মুকুট/দ্বিতীয় অঙ্ক/চতুর্থ দৃশ্য

উইকিসংকলন থেকে

চতুর্থ দৃশ্য

রণক্ষেত্র

যুবরাজ ও ইন্দ্রকুমার

 যুবরাজ। আজকের যুদ্ধে গতিকটা ভালো বোঝা যাচ্ছে না। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের সৈন্যেরা কালকের ব্যাপারে আজও নিরুৎসাহ হয়ে রয়েছে—ওরা যেন ভালো করে লড়ছে না। ইশা খাঁ কোন্ দিকে।

 ইন্দ্রকুমার। ঐ যে পূর্বকোণে তাঁর নিশান দেখা যাচ্ছে।

 যুবরাজ। ভাই, তুমি কেন আজ আমার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছ। তোমার বোধ হয় ঐ উত্তরের দিকে যাওয়াই কর্তব্য।

 ইন্দ্রকুমার। না, আমার এই জায়গাই ভালো।

 যুবরাজ। ইন্দ্রকুমার, তুমি তোমার দাদাকে আজ নির্বুদ্ধিতা থেকে বাঁচাবার জন্যে সতর্ক হয়ে কাছে কাছে ফিরছ। খাঁ সাহেব যে আবার কোনো সুযোগে আমার বুদ্ধির দোষ ধরবেন এটা তোমার ভালো লাগছে না। কিন্তু ভাই, আমারও নির্বুদ্ধিতার সীমা আছে—আমি আজ বোধ হয় সাবধানে কাজ করতে পারব। ঐ দেখো, চেয়ে দেখো, আমার কিন্তু ভালো বোধ হচ্ছে না। ঐ দেখো, ঐ পাশে আমাদের সৈন্যেরা যেন টলেছে, এখনই পালাতে আরম্ভ করবে— তুমি না হলে কেউ ওদের ঠেকাতে পারবে না। ইন্দ্রকুমার, দেরি কোরো না, আমার জন্যে তোমার কোনো ভয় নেই। এ কী! এ কী! এ কী!

 ইন্দ্রকুমার। তাই তো, এ কী! শত্রুসৈন্যের হঠাৎ যুদ্ধ বন্ধ করলে যেন।

 যুবরাজ। ঐ যে সন্ধির নিশান উড়িয়েছে। ওদের তো পরাজয়ের কোনো লক্ষণ ছিল না, তবে কেন এমন ঘটল। আমার তো মনে হচ্ছিল, আজকের যুদ্ধে আমাদের সৈন্যেরাই টল‍্মল্ করছে।

দূতের প্রবেশ

 দূত। যুবরাজ, শত্রুপক্ষ যুদ্ধে ক্ষান্ত হয়েছে।

 যুবরাজ। সে তো দেখতে পাচ্ছি। এর কারণ কী।

 দূত। কারণ এখনও জানতে পারি নি কিন্তু শুনতে পেয়েছি, আরাকানরাজ আর আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না বলে সংবাদ পাঠিয়েছেন।

 যুবরাজ। সুসংবাদ। আমার কেবল মনে একটি বেদনা বাজছে।

 ইন্দ্রকুমার। কিসের বেদনা, দাদা।

 যুবরাজ। রাজধর কেন সৈন্য নিয়ে চলে সে যদি থাকত তাহলে কী আনন্দের সঙ্গে আমরা তিন ভাই জয়োৎসব করতে পারতুম। আজকের আমাদের জয়গৌরবের মধ্যে এই একটি মস্ত অভাব রয়ে গেল— রাজধর যুদ্ধে যোগ না দিয়ে আমাকে বড়ো দুঃখ দিয়েছে।

 ইন্দ্রকুমার। জয়ের ভাগ না নিয়েই সে যদি পালিয়ে থাকে তাতে এমনি কী ক্ষতি হয়েছে দাদা।

 যুবরাজ। না ভাই, আমরা তিন ভাই একত্রে বেরিয়েছি, বিজয়লক্ষ্মীর প্রসাদ আমরা ভাগ করে ভোগ না করতে পারলে আমার তো মনে দুঃখ থেকে যাবে। রাজধর যদি মাথা হেঁট করে বাড়ি ফেরে, আমাদের সৌভাগ্যে যদি তার মুখ বিমর্ষ হয়, তাহলে এই কীর্তি আমাকে কিছুমাত্র সুখ দেবে না। ঐ যে ঘোড়া ছুটিয়ে সেনাপতি সাহেব আসছেন।

ইশা খাঁর প্রবেশ

 ইন্দ্রকুমার। খাঁ সাহেব, শত্রুসৈন্য হঠাৎ যুদ্ধ থামিয়ে দিলে কেন তার কোনো খবর পেয়েছ?

 ইশা খাঁ। পেয়েছি বই কি। রাজধর আরাকানরাজকে বন্দী করেছে।

 ইন্দ্রকুমার। রাজধর! মিথ্যা কথা।

 ইশা খাঁ। যা মিথ্যা হওয়া উচিত ছিল এক-এক সময় তাও সত্য হয়ে ওঠে। আমি দেখতে পাচ্ছি, আল্লার দূতেরা এক-এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে, শয়তান তখন সমস্ত হিসাব উলটো করে দিয়ে যায়।

 ইন্দ্রকুমার। শয়তানও কি রাজধরকে জিতিয়ে দিতে পারে।

 ইশা খাঁ। একবার তো জিতিয়েছিল সেই অস্ত্রপরীক্ষার সময়— এবারও সেই শয়তান জিতিয়েছে।

 যুবরাজ। সেনাপতি সাহেব, তুমি রাজধরের উপর রাগ কোরো না। সে যদি জিতে থাকে তাতে তো আমাদের জিত। কখন সে যুদ্ধ করলে, কখন বা বন্দী করলে, আমরা তো জানতে পারিনি।

 ইশা খাঁ। কাল সন্ধ্যার পরে আমরা যখন যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে শিবিরে ফিরে এলেম তখন সে অন্ধকারে গোপনে নদী পার হয়ে হঠাৎ আরাকানরাজের শিবির আক্রমণ করে তাঁকে বন্দী করেছে। আমাদের সাহায্য করবার জন্যে আমি তাকে যেখানে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলুম সেখানে সে ছিলই না। আমি সেনাপতি, আমার আদেশ সে মান্যই করেনি।

 ইন্দ্রকুমার। অসহ্য। এ জন্যে তার শাস্তি পাওয়া উচিত।

 ইশা খাঁ। শুধু তাই! যুবরাজ উপস্থিত থাকতে সে কিনা নিজের ইচ্ছামতো সন্ধিপত্র রচনা করেছে।

 ইন্দ্রকুমার। এর শাস্তি না দিলে অন্যায় হবে।

 ইশা খাঁ। তোমার দাদাকে এই সহজ কথাটি বুঝিয়ে দাও দেখি।

রাজধরের প্রবেশ

 ইন্দ্রকুমার। রাজধর! তুমি কাপুরুষতা প্রকাশ করেছ।

 রাজধর। তোমার মতো যুদ্ধে ভঙ্গ দিয়ে পুরুষকার প্রকাশ করতে আমি এতদূরে আসিনি— আমি যুদ্ধ জয় করতে এসেছিলুম।

 ইন্দ্রকুমার। তুমি যুদ্ধ করেছ! এবং জয় করেছ! জয়লক্ষ্মীর মুখ যে লজ্জায় লাল করে তুলেছ।

 রাজধর। তা হতে পারে, সেটা প্রণয়ের লজ্জা। কিন্তু, তিনি যে আমাকে বরণ করেছেন তার সাক্ষী এই।

 ইন্দ্রকুমার। এ মুকুট কার।

 রাজধর। এ মুকুট আমার। এ আমার জয়ের পুরস্কার।

 ইন্দ্রকুমার। যুদ্ধ থেকে পালিয়েছ তুমি—তুমি পুরস্কার পাবে কিসের। এ মুকুট যুবরাজ পরবেন।

 রাজধর। আমি জিতে এনেছি, আমিই পরব।

 যুবরাজ। রাজধর ঠিক কথাই বলছেন। ওঁর জয়ের ধন তো উনিই পরবেন।

 ইশা খাঁ। সেনাপতির আদেশ লঙ্ঘন করে উনি অন্ধকারে শৃগালবৃত্তি অবলম্বন করলেন— আর উনি পরবেন মুকুট! ভাঙা হাঁড়ির কানা প’রে যদি দেশে যান তবেই ওঁকে সাজবে।

 রাজধর। আমি যদি না থাকতুম ভাঙা হাঁড়ির কানা তোমাদের পরতে হত। এতক্ষণ থাকতে কোথায়।

 ইন্দ্রকুমার। যেখানেই থাকি তোমার মতো পালিয়ে থাকতুম না।

 যুবরাজ। ইন্দ্রকুমার, তুমি অন্যায় বলছ, ভাই। সত্য বলতে কী, রাজধর না থাকলে আজ আমাদের বিপদ হত।

 ইন্দ্রকুমার। কিচ্ছু বিপদ হত না। রাজধর সৈন্য লুকিয়ে রেখেই আমাদের বিপদে ফেলবার চেষ্টা করেছিল। রাজধর না থাকলে এ মুকুট আমি যুদ্ধ করে আনতুম। রাজধর চুরি করে এনেছে। এ মুকুট এনে আমি তোমাকেই পরাতুম, নিজে পরতুম না।

 যুবরাজ। (রাজধরের প্রতি) ভাই, তুমিই আজ জিতেছ। তুমি না থাকলে অল্প সৈন্য নিয়ে আমাদের কী বিপদ হত বলা যায় না। এ মুকুট আমি তোমাকেই পরিয়ে দিচ্ছি।

 ইন্দ্রকুমার। (রুদ্ধকণ্ঠে) রাজধর ক্ষাত্রধর্ম লঙ্ঘন করেছে বলে তোমার কাছ থেকে আজ পুরস্কার পেলে— আর আমি যে প্রাণকে তুচ্ছ করে বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করলুম, তোমার মুখ থেকে একটা প্রশংসার কথাও শুনতে পেলুম না। এমন কথা তোমার মুখ থেকে আজ শুনতে হল যে, রাজধর না থাকলে কেউ তোমাকে বিপদ হতে উদ্ধার করতে পারত না। কেন দাদা, আমি কি প্রত্যুষ থেকে আর সন্ধ্যা পর্যন্ত, তোমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করিনি। আমি কি রণক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়েছিলুম। আমি কি শত্রুসৈন্যের বেষ্টন ছিন্ন করে তোমার সাহায্যের জন্য আসিনি। কী দেখে তুমি বললে, তোমার স্নেহের রাজধর ছাড়া কেউ তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারত না!

 যুবরাজ। ভাই, আমি নিজের বিপদের কথা বলছিনে।

 ইন্দ্রকুমার। থাক্ দাদা, থাক্। আর কিছুই বলতে হবে না। রাজধরের মতো এমন অসাধারণ বীরকে যখন তুমি সহায় পেয়েছ তখন আমার আর প্রয়োজন নেই— আমি চললেম।

 যুবরাজ। ভাই, আবার! আবার তুমি আত্মবিস্মৃত হচ্ছ!

 ইন্দ্রকুমার। যেখানে আমার প্রয়োজন নেই সেখানে আমার পক্ষে থাকাই অপমান।

[প্রস্থান

 ইশা খাঁ। যুবরাজ, এ মুকুট তোমার কাউকে দেবার অধিকার নেই। আমি সেনাপতি, আমি যাকে দেব এ তারই হবে।

রাজধরের মাথা হইতে মুকুট লইয়া যুবরাজকে পরাইয়া

দিতে উদ্যত হইলেন

 যুবরাজ। (সরিয়া গিয়া) না, এ মুকুট আমি নিতে পারিনে।

 ইশা খাঁ। তবে থাক্। এ মুকুট কেউ পাবে না। এ কর্ণফুলির জলে যাক। (মুকুট নিক্ষেপ) রাজধর যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন, উনি শাস্তির যোগ্য।

 রাজধর। দাদা, তুমি সাক্ষী রইলে। এ আমি ভুলব না।

 যুবরাজ। এইটেই কি সকলের চেয়ে মনে রাখবার কথা। মুকুটটাও যদি জলে গিয়ে থাকে তবে ওর সমস্ত লাঞ্ছনাও যাক। তোমারও যা ভোলবার ভোলো, আমাদেরও যা ভোলবার ভুলে যাই। দেখি, ইন্দ্রকুমার সত্যই রাগ করে আমাদের ছেড়ে চলে গেল কিনা।