দুর্ভাগার সকরুণ সকল প্রত্যাশা,
জীবনের সকল সম্বল; দুঃখীর আশ্রয়বাসা
নিশ্চিন্তে ভাঙিয়া আনে দুর্দ্দাম দুরাশা হোমানলে
আহুতি ইন্ধন জোগাইতে; নিঃসঙ্কোচে গর্ব্বে বলে,
আত্মতৃপ্তি ধর্ম্ম হতে বড়ো; দেখি আত্মম্ভরী প্রাণ
তুচ্ছ করিবারে পারে মানুষের গভীর সম্মান
গৌরবের মৃগতৃষ্ণিকায়; সিদ্ধির স্পর্ধার তরে
দীনের সর্ব্বস্ব সার্থকতা দলি দেয় ধূলি পরে
জয়যাত্রাপথে; দেখি ধিক্কারে ভরিয়া উঠে মন,
আত্মজাতি-মাংসলুব্ধ মানুষের প্রাণনিকেতন
উন্মীলিছে নখে দন্তে হিংস্র বিভীষিকা,— চিত্ত মম
নিষ্কৃতি সন্ধানে ফিরে পিঞ্জরিত বিহঙ্গমসম,

মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে বাজে শৃঙ্খল-বন্ধন অপমান
সংসারের। হেনকালে জ্বলি উঠে বজ্রাগ্নি সমান
চিত্তে তাঁর দিব্যমূর্ত্তি, সেই বীর রাজার কুমার
বাসনারে বলি দিয়া বিসর্জ্জয়া সর্ব্ব আপনার
বর্ত্তমান কাল হতে নিষ্ক্রমিলা নিত্যকালমাঝে
অনন্ত তপস্যা বহি মানুষের উদ্ধারের কাজে
অহমিকা বন্দীশালা হতে।— ভগবান বুদ্ধ তুমি,
নির্দ্দয় এ লোকালয়, এ ক্ষেত্রই তব জন্মভূমি।
ভরসা হারালো যারা, যাহাদের ভেঙেছে বিশ্বাস,
তোমারি করুণা-বিত্তে ভরুক তাদের সর্ব্বনাশ,—
আপনারে ভুলে তারা ভুলুক দুর্গতি।— আর যারা
ক্ষীণের নির্ভর ধ্বংস করে, রচে দুর্ভাগ্যের কারা
দুর্ব্বলের মুক্তি রুধি, বোসো তাহাদেরি দুর্গদ্বারে
তপের আসন পাতি’, প্রমাদবিহ্বল অহঙ্কারে
পড়ুক সত্যের দৃষ্টি; তাদের নিঃসীম অসম্মান
তব পুণ্য আলোকেতে লভুক নিঃশেষ অবসান।

২৯ জুলাই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯৩৩