মহাভারত (উপক্রমণিকাভাগ)/পঞ্চচত্বারিংশ অধ্যায়

উইকিসংকলন থেকে

পঞ্চচত্বারিংশ অধ্যায়— আস্তীকপর্ব্ব।

উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, এই সময়েই অতি তেজস্বী মুহাতপস্বী মহর্ষি জরৎকারু কঠোর ব্রতে দীক্ষিত হইয়া নানা পবিত্র তীর্থে স্নান করিয়া ভূমণ্ডলে ভ্রমণ করিতেছিলেন। এই রূপে বায়ুভক্ষ, নিরাহার, দিন দিন ক্ষীণকলেবর, ও, যত্রসায়ংগৃহ হইয়া ভ্রমণ করিতে করিতে, একদা তিনি তাছি দীনভাবাপন্ন, অনাহারী, শুদ্ধশরীর, উর্দ্ধপদ, অধঃশিরাঃ, গর্তে লম্বমান স্বীয় পিতৃগণকে অবলোকন করিলেন। তাহাদিগকে পরিত্রাণেচ্ছু বোধ করিয়া নিতান্ত কাতর হইয়া জিজ্ঞাসিলেন, আপনারা কে বলুন, আমি দেখিতেছি, আপনার একমাত্র উশীরস্তম্ব অবলম্বন করিয়া অধোমুখে গর্তে লম্বমান আছেন, গর্ত্তস্থিত মূষিক উশীরস্তম্বের মূল প্রায় সমস্ত ভক্ষণ করিয়াছে, একমাত্র তনু অবশিষ্ট আছে, তাহাও অবিলম্বেই নিঃশেষ হইবে, অনন্তুর আপনারাও এই গর্তে পতিত হইবেন। অপিনাদিগকে এপ্রকার ঘোর বিপদাপন্ন দেখিয়া আমার শোক উদ্ভূত হইতেছে; অতএব অজ্ঞ করুন, আপনাদিগের কি সাহায্য করি, আমার সঞ্চিত তপস্যার চতুর্থ ভাগ, তৃতীয় ভাগ, অর্দ্ধ ভাগ বা সমগ্র দ্বারা আপনারা নিষ্কৃতি লাভ করুন।

 পিতৃপুরুষের কহিলেন, হে বৃদ্ধ ব্রহ্মচারি! তুমি আাপন তপস্যার ফল দিয়া আমাদিগের পরিত্রাণ ইচ্ছা করিতেছ, কিন্তু তপস্যাবলে আমাদিগের উদ্ধার লাভ হইতে পারে না, আমাদিগের ও তপস্যার ফল আছে। আমরা কেবল বংশলোপের উপক্রম হওয়াতেই অপবিত্র নরকে পতিত হইতেছি। আমরা এই মহাগর্ত্তে লম্বমান হইয়া হতজ্ঞান হইয়াছি; এজন্য তোমার। পৌরুষ সর্বত্র বিখ্যাত, তথাপি তোমাকে চিনতে পারিতেছি না। হে মহাভাগ! তুমি আমাদিগকে শোকাবিষ্ট ও সাতিশয় দুঃখিত দেখিয়া অনুকম্পা প্রকাশ করিতেছ; অতএব তুমি আমাদিগের পরিচয় বধ কর। আমরা যাযাবর নামে ঋষি, বংশনাশের উপক্রম হওয়াতেই পুণ্যলোক হইতে প্রচুত হইয়া অধোগতি প্রাপ্ত হইতেছি, আমাদিগের প্রগাঢ় তপস্যার ফল বিলুপ্ত হইয়াছে, আমাদের আর কোনও উপায় নাই। আমরা অতি হতভাগ্য, আমাদিগের একমাত্র সন্তান আছে, কিন্তু সেই হতভাগ্যের থাকা না থাকা তুল্য হইয়াছে। তাহার নাম জরৎকারু। জরৎকারু বেদবেদাঙ্গপারগ, নিয়তাত্মা ও ব্রতপরায়ণ, সে সর্ব্ব ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া একমাত্র তপস্যাধর্ম্ম অবলম্বন করিয়াছে, তাহার তপস্যালোভদোষেই আমাদের দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে। তাহার ভার্য্যা নাই, পুত্র নাই, বান্ধবও নাই, তাহাতেই আমরা অনাথের ন্যায়, হতজ্ঞান হইয়া এই মহাগর্তে লমান আছি। হে দ্বিজবর! আমরা যে উশীরস্ত অবলম্বন করিয়া আছি, উহা আমাদিগের কুলস্তম্ব; আর যে স্তমুল দেখিতেছ, তাহা আমাদিগের কাল গ্রস্ত সন্তানপরম্পরা, এবং যে অৰ্দ্ধাৰশিষ্ট মুল দেখিতেছ ও যাহাতে আমরা লম্বিত আছি, ওই তপস্যারত মুঢ়মতি অচেতন জরৎকারু; আর যে মূষিক দেখিতেছ, ইনি মহাবল পরাক্রান্ত কাল, ইনিই অল্পে অল্পে তাঁহাকে সংহার করিতেছেন। জরৎকারুর কঠোর তপস্যায় আমাদিগের উদ্ধার সাধন হইবে না। আমরা হতভাগ্য, আমাদিগের মূল প্রায় শেষ হইয়াছে; এই দেখ, আমরা পাপাত্মার স্যায় অধঃপতিত হইতেছি; আমরা সবান্ধবে এই গর্তে পতিত হইলে জরৎকারু কালপ্রেরিত হইয়া নিরগামী হইবেক। তপস্যা যজ্ঞ প্রভৃতি যে সমস্ত উৎকৃষ্ট ফলপ্রদ পরম পবিত্র কর্ম্ম আছে, সে সকল সন্তানের সমান উপকারক নহে। তুমি আমাদের দুরবস্থা দর্শনে দুঃখিত হইয়া অনুকম্পা প্রদর্শন করিতেছ, এ নিমিত্ত তোমাকে এই অনুরোধ করিতেছি যে, তুমি আমাদিগকে যেপ্রকার দেখিলে তাহার সহিত দেখা করিয়া সমস্ত অবিকল বর্ণন করিবে, এবং এই অনুরোধ করিবে যে, তুমি দারপরিগ্রহে ও পুত্রোৎপাদনে যত্নবান হও। সে যাহা হউক, তুমি আমাদিগের পরম বন্ধুর ন্যায় অনুকম্পা করিতেছ, অতএব, তুমি কে আমরা শুনিতে বাসনা করি।