ব্রজবিলাস/পঞ্চম উল্লাস

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চম উল্লাস।

এতদ্দেশীয় পূজনীয় সাধুসমাজের প্রাতঃস্মরণীয় চাঁই মহোদয়বর্গের নিকট, কৃতাঞ্জলিপুটে, বিনয়নম্র বচনে, আমার নিবেদন এই, আমার এই ভাঁড়ামি, বা পাগলামি, অথবা পাণ্ডিত্যপ্রকাশ দেখিয়া, আপনারা যেন আমায় বিদ্দাসাগরের গোঁড়া, অথবা দলের পোক, না ভাবেন। ইহা যথার্থ বটে, কোনও কোনও কারণে, বিদ্যাসাগরের উপর আমার একটু আন্তরিক টান আছে। যেরূপ দেখিতে ও শুনিতে পাই, লোকটা অমায়িক, নিরহঙ্কার, পরোপকারী; যাঁহারা নিকটে যান, সকলেই সন্তুষ্ট হইয়া আইসেন। কিন্তু, এই খাতিরে, আমি তাঁহার গোঁড়া বলিয়া পরিচিত ও পরিগণিত হইতে সম্মত নহি। তাঁহার কথা উত্থাপিত হইলে, হদ্দমুদ্দ এই পর্যন্ত বলিতে রাজি আছি, লোকটা বড় মন্দ নয়। এ ভিন্ন, আর সকল বিষয়েই, আমি তাঁহার উপর মর্মান্তিক চটা। না চটিয়া, কেমন করিয়া, চলে বলুন। তিনি পবিত্র সাধুসমাজের অনুবর্তী হইয়া চলিতে রাজি নহেন; নিজে যাহা ভাল বুঝিবেন, তাই বলিবেন, তাই করিবেন; সাধুসমাজের দিজ্ঞজ চাঁইদিগের খাতির রাখিবেন না, ও তাঁহাদের নিষ্কলঙ্ক দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইয়া চলিবেন না। এমন লোককে, কেমন করিয়া, মানুষ বলিয়া গণ্য করি, বলুন।

 পূর্বাপর যেরূপ দেখিয়া আসিতেছি, তাহাতে হত ভাগার বেটার বিষয়বুদ্ধি বড় কম; এমনকি, নাই বলিলেও, বোধ হয়, অন্যায় বলা হয় না। বিষয়বুদ্ধি থাকিলে, তিনি, কখনই, বিধবাঢ় বিবাহকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করিতেন না। বিধবা বিবাহে হাত দিয়া, পবিত্র সাধুসমাজে হেয় ও অশ্রদ্ধেয় হইয়াছেন, সকল লোকের গালাগালি খাইতেছেন, এবং শুনিতে পাই, ঐ উপলক্ষে দেনাগ্রস্তও হইয়াছেন। ইহারই নাম,

আপনার নাক কাটিয়া পয়েন্ন যাত্রাভঙ্গ করা।

এই রকমারিকাণ্ডে লিপ্ত হওয়াতে, তাঁহার নিজের নাকালের চুড়ান্ত হইয়াছে; এবং পুণ্যভূমি ভারতবর্ষকে, বিশেষতঃ, পরম পবিত্র গৌড় দেশকে, সর্বোপরি, সোনার লঙ্কা যশোহরপ্রদেশকে, একবারে ছারখার করিতে বসিয়াছেন। এমন বাঁদরামি, এমন পাগলামি, এমন মাতলামি, কেহ কখনও দেখিয়াছেন বা শুনিয়াছেন, আমার এরূপ বোধ হয় না। বুদ্ধিমান ব্যক্তি মাত্রেই বলিবেন, অথবা বলিবেন কেন, মুক্তকণ্ঠে বলিতেছেন, তিনি, নাম কিনিবার জন্যে, দেশের সর্বনাশের পথ করিয়াছেন। দেখুন, বাটীতে বিধবা থাকিলে, গৃহস্থের কত মত উপকার হয়। প্রথমত, বিনি মাইনায়, রাঁধুনি, চাকরানি, মেথরানি পাওয়া যায়। দ্বিতীয়তঃ, সময়ে সময়ে, বাটীর পুরুষদিগের, প্রকারান্তরে, অনেক উপকার দর্শে; তৃতীয়তঃ, বাটীয় চাকরেরা বিলক্ষণ বশীভূত থাকে, ছাড়াইয়া দিলেও, হতভাগার বেটারা নড়িতে চায় মা; চতুর্থতঃ, প্রতিবাসীরা অসময়ে, বাইতে আইসেন। এটি নিতান্ত সামান্য কথা নহে; কারণ, যেরূপ দেখিতে পাওয়া যায়, অসময়ে কে কাহারও দিক মাড়ায় না। যে পাষণ্ড এই সমস্ত সুবিধা ও উপকারের পথ রুদ্ধ করিবার চেষ্টা করে, তার, মুখদর্শন করা উচিত নয়। মুখের বিষয় এই, আমরা স্বাধীন জাতি নহি; স্বাধীন হইলে, এত দিন, কোন কালে, বিদ্যাসাগর বাবাজি স্বশরীরে স্বর্গারোহণ করিতেন। কারণ, স্বাধীন সাধুসমাজের তেজীয়ান্‌ চাঁই মহোদয়েরা, কখনই, এ অত্যাচার, এ অপমান, সহ করিয়া, গায়ের ঝাল গায়ে মারিয়া, চুপ করিয়া থাকিতেন না; বিদ্রোহী বলিয়া, বিচারালয়ে তাঁহার নামে অভিযোগ উপস্থিত করিতেন, এবং আপনারাই, ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের ন্যায়, ধৰ্মাসনে বসিয়া, তাঁহাকে শূলে চড়াইয়া, যথোপযুক্ত আক্কেলসেলামি দিতেন। হায় রে সে কাল!!! হা জগদীশ্বর!.তুমি, কত কালে, সদয় হইয়া, এই হতভাগা দেশকে পুনরায় স্বাধীন করিবে। এরূপ যথেচ্ছার আর আমরা কত কাল সহ করিব!!! .  বিধবাবিবাহ প্রচলিত হইলে, ব্যভিচার দোষের ও ভ্রুনহত্যা পাপের নিবারণ হইবেক, এ কথার অর্থ কি। ব্যভিচার যদি দোষ বলিয়া গণ্য হইত, তাহা হইলে, এই পবিত্র দেশের অতিপবিত্র সাধুসমাজে, কদাচ এরূপ প্রবল ভাবে প্রচলিত থাকিত না। পুরুষের ব্যভিচার, এ দেশে, দোষ বলিয়া কখনও উল্লিখিত হইতে শুনি নাই; কেবল স্ত্রীলোকের বেলায় দোষ বলিয়া গণ্য হইয়া থাকে। কিন্তু, নিবিষ্ট চিত্তে অনুধাবন করিয়া দেখিলে, তাহাতে বাস্তবিক কোনও দোষ আছে, এরূপ প্রতীতি জন্মে না দোষের কথা দূরে থাকুক, ব্যভিচার, পূর্ব্ব কালে, সনাতন ধর্ম বলিয়া পরিগণিত ছিল; কেহ তাহাতে কিছুমাত্র দোষ বিবেচনা করিত না। ইহা সত্য বটে, উদ্দালক মুনির পু্ত্র শ্বেতকেতু খুড়, বুড়মি করিয়া, এই সনাতন ধর্মে দোষারোপ করিয়া গিয়াছেন[১]। কিন্তু, তিনি দুনিয়ার মালিক ছিলেন না। তিনি, রাগের বশীভুত হইয়া, না বুঝিয়া সুঝিয়া, এক কথা বলিয়া গিয়াছেন বলিয়া, সকলকে তাহা ঘাড় পাতিয়া লইতে হইবে, তাহার মানে কি। আর, ইহাও বিবেচনা করিয়া দেখা আবশ্যক, ব্যভিচার সনাতন ধর্ম বলিয়া পরিগণিত। সনাতন শব্দের অর্থ নিত্য, যাহার বিনাশ নাই, যাহা সর্ব কাল বিরাজমান থাকে। শ্বেত কেতুর এত বড় ক্ষমতা ছিল না যে, তিনি নিত্য পদার্থের লোপাপত্তি করিতে পারেন। সে ক্ষমতা থাকিলে, সনাতন ব্যভিচার ধর্ম, কোন কালে, লয়প্রাপ্ত হইতেন, একাল পর্য্যন্ত, নির্ব্বিরোধ ও অপ্রতিহত প্রভাবে, রাজত্ব ও একাধিপত্য করিতে পাইতেন না। যাহা হউক, যখন ব্যভিচার সনাতন ধর্ম্ম বলিয়া পরিগণিত, এবং যখন সেই সর্ব্বজীবহিতকর সনাতন ধর্ম, পৃথিবীর সর্ব্ব প্রদেশে, বিশেষতঃ পুণ্যভূমি ভাতবর্ষের পরম পবিত্র সাধুসমাজে, আবহমান কাল, এত প্রবলভাবে প্রচলিত রহিয়াছে, তখন উহাকে দোষ বলিয়া গণ্য করা ঘোরতর অধর্মের কর্ম্ম, তাহার সন্দেহ নাই। অতএব, বিদ্যাসাগর বাবাজি, সাধুসমাজে চির প্রচলিত সেই প্রশংসনীয় সনাতন ধর্ম্মকে দোষ বলিয়া গণ্য করিয়া তাহার নিবারণার্থে, বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত বলিয়া, যে পাণ্ডিত্যপ্রকাশ করিয়াছেন, তাহা গ্রাহ্য করা কদাচ উচিত নহে। ফলকথা এই, ব্যভিচার বন্ধ করিবার নিমিত্ত, বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত ও আবশ্যক, এ কথার অর্থ নাই।

 ভ্রূণহত্যার বিষয়ে বক্তব্য এই যে, নির্ব্বোধ নির্বিবেক শাস্ত্রকারেরা, কি মতলবে বলিতে পারি না, ভ্রূণহত্যাকে পাপ বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন; সে জন্য ভয় পাইয়া, বিধবা বিবাহ দেওয়া আবশ্যক বলিয়া বোধ হয় না। শাস্ত্রকারেরা, নিতান্ত পাগলের মত, কত বিষয়ে কত কথা বলিয়াছেন; কই, আমরা ত সে সকল কথা গ্রাহ করিতেছি না। তবে এইটির বেলায়, তাঁঁহআদের খাতির রাখিবার জন্য, ব্যস্ত হইবার কারণ কি।

 কিঞ্চ, স্ত্রীলোক, গুরুজনের খাতির এড়াইতে না পারিয়া, কিংবা প্রিয় জনের নাছোড় পীড়াপীড়িতে পড়িয়া, সনাতন ব্যভিচার দেবের উপাসনায় প্রবৃত্ত হইলে, প্রকৃতিদেবীর অলঙ্ঘনীয় নিয়ম অনুসারে, গর্ভসঞ্চার, অধিকাংশ স্থলে, অপরিহার্য্য; এবং, পবিত্র সাধুসমাজের অবলম্বিত ও অনুমোদিত প্রথা অনুসারে, তথাবিধ স্থলে, জ্বণহত্যাও অপরিহার্য্য[২]। অপরিহার্য্য বিষয়ের অনুঠান বা অনুমোন, কোনও অংশে, দোষাবহ বলিয়া বিবেচিত হওয়া উচিত মহে। এজন্যই, গোপকুলোদ্ভব ভগবান্ দেবকীনন্দন স্বীয় প্রিয়বান্ধব তৃতীয় পাণ্ডব অর্জ্জুনকে,

জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তন্মাদপরিহার্য্যেঽর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি[৩]

জন্মিলেই মৃত্যু অবধারিত, মৃত্যু হইলেই পুনর্জ্জন্ম অবধারিত। অতএব, অপরিহার্য্য বিষয়ে, তোমার শোক করা উচিত নহে।

এই সারগর্ভ উপদেশ দিয়াছিলেন। সেইরূপ,

জারাশ্রয়ে ধ্রুবো ভ্রূণো ভ্রূণে হত্যা ধ্রুবী স্মৃতা।
তস্মাদপরিহার্য্যেঽর্ধে ন দোষঃ সাঁধুসংসদি[৪]

উপপতির আশ্রয়গ্রহণে, ভ্রূণসঞ্চার অবধারিত; ভ্রূণসঞ্চার হইলে, ভ্রূণহত্যাও অবধারিত। অতএব, অপরিহার্য্য বিষয়ে, সাধুসমাজে দোষ নাই।

 বস্তুতঃ, সূক্ষ্ম বিবেচনা করিয়া দেখিলে, ভ্রূণহত্যায় কোনও দোষ আছে, এরূপ প্রতীতি হয় না। ভ্রূণহত্যাকে পাপজনক, বা কোনও অংশে নিন্দনীয়, বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারেন, কই, এমন বেটা ছেলে ত, এ পর্যন্ত, আমাদের দিব্য চক্ষে ঠেকে নাই। পেট ফাঁপিলে, ও পেটে মল জমিলে, ডাক্তরেরা, জোলাপ দিয়া, পেট পরিষ্কার করিয়া দেন। ভ্রুনহত্যাও, পৰিত্র সাধুসমাজের প্রাতঃস্মরনীয় চাঁই মহোদয়দিগের ন্যায়, স্থির চিত্তে বুৰিয়া দেখিলে, তাহার অতিরিক্ত কিছুই নহে। সাধুসমাজের অভিমত অভিধান গ্রন্থে, ভ্রুনহত্যা শব্দের যে বিশুদ্ধ ও বিশদ ব্যাখ্যা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতেও ইহাই প্রতিপন্ন হয়। যথা, -

 ভ্রুণহত্যা-সৎ, প্রীতিপ্রদ প্রয়োগবিশেষ দ্বারা, পেটে ফাঁপবিশেষ জন্মিলে, ও মলবিশেষ জমিলে, প্রক্রিয়াবিশেষ দ্বারা, পেটের ঐ ফাঁপবিশেষের নিবারণ, ও পেট হইতে ঐ মলবিশেষের নিকাশন।

 কলকথা এই, ভ্রুণহত্যা, কিঞ্চিৎ অংশেও, দোষাবহ নহে; দোষাবহ হইলে, আমাদের এই পরম পবিত্র অতি বিচিত্র সাধুসমাজে, কদাচ, সচরাচর এরূপ প্রচলিত থাকিত না। এইরূপ চিরচলিত, দোষম্পর্শশূন্য, সার্ব্বজনীন সদাচারকে পাপ বলিয়া গণ্য করিয়া, তন্নিবারনার্থে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত ও আবশ্যক বলিয়া, পাণ্ডিত্যপ্রকাশ করা, নিরবচ্ছিন্ন উন্মাদের লক্ষণ ব্যতীত আর কিছুই প্রতীত হয় না।

 সাধুসমাজের বহুদর্শী বিচক্ষণ চাঁই মহোদয়বর্গের মুখে সদাসর্ব্বদা শুনিতে পাই, বিধবারা অবিবাহিত থাকাতে, সমাজের অশেষবিধ হিতসাধন হইতেছে; তাহাদের বিবাহ প্রচলিত হইলে, দেশটা একবারে ছারখার হইবেক। ইরেজি বিদ্যায় মূর্তিমত্ত, জলজিয়ন্ দেশহিতৈষী মহাপুরুষদিগের মুখেও, ঐরূপ কর্ণসুখকরী সাধুভাবা, সময়ে সময়ে, শুনিতে পাওয়া যায়। কিন্তু, এ বিষয়ে বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয়দের মনোগত অভিপ্রায় কি, এ পর্যন্ত, কেহ তাহা স্থির বুঝিতে পারেন নাই। তাহার কারণ এই, শ্রীমান খুড় মহাশয়েরা নিতান্ত নিরীহ জন্তু; যাহাদিগকে, সর্ব্ব সময়ে, সর্ব্ব বিষয়ে, সাধুসমাজের ক্রীত দাসের ন্যায়, চলিতে ও বলিতে হয়; কোনও বিষয়ে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, অভিপ্রায় প্রকাশ করা তাঁহাদের ইচ্ছা, ক্ষমতা, ও ব্যবসায়ের বহির্ভুত।

 এক বড় মানুষের কতকগুলি উমেদার ছিলেন। আহার প্রস্তুত হইলে, বাবু, পার্শ্ববর্ত্তী গৃহে গিয়া, আহার করিতে বসিলেন; উমেদারেরাও, সঙ্গে সঙ্গে, তথায় গিয়া, বাবুর আহার দেখিতে লাগিলেন। নুতন পটোল উঠিয়াছে। পটোল দিয়া মাছের ঝোল করিয়াছে। বাৰু দুই চারি খান পটোল খাইয়া বলিলেন, পটোল অতি জঘন্য তরকারি বোলে দিয়া, ঝোলটাই খারাপ করিয়াছে। ইহা শুনিয়া, উমেদারেরা বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, কি অন্যায়! আপন কা্র ঝোলে পটোল!! পটোল ত ভদ্র লোকের খাদ্য নয়। কিন্তু, ঝোলে যত গুলি পটোল ছিল, বাৰু ক্রমে ক্রমে সকল গুলিই খাইলেন, এবং বলিলেন, দেখ, পটোলটা তরকারি বড় মন্দ নয়। তখন উমেদারের কহিলেন, পটোল তরকারির রাজা; পোড়ান, ভাজুন, সুক্তায় দেন, ডালনায় দেন, চড়চড়িতে দেন, ঝোলে দেন, ছোকায় দেন, দম্ করুন, কালিয়া করুন, সকলেই উপাদেয় হয়; বলিতে কি, এমন উৎকৃষ্ট তরকারি আর নাই। বাবু কহিলেন, তোমরা ত বেস লোক; যেই আমি বলিলাম, পটোল ভাল তরকারি নয়, অমনি তোমর পটোলকে, নরকে দিলে; যেই আমি বলিলাম, পটোল বড় মন্দ তরকারি নয়, অমনি তোমরা পটোলকে স্বর্গে তুলিলে। উমেদারেরা কহিলেন, মহাশয়, আপনি অন্যায় আজ্ঞা করিতেছেন। আমরা ঝোলের উমেদার নই, পটোলেরও উমেদার নই, উমেদার আপনকার; আপনি যাহাতে খুসি থাকেন, তাহাই আমাদের সর্ব্ব প্রযত্নে কর্ত্তব্য। এই উত্তর শুনিয়া, বাবু নিরুত্তর হইলেন।

 শ্রীমান্ বিদ্যাবাগীশ খুড় মহাশয়েরা এই মনোহর উপাখ্যানের প্রকৃত দৃষ্টান্তস্থল। তাঁহারা শাস্ত্রেরও উমেদার নহেন, ধর্মেরও উমেদার নহেন; তাঁহারা উমেদার পয়সার; পয়সাওয়ালার যাহাতে খুসি থাকেন, তাহাই, তাঁহাদের সর্ব্ব প্রযত্নে কর্তব্য বলিয়া, নির্বিবাদে স্থিরীকৃত হইয়া রহিয়াছে।

 যদি বলেন, সকল পয়সাওয়ালারা ত পয়সা দেন না, তবে কি জন্য তাঁহাদের সকলকে খুসি করিবার চেষ্টা করিবেন। ইহার উত্তর এই, খুড় মহাশয়েরা, গুড়কলসপিপীলিকা। গুড়ের কলসীর মুখ এমন বন্ধ করা আছে যে, তাহাতে কোনও মতে প্রবেশ করিবার সম্ভাবনা নাই; সুতরাং, গুড় খাইতে পাওয়ার প্রত্যাশা সুদুরপরাহত; তথাপি পিপীলিকারা, গুড়ের গন্ধেই মাত হইয়া, কলসীর চারি দিকে, সারি বাঁধিয়া, ঘুরিয়া বেড়াইতে থাকে। সেইরূপ, বিদ্যাবাগীশ পুড় মহাশয়েরা, পয়সা পান না পান, পয়সার গন্ধে অন্ধ হইয়া, যদি পাই এই প্রত্যাশায়, পয়সাওয়ালার গদির নীচে গরুড়ের ন্যায়। বসিয়া, শ্লোক পড়িয়া তোষামোদ ও জল উচু নীচু করেন, এবং, যৎকিঞ্চিৎ লাভের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া, ইহকালে ও পরকালে এক কালে জলাঞ্জলি দিয়া, পয়সাওয়ালাদের খাতিরে, তাঁহাদের অভিমত ব্যবস্থায়, অবিকৃত চিতে, স্ব স্ব নাম স্বাক্ষর করিয়া থাকেন। শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভার চতুর্থ সাংবৎসরিক অধিবেশনে নিমন্ত্রিত বিদ্যাবাগীশের পাল, এবং পালের গোদা শ্রীমান্ ব্রজনাথ বিদ্যারত্ন খুড়, যে ব্যবস্থাপত্রে স্বাক্ষর করিয়াছেন, তাহা এ বিষয়ের সর্ব্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্তস্থল। আশীর্ব্বাদ করি, পুণ্যশ্লোক, পূজ্যপাদ খুড় মহাশয়েরা চিরজীবী হউন।

 ধর্ম্মকথা বলিতে গেলে, তাঁহাদের ঈদৃশ ব্যবহার, কোনও অংশে, দোষাবহ বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে। কারণ, নীতিশাস্ত্রে ব্যবস্থাপিত আছে,

অর্থস্য পুরুষো দাসঃ।
মানুষ পয়সার গোলাম।

পয়সার জন্যে, মানুষে না করিতে পারে, এমন কর্ম্মই নাই। দেখুন, চুরি, ডাকাইতি, গলায় ছুরি, জুয়াচুরি, বাটপাড়ি, জাল সাক্ষী, জাল দলীল, জাল মোকদ্দমা, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা প্রভৃতি এ দেশের লোকের অঙ্গের আভরণ হইয়া উঠিয়াছে। যিনি, যে পরিমাণে, এই সকল বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পারেন, তিনি, সেই পরিমাণে, সাধুসমাজে, বাহাদুর বলিয়া, গণনীয় ও প্রশংসনীয় হইয়া থাকেন।

 অবশেষে, শ্রীমান্ বিদ্যারত্ন খুড়কে, কিছু উপদেশ দিয়া, এবারকার মত, জাল গুড়াইতেছি।

 খুড় মহাশয়!

আপনি বেয়াড়া পণ্ডিত; কিন্তু, আপনকার মত, বেয়াড় আনাড়িও প্রায় চক্ষে পড়ে না। যে দিন, সর্ব্বপ্রথম, আপনার চাঁদমুখ নয়নগোচর করিয়া, মানবজন্ম সফল করি; সে দিন, ব্যবস্থা দিবার সময় বচন ফচন দেখা যায় না, এই কবুল দিয়া, হদ্দমুদ্দ আনাড়ির কর্ম্ম করিয়াছিলেন। সাবধান করিয়া দিতেছি, যেন উত্তর কালে, আর কখনও, ওরূপ মুখআলগা না হন। যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষিণী সভার সভ্য মহোদয়দিগের আহ্বান অনুসারে, সভায় উপস্থিত হইয়াছিলেন, বেস করিয়াছিলেন; তাঁহারা সভায় বক্তৃতা করিতে বলিয়াছিলেন, ভালই; আপনকারদের দস্তুর মত, পাগলের ন্যায়, কতকগুলা অগড়ম বগড়ম বকিয়া, খানিক ক্ষণ গোলমাল করিয়া, বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেই, বেস হইত। তাহা না করিয়া, বক্তৃতা লিখিয়া, ফাঁদে পা দিলেন কেন। যেরূপ জড়াইয়া পড়িয়াছেন, ছাড়াইয়া উঠা কঠিন। বলিতে কি, আপনি অতি বড় বক্কেশ্বর। এক্ষণে, আপনাকে এই উপদেশ দিতেছি, আপনাদের সমাজের সর্ব্বপ্রধান নৈয়ায়িক শ্রীমান্ ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন খুড় মহাশয়ের নিকট, কিছু দিন জ্ঞান শিক্ষা করিবেন। তিনি, আপনার মত, বেহোঁস আহলাদিয়া ছোকরা, বা কাছাআলগা লোক, নহেন।

 কিছু দিন হইল, নৈয়ায়িক বিদ্যারত্ন খুড়, শিয়ালদহ ইষ্টেশনে, খুলনার অস্তঃপাতী নৈহাটীনিবাসী যুক্ত বাবু কৈলাসচন্দ্র বসুর সহিত, বিধবাবিবাহ বিষয়ে, বাদানুবাদ করিতেছিলেন। বিদ্যাসাগর, বচনের অযথা অর্থ লিখিয়া, লোককে প্রতারণা করিয়াছেন; নৈয়ায়িক বিদ্যারত্ন খুড় এইরূপ বলাতে, নিকটবর্ত্তী এক ব্যক্তি কহিলেন, বিদ্যাসাগর, বচনের অযথা অর্থ লিখিয়া, লোককে প্রতারণা করিয়াছেন, যদি আপনকার এরূপ বোধ ও বিশ্বাস, থাকে, তাহা হইলে, ঐ সমস্ত লিখিয়া, সর্ব্ব সাধারণের গোচরার্থে, প্রচারিত করা আপনার উচিত। তাহাতে নৈয়ায়িক বিদ্যারত্ন খুড় কহিলেন,

“শতং বদ মা লিখ।”
শতবার বলিও, লিখিও না

কোনও বিষয়ে কোনও কথা বলিলে, যদি উত্তর কালে ধরাধরি পড়ে, কোন শালা বলিয়াছে বলিলেই, নিষ্কৃতি পাওয়া যায়; লিখিলে, ফাঁদে পা দেওয়া হয়, সহজে এড়াইতে বা ভাঁড়াইতে পারা যায় না। এজন্যই, পূর্ব্বোক্ত নীতিবাক্যে, লিখিতে নিষেধ। দেখুন দেখি, আপনার দুজনেই, এক এক বিষয়ে, সর্ব্বপ্রধান সমাজের সর্ব্বপ্রধান ব্যক্তি; উভয়েই বিদ্যারত্ন উপাধি ধরেন; উভয়েই সর্ব্বত্র সর্ব্বপ্রধান বিদায় মারিয়া থাকেন। কিন্তু, বুদ্ধি ও বিবেচনা বিষয়ে, উভয়ের আসমান জমীন ফরক। তিনি, পাগলের মত বেড়বেড় করিয়া বকিয়া, লোককে জ্বালাতন করিতে সম্মত আছেন। কিন্তু, লিখিয়া ফাঁদে পা দিতে, কোনও মতে, সম্মত নহেন। আপনি এমনই আনাড়ি, তাড়াতাড়ি লিখিয়া, ফাঁদে পা দিয়া জড়াইয়া পড়িলেন।

 যদি বলেন, আমার উপরেই তোমার এতটা চোট কেন। আমাতে ও নৈয়ায়িক বিদ্যারত্নতে তফাৎ কি। আমরা উভয়েই ত, বিদায়ের সময়, এক ব্যবস্থায় স্বাক্ষযর করিয়াছি। ইহা সত্য বটে, আপনারা উভয়েই এক ব্যবস্থায় স্বাক্ষর করিয়াছেন; কিন্তু, সে জন্যে আমি আপনাদিকে ধর্ম্মতঃ অপরাধী করিতে পারি না। সে স্বাক্ষর আপনারা স্বেচ্ছা পূর্ব্বক করেন নাই; তাহা কেবল পয়সাওয়ালাদের খাতিরে ও পীড়াপীড়িতে করিতে হইমাছে। ঐ স্বাক্ষর না করিলে, আপনাদের, এ জন্মে আর, যশোহর প্রদেশে প্রবেশ করিবার অধিকার থাকিত না; এবং সেরূপ ঘটিলে, আমিই আবার আপনাদিগকে, আনাড়ির চুড়ামণি ও বেঅকুফের শিরোমণি বলিয়া, শত সহস্র বার তিরস্কার করিতাম। পয়সাওয়ালাদের মনোরঞ্জনই বিদ্যাবাগীশ দলের বিদ্যাভ্যাস ও শাস্ত্রানুশীলনের এক মাত্র উদ্দেশ্য, ইহা কাহারও অবিদিত নহে। আমার সুক্ষ বিচারে, সে বিষয়ে আপনাদের সাত খুন মাপ। আপনকার সন্তোষার্থে, অধিক আর কি বলি, পয়সাওয়ালাদের খাতিরে বা পীড়াপীড়িতে, কোনও কর্ম্ম করিলে, যদি কেহ আপনাদের উপর, কোনও প্রকায়ে, দোষামোপ করিতে অগ্রসর হয়, আমি খোদহাকিমি করিয়া, শ্রীমতী যশোহরহিন্দুধর্ম্মরক্ষণীসভা দেবীর সহায়তা গ্রহণ পূর্ব্বক, তাহাকে ফাঁসি দিতে, শূলে চড়াইতে, অথবা জন্মের মত দ্বীপান্তরে পাঠাইতে, ক্ষণ মাত্র বিলম্ব করিব না।

 কিছু দিন হইল, অধুনা লোকান্তরবাসী, এক চিরস্মরণীয়, বহুদর্শী বিচক্ষণ,

পণ্ডিতে চ গুণাঃ সর্ব্বে মূর্খে দোষা হি কেবলম্।

এই নীতিবাক্যের, ‘পণ্ডিতের সব গুণ, দোষের মধ্যে বেটারা বড় মূর্খ’, এই ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। নিবিষ্টচিত্তে, বিশিষ্টরূপ বিবেচনা করিয়া বলুন দেখি, এই চমৎকারিণী ব্যাখ্যা, সর্ব্বাংশে সুসঙ্গত বলিয়া, নির্বিবাদে প্রতিপন্ন হয় কি না।

 যাহা হউক, আপনি আর এরূপ কাঁচা কর্ম্ম না করেন, এই আমার প্রার্থনা, এই আমার অনুরোধ, এই আমার উপদেশ। পুনরায় এরূপ কাঁচা কর্ম্ম করিলে, যদিও, খুড় বলিয়া খাতির রাখিয়া, বাঁদরামি করিয়াছেন, না বলি; পাগলামি বা মাতলামি করিয়াছেন, এ কথা বলিতে কিছু মাত্র সঙ্কুচিত হইব না। অলমতিবিস্তরেণ; অর্থাৎ, এ বার এই পর্যন্ত।

খুড়র গুণের কথা অতি চমৎকার।
এমন গুণের খুড় না হেরিব আর
খুড়টির গুণের বালাই লয়ে মরি।
খুড়র পিরিতে সবে বল হরি হরি॥

হরিবোল! হরিবোল!
হরিবোল!

ইতি শ্রীব্রজবিলাসে মহাকাব্যে কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য কৃতৌ
পঞ্চম উল্লাসঃ।

সমাপ্তমিদম্ পূর্ব্বার্দ্ধম্।

  1. দ্বিতীয় পরিশিষ্ট দেখ।
  2. ও দেশের পুরুষজাতির পায়ে কোটি কোটি দণ্ডবৎ। তাঁহারা স্ত্রীলোকের পরকাল খাইবার আসল ওস্তাদ। স্ত্রীলোক, স্বভাবতঃ, সাতিশয় লজ্জাশীল; অতঃকরণে দূরভিলাষের উদয় হইলেও, তাঁহারা, লজ্জার খাতিরে, মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না। তাহারা, স্বয়ম্প্রবৃত্ত হইয়া, ধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়াছেন, এরূপ দৃষ্টান্ত অতিবিরল। কিন্তু, নিরতিশয় আক্ষেপের বিষয় এই পুরুষজাতির প্রবর্ত্তনাপরতন্ত্র হইয়া, এক বার অপথে পদার্পণ করিলে, লজ্জাভঙ্গ হইয়া যায়; একবার লজ্জাভঙ্গ হইলে, আর রক্ষা নাই। তখন,

    “খুলিল মনের দ্বার না লাগে কপাট”।

     সরিশেষ অভিনিবেশ সহকারে, অনুসন্ধান ও অনুধাবন করিয়া দেখিলে, ভয়ানক স্বার্থপর পুরুষজাতির অনিবার্য্য দুষ্প্রবৃত্তির আতিশয্যই স্ত্রীলোকের চরিত্রদোষের মূলকারণ বলিয়া স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।

  3. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ২। ২৭।
  4. ধর্ম্মনির্ব্বাণ তন্ত্র ৩। ৭। ২১।