বিষয়বস্তুতে চলুন

মালা/কাতরতা

উইকিসংকলন থেকে

কাতরতা


হয় বিধি! এই কিহে বিধান তোমার?
অকালে হরিলে মম দেহের জীবন!
সম্মুখে রাখিয়া ছিলে সুধার ভাণ্ডার।
গরল তাহাতে কেন দিলে অকারণ?

ক’রেছিলে মোরে হায় আদরে পালিতা।
পিতা-মাতা-হৃদয়ের ছিলাম প্রসূন।
এখন করিলে এই দুঃখেতে দলিতা।
হায় বিধি একি বিধি তোর নিদারুণ!

কেন পাঠাইলে হায় এ ভব সংসারে?
কেন ক’রেছিলে মোরে বল রাজরাণী?
সহিবারে এ দারুণ জ্বালা এ অন্তরে।
ক’রেছিলে মোরে বুঝি সৃষ্টি পদ্মযোনি?

ওরে বিধি! এই যদি ছিল রে বাসনা।
কেন পিয়াইলি মোরে সে অমৃত স্বাদ?
এখন আমারে কেন করিলে বঞ্চনা?
সাধিলে জীবন ব্যাপি কি দারুণ বাদ!


করিবারে অনাথিনী জগতে আমারে।
পাঠাইয়া ছিলে কিহে এই ধরামাঝে?
আর না সহিতে পারি যাতনা অন্তরে।
অভাগীরে রাখিয়াছ আর কোন কাজে?

আর না ধরিতে পারি এ ছার জীবন।
আর না বহিতে পারি এ যন্ত্রণা শিরে।
দুঃখিনীরে রাখিয়াছ আর কি কারণ?
কাড়িয়া লইয়া মম সর্ব্বস্বধনেরে?

দিয়েছিলে সুখ-সৌধ-উপরেতে স্থান।
নন্দন-কানন সৃষ্টি ক’রেছিলে মম।
সুখ-পারিজাত-পুষ্প করি শোভমান।
দিয়াছিলে মনোমত স্বামী প্রিয়তম।

ফল ফুলে সুশোভিত করিয়া উদ্যান।
সাজাইয়া ছিলে বিভু মনোমত করি।
বল কে হইয়া আর হরষিত প্রাণ—
কণ্টক কাটিয়া পুষ্প লইবে আহরি?

হায় বিধি! এত যদি ছিল তোর মনে—
কেন মোরে পাঠাইলি এই ধরাধামে?


কেন বা হরিলি মম হৃদয়-রতনে?
দিবানিশি রহি আমি মরিয়া মরমে।

দিবানিশি বহাইতে সুখ-প্রস্রবণ—
দিবানিশি ছুটাইতে প্রীতির লহর—
এখন নয়ন-নীর সদা বরিষণ!
দেখিয়া তোমার ইহা কাঁদে না অন্তর?

জগতের সার রত্ন মোরে দিয়াছিলে।
হীরা, মতি, পান্না, চুণি, নহে এ রতন—
পদ্মরাগ অয়স‍্কান্ত নাহি এতে মিলে—
পলা, নীলা, সূর্যকান্তে নহেক তুলন।

কষিত-কাঞ্চন কভু সমতুল নয়।
এ উজ্জ্বল ভাতি তাহে করেনা বিকাশ।
এ প্রভায় সুবর্ণের ম্লান প্রভা হয়।
বিশুদ্ধ এ স্নিগ্ধ জ্যোতি করিত প্রকাশ!

মথিয়া তুলিয়া ছিলে অমৃত সাগর।
বাছিয়া উজ্জ্বল হেরি এই রত্ননিধি।
পরাইয়া ছিলে সাধে গলদেশে মোর।
এখন খুলিয়া নিলে এই কিরে বিধি?


এই কি বিধাতা তব বিচারের নীতি?
কাড়ি লও প্রিয়পতি কাঁদায়ে পত্নীরে!
এই কি তোমার চির নিয়ম পদ্ধতি?
অর্দ্ধাঙ্গিনী ফেলি রাখ অনাথিনী ক’রে!

নিদারুণ জ্বালা প্রাণে সহিতে না পারি।
দিবানিশি জ্বলে হৃদে বিষম অনল।
নাথের বিরহে ধৈর্য্য আর নাহি ধরি।
ত্যজিব এ ছার প্রাণ ভখিয়া গরল!

কাঁদিবার তরে বুঝি করিলে সৃজন?
পাষাণে গঠিয়া হিয়া এই দুঃখিনীরে।
জীবন-সম্বল সেই স্বামীর চরণ।
উদ্দেশে করিব স্নাত নয়নের নীরে।

কাঁদিবার তরে বুঝি জনম আমার!
কাঁদিব বলিয়া বুঝি এসেছি এ ভাবে?
কাঁদিয়া বহিব বুঝি এ জীবন ভার?
নয়ন সলিলে বুঝি কিছু জ্বালা যাবে।

এ জীবনে শুকাবে না এই অশ্রুধার।
এ জীবনে মুছিবে না বিষাদ কালিমা।


শতধা বিদীর্ণ হ’ল হৃদি চুরমার!
চির তরে অস্তমিত সে সুখ চন্দ্রমা।

চির তরে দুঃখ মম হ’য়েছে সঙ্গিনী।
চির তরে দুঃখ মম ভূষণ অঙ্গের।
বিধাতা করিল মোরে এ চিরদুঃখিনী।
দুঃখেতে ভরিয়া রবে স্থান হৃদয়ের।

হায় বিভু মোরে আর বল কি কারণ—
বিচ্ছিন্ন করিয়া মম প্রাণপতি সনে।
জীবন সম্বল সেই স্বামীর চরণ—
হারাইয়া পরমেশ! রহিব কেমনে?

জীবনসর্ব্বস্ব সেই আরাধ্য দেবতা।
কাঁদাইয়া অভাগীরে গিয়াছেন চলি!
রাখিয়াছ পরমেশ! নাথে ল'য়ে যথা।
তথায় লইয়া যাও কাতরেতে বলি।

নিয়তির চক্রখানি করি সঞ্চালন—
ল’য়ে যাও মোরে বিভু আর নাহি পারি।
ল’য়ে যাও যথা মম রেখেছ জীবন—
মিলাও তাঁহার সহ করুণা বিতরি।