বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্রাহ্মণ-রোমান-ক্যাথলিক-সংবাদ/সম্পাদকের নিবেদন

উইকিসংকলন থেকে

নিবেদন

 ১৯২৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থানুকূল্যে পর্ত্তুগীজ সরকারী দপ্তরের কাগজপত্র দেখিবার জন্য গোয়া নগরে যাই। তথাকার গ্রন্থালয়ে কুহ্না রিভার-সঙ্কলিত এভোরার পুথিপত্রের তালিকায় একজন বাঙ্গালী রাজপুত্রের লেখা একখানি পুস্তকের বিবরণের প্রতি আমার দৃষ্টি স্বভাবতঃই আকৃষ্ট হয়। কলিকাতায় ফিরিয়া পর্ত্তুগীজ দপ্তরের ঐতিহাসিক কাগজপত্রের যে বিবরণ লিখিয়াছিলাম, তাহাতে প্রসঙ্গতঃ ভূষণার রাজপুত্র-লিখিত পুস্তকেরও উল্লেখ ছিল। সৌভাগ্যক্রমে স্যার রাসবিহারী ঘোষ বৃত্তি পাইয়া ঐ বৎসরই আমি বিলাত যাত্রা করি। ১৯২৬ সালের শেষ ভাগে ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও চিঠিপত্রের সন্ধানে পর্ত্তুগালে গিয়াছিলাম। পর্ত্তুগীজ ভাষায় লিখিত ভারতবর্ষ-সম্বন্ধীয় সকল পুস্তক ও কাগজপত্র পড়িবার অবকাশ আমার ছিল না। মারাঠা ইতিহাসের উপাদান-সংগ্রহের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বৃত্তি দান করিয়াছিলেন; সুতরাং তাহাই ছিল আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। মনে মনে ইচ্ছা ছিল যে অবসর পাইলে দোম আন্তোনিয়োর পুথিখানির খোঁজ লইতে হইবে। আমি প্রায় তিন মাস পর্ত্তুগালে ছিলাম। তাহার মধ্যে পনের দিনের বেশী এভোরায় থাকিবার সুবিধা হয় নাই। রোমান হরফে লেখা হইলেও বাঙ্গালা ভাষা যাহার অনধিগম্য তাহার পক্ষে নির্ভুলভাবে এই পুথি নকল করা সম্ভব নহে। লাইব্রেরীর একজন কেরাণীকে ঐতিহাসিক চিঠিপত্রগুলি নকল করিবার ভার দিয়াও আমি সমগ্র পুথিখানি নকল করিবার সময় পাই নাই। বিশেষ অনুরোধ করিয়াও পুথিখানি লাইব্রেরীর বাহিরে আনিবার অনুমতি পাই নাই। পাইলে হয়ত সমগ্র পুথি নকল করিয়া আনিতে পারিতাম। যাহা হউক প্রথম ৮৩ পৃষ্ঠা ও শেষের দুই পৃষ্ঠা নকল করা হইয়াছিল। তাহাই এখানে মুদ্রিত হইল। বাকী ৩৫ পৃষ্ঠার প্রতিলিপি যদি কখনও পাওয়া যায় তবে ভবিষ্যতে প্রকাশ করিবার ইচ্ছা রহিল। প্রাচীন বাঙ্গালা গদ্যের নিদর্শন-হিসাবেই এই পুস্তক পঠিত হইবে। সুতরাং যদি কখনও ঐ ৩৫ পৃষ্ঠার প্রতিলিপি না পাওয়া যায় তাহাতেও বিশেষ ক্ষতি হইবে বলিয়া মনে হয় না।

 দেশে ফিরিয়া “বার্ষিক বসুমতী”তে এই পুস্তকের একটি অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রকাশ করিয়াছিলাম। চারি বৎসর পূর্ব্বে অধুনা-লুপ্ত “উপাসনা”য় প্রথম ১৭ পৃষ্ঠা ছাপা হয়। ইতিমধ্যে কয়েক জন বন্ধু এই পুস্তক প্রকাশের জন্য অনুরোধ করিয়াছেন। কিন্তু অনবসর, অসুস্থতা ও ছাপাখানার বিভ্রাটে এই কার্য্যে অতিশয় বিলম্ব হইয়া গিয়াছে।

 মুদ্রিত পুস্তকে চৌকা ব্রাকেটের মধ্যে মূল পুথির পৃষ্ঠার সংখ্যা দেওয়া হইয়াছে। রোমান হরফে লেখা অংশ যাহাতে নির্ভুল হয় তাহার জন্য যত্নের ত্রুটি হয় নাই। তথাপি ভুলভ্রান্তি থাকাই সম্ভব। ভবিষ্যতে হয়ত যোগ্য ব্যক্তিরা এই পুস্তক-সম্বন্ধে আলোচনা করিতে চাহিবেন। তাঁহাদের সুবিধার জন্য মূল পুথির যে নকল করিয়া আনিয়াছিলাম তাহা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙ্গালা পুথি-বিভাগে প্রদত্ত হইল।

 বাঙ্গালা আমার মাতৃভাষা হইলেও আমি ভাষাতত্ত্ববিৎ নহি। প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যের সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয়ও আমার নাই। কেবল মাতৃভাষার সামান্য সেবা করিবার লোভে এই পুস্তকের সম্পাদনভার যোগ্য লোকের হস্তে অর্পণ করিতে পারি নাই। আশা করি, এই অতি স্বাভাবিক দুর্ব্বলতা সহৃদয় সাহিত্যিকগণের নিকট ক্ষমার অযোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবে না।

 রোমান হরফে লেখা বাঙ্গালা গদ্য-পুস্তক-সম্বন্ধে বাঙ্গালা ভাষায় অনভিজ্ঞ পণ্ডিতদিগেরও কৌতূহল থাকিতে পারে, এই জন্য একটি সংক্ষিপ্ত ইংরাজী বিবরণও বাঙ্গালা প্রস্তাবনার পরে মুদ্রিত হইল।

 এই পুস্তক-সম্পাদনে আমি বন্ধুবর শ্রীযুক্ত শৈলেন্দ্রনাথ মিত্র, শ্রীযুক্ত প্রিয়রঞ্জন সেন ও কল্যাণীয় অধ্যাপক সুধীরকুমার দাশের নিকট নানাবিধ সাহায্য পাইয়াছি। আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত আশুতোষ ভট্টাচার্য্য মহাশয়ও আমাকে নানা বিষয়ে সাহায্য করিয়াছেন। নবগোয়া-নিবাসী অধ্যাপক পাণ্ডুরঙ্গ পিসুর্লেকর আমার জন্য গোয়া দপ্তর হইতে ফাদার আম্ব্রোসিয়োর পত্র নকল করিয়া পাঠাইয়াছেন। এভোরার পুথির শিরোনামা ও প্রস্তাবনার আলোকচিত্র লিস্‌বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দাভিদ লোপেসের অনুগ্রহে পাইয়াছি। পরম স্নেহভাজন শ্রীমান্ শশিভূষণ দাশগুপ্ত শব্দসূচী সঙ্কলন করিয়া দিয়াছেন। কলিকাতার সেণ্ট জেভিয়ার্স কলেজের কর্ত্তৃপক্ষ আমাকে তাঁহাদের সংগৃহীত পর্তুগীজ পুস্তকগুলি দেখিতে দিয়া বাধিত করিয়াছেন। এই জন্য তাঁহারের সকলের নিকট কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি।

 এই সাম্প্রদায়িক উষ্ণতার যুগে একটি কথা বিশেষ করিয়া বলা প্রয়োজন। দোম আন্তোনিয়োর পুথিতে হিন্দুধর্ম্মের নিন্দা আছে। আমি নিজে হিন্দু, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ত্তৃপক্ষেরও হিন্দু-বিদ্বেষের কারণ নাই। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রাচীন গদ্যের নিদর্শন-হিসাবে এই বইখানির কিছু মূল্য আছে বলিয়াই বিশ্ববিদ্যালয় কর্ত্তৃক ইহা প্রকাশিত হইল। সাধারণের নিকট হিন্দুর ধর্ম্মমত হেয় প্রতিপন্ন করিবার অভিসন্ধি সম্পাদক অথবা প্রকাশকের নাই, থাকিতে পারে না। এই জাতীয় পুস্তক বেশী বিক্রয় হইবার সম্ভাবনা নাই। সুতরাং কোন সাধারণ প্রকাশক এই পুস্তক-মুদ্রণের ব্যয় স্বীকার করিতেন কিনা সন্দেহ। এই জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়কে এই ক্ষুদ্র পুস্তক প্রকাশের ভার গ্রহণ করিতে হইয়াছে। ইতি

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
১লা জানুয়ারী, ১৯৩৭

শ্রীসুরেন্দ্রনাথ সেন