বেল্লিক রামায়ণ/উপায় চিন্তা

উইকিসংকলন থেকে

উপায় চিন্তা।

বিষম বিভ্রাট ক্রমে পড়িল যে, হায়।
ভাবনা সদাই, হায়, কি হয় উপায়॥
দুঃখিনী অভার পত্নী, কাঁদিয়ে আকুল।
ভাবনা-সাগরে নাহি পায় ত সে কূল॥
বলে, “হায় বিধি এ কি লিখিলে কপালে।
এ কোন্ মূর্খের হাতে আমারে ঠেকালে॥
কিছু বুদ্ধি নাহি ঘটে, কি কোরে কি হয়।
কোন্ দুঃখে কর্ম্মত্যাগ করে দুরাশয়॥
মাস গেলে বিশখানি চাক্‌তি রূপার।
অনা’সে আসিতেছিল, কি ছিল চিন্তার॥
কেন হেন আহাম্মকি ত্যজিল চাকরী।
এখন কি দেবে পেটে, কি আছে তাহারি॥
এতগুলি বাছ্ কাছ্ কি খাইয়ে বাঁচে।
এক কড়াকড়ি আর নাহিক যে কাছে।

বুড়ো হাতী, একটুকু লজ্জাও ত নাই।
কেবলি ছেলের বাপ্ তাতে কি কামাই?
ধরিয়ে দশের হাতে পায়ে কত কোরে।
দিয়েছিনু চাকুরী সে জুটায়ে তােমারে॥
কেবল আমারি দুঃখে দুঃখী না কি তারা
তাই সে তাদের তব তরে এত করা॥
তা না হলে কিসের বা গরজ তাদের।
তােমার তরেতে চেষ্টা করে এত ঢের॥
অতি হতভাগা না কি তুমি অভাজন।
তাই সে অবুঝপণা করহ এমন॥
ভাল, যা হইবার, হইয়ে গিয়েছে।
কিবা লাভ আর বা আমার বােকে মিছে॥
নাহি আর রহিব ত আমি তব কাছে।
করিব এবার ঠিক্ যাহা মনে আছে॥
যে দিকে দুচক্ষু যাবে যাব আমি চোলে।
মানুষ করহ তুমি তব ছেলেপুলে॥
দিয়েছে তােমার হাতে মা বাপ যখন।
অবশ্য সহিতে মােরে হবে ত এমন॥
পাপ সংসর্গের ফলে পাপ মহাত্মায়।
আমি যে দুঃখিনী তাহা তব ভাগ্যে হায়॥”
অভা বলে সবিনয়ে, “ক্ষম প্রাণপ্রিয়ে।
যা হবার হয়েছে তা, অদৃষ্টে পড়িয়ে॥

কি হবে বকিলে আর মিছে এতখানি।
কপাল ছাড়া ত পথ নাহি সুবদনি॥
কপালেতে লেখা না কি আছে এই দুঃখ।
তেঁই সে কিছুতে নাহি পাই মনে সুখ॥
তুমি চেষ্টা করিলে কি হইবে সুফল।
তুমি আমি নিমিত্তের ভাগী ত কেবল॥
এখন কিসে কি হয় এস তাই ভাবি।
খেটে যাতে ঘুচে দুঃখ, উঠে সুখরবি॥
যদিও ভাগ্যের ফল তবু চেষ্টা চাই।
চেষ্টায় কিছুও দেখি পাই কি না পাই॥”
তখন রমণী বলে, “কি চেষ্টা দেখিবে।
কোন্ পথ রাখিয়াছ, কোন্ দিকে যাবে॥
সকল পথেই কাঁটা দেছ নিজ হাতে।
সহজে চলিবে, বল, আর কোন্ পথে?
জ্বেলে দি আগুন তব বুদ্ধির কপালে।
না জ্বালাও আর, বুদ্ধি খাটাইব বোলে॥”
অভা বলে, “দিন কত থাক চুপ কোরে
দেখ না কি করি আমি, না ভাব অন্তরে॥
আছয়ে সুযুক্তি এর, এখনি করিব।
চেষ্টা সে যা হােক্, কেন অকারণ ভাব॥
করেছি যে ঋণ তাহা হবে পরিশােধ।
তা ছাড়া হাতেও রবে, মানহ প্রবােধ॥

পুত্র সে বেল্লিকরাম হয়েছে ডাগর।
বিবাহের চেষ্টা এক দেখি অতঃপর॥
যেমন তেমন কোরে দু তিন হাজার।
পাব ত নিশ্চয় কিবা অন্যথা তাহার॥
কুলীন আমরা, তায় পুত্রটি সে ভাল।
এমন সুছেলে কোথা পাবে লােক বল॥
দেখিতেও এমনি বা মন্দটি কি কও।
শীঘ্র দিন কাটিবে লো চিন্তিত না হও॥
আজিকালি মধ্যেতেই করিব যা হােক্।
মাথা খাও, নাহি রাগো, তেয়াগ লো শােক॥
ঘটক লাগাবো আজিকালি মধ্যেতেই।
সুখবর তােমারে লো দিতেছি সে এই॥”
দুঃখিনী রমণী তবে, করিল জিজ্ঞাসা।
“ভাল, তাই দিলে নয়, তায় বা কি আশা?
কত টাকা ছিল-তব, কোথা সে এখন।
তুমি কি হাতেতে টাকা রাখিবে কখন?
হাতেতে ওড়ন্‌চণ্ডী আছয়ে তােমার।
যা পাবে, সে সকলি ত দেবে ছারেখার॥
এমন বাওনডােলে কে দেখেছে কোথা?
আপনি যে খেতে চায় আপনার মাথা॥”
এইরূপে হয় নানা কথোপকথন।
অথবা বিতণ্ডা বল, যা বলিতে মন॥

হলে গত কিছুক্ষণ এ হেন রূপেতে।
আর এক ঘটনা সে, ঘটে এ স্থানেতে॥
সেই সে আতরমণি আসে মহারোষে।
বলে, “কি গো চুপ কোরে আছ যে হে বােসে॥
নিলে যে এতটা টাকা, কি তার কিনারা।
বল ত কেমন ধারা মানুষ তোমরা?
দিয়ে সর্‌ষের তেল নাসিকার দ্বারে।
ভাল ত ঘুমাও দেখি নিশ্চিন্ত অন্তরে॥
টাকায় যে আনা আনা, সুদ বলেছিলে।
এতটা দিনেতে তার কত বা সে দিলে॥
চুলােয় যাক্ সে টাকা সুদের বাবৎ।
আসল দিলেই বাঁচি দিই নাকে খৎ॥
কত সে কষ্টের টাকা আমাদের হায়।
এ টাকা যাইলে তা কি প্রাণে সহা যায়॥
নাহিক বয়স আর, করিব রােজগার।
বুড়া বয়েসেতে এ কি জ্বালা গাে আমার॥
মাথা খুঁড়ে মরিব সে, পায়ে তব আজি।
আমার সহিত কর এত কার্‌সাজি॥
ডাকাতের ডাকাত যে তুমি হে নিশ্চয়।
এমনি কোরে কি লােক লােকেরে মারয়॥
অতি ভাল লােক তােমা জ্ঞেয়ান করিনু।
তেঁই ত এতটা টাকা ধরে তােমা দিনু॥

ভাল ফল হাতে হাতে দিলে তুমি বেশ।
অন্তরে তােমার নাহি দয়ার কি লেশ॥
এইরূপে টাকা-কড়ি যদি খােয়া যাবে।
এ বুড়া বয়েসে আর কিবা গতি হবে॥
আঁটিয়ে কাঁচুলি বুকে, বিননিয়া কেশ।
নিত্য রকমারি তথা পরিয়া সুবেশ॥
ঝম্ ঝমে ঝাঁঝমল পায়ে ঝমঝম্।
রঙাইয়ে গাল দুটি দিয়ে লাল রঙ॥
আর কি যৌবন ফিরে পা(ও)য়া যাবে, হায়।
যৌবন বিহনে ধন কে দিবে আমায়॥
যা কিছু সম্ভোগ সব যৌবন কারণ।
রমণীর যা কিছু সে কেবলি যৌবন॥
যৌবন সে বাপ খুড়ো, ভাই, মা, ভগিনী।
যৌবন সে স্বামী পুত্র বন্ধু ও সঙ্গিনী॥
যৌবন বিহনে গতি কিছু নাহি আর।
বল বুদ্ধি সকলি সে যৌবন যাহার॥
মহাবেগে কোপমতী নদী সে যেমন।
সেইরূপ সে রমণী যাহার যৌবন॥
যৌবনে আহার দেয় যৌবনে বিহার।
যৌবনেই বহে তত সুখ-সমাচার॥
নাহিক যৌবন যার, কি সুখ জীবনে।
তবে একমাত্র গতি, বাড়ে যদি ধনে॥

ধন যদি রহে তবু কিছু সুখ পায়।
একমাত্র ধনেতেই শেষ রক্ষা, হায়॥
ধন থাকিলেও তবু গণে দশে পাঁচে।
ধনশূন্য যেবা তার, কিবা সুখ বেঁচে॥
ধনেরি কারণে কার্য্য যত করিলাম।
বড় দুঃখ শেষে কিন্তু পেয়ে হারালাম॥
দাও মাের টাকা তুমি ফিরায়ে আমারে।
কাজ নেই সুদেতে আসল দাও ফিরে॥
যা হবার হয়ে গেছে, করেছি গুখুরি।
দাও বাবু টাকা ফিরে ব্যগ্রতা হে করি॥
কোরো না আমারে আর এ বয়েসে খুন।
বুড়ো বয়সেতে আর কেন এ আগুন॥
ভাল-মানুষের বুঝি কাল নাই আর।
তাই বুঝি কর তুমি এই ব্যবহার॥
বাজারের বেশ্যা আমি কিন্তু রেখাে মনে।
সহজে না ছাড়িয়ে ত দিব কদাচনে॥
ভূত ভাগাইয়ে আমি দিব গালি দিয়ে।
রাস্তায় রাস্তায় কীর্ত্তি বেড়াব গাহিয়ে॥
বাছ্ কাছ্ নিয়ে তুমি করিতেছ ঘর।
কেন মাের শাপে বাবু হবে জরজর॥
এই বেলা সহমানে দাও মাের টাকা।
কেন অকারণ বল কর কথা বেঁকা॥

বেঁকালেই বেঁকাইতে হয় ত বচন।
কি দোষ আমার, বলিতেছি ত এখন॥
সময় থাকিতে কর বিহিত যা হয়।
নতুবা উচিত যাহা করিব নিশ্চয়॥”
ভাবে অভারাম বাবু “কি উপায় করি।
কেমনে ইহার হাতে আজি আমি তরি॥
যেই কথা বলিল এ, পারেও না কোন্।
কি আছে তাসাধ্য এর, বেশ্যা এ যখন॥”
বেল্লিকের রামায়ণ অতি সে সুন্দর।
একদণ্ড পাঠেতেই বনে ত বান্দর॥