বেল্লিক রামায়ণ/টেকচাঁদ শেঠ

উইকিসংকলন থেকে

টেকচাঁদ শেঠ।

মধ্যেতে আশ্চর্য্য এক আছয়ে কাহিনী।
কহিতে হইবে মােরে সেটী যে এখনি॥
এই সহরেতে টেকচাঁদ শেঠ নামে।
বসতি করয়ে এক তাঁতি কোন স্থানে॥
ধনীর সন্তান সেই টেকচাঁদ হয়।
পিতৃ-বিয়ােগেতে বহুধন প্রাপ্ত হয়॥
কিন্তু বহু বিপরীত দান ধ্যান কোরে।
একবারে ফোঁপরা সে হয় ত ভিতরে॥
কড়ার সম্বল আর নাহিক রহিল।
কেমনে চলিবে দিন ভাবনা পড়িল॥
বাহিরে প্রকাশ কিন্তু না করে কাহারে।
ঋণ করিয়েও মান রাখে ত বাহিরে॥
কিন্তু ক্রমে ক্রমে হেন হলো আওহাল।
পেটভরে খেতো দুটো সকাল বিকাল॥—
তাও নাহি পায় আর সদা ক্ষুধানলে।
ভিতরে ভিতরে বাবু মরে জ্বলে জ্বলে॥
দূরসম্পর্কীয় কোন ভাই এক ছিল।
দয়া করি সেই কিছু সাহায্য করিল॥
রােক চারি শত টাকা ব্যবসা করিতে।
দিল সেই ভাই ঐ টেকচাঁদ-হাতে॥

মণিহারী দোকান খুলিতে একখানি।
অনুমতি দেয় সেই ভাইটী তখনি॥
ভায়ের কথায় টেক শীঘ্র তাহা করে।
কিঞ্চিৎ লাভও দেখা গেল অতঃপরে॥
বড় ইচ্ছা তার পুনঃ করয় কাপ্তিনী।
সময়ের বন্ধু এক আইল অমনি॥
গলা ধরি তার কান্দে সেই টেকচাঁদ।
“কেমনেতে বল ভাই পূরে মনসাধ॥”
সে তারে কহিল এই—দানিল যুকতি।
“উপায় তােমারে এক বলি হে সম্প্রতি॥
তিন চারি পাঁচ করি প্রত্যহ এমন।
আনিব মানুষ হেথা নিত্য সে নূতন॥
বহুৎ সুহৃদ্ মম আছয়ে সহরে।
আনিব সে পালামত আমি সবাকারে॥
রবিবারে রবিবারে গাহনা-বাজনা।
অন্য অন্য দিনে মাত্র শুধু আনাগোনা॥
বসিয়ে খানিক ক্ষণ যাইবে চলিয়া।
‘খুব খাওয়া হয়েছে, আঃ!’ কথাটি বলিয়া॥
এক পয়সারো খাদ্য না হবে খা(ও)য়াতে।
অথচ প্রত্যহ যেন খায় সকলেতে॥
এমনি রকমখানা বাহিরে প্রকাশ।
রীতিমত ইজ্জত যে রবে সর্ব্বপাশ॥

প্রতিবেশী সবাই ভাবিবে এই কথা।
অবশ্য ভিতরে লক্ষ্মী আছে আজো গাঁথা॥
নতুবা কাপ্তেনি হেন কেমনে করিবে।
নিত্য দশে পাড়ে পাত, কোথা অর্থ পাবে॥
তবে যে পাড়ার লোকে, ডাকে না কারুরে।
তার অর্থ নিশ্চয় অবজ্ঞা এ সবারে॥
না হয় বলিবে হদ্দমুদ্দ অহঙ্করে।
কিবা ক্ষতিবৃদ্ধি তায়, বল না আমারে॥
গরীব পায় না খেতে, এ ত বলিবে না।
তবে আর তার জন্যে আছে কি ভাবনা॥”
বলে টেকচাঁদ তবে, “তাহা ত হইবে।
কিন্তু এরা আসিবে যে, কি স্বার্থে আসিবে॥
বিনা স্বার্থে কে কাহার দ্বারে বল যায়?
বল দেখি তাহার কি আছয় উপায়?
বিনা স্বার্থে আসিবে যে কেহ কার বাড়ী।
কোথায় আছয় হেন সাধু নর নারী?
কেমন আশ্চর্য্য কথা কহ তুমি ভাই।
স্বপ্নেও ত হেন বাণী কভু শুনি নাই॥”
কহে বন্ধুবর তবে “কর অবধান।
শুনিলে সকল ভ্রান্তি হবে সমাধান॥
দুই পয়সা মাত্র সেই প্রতি জনে জনে।
হবে দিতে ছিটে ছাটা সেবন কারণে॥

কালাচাঁদ সেবক যেথায় আছে যত।
ছিটে ছাটা পেলেই সে মহা আনন্দিত॥
তা হলেই করিবেক জয় জয়কার।
তুমি অনায়াসে কার্য্য সাধিবে তােমার॥
বাটীর বাহির তারা হইবে যখনি।
খােশ নামি তােমার সে করিবে তখনি॥
বলিবে দশের কাছে কোরে গলাবাজি।
হয় না কোথাও হেন, খেয়েছি যা আজি॥
দেখিয়ে শুনিয়ে সবে লেগে যাবে তাক্।
একেবারে রবে যেন হইয়ে অবাক॥”
বলিল সে টেকচাঁদ এই ত তখন।
“শুনিনু ত যাহা তুমি করিলে বর্ণন॥
কিন্তু এক কথা হয়, মধ্যেতে ইহার।
প্রত্যহ যে হয় ভােজ এত জনাকার॥
কোথা কিন্তু নিদর্শন তাহার সে মিলে।
ভাঁড় খুরি গেলাসাদি দুয়ারের কোলে?
মাছের আঁইস, পাতা, চাই ত পতিত।
নতুবা কেমনে ইহা হইবে প্রতীত?
একখানি লুচি-ছেঁড়া কিম্বা তরকারী।
নাহি দেখা যায় পােড়ে আছে দ্বারে যারি॥
সে যে প্রতি রাত্রে ভােজ দেয় দশজনে।
কে করে বিশ্বাস বল, এরূপ বর্ণনে?

কোনরূপে কায়ক্লেশে চলে নিজ দিন।
কেমনে ম্যানেজ্ ইহা করি একদিন॥
অধিক দিনের কথা সে ত জুঁদা বাত।
এক দিনেতেই মােরে করিবে যে কাৎ॥
বাহিরে নমুনা যদি প্রত্যক্ষেতে দেখে।
তবে ত বিশ্বাস সবে করিবে আমাকে॥
নতুবা বলিবে, “একদম্ ফকিকারি।
কেবলি ভড়ং চাকচিক্য সে উপরি”॥
বলে সেই বন্ধু তবে “শুন মতিমান্।
আছয় উপায় এক মিলিত প্রমাণ॥
চুপি চুপি ডাকি এক ঝাড়ু-বর্‌দারে।
বন্দোবস্ত সঙ্গে তার রাখ কিছু কোরে॥
প্রতি রাত্রি প্রভাত না হইতে হইতে।
যেথা যত কর্ম্মবাড়ী আছে সহরেতে॥
সকল বাড়ীর দ্বার হইতে তুলিয়া।
আনিবে সে নিদর্শন তােমার লাগিয়া॥
তােমার বাড়ীর দ্বারে করি জমেয়াত।
রাখিবে তাবৎ, নহে যাবৎ প্রভাত॥
প্রভাত হলেই যত লােক সে জাগিবে।
তােমার বাড়ীর দ্বারে ঐ সব দেখিবে॥
দেখিয়াই মনে মনে করিবেক স্থির।
নিশ্চয় হয়েছে ভােজ মধ্যেতে রাত্রির॥

নতুবা এ সব কেন রহিবে পড়িয়া।
ভাঁড় খুরি গেলাসাদি ব্যঞ্জন করিয়া॥
সপ্তাহে পয়সা দুই হইবে ত দিতে।
এর জন্যে চিন্তা আর বল কিবা চিতে॥।
অল্পে খােশ্‌নামি হবে, পাবে বহু মান।
কেহ নাহি জানিবে ত ভিতর সন্ধান॥
খাও বা না খাও কিছু নাহি পাও খেতে।
যা কেন হোক্ না তব অবস্থা ঘরেতে॥
না চাবে জানিতে কেহ সে সব সন্ধান।
বাহ্যিক দেখিয়ে শুধু লইবে প্রমাণ॥
কাপ্তেন সে বড়গােছ্ সবাই ভাবিবে।
দাও বা না দাও কিছু তবু যশ গাবে॥
ভয়েতে সহজে কেহ না ঘেঁষিবে কাছে।
অথচ ভিতরে দেখ সকলি সে মিছে॥”
“ভেল মাের ভাই” বলি তবে টেকচাঁদ।
বেষ্টন করিল বাহু বেড়ি তার কাঁধ॥
বলিল বিপুল খুসি হইয়া তখন।
“বলেছ যা তুমি মিথ্যে নহে কদাচন॥
সপ্তাহেতে আনা চারি একটাকা মাসে।
খরচ করিলে যশ হতে পারে দেশে॥
এতু অল্পে এত মান কেবা আর পাবে।
কাহার ঘটেতে বল এ বুদ্ধি যােগাবে?

তুমি যাই ছিলে ভাই, করিলে উপায়।
বেল্লিকের রামায়ণ কত গুড় হায়!