মায়া-মৃগ/তৃতীয় দৃশ্য

উইকিসংকলন থেকে



তৃতীয় দৃশ্য।

পঞ্চবটী সন্নিহিত বিজন প্রদেশ।


(রাম লক্ষণ ও সীতার প্রবেশ।)

 সীতা। (ম্লানমুখে রামের প্রতি) আর্য্যপুত্র! পঞ্চবটী আর কত দূর আছে?

 রাম। প্রিয়ে! আর অধিক দূর নাই; ঐ যে সম্মুখে দেখা যা'চ্ছে। (অঙ্গুলি দ্বারা নির্দ্দেশ।)

 সীতা। (পরিক্লান্ত বচনে।) তবে চলুন।

 রাম। (সবিষাদে), হা দুর্দৈব! যে অসূর্য্যম্পশ্যরূপা জানকী কখনো অন্তঃপুরান্তর হন্‌ নাই, বিমানচারী বিহঙ্গেরাও যে রঘু-কুল-বধূর মুখ-বিধু কখনো দর্শন ক’র্ত্ত্যে পায় নাই, সর্ব্বদা শত শত কিঙ্করী যাঁ’র পরিচর্য্যায় নিযুক্ত থাক্ত, যে কোমলাঙ্গী কমলার পদ-কমল কঠিন মৃত্তিকা স্পর্শে রক্তোদগীরণোন্মুখ হ’ত, যে চার্ব্বঙ্গীর চারু অঙ্গ দুর্লভ রত্নরাজিরচিত অলঙ্কারে সতত বিভূষিত থাক্ত, যে রঘু-কুল-রাজলক্ষ্মী লক্ষ লক্ষ লোকের দর্শন-অভিলষণীয় ছিল, এখন সেই কনক-লতা সীতা দীনা হীনা বনবাসিনী তপস্বিনী বেশে বনে বনে পর্য্যটন ক’চ্ছেন্‌!! আতপ-তাপে প্রিয়ার মুখমণ্ডল প্রভাতকালীন চন্দ্রমার ন্যায় মলিন ও নিষ্প্রভ হ'চ্ছে! হায়! আমাকে প্রেয়সীর ঈদৃশ কষ্টও স্বচক্ষে, অবলোকন ক’র্ত্ত্যে হ’ল! না জানি, অদৃষ্টে আরো কত আছে? (দীর্ঘনিশ্বাস।)

 সীতা। নাথ! আপনি আক্ষেপ ক’র্ব্বেন্‌ না। সতত স্বামীর সহবর্ত্তিনী থাকা অপেক্ষা স্ত্রীলোকের পক্ষে আর অধিক কি সুখ আছে?

 লক্ষণ। (রামের প্রতি) আর্য্য। দেবীর দুঃখ আর চক্ষে দেখা যায় না। ঐ দেখুন্‌, কুশান্ধুরাঘাতে আর্য্যার চরণযুগল রুধিরধারে রঞ্জিত হ’য়েছে।

 রাম। (সবিষাদে) হা হতবিধে! জানকীর অদৃষ্টে এত দুঃখও লিখেছ। মন্দভাগা রামের হস্তে পতিত হ’য়ে জানকীর ভাগ্যে সুখভোগ হ’ল না। রাজকন্যা ও রাজবধু হ’য়ে এমন দুঃখ কেউ কখনো পায় নাই।—হা মাতঃ কৌশল্যে! তোমার প্রাণাধিকা বধূর এত কষ্ট কিছুই জান্তে পা’চ্ছ না। যে বধু জানকীকে কখনো মৃত্তিকা স্পর্শ কর্ত্যেও দিতে না, এখন তোমার সেই সীতার কোমল পদ কণ্টকাঘাতে শোণিতসিক্ত হ’চ্ছে - রে। দগ্ধ নয়ন। প্রিয়া জানকীর এ দুঃখ আর দেখিস্‌ না, এখনি চিরমুদিত হ’!

 সীতা। জীবিতেশ্বর। দাসীর জন্য এত ব্যাকুল হ’চ্ছেন কেন? আপনার কষ্ট অপেক্ষা আমার কষ্ট তত অধিক নয়। আপনি নিকটে থাক’লে, কোনো কষ্টকেই কষ্ট ব’লে আমার বোধ হয় না।

 রাম। প্রাণেশ্ববি! পতিপ্রাণা প্রমদার প্রধান ধর্ম্মই এই। তোমার ন্যায় গুণবতী সতীর পতি হওসা, অনন্ত সুখের বিষয় -প্রিয়ে! তোমার সদগুণ-পাশে আমার মন দৃঢ় আবদ্ধ র’য়েছে; এমন কি, তোমারে তিলেকের জন্যও নয়নান্তরিত ক’র্ত্ত্যে, হৃদয় শতধা বিদীর্ণ হয়।

 সীতা। নাথ!! দাসীর প্রতি এরূপ অনুগ্রহ যেন চিরকালই থাকে। স্ত্রীলোকের পক্ষে এর অপেক্ষা আর সৌভাগ্যের বিষয় কি আছে?

 রাম। প্রিয়ে! তোমার বচন-সুধায়, আমার কর্ণকুহরে সততই অমৃতধারা বর্ষণ হয়; সর্ব্ব শরীর অভূতপূর্ব্ব আনন্দ-রাসে আপ্লুত হয়; ইন্দ্রিয়গণ আপনা হ’তেই অবশ হ’য়ে স্ব স্ব কার্য্য পরিত্যাগ ८॥

 লক্ষণ। (সবিষাদে) হা সুপবিত্রে অযোধ্যানগরি! তুমি এখন বিধবা হ’য়ে দস্যু ভরতের হস্তগত হ’য়েছি!!! যখন ধার্ম্মিক-শ্রেষ্ঠ আর্য্য রাম{ চন্দ্র তোমাকে পরিত্যাগ ক’রেছেন, তখন আর তুমি সেই পুণ্যপুরী নাও; শ্মশান অপেক্ষাও অশুচি হ’য়েছ।—হা মাতঃ বসুন্ধারে। এখনি দ্বিধা হ’য়ে, ভরত ও সকৈকেয়ী অযোধ্যাকে গ্রাস কর;রামত্যক্ত অযোধ্যা আর দর্শনীয় নয়।

 রাম। ভ্রাতঃ লক্ষণ! তুমি এরূপ বাক্য কেন প্রয়োগ ক’চ্ছ? ভারত অতি ধার্ম্মিক, তা’র निন্দা ক'রো না।

 লক্ষণ। (উগ্রভাবে) তিনি যখন এখনো সেই পিশাচী কৈকেয়ী মাতার দণ্ড বিধান করেন নাই, তখন তিনি আর ধার্ম্মিক-পদবাচ্য ন’ন্‌।— পিশাচী-গর্ভজাত কি কখনো ধর্ম্মাত্মা হ’য়ে থাকে? সর্পিণী-অণ্ডে কি কখনো ময়ুর-শাবক জন্মায়? শার্দূলী গর্ভে কি কখনো হরিণ-শিশু জন্মগ্রহণ  করে?—আর্য্য! আপনি অনুমতি করুন্‌, এখনি নিজ বাহুবলে পাপের সমুচিত প্রতিফল প্রদান ক’রে অযোধ্যার রাজাসনে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করি। ভরত যদি ত্রিলোক সহায় ক'রে আ'সেন, তথাপিও লক্ষণের এই অভেদ্য কোদণ্ডচু্যত অমোঘ শর-জালের প্রচণ্ড বেগ কখনই সহ্য কর্ত্ত্যে সমর্থ হ’বেন না - অগ্নি যদি দাহিকাশক্তি পরিহীন হয়, পশ্চিম গগণে যদি দিনকরের উদয় হয়, রস যদি রসাতলে গমন করে, তথাপিও লক্ষণের বাক্য কখনো অন্যথা হ’বে না।—আর্য্য! এই দেখুন, আমি শরাসনে শর সন্ধান ক’ল্যোম। (ধনুকে শর ষোজনা।)

 রাম। ভ্রাতঃ লক্ষ্মণ! তুমি বাতুল হ’লে না কি? নিরস্ত হও। তোমার ন্যায় বীর-পুরুষের কিছুই অশক্য নাই, তা'আমি অবগত আছি। ত্বদীয় ভীষণ শরবেগ, বোধ হয়, সুমেরুও সহ্য ক’র্ত্ত্যে পারেন না। কিন্তু ভ্রাতঃ! বিমাতা কৈকেয়ী ও সুশীল ভরত সততই আমাদের অবধ্য। তুমি আর ও কথা কদাচ জিহ্বাগ্রে আনয়ন ক’রো না।; এর উচ্চারণেও পাপ হয়। অস্ত্র সংযত কর।

 লক্ষ্মণ। (শর সংযত করিয়া) আর্য্য! আপনকার আজ্ঞার অন্যথাচরণ করা কা’র সাধ্য?

 সীতা। দেবর লক্ষ্মণ! আর্য্যপুত্রকে এই জন্যই রঘু-কুল-তিলক বলে।

 লক্ষ্মণ। দেবি! অর্য্যের গুণগ্রাম ত্রিভুবন খ্যাত। দেখুন্‌, রাজ্যনাশে ও বনবাসে অর্য্যের মনে কিছুমাত্রও বৈকল্য নাই।—প্রবল বাত্যাবেগে। গভীরার্ণবও কখনো অক্ষুব্ধ দৃষ্ট হয় না। কিন্তু। অর্য্যের মন এততেও কিঞ্চিমাত্র বিচলিত হয় নাই। জগতে ঈদৃশ মহাত্মাই ধন্য!

 সীতা। অর্য্যপুত্রের সহ্যগুণ, মাতা বসুমতী অপেক্ষা ও অধিক; মনে কিছুমাত্র ক্ষোভ নাই।

 রাম। প্রিয়ে! আমার মনস্তাপের কারণ কি? ভরত ত আমার পর নয়, তবে তা’র রাজ্য ভোগে মনে ক্ষোভের উদয় হ’বে কেন? দেখ, সেও কিছু স্বেচ্ছায় রাজ্য পালন ক’চ্ছে না; আমার আজ্ঞাক্রমেই ন্যস্ত ধনের ন্যায় রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণ। ক’চ্ছে। আরো দেখ, পিতামাতার সেবাশুশ্রূষাদি করাই সন্তানের অনুষ্ঠেয় কার্য্য; তদ্বিপরীতাচরণে অশেষ অধর্মের সঞ্চার হয়। ভরত, পরম। পবিত্র রঘুকুলে জন্ম গ্রহণ ক'রে, মাতৃদণ্ড রূপ বিষম পাপ-পঙ্কে কি রূপে লিপ্ত হ’তে পারে? আমি ভরতের ভ্রাতৃভক্তি ও সদ্বিবেচনা দর্শনে পরম প্রীতি লাভ ক'রেছি। তোমরা, আমার সমক্ষে, আর তা’র নিন্দাবাদ ক’রো না। আহা! চিত্রকূটে ভরতকে যখন অযোধ্যায় বিদায় দিই, ভরতের তৎকালিক রোদন ও বিলাপের কথা স্মৃতিপথে উদিত হ’লে, এখনো আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়।

 লক্ষ্মণ। (সহাস্য মুখে) সে সমস্তই কপট। আপনার সরল মন, সেই জন্যই চাতুর্য্য বু’ঝতে পারেন না। দেখুন্‌, ব্যাধেরাও সুমধুর বংশীবাদন সরল-বুদ্ধি মৃগের মন মুগ্ধ ক’রে থাকে।

 রাম। ভ্রাতঃ! ও কথার আলোচনা পরিত্যাগ কর; অন্যথা, মর্মান্তিক পীড়া পা’ব। তুমি কখনই আমার বাক্যের প্রতিবাদ কর নাই, এক্ষণে তা’ নূতন দেখ্‌ছি।

 লক্ষ্মণ। (সবিনয়ে) আর্য্য! প্রচণ্ড প্রভঞ্জন প্রতাপে প্রকাণ্ড পাদপ পৃথ্বী-পাতিত হ’লে কি তদাশ্রয়ী বিহুগকুল নীরবে ও নিরুদ্বেগে থাক্তে পারে? মামরা আপনার আশ্রিত, আপনার কোনো বিপদ বা ক্লেশ হ'লে, আমরাও বিপদ ও ক্লেশ অনুভব করি। আর্য্য! ক্রোধোদয়ে মানুষ্যের জ্ঞান লোপ পায়, আপনার সমক্ষে যদি কিছু ঔদ্ধত্য প্রকাশ হ’য়ে থাকে, তবে এ চিরদাস লক্ষণের প্রতি কৃপাকটাক্ষবিক্ষেপে অপরাধ মার্জ্জনা করুন।

 রাম। (লক্ষ্মণকে আলিঙ্গন করিয়া) ভ্রাতঃ লক্ষ্মণ। সাধু! সাধু! তোমার বাক্যে আমি পরম পরিতুষ্ট হ’লেম। তুমি যে নিতান্তই আমার শুভাভিলাষী, তা' আমি বিলক্ষণ অবগত আছি। ভ্রাতঃ! তুমিও কেবল আমার জন্য রাজ্যত্যাগী হ’য়ে অকারণে দারুণ দুঃখ ভোগ ক’চ্ছ।

 লক্ষ্মণ। ভৃত্য নিকটে উপস্থিত না থা’ক্‌লে প্রভুর সেবা কে ক’র্ব্ব্যে? প্রভুর মঙ্গলামঙ্গলেই ভৃত্যের মঙ্গলামঙ্গল।

 রাম। প্রিয়ে জানাকি! লক্ষ্মণ আমাদের নিতান্ত অনুগত। ঈদৃশ ভ্রাতৃরত্ন লাভ করা পরম শ্লাঘার বিষয়।

 সীতা। আর্য্যপুত্র! দেবর লক্ষণ সতত আমাদের মঙ্গলানুধ্যায়ী। লক্ষণের ঋণ কিছুতেই পরিশোধ হ’বার নয়।

 লক্ষ্মণ। দেবি। আপনার সবিশেষ অনুগ্রহ করেন। ব’লেই এ কথা ব'লছেন। গুণদর্শন আপনাদের স্বভাবসিদ্ধ।

 রাম। ভ্রাতঃ লক্ষ্মণ।আমাদের সঙ্গে বনে বনে ভ্রমণ ক্লেশে, জানকীর নিরতিশয্য কষ্ট হ’চ্ছে। জানকীর এ দুঃখ আর প্রাণে সহ্য হয় না।

 লক্ষ্মণ। আর্য্য। এ দাসও ইতিপূর্বে তা’র উল্লেখ ক’রেছে। রাজদুহিতা ও রাজবধুর বনবাসজনিতও এ দারুণ ক্লেশ সহ্য হ’বে কেন?

 রাম। (দীর্ঘনিশ্বাস সহকারে) এই জন্যই গৃহে থাক্তে জানকীকে তৎকালে অনুরোধ ক’রেছিলাম।

 সীতা। আর্য্যপুত্র! প্রভু যা’র বনবাসী, সে কি কখনো গৃহসুখাভিলাষী হ’যে থাক্তে পারে?— সতত দিনমণি পার্শ্বে থা'ক্‌লে, নলিনী কি কখনো মলিনী হ’য়ে থাকে? আপনি যখন নিকটে আছেন, তখন আমার কষ্টেরই বা কারণ কি?

 রাম। (লক্ষ্মণের প্রতি) সীতা রামময়জীবিতা, সেই জন্য এরূপ ব’ল্‌ছেন।—যা'হ’ক ভ্রাতঃ! এখন কি করা কর্ত্তব্য?

 লক্ষ্মণ। আর্য্য! এ দাসের মতে, এই পঞ্চ বটীর কোনো সুরম্য প্রদেশে আশ্রম ক’রে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করা কর্ত্তব্য।

 রাম। ভ্রাতঃ! এ জনশূন্য নিবিড়ারণ্য, হিংস্র। শ্বাপদ ও দুবাচার নিশাচরের আবাসস্থল। এ স্থানে অবস্থানে অশেষ আপদের আশঙ্কা আছে।

 সীতা। (সভয়ে)। তবে এখানে অবস্থিতিতে কাজ নাই; চলুন, অন্যত্র গমন কবি।

 লক্ষ্মণ। দেবি। যে আর্য্যের শরাগ্নিতে তাড়কাদি দুর্দ্ধর্ষ রাক্ষসবৃন্দ ভস্মীভূত হ'য়েছে, তাঁ'র বিদ্যমানে ও এ দাস লক্ষ্মণের হস্তে ধনুঃশর থাক্তে, ত্রিভুবনের ক’রো। আপনার ভয় নাই; আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন্‌।

 রাম। ভ্রাতঃ। তবে সত্বরই অবস্থানোপযোগী স্থলান্বেষণ করা; আর কালক্ষেপে প্রয়োজন নাই। পুণ্যসলিলা গোদাবরী তটে অনেক সুরম্য স্থান আছে; চল, সেই স্থলে গমন করি।

 লক্ষ্মণ। যে আজ্ঞা, চলুন্‌।

[সকলের প্রস্থান।

ইতি তৃতীয় দৃশ্য।