মিষ্টান্ন-পাক/প্রথম পরিচ্ছেদ

উইকিসংকলন থেকে

মিষ্টান্ন-পাক।

প্রথম পরিচ্ছেদ।

দুগ্ধ-প্রকরণ।

দুগ্ধ-জাত দ্রব্য-সমূহ।

নী বা মাটার পরিমাণ দেখিয়া-ই দুগ্ধের গুণাগুণ জানিতে পারা যায়। দুগ্ধ উত্তম হইলে, তাহাতে অধিক সর, আর নিকৃষ্ট হইলে অল্পমাত্র সর পড়িয়া থাকে। যে পাত্র উত্তমরূপ মার্জ্জিত হয় নাই, তাহাতে দুগ্ধ রাখিলে-ই তাহা নষ্ট হইয়া যায়।

 দুগ্ধ পুষ্টি-কর বটে; কিন্তু সকলের সহ্য হয় না। তিন অংশের এক অংশ চূণের জল মিশাইয়া পান করিলে, দুগ্ধে অম্ল বা অজীর্ণতা জন্মাইতে পারে না; বরং নিয়মিত পান করিলে, ঐ সকল রোগের শান্তি হয়। যাঁহার দুগ্ধ জীর্ণ হয় না, তিনি কোনরূপ অম্লরস মিশাইয়া ব্যবহার করিতে পারেন।

 নাড়ী-প্রদাহ রোগে দুগ্ধ উষ্ণ জলের সহিত মিশ্রিত করিয়া পান করিলে বিশেষ উপকার দর্শে।

 দুধের দোষ নাশ করিবার জন্য অনেকে দুধ জ্বাল দিয়া পান করিয়া থাকেন। কিন্তু যেখানে দুধ—স্তন-দুধের পরিবর্ত্তে ব্যবহার করিতে হইবে, সে স্থলে কদাচ তাহা জ্বাল দিবে না। উহাতে কুসুম কুসুম উষ্ণ জল মিশাইয়া লইবে।

 শরীর বৃদ্ধি ও শরীর রক্ষার নিমিত্ত যাহা কিছু আবশ্যক, বিশুদ্ধ দুধে সে সমস্ত-ই আছে। বিশেষতঃ, শিশুর পক্ষে, দুধ আপনাপনি-ই পরিপাক হইয়া যায়; কোন শক্তির-ই প্রয়োজন করে না। জ্বররোগীর পক্ষে অন্যান্য আহার অপেক্ষা বিশুদ্ধ দুধ বিশেষ উপযোগী; পুরাতন অজীর্ণ রোগে দুধ বিশেষ উপকার করে। পূর্ণ-বয়স্ক সুস্থ ব্যক্তির পক্ষে, দুধ কিছু উপযোগী খাদ্য নহে। যাহাদিগের দেহ এখন-ও সম্পূর্ণরূপে বৃদ্ধি পায় নাই, দুধ তাহাদিগের পক্ষে-ই বিশেষ উপযোগী। দুধে যে সকল পদার্থ আছে, জন্তু-ভেদে তাহাদিগের পরিমাণ ও গুণের ন্যূনাধিক্য হইয়া থাকে। অবস্থা-বিশেষে-ও এক জন্তুর দুধ-ই ভিন্ন ভিন্ন গুণাগুণ প্রাপ্ত হয়। নারীর দুধ লইয়া অন্যান্য দুধের গুণাগুণ বিচার করিতে হইবে। অন্যান্য জন্তু অপেক্ষা গাভীর দুধ-ই নারীর দুধের প্রায় সমান। এই জন্য-ই ইহা সাধারণতঃ অধিক পরিমাণে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন গাভী-দুগ্ধ নারী-দুগ্ধের পরিবর্ত্তে ব্যবহার করিতে হয়, তখন ইহাতে অধিক পরিমাণে শর্করা মিশ্রিত করা কর্ত্তব্য।

 বৃদ্ধ গাভী অপেক্ষা অল্প বয়স্কা গাভীর দুগ্ধ উৎকষ্ট। শিশুর পক্ষে, শিশুর বয়স অপেক্ষা, গাভীর বৎসের বয়স অল্প হইলে-ই ভাল হয়। অর্থাৎ যে গাভী দুই মাস প্রসূত হইয়াছে, তাহার দুধ চারি মাসের শিশুর পক্ষে বিশেষ উপকারী। প্রথম দোহন করা দুধ অপেক্ষা, শেষের দোহন করা দুধের মাটা অধিক। প্রাতঃকালের দুধ অপেক্ষা, অপরাহ্ণের দুধে অধিক নবনীত পাওয়া যায়। গাভীর আহার-ভেদে-ও দুধের বিলক্ষণ তারতম্য হইয়া থাকে। জঘন্য আহারে দুধের গুণ একেবারে হ্রাস করিয়া ফেলে। পলাণ্ডু, লশুন প্রভৃতি উগ্র উদ্ভিদে দুধে দুর্গন্ধ করে। বিষাক্ত উদ্ভিদ্ আহারে দুধ অনিষ্ট-জনক হয়; উৎকৃষ্ট দুধ পাইতে হইলে, গাভীকে সতেজ-তৃণ-পূর্ণ গোষ্ঠে চারণ করা-ই কর্ত্তব্য।

 আর্য্যেরা সকল জন্তুর দুগ্ধ পরীক্ষা করিয়া গিয়াছেন। দুগ্ধ বিষয়ে আর্য্যেরা কিরূপ পরীক্ষা করিয়াছেন, কোন জন্তুর দুধের কিরূপ গুণ—তাঁহারা কিরূপে বিবৃত করিয়া গিয়াছেন, তাহা নিম্নে লিখিত হইল।

 দুধমাত্রে-ই স্বাদু, স্নিগ্ধ, তেজস্কর, ধাতু-বর্দ্ধক, বাত-পিত্ত-হর, শুক্র-বৃদ্ধি-কর, শীতল, শ্লেষ্মকর এবং গুরু। এই গেল দুধমাত্রের-ই সাধারণ ধর্ম্ম। তাহার পর কোন্ জন্তুর দুধে কিরূপ গুণ আছে, তাহার পরিচয় দিতেছি।

 গোদুগ্ধ। —প্রাণ-ধারক, বল-কর, গুরুত্ব-কর, শুক্র-কর, মেধ্য অর্থাৎ বিশুদ্ধ, রক্তপিত্তরোগ-নাশক, এবং বায়ু-নিবারক।

 ছাগীদুগ্ধ।—মধুর, শীতল, মল-বর্দ্ধক, অগ্নি-কর, রক্তপিত্ত, বিকার ও শ্বাস-কাস-নাশক।

 মেষীদুগ্ধ।—গুরু, স্বাদু, স্নিগ্ধ, উষ্ণ, কফ-পিত্ত-নাশক।

 মহিষীদুগ্ধ।—অতি-স্নিগ্ধ, নিদ্রা-কর, অগ্নি-নাশক।

 উষ্ট্রীদুগ্ধ।—রুক্ষ, উষ্ণ, শোথ, বাত এবং কফ-নাশক।

 অশ্বীদুগ্ধ।—সলবণ, মধুরাম্ল, লঘু।

 হস্তিনীদুগ্ধ।—মধুর, শুক্র-কর, পশ্চাৎ কষায়, গুরু।

 নারীদুগ্ধ।—প্রাণ-ধারক, শরীর-হিত-কর, বল-কর, তৃপ্তিজনক প্রভৃতি গুণ বিদ্যমান আছে।

 নারী-দুধের পর-ই গো-দুগ্ধের উপযোগিতা। আর্য্যেরা এই জন্য গোদুগ্ধের-ই কিছু সবিস্তারে গুণ বর্ণনা করিয়াছেন। কোন্ সময়ে কিরূপ গোরুর দুধে কিরূপ গুণ, কোন্ দ্রব্য-ভক্ষিণী গাভীর দুগ্ধের কিরূপ গুণ, তাহা-ও আর্য্য আয়ুর্ব্বেদিকেরা বিবৃত করিয়াছেন ৷

 প্রত্যূষপানে গোদুগ্ধ গুরু, বিষ্টম্ভ, রোগোৎপাদক, দুর্জ্জর; এই জন্য সূর্য্যোদয়ের পর, অর্দ্ধ প্রহর অতিবাহিত হইলে, তাহার পর গোদুগ্ধ পান করিবে; তখন গোদুগ্ধ পথ্য, লঘু এবং অগ্নি-বর্দ্ধক। বৎস-হীনা এবং বালবৎসা গাভীর দুধে দোষ আছে। যে গাভী একবর্ণ বৎস প্রসব করিয়াছে, তাহার দুধ এবং শ্বেতবর্ণ ও কৃষ্ণ বর্ণ গাভীর দুধ প্রশস্ত! যে গাভী ইক্ষু, মাষকলাই, বৃক্ষপত্র ভক্ষণ করে, যাহার ঊর্দ্ধ শৃঙ্গ, এমন গাভীর দুধ কাঁচা-ই খাও, আর জ্বাল দিয়া-ই খাও, বিলক্ষণ উপকার পাইবে।

 বাসী দুগ্ধ।—বহু-দোষ-কর, গুরু, বিষ্টম্ভ, রোগ-কর, দুর্জ্জর।

 অপক্ক দুগ্ধ।—অনেক সময় পেট ভার করে, এবং অনেক সময়ে নেত্র-রোগ উৎপাদন করিয়া থাকে। কেবল নারী-দুধ-ই অপক্ক ব্যহার্য্য, আর সকল দুধ-ই জ্বাল দিয়া ব্যবহার করিতে হইবে।

 দুধ ছয়দণ্ড কাল অতপ্ত অবস্থায় রাখিলে বিকৃত হইয়া যায়। ছয় মুহূর্ত্ত অর্থাৎ বার দণ্ডের পর দোষোৎপাদক, দশ মুহূর্ত্তের পর তাহা বিষ-তুল্য।

 নব-প্রসূতা গাভী, ছাগী প্রভৃতির দুধ মধুর বটে, কিন্তু অধিক ক্ষারযুক্ত, রুক্ষ, পিত্ত, দাহ এবং রক্ত-রোগ উৎপাদন করে, এই জন্য উহা অপেয়। প্রথম প্রসূতা গাভী, ছাগী প্রভৃতির দুধ গুণ-হীন এবং অসার; মধ্যম বয়সের দুধ-ই তেজস্কর, বৃদ্ধ বয়সের দুধ দুর্ব্বল। প্রসূতা গাভীর তিন মাস পরে, যে দুধ হয়, তাহা-ই অতি প্রশস্ত।

 দুধ জ্বালে একবার উথলিয়া উঠিলে, তাহাকে এক বলকের দুধ কহে। দুর্ব্বল রোগীর পক্ষে এইরূপ দুধ খাদ্যে ব্যবস্থা, কারণ উহা গুরু-পাক নহে। দুধ জ্বালে যে পরিমাণ ঘন করা যায়, সেই পরিমাণে গুরু-পাক হইয়া উঠে।

 দুধ দ্বারা ক্ষীর, সর, মাখন প্রভৃতি অতি উপাদেয় খাদ্য-দ্রব্য-সমূহ প্রস্তুত হইয়া থাকে। নির্জ্জলা অর্থাৎ খাঁটি দুধ-ই উৎকৃষ্ট।

দুগ্ধের গুণাগুণ।

 গো, মহিষ, ছাগ, মেষ এবং গর্দভ প্রভৃতি প্রাণী সকলের দুগ্ধ মনুষ্যদিগের পানীয়। প্রাণি-ভেদানুসারে বিভিন্ন দুগ্ধের বিভিন্ন গুণ। সাধারণতঃ, সকল প্রকার দুগ্ধ-ই প্রাণধারণের উপযোগী, বল-কারক, আয়ুবর্দ্ধক, পুষ্টি-কর, শুক্র-জনক, অগ্নি-বর্দ্ধক, মেধা-স্মৃতি প্রভৃতির বৃদ্ধিকারক, নিদ্রা-কর, স্রোতঃ-শোধক এবং দোষ-নাশক। সকল প্রাণীর-ই দুগ্ধ সদ্যঃ-প্রসবের পরে ও প্রসবের বহুকাল পরে-ও নানা-দোষ-জনক হইয়া থাকে; এজন্য মধ্য-প্রসূতার দুগ্ধ-ই অত্যন্ত উপকারক। গর্ভিণীর দুগ্ধ-ও রস-গুণ প্রভৃতিতে নিতান্ত বিকৃত হইয়া থাকে; সুতরাং তাহা-ও পরিত্যাজ্য।

 অপক্ক দুগ্ধ গুরু-পাক আর শ্বাস-কাস প্রভৃতি রোগের উৎপাদক। এজন্য সকল দুগ্ধ-ই পক্ক অর্থাৎ জ্বাল দেওয়া প্রশস্ত। কিন্তু কেবলমাত্র নারী-দুগ্ধ-ই অপক্ক অবস্থাতে রোগ-নাশক এবং পানের উপযুক্ত। ধারোষ্ণ অর্থাৎ দোহনমাত্রে-ই গব্যাদি দুগ্ধ সর্ব্ব-রোগ-নাশক এবং অমৃতের ন্যায় উপকারক। দোহনের পর কিছুক্ষণ অবস্থিত থাকিলে-ই, সেই দুগ্ধ জ্বাল দিয়া পান করিতে হয়। দুগ্ধ প্রাতঃকালে পান করিলে, অগ্নি-বৃদ্ধি, শারীরিক পুষ্টি ও শুক্র বর্দ্ধিত হয়; মধ্যাহ্নে পান করিলে, বলের বৃদ্ধি, কফের নাশ ও মুত্র-কৃচ্ছ্রের নিবারণ হয়। রাত্রিকালে পান করিলে, নানা রোগের শান্তি হইয়া থাকে।

 বাল্য, যৌবন ও বার্দ্ধক্যে, সকল কালে-ই দুগ্ধ সমান উপকারী; অতএব, দুগ্ধ সকল সময়ে-ই সুপথ্য। আয়ুর্ব্বেদ মতে নবজ্বর, উদরাময়, শ্লৈষ্মিকপ্রমেহ প্রভৃতি কতিপয় রোগে দুগ্ধ অপকার করিয়া থাকে। মৎস্য, মাংস, লবণ, গুড়, মূলা, শাক ও জাম প্রভৃতি কতকগুলি দ্রব্যের সহিত একত্র দুগ্ধ পান করা উচিত নহে; তাহাতে নানাবিধ রোগ জন্মিতে পারে।

 দুগ্ধ পাক করিতে হইলে, চারি ভাগের এক ভাগ জল তাহার সহিত মিশ্রিত করিয়া পাক করিতে হয়। অধিক ঘন করিয়া দুগ্ধ পাক করা উচিত নহে; তাহাতে উহা অত্যন্ত গুরু-পাক হয়, সুতরাং মন্দাগ্নি ব্যক্তিদিগের উদরাময়াদি রোগ জন্মিতে পারে।

 দুগ্ধ আবর্ত্তিত করিলে, যে ফেন উদ্‌গত হয়, তাহা মধুর রস, অগ্নি-বর্দ্ধক, বল-কারক, উৎসাহ-জনক, বাত-নাশক, কৃশ ও মন্দাগ্নি ব্যক্তির বিশেষ উপকারক, এবং জরাতিসার, গ্রহণী ও বিষমজ্বর প্রভৃতিতে অত্যন্ত উপকারক।

 পাকা আমের সহিত মিশ্রিত দুগ্ধ মধুর-রস, শীত-বীর্য্য, অত্যন্ত গুরুপাক, রুচি-কর, বল-কারক, বল-বর্দ্ধক, পুষ্টি-জনক, কফ-বর্দ্ধক, এবং বাতপিত্ত-নাশক।

দুগ্ধের ছস্।

 দুইটি ডিমের হরিদ্রাংশ, এক চা-চামচ ময়দা, এক টেবল চামচ ভাল চিনি এবং পরিমাণ মত লেবুর খোসা চূর্ণ এক সঙ্গে উত্তমরূপ মিশ্রিত কর। যখন দেখিবে, সমুদায়গুলি বেশ মিশিয়া আসিয়াছে, তখন উহাতে তিন ছটাক দুধ কিংবা সর ঢালিয়া দিয়া জ্বালে চড়াও; কিন্তু জালে দুধ গরম হইলে অর্থাৎ ফুটিয়া উঠিবার আগে নামাইয়া লও। অধিকক্ষণ জ্বালে থাকিলে ছস্ জমিয়া যাইবে।

দুগ্ধের সূপ।

 কোয়ার্ট বোতলের এক বোতল পরিমাণ দুধ জ্বালে চড়াও। এদিকে এক চা-চামচ ময়দায় চারিটি ডিমের হরিদ্রাংশ উত্তমরূপ মিশ্রিত কর। এখন উহাতে উপযুক্ত পরিমাণ চিনি এবং অল্প মাত্রায় লবণ যোগ করিয়া রাখ।

 পূর্ব্বে যে দুধ জ্বালে চড়াইয়াছ, তাহা ফুটিয়া উঠিবার পূর্ব্বে, ঐ ডিমমিশ্রিত ময়দা, উহাতে ঢালিয়া দিয়া, নাড়িয়া চাড়িয়া নামাইয়া লও। ডিম মিশাইবার পর, জ্বাল পাইলে উহা জমিয়া আসিবে।

মাটা-তোলা দুধ।

 দুগ্ধ খাদ্য, পথ্য এবং ঔষধরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। অতি প্রাচীন কাল হইতে আয়ুর্ব্বেদ-শাস্ত্রে দুগ্ধের গুণাগুণ পরীক্ষিত হইয়া, জনসমাজে যার-পর-নাই উপকার সাধিত হইয়াছে। শোথ, যকৃৎ, প্রস্রাব অথবা হৃৎপিণ্ডের যে কোন রোগ হইতে শোথ হইলে, দুগ্ধ-ই একমাত্র পথ্য ও ঔষধের কার্য্য করিয়া থাকে। রুষিয়ার সুবিখ্যাত ডাক্তার কারল সাহেব, অধিকাংশ রোগে, রোগীকে দুগ্ধ পথ্য ও ঔষধরূপে ব্যবহার করিতে উপদেশ দেন। বিলাতের ডাক্তার ডনকিন্ সাহেব, প্রস্রাবের পীড়ায় অর্থাৎ বহুমূত্র রোগে, দুগ্ধ ব্যবহার করিতে বলেন। বিলাতের ডাক্তারেরা বহুমূত্র-রোগে মাটা-তোলা দুধ ব্যবস্থা করিয়া থাকেন। মাটা বা নবনীত তুলিয়া লইলে, যে দুধ অবশিষ্ট থাকে, ইংরাজিতে তাহাকে ‘স্কিম মিল্ক’ বলিয়া থাকে। এই দুগ্ধ অত্যন্ত উপকারী; সহজে পরিপাক হয়।

 পৃথিবীর সকল দেশে, একরূপ নিয়মে মাটা তোলা হয় না; অর্থাৎ গ্রীষ্মপ্রধান দেশে যে নিয়মে মাটা তোলা হয়, শীত-প্রধান দেশে অন্যরূপ নিয়ম অবলম্বিত হইয়া থাকে। আমাদের গরম দেশ; এখানে কাঁচা দুধ, অধিকক্ষণ রাখিলে, তাহা বিকৃত হইয়া থাকে। বিলাতে দশ বার ঘণ্টা পর্য্যন্ত রাখিলে-ও, কাঁচা দুধ নষ্ট হয় না। এজন্য তথায় কোন প্রশস্ত পাত্রে দুগ্ধ দোহন করিয়া, খোলা স্থানে রাখিতে হয়। শীতল বাতাস লাগিয়া, দুধের উপরে মাটা বা ননী জমিয়া থাকে। অনন্তর, তাহা তুলিয়া লইলে, অবশ্লিষ্ট দুধকে ‘স্কিম মিল্ক’ কহিয়া থাকে। মাটার ইংরাজি নাম ক্রিম অর্থাৎ সর। খাদ্য বা পথ্যের জন্য টাট্‌কা দুগ্ধ-ই উপকারী। রোগীর পরিপাক-শক্তি, বল এবং বয়স অনুসারে দুগ্ধের পরিমাণ স্থির করা আবশ্যক।

 দিবসের দুধ রাত্রিকালে ব্যবহার করা উচিত নহে; কারণ, তাহা বিকৃত হইবার সম্ভাবনা। রোগীকে এককালে অধিক পরিমাণে দুগ্ধ পান করিতে দেওয়া, স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নহে। কাহার-ও কাহার-ও মতে, বার ঘণ্টার মধ্যে চারিবার পান করিতে দিলে-ই চলিতে পারে। যেরূপ নিয়মে চা পান করা হয়, সেইরূপ নিয়মে, ঈষদুষ্ণ দুগ্ধ চামচে করিয়া পান করিলে, সমধিক উপকার হইবার কথা; কারণ, অল্প অল্প পরিমাণে দুগ্ধ পান করিলে, মুখের লালার সহিত মিশ্রিত হইয়া, উহা সহজে পরিপাক হয়। এককালে অধিক দুগ্ধ পান করিলে, পরিপাকের ব্যাঘাত জন্মিয়া থাকে।

 কোন কোন চিকিৎসক, উদরাময় না থাকিলে, দুধ জ্বাল না দিয়া, পান করিতে পরামর্শ দিয়া থাকেন। রোগীকে গরম দুধ পান করিতে দিতে হইলে, দুধ জ্বাল না দিয়া, একটি বোতলে পুরিয়া, সেই বোতলটি ফুটন্ত জলে কিছুক্ষণ ডুবাইয়া রাখিলে-ই, দুধ গরম হইবে। এই দুধ পান করা ভাল।

 আমাদের দেশে, দুধ জ্বাল দিয়া, তাহা হইতে সর তোলা হইয়া থাকে; এজন্য, এ-দেশীয় দুধ ও বিলাতি ননী বা ক্রিম তোলা দুধের গুণের তারতম্য হইয়া থাকে। এদেশে চিকিৎসকগণ, কাঁচা দুধ হইতে মাখন তুলিয়া, সেই দুধ রোগীর পথ্যে ব্যবস্থা করিয়া থাকেন।

 অম্লরোগে, অর্থাৎ যে সকল রোগীয় বুক জ্বালা প্রভৃতি উপসর্গ থাকে, তাহাদিগের জন্য দুগ্ধের সহিত গুঁড়া সোডা, চূণের জল কিংবা লবণ মিশাইয়া পান করিতে দিতে হয়। দুধের সহিত সামান্য পরিমাণে ভাতের ফেন, বার্লি-ওয়াটার, মেলিন্স্ ফুড প্রভৃতির যে কোনটি মিশাইয়া, পান করিলে, দুগ্ধ আমাশয়ে গিয়া, ছানায় পরিণত হয় না। এইরূপ দুগ্ধ সহজে হজম হয়।

দীর্ঘকাল দুগ্ধ রাখিবার উপায়।

 কটি বোতলে দুগ্ধ পূর্ণ করিয়া, এক-কড়া জলের ভিতর বোতলটি এরূপভাবে রাখিবে, যেন উহার মুখ জলের উপরে থাকে; অর্থাৎ দুধে যেন জল মিশিয়া না যায়। এখন বোতল-সহ কড়াখানি জ্বালে চড়াইবে। প্রায় পনর মিনিট পর্য্যন্ত এইরূপ অবস্থায় থাকিলে, উহা জল হইতে তুলিয়া লইবে। আর, যাহাতে বায়ু প্রবেশ করিতে না পারে, এরূপ করিয়া, বোতলটির মুখ আঁটিয়া রাখিবে। ফলতঃ, বায়ু প্রবেশ করিতে না পাইলে, এই দুগ্ধ এক বৎসরের অধিক কাল পর্য্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় থাকিবে। অধিক দিনের জন্য ভাল অবস্থায় দুধ রাখিতে হইলে, এমন সহজ উপায় আর দেখা যায় না।

 বিলাত অঞ্চলে ঘোড়ার খাদ্যের জন্য এক প্রকার গাজর উৎপন্ন হইয়া থাকে। সেই গাজর কুরিয়া এক চা-চামচ পরিমাণ এক কড়া দুধে দিলে, দুধ অধিক দিন পর্য্যন্ত ভাল অবস্থায় থাকে।

রক্ষিত বা জমান দুগ্ধ।

 দুগ্ধ যে আমাদের একটি প্রধান খাদ্য, এ কথা কেহ-ই অস্বীস্কার করিতে পারেন না। এই প্রয়োজনীয় দ্রব্য কোন সময়ে ও কোন্ স্থানে পর্য্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়, এবং কোন্ সময়ে ও কোন্ স্থানে ইহা দুষ্প্রাপ্য হইয়া থাকে, তাহা-ও অনেকে অবগত আছেন। যে স্থানে কোন সময়ে ইহা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, সেই স্থান হইতে সংগ্রহ করিয়া, যদি কোন উপায়ে অবিকৃত রাখা যায়, তাহা হইলে, যে স্থানে যে সময়ে দুগ্ধ দুস্প্রাপ্য হইর। উঠে, সেই সময়ে সেই স্থানে ইহার দ্বারা বিস্তর উপকার সাধিত হইতে পারে।

 ইংলণ্ড, ফ্রান্স, সুইজর্লণ্ড প্রভৃতি সুসভ্য দেশ-সমূহে দুগ্ধ জমাইয়া রাখিবার প্রথা প্রচলিত আছে। এমন কি, সেই দুধ আমাদের দেশে-ও আজকাল ব্যবহৃত হইতে আরম্ভ হইয়াছে। ‘কন্‌ডেম্‌ণ্ড মিল্ক’ নামে যে দুধ, এদেশে বালক, বালিকা, রোগী এবং চায়ের জন্য ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তাহা সুইজর্লণ্ড হইতে আনীত হয়।

 আমাদের দেশে দুধ যদি-ও প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হইয়া থাকে, কিন্তু কি নিয়মে যে, তাহা অধিক দিন পর্য্যন্ত অবিকৃতভাবে রাখিতে হয়, তাহা কেহ-ই অবগত নহেন। এদেশে দুগ্ধ-জাত ‘খোয়াক্ষীর’ কিছু দিন পর্য্যন্ত যদি-ও রাখা হইয়া থাকে, কিন্তু তাহাতে-ও এক প্রকার দুর্গন্ধ অনুভূত হয়। গরম জলে একবার সিদ্ধ করিয়া লইলে, ঐ গন্ধ অনেক পরিমাণে কমিয়া আইসে। ফলতঃ, ক্ষীরের দ্বারা দুধের অভাব মোচন হয় না। এজন্য দুধ এরূপভাবে রাখিবার কৌশল জানা আবশ্যক, যাহাতে উহার উপকারিতা কিংবা গুণের হ্রাস না হয়, অথচ প্রয়োজন মত ব্যবহার করিতে পারা যায়।

 একথা অবশ্য-ই স্বীকার্য্য যে, আমাদের দেশে দুগ্ধ কখন-ই অপ্রাপ্য হয় না; কিন্তু সময়ে সময়ে এত-ই দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠে যে, জমাইয়া রাখিবার উপায় সাধারণের জানা থাকিলে, এবং সেই উপায় অবলম্বন করিলে, বিস্তর উপকার হইতে পারে। এতদ্ব্যতীত ইহা-ও প্রমাণ দ্বারা জানা গিয়াছে যে, জমান দুগ্ধ টাটকা গো-দুগ্ধ অপেক্ষা কোন অংশে গুণে হীন নহে; বরং উহাতে টাটকা দুধ অপেক্ষা জলীয় অংশ অনেক কম, অতএব উহার পুষ্টিকারিতা-শক্তি-ও অধিক। ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশ-সমূহে, যে নিয়মে দুধ জমান হয় তাহা নিম্নে লিখিত হইল।

 প্রথমতঃ, দুধ ছাঁকিয়া একটি বড় পাত্রে রাখিতে হয়। পরে অপর কোন বৃহত্তর পাত্রে জল গরম করিয়া, সেই গরম জলের ভিতর দুগ্ধপাত্রটি এরূপভাবে স্থাপন করিবে, যেন তাহার মুখ খোলা অথচ জলের উপর-ই থাকে। এইরূপে কিছুক্ষণ দুধ জ্বাল দিলে, তাহার জলীয় অংশ বাষ্পাকারে উঠিয়া যাইরে। যখন দেখিবে যে, বাষ্পাকারে জলের অংশ উঠিয়া যাওয়ায় দুধের পরিমাণ কমিয়া আসিয়াছে, তখন পরিমাণ মত চিনি দিয়া খানিক-ক্ষণ জ্বালে রাখিবে। এই সময় দুধ মধুর ন্যায় আঠাআঠা হইয়া আসিবে।

 এদিকে, আর একটি বৃহৎ পাত্রে শীতল জল রাখিয়া, ঐ গরম দুধ-সহ পাত্রটি এরূপভাবে স্থাপন করিবে, যেন তাহার মুখ জলের উপরে থাকে; অর্থাৎ দুধে কোন মতে জল না প্রবেশ করে।

 এইরূপ অবস্থায় রাখিয়া দুধ শীতল হইলে, টিনের পাত্রে অথবা বোতলে পূরিয়া উত্তমরূপে মুখ আঁটিয়া রাখিবে। যত দিন পাত্রটি ভাল থাকিবে, তত দিন দুধ-ও অবিকৃত থাকিবে।

 এক বাটি (পেয়ালা) গরম চাতে এক চা-চামচ জমান দুধ দিলে ঊত্তমরূপ চা প্রস্তুত হইবে।

ঘৃত।

 ঘৃতের ভাল মন্দের উপর ঘৃত-পক্ক দ্রব্য-মাত্রের-ই উত্তমতা নির্ভর করিয়া থাকে। এজন্য ঘৃতের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, উহা প্রস্তুত করিতে হয়। সর ও মাখন, নবনীত বা মাটা দ্বারা ঘৃত প্রস্তুত হইয়া থাকে। মাখনের ঘৃত অপেক্ষা সরের ঘৃত অতি উৎকষ্ট। সর জ্বাল দিলে যে খাঁকরি উঠিয়া থাকে, তাহা ছাঁকিয়া লইলে, সরের ঘৃত প্রস্তুত হয়। এই ঘৃতের অতি সুগন্ধ।

 সরের ন্যায় আবার মাখন জ্বালাইয়া ঘৃত প্রস্তুত হইয়া থাকে। কাঁচা দুধ মন্থন করিলে যে নবনীত বা মাটা উঠে, তাহা জ্বাল দিয়া লইলে-ও ঘৃত উৎপন্ন হয়। তদ্ভিন্ন, ছানার জল, ঘোল মওয়ার ন্যায় মন্থন করিলে, তৈলবৎ যে পদার্থ ভাসিয়া উঠে, তাহা জ্বালাইয়া লইলে ঘৃত উৎপন্ন হয়। মন্থন না করিয়া-ও, ছানার জল আগুনের আঁচে বসাইয়া রাখিলে-ও, জলের উপর ঘৃত ভাসিয়া উঠে, তাহা জ্বাল দিয়া লইলে-ই অতি উপাদেয় ঘৃত পাওয়া যায়। সর ও ছানার ঘৃত কাঁচা খাইতে ভাল লাগে।

 ঘৃত-পক্ক দ্রব্য প্রস্তুত করিতে হইলে ঘৃত যে, তাহার একটি প্রধান উপকরণ, তাহা কাহাকে-ও বলিয়া দিতে হয় না। এস্থলে ইহাও জানা আবশ্যক যে, মন্দ ঘৃতে কোন দ্রব্য পাক করিলে, কেবলমাত্র যে, খাদ্য-দ্রব্য বিস্বাদ হইয়া থাকে এরূপ নহে, সেই খাদ্যে স্বাস্থ্যের-ও বিস্তর অপকার করিয়া তুলে। খাদ্য-দ্রব্য যে, শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষার একপ্রকার ভিত্তিস্বরূপ, তাহা মনে রাখিয়া, উহা প্রস্তুত ও ব্যবহার করা উচিত।

 খাদ্য-দ্রব্যের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণ করিবার জন্য অনেক সময় দেখিতে পাওয়া যায়, ঘৃতে নানা প্রকার রং ফলান হইয়া থাকে। কোন্ প্রকার বর্ণ করিতে হইলে, কি প্রকার উপায় অবলম্বন করা আবশ্যক, তাহা নিম্নে লিখিত হইল।

 এক সের পরিমিত ঘৃত জ্বালে বসাইয়া দাগ করিয়া লইবে। পরে, তাহাতে আট আনা জাফরাণ দিয়া, মৃদু-তাপে নাড়িতে থাকিবে। ঘৃতের উত্তম বর্ণ হইলে, বিলম্ব না করিয়া নামাইয়া, শীতল না হওয়া পর্য্যন্ত অনবরত কাটি বা খুন্তি দ্বারা নাড়িতে হইবে।

 হরিৎ বর্ণ।—ঘৃতে হরিৎ বর্ণ করিতে হইলে, আধপোয়া পালং শাক বাটিয়া, তদ্দ্বারা বড়া প্রস্তুত করিবে। এখন, এক সের পরিমিত ঘৃত জ্বালে চড়াইয়া দাগ করিয়া তাহাতে ঐ বড়াগুলি ঢালিয়া দিয়া, মৃদু তাপ দিতে থাক, দেখিবে ঘৃত হরিৎবর্ণ হইয়াছে।

 লোহিত বর্ণ।—একপোয়া পরিমিত কন্‌কানটে শাক বাটিয়া, এক সের পরিমিত ঘৃতে নিক্ষেপ করিয়া, উপরোক্ত উপায়ে প্রস্তুত করিলে, ঘৃতের বর্ণ লাল হইবে

 বাদামী বর্ণ।—আট আনা জাফরাণ, এক তোলা নারিকেল, এক সঙ্গে উত্তমরূপে বাটিয়া, তাহাতে একটি লেবুর (পাতি কিংবা কাগজি) রস মিশাইয়া বড়া প্রস্তুত করিবে। এদিকে, ঘৃত জ্বালে চড়াইয়া, তাহাতে ঐ বড়া নিক্ষেপ করিয়া, মৃদু তাপ দিতে থাকিবে; দেখিবে, ঘৃতের উত্তম বাদামী বর্ণ হইয়াছে।

 যদি-ও নানা উপায়ে ঘৃতের নানা প্রকার বর্ণ করা যাইতে পারে, কিন্তু কোন প্রকার দ্রব্য মিশাইয়া, উহার স্বাভাবিক গুণের পরিবর্ত্তন না করাই ভাল।

 আয়ুর্ব্বেদ-মতে ঘৃতের সাধারণ গুণ। — আয়ুর বৃদ্ধিকারক, শরীরের দৃঢ়তা-বর্দ্ধক, শীত-নাশক, বল-কারক, পথ্য এবং কান্তি, সৌকুমার্য্য, বুদ্ধি ও স্মৃতি প্রভৃতির বৃদ্ধি-কারক।

মাখন।

 দুগ্ধ থিতাইলে, উহার উপরে যে তৈলের মত পদার্থ ভাসিতে থাকে, তাহাকে-ই মাটা বলে। মাটা হইতে মাখন জন্মে। উদরে যখন কোন দ্রব্য-ই না তলায়, তখন-ও মাটা অনায়াসে-ই হজম করিতে পার যায়। মাটা-তোলা দুগ্ধে ঘৃতের ভাগ অল্প দেখা যায়, সুতরাং যে রোগীর জীর্ণ না হয়, তিনি স্বচ্ছন্দে মাটা-তোলা দুগ্ধ ব্যবহার করিতে পারেন।

 দধি বা দুগ্ধ মন্থন করিয়া যে ঘৃতের ভাগ পাওয়া যায়, তাহাকে-ই নবনীত বা মাখন বলে। মাখন তুলিয়া উত্তমরূপে ধুইয়া ও ফেটাইয়া লওয়া কর্ত্তব্য। তাহা হইলে উহা টাটকা থাকে এবং বিস্বাদ হয় না। মাখন টাট্‌কা রাখিবার জন্য উহাতে লবণ-ও মিশান হইয়া থাকে। বাতাস না লাগে, এরূপ করিয়া কোন পাত্র-মধ্যে রাখিয়া দিলে-ও, মাখন টাটকা থাকে। প্রত্যহ জল বদলাইয়া তাহাতে রাখিলে-ও মাখন টাটকা থাকিবে।

 যাহাদিগের পাক-শক্তি ক্ষীণ, তাহারা-ও বিশুদ্ধ টাটকা মাখন সহজে-ই জীর্ণ করিতে পারে; কিন্তু অধিক পরিমাণে ভক্ষণ করা কর্ত্তব্য নহে। বাসী, বিস্বাদ, দুর্গন্ধ বা উত্তপ্ত মাখন অজীর্ণ ও অন্যান্য রোগে অখাদ্য; খাইলে আমাশয় উৎপাদন করিবে। মাখন বিশুদ্ধ কি না, দৃষ্টি, আস্বাদ ও গন্ধ দ্বারা তাহা অনায়াসে-ই জানিতে পারা যায়। বিশুদ্ধ মাখনের বর্ণ উজ্জ্বল-পীত। মাথনে একখানি ছুরী শীঘ্র চালাইলে, যদি ডোবার মত দেখা যায়, তাহা হইলে জানিবে যে, তাহাতে অন্য দ্রব্য মিশান হইয়াছে। বিশুদ্ধ মাখন গলাইলে, অতি পরিষ্কৃত ঘৃত প্রস্তুত হইবে। বিশুদ্ধ মাখন জিহ্বায় দিলে সহজে-ই গলিয়া যাইবে, এবং বেশ মোলায়েম বোধ হইবে। মাখনের সুগন্ধ অধিকদিন থাকে। সুতরাং, মাখন ভাল কি মন্দ, গন্ধ দ্বারা তাহা ততদূর ঠিক করিয়া জানা যায় না।

 আয়ুর্ব্বেদ মতে মাখনের সাধারণ গুণ।—মধুর রস, শীতল, রুচি-কর, মল-রোধক, বর্ণ-কারক, কান্তি-জনক, বল ও শুক্রের বৃদ্ধি-কারক, পুষ্টি-কর, চক্ষুর হিতকর, শ্রান্তি-নাশক, বাত-কফ-নিবারক এবং সর্ব্বাঙ্গ-শূল, কাস, ক্ষয়, কৃশতা, শুক্র-হীনতা, স্নায়বিক দৌর্ব্বল্য ও বায়ু-রোগ-মাত্রে-ই বিশেষ উপকারী।

ব্রজ-মাখন।

 ভাল রকম জমাট দধি, ছানা বাঁধার ন্যায়, একখানি পরিষ্কৃত কাপড়ে কসিয়া বাঁধিয়া, ঝুলাইয়া রাখিবে। কিছুক্ষণ এইরূপ অবস্থায় থাকিলে, দধি হইতে জল ঝরিয়া পড়িবে; সুতরাং পুটলিটি অপেক্ষাকৃত ঢিলা হইয়া আসিবে; তখন বাঁধন খুলিয়া, পুনর্ব্বার কসিয়া বাধিয়া, পূর্ব্ববৎ ঝুলাইয়া দিবে। এইরূপ অবস্থায় রাখিলে, যখন দেখা যাইবে, দধি হইতে আর জল ঝরিতেছে না, তখন তাহা নামাইয়া লইবে। এখন এই দধি দেখিতে ঠিক মাখনের ন্যায় বোধ হইবে। অনন্তর, একটি পরিষ্কৃত পাত্রে এই দধি উত্তমরূপে ফেটাইয়া লইবে। পরে, তাহাতে মিছরি মিশাইয়া আহার করিবে। যে দধি অত্যন্ত অম্ল, তদ্দ্বারা উহা প্রস্তুত করিলে, তত সুখাদ্য হয় না; কারণ, অম্লের তীব্রতায় রসনার তত আদর-যোগ্য হয় না। হিন্দুশাস্ত্র মতে ব্রজ-মাখন অতি পবিত্র। দেব-ভোগে ব্যবহৃত হইয়া থাকে।


দধি।

 দুগ্ধে অম্ল-রস পতিত হইলে, তাহা বিকৃত হইয়া জমিয়া উঠিলে, দুগ্ধের সেই অবস্থাকে দধি কহিয়া থাকে। নানাপ্রকার নিয়মে দধি প্রস্তুত হইতে পারে। খাঁটি দুধ জ্বালে মারিয়া, সেই দুধ কোন পাত্রে রাখিয়া, অল্প গরম থাকিতে থাকিতে, তাহাতে অম্ল-রস দিয়া রাখিলে দধি জমিয়া উঠে। যে অম্ল-রস দ্বারা দধি প্রস্তুত হইয়া থাকে, তাহাকে “দম্বল” কহে। দধি, ছানার জল, তেঁতুল, এবং লেবুর রস প্রভৃতি দ্বারা দম্বল প্রস্তুত হইয়া থাকে।

 জ্বালে দুধ অধিক না মারিয়া কিংবা জল-মিশ্রিত দুধে যে দধি প্রস্তুত হয়, তাহা গাঢ় এবং তত সুস্বাদু হয় না। আর খাঁটি দুধ অর্দ্ধেক মারিয়া যে দধি প্রস্তুত করা যায়, তাহা উত্তম-রূপ জমিয়া থাকে, এবং তাহার আস্বাদ অতি তৃপ্তি-জনক হয়।

 মিষ্ট দধি প্রস্তুত করিতে হইলে, দুধ জ্বালের সময়, তাহাতে পরিস্কৃত চিনি কিংবা বাতাসা দিতে হয়। এই দধিকে ‘চিনি-পাতা’ দধি কহে। ভাল করিয়া তৈয়ার করিতে পারিলে, চিনি পাতা দধি বাস্তবিক রসনার লোভনীয়।

 দধি ভালরূপ না জমিলে, উহা গরমে রাখিতে হয়; অর্থাৎ যে পাত্রে দধি পাতা বা বসান হইয়া থাকে, তাহা কম্বল প্রভৃতি দ্বারা ঢাকিয়া রাখিলে-ই গরমে রাখা হইল। যতক্ষণ পর্য্যন্ত দধি ভালরূপ না জমিয়া উঠে, ততক্ষণ তাহা নাড়া চাড়া উচিত নহে। নাড়া চাড়া করিলে, জমার পক্ষে ব্যাঘাত জন্মে। এস্থলে ইহা-ও জানা আবশ্যক যে, দুধে অধিক দম্বল পড়িলে-ও ভাল জমে না, অধিকন্তু জল কাটিয়া থাকে। গাওয়া দুধ অপেক্ষা ভাঁইসা দুধে অতি উৎকৃষ্ট কঠিন আকারের দধি জমিয়া থাকে।

 আয়ুর্ব্বেদ মতে দধির সাধারণ গুণ।— অম্ল-মধুর রস, অম্লবিপাক, গুরু-পাক, শীতল, মল-রোধক, মুখ-রোচক, শোথ-জনক, বল-কর, শুক্র-বর্দ্ধক, পুষ্টি-কারক এবং অগ্নি-দীপক।

ভাপা দধি।

 দুধ জ্বালে চড়াইয়া অনবরত নাড়িতে থাকিবে, এবং জ্বালে অর্দ্ধেক মরিয়া আসিলে, উনান হইতে নামাইবে। এখন একটি মাটির পাত্রে উহা রাখিয়া, অনবরত নাড়িতে থাকিবে। কুসুম কুসুম গরম থাকিতে দুধে দম্বল দিবে। অনন্তর, গরম-জল-পূর্ণ একটি পাত্রের উপর দধি-পাত্র স্থাপন করিবে। নিয়মিত সময়ে উহা জমিয়া, ভাপা দধি প্রস্তুত হইবে।

 দধি-মিষ্ট আস্বাদনের করিতে হইলে, পাত্রটি জলে স্থাপনের পূর্ব্বে, উপযুক্ত পরিমাণ চিনি কিংবা বাতাসা- মিশাইবে। লবণাক্ত করিতে হইলে, চিনি না দিয়া, ঐ সময় লবণ দিতে হইবে। যখন দেখা যাইবে, দধি উত্তমরূপ জমিয়া আসিয়াছে, তখন তাহা খাদ্যে ব্যবহার করিতে হইবে। চীন-দেশীয় পাত্রে প্রথমতঃ অম্ল-দধি মাখাইয়া, তাহাতে গরম দুধ ঢালিয়া রাখিয়া দিলে, নিয়মিত সময়-মধ্যে সেই দুধ জমিয়া উত্তম দধি প্রস্তুত হইবে।

 দুধে সর না পড়ে এরূপ নিয়মে ক্রমাগত নাড়িতে থাকিবে। অনন্তর, সেই দুধ কোন পাত্রে স্থাপন করিয়া তাহাতে মিষ্ট দধির দম্বল দিলে, উহা গাঢ় দধি হইয়া উঠিবে। ক্ষীরের দধি প্রস্তুত করিতে হইলে, অগ্রে ক্ষীর প্রস্তুত করিয়া, তাহাতে পরিমিত দম্বল দিয়া রাখিবে, জমিয়া দধি প্রস্তুত হইবে। দধি পাতিবার পক্ষে মৃত্তিকা ও প্রস্তর-পাত্রই প্রশস্ত। দধি অধিক দিন রাখিলে, তাহা তীব্র-অম্ল হইয়া উঠে। কিন্তু কেমন আশ্চর্য্য, অত্যন্ত টক হইয়া পুনর্ব্বার তাহার অম্লত্ব হ্রাস হইয়া আইসে।

 দধি মন্থন করিয়া তাহার সার ভাগ তুলিয়া লইলে, যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহাকে ঘোল কহে। দধি যেরূপ পুষ্টি-কর, ঘোলের সেরূপ অনপুষ্টিকারিতা শক্তি নাই। কিন্তু সহজে-ই জীর্ণ হইয়া থাকে। ইহাতে আমাশা জন্মাইবার বা পেট কামড়াইবার কোন আশঙ্কা নাই। পেয় দ্রব্যের মধ্যে যোল অতি তৃপ্তি-কর। গাত্র-দাহের পক্ষে ঘোল বিশেষ উপকারক।

অমৃত-দধি।

 ধি, ক্ষীর কিংবা রাবড়ি প্রস্তুত করিতে হইলে, নির্জ্জলা অর্থাৎ খাঁটি দুগ্ধের দ্বারা না করিলে, কখন-ই উপাদেয় হয় না। এজন্য, সর্ব্বাগ্রে খাঁটি দুগ্ধ সংগ্রহ করিতে হয়। অমৃত-দধির পক্ষে গাভী-দুগ্ধ-ই উত্তম। প্রথমে, একখানি পরিষ্কৃত কড়াতে দুধ জ্বাল দিতে আরম্ভ করিবে। দুধ আওটাইতে আওটাইতে যখন দেখিবে, অর্দ্ধেকের কম মরিয়া আসিয়াছে, তখন নামাইবে। জ্বালের অবস্থায় যে, সর্ব্বদা নাড়িতে হয়, তাহা যেন মনে থাকে। সর্ব্বদা নাড়িবার দুইটি কারণ আছে; প্রথম কারণ এই যে, সর্ব্বদা না নাড়িলে, দুধ ধরিয়া বা আঁকিয়া যাইবার সম্ভাবনা; দ্বিতীয় কারণ এই যে, সর্ব্বদা নাড়িতে থাকিলে, দুধে সর জমিতে পারিবে না। সর পড়িলে, দুধের সারভাগ মরে সঞ্চিত হয়; সর তুলিলে, দুধের তত আস্বাদ থাকে না।

 আওটান অবস্থায় দুধ ঘন হইয়া আসিলে, তাহা জ্বাল হইতে নামাইবে; এবং নূতন মাটির পাত্রের ভিতরের চারিদিকে অম্ল-দধি মাখাইবে। অনন্তর, পূর্ব্ব-প্রস্তুত দুগ্ধ, ঈষৎ উষ্ণ থাকিতে থাকিতে; দধিলিপ্ত পাত্রে ঢালিয়া দিবে; এরূপ নিয়মে ঢালিয়া দিবে, যেন পাত্রটি পূর্ণ না হয়, অর্থাৎ কিছু খালি থাকে। এখন, অপর একটি বড় হাঁড়ি জল-পূর্ণ করিয়া, তাহাতে দুগ্ধ-সহ পাত্রটি স্থাপন করিবে, অর্থাৎ দুগ্ধের পাত্রটির যেন গলদেশ পর্যাস্ত জল-মগ্ন থাকে। এদিকে, অপর একটি হাঁড়ির তলদেশে একটি টাকার আয়তন-পরিমাণ ছিদ্র করিয়া তাহা জলের হাঁড়ির উপর স্থাপন করিবে। এখন, ময়দা বা মৃত্তিকার লেপ দ্বারা জোড়-মুখ আঁটিয়া দিবে। অনন্তর, জলের হাঁড়ি তপ্ত অঙ্গারের উপর বসাইয়া রাখিবে, দধি জমিয়া আসিবে। এই দধি মিষ্টাস্বাদবিশিষ্ট করিতে হইলে, দুধ জ্বাল দেওয়ার সময়, তাহাতে সের প্রতি এক ছটাক চিনি কিংবা বাতাসা দিবে। অমৃত-দধি রসনার অত্যন্ত তৃপ্তি-জনক।

 অমৃত-দধি (প্রকারান্তর)—বাঁধা দধি একখানি কাপড়ে করিয়া, তাহাতে দুধ ও এলাচ-চূর্ণ এবং চিনি মিশাইয়া ছা্ঁকিতে হইবে। দুধ ও চিনি এরূপ নিয়মে মিশাইয়া লইবে, যেন অধিক পাতলা কিংবা মিষ্ট কম বেশী না হয়। এইরূপে প্রস্তুত দধিকে অমৃত-দধি কছে।

পক্ষীর ত্বকে দধি জমান।

 দুগ্ধে দম্বল বা কোন রকম অম্ল-রস দ্বারা দধি বসান হইয়া থাকে। কিন্তু পক্ষীর ত্বকে উত্তম দধি জমিয়া যায়, তাহা অনেকে-ই অবগত নহেন। যে নিয়মে ত্বক্ দ্বারা দধি হইয়া থাকে, সে প্রণালী অতি সহজ। একটি পাথীর পাকস্থলী দুই ভাগে বিভক্ত করিলে, তন্মধ্যে কাগজের ন্যায় একখানি ত্বক্ বা চামড়া বাহির হইবে। অনন্তর, তাহা জলে উত্তমরূপ ধুইয়া পরিষ্কার করিবে। এখন উষ্ণ দুধে এই ত্বক্ এক ঘণ্টা পর্য্যন্ত ঘর্ষণ করিয়া, উহাতেই স্থাপন করিবে, দধি প্রস্তুত হইবে।

চীনের পাত্রে দধি বসাইবার নিয়ম।

 চীনের পাত্রে দম্বল মাখাইয়া, তাহাতে উষ্ণ দুগ্ধ স্থাপন করিলে, দধি জমিয়া উঠিবে।


আম্র-মুকুলের দধি।

 ষ্ণ দুগ্ধে আম্র-মুকুল চূর্ণ করিয়া দিলে, সুগন্ধ দধি প্রস্তুত হইবে। এই দধি অতি রুচি-জনক।


তক্র।

 ক্রকে ঘোল কহে। সাধারণতঃ ঘোল পাঁচ প্রকার; অর্থাৎ যে ঘোলে জল মিশান হয় না, আর সর থাকে, তাহাকে মণ্ড কহে। সর ও জল-শূন্য ঘোলকে মথিত কহিয়া থাকে। আর আধ ভাগ ভাল জল মিশান হইলে, তাহার নাম তক্র। এবং চারি ভাগের এক ভাগ জল-যুক্ত ও সর-হীন ঘোলকে ছবিকা কহে। এতদ্ভিন্ন সাধারণ নাম ঘোল।

 সর-যুক্ত ঘোল, গুরু-পাক, পুষ্টি-কারক ও কফ-বর্দ্ধক, আর নিদ্রা, তন্দ্রা ও জড়তা-জনক। যে ঘোলে অম্ল সর থাকে, তাহা-ও গুরুপাক, শুক্র-বর্দ্ধক, বল-কারক আর কফ-জনক। যে ঘোলের সমুদয় সর তুলিয়া লওয়া হয়, তাহা লঘু-পাক ও সুপথ্য। ঘোল-মাত্রে-ই ত্রিদোষ-নাশক, রুচি-কর, অগ্নি-বর্দ্ধক ও বর্ণের উৎকর্ষ-কারক এবং শ্রান্তি, ক্লান্তি, বমি, আমাতিসার, গ্রহণী, অগ্নি-মান্দ্য, বিসূচিকা, বাতজ্বর ও পাণ্ডু রোগে উপকারক।

ক্ষীর বা মেওয়া।

 নির্জ্জলা দুগ্ধে যেরূপ সুস্বাদু ক্ষীর প্রস্তুত হইয়া থাকে, জল-মিশ্রিত দুগ্ধে সেরূপ ক্ষীর হয় না। এজন্য প্রায়ই দেখা যায়, ব্যবসায়ি গণ উহাতে এরারুট, সুজি এবং পাণিফলের পালো ও চিনি মিশ্রিত করিয়া গাঢ় ও মিষ্ট করিয়া থাকে। খাঁটি দুগ্ধের ক্ষীরের বর্ণ যেরূপ উজ্জ্বল, জল-মিশ্রিত দুগ্ধের ক্ষীরের সেরূপ বর্ণ হয় না; এজন্য নির্জ্জলা দুগ্ধে ক্ষীর প্রস্তুত করা-ই প্রশস্ত। আকার-ভেদে ক্ষীরের ভিন্ন ভিন্ন নাম হইয়া থাকে। তিন ভাগ দুধ মারিয়া এক ভাগ রাখিলে, গাঢ় ক্ষীর হইয়া থাকে। আর সমুদার দুধ মারিয়া এক ভাগ রাখিলে, কঠিন ক্ষীর হয়, ইহাকে-ই খোয়া বা ডেলা ক্ষীর বলে। এই ক্ষীর সন্দেশ, বরফি এবং অন্যান্য প্রকার খাদ্য-দ্রব্যে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। কঠিন ক্ষীর বাটিয়া পাকে ব্যবহৃত হয়।


ক্ষীরের পাতা, ফুল ও ছাঁচ

 ক্ষীর দ্বারা পাতা, লতা, ফুল, ফল এবং নানাপ্রকার আকৃতি বিশিষ্ট ছাঁচ প্রস্তুত হইয়া থাকে। এই সকল দ্রব্য প্রস্তুত করা অতি সহজ। এদেশে রমণীগণ ঐ সকল সুদৃশ্য খাদ্য-দ্রব্য প্রস্তুত করিতে বিশেষ রূপ নিপুণতা প্রকাশ করিয়া থাকেন। দুধ অতি পবিত্র পুষ্টিকর খাদ্য, এজন্য হিন্দুজাতির মধ্যে দুগ্ধজাত খাদ্য বহুল পরিমাণে আদরের সহিত প্রস্তুত হইয়া থাকে।

 নির্জ্জলা দুগ্ধের ক্ষীর প্রস্তুত করিলে, তদুৎপন্ন যাবতীয় দ্রব্যের বর্ণ উজ্জল-শুভ্র হইয়া থাকে। জল-মিশ্রিত দুগ্ধের ক্ষীর ভালরূপ সাদা হয় না, প্রত্যুত উহার বর্ণ কাল হইয়া থাকে। এজন্য খাঁটি দুগ্ধদ্বারা ক্ষীর প্রস্তুত করা উচিত।

 ক্ষীরের ছাঁচ প্রভৃতি প্রস্তুত করিতে হইলে, দুধ মারিয়া, মোমের মত অর্থাৎ কাদার ন্যায় ক্ষীর তৈয়ার করিতে হয়। এই ক্ষীর দ্বারা যে কোন আকারের খাদ্য-দ্রব্য গঠন করা যাইতে পারে।

 পাথরের উপর নরুণ দ্বারা নানাপ্রকার খোদাই কাজ করিতে হয়। অর্থাৎ লতা-পাতা প্রভৃতি বহুবিধ মনোহর দৃশ্য খোদাই করিলে, ছাঁচ প্রস্তুত হইয়া থাকে।

 মোমের মত ক্ষীর প্রস্তুত হইলে, সেই ক্ষীরের এক একটি গুটি কাটিয়া লও, এবং পূর্ব্বোক্ত ছাঁচে অল্প পরিমাণে গরম ঘৃত মাখাইয়া তাহাতে ঐ গুটি আস্তে আস্তে টিপিয়া, ছাঁচের আকার-পরিমাণ বিস্তৃত করিলে, ছাঁচ প্রস্তুত হইল। অনন্তর অতি ধীরে ধীরে তাহা ছাঁচ হইতে তুলিয়া কাপড়ের উপর রাখিবে। অল্প-ক্ষণ থাকিলে, উহা কঠিন হইয়া আসিবে। ফল-কথা, ছাঁচের আকার ও কারিকুরী অনুসারে ক্ষীরের ছাঁচ প্রস্তুত হইয়া থাকে। সুতরাং পাতা, লতা এবং ফুল, ফল প্রভৃতি যে কোন আকারে প্রস্তুত হইবে, ক্ষীরের ছাঁচও ঠিক সেইরূপ আকারের তৈয়ার হইবে। এই সকল ক্ষীর-জাত দ্রব্য জল-খাবারের পাত্র প্রভৃতি সাজাইবার পক্ষে উত্তম। ক্ষীরের দ্রব্য অধিক দিন রাখিলে, তাহা হইতে একপ্রকার দুর্গন্ধ নির্গত হয়; সুতরাং তখন তাহা খাদ্যের পক্ষে সুখ-জনক হয় না।

ক্ষীরের নিচু।

 প্রথমে ক্ষীর লইয়া চটকাইয়া, মোমের মত্ত হইলে, তাহা দ্বারা এক একটি গুটি কাট, এবং প্রত্যেক গুটি দ্বারা নিচুর আকৃতি গঠন কর। এইরূপে সমুদায় গুটি প্রস্তুত হইলে, একটি পাত্রে রাখ।

 এখন, কিছু পোস্তদানা অল্প ভাজিয়া নামাইয়া রাখ। এই ভাজা দানাগুলি ক্ষীরের গঠিত নিচুর গায়ে কাঁটার ন্যায় বসাইয়া দেও। অনস্তর, আলতা বা নটকানের রঙে, ঐ পোস্তদানাগুলিতে অল্প অল্প ছোপ দিয়া রং করিয়া দেও। পাকা নিচুর যেরূপ রং হইয়া থাকে, ঠিক সেইরূপ রং করিয়া দিবে। রং দেওয়া হইলে, একটি লবঙ্গ ফুটাইয়া, উহার বোঁটা করিয়া দিবে। অনন্তর, তাহার কাছে দুই চারিটি বড় এলাচের দানা বসাইয়া দিবে। এইরূপে সমুদায় নিচুগুলির বোঁটা তৈয়ার হইলে, নিচুর পাতা-সমেত কচি ডাল ভাঙ্গিয়া পাত্রে রাখিয়া, তাহার গায়ে গঠিত নিচু বসাইয়া দিবে। এখন, উহা দেখিতে ঠিক্ নিচুর ন্যায় হইবে। হঠাৎ কেহ বুঝিতে পারিবে না যে, উহা তৈয়ারি নিচু। অবিকল গাছের ডাল-ভাঙ্গা নিচু বলিয়া বোধ হইবে।

ক্ষীরের আম।

 ক্ষীরের আম করিতে হইলে, খোয়া ক্ষীর লইতে হইবে। মনে কর, যদি এক সের পরিমাণ খোয়া লইয়া আম প্রস্তুত করিতে হয়, তবে উহাতে এক ছটাক কাশীর চিনি, এক কাঁচ্চা ভাল চিনি, আধ কাঁচ্চা ছোট এলাচ-চূর্ণ এবং কিঞ্চিৎ আম-আদার রস লাগিয়া থাকে।

 প্রথমে, একখানি পরিষ্কৃত কড়ায় ক্ষীর জ্বালে চড়াও; এবং তাহাতে কিঞ্চিৎ গরম দুধ ঢালিয়া দিয়া, খুন্তি দ্বারা নাড়িতে চাড়িতে থাক। জ্বালে গাঢ় হইয়া আসিলে, তাহাতে পূর্ব্বোক্ত উপকরণগুলি (আদার রস ব্যতীত) ঢালিয়া দেও। যখন দেখিবে, বেশ শক্ত গোছের হইয়া আসিয়াছে, তখন পাক-পাত্রটি জ্বাল হইতে নামাইয়া রাখ, এবং নাড়িতে নাড়িতে জুড়াইয়া আসিলে, তখন এই ক্ষীর লইয়া এক একটি গুটি কাটিয়া পাত্রান্তরে রাখ। অনন্তর, আম-আদার রস হাতে মাখিয়া, পুর্ব্বোক্ত ক্ষীরের গুটি লইয়া, আমের ন্যায় আকৃতি গঠন করিবে। অথবা গুটি কাটিবার পূর্ব্বে সমুদায় ক্ষীরে আদার রস দিয়া লইলে-ও চলিতে পারে। আর, যেরূপ ছাঁচে আম-সন্দেশ প্রস্তুত হয়, সেইরূপ ছাঁচে ক্ষীরের গুটি পুরিয়া, চাপিয়া তুলিয়া লইলে-ই, উত্তম ক্ষীরের আম প্রস্তুত হইয়া থাকে। সমুদায় আমগুলি গঠিত হইলে, আমের কচি পাতা-যুক্ত সরু সরু ভাল ভাঙ্গিয়া কোন পাত্রে রাখ, এবং তাহার কোলে কোলে এক একটি আম সাজাইয়া দেও।

ক্ষীরের পিচ্‌ফল।

 নিচুর ন্যায় ক্ষীর দ্বারা পিচ্‌ফল প্রস্তুত হইয়া থাকে। পিচ্ তৈয়ার করিতে হইলে, প্রথমে কঠিন গোছের ক্ষীর লইয়া একটি পাত্রে করিয়া জ্বালে চড়াইতে হইবে। এই সময় উহাতে অল্প পরিমাণ গরম দুধ মিশাইয়া, খুন্তি দ্বারা ঘন ঘন নাড়িতে থাকিবে। অনন্তর, উহা উত্তম গাঢ় গোছের হইয়া আসিলে, জ্বাল হইতে পাত্রটি নামাইবে।

 যখন দেখা যাইবে, ক্ষীর বেশ ঠাণ্ডা হইয়াছে, তখন তদ্দ্বারা এক একটি পিচ-ফলের সদৃশ ক্ষীরের পিচ্ গড়াইবে। পিচের মাথার দিক্‌টা অল্প বাঁকা ধরণের, সুতরাং গড়াইবার সময় তাহা যেন মনে থাকে। এইরূপে সমুদায়গুলি গঠিত হইলে, তাহার গায়ে যবের ছাতু মাখাইবে। ছাতু মাখান হইলে আল্‌তা গুলিয়া ছোপ দিয়া তাহার রং করিবে। এই সময় একটি কথা মনে রাখা আবশ্যক; অর্থাৎ পাকা পিচের সমস্ত অংশ এককালে লাল হইয়া উঠে না, সুতরাং কেবলমাত্র বাঁকের কাছ হইতে মুখ পর্য্যন্ত রং দিতে হয়। ফলতঃ, পাকা পিচের আকার ও বর্ণ বেরূপ দেখিয়াছ, অবিকল সেইরূপ করিবে। যাঁহারা প্রথমে উহা প্রস্তুত করিবেন, একটি পিচ্‌ফল সম্মুখে রাখিয়া তৈয়ার করিলে ভাল হয়। একটু হাতের নিপুণতা ভিন্ন উহাতে আর কিছুমাত্র বিদ্যা প্রকাশের প্রয়োজন হয় না।

 এক্ষণে গঠিত ও রঞ্জিত পিচ্‌গুলির বোঁটা করিতে হইবে। অতএব একটি লবঙ্গ ফুটাইয়া, তাহার পাশে বড় এলাচের দুই চারিটি দানা সাইয়া দেও, বোঁটা প্রস্তুত হইবে। অনন্তর, পিচের কচি পাতা-সমেত কচি ডাল আনিয়া থালায় রাখ এবং তাহার কোলে অর্থাৎ শাখার যে যে স্থানে ফল ধরে, সেই সেই স্থানে ঐ পিচ্‌গুলি সাজাইয়া দেও; দেখিবে উহা যেন ঠিক ডাল-সহ পিচ্‌সমূহ থালায় শোভা পাইতেছে। এখন উহা কুটুম্বিতা প্রভৃতিতে ব্যবহার কর।

ক্ষীরের কামরাঙ্গা।

 ক্ষীরের কামরাঙ্গা প্রস্তুত করিতে হইলে, কামরাঙ্গার ছাঁচে তৈয়ার করিতে হয়।

 খোয়া ক্ষীয়ে কিছু গরম গাওয়া ঘৃত ও জাফরান মিশাইয়া উত্তমরূপে চটকাইয়া লও। রেশ মোলায়েম গোছের হইয়া আসিলে, তখন সেই ক্ষীরের এক একটি গুটি কাট। এখন, এই গুটি কামরাঙ্গার ছাঁচে পুরিয়া চাপিয়া ধর, কামরাঙ্গা প্রস্তুত হইল। পরে, আস্তে আস্তে ছাঁচ হইতে বাহির করিয়া লও, দেখিবে ক্ষীরের অতি উৎকষ্ট কামরাঙ্গা প্রস্তুত হইয়াছে। এই কামরাঙ্গা জল-পানের থালা সাজাইবার পক্ষে, অতি আদরের সহিত ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

ক্ষীরের আপেল।

 ক্ষীরের রের সঙ্গে কিছু নটকানের রং মিশাইয়া, উহা বেশ করিয়া ঠাসিয়া লও। ইচ্ছা হইলে, এই সময় ছোট এলাচের গুঁড়া কিংবা গোলাপী আতর-ও দুই এক বিন্দু মিশাইতে পার। ক্ষীর উত্তমরূপ ঠাসা হইলে, তাহার গুটি কাটিবে। এখন, এই গুটি আপেলের ছাঁচে পূরিয়া বাহির করিয়া লইলে-ই, ক্ষীরের অতি সুদৃশ্য আপেল ফল প্রস্তুত হইল।

 এস্থলে জানা আবশ্যক, কেহ কেহ প্রথমে ক্ষীরের সঙ্গে নটকানের রং না মিশাইয়া, ছাঁচ হইতে বাহির করার পর রং দিয়া-ও থাকেন। কারণ, আপেল ফলের সমুদায় অঙ্গ একরূপ লাল হয় না। যে ষে স্থানে লাল হওয়া সম্ভব, সেই সেই স্থানে রং করা প্রয়োজন।

ক্ষীরেলা।

 খাঁটি দুধই ক্ষীরেলার পক্ষে প্রশস্ত। দুধ যে পরিমাণে নির্জ্জলা হইবে, ক্ষীরেলার আস্বাদ ও সেই পরিমাণে সুমধুর হইবে। মনে কর, তিন সের দুধের ক্ষীরেলা প্রস্তুত করিতে হইবে। প্রথমে একখানি পরিষ্কৃত কড়ায় দুধ ছাঁকিয়া, জ্বালে চড়াইবে। জ্বালের অবস্থায় সর্ব্বদা নাড়িতে থাকিবে। বিশেষতঃ, যখন দুধ উথলিয়া উঠিবে, তখন হইতে খুব ঘন ঘন কাটি দিয়া ঘুটিতে বা নাড়িতে হইবে। দুধ অর্দ্ধেক পরিমাণ জ্বলে মরিয়া আসিলে, তাহাতে সাত আটখানি চিনির বাতাসা দিয়া নাড়িতে থাকিবে। এবং যখন দেখিবে, দুধ মরিয়া গাঢ় হইয়া আসিতেছে, সেই সময় উহা এরূপ নিয়মে চারিধারে নাড়িতে থাকিবে, যেন কড়ার গায়ে ধরিয়া বা আঁকিয়া না যায়। অনন্তর, যখন দেখিবে, ক্ষীর শক্ত কাদার মত ঘন হইয়াছে, তখন জ্বাল হইতে কড়াখানি নামাইবে, এবং একখানি পরিষ্কৃত পিতলের খুন্তি দ্বারা কড়ার গায়ের অর্থাৎ চারি ধারের ক্ষীর চাঁচিয়া একত্রিত করিবে। একত্রিত করা হইলে, খুন্তি দ্বারা খুব নাড়িতে থাকিবে। নাড়িতে নাড়িতে উহা অত্যন্ত নরম মোমের মত হইয়া আঁটিয়া আসিবে। অনন্তর, তাহা কোন পরিষ্কৃত পাত্রে তুলিয়া রাখিলে-ই ক্ষীরেলা প্রস্তুত হইল।

 এই ক্ষীরেলা দ্বারা ক্ষীরের নিচু, পিচ্‌, আম প্রভৃতি নানাবিধ সুদৃশ্য খাদ্য প্রস্তুত হইয়া থাকে। ফলতঃ, পাচিকাদিগের নিপুণতা অনুসারে, ক্ষীর দ্বারা নানা প্রকার ফুল, ফল প্রভৃতি কুটুম্বিতায় ব্যবহার্য্য তত্ত্বের উপযোগী দ্রব্য প্রস্তুত হইতে দেখা যায়। হিন্দু রমণীদিগের ন্যায় অন্য কোন দেশীয় মহিলাগণ ক্ষীরের উপাদেয় খাদ্য প্রস্তুত করিতে সমর্থ নহেন।

নষ্ট বা নট ক্ষীর।

 যে পাত্র উত্তমরূপে মার্জ্জিত হয় নাই, তাহাতে দুধ রাখিলে-ই তাহা নষ্ট হইয়া যায়। কাঁচা দুধ অধিক-ক্ষণ জ্বাল না দিয়া রাখিলে-ও, তাহা বিকৃত হইয়া থাকে। নট দুধ খাইতে অম্ল বোধ হয়। এই দুধ খাইলে, অম্লশূল, আমাশয় ও মুখে ক্ষত-রোগ জন্মে।

 কেহ কেহ আবার দুধে অল্প অম্ল-রস দিয়া, তাহা নট করিয়া লইয়া থাকেন। নট দুধ জ্বালে মারিয়া, ঝুরা ক্ষীরের ন্যায় করিতে হয়। আর, জ্বালের অবস্থায় তাহাতে চিনি কিংবা বাতাসা মিশাইয়া লইলে, উহার একপ্রকার মিষ্ট আস্বাদন হইয়া থাকে।

 নট-দুধ জ্বালে চড়াইয়া, অনবরত নাড়িতে হয়; কারণ, নাড়া কম হইলে, উহা আঁকিয়া যাইবার সম্ভাবনা। নট-দুধ আঁকিয়া উঠিলে, তাহা একপ্রকার অখাদ্য হইয়া থাকে। জ্বালের অবস্থায় যখন দেখা যাইবে, কড়া ও কাটির গায়ে দুধ কামড়াইয়া ধরিতেছে, এবং তাহার জলীয় ভাগ মরিয়া আসিয়াছে, তখন উহা নামাইয়া পাত্রান্তরে তুলিয়া লইলে-ই নট-ক্ষীর প্রস্তুত হইল।

তাল-ক্ষীর।

 প্রথমে খাঁটি দুধ জ্বালে চড়াইবে এবং তাহার সিকি পরিমাণ মারিয়া তাহাতে তালের মাড়ি ঢালিয়া দিবে। এস্থলে আর একটি কথা জানা আবশ্যক, অর্থাৎ তাল ক্ষীরে অর্দ্ধেক দুধ, অর্দ্ধেক তালের মাড়ি, আবার কখন কখন তিন ভাগ দুধ, আর এক ভাগ তালের মাড়ি ব্যবহৃত হইয়া থাকে। দুধে তালের মাড়ি ঢালিয়া দিয়া, উহা ঘন ঘন নাড়িতে থাক; এবং এই সময় হইতে, মৃদু জ্বাল দিতে থাক। নাড়িতে নাড়িতে যখন দেখা যাইবে, কাটির পায়ে উহা কামড়াইয়া ধরিতেছে তখন তাহাতে পরিষ্কৃত চিনি বা বাতাসা (রুচি অনুসারে) ঢালিয়া দিবে, এবং একটু জ্বালে রাখিয়া নামাইয়া, উহাতে ছোট এলাচের গুঁড়া এবং অল্প পরিমাণে কর্পূর দিয়া লইলে ভাল হয়। উহা শীতল হইলে, আহার করিয়া দেখ, তালক্ষীর কেমন সুখাদ্য।

আতা-ক্ষীর।

 সুপক্ক আতার শাঁস ও মাড়ি বাহির করিয়া রাখিবে। এরূপ নিয়মে বাহির করিবে, উহার সহিত যেন আতার বিচি না থাকে। এদিকে খাঁটি দুধ জ্বালে চড়াইয়া নাড়িতে থাকিবে। অর্দ্ধেক মরিয়া আসিলে, তাহাতে আতার মাড়ি ও পরিষ্কৃত চিনি মিশাইয়া নাড়িতে থাকিবে। ক্ষীরের আকারে পরিণত হইলে, নামাইবে। শীতল হইলে, রুচি অনুসারে দুই এক বিন্দু গোলাপী আতর মিশাইয়া লইবে। আতা-ক্ষীর অতি উপাদেয় খাদ্য।

ক্ষীরের গোবিন্‌ভোগ।

 মিষ্ট দ্রব্য মধ্যে গোবিন্‌ভোগ অতি সুমিষ্ট, রসমা-তৃপ্তি-কর, উপাদেয় খাদ্য। মনে কর, যদি একসের ক্ষীরে গোবিনভোগ প্রস্তুত করিতে হয়, তবে একসের সফেদা, এক পোয়া বেসম এবং উপযুক্ত জাফরাণ, ছোট এলাচ ও গোলমরিচ চূর্ণ, ঐ ক্ষীরের সহিত জল দিয়া গুলিয়া খুব ফেটাইতে থাক। মতিচুর ও মেঠাইয়ের গোলা যেরূপ নিয়মে ফেটাইতে হয়; এই গোলাও সেইরূপ ফেটাইবে। উত্তমরূপ ফেটান হইলে, তখন একখানি কড়াতে ঘৃত জ্বালে চড়াও; এবং উহা পাকিয়া আসিলে, বুঁদে ঝাড়ার ন্যায় ভাজিয়া, চিনির রসে ফেল। অনন্তর, রস হইতে তুলিয়া, মিঠাই বাঁধার ন্যায় বাঁধিয়া লইলেই, গোবিন্-ভোগ প্রস্তুত হইল।

ক্ষীরের মাছ।

 ক্ষীরের ছাঁচ ও নিচু প্রভৃতি প্রস্তুত করিতে যেরূপ ক্ষীর ব্যবহৃত হইয়া থাকে, সেইরূপ ক্ষীরে অল্প পরিমাণে গরম গাওয়া ঘৃত মিশাইয়া, উত্তমরূপে ঠাসিয়া লইবে। যখন দেখা যাইবে, বেশ খিচ্-শূন্য অথচ মোমের ন্যায় নরম হইয়া আসিয়াছে, তখন সেই ক্ষীরের এক একটি গুটি কাটিবে। মাছের ছাঁচে সেই গুটি পুরিয়া, অল্প অল্প চাপে মাছ তৈয়ার করিবে। পরে ছাঁচ হইতে বাহির করিলে-ই, ক্ষীরের মাছ প্রস্তুত হইল। এখন, এই মাছে তিনটি করিয়া কিস্‌মিস্ বসাইয়া দিলে-ই, ক্ষীরের মাছ দেখিতে বেশ সুদৃশ্য হইবে।


ক্ষীরের যোসি।

 ক্ষীরের সহিত অল্প পরিমাণে মিহি ময়দা মিশাইয়া, সরু তারের ন্যায় পাকাইয়া লও। এখন, তাহা নখে করিয়া ছোট অর্থাৎ কিছু লম্বা ধরণে কাটিতে থাক। কাটিতে গেলে, যদি হাতে জড়াইয়া ধরে, তবে হাতে অল্প ময়দা মাখিয়া পাকাইয়া লইবে; আর জড়াইয়া লাগিবে না। এই কর্ত্তিত কুচিগুলি ঘৃতে ভাজিয়া লও। এ দিকে, দুধ জ্বালে অর্দ্ধেক মারিয়া তাহাতে ভাজা কুচিগুলি ফেলিয়া দেও, এবং উপযুক্ত পরিমাণে হয় চিনি নতুবা বাতাসা দিয়া জ্বাল দিতে থাক। ইচ্ছা হয় যদি এই সময় বাদাম ও পেস্তা এবং ছোট এলাচের দানা মিশাইতে পার। এই সকল দিলে, উহার আস্বাদ অপেক্ষাকৃত সমধিক সুমধুর হইবে। জ্বালের অবস্থায় বেশ ঘন হইলে, নামাইয়া লও। এই সুখাদ্য দ্রব্যকে ক্ষীরের যোসি করে।


ক্ষীর-কমলা।

 ক্ষীর-কমলা পাক করিতে হইলে, খাঁটি দুধ সংগ্রহ করিবে। জলীয় দুধে উহার আস্বাদ ভাল হয় না। আর যে লেবু অম্লরস-বিশিষ্ট, তদ্বারা পাক করিলে, দুধ ছিঁড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। এজন্য খাঁটি দুধ ও মুমিষ্ট লেবু লইয়া, ক্ষীর-কমলা প্রস্তুত করিতে হয়।

 প্রথমে, দুধ জ্বাল দিতে আরম্ভ করিবে। মৃদু জ্বালে ঘন ঘন নাড়িয়া, দুধ আওটাইতে থাকিবে। যখন দেখিবে, দুধ বেশ ঘন হইয়া আসিয়াছে, অর্থাৎ চন্দনে ক্ষীরের ন্যায় হইয়াছে, তখন তাহাতে চিনি ও কমলালেবুর রস দিবে। খাঁটি দুধ হইলে, প্রতি সেরে এক ছটাক চিনি দিলে, সুমিষ্ট হইবে। দুধে চিনি দিলে-ই, দুধ একটু পাতলা হইয়া আসিবে। এজন্য চিনির পরিবর্ত্তে সাদা বাতাসা দিতে পারা যায়। আর লেবুর খোসা, চিনি প্রভৃতি পরিষ্কৃত করিয়া, কোয়াগুলি পাতলা নেকড়ায় চিপিয়া, রস বাহির করিবে। পরে সেই রস দুধে দিবে। কেহ কেহ আবার রসের সহিত লেবুর কতক কুয়া ছাড়িয়া-ও দিয়া থাকেন। দুধ মরিয়া ক্ষীর হইলে, তাহা জ্বাল হইতে নামাইবে। ক্ষীর শীতল হইলে, উহাতে দুই এক ফোঁটা (পরিমাণ বুঝিয়া) গোলাপী আতর দিলে, ক্ষীর-কমলা অপেক্ষাকৃত উপাদেয় হইয়া থাকে। মিষ্ট খাদ্য-দ্রব্যের মধ্যে ক্ষীর-কমলা যার-পর-নাই রসনা তৃপ্তিকর।

ক্ষীর-আম।

 ক্ষীর-আম অতি উপাদেয় মুখ-রোচক পরিত্র খাদ্য। কাঁচা আমের রসে ইহা প্রস্তুত হইয়া থাকে বলিয়া ইহার নাম ক্ষীর-আম। দুই প্রকার নিয়মে এই খাদ্য প্রস্তুত হইয়া থাকে। ক্ষীরের জন্য নির্জ্জলা দুগ্ধ-ই প্রশস্ত। দুধে জল থাকিলে, উহার আস্বাদন পান্‌সা হয়। প্রথমতঃ, কাঁচা আমের খোসা ছাড়াইয়া, তাহা উত্তমরূপে ধুইয়া লইবে। পরে, পরিষ্কার শিলে ছেঁচিয়া রস বাহির করিয়া, একটি পাত্রে রাখিবে। এস্থলে একটি কথা মনে রাখা আবশ্যক, সকল আমের একরূপ অম্লত্ব থাকে না; এ জন্য প্রতি সের দুধে কি পরিমাণ রস দিতে হয়, তাহা অনুমান দ্বারা ঠিক করিয়া লওয়া উচিত ৷

 দুধে অম্ল রস সংযোগ হইলে, উহা বিকৃত অর্থাৎ কাটিয়া বা ছিঁড়িয়া যায়, তাহা সকলেই অবগত আছেন। কিন্তু ক্ষীর-আমে দুধ আদৌ বিকৃত হয় না। যে নিয়মে আম্র-রস মিশাইলে, দুধ বিকৃতব হয় না, তাহা জানা আবশ্যক। আম্র-রস মিশাইবার সময় উহা খুব নাড়িতে অর্থাৎ হাতা করিয়া ফেটাইতে থাকিবে, এবং সেই অবস্থার ক্রমে ক্রমে অল্প পরিমাণে আমের রস ও চিনি মিশাইয়া, উহা জ্বালে চড়াইবে। আম্র-রস ও চিনি এমন নিয়মে মিশাইতে হইবে; তাহার যেন মধুরান্ন আস্বাদন হয়। অনন্তর, জ্বালে উহা গাঢ় অর্থাৎ কাটির গায়ে কামড়াইয়া ধরিতে আরম্ভ হইলে, নামাইয়া লইবে।

 দ্বিতীয় প্রণালী।—অগ্রে ক্ষীর প্রস্তুত করিয়া, সেই ক্ষীরে পূর্ব্বোক্ত নিয়মে আম্র-রস ও চিনি মিশাইয়া লইলে-ই; ক্ষীর-আম প্রস্তুত হইবে। কেহ কেহ আবার উহাতে ছোট এলাচদানা-চূর্ণ ও কর্পূর দিয়া থাকেন। রুচি অনুসারে দুই এক বিন্দু গোলাপী আতর-ও ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ফলতঃ, যাহাতে কাঁচা আমের গন্ধ নষ্ট না হয়, তৎপ্রতি দৃষ্টি রাখিয়া, ঐ সকল উপকরণ মিশাইতে হয়।

আঙ্গুর-ক্ষীর।

 প্রথমে আঙ্গুরগুলি বোঁটা ফেলিয়া দিয়া পরিষ্কার করিবে যেগুলি পচা বা দাগী, তাহা ফেলিয়া দিবে। এখন, এক পোয়া আঙ্গুর অল্প জলে সিদ্ধ করিয়া তাহার রস বাহির করিবে। রস বাহির করিয়া, একটি পরিষ্কৃত পাক-পাত্রে রাখিয়া, তাহা মৃদু জ্বালে বসাইবে। রস গরম হইলে, তাহাতে এক ছটাক চিনি মিশাইবে। তাপে ফুটিতে আরম্ভ হইলে, দুইটি ডিমের হরিদ্রাংশ ফেনাইয়া, উহাতে ঢালিয়া দিয়া, নাড়িতে চাড়িতে থাকিবে। যখন দেখিবে, রস ঘন হইয়া আসিয়াছে, তখন তাহাতে পরিমাণ-মত গোলাপ-জল, অথবা রসের ঠাণ্ডা অবস্থায় দুই এক ফোঁটা গোলাপী আতর মিশাইয়া, একবার ভাল করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া লইলে-ই, আঙ্গুরের উপাদেয় ক্ষীর প্রস্তুত হইল। এই ক্ষীর অত্যন্ত সুখাদ্য এবং পুষ্টি-কর। শরীরের বল-বৃদ্ধির পক্ষে আঙ্গুর-ক্ষীর যার-পর-নাই উপকারী।

রাবড়ি।

 পকরণ ও পরিমাণ।—দুগ্ধ আড়াই সের, পাথুরে চূর্ণের জল আধ তোলা, মিছরি-চূর্ণ আধ পোয়া, ছোট-এলাচ-চূর্ণ আধ তোলা, গোলাপী আতর ঈষৎ।

 প্রথমে, দুধে আধ তোলা চূণের জল মিশাইয়া জ্বালে চড়াইবে। জ্বালে উহা গরম হইয়া আসিলে, পাখা লইয়া ধীরে ধীরে বাতাস দিবে, এবং ডা’ন হাতে খড়িকা অথবা সরু শলা বা অন্য কোন দ্রব্য দ্বারা দুগ্ধোপরি পতিত পাতলা সর আস্তে আস্তে টানিয়া লইয়া, কড়ার গায়ে, চারি ধারে সংলগ্ন করিয়া রাখিবে। এইরূপে, যেমন সর পড়িবে, অমনি তাহা কড়ার কিনারায় লাগাইতে থাকিবে, এবং মধ্যে মধ্যে দুধ নাড়িয়া দিবে। জ্বালে যখন আড়াই সের দুধের মধ্যে, আধ সের অবশিষ্ট থাকিবে, তখন দুধ নামাইয়া পাত্রের চারি ধারের সংলগ্ন সর দুধে মিশাইয়া দিবে। এই সময় উহাতে মিছরি, এলাচ-চূর্ণ এবং গোলাপী আতর দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া লইলে-ই, উৎকৃষ্ট রাবড়ি প্রস্তুত হইল। এখন, উহা রসনায় দিয়া দেখ, রাবড়ি কেমন উপাদেয় খাদ্য।

 উপরিলিখিত উপকরণ ব্যতীত অর্থাৎ কেবল মাত্র দুগ্ধ ও পরিষ্কৃত চিনি দ্বারা-ও রাবড়ি প্রস্তুত হইতে পারে। পূর্ব্ববৎ নিয়মে প্রস্তুত করিতে হইবে।

নমস্।

 মস্ অতি উপাদেয় খাদ্য; সামান্য ব্যয় ও পরিশ্রমে উহা প্রস্তুত হইয়া থাকে। কেবলমাত্র দুধ ও মিছরি কিংবা চিনি দ্বারা উহা পাক করিতে হয়। যে পরিমাণ দুধ লইয়া নমস্ তৈয়ার করিবে, তাহার উপযুক্ত মিছরি অথবা পরিষ্কৃত চিনি লইবে। প্রথম, দুধ উত্তমরূপ জ্বাল দিয়া, তাহাতে মিছরি কিংবা চিনি মিশাইয়া, রাত্রে শিশিরে রাখিবে। পর-দিবস ঘোল মওয়ার ন্যায় মন্থন করিবে। মন্থন-সময় উপরে যে ফেনা উঠিবে, তাহা তুলিয়া লইলে-ই, নমস্ তৈয়ার হইল।

বসন্তী।

 রাব্‌ড়ির ন্যায় বসন্তী-ও অতি উপাদেয় খাদ্য। যে নিয়মে রাব্‌ড়ি প্রস্তুত করিতে হয়, সেই নিয়ম অনুসারে দুধে সর জমাইতে হয়, এবং কতক পরিমাণে সর জমিলে, তাহাতে পরিষ্কৃত চিনি মিশাইয়া, জ্বাল হইতে নামাইতে হয়। ইচ্ছা করিলে আবার, এ সময় চিনি না দিয়া, উহা ঠাণ্ডা হইলে, চিনিতে দুই এক ফোঁটা গোলাপী আতর মিশাইয়া, ঐ চিনি দুধে মিশাইলে, অতি উপাদেয় হইয়া থাকে। দুধে যে সর পড়িবে, তাহা দুধের সহিত ছিঁড়িয়া বা কুঁচাইয়া দিতে হয়। ফলতঃ, খুব নাড়িতে আরম্ভ করিলে-ই, সর আপনা হইতে-ই কুঁচি কুঁচি হইয়া আসিবে। যদি চিনির সহিত আতর দিতে ইচ্ছা না কর, তবে গোলাপ জলে দুই এক ফোঁটা আতর মিশাইয়া, ঐ জল দুধে ঢালিলে-ও হইতে পারে। আতর অভাবে, ভাল গোলাপ জল দ্বারা গোলাপী গন্ধ করা যাইতে পারে। আতর মিশাইলে, গন্ধ অধিকক্ষণ স্থায়ী হইয়া থাকে। ফলতঃ, রাব্‌ড়ি ও বসন্তীর পাক প্রায় এক-ই প্রকার। ক্ষীর যেরূপ গাঢ়, বসন্তী-ও সেইরূপ গাঢ় করিতে হয়; প্রভেদের মধ্যে উহার সহিত সরের কুঁচি ও গোলাপের গন্ধ থাকাতে, ক্ষীর অপেক্ষা উহা অত্যন্ত রসনাতৃপ্তি-কর।

সর-পূরিয়া

 র-পূরিয়া ও সর-ভাজার জন্য কৃষ্ণনগর বিশেষরূপ প্রসিদ্ধ। খাঁটি দুধে-ই উহা ভাল হইয়া থাকে। দুইখানি কড়ায়, প্রত্যেক খানিতে আড়াই সের করিয়া দুধ জ্বালে চড়াও। জালের অবস্থায় নাড়িতে হয়, তাহা যেন মনে থাকে। বিশেষতঃ, দুধ উথলিয়া আসিলে, ঘন ঘন নাড়িতে হইবে। এই সময় উনানের আঁচ বা জ্বাল কমাইয়া দিবে, এবং নাড়া বন্ধ করিবে। আঁচ কমিয়া আসিলে, আপনা হইতে-ই, দুধের উপর সর জমিরা আসিবে। এখন, একখানি কড়া হইতে সর ছিঁড়িয়া ছিঁড়িয়া, অপর কড়ার সরের উপর আস্তে আস্তে রাখিয়া দিবে। এই কড়ায় আর জ্বাল না দিয়া, কেবলমাত্র আগুনের আঁচের উপর রাখিবে আর যে কড়া হইতে সর তুলিয়া লইতেছ, তাহার জ্বাল বন্ধ না করিয়া, অল্প অল্প জ্বাল দিতে থাক। সমুদায় সর তোলা হইলে, অল্প জ্বাল দেওয়ার পর, পুনর্ব্বার জ্বাল কমাইয়া দেও। দেখিবে, অল্পক্ষণের মধ্যে পুনর্ব্বার সর জমিয়া আসিয়াছে। সর জমিলে, পূর্ব্বের ন্যায় তাহা তুলিয়া তুলিয়া, পূর্ব্ব কড়াস্থিত সরের উপর বসাইয়া দেও। এইরূপে তিন চারি বার সর তুলিয়া লইয়া, উক্ত সরের উপর রাখিবে।

 এইরূপে তিন চারিবার সর তোলা হইলে, যে কড়ায় সর জমান হইতেছে, সেই কড়া হইতে সিকি পরিমাণে দুধ অতি সাবধানে অপর কড়ায় অর্থাৎ সর-তোলা কড়ায় ঢালিয়া দিবে। ঢালিবার সময় যেন জমান সরখানি ছিঁড়িয়া না যায়। অনন্তর, এই সর অতি সাবধানে কড়া হইতে তুলিয়া, কোন পাত্রে রাখিয়া, পরে ছুরী দ্বারা তাহা চৌকা চৌকা আকারে কাটিবে। এই সময় আর একখানি কড়াতে কিছু গাওয়া ঘৃত জ্বালে বসাইবে এবং তাহাতে পরিমাণ-মত—আধ-ভাঙ্গা ছোট এলাচ এবং মিছরির গুঁড়া দিয়া ফুটাইবে। এই সময় তাড়ু অথবা খুন্তি দ্বারা উহা নাড়িয়া চাড়িয়া দিবে। ফুটিয়া উঠিলে, জ্বাল হইতে নামাইয়া, একটি বিড়ার উপর কড়াখানি বসাইরে। এখন কর্ত্তিত সরের টুকরা, এক একখানি করিয়া ঐ ঘৃতের উপর সাজাইয়া দিবে। এই সময়, যে কড়াতে সরপড়া দুধ উনানে বসান আছে, সেই-কড়ায় সর-যুক্ত দুধ অল্প অল্প করিয়া, উহার উপর ঢালিয়া দিবে। অনন্তর, কর্ত্তিত সরগুলি উল্‌টাইয়া, দুই পিঠ-ই সমানরূপ গরম করিয়া লইবে। জুড়াইলে খাদ্যের উপযুক্ত হইবে।

 প্রকারান্তর।—এক পোয়া বাদাম ঘৃতে সামান্যরূপ ভাজিয়া, উহা অর্দ্ধ কিংবা সিকি খণ্ড করিয়া কাটিয়া রাখ। পরে, এক পোয়া ক্ষীর জ্বালে চড়াইয়া, তাহাতে রসগোল্লার রস অর্থাৎ যেরূপ চিনির রস রসগোল্লায় ব্যবহৃত হইয়া থাকে, সেইরূপ রস এক পোয়া ঢালিয়া দিয়া, তাড়ু দ্বারা সন্দেশ পাকের ন্যায় অনবরত নাড়িতে থাক। অল্পক্ষণ নাড়া চাড়ার পর, ভর্জ্জিত বাদামগুলি উহার উপর ঢালিয়া দেও। জ্বালে ক্ষীর গাঢ় হইলে, উনান হইতে পাক-পাত্রটি নামাইয়া, বিচ মারিয়া জমাইয়া লও। বিচ-মারায় উহা এরূপ শক্ত হইবে যে, হাতে করিয়া অনায়াসে-ই সন্দেশ বাঁধিতে পারা যাইবে। এই সময়, একটি কথা মনে রাখা আবশ্যক, অর্থাৎ বিচ-মারার পূর্ব্বে, দুই আনা ওজনের জাফরাণ, কিছু মিছরির ও ছোট এলাচের দানা উহাতে মিশাইয়া লইতে হইবে।

 এখন, একখানি পাঁচ বা সাড়ে পাঁচ ছটাক সরের উপর, ঐ ক্ষীর বেশ করিয়া, সমান আকারে বেলুন দ্বারা বসাইতে হইবে। পরে, তাহার উপর আর একখানি সর আচ্ছাদন করিয়া দিবে। এই সরের উপর আবার ঐরূপ ক্ষীর বেলিয়া, অন্য একখানি দ্বারা আচ্ছাদন করিবে। এইরূপে দুই, তিন বা ততোধিক আচ্ছাদনের পর, তাহা ছুরী দ্বারা চতুষ্কোণ করিয়া কাটিয়া লইবে। উপকরণ ও পরিমাণ অর্থাৎ ক্ষীর, রস, বাদাম প্রভৃতির তারতম্যানুসারে সর-পূরিয়ার আস্বাদন সমধিক সুমধুর হইয়া থাকে। আর একটি কথা, বাদামের সঙ্গে পেস্তা দিলে, আর ও ভাল হয়। কিন্তু বাদাম ও পেস্তার ওজন যেন এক পোয়ার অধিক না হয়।

সর-ভাজা।

 র-পূরিয়ার সরের ন্যায় সর জমাইয়া, তাহা দুই তিন ভাঁজ করিবে, এবং গাওয়া ঘৃত জ্বালে চড়াইয়া, তাহাতে ছোট এলাচের দানা দিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নামাইবে। এখন, এই গরম ঘৃতে সরগুলি এক মিনিট রাখিয়া ভাজিয়া লইবে। অনন্তর, তাহা চিনির রসে পাক করিয়া লইলে-ই, সর-ভাজা প্রস্তুত হইল।

 আয়ুর্ব্বেদ মতে সরের গুণাগুণ।—মধুর রস, শীতল, গুরুপাক, তৃপ্তি-জনক, পুষ্টি-কর, স্নিগ্ধ, শুক্র ও রতিশক্তির বৃদ্ধি-কারক, বায়ুনাশক, রক্তপিত্ত-নিবারক এবং কফ-বর্দ্ধক।

ছানা প্রস্তুত।

ক্ষীরের ন্যায় খাঁটি দুধে ছানা প্রস্তুত করিতে হয়। ছানার দুধ জ্বালে বেশ করিয়া মারিতে হয়। দুধ অপেক্ষাকৃত ঘন হইলে, তাহা জ্বাল হইতে নামাইবে। এদিকে, একটি হাঁড়ির মুখে একখানি মোটা অথচ শক্ত পরিষ্কৃত কাপড় একটু ঢিলাভাবে বাঁধিবে। আর, সেই হাঁড়ির নিকট (দম্বল) ছানার জল রাখিবে। ছানার জলে দুধ জমাইয়া ছানা প্রস্তুত করিতে হয়। এজন্য ছানার জল যত অধিক দিনের পুরাতন হয়, ততই ভাল। এক্ষণে, হাঁড়ির মুখে বাঁধা কাপড়ের উপর, অল্প পরিমাণে ছানার জল ছিটাইয়া দিয়া, তাহাতে গরম দুধ খানিক ঢালিয়া দেও। পুনর্ব্বার দুধের উপর ছানার জল ছিটাইয়া দিয়া, আবার দুধ দিতে থাক। এইরূপ নিয়মে সমুদায় দুধ, কাপড়ের উপর দেওয়া হইলে, উহা জমিয়া শক্ত হইয়া আসিবে। অনন্তর, কাপড়খানি গুটাইয়া, ঢিলাভাবে পুটলি বাঁধিয়া, একটি বড় হাঁড়ি অথবা পুষ্করিণী প্রভৃতি কোন জল-পূর্ণ স্থানে, উহা ডুবাইয়া রাখিবে। তিন চারি ঘণ্টা পরে দেখিবে, উহা ফুলিয়া, ফাঁপিয়া, উৎকৃষ্ট এক চাপ ছানা প্রস্তুত হইয়াছে। ইহা-ই উৎকৃষ্ট ছানা। এই ছানার সন্দেশ প্রভৃতি প্রস্তুত করিলে, তাহা অতি মধুরাস্বাদনের হয়। সচরাচর গৃহস্থ ঘরে আর একটি সহজ উপায়ে ছানা প্রস্তুত হইয়া থাকে; কিন্তু তাহা তত উত্তম হয় না। দুধ জ্বালের অবস্থায় তাহাতে ছানার জল ঢালিয়া দিয়া, জমান হইয়া থাকে। পরে তাহা নেকড়ার পুটলিতে বাঁধিয়া; জলের মধ্যে ডুবাইয়া রাখা হইয়া থাকে। কিন্তু পূর্ব্বোল্লিখিত নিয়মে ছানা প্রস্তুত করিলে, যেরূপ উত্তম হইবার কথা, ইহাতে সেরূপ হয় না।

 আয়ুর্ব্বেদ-মতে ছানার গুণাগুণ।— অম্ল-মধুর রস, শীতল, গুরু-পাক, নিদ্রা-কারক, বায়ু-নাশক, বল-কারক, পুষ্টি-জনক এবং শুক্র-বর্দ্ধক।

ছানার মুড়কি।

 ছানা-ভাজার ন্যায়, মুড়কির ছানার-ও জল নিঃসরণ করিতে হয়। পরে তাহা ডুমা ডুমা ধরণে কাটিবে। অনন্তর, ডুমা-সমূহ চিনির রসে পাক করিয়া লইলে-ই, ছানার মুড়কি পাক করা হইল। রসে পাক করিয়া, এরূপ অবস্থায় জ্বাল হইতে নামাইবে যেন, উহা জুড়াইয়া আসিলে বেশ খড়-খড়ে হয়, আর যেন রসে আঠা আঠা না থাকে।

ছানাভাজা।

 ভাল রকম, টাট্‌কা ছানার জল বাহির করিবে। যখন দেখা যাইবে, সমুদয় জল উত্তমরূপ বাহির হইয়াছে, তখন চৌকা তক্তির আকারে কাটিবে। এখন ঐ কর্ত্তিত তক্তিগুলি, চিনির রসে পাক করিয়া লইলে-ই ছানাভাজা প্রস্তুত হইল।


ছানার রসমাধুরী।

 ত্তম টাট্‌কা ছানা বেশ করিয়া বাটিয়া লও। তাহাতে ক্ষীর ও ছোট এলাচের দানা-চূর্ণ মিশাও। উত্তমরূপ মিশ্রিত হইলে, তদ্দ্বারা ইচ্ছামত আকারে উহা গঠন কর। এদিকে ঘৃত জ্বালে পাকাইয়া লও, এবং তাহাতে ঐ গঠিত ছানাগুলি ছাড়িয়া দেও। একটু লাল্‌চে ধরণে ভাজা হইলে, তুলিয়া চিনির রসে ডুবাইয়া রাখ। অনন্তর, তাহা রস হইতে তুলিয়া আহার করিয়া দেখ, উহার আস্বাদ কেমন মধুর।