বিষয়বস্তুতে চলুন

ভারত দীধিতি

উইকিসংকলন থেকে

ভারত দীধিতি

ভারত দীধিতি।

শ্রীদীননাথ দাস চন্দ প্রণীত।

“চলচ্চিত্তং চলদ্বিত্তং চলজ্জীবনযৌবনম্‌’
চলাচলমিদং সর্ব্ব কীর্ত্তির্যস্য স জীবতি
যশঃ কীর্ত্তি পরিভ্রষ্টো জীবন্নপি ন জীবতি।”

কলিকাতা

বাল্মিকী যন্ত্রে

শ্রীকালীকিঙ্কর চক্রবত্তি কর্তৃক

প্রকাশিত।

শকাব্দা ১৮০০।

ভক্তি উপহার।

অশেষ গুণালঙ্কত পরম শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীল
শ্রীযুক্ত রায় রাজীব লোচন রায়।
বাহাদুর মহোদয়ের করকমলে।

এই গ্রন্থ অর্পিত হইল॥

 গুণনিধি।—

 আমি আপনার নিকট আমার বিদ্যার পরিচয় ও দিই নাই বা বুদ্ধির পরিচয়ও দিই নাই এবং আমার কবিত্যের পরিচয় ও দিই নাই শুদ্ধ এই প্রত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান মনোহারিণী ঘটনাটী মাত্রই পরিচয় দিয়াছি। এবং একথা বিলক্ষণ সাহস করিয়াই বলিতে পারি যে আমার বর্ণিত বিষয়টী অলীক বা ভ্রান্তিমূলক বলিয়া কেহই দোষারোপ বা অনাদর করিতে পারিবেন না। রচনার যে যে স্থানে দোষ দৃষ্ট হইবে স্বীয় গুণে সংশোধন ও মার্জনা করিয়া লইবেন। আর আমি বেসী কথা জানি না ও বেসী অলঙ্কারও জানি না এবং আপনার পক্ষে এমন কোন বেসী কথা বা বেসী অলঙ্কারও দেখি না যে সেই কথাতে আপনাকে সন্তুষ্ট বা সেই অলঙ্কারে আপনাকে অলংকৃত করি এস্থলে ভবাদৃশ মহাত্মা গণের নিকট মদ্বিশ ক্ষুদ্র জনের বেসী বাগ্‌জাল বিস্তার করা কেবল বাচালতা ও চাপল্যতা প্রকাশ মাত্র। অতএব আমার এই ক্ষুদ্র গ্রন্থ খানি আপনি অনুগ্রহ পূর্ব্বক একবার মাত্র আদ্যোপান্ত পাঠ করিলেই আমার সমুদয় শ্রম সফল ও সার্থক হইবে জানিয়া এই (ভারত দিধিতি) আপনার হস্তে সমর্পণ করিলাম, এখন জঘন্য বলিয়া নির্ব্বাণই করুণ বা মন্দ নয় বলিয়া উজ্জ্বলই করুণ ইতি।

২৫শে ভাদ্র
একান্ত বসম্বদ
১২৮৫।
শ্রীদীননাথ দাস চন্দ।

 একদিন আষাঢ় মাসে দুঃসহ গ্রীষ্মাতিশয় প্রযুক্ত রজনীতে গৃহের অভ্যন্তরে নিদ্রা না হওয়াতে আমি বহিঃস্থিত এক তরুতলে আপন উত্তরীয় বসন বিস্তার করত ও তাহাতে অঙ্গ নিক্ষেপ করিয়া গগনোদিত নক্ষত্রমালার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া রহিয়াছি, ইত্যবসরে মন্দ মন্দ শীতল সমীরণ সুধাবৃষ্টির ন্যায় গাত্রে লাগাতে ক্রমে সকল সন্তাপহারিণী নিদ্রাদেবী আসিয়া একেবারে আমার নেত্রোপরি আবির্ভূতা হইলেন। তখন গভীর নিদ্রায় অচেতন ও অভিভূত হইয়া স্বপ্নে দেখিতেছি যেন জগৎপাতা জগদীশ্বরের অত্যাশ্চর্য্য অনির্ব্বচনীয় মহিমা ও বিচিত্র মনোহর কীর্ত্তি সমুদয় অবলোকন মানসে আমি বৰ্দ্ধমান, বৈদ্যনাথ প্রভৃতি নানা স্থান পরিভ্রমণ করত পরিশেষে সুবিশাল বিন্ধ্যাচলে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম পর্ব্বত পূর্ব্ব ও পশ্চিম দিকে ক্রমশঃ বিস্তীর্ণ হইয়া ভারতবর্ষকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া ঈশ্বরের অলৌকিক কার্য্যেরই পরিচয় দিতেছে। পর্ব্বতের মধ্য ও উপরি ভাগে বিচিত্র মনোহর তরু ও লতাকুঞ্জ আছে এবং মধ্যে মধ্যে নানা বর্ণের পরম রমণীয় মসৃণ শিলা সকল পতিত রহিয়াছে এবং নিম্নস্থ চতুর্দ্দিকের মাঠ সকল ধূ ধূ করিতেছে। হঠাৎ বোধ হয় কোথায় আইলাম, একে আষাঢ়ান্ত বেলা তাহাতে আবার সমস্ত দিন অনাহার, শরীর নিতান্ত ক্লান্ত ও ঘর্ম্মাক্ত হইয়াছে, চরণ আর চলে না, তখন অনতিদূরস্থিত এক অসভ্য পর্ব্বতবাসীর কুটীর হইতে তৎসময়োচিত যৎকিঞ্চিৎ ফল মূল ভক্ষণ ও জল পান করিয়া কথঞ্চিৎ সুস্থ হইলাম। দেখিলাম দিবা অবসান প্রায়, দুই এক দণ্ড বেলা আছে মাত্র। ভগবান দিন-মণি-অস্তাচলের উন্নত চূড়া অন্বেষণ করিতেছেন, মহিষ ও গাভী প্রভৃতি পশুগণ কবল পরিত্যাগ করত ঊর্দ্ধ মুখে গ্রামের দিকে ধাবমান হইতেছে। পক্ষিগণ কলরব পূর্ব্বক শ্রেণীবদ্ধ হইয়া আপন আপন অভিমত নীড় প্রদেশে গমন করিতেছে। এবং ক্রমে সন্ধ্যা-সমীরণে বৃক্ষ সকল সঞ্চালিত হইয়া স্বভাবের পরম শোভা সম্পাদন করিতে লাগিল। সেই সময় বলবতী ইচ্ছার সুশাসনের বশবর্ত্তী হইয়া আমার কৌতূহল ক্রমশঃ এইরূপ প্রবল হইয়া উঠিল যে তাহা কোন ক্রমেই সংযম করা নিতান্ত অসাধ্য বোধ হইল। তখন নিতান্ত দর্শনলোলুপ হইয়া হিতাহিত বা দিকবিদিক্‌ বিবেচনা না করিয়া দুরারোহ উন্নত ও বিস্তৃত সেই বিন্ধ্য গিরির উপরে আরোহণ করিলাম। আরোহণ করিয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ ও পরিদর্শন করিতে করিতে পরম কারুণিক পরমেশ্বরের অত্যাশ্চর্য্য বাক্‌পথাতীত কীর্ত্তি সমুদয় অবলোকনান্তর তাঁহাকে অন্তরের সহিত ধন্যবাদ দিতেছি এমন সময়ে সহসা অন্ধকার আসিয়া একেবারে জগৎ আচ্ছন্ন করিল। চতুর্দ্দিক অন্ধকার, আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না, চারিদিকে ব্যাঘ্র ভল্লুক গণ্ডার প্রভৃতি ভীষণাকার হিংস্র জন্তুগণের ভয়ঙ্কর চীৎকার শব্দে আমার গাত্রের শোণিত শুষ্ক হইয়া গেল ও ভয়ে কলেবর কাঁপিতে লাগিল। তখন মনে মনে বিবেচনা করিলাম কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি। এইরূপ বিপদস্থ হইব পূর্ব্বে ইহা কিছুমাত্র বিবেচনা হয় নাই। আপনি কুকর্ম্ম করিয়াছি কে তাহার ফল ভোগ করিবে, জগদীশ্বরের মনে যাহা আছে তাহাই হইবেক। একে সেই নিবিড় গাঢ় অন্ধকারময় নিশা, তাহাতে আবার পর্ব্বত প্রদেশ, সঙ্গে দ্বিতীয় ব্যক্তি কেহ নাই যে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া কোন পরামর্শ স্থির করি। যাহা হউক, যে পথ দিয়া পর্ব্বতে আরোহণ করিয়াছি সেই পথ দিয়া পুনরায় গমন করিলে নিম্নে যাইতে পারিব ও লোকালয় পাইব ঐ স্থির করিয়া সেই দিকেই গমন করিতে লাগিলাম। অন্ধকারে কোন দিক্‌ নির্ণয় ও লক্ষ্য স্থির করিতে পারিয়া যাইতে যাইতে সম্মুখে এক খণ্ড উন্নত মসৃণ প্রস্তর ছিল তাহাতে আঘাত লাগিয়া তথা হইতে এককালে নিম্নে পতিত হইলাম, পতিত হইবামাত্র মূর্চ্ছা আমার চৈতন্য হরণ করিল। তখন মূর্চ্ছা দ্বারা আক্রান্ত ও অভিভূত হইয়া দেখিলাম, চতুর্দ্দিক্‌ অন্ধকারময় ও সমগ্র ভারত আলোকশূন্য এবং শ্মশানপ্রায়; বোধ হইল যেন ভারত এককালে নিষ্প্রদীপ হইয়া রসাতলে যাইতেছে। তদনন্তর কোথায় যাই কি করি কিছুই দেখিতে পাই না ও বুঝিতে পারি না। অন্ধকারে কোন পথ দেখিতে না পাইয়া যাইতে যাইতে কখন সম্মুখে ভগ্নাবশেষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রস্তর খণ্ডের উপর ও কখন বা পার্শ্বে অতীব কণ্টকাকীর্ণ তরুরাজির উপর পতিত হইতে লাগিলাম। শরীর সর্ব্বদা আঘাতিত ও ক্ষত বিক্ষত হইয়া গাত্র হইতে বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়িতে লাগিল। সে সময় ক্ষণেক ক্ষণেক মরণাধিক যন্ত্রণা অনুভব করিতে লাগিলাম। ক্ষুধায় জঠরানল জ্বলিতেছে ও তৃষ্ণায় বুক ফাটিয়া যাইতেছে। এমন কাহাকেও দেখিতে পাই না যে সে সময় এক বিন্দু বারি প্রদান করিয়া আমার প্রাণ রক্ষা করে। তখন ক্ষুধায় তৃষ্ণায় অধীর ও যন্ত্রণায় একেবারে জ্ঞান-শূন্য হইয়া চীৎকার পূর্ব্বক বলিতে লাগিলাম, আ কুলাঙ্গার ভারত সন্তানগণ! এই সোণার ভারত এককালে নিষ্প্রদীপ হইয়াছে তাহা তোমরা কিছুই দেখিতে পাইতেছ না। কি আশ্চর্য্য! এই ভারত জ্যোতিতে ও ভারত আলোকে স্থির দৃষ্টি হইয়া কত প্রকার অপরিচিত ও অজ্ঞাত দেশীয় লোক ভীষণ সাগর পার হইয়া নানাবিধ রত্ন সংগ্রহ করিয়াছে ও আপন আপন দেশ সমুদয়কে সমুজ্জ্বল ও আলোকিত করিয়াছে, তোমরা কি তাহা কিছুই জানিতেছ না। ধিক্‌! পামর ভারত সন্তানগণকে ধিক্‌! তখন এইরূপ ও অন্যরূপ কত প্রকার বলিতে লাগিলাম, সকল এক্ষণে স্মরণ হয় না। কিন্তু কাহাকে বলি, কে শুনে, সকলেই অন্ধ ও সকলেই বধির।

 অনন্তর ক্ষণকাল পরেই একটা হাহাকার ও করুণ রব শুনিতে পাইলাম। যেন সকলেই বলিতেছে উঃ প্রাণ যায় প্রাণ যায়। ক্ষুধায় প্রাণ গেল, কোথায় যাই কোথায় গেলে এ ক্ষুধার শান্তি হয়। এইরূপ বলিতেছে ও যে যাহা পাইতেছে অবিকৃত চিত্তে খাইতেছে, সকলি একাকার, খাদ্যাখাদ্যের কিছুই বিচার নাই, ব্রাহ্মণ শূদ্র চণ্ডাল যবন প্রভৃতির কিছুই বিশেষ নাই, কাহারো মনে ধর্ম্ম ভয় নাই, কোন ব্যক্তিরই সদাচারে প্রবৃত্তির লেশমাত্র নাই এবং এক জনেরও সৎকর্ম্মে মতি নাই। কেবল সুরাপানে সকলের চক্ষু সততই জবাবর্ণ ও সকলেই উন্মত্ত এবং সকলেই যথেচ্ছাচারী। সকলেরই আকার বিশ্রী বিবর্ণ ও শীর্ণ, হঠাৎ দেখিলে তাহাদিগকে পিশাচ বলিয়া ভয় হয়, অস্পৃশ্য ও অখাদ্য ভোজন ও অপেয় পান করিয়াও তাহাদিগের মহা ক্ষুধার শান্তি ও পিপাসার নিবৃত্তি হইতেছে না, কেবল অহরহঃ বলিতেছে, ক্ষুধায় প্রাণ যায় প্রাণ যায়। তখন নিতান্ত বিস্মিত হইয়া ভাবিলাম একি! ভারতসন্তানদের এই দুর্দ্দশা। হা বিধে! তোমার নির্ব্বন্ধ খণ্ডন করে কাহার সাধ্য। হা ঈশ্বর! তুমি সকলি করিতে পার। তুমি পর্ব্বতকে তৃণ করিতেছ ও তৃণকে পর্ব্বত করিতেছ, তোমার অসাধ্য কি আছে। যে ভারত আপন জ্যোতিতে সকল দেশকে জ্যোতির্ম্ময় করিয়াছে, যে ভারত আপন আলোকে সকল দেশকে আলোকিত করিয়াছে এবং যে ভারত আপন অন্নে জগৎস্থ সমুদয় দেশকে প্রতিপালন করিয়াছে সেই ভারত আজ জ্যোতিহীন ও অন্ধকারময় হইল এবং সেই ভারত সন্তানেরা আজ উদরের জ্বালায় অধীর ও ক্ষুধায় জ্ঞানশূন্য হইয়া দীন বেশে দ্বারে দ্বারে ও পথে পথে ভ্রমণ করিতেছে। কি আশ্চর্য্য! অনন্তর কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া পরে ভাবিলাম ভাল, সকল দুঃখবিনাশিনী ভারত-অধিষ্ঠাত্রী ভগবতী লক্ষ্মী দেবী এক্ষণে কোথায়, তিনি থাকিলে ত এরূপ কখনই হইত না। এবং তৎ-সপত্নী অজ্ঞাননাশিনী মহামতি বাক্‌বাণী সরস্বতীই বা কোথায় রহিলেন, তিনি থাকিলে ত কেহই অজ্ঞানান্ধ হইয়া কর্ত্তব্য কর্ম্মে পরাঙ্মুখ হইত না। এবং উভয় সপত্নীর হৃদয়বাসী ও আনন্দপ্রদাতা এবং জগতের একমাত্র উপায় ভগবান ধর্ম্মই বা কোথায় গেলেন, তিনি থাকিলে ত সকলই থাকিত কিছুরই অভাব হইত না। শুনিয়াছি লক্ষ্মী সাগরপারে গিয়া বসবাস করিবেন এই অভিলাষ করিয়া ও কৃতসংকল্পা হইয়া তিনি আজ এক শত বৎসরের অধিক হইল আয়োজন করিতেছিলেন। বোধ করি তাঁহার সেই অভিলাষ এত দিনে পূর্ণ হইয়া থাকিবেক। আর সরস্বতী বাল্মীকি বেদব্যাস কালিদাস প্রভৃতি মহা মহা গুণনিধি সন্তানগণের শোকে শবাকার ও শয্যাগত হইয়াছিলেন। তাহার পর তিনি এক্ষণে তাঁহাদিগের সেই দুঃখে আত্ম সমর্পণ করিলেন কি দেশান্তরে গেলেন কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। ভগবান ধর্ম্ম পূর্ব্বে রামচন্দ্র যুধিষ্ঠির প্রভৃতি প্রাণাধিক প্রিয়তম পুত্রগণের শোকে নিতান্ত কাতর ও একান্ত অধৈর্য্য এবং হতচেতন হইয়া যার পর নাই দুঃখে দিন যাপন করিতেছিলেন, তাহার পর আবার এক্ষণে উভয় জায়ার বিয়োগ শোকে যার পর নাই কাতর ও এককালে বিহ্বল হইয়া বোধ হয় অন্তর্হিত হইয়াছেন। এতদ্ভিন্ন আর কি বিবেচনা হইতে পারে, ইত্যাদি অনেক রূপ ভাবিতেছি এমন সময়ে দেখিলাম কিঞ্চিৎ উত্তর—পশ্চিম দিকে ও অনতি দূরে এক নিবিড় বন, সেই বনের অভ্যন্তরে হঠাৎ একটা আলোক দৃষ্টিগোচর হইল এবং অল্প বোধ হইল যেন তথায় একটা স্ত্রীলোক শয়ন করিয়া আছেন আর দুইটী স্ত্রীলোক তাঁহার উভয় পার্শ্বে বসিয়া আছেন। গাঢ় অন্ধকার মধ্যে সহসা আলোক দেখিয়া আমার অন্তঃকরণ যার পর নাই আহ্লাদে পুলকিত ও একেবারে সুখময় হ্রদে ও অমৃতময় সরোবরে অভিষিক্ত হইল। তখন স্ত্রীলোক তিনটী কে, কি নিমিত্তই বা দীন ও মলিন বেশে এবং বিষণ্ণ চিত্তে ঐ নিবিড় অরণ্যানীতে এই ভয়ঙ্কর অন্ধকারময়ী যামিনী যাপন করিতেছেন এবং কেনই বা দিব্য আশ্রম পরিত্যাগ করিয়াছেন ইহার আদ্যোপান্ত সমুদয় কারণ জানিবার নিমিত্ত ক্রমে ক্রমে তাঁহাদিগের নিকটবর্ত্তী হইলাম। নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখিলাম, শীর্ণকায়া অতি মলিন বেশা একটী স্ত্রীলোক ধরায় অঞ্চল পাতিয়া শয়ন করিয়া আছেন, শরীর স্পন্দহীন ও কান্তি শূন্য এবং দুই চক্ষু মুদ্রিত, হঠাৎ দেখিলে মৃতদেহ ভিন্ন আর কিছুই অনুভূত হয় না, আর দুইটী স্ত্রীলোক বাম করে বাম গণ্ড সংস্থাপন পূর্ব্বক বিষণ্ণ বদনে ও দুঃখিত চিত্তে দুই পার্শ্বে বসিয়া আছেন, এবং নয়নজলে কপোল যুগল ভাসিতেছে।

 অনন্তর তাঁহাদিগের সেই আশ্চর্য্য রমণীয় রূপ ও মনোহর আকার দেখিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলাম, ইহাঁরা কখনই সামান্যা মানবী নহেন কোন দেবকন্যা হইবেন তাহার আর সন্দেহ নাই এবং বোধ হইতেছে ইহাঁদিগেরই এই দেহ প্রভায় বন উজ্জ্বল ও আলোকময় হইয়াছে; বোধ হয় কোন দুঃসহ দারুণ শোকে একান্ত অধীরা ও নিতান্ত অধৈর্য্য বশতঃ মনের দুঃখে একেবারে বিরাগিনী হইয়া এই নির্জ্জন বনে আসিয়া অবস্থিতি করিতেছেন ও অভিভূতা হইয়া আছেন। কি আশ্চর্য্য! শোক তাপ কি সকল শরীরকেই আশ্রয় করিয়াছে, কিন্তু বোধ করি ইহাঁদিগের শোকের কোন মহৎ কারণ থাকিবেক, তা নতুবা সামান্য শোক এতাদৃশ পবিত্র মূর্ত্তিকে কখনই কলুষিত ও অভিভূত করিতে পারিত না, এইরূপ ভাবিতে ভাবিতে একেবারে তাঁহাদিগের সম্মুখবর্ত্তী হইলাম, সম্মুখবর্ত্তী হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীত বচনে জিজ্ঞাসা করিলাম ভগবতি! আপনার কে এবং এই স্বর্ণলতা ও সৌদামিনী সদৃশা অতি শীর্ণাকায়া স্ত্রীলোকটী যিনি ধরায় শয়ন করিয়া বসুমতীকে পবিত্র ও বন আলোকিত করিয়াছেন ইনিই বা কে। ইহাঁর অধিষ্ঠান স্থান কোথা ও কি নিমিত্তই বা সকল সুখে জলাঞ্জলি দিয়া এবং দিব্যাশ্রম পরিত্যাগ পূর্ব্বক এই নির্জ্জন গহনে ধরাশয্যা আশ্রয় করিয়াছেন এবং কেনই বা মৃতপ্রায় হইয়া পতিতা আছেন, বাস্তবিক উনি জীবিতা না মৃতা, এই সমুদয় শুনিতে ও জানিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়াছে, যদি আপনাদিগের কোন ক্লেশকর ও হানিজনক না হয় তবে অনুগ্রহ পূর্ব্বক আদ্যোপান্ত আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা আমার চঞ্চল চিত্তকে পরিতৃপ্ত ও চরিতার্থ করুন, বারংবার এইরূপ অনেক অনুনয় ও বিনয় করাতে পার্শ্বোপবিষ্টা এক রমণী অশুপূর্ণ নয়নে ও গদগদ্‌ বচনে অতি মৃদু মধুর স্বরে আমাকে বলিতে লাগিলেন অয়ি ভীরু মানব! আমাদিগের পাষাণ বিদারক ঈদৃশ ক্লেশ ও দৌর্ভাগ্যের এবং বিধিনির্ব্বন্ধিত অখণ্ডনীয় এই অদ্ভুত ঘটনার অনুসন্ধানে তোমার এত প্রয়োজন কি? উহা কেবল শোকানল ও দুঃখার্ণব, যদি শুনিতে নিতান্তই অভিলাষ হইয়া থাকে কিঞ্চিৎ বলিতেছি শ্রবণ কর। ঐ যে ধরাশায়িনী সৌদামিনী সদৃশা কামিনী দেখিতেছ, উনি এই সসাগরা ও সদ্বীপা ভারত প্রসবিনী, উহাঁর নাম ভারতমাতা উহাঁর অধিষ্ঠান স্থান এই ভারত এবং উনিই ভারতের এক মাত্র অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ভীষ্ম, দ্রোণ, ভীম, অর্জ্জুন ও দুর্য্যোধন প্রভৃতি দিগ্বিজয়ী মহা মহা বীরচুড়ামণি এবং বাল্‌মীকি, বেদব্যাস, বাণভট্ট, কালিদাস প্রভৃতি জগদ্বিখ্যাত কবিকুল তিলক ইহাঁর বহুবিধ গুণনিধি সন্তান সকল অকালে কালকবলে নিহত হুওয়াতে তাঁহাদিগের সেই হৃদয়-ভেদী দুর্ব্বিষহ শোকে একান্ত কাতরা ও নিতান্ত অধীরা হইয়া একেবারে স্বীয় শরীর পতন করিয়াছিলেন, তাহার পর আবার উহাঁর ইদানিন্তন কতকগুলা কুলাঙ্গার সন্তানদের অশ্রুত ও অবক্তব্য কুৎসিত আচার ব্যবহার দেখিয়া একেবারে মনের ঘৃণায় ও লজ্জায় লোকালয়ে তার মুখ দেখাইতে না পারিয়া এই নির্জ্জন জনশূন্য অরণ্যে অবস্থিতি করিতেছেন। উহাঁর ন্যায় হতভাগিনী ও দুর্ভাগ্যবতী নারী এই ধরণীতলে কাহাকেও দেখিতে পাই না; অধিক কি বলিব, বসুমতী উহাঁর দুঃখেই মাটী হইয়াছেন ও বাসুকী দ্বিসহস্র নেত্রে উহাঁর দুঃখ আর দেখিতে না পারিয়া একেবারে পাতালে গিয়া অবস্থিতি করিতেছেন এবং রত্নাকর উইাঁর নিমিত্তই অতলস্পর্শ হইয়াছেন। রোম প্রভৃতি উহাঁর কনিষ্ঠা ভগ্নী সকল কত সময়ে কত ক্লেশ ও কতপ্রকার যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছেন এবং কতপ্রকার উৎকট পীড়ায় নিদান শঙ্কটাপন্ন হইয়া একপ্রকার মৃতপ্রায় হইয়াছিলেন, তাহার পর তাঁহাদিগের সুশীল মহামতি প্রিয় সন্তানগণের উৎসাহে ও যত্নে এবং সুশ্রূষাগুণে পুনৰ্জ্জীবিতা হইয়াছেন। উহাঁর দুরাচার নরাধম পামর সন্তানদের যত্ন ও সুশ্রূষা করা দূরে থাকুক, তাহারা ক্রমে ক্রমে মাতৃরক্তশোষণ ও পান করিতেছে এমন কি জননী ও জন্মভূমীর নাম পরিচয় দিতেও তাহারা লজ্জা বোধ করে। কুলাঙ্গারের মাতৃভাষাকে এককালে জলাঞ্জলি দিয়াছে ও তাহাতে তাহাদের যারপর নাই অরুচি জন্মিয়াছে। ঐ দেখ সকলেই সুরাপানে উন্মত্ত, সকলেরই জ্ঞান শূন্য ও সকলেই যথেচ্ছাচারী এবং সকলেই নিষ্ঠুর ও মাতৃদ্রোহী! কাহারো মনে দয়া নাই মায়া নাই ও হিতাহিত জ্ঞান নাই এবং একজনেরও ধর্ম্ম ভয় নাই। কেবল কুপথে গমন, কুক্রিয়া সাধন ও অভক্ষ্য ভোজন এবং অপেয় পান করাই এক্ষণে উহাদিগের দৃঢ় ব্রত হইয়াছে। কিসে স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি সাধন হয়, কিসে জ্ঞানোন্নতি হয় এবং কিসে মাতৃদুঃখ দূর হয় তাহাতে ভ্রূক্ষেপও নাই; কিসে গাড়ী যুড়ী বাড়ী হইবেক ও কিসে চশমা ঘড়ী ছড়ি হইবেক, কেবল তাহার জন্যই সতত তৎপর; অধিক কি বলিব, ঐ দেখ কুলাঙ্গারদিগের ঈদৃশ কুৎসিত জঘন্য আচার ব্যবহার দেখিয়া পক্ষী সকল তরুশাখায় উপবেশন পূর্ব্বক সমস্ত দিন যেন ছি ছি করিয়া এক্ষণে আপন আপন নীড়ে নিদ্রা যাইতেছে, কিন্তু ঝি ঝি পোকারা এখনও ক্ষান্ত হয় নাই ও তারাগণ নভোমণ্ডল হইতে মুখ মুচ্‌কে হাসিতেছে এবং কমলিনী আর দেখিতে না পারিয়া একেবারে মুদিত হইয়াছে। অতএব এ সকল দুঃখ কি মায়ের প্রাণে সহে? না এই সমস্ত ঘৃণাকর লজ্জাকর ও হাস্যাম্পদ ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া জননী লোকালয়ে থাকিতে না মুখ দেখাইতে পারেন? সুতরাং উনি সকল বিষয়ে জলাঞ্জলি দিয়া এই নির্জন বনবাসিনী হইয়াছেন, অধিক আর কি শুনিবে বল। আমি আর বলিতে পারি না, আমার বাক্‌শক্তি রহিত ও কণ্ঠরোধ হইয়া আসিতেছে। আর আমরা দুই জন উহাঁর দাসী। চিরকাল উহাঁর শ্রীচরণেরই সেবা করিয়াছি ও উহাঁর অন্নেই প্রতিপালিতা হইয়াছি এখন উহাঁকে এই দারুণ দুরবস্থায় ফেলিয়া কোথায় যাইব; সুতরাং উহাঁর দুঃখেরই অংশভাগিনী হইয়া উহাঁকেই অবলম্বন করিয়া আছি। তিনি যখন এইরূপ অতীব দুঃখের ও অশ্রোতব্য বৈরাগ্য বৃত্তান্তের পরিচয় দিতেছিলেন, তখন রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হইবেক। পৃথ্বীতে ঝিল্লি রব হওয়াতে ও নিশার শিশির বিন্দু বিন্দু পতন হওয়াতে বোধ হইল যেন নিশাদেবী ভারত মাতার দুঃখ আর সহ্য করিতে না পারিয়া করুণ স্বরে রোদন ও নেত্র জল মোচন করিতেছেন, শৃগালগণ চতুর্দ্দিকে ঊৰ্দ্ধমুখে ধ্বনি করাতে বোধ হইল যেন তাহারা ভারত মাতার দুঃখে দুঃখিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিতেছে এবং বৃক্ষ হইতে শুষ্ক পত্র সকল শর শর্‌ শব্দে পতিত হওয়াতে বোধ হইল যেন বৃক্ষ সকল পল্লবপাতচ্ছলে অশ্রুপাত করিতেছে। অনন্তর পার্শ্বোপবিষ্টা ও শোকদুঃখ বর্ণনকারিণী সেই কামিনী অতি মৃদু মধুর স্বরে আমাকে জিজ্ঞাসিলেন, অয়ি কৌতূহলাক্রান্ত! তুমি কে এবং কোথা হইতে কি নিমিত্তই বা এই দারুণ অন্ধকারময়ী নিশাতে আমাদিগের এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছ? তুমি কি কোন মন্দ লোক, অন্তঃকরণে কোন দুষ্ট অভিসন্ধি করিয়া এখানে আসিয়াছ? না বাস্তবিক কোন বিপন্ন পথিক, পথভ্রান্ত হইয়া আমাদিগের এখানে আসিয়া উপনীত হইয়াছ। এই সমুদয় বৃত্তান্ত অকপট চিত্তে আমার নিকট বর্ণন কর। আমি কৃতাঞ্জলিপুটে অতি বিনীত বচনে বলিলাম, ভগবতি! আমি কোন মন্দ লোক নহি এবং কোন মন্দ অভিপ্রায়েও এখানে আসি নাই, আমি যথার্থই একজন বিপন্ন পথিক, পথ ভ্রান্ত হইয়াই এখানে আসিয়াছি। তখন আমার দেশ ভ্রমণ ও অদৃষ্টচর দুঃখের আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত বর্ণন করিলাম। আমার বর্ণনা শেষ হইতে না হইতেই সেই ধরাশায়িনী স্থিরা সৌদামিনী সদৃশা ভারতমাতা চক্ষুরুন্মীলন পূর্ব্বক আমার প্রতি নেত্রপাত করিলেন, তাঁহার সেই সুপ্রশান্ত নেত্রপাত মাত্রেই আমি আপনাকে চরিতার্থ ও কৃতকৃতার্থ বোধ করিলাম এবং আমার সকল ক্লেশ শান্তি ও সকল দুঃখ এককালে দূর বোধ হইল। তদনন্তর তিনি তর্জ্জন গর্জ্জন পূর্ব্বক আমাকে বলিতে লাগিলেন, অয়ি ভ্রান্ত পথিক! কে বলে ভারত অন্ধকারময় ও জ্যোতিঃহীন। কে বলে ভারত আলোকশূন্য। কে বলে ভারত নিস্প্রদীপ হইয়াছে এবং কে বলে ভারত শ্মশান সমান। কে বলে লক্ষ্মী সাগর পরে গিয়া অবস্থিতি করিতেছেন। কে বলে স্বরস্বতী দেশান্তরে গমন করিয়াছেন এবং কে বলে ধর্ম্ম অন্তর্হিত হইয়াছেন। ঐ দেখ পূর্ব্ব দিক্‌ ভাগে শ্রোতস্বতী জাহ্নবীতীরস্থিতা প্রসিদ্ধা কাশীম বাজার নগরিতে আমার সকল দুঃখবিমোচনী প্রাণাধিকা প্রিয়তমা কন্যা মহারাণী স্বর্ণময়ীরূপ মহাশশির উদয় হইয়াছে ও তদ্বারা ভারতের সমস্ত তিমির এককালে বিনষ্ট হইয়াছে দেখিতে পাইতেছ না এবং তাঁহার সেই নির্ম্মল আলোকে দীন দুঃখি অনাথ ও অন্ধ প্রভৃতি সকলেই সুন্দর দৃষ্টি লাভ করিয়াছে ও আপন আপন দুঃখ সমূদয় দূর করিয়াছে। ঐ দেখ অশিতি বৎসরের অধিক বয়স্ক দৃষ্টিহীন কত কত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরাও স্বর্ণময়ীর নির্ম্মল পবিত্র আলোকে কত প্রকার উৎকট ও অস্পষ্ট গ্রন্থ ও শাস্ত্র সকল সুন্দর দৃষ্টিতে ও অভ্রান্ত রূপে মনের সুখে উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করিতেছেন এবং আবাল বৃদ্ধ বনিতা প্রভৃতি সকলেই অবহিত ও অনন্যমনা হইয়া শ্রবণ করত পরম প্রীতি লাভ করিতেছে। অধিক কি, ঐ দেখ তারাপতি তাঁহার আর সেই সকলঙ্ক কীরণ বিস্তার করিতে না পারিয়া যেন লজ্জায় মলিন বেশে লুক্কায়িত হইয়াছেন। কারণ তিনি কলঙ্কী এবং তাঁহার সেই কীরণও সকলঙ্ক। কিন্তু ঐ দেখ আমার স্বর্ণময়ীর নিষ্কলঙ্ক জ্যোতিঃ এবং তাঁহার সেই নিষ্কলঙ্ক পবিত্র জ্যোতিতে সমস্ত ভারত জ্যোতির্ম্ময় ও আলোকিত হইয়াছে দেখিতেছ না। ফলতঃ স্বর্ণময়ীই এক্ষণে ভারতের এক মাত্র জ্যোতিঃ, স্বর্ণময়ীই এক্ষণে ভারতের একমাত্র আলোক। আর ঐ দেখ তিনি স্বীয় গুণে ও যত্নে লক্ষ্মী স্বরসতী ও নারায়ণকে একেবারে বশীভূত করিয়াছেন ও সকলকে আপন অধীনে রাখিয়াছেন, লক্ষ্মী স্বরসতী সপত্নী বিধায় সর্ব্বদা একস্থানে অবস্থিতি করিলে পাছে কলহ হয় এজন্য লক্ষ্মীদেবীকে আপন গৃহের অভ্যন্তরে নিরূপিত স্থান নির্দ্দেশ করিয়া দিয়া সর্ব্বদা সতর্কতা পূর্ব্বক রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন ও ভগবতী স্বরসতীকে আপন কণ্ঠে রাখিয়া যার পর নাই যত্ন করিতেছেন। এবং দেবাদিদেব নারায়ণকে তাঁহার সেই সুপ্রশস্ত হৃদয়মন্দিরে বসবাস করাইয়া সর্ব্বদা কেবল তাঁহারই সেবা করিতেছেন। অধিকন্তু সকল গুণের আধার স্বরূপ অতীব ধীশক্তি সম্পন্ন পরাৎপর গুরু বৃহস্পতিকে আপনার মন্ত্রীত্ব পদে অভিষিক্ত করিয়া সকল বিষয়েরই ভার তাঁহার প্রতিই অৰ্পণ করিয়া নিশ্চিন্তা রহিয়াছেন, এবং মহামতি মন্ত্রী বৃহস্পতিও পরম শ্রদ্ধা ও যত্নসহকারে আপন গুণে ও সৌজন্যে যথাযোগ্য সকলের যত্ন ও সুশ্রূষা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করিতেছেন, কোন বিষয়েরই অণুমাত্র ক্রটী হইতেছে না। তাঁহার সেই অপক্ষপাতিতা কার্য্যদক্ষতাগুণে সন্তুষ্ট ও বশীভূত হইয়া সকলেই স্থিরভাবে ও অবিচলিতচিত্তে পরম সুখে অবস্থিতি করিতেছেন। ঐ দেখ স্বর্ণময়ী আমার পরম যত্ন ও উৎসাহ সহকারে প্রাচীন কবিকুলের কীর্ত্তি সমুদয়, বিলুপ্ত প্রায় হইবায় তিনি তাহার পুনরুদ্ধার করিয়া আপনার চিরস্থায়িনী কীর্ত্তি সংস্থাপন করিতেছেন, এবং ঐ দেখ তিনি দীন দুঃখি অনাথ দিগের ক্ষুধা শান্তি ও অভিলাষ পূর্ণ করিয়া অনন্ত যশঃ লাভ করিতেছেন। ঐ দেখ ভারতরূপ সরোবরে স্বর্ণময়ীরূপা কমলিনী বিকশিতা হইয়াছে এবং তাহার যার পর নাই মনোহর গন্ধে একেবারে ভারত মোহিত হইয়াছে। স্বর্ণময়ী আমার দুঃখীর দুঃখ মোচন ও বিপন্নের বিপদোদ্ধার করিয়া কি মহতী কীর্ত্তিই করিতেছেন। ফলতঃ তিনি অন্ধের যষ্টি, দুর্ব্বলের বল ও নিরাশ্রয়ীর আশ্রয় হইয়া অনন্ত সুখের হেতু ও অক্ষয় স্বর্গের সেতু বন্ধন করিতেছেন। ঐ দেখ ধনী মানী দীন দরিদ্র ও অনাথ প্রভৃতি সকলেই মুক্তকণ্ঠে তাঁহাকে ধন্যবাদ দিতেছে ও তাঁহারই যশোকীর্ত্তন করিতেছে। ঐ দেখ আকাশগামী বিহঙ্গমকুল বৃক্ষশাখায় বসিয়া অতি মনোহর স্বরে কেবল তাঁহারই অশেষ গুণ গান করিতেছে। অধিক কি বলিব ঐ দেখ দীনমাতা স্বর্ণময়ীর এবম্বিধ অশেষ প্রকার যশোগন্ধ মস্তকে করিয়া পবন সকল কার্য্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক অণুক্ষণ উত্তর দক্ষিণ পূর্ব্ব পশ্চিম চতুঃর্দ্দিকে তাঁহার সেই সুগন্ধ যশোগন্ধ বিস্তার করিতেছেন এবং তিনি তাঁহারই অত্যাশ্চর্য্য চিরস্থায়িনী মনোহর কীর্ত্তির নিশান সকল স্কন্ধে করিয়া দেশে দেশে ভ্রমণ করিতেছেন। ঐ দেখ, নিশাপতি সমস্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া তাঁহারই অলৌকিক কীর্ত্তি সমুদয় অবলোকানন্তর প্রভাতে আর থাকিতে না পারিয়া যেন মনের দুঃখে অতি মলিন হইয়া নিভৃত প্রদেশে গমন করিয়াছেন। তারাগণ দিনের বেলায় দিনকরের ভয়ে প্রকাশ হইতে না পারিয়া এই সময় সময় পাইয়া নভোমণ্ডল হইতে একদৃষ্টিতে তাঁহারই কীর্ত্তি সমুদয় অবলোকন করিতেছে। ঐ দেখ, গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ প্রভৃতি ষড়ঋতু সকল পুনঃপুনঃ যেন উহাঁরই গুণ গণনা করিয়া পরিবর্ত্তিত হইতেছে এবং ভগবান ভাস্কর প্রতিদিন উদয় হইতে অস্ত পর্য্যন্ত উহাঁরই অলৌকিক কার্য্য ও অবিনশ্বর চিরস্থায়িনী কীর্ত্তি সমুদয় পর্য্যবেক্ষণ করিয়া সেই অনাদি অচিন্তনীয় স্বৰ্গীয় পিতার নিকট যেন তাহারই পরিচয় দিতেছেন। ফলতঃ স্বর্ণময়ীই এক্ষণে আমার সর্ব্বস্ব ধন, স্বর্ণময়ীই আমার সকল দুঃখ দূর করিয়াছে ও স্বর্ণময়ীর জন্যই আমি ভারতে আছি এবং স্বর্ণময়ীর জন্যই দুঃখিনী ভারতমাতা বলিয়া সকলের নিকট পরিচয় দিয়া এখনও মুখ দেখাইয়া থাকি। তুমি সমস্ত দিন অনাহারে থাকিয়া মধ্যে যৎকিঞ্চিৎ অকিঞ্চিৎকর ফল মূল ভক্ষণ করিয়া ক্ষুধায় নিতান্ত কাতর হইয়া বেড়াইতেছ, অতএব সেই প্রাতঃস্মরণীয়া দীনপালিকা দীনমাতার নিকট যাও যে তথায় কোন ফলেরই অভাব নাই সকল ফলই, প্রাপ্ত হইবে; সকল ক্ষুধার শান্তি হইবে এবং তোমার সকল ক্লেশ ও সকল দুঃখ এককালে দূর হইবে। অনন্তর সেই বনদেবী ভারতমাতার এবম্প্রকার বহুবিধ সুমধুর বাক্য পরম্পরা শ্রবণানন্তর সহসা আমার মূর্চ্ছাপনয়ন হইল এবং মূর্চ্ছাভঙ্গ হইয়া দেখি যে সেই সুপ্রশস্ত বিন্ধ্যগিরির নিম্নস্থ প্রস্থদেশে পতিত হইয়া রহিয়াছি, শরীর ধূলায় ধূসরিত ও অতিশয় আঘাতিত এবং নিতান্ত ক্ষত বিক্ষত হইয়াছে; কি করি; তখন তথা হইতে আস্তে আস্তে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সাধ্যাতীত পরিশ্রম ও পর্য্যটন করত অতি কষ্টে কতিপয় দিবসে দেশে আসিয়া উপস্থিত হইলাম।

 এমন সময়ে হঠাৎ আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল, নিদ্রা ভঙ্গ হইয়া দেখি যে রাত্রি প্রভাত হইয়াছে। তারাগণ অদৃশ্য, কুমুদিনী মুদিতা ও কমলিনী বিকসিতা হইয়াছে, পক্ষীগণ কলরব করিয়া আহারের অন্বেষণে আপন আপন অভিমত দিক্‌ দিগন্তে গমন করিতেছে ও ভগবান মরিচিমালি পূর্ব্ব দিক্‌ হইতে রক্তিমা বর্ণে উদয় হইতেছেন এবং আমি সেই তরুতলেই শয়ন করিয়া আছি। রাত্রের শিশিরে আমার পরিধান ও উত্তরীয় বসন সকল ভিজিয়া গিয়াছে ও বৃক্ষপত্র হইতে শিশিরের জল মুক্তাকলাপের ন্যয় বিন্দু বিন্দু গাত্রে পতিত হইতেছে, তথাপি সংজ্ঞা নাই এবং আমার সমস্ত শরীর যেন অবশ প্রায় হইয়াছে। তখন আমি আমার এই অপূর্ব্ব মনোহর স্বপ্ন বৃত্তান্ত মনে মনে চিন্তা করিতে করিতে ঈশ্বরের নাম স্মরণ পূর্ব্বক সত্ত্বরে গাত্রোত্থান করিলাম এবং এই অত্যাশ্চর্য্য অদ্ভুত মনোহর মোহ বৃত্তান্ত জনসমাজে প্রচার করিতে কৃত সংকল্প হইলাম।

আয়রে ভারত বাসি, মুক্তকণ্ঠে দিবা নিশী,
স্বর্ণময়ী গুণ গাথা গাও নারে গাও না,
যশের সৌরভ তাঁর, লয়ে সবে অনিবার,
তাঁহার চরিতামৃত পীয়ো মারে পীইয়ো না,
পবন রে! ধীরে ধীরে, সৌরভ লইয়া শিরে,
দশ দিকে মন সুখে বও নারে বও না,
তটিনী রে! কলস্বরে, গিয়ে তুমি ত্বরা করে,
সাগরে যশের বার্ত্তা কও নারে কও না,
পাখী রে! মহিরে ছেড়ে, যাওরে গগণে উড়ে,
রবি রে! এ সমাচারে তোষ নারে তোষণা,
গিরি রে! উন্নত শিরে, সদা বাহু ঊৰ্দ্ধ করে,
"জয় মহারাণী" বাক্য ঘোষ নারে ঘোষ না,
ফণী রে! বলিরে তোরে, যাওরে পাতাল পুরে,
মহারাণী সুধা যশে বাসূকীরে তোষ না,
রবি রে! মিনতি তোরে, যাও তুমি শীঘ্র করে,
বৈকুণ্ঠ স্বামীর কাছে এ ষোষণা ঘোষ না,
কবি রে! গাও রে সদা, গুণময়ী গুণ গাথা,
তব আশা পূর্ণ কই হলো নারে হলো না,
লেখনী রে! এখনি রে, থেম না থেম না ওরে,
কি দুঃখে হইলে ক্ষান্ত বল নারে বল না।


এই লেখাটি বর্তমানে পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত কারণ এটির উৎসস্থল ভারত এবং ভারতীয় কপিরাইট আইন, ১৯৫৭ অনুসারে এর কপিরাইট মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। লেখকের মৃত্যুর ৬০ বছর পর (স্বনামে ও জীবদ্দশায় প্রকাশিত) বা প্রথম প্রকাশের ৬০ বছর পর (বেনামে বা ছদ্মনামে এবং মরণোত্তর প্রকাশিত) পঞ্জিকাবর্ষের সূচনা থেকে তাঁর সকল রচনার কপিরাইটের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ ২০২৪ সালে, ১ জানুয়ারি ১৯৬৪ সালের পূর্বে প্রকাশিত (বা পূর্বে মৃত লেখকের) সকল রচনা পাবলিক ডোমেইনের আওতাভুক্ত হবে।