বিষয়বস্তুতে চলুন

ভারতে অলিকসন্দর/প্রথম ভাগ/দ্বিতীয় অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অধ্যায়

 এসিয়াবাসীর সহিত ইয়ুরোপবাসীর অহিনকুল সম্বন্ধ। অতি প্রাচীনকালে আমাদের এই জম্বুদ্বীপের অধিবাসীরা, অসভ্য ইয়ুরোপীয়দিগকে পরাজয় করিয়া, তাহাদের দেশ অধিকার করেন। সেই সকল ইয়ুরোপজেতাদিগের ভাব ও ভাষা অনুশীলন করিয়া বর্ত্তমান কালের ইয়ুরোপীয় পণ্ডিতেরা বিবেচনা করেন তাহারা আমাদের আর্য্য জাতির একটি শাখা। বহুদিন আমাদের সঙ্গভ্রষ্ট এবং অদর্শন জন্য তাহারা ম্লেচ্ছত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। এ কথা ভগবান মনুর সময় হইতে বর্ত্তমান কালেও আলোচিত হইয়া থাকে। তাহারা আমাদের এসিয়াবাসীর সন্তান সন্ততি হইলে ও কিন্তু তাহারা আমাদিগকে অসভ্য, বর্ব্বর প্রভৃতি আখ্যায় সম্বোধন করিতে ভুলিয়া যাইত না, বা অবকাশ পাইলে আমাদের দেশ জয়, আমাদের প্রতি অত্যচার করিয়া এসিয়াবাসীকে ধ্বংস করিতে পশ্চাৎ পদ হইত না ও হয় নাই। অপর পক্ষে এসিয়াবাসীরাও পতঙ্গপালের ন্যায় অসংখ্য দলে বিভক্ত হইয়া ইয়ুরোপ খণ্ডকে ব্যতিব্যস্ত করিয়াছে, আটলাণ্টিকের তট পর্য্যন্ত ভূভাগ অধিকার করিয়াছে, জ্ঞান বিতরণ করিয়া ইয়ুরোপের বর্ত্তমান সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করিয়াছে।

 পারস্যপতি জারেকসার্সের গ্রীস আক্রমণের পর হইতে গ্রীকগণের হৃদয়ে বৈরনির্য্যাতন স্পৃহা স্থান লাভ করে। এই ইচ্ছা সমগ্র জাতির ইচ্ছা হইলেও গ্রীসবাসী পরস্পর বিবাদ বিসম্বাদে লিপ্ত থাকায়—উপযুক্ত ব্যক্তি দ্বারা জাতীয় ইচ্ছা সম্বর্দ্ধিত ও পরিচালিত না হওয়াতে, অনেক দিন ইহা প্রসুপ্ত অবস্থায় অবস্থান করে। ব্যক্তিগত বাসনার ন্যায়, জাতীয় বাসনা ও প্রনষ্ট হয় না, অনুকুল অবকাশ পাইলেই উহা উভয়েতেই বিকাশ পাইয়া থাকে। দশসহস্র গ্রীকের প্রত্যাবর্ত্তণের পর গ্রীকদের চোখের পরদা খুলিয়া খুলিয়া গেল, বৈরানল সন্ধুক্ষিত হইল। এই অভিযানে গ্রীকেরা পারস্য সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরিক বিষয় অবগত হইল—রাস্তা, ঘাট, মাট প্রত্যক্ষ করিল, পারসিক মোহ দূর হইল। গ্রীসে নূতন যুগের আবির্ভাব হইল, পারস্যের অর্থ বা বাহুবলের উপকথা আর গ্রীকবাসীকে ভুলাইয়া রাখিতে সমর্থ হইল না। বর্ত্তমান কালে পাশ্চাত্য শক্তি প্রাচ্যের হস্তে নিগৃহীত হইয়া ভবিষ্যতে যাহাতে এসিয়াবাসীর হস্তে বিশেষরূপে লাঞ্ছিত না হয়, সে জন্য তাহারা যেমন এখন হইতেই উপায় উদ্ভাবন করিতেছেন, সেইরূপ যদি দশ সহস্র গ্রীকের প্রত্যাবর্ত্তনের পর পারস্য সম্রাট বা তাঁহার স্বদেশবাসী নিজেদের দুর্ব্বলতা দুর করিতে সমর্থ হইতেন, তাহা হইলে এসিয়াবাসীকে অলিকসন্দরের হস্তে নিপীড়িত হইতে হইত না।[]

 আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি যে গ্রীসদেশ কতকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদে বিভক্ত ছিল। একে ক্ষুদ্র, তাহার উপর বিবাদ বিসম্বাদ থাকায়, তাহারা সমর নিপুন হইলেও নৌযুদ্ধে ও স্থলযুদ্ধে অদ্ভুত বীরত্ব দেখাইলেও পারসীকদের বড় কিছুই করিতে পারে নাই। ইহা ব্যতীত গ্রীক রাজ্যের নাগরিক যোদ্ধাদের সংখ্যাও খুব কম ছিল। সেকালে স্পার্টা ও এথেন্স বাহুবলে গ্রীসের শীর্ষস্থানীয় ছিল। এরেষ্টোটালের সময় প্রথমোক্তের নয় সহস্র এবং শেষোক্তের নাগরিকের সংখ্যা ২০।৩০ হাজারের বেশী হইবে না। লুকাত্রা (Luctra) ক্ষেত্রে ৭ শত স্পার্টান এবং চিরোনিয়া (Chaeronea) ক্ষেত্রে ৩ সহস্র এথেনবাসী নিহত হওয়াতে উভয় রাজ্য হীনবল হইয়া পড়ে। এরূপ অবস্থায় গ্রীসবাসীর এসিয়া আক্রমণ কল্পনা আকাশ কুসুমের ন্যায় অলীক হইলেও পারসিকেরা গ্রীসের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিগণকে প্রচুর অর্থ প্রদান করিয়া নানাপ্রকার ষড়যন্ত্রের অবতারণা করাইয়া ছিল। পারস্যের অর্থে যে সকল ব্যক্তি পরিপুষ্ট হইত, তাহাদের মধ্যে এথেন্সের ডিমস্‌থিনিস বিশেষ উল্লেখযোগ্য, ইনি মাসিদনের ফিলিপের বিরুদ্ধে অনলবর্ষি বক্তৃতা দ্বারা বিশেষ খ্যাতিলাভ করেন।

 মাসিদনের অধিপতি ফিলিপ, সৈন্য বিষয়ক সংস্কার করিয়া সৈন্যগণকে সমর দুর্জ্জয় করিয়াছিলেন। তিনি ভাড়াটে বা সখের সৈন্যের পরিবর্ত্তে বেতনভূক্ স্থায়ী সৈন্য নিযুক্ত করিয়া তাহাদিগকে যুদ্ধ বিদ্যায় সুনিপুণ করিয়াছিলেন। ফিলিপই ইয়ুরোপ খণ্ডে বেতনভূক্ স্থায়ী সৈন্যের প্রবর্ত্তক। এই সকল সৈন্যগণকে তিনি সময় সময় প্রচুর পুরস্কার এবং সম্মান প্রদান করিয়া তাহাদিগের হৃদয়ে জাতীয় ভাবের অঙ্কুর উৎপাদন করেন। জাতি বা সৈন্য একদিনে গঠিত হয় না! ফিলিপ, মধ্যবিত্ত গৃহস্থের বালকগণকে রাজধানীতে আনয়ন করিয়া শিক্ষা প্রদান করিতেন—যুদ্ধকালে এই সকল যুবক, সৈন্যচালনা করিয়া শত্রুদিগের ভীতি উৎপাদন করিত। ইহাদিগের মধ্যে বিলাসিতার লেশমাত্রও ছিল না। একজন সেনানী শীতকালে—সে শীত আমাদের দেশের শীত অপেক্ষা অনেক বেশী—গরম জলে স্নান করিয়াছিল বলিয়া, সে ফিলিপ কর্ত্তৃক অত্যন্ত ভর্ৎসিত হইয়াছিল! একজনের সঙ্গে স্ত্রীলোক ছিল বলিয়া সে পদচ্যূত হয়। ফিলিপ, এরূপ কঠোরতা অবলম্বন না করিলে তাঁহার সৈন্য কখনই দিগ্বিজয় করিতে সমর্থ হইত না। ফিলিপ, অশ্বারোহী ও পদাতিক উভয় সৈন্যেরই সংস্কার সাধন করিয়াছিলেন। অলিকসন্দার, যে সৈন্য লইয়া এসিয়া বিজয়ে বহির্গত হন সে সৈন্য ফিলিপের সৈন্য, যে সৈন্যবলে তিনি গ্রাণিকস্ ক্ষেত্রে পারসীকগণকে পরাভূত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন তাহা ফিলিপেরই সৈন্য—ফিলিপের সেনানীরাই অলিকসন্দরের প্রধান সহায় ছিল। অলিকসন্দরের সেনানীরা ফিলিপের সেনানীদের প্রতিচ্ছায়া স্বরূপ ছিল বলিলে অত্যুক্তি হয় না।

 ফিলিপ, সৈন্যগণকে “রাজসহচর” “রাজপার্ষদ” ইত্যাদি নামে অভিহিত করিয়া তাহাদিগকে গৌরবান্বিত করিতেন। এই রূপ যে সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সর্ব্বাগ্রে গমন করিয়া শত্রু সৈন্যকে প্রহার করিত—যুদ্ধের ভীতিপ্রদ প্রদেশে গমন করিয়া বীরত্ব দেখাইত, সে এবং অন্যান্য কৃতকর্ম্মা যোদ্ধা কেহ বা দ্বিগুণ বেতন কেহ বা অর্থ পুরষ্কার ইত্যাদি লাভ করিয়া কৃতকৃতার্থ হইত। মেসিডোনিয়ান ব্যতীত যে কোন যোগ্য ব্যক্তি এ সম্মানে বঞ্চিত হইত না। ফিলিপের সৈন্য, আশঙ্কাদর্শী বুদ্ধিমান এথেনিয়ান, বা কঠোরকর্ম্মা স্পার্টান অপেক্ষা যুদ্ধকালে দক্ষতা দেখাইতে সমর্থ হইত।

 দূরদর্শী রাজনীতিবিৎ ফিলিপ, ধীরে ধীরে গ্রীকগণকে সাম, দান ও ভেদের দ্বারা নিজের পক্ষপাতী করিয়াছিলেন। যেস্থানে উক্ত উপায়ত্রয় ব্যর্থ হইয়াছিল, সেইস্থানে তিনি দণ্ড প্রয়োগ করিয়া স্বকার্য্য সাধন করিয়াছিলেন। ঘুষ ও ষড়যন্ত্র, ফিলিপের প্রধান অস্ত্র, এই অস্ত্রের সাহায্যে কার্য্য সম্পন্ন হইলে, তিনি অসিকোষ মুক্ত করিতেন না, কিন্তু ইহা ব্যর্থ হইলে দণ্ড প্রয়োগে শত্রুজয় করিতেন। এইরূপে ফিলিপ, স্পার্টা ব্যতীত গ্রীসের অন্য সমস্ত জনপদকে নিজের পক্ষভুক্ত করিয়া একছত্রি হন। ইহার ফলে করিন্থের জাতীয় সমিতিতে ফিলিপ সমস্ত গ্রীসের নায়ক-প্রধান হইয়া পারস্যের বিরুদ্ধে পূর্ব্ব-সঞ্চিত ক্রোধবহ্নি উদ্গীরণ করিতে মনস্থ করেন।

 বলবান কাল ফিলিপের ইচ্ছা পূর্ণ করিলেন না। যিনি অনেক ক্লেশে গ্রীসের অনেক ভাঙ্গিয়া চুর্ণ করিয়া একতা সম্পাদন করিলেন, যিনি শত্রু সংহার করিবার জন্য তীক্ষ্ণধার অস্ত্র শস্ত্র ও সমরনিপুন সৈন্যবল প্রস্তুত করিলেন, তিনি তাঁহার স্ত্রী ও পুত্র প্রেরিত ঘাতকের হস্তে ৪৫ বৎসর বয়ঃক্রমে অকালে—ডিমনথিনিসের “পেলার বর্ব্বর”—মানবলীলা সম্বরণ করেন।

 ফিলিপ মরিয়া গেলেন বটে, কিন্তু অলিকসন্দরের জন্য (১) শক্তিশালী সেনা প্রস্তুত—(২) সামুদ্রিক বন্দর অর্জ্জন এবং (৩) পারস্যের বিরুদ্ধে গ্রীসের সমস্ত শক্তিকে একত্র করিয়া দিলেন।

 ফিলিপের মৃত্যুর সময়, অলিকসন্দর বিংশতি বৎসর বয়ঃক্রমে পদার্পণ করেন। অলিকন্দসর গ্রীক-রাজ এপিবোতের কন্যা অলিমফিয়ার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ফিলিপের সহিত অলিমফিয়ার যৌবনের প্রারম্ভে প্রণয় হইয়াছিল,কালে এই প্রণয় পরিণয়ে পরিণত হয়। অলিকসন্দরের জননী অদ্ভুত প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি বড় বড় সাপ লইয়া খেলা করিতেন, শয়নকালেও তাঁহার পার্শ্বে সাপ শয়ন করিয়া থাকিত। ইহা ব্যতীত তিনি বড়ই কোপন স্বভাব ছিলেন, সেকালের অনেকের ধারণা মিশ্রদেশের জনৈক ফলিত জ্যোতিষীর ঔরসে অলিকসন্দরের জন্ম হয়। এই সকল কারণেই হউক, অথবা তাঁহার চরিত্রগত দোষের জন্যই হউক, ফিলিপ তাঁহাকে দেখিতে পারিতেন না, তাঁহার সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, এবং অলিকসন্দরকে সভামধ্যে জারজ বলিতেও লজ্জিত হইতেন না। অলিকসন্দরের জন্ম সম্বন্ধে এরূপ কথিত হয় যে অলিমফিয়া স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন, তাঁহার উদরের উপর বজ্র পতিত হইয়া চতুর্দ্দিকে বহুদূর পর্য্যন্ত স্থান দগ্ধ করিয়া অন্তর্হৃত হয়—ফিলিপও স্বপ্ন দেখেন যেন তিনি অলিমফিয়ার গর্ভ সিংহ অঙ্কিত সিলমোহর দ্বারা চিহ্ণিত করিয়াছেন। গ্রীসের স্বপ্নতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা উপরোক্ত স্বপ্নে স্থির করেন, যে অলিমফিয়ার গর্ভজাত বালক একজন অসাধারণ শক্তিশালী হইবে।

 অলিকসন্দর খৃষ্টের ৩৬৫ বৎসর পূর্ব্বে মেসিডোনিয়ার পেলা নগরে অক্টোবর মাসের প্রথম ভাগে জল ঝড়যুক্ত রাত্রিতে জন্মগ্রহণ করেন। এরূপ কথিত আছে যে, এই রাত্রে ইফিসুস্ নগরের ডিয়ানা দেবীর মন্দিরে আগুন লাগে—অনেকের ধারণা এ আগুনে কেবল মন্দির পোড়েনি ইহাতে এসিয়ার কপাল পোড়ার প্রারম্ভ হয়। এস্থানের ডিয়ানার অদ্ভুত মন্দির প্রাচীনকালের সপ্ত আশ্চর্য্য-কীর্ত্তির মধ্যে একতর বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে।

 ফিলিপ, পুত্ত্রলাভের সহিত শত্রুগণের উপর তাঁহার সেনানীর বিজয়লাভ, এবং ওলিম্পিয়া উৎসবে ঘোড়দৌড়ে তাঁহার অশ্বের জয়লাভ সংবাদে নিজেকে পরম ভাগ্যবান বিবেচনা করিয়াছিলেন। দক্ষিণ গ্রীসে পীসা নগরীর নিকট ওলিম্পিয়া ক্ষেত্রে প্রতি চারি বৎসর অন্তর গ্রীসের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ উৎসবের অনুষ্ঠান হইত—এই উৎসবের সময় সকল প্রদেশের গ্রীসবাসী পরস্পর শত্রুতা পরিত্যাগ করিয়া একমত হইয়া এই উৎসবে যোগ দিত। এখানে নূতন গ্রন্থ পাঠ—কবির লড়াই—ব্যায়াম মল্লক্রীড়া, ঘোড়দৌড়, গাড়িদৌড় প্রভৃতিতে যিনি যিনি শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতেন, সেই সেই ভাগ্যবানের নাম, অতি অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র গ্রীসের ঘরে ঘরে প্রচারিত হইত। তাহার সম্মানের অবধি থাকিত না, অধিবাসীর সম্মানের সহিত তাহার জন্মভূমিও সাধারণের নিকট সুপরিচিত হইত এবং দেবতার ন্যায় সে ব্যক্তি পূজিত হইত। এরূপ উৎসব ক্ষেত্রে জয়লাভের সহিত অলিম্‌ফিয়ার পুত্ত্র প্রসব, এবং সেনানী পারমিনিওর, ইলিরিয়ান্ পরাজয় ঘটনা ফিলিপের সৌভাগ্য বিশেষরূপে সূচন করিয়াছিল। দৈবজ্ঞরাও এরূপ পুত্ত্র শত্রুর অজেয় হইবে বলিয়া ফিলিপকে বিশেষরূপে আহ্লাদিত করিয়াছিল।

 অলিকসন্দরের বাল্যজীবনীর কথা বিশেষ কিছু জানা যায় না। এরূপ কথিত আছে যে ফিলিপ, সুপ্রসিদ্ধ দার্শনিক এরেষ্টোটালকে পুত্রের জন্ম সংবাদ প্রদান করিয়াছিলেন, কেহ কেহ ইহা অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দেন। সম্ভবতঃ রাজ-শিষ্যের পঞ্চদশ বৎসর বয়ক্রমের সময় তিনি উপদেশ দিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। এরেষ্টোটালের পিতা মাসিদন রাজপরিবারের গৃহচিকিৎসক ছিলেন। এরূপ অবস্থায় তাঁহার সময় সময় অলিকসন্দরের বাল্যশিক্ষা পর্য্যবেক্ষণ নিতান্ত অসম্ভবও নহে। এরেষ্টোটাল শিক্ষাদান সময় তিন ভাগে বিভক্ত করিয়াছেন। প্রথম, জন্ম হইতে সপ্তম বর্ষ, দ্বিতীয় অষ্টমের আরম্ভ হইতে অষ্টাদশের শেষ, এবং তৃতীয় কাল একশ বৎসর পর্য্যন্ত। এরেষ্টোটাল বলেন, প্রথমে শিশুর খাদ্য ও শরীরের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত, শিশু যাহাতে শীতসহিষ্ণু হয়, সে জন্য শীতল জল অথবা অল্প পরিমাণে শীতবস্ত্র ব্যবহার করিতে অভ্যস্ত করান উচিত। যাহাতে খারাপ না শেখে সে জন্য চোক ও কাণের উপর বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। সম্ভবপর খেলার সময়ও যাহাতে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হয়, এরূপভাবে শিশুকে খেলাইতে দিতে বলেন। অলিম্‌ফিয়ার,লিয়ননেটাস নামক একজন আত্মীয়, অলিকসন্দরকে বাল্যকালে রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন—ইনি একজন কঠোর নীতিপরায়ণ ছিলেন। সম্ভবতঃ ইহার শিক্ষায় অলিকসন্দরের শরীর সুদৃঢ় বলবান ও কর্মমঠ হইয়াছিল। লাইসিমেক্‌স নামক একজন ব্যক্তির হস্তে অলিকসন্দরের শিক্ষার ভার অর্পিত হয়। প্লুটার্ক, ইহাকে বড় ভাল চক্ষে দেখেন নাই—রাজাদের মোসাহেবেরা রাজা ও রাজপুত্ত্রগণকে ইতিহাস প্রসিদ্ধ ব্যক্তির সহিত যেরূপ তুলনা করিয়া আনন্দ করিয়া থাকে, ইনিও সেইরূপ অলিকসন্দরকে হোমরের বীর এচিলসের সহিত তুলনা করিয়া আমোদ প্রকাশ করিত। এই সময় হইতে অলিকসন্দরের হৃদয়ে হোমর প্রীতি অঙ্কুরিত হয় কিনা তাহা আমরা অবগত নহি।

 এরিষ্টটেলের মতানুসারে দ্বিতীয় শিক্ষা অর্থাৎ ৮ হইতে ১৭ বৎসর পর্য্যন্ত যে শিক্ষা দেওয়া হয় তাহার প্রথম ভাগে সাহিত্য—ব্যায়াম—সংগীত এবং চিত্র সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া হইত। ব্যাকরণ, পদ্য, গদ্য ও ইতিহাস সাহিত্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হইত। ব্যায়ামে-শরীরের দৃঢ়তা,সুন্দর গঠন, কর্ম্মনিপুণতা প্রভৃতি বর্দ্ধিত হইয়া থাকে। তিনি বালকগণের প্রথম অবস্থায় উৎকট ব্যায়ামের পক্ষপাতি ছিলেন না। ইহাতে শরীর গঠনের ব্যাঘাত জন্মাইয়া থাকে। এ বিষয়ে তিনি হিসাব দেখাইয়া বলেন যে ওলিম্‌ফিক্ উৎসবে যাহারা জয়লাভ করিয়াছেন, তাহাদিগের মধ্যে দুই তিন জন ব্যতীত আর কেহ যৌবন প্রৌঢ় উভয় অবস্থায় জয়যুক্ত হইতে সমর্থ হন নাই। কচিছেলের মাথায় শিক্ষার বোঝা দেওয়া, বা তাহার দ্বারা অতিরিক্ত ব্যায়াম করান শরীর গঠনের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিজনক। সৌন্দর্য্যজ্ঞানহীন মানুষ অন্ধের সমান বলিলে অত্যুক্তি হয় না। সৌন্দর্য্যজ্ঞান যাহাতে বর্দ্ধিত হয় সে বিষয়ে গ্রীক শিক্ষকগণ ছাত্রের বাল্যকাল হইতে চোক ফুটাইয়া দিতেন। চিত্রাঙ্কণ বিষয়ক শিক্ষাও ছাত্রগণকে বেশ ভাল রূপই দেওয়া হইত। প্রাচীন গ্রীসের সৌন্দর্য্যজ্ঞান ইতিহাস প্রসিদ্ধ, ভাস্কর কার্য্যে গ্রীক অদ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়াছিল। ছাত্রকে কণ্ঠ সঙ্গীত এবং যন্ত্রসঙ্গীত উভয়ই শিক্ষা দেওয়া হইত। বালকের শিক্ষার ইহা একটি অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইত। শিশু যেরূপ ঝুমঝুমির শব্দে আনন্দ প্রকাশ করিয়া থাকে। সেইরূপ শ্রান্ত মানুষ সঙ্গীত শ্রবণ করিয়া প্রফুল্লিত হইয়া থাকে।

 অলিকসন্দরের যে সময় একাদশ বৎসর বয়ক্রম, সে সময় ডিমস্থিনিস, এসচিনিস এবং আরো আটজন এথেন্সের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি, রাজকার্য্যের জন্য ফিলিপের দরবারে আগমন করেন। রাজকার্য্যের পর ফিলিপ সমাগত এথেন্সবাসীর কাছে তাঁহার পুত্ত্রের পরিচয় প্রদান করেন। অলিকসন্দর বীণা (হার্প) যন্ত্র বাজাইয়া এবং নাটকের স্থান বিশেষ আবৃত্তি করিয়া নিজের শিক্ষার পরিচয় প্রদান করেন। ডিমস্থিনিস রাজপুত্রের উচ্চারণ গত দোষ ধরিলেও একাদশ বৎসরের বালকের পক্ষে ইহা সামান্য প্রশংসার কথা নহে।

 খৃষ্টের ৩৪২ পূর্ব্বে অলিকসন্দারের পঞ্চদশ বৎসর বয়ক্রমের সময় এরিষ্টটেল রাজকুমারের শিক্ষার ভার স্বয়ং গ্রহণ করেন, এবং তাঁহার এসিয়া গমনের পূর্ব্ব সময় পর্য্যন্ত তাঁহার নিকট অবস্থান করিয়াছিলেন। এরিষ্টটেল, ইয়ুরোপের প্রাচীন যুগের একজন অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি ন্যায় দর্শন,প্রকৃতি বিজ্ঞান, রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ক অতি উৎকৃষ্ট গ্রন্থ রচনা করিয়া ইয়ুরোপীয় বিজ্ঞানের ভিত্তি সংস্থাপন করিয়াছেন। এরূপ ব্যক্তি,অলিকসন্দরের ন্যায় অসাধারণ মেধা সম্পন্ন ছাত্রকে সুশিক্ষিত করিবেন, তাহা কিছু আশ্চর্য্যের কথা নহে। রাজগুরু শিষ্যকে নানা বিষয়ের শিক্ষার সহিত তাঁহার পূর্ব্বর্তন প্রভুর হত্যার প্রতিশোধ জন্য পারস্যপতির বিরুদ্ধে অলিকসন্দরের হৃদয়ে এ সময়ে বীজ বপনও সম্ভবতঃ করিয়া থাকিবেন।[]

 এরিষ্টটেল, অলিকসন্দরকে যে সকল কাব্যের রসাস্বাদন করাইয়াছিলেন, তাহার মধ্যে অমরকবি হোমরের ইলিয়দ কাব্য সর্ব্বপ্রধান। অলিকসন্দর ইহা পাঠ করিয়া বীররসে বিভোর হইয়াছিলেন।

 ইলিয়াদের যুদ্ধস্থলের দারুণ দৃশ্য, সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড গ্রাস করিবার জন্য যেন যুদ্ধদেবী বিকট বদনব্যাদন করিয়া গভীর গর্জ্জন করিয়া অগ্রসর হইতেছেন, শত্রুনাশ করিবার জন্য গ্রীকদিগের দুরন্ত ক্রোধাগ্নি, যেন আকাশ পাতাল ভস্মীভূত করিবার জন্য লক্ লক্ করিয়া চতুর্দ্দিকে প্রসারিত হইতেছে। কোন স্থানে বা অগ্নিকুণ্ড ভীষণ আকার ধারণ করিয়া শশীসূর্য্য ধূমে আচ্ছাদিত করিয়া ঘন ঘন বজ্রঘোষে সমস্ত দিক বিদিক আলোড়িত করিয়া ক্রোধাগ্নির উগ্র শিখায় জগৎ ঝলসিয়া ফেলিতেছে, ইলিয়াদির এই সকল ঘোরতর ভয়ঙ্কর দৃশ্য অলিকসন্দরের বড়ই প্রীতিপ্রদ ছিল। তিনি প্রাণের সখার ন্যায় আজীবন সমরজ্ঞানের আধার এই ইলিয়াদকে সঙ্গে লইয়া বেড়াইয়াছিলেন—শয়নকালে পাছে সঙ্গচ্যুত হন এই জন্য অলিকসন্দর ইহা তলবারের সহিত শিয়রে করিয়া শয়ন করিতেন। এই ইলিয়দের সঙ্গ ফলে অলিকসন্দর জগজ্জেতা হইয়াছিলেন। অলিকসন্দর, পারস্যাধিপতিকে পরাজয় করিয়া তাঁহার বহুমূল্য রত্নখচিত যে রত্নাধার প্রাপ্ত হন, সেই রত্নাধারে তাঁহার অমূল্য রত্ন ইলিয়াদ রক্ষা করিয়া সেই রত্নাধারের মূল্য বৃদ্ধি করিয়াছিলেন, সেই গ্রন্থখানি অলিকসন্দারের আজীবন সহচররূপে অবস্থান করে। অলিকসন্দর সাধারণতঃ রাজনীতি, সমাজনীতি, লোকযাত্রা প্রভৃতি লৌকিক বিদ্যায় অভিজ্ঞ হইয়াছিলেন, পারলৌকিক বিষয়ক জ্ঞান তিনি তাঁহার গুরুর কাছে কিছু পাইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না, তাহা যদি পাইতেন তাহা হইলে তাঁহার পাশব প্রবৃত্তি সকল উত্তরকালে কখনই সীমা অতিক্রমণ করিয়া বৃদ্ধি পাইতনা।

 অলিকসন্দরের উচ্চ আশা, বাল্যকাল হইতে বদ্ধমূল হইয়াছিল। ফিলিপের বিজয়বার্ত্তা যখন আনীত হইত, তখন ইহা শ্রবণ করিয়া অলিকসন্দর সঙ্গী বালকগণকে বলিতেন “বাবা যদি সব জয় করিলেন তবে আমরা কি জয় করিব?” ইত্যাদি বলিয়া আক্ষেপ করিতেন।

 “আমি বড়মানুষের ছেলে” অলিকসন্দরের হৃদয়ে এভাবটাও বেশ ছিল, এর বাপ ফিলিপের এভাব বড় ছিল না। তিনি ওলিম্‌ফিক্ উৎসবে যোগ দিতে পশ্চাৎপদ হইতেন না। অলিকসন্দর দৌড়াইতে খুব মজবুত ছিলেন। এক সময় তাহাকে ওলিম্‌ফিক উৎসবে দৌড়িবার জন্য কেহ অনুরোধ করেন, প্রত্যুত্তরে অলিকসন্দার বলেন “যদি কোন রাজপুত্ত্র আমার প্রতিদ্বন্দ্বি হন তাহা হইলে আমি দৌড়াইতে প্রস্তুত আছি। গ্রীসের ওলিম্‌ফিক উৎসব জনসাধারণের জাতীয় সম্পত্তি—একজন দরিদ্র গ্রীকবাসীর যেরূপ অধিকার ছিল, একজন রাজার তাহা অপেক্ষা কিছু বেশী অধিকার ছিল না। একবার পারস্যপতি এখানে তাঁহার রথ পাঠাইতে চাহিয়াছিলেন কিন্তু বৈদেশিকবলিয়া তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী পদলাভ করিতে সমর্থ হন নাই।

 অলিকসন্দরের প্রতিভা বিষয়ক গল্পে কথিত হয়— এক সময় পারস্য দূত রাজধানীতে আগমন করেন, সে সময় ফিলিপ স্থানান্তরে অবস্থান করিতেছিলেন। অলিকসন্দর দূতকে সন্ত্রমের সহিত গ্রহণ করিয়া প্রবীণের ন্যায় আলাপ করেন, তিনি পারস্যপতির স্বভাব চরিত্র, তাঁহার সৈন্যবল, শত্রুর সহিত তিনি কিরূপ ব্যবহার করেন, সে প্রদেশের রাস্তা ঘাট ও দূরত্ব বিষয়ক নানাপ্রকার প্রশ্ন করিয়া সকলকে মুগ্ধ করিয়াছিলেন।

 এক সময় একজন লোক ফিলিপকে একটা ঘোড়া বিক্রয় করিতে আগমন করে, ঘোড়া সকলের পছন্দ হইল, ১৩ টালাণ্ট (প্রায় ৩৮ হাজার টাকা) দাম স্থির হইল। পরীক্ষার জন্য, সকলে ময়দানে সমবেত হইলেন। এ সময় ঘোড়াটা অত্যন্ত দুষ্টুমি করিতে লাগিল, পিঠে কাহাকেও চড়িতে দিল না, তাহাকে সহিসদের ধরিয়া রাখাও দায় হইয়া উঠিল। ফিলিপ ঘোড়ার অবস্থা দেখিয়া দূর করিয়া দিতে আজ্ঞা করিলেন। অলিকসন্দর অবস্থা ভাল করিয়া দেখিতেছিলেন, তিনি পিতাকে ঘোড়া ফিরাইয়া দিতে দেখিয়া বলিলেন “একটু নিপুণতা ও কুশলতা না থাকার জন্য এমন ঘোড়া হাতছাড়া হইল।” ফিলিপ প্রথমে এ কথার উপর লক্ষ্য করিলেন না। কিন্তু বারংবার এই কথা বলায় তিনি একটু বিরক্ত হইয়া বলিলেন যুবকেরা মনে করে তারা যেন বুড়োদের চেয়ে সকল বিষয়ে বেশী বোঝে। অলিকসন্দর প্রত্যুত্তরে“কিছু কিছু বোঝে” উত্তর দিলেন। ফিলিপ বলিলেন, “তুমি যদি চড়িতে না পার তাহা হইলে তোমার প্রগল্‌ভতার জন্য কি হারিবে? উত্তরে বলিলেন “ইহার মূল্য” এই কথায় পার্শ্বের সকলে হাসিতে লাগিল। অলিকসন্দর ক্ষণবিলম্ব না করিয়া ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া তাহাকে সূর্য্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া ধরিল। ঘোড়াটা নিজের ছায়া দেখিয়া ভয় পাইতেছিল—নিজের অঙ্গ সঞ্চালনের সহিত ছায়াটা আরো সঞ্চালিত হইতেছিল, ইহাতে সে আরো বিভীষিকাগ্রস্ত হইতেছিল। অলিকসন্দর, ঘোড়ার ভয়ের কারণ বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তাই ঘোড়া যাহাতে ছায়া দেখিতে না পায়, সূর্য্যের দিকে মুখ ফিরাইয়া ধরেন এবং আস্তে আস্তে পিট চাপড়াইয়া, মিষ্ট কথা কহিয়া, তাহাকে শান্ত করেন। অলিকসন্দর নির্ভয়ে লাফাইয়া ঘোড়ার উপর দৃঢ়ভাবে উপবেশন করিয়া অতি দ্রুতবেগে ঘোড়াকে দৌড় করান। ফিলিপ প্রভৃতি প্রথমে অত্যন্ত ভীত হইয়াছিলেন, তারপর যখন নির্ব্বিঘ্নে বালক প্রত্যাগমন করিল তখন সকলের আহ্লাদের সীমা রহিল না। ফিলিপ সাশ্রুনয়নে পুত্ত্রকে আলিঙ্গন করিয়া বলেন “পুত্ত্র তুমি স্বতন্ত্র রাজ্য সংস্থাপন কর মাসিদন তোমার পক্ষে অত্যন্ত ক্ষুদ্র।” অলিকসন্দরের এই ঘোড়ার নাম বুকেফেলস বা বৃষ-শীর্ষ। এই ঘোড়ায় চড়িয়া অলিকসন্দর বহুযুদ্ধে জয়লাভ করেন। এই ঘোড়ার সাহায্যে তাঁহার প্রাণ অনেকবার রক্ষিত হইয়াছিল। অবশেষে এই ঘোড়া আমাদের দেশে পঞ্চত্ব লাভ করে। প্লুটার্ক বলেন এই ঘটনার পর ফিলিপ পুত্রকে এরিষ্টটেলের হস্তে বিদ্যা শিক্ষার জন্য সমর্পণ করেন।

 এরিষ্টটেল, রাজধানীর কোলাহল বিবর্জ্জিত স্বীয় জন্মভূমি ষ্ট্যাগিরা নামক গ্রামে, নিয়ার্কস, তূরময় প্রভৃতির সহিত আলিকসন্দরকে নানা বিষয়িনী শিক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন। এ স্থানে তিনি চার বৎসর অধ্যয়ণ করিয়াছিলেন।

 অধ্যয়ন সাঙ্গ হইবার পূর্ব্বেই, সময় সময় অলিকসন্দরকে, পিতার অনুপস্থিতকালে রাজকার্য্য পরিদর্শন করিতে হইত। অলিকসন্দরের ষোড়শ বৎসর বয়ক্রমের সময় ফিলিফ ব্যাজণ্টাইন (বর্ত্তমান কনিষ্টাণ্টনোপল) প্রদেশে যুদ্ধ করিতে গমন করেন। পিতার অনুপস্থিত কালে পুত্র রাজ্য রক্ষক নিযুক্ত হইলেন। ৩৩৯ খৃঃ পূঃ অব্দে বালক অলিকসন্দর, শত্রু সংহার করিবার জন্য সর্ব্ব প্রথম অস্ত্রগ্রহণ করেন বলিয়া ইহা ঐতিহাসিকদিগের কাছে বিশেষরূপে স্মরণীয়, হইয়াছে। ফিলিপ দূরতর প্রদেশ যুদ্ধে নিযুক্ত রহিয়াছেন দেখিয়া ইলিরিয়ার অধিবাসীবৃন্দ তাঁহার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। বিদ্রোহীরা মনে করিয়াছিল এ সময় ফিলিপ ও তাঁহার রণনিপুন সেনানীগণ কেহই পেলাতে উপস্থিত নাই, এসময় যুদ্ধ আরম্ভ করিলে তাহারা নিশ্চয়ই বিজয় লাভ করিবে, কিন্তু তাহাদের আশা পূর্ণ হইল না—অলিকসন্দর বিদ্রোহের কথা শ্রবণ করিবামাত্র একদল সৈন্য লইয়া তাহাদের বিরুদ্ধে যাত্রা করেন। তাঁহার এই হাতেখড়ি— অসিধারণের দিনে বিজয় শ্রী তাঁহার অঙ্কগতা হন। শত্রুগণকে তিনি সম্পূর্ণরূপে পরাজয় করিলেন, তাহাদের গ্রাম ও নগর তাঁহার ক্রোধবহ্নি হইতে রক্ষা পাইল না। বিদ্রোহীরা সমুচিত শিক্ষাপ্রাপ্ত হইল। অলিকসন্দর তাঁহার এই বিজয়ের স্মৃতিস্বরূপ এস্থানে একটি নগর স্থাপন করেন, ইহার নাম হইল আলেকজেণ্ডার পলিস বা আলেকজেণ্ড’রপূর।

 যুদ্ধস্থল হইতে প্রত্যাগমন করিয়া, বালক আবার রাজকার্য্যের ভারগ্রহণ করিলেন। এই সময় পারস্যপতির দূত পেলাতে উপস্থিত হন। অলিকসন্দর কিছুতেই পশ্চাৎপদ হইবার পাত্র নহেন, তিনি দূতকে যথোচিৎ সম্ভ্রমের সহিত দরবার মধ্যে গ্রহণ করিলেন। প্রবীণের ন্যায় আলাপ পরিচয় করিলেন—ইহাতে বালকত্বের লেশমাত্রও প্রকাশ পাইল না। তিনি পারস্যপতির স্বভাবচরিত্র, তাঁহার সৈন্যবল, শত্রুর সহিত তিনি কিরূপ ব্যবহার করেন—সে প্রদেশের রাস্তাঘাট ও তাহার দূরত্ব বিষয়ক নানা প্রকার প্রশ্ন করিয়া সকলকে মুগ্ধ করিয়াছিলেন। এই সকল প্রশ্ন দেখিয়া অনেকে এই সময় হইতে অলিকসন্দরের হৃদয়ে এসিয়া বিজয় বাসনা অঙ্কুরিত হইয়াছিল কল্পনা করিয়া থাকেন।

 ফিলিপের বাহুবলের দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়াতে, এথেন্সবাসীর হৃদয়ে উদ্বেগের লক্ষণ সকল ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয়। ইহার সহিত ডিমস্থেনিস প্রমুখ বক্তাগণের ফিলিপের বিরুদ্ধে অনলবর্ষি বক্তৃতায় এথেন্সবাসী অত্যন্ত উত্তেজিত হয়। এই সময় ফিলিপ, ইলেতিয়া নামক একটি ক্ষুদ্র নগর অধিকার করিয়া তাঁহার সেনানিবাস গড়বন্দি করিয়া সুরক্ষিত করেন। ইলেতিয়া, এথেন্স রাজ্যের সীমান্ত প্রদেশ হইতে প্রায় তিরিস এবং এথেন্স, নগর হইতে প্রায় ৪৫ ক্রোশ দূর। ফিলিপের ইলেতিয়া অধিকার সংবাদ এথেন্সে আনীত হইলে—এথেনীয়নরা অত্যন্ত শঙ্কিত হন, তাঁহারা ফিলিপের এথেনীয় রাজ্য আক্রমণের দুরভিসন্ধি কল্পনা করিতে লাগিলেন। ডিমস্থিনিসের দল বৃদ্ধি পাইতে লাগিল যুদ্ধের জন্য সকলেই উৎসুক হইল। দলে পরিপুষ্ট হইবার জন্য ডিমস্থিনিস, থেবে গমন করিলেন, থেববাসীরা প্রথমে ডিমস্থিনিসের কথায় কান দেয় নাই, ধীরে ধীরে তাঁহার কথায় মুগ্ধ হইয়া ফিলিপের বিরুদ্ধে তাহারা এথেন্সবাসীর সহিত মিলিত হয়। ডিমস্থিনিস এ সময়ে জনসাধারণের হৃদয়রাজ্যের অধিশ্বর স্বরূপ হন, তাঁহার কথায় কি থেব, কি এথেন্সবাসী, সকলেই পরিচালিত হইতে ছিল—যে থেববাসী ইতিপূর্ব্বে ফিলিপের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিল তাহারা এক্ষণে বক্তার কথায় মুগ্ধ হইয়া, তাঁহার বিরুদ্ধাচরণে প্রবৃত্ত হইল।

 চ্যারোনিয়াক্ষেত্রে গ্রীসের বাহুবলের পরীক্ষা হইল। এক দিকে ফিলিপ অপর দিকে থেব—এথেন্স প্রভৃতি, এক্ষেত্রে যদি গ্রীস জয়যুক্ত হইতেন তাহা হইলে সম্ভবতঃ অলিকসন্দরের ভাবী দিগ্‌বিজয় আদি ঘটনা হইত কি না, সে বিষয় সন্দেহ হইয়া থাকে। এজন্য এই যুদ্ধকে অনেকে পৃথিবীর একটি প্রধান যুদ্ধ বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকেন। এ যুদ্ধে ফিলিপের সহিত তিরিস হাজার উৎকৃষ্ট পদাতিক এবং দুইহাজার অশ্বারোহীসেনা আগমন করিয়াছিল। সন্মিলিত গ্রীক সেনা ও উক্ত সংখ্যার সুমতুল্যই ছিল। সম সংখ্যক হইলেও গ্রীক সেনা, ফিলিপ সেনার ন্যায় সমরনিপুন বা ক্লেশ-সহিষ্ণু ছিল না। গ্রীক সেনার অধিকাংশ ভাড়াটে এবং সখের নাগরিক সেনা—ডিমস্থিনিস ও স্বদেশের গৌরব রক্ষার জন্য যুদ্ধ করিতে গমন করিয়াছিলেন। বক্তৃতাকালে তিনি যেরূপ তেজস্বিতা ও নির্ভিকতা দেখাইতেন, যুদ্ধকালে তিনি তাহার সম্পূর্ণ বিপরীতভাব দেখাইয়াছিলেন—তিনি সর্ব্বপ্রথমে রণে ভঙ্গ দিয়া অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া কাপুরুষের ন্যায় পলায়ন করিয়াছিলেন। এই ঘোরতর যুদ্ধে গ্রীকগণ অকাতরে যুদ্ধ করিলেও বিজয় লক্ষ্মী ফিলিপের অঙ্কগতা হন। অলিকসন্দর এই যুদ্ধে যথেষ্ট বীরত্ব দেখাইয়াছিলেন। গ্রীকবাসীর পরাজয়ের সহিত ফিলিপের উচ্চ আশার দ্বার অনর্গল হইল, এথেন্স ও থেবের দর্পচূর্ণ হইল, কাযেই আর কেই ফিলিপের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে সাহসী হইল না। সম্ভবতঃ ৩৩৮ খৃঃপূঃ ভাদ্র মাসে এই যুদ্ধ হইয়াছিল।

 এই যুদ্ধে প্রায় তিন হাজার এথেন্সবাসী এবং প্রায় এতগুলি থেরবাসী নিহত বা বন্দী হইয়াছিল। এই তিন হাজার বা ছয় হাজার লোকের অভাবে গ্রীসবাসী একেবারে হীনবীর্য্য হইয়া পড়িল। ইহা বড়ই আশ্চর্য্যের কথা, সে সময়ের এথেন্সবাসী লিখিতে, পড়িতে, বক্তৃতা, করিতে বা ভাস্কর কার্য্যে, অথবা সভ্যতা ভব্যতা সকল বিষয়েই মেসিদনবাসী অপেক্ষা অনেক অংশে শ্রেষ্ঠ ছিল। এ শ্রেষ্ঠতা তাহাদিগের সন্মান রক্ষা করিতে সমর্থ হয় নাই—এ শ্রেষ্ঠতার সহিত যদি তাহাদিগের বাহুবলের বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইত, তাহা হইলে আর তাহাদিগকে অসভ্য মাসিদুনিয়ার হস্তে লাঞ্ছিত হইতে হইত না।

 এরূপ কথিত আছে যে এই যুদ্ধের পর ফিলিপ পক্ষীয় যে সকল লোক সন্ধিসংস্থাপনের জন্য এথেন্সে গমন করিয়াছিলেন, তাহাদের সহিত অলিকসন্দ ও গমন করিয়াছিলেন। ইহাতে অলিকসন্দরের জ্ঞানের সীমা অনেকটা বৃদ্ধি পাইয়াছিল সে বিষয় সন্দেহ নাই। ফিলিপ, পুত্রের প্রতিভা দেখিয়া যথেষ্ট আনন্দিত হইলেন। জনসাধারণ পুত্রকে “রাজা” এবং পিতাকে “সেনানী” বলিয়া সম্বোধন করিত। পূত্র সাধারণের প্রীতির পাত্র হইয়াছে দেখিয়া, পিতার আনন্দের সীমা থাকিত না। পিতাকে কিন্তু এ আনন্দ বড় বেশীদিন ভোগ করিতে হয় নাই।

 স্পার্টাব্যতীত সমগ্র গ্রীস এখন ফিলিপের অধীনতা স্বীকার করিল। স্পার্টা অধীনতা স্বীকার না করিলেও তাহার এরূপ ক্ষমতা ছিল না যে, সে ফিলিপের বিরুদ্ধাচরণ করিতে সমর্থ হয়। চ্যারোনিয়া যুদ্ধের প্রায় একবৎসর পরে কোরিন্থ নগরে এক মহাসভার অধিবেশন হয়। স্পার্টা ব্যতীত সমগ্র গ্রীসের প্রতিনিধিবর্গ এই সভায় ফিলিপকে পারস্যপতির বিরুদ্ধে সেনানীপ্রধান পদে নিযুক্ত করেন। এই সভা অধিবেশনের এক বৎসর পরে, আমাদের এসিয়ার বিরুদ্ধে ফিলিপ যাত্রা করিবেন, এইরূপ স্থির হইল। সকল দেশই নিজের নিজের সামর্থ অনুসারে ধন বল ও জনবল দিয়া সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন।

 মানুষ বিভিন্ন মতাবলম্বী হইলেও, সাধারণ বিপদ ও সম্পদ কিন্তু অনেক সময় তাহাকে এক মতাবলম্বী করিয়া থাকে। সে সময়, সকলে একচিত্ত হইয়া বিপদ দূর, বা সম্পদ সাধনের চেষ্টা করিয়া থাকে। সম্ভবতঃ ফিলিপ ও মনে করিয়া থাকিবেন যে, বর্ত্তমানে তিনি বিভিন্ন প্রকৃতির গ্রীসবাসীর হৃদয়ের সহানুভূতি না পাইলেও কালে সর্ব্বদা একত্র অবস্থান, এবং সাধারণ বিপদ ও সম্পদে সকলে সুখী ও দুঃখী হইতে শিখিয়া তাহারা তখন তাঁহার প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করিতে বাধ্য হইবে।

 মানুষ সংসার ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্য লাভ করিলে, অনেক সময় তাহার বুদ্ধি ভ্রংশ হইয়া থাকে, নিজের পূর্ব্ব অবস্থা ভুলিয়া যায়—নিজের উপর তাহার একটা ভ্রম বিশ্বাস উৎপন্ন হইয়া থাকে। গ্রীসের উপর অনন্য সাধারণ বিজয় লাভের সহিত ফিলিপের মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়াছিল। তাঁহার বিবাহিতা স্ত্রী এবং বহু সংখ্যক উপপত্নী বর্ত্তমাণ থাকিলেও, তিনি এসময় দার সংগ্রহ করিতে বিরত হন নাই। এক দিকে এসিয়া বিদারণের জন্য অস্ত্র শস্ত্র সংগ্রহ হইতেছিল, অপরদিকে তাঁহার শরীর বিদারণের কারণ স্বরূপ দার সংগ্রহ বাস্তবিকই অপূর্ব্ব হইয়াছিল। আলোকের নিচে যেরূপ অন্ধকার স্থান লাভ করে সেইরূপ ধনবানদের কাছে এক প্রকার নিকৃষ্ট জীব আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকে। ফিলিপের কাছেও এই সকল জীবেরা আশ্রয় লাভে বঞ্চিত হয় নাই। ফিলিপের বিবাহ, তাহারা সমর্থন করিল এবং এই স্ত্রীর গর্ভের সন্তান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলিয়া তাহারা ঘোষণা করিতে লাগিল। ইহার সহিত ফিলিপও যোগ দিলেন, তিনি সকলের সমক্ষে আলিকসন্দরের জননীকে ব্যাভিচারিণী, পুত্রকে জারজ, ইত্যাদি শব্দে অভিহিত করিতে লাগিলেন। ইহার ফল ফলিল, পিতা পুত্রে, স্বামী স্ত্রীতে বিষম বিরোধ উপস্থিত হইল। একদিন মদ্যপান কালে, একজন পারিষদ বলিল, এইবার এই রাণীর গর্ভে যে পুত্র জন্ম গ্রহণ করিবে, সে এই সিংহাসনে উপবেশন করিবে। এই শব্দ অলিকসন্দরের কর্ণ কুহরে প্রবেশ করিলে, তিনি বলিলেন “তবে আমি কি জারজ” এই কথা বলিয়া তিনি মদিরা পাত্র বক্তার মুখে নিক্ষেপ করেন। মদ্যপানে বিহ্বল ক্রোধোন্মত্ত ফিলিপ এই দৃশ্য দেখিয়া পুত্ত্রকে হত্যা করিবার জন্য যে সময় কোষমুক্ত অসিহস্তে “টেবিল” অতিক্রমণ করিবেন, সে সময় তাঁহার পদস্খলন হওয়াতে পড়িয়া যান। আলিকসন্দর পিতাকে পড়িয়া যাইতে দেখিয়া সমবেত বক্তিবর্গকে সম্বোধন করিয়া বলেন, “দেখুন যিনি ও টেবিল হইতে এ টেবিলে না পড়িয়া আসিতে পারেন না, তিনিই আবার সরিৎ-সাগর-শৈল-সঙ্কুল ইয়ুরোপ হইতে এসিয়াতে গমন করিবার জন্য প্রস্তুত হইতেছেন! “এই ঘটনার পর রাজনীতে অবস্থান করা আলিকসন্দর যুক্তি যুক্ত বিবেচনা করিলেন না। তিনি তাঁহার জননী সহ স্থানান্তরে গমন করিলেন। স্থানান্তরে অবস্থান করিলেও বিবাদের হ্রাস হইল না বরং দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ফিলিপের গৃহ-কলহের কথা সর্ব্বত্র প্রচারিত হইল। ফিলিপ কর্ত্তৃক আলিকসন্দরের সহচর ও বন্ধুগণ নিগৃহীত হইতে লাগিল, ফিলিপের গৃহ অশান্তি পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল।

 এই সময় একজন সন্ত্রান্ত গ্রীক ফিলিপের আতিথ্য গ্রহণ করেন। একদিন নানা কথার পর ফিলিপ তাঁহাকে গ্রীসের শান্তির কথা জিজ্ঞাসা করেন। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন যিনি নিজের গৃহ অশান্তি পরিপূর্ণ করিয়াছেন, গ্রীসের শান্তির কথা জিজ্ঞাসা করিতে তিনি অধিকারী বটে?” গ্রীক পণ্ডিতের এই তীব্র তিরস্কারে ফিলিপ লজ্জিত হন এবং পুত্র কলত্রের সহিত যাহাতে পুনরায় মিলন হয়, সে জন্য তিনি তাঁহাকে মধ্যস্থ হইতে অনুরোধ করেন। ইঁহার মধ্যস্থতায় স্ত্রী পুত্রের সহিত মিলন হইল বটে কিন্তু অন্তরের মিলন হইল না, বিবাদের কারণ দূর না হওয়াতে এ মিলন স্থায়ী হইল না।

 ফিলিপের হৃদয়ের দুর্ব্বলতার সহিত তাঁহার নূতন স্ত্রী ও তাহার পরিজনবর্গের ক্ষমতা বিশেষ রূপে বৃদ্ধি পাইয়া ছিল। তাহারা ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়া সকলের যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হইয়াছিল। ইহাদের আজ্ঞানুসারে পউসেনিয়স নামক এক ব্যক্তি বিশেষ রূপে নিগৃহীত হয়। সে এই অবমাননার বিচারপ্রার্থী হইয়া ফিলিফের নিকট গমন করে। এই দিন রাজবাটিতে বিশেষ উৎসব ছিল। ফিলিপের কন্যার বিবাহ—এবং এসিয়া বিজয়ে গমন উপলক্ষে এই উৎসবের মাত্রা খুব বাড়িয়া গিয়াছিল। ফিলিপ, নাটক অভিনয় দেখিতে যাইবার সময় পউসেনিয়স কর্ত্তৃক নিহত হন। ইহার সহিত আরো কএকজন লোক ছিল, তাহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ ফিলিপের রক্ষীগণ কর্ত্তৃক নিহত হন। ফিলিপের জীবন নাটকের অভিনয় এইরূপে শেষ হয়। এই অভিনয়ে, ফিলিপের সহধর্ম্মিণী অলিমফিয়া এবং দিগ্বিজয়ী পুত্র অলিকসন্দর বিশেষরূপে লিপ্ত ছিলেন বলিয়া সে কালের লোকেরা কীর্ত্তন করিয়াছেন।

 ফিলিপ, সমস্ত গ্রীস বাসীকে একমতাবলম্বী করিয়া স্বয়ং তাহাদিগের সেনানী প্রধান হইয়া পারস্য পতির বিরুদ্ধে গমন করিবেন ইত্যাদি কত স্বপ্নই দেখিয়া ছিলেন, শ্রীভগবান কিন্তু ঘাতকের শানিত অস্ত্রে ৪৬ বৎসর বয়ক্রমের সময় তাঁহার সে স্বপ্ন ভাঙ্গিয়াদেন।

 ফিলিপের যতই কেন দোষ থাকুক না, তিনি জাতীয় শত্রু পারস্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকৃতির সমস্ত গ্রীসবাসীকে এক করিয়াছিলেন, তিনি পারসীক মোহ দূর করিয়া জাতীয় গৌরব বৃদ্ধির জন্য—সমস্ত গ্রীস বাসীকে সম্মিলিত করিয়াছিলেন, ইহা তাঁহার পক্ষে সামান্য প্রশংসার কথা নহে। মোহ দূর হইলে, অজ্ঞান আর ভয় দেখাইতে সমর্থ হয় না। কিছু দিন পূর্ব্বে যে গ্রীসবাসী পারস্যে লোকবল ও ধন বল দেখিয়া বিভীষিকাগ্রস্ত হইত, সেই গ্রীসবাসী এক্ষণে উপযুক্ত ব্যক্তির নেতৃত্বে পারস্য জয়ের কল্পনা কার্য্যে পরিণত করিতে সচেষ্ট হইল।

 যে দেশের রমণী পতির মৃত্যুর পর অগ্নি-প্রবেশ করিয়া পতির অনুগমন করে, যে দেশের অবলা কঠোর বৈধব্যব্রত অবলম্বন করিয়া পতি দেবতার পূজা করিয়া থাকে। যে দেশের লোক পিতার তৃপ্তির জন্য রাজ ঐশ্বর্য্য পরিত্যাগ করিয়া আজীবন ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন করে, যে দেশবাসী পিতার আদেশ পরিপালন জন্য সহাস্য বদনে বনে গমন করে, যে দেশের পুত্ত্র পিতার সন্তোষের জন্য অবিকৃত বদনে দুঃখময় জরাকে গ্রহণ করিয়া থাকে, যে দেশের জনগণ, পিতাপরিতুষ্ট হইলে সমস্ত দেবতা তুষ্ট হইবে বিবেচনা করিয়া যাঁহার সেবা করিয়া থাকে, সে দেশের লোকের কাছে ওলিম্‌ফিয়া বা অলিকসন্দরের এই পাপ কথা ঘৃণার সহিত পঠিত হইবে সে কথা বলাই বাহুল্য।


  1. Events are occuring in the Far East which deserve the most attentive estimation of Europe, and a prudent recollection of that mighty Oriental torrent which once overran Russia and conquered Christaian lands up to the borders of Austria and Italy. We are too apt to dispise unaggrassive, unwarlike, agricultural people, spread over a wide territory, who, however, on suflicient provocation, can, with training and expert leaders, become as dashing as the French under Napoleon, as well—ordered and stubborn as the Ironsides of Cromwell. There is a power in the East which, compellcd by Western aggression, as foolish as it is unjust, on its territory, may in days to come rouse itself into expansive energy, and surpass the irruption of Strength and intelligence will be the Chief Tactors, snb divo, in establishing the nation of the future upon a basis as secure as may be,
    Hon. R. Russell.
  2. এরিষ্টটেল কিছুদিন আতারনিয়ার অধিপতি হারমিয়াসের কাছে অবস্থান করেন। এরূপ কথিত হয় যে পারস্যপতি আরতাজেরেকসাস ইহাকে অন্যায় পূর্ব্বক হত্যা করেন।