মালা/শশধরের প্রতি

উইকিসংকলন থেকে

শশধরের প্রতি।

হাসিছে ধরণী চন্দ্রমা-কিরণে
হাসিছে কুমুদী প্রাণেশ-মিলনে
সরোবর মাঝে প্রফুল্লিত মনে
গগন উপরে শশীরে হেরি।

সারাদিন বালা ছিল যে মুদিত
প্রাণনাথে হেরি হ’ল প্রস্ফুটিত
হইল হৃদয় প্রেমে পুলকিত
প্রেম-সুধা পিয়ে হৃদয় ভরি॥

প্রেমের তরঙ্গে মাতাইয়া প্রাণ।
করিতেছে নাথে প্রেম প্রতিদান
প্রণয় সুধাতে বিভোর পরাণ।
আত্মহারা ধনী প্রেমেতে মজি।

তবে কেন সখি! আমি লো এখন
সহিতেছি এই বিরহ বেদন
না হেরিয়া মম পতি প্রাণধন
বিরহ-বিধুরা আমি লো আজি

বিষম বিরহে দহিছে হৃদয়
বিষ বরিষণ ও চঁদ সুধায়
চন্দ্রমা-কিরণ যেন বিষময়
 জ্বালায় দ্বিগুণ শশাঙ্ক মােরে।

হেরি ওই চাঁদ শুনলো সজনি!
মাের হৃদি চাঁদে মনে পড়ে ধনী
হতেছে আমার আকুল পরাণি
 হৃদি-চাঁদ বিন রহি আঁধারে॥

চাদের কিরণে নীরবে বসিয়া
কাটাই রজনী কাঁদিয়া কাঁদিয়া
ব্যাকুল অন্তর আকুল এ হিয়া
 শশধরে হেরি নয়ন ঝরে।

পড়ে মনে সেই চারু চন্দ্রানন
পড়ে মনে সম মুকুতা দশন
হেরিয়া ও চাঁদ অধীর যে মন
 অবলা জীবন ধরিতে নারে॥

সুধাসিক্ত সেই কি অমিয় হাসি
ছড়াইত প্রাণে পীযূষের রাশি
পিয়িবারে সুধা পরাণ পিপাসী
 কি প্রবল তৃষা রহে হৃদয়ে।


চন্দ্রমা-নিন্দিত রূপ সুমোহন
হৃদয়েতে মম ভাতে সর্ব্বক্ষণ
ও চাঁদে নিরখি দহে মম মন
যাপি যে যামিনী কাতরা হ’য়ে।৷

হাস তুমি সখি! হেরিয়া নাথেরে
আমি ভাসিতেছি নয়নের নীরে
না পারি সহিতে মরি যে গুমুরে
হৃদয়ে জ্বলে যে বিষম জ্বালা।

হাসিছ সজনী চাহি পতি পানে
আমি কাঁদি হেরি কুমুদী-রঞ্জনে
শত ধারা মম বহে দুনয়নে
চাঁদের কিরণে গরল ঢালা॥

সুধাকর পানে চাহি আমি যত
আকুল উচ্ছ্বাস প্রাণে জাগে কত
মনে পড়ে সেই মিলন নিশীথ
মনে পড়ে সেই প্রাণের কথা।

মনে পড়ে এই মিলন-মন্দিরে
ভাতিত কৌমুদী কিবা স্তরেস্তরে
বসিতাম যথা লইয়া নাথেরে
রহিয়া তথায় পাই যে ব্যথা।৷

হাস সখি! তুমি হাস প্রাণ খুলে
উন্মুক্ত করিয়া হৃদয় অর্গলে
লহ লহ ধনী হৃদয়েতে তুলে
 রাখ সযতনে ধরিয়া নাথে।

পাষাণ হৃদয় পুরুষ যে জাতি
ত্যজিবে অচিরে তােমারে গো সতী
বিরহ বেদনা সহিবে যে নিতি
 ফেলিয়া তােমারে যাইবে পথে॥

লম্পট চতুর তােমার নাগর
কলঙ্কমণ্ডিত ওই শশধর
প্রতি ফুলে সুধা ঢালে নিরন্তর
 এই কি তোমার প্রেমের রীতি।

কালিমা বর্জিত নিষ্কলঙ্ক চাদ
মরি কি সুন্দর সে মুখের ছাদ
বারেক হেরিতে মনে বড় সাপ
 প্রেমময় সেই প্রাণের পতি॥

হৃদাকাশ মাঝে হৃদি-শশধর
রহিত যে সদা উজলি অন্তর,
এবে অমানিশা বিনা প্রাণেশ্বর
 পূরণিমা নিশি নাহি লো এবে।


কোথা হৃদাকাশে সেই পূর্ণ শশী
প্রাণেশ বিরহে এ ঘোর তামসী
অধীর হৃদয় হেরি এই নিশী
অবলা হৃদয়ে কতই সবে।৷

সহে না এ ঘোর বিরহ যাতনা
প্রিয়তমে ছাড়ি বাঁচে কি ললনা
বাঁচে কি চাতকী জলধর বিনা
কভু মণি ছাড়ি রহে কি ফণী?

হেরিয়া সুধাংশু! গগনে তোমায়
জ্বলিতেছে প্রাণ বিরহ জ্বালায়
প্রাণনাথ বিনা প্রাণ বাহিরায়
তোরে হেরি জ্বলি প্রতি রজনী।৷

থাক থাক শশী গগন উপর।
প্রতি জ্যোতি আর মম অঙ্গোপর
ঢেলনা ঢেলনা বিষ নিরন্তর
জুড়ি দুই কর করি মিনতি।

মম দুঃখে তুমি বুঝি সুধাকর
প্রাণ খুলে হাসিতেছ নিরন্তর
ও বিদ্রুপে মোর দহে যে অন্তর
হ’তেছে পরাণ কাতর অতি।৷

মম হৃদয়েশ ত্যজি হৃদাকাশ
রাখিয়াছে মােরে করিয়া নিরাশ
তাই জানি বুঝি কর উপহাস
 বুঝিয়াছি তব মনের কথা।

প্রাণেশের সনে মিলন যখন
করিতাম সুখে নিশী জাগরণ
মাখিয়া শরীরে তােমার কিরণ
 হত সুখী মন দিও না ব্যথা॥

প্রিয়তম বিনা আঁধার হৃদয়
হইয়াছে এবে অতি দুঃখময়
এ দারুণ জ্বালা আর নাহি সয়
 অবলা সরলা সরল প্রাণে।

কেন প্রাণসখা নিদয় এখন
ভুলিয়াছ তব প্রেমাধিনী জন
তাহারে বধিছ কেন অকারণ
 তােমার বিরহ বিচ্ছেদ বাণে॥

ওহে প্রাণময় মম প্রাণেশ্বর!
মােরে ছাড়ি গেছ অমর-নগর
প্রেমিকের একি রীতি গুণাকর
 আশ্রিতা লতারে তরু কি ছাড়ে?


তুমি সুধাকর তব অঙ্গ জ্যোতি
বিহনে তোমার মলিন মূরতি
বিরহ অনলে জ্বলি দিবারাতি
মম এ হৃদয় সদাই পোড়ে।

রহে শশী বহু যোজন অন্তরে
প্রতি রজনীতে আসি নভোপরে
দেয় দেখা দেখ আপন প্রিয়ারে
রহে সুখে সতী পতি-মিলনে।

কেন নাথ! তুমি হইয়া নিদয়
ভুলিয়া রয়েছ তব প্রমদায়
হেন নির্দ্দয়তা উচিত না হয়
হওহে উদয় হৃদি গগনে—
এস হে নিদয়! মম সদনে॥