মুকুট/দ্বিতীয় অঙ্ক/প্রথম দৃশ্য

উইকিসংকলন থেকে

দ্বিতীয় অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য

রাজধরের শিবির

রাজধর ও ধুরন্ধর

 ধুরন্ধর। তুমি পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে তফাতে থাকবে নাকি।

 রাজধর। হাঁ, ইশা খাঁর কাছে আমি এই প্রস্তাব পাঠিয়েছিলুম।

 ধুরন্ধর। সে তো আমি জানি; আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলুম। তাই নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়ে গেল।

 রাজধর। কিরকম।

 ধুরন্ধর। প্রথমেই তো ইন্দ্রকুমার অট্টহাস্য করে উঠলেন— তিনি বললেন, রাজঘরের যুদ্ধপ্রণালীটাই ঐরকম— যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে থেকেই তিনি যুদ্ধ করতে ভালোবাসেন।

 রাজধর। সে-কথা ঠিক। ক্ষেত্র হতে যুদ্ধ করে মজুররা— দূরে থেকে যে যুদ্ধ করতে পারে সেই যোদ্ধা। ইশা খাঁ কী বললেন।

 ধুরন্ধর। তোমার উপর তাঁর বিশ্বাস কিরকম সে তো তুমি জানই— তুমি যদি পায়ে ধরতে যাও তাহলেও তিনি সন্দেহ করেন নিশ্চয় জুতোজোড়াটা তোমার সরাবার মতলব আছে। তাই ইশা খাঁ বললেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্র থেকে রাজধর তফাতে থাকতে চান সেটা তাঁর পক্ষে আশ্চর্য নয় কিন্তু পাঁচ হাজার সৈন্য সঙ্গে রাখতে চান সেইটে আমার ভালো ঠেকছে না।’

 রাজধর। যুবরাজ কিছু বললেন না?

 ধুরন্ধর। যুবরাজ কাউকে যে সন্দেহ করবেন সেপরিমাণ বুদ্ধি ভগবান তাঁকে দেননি— এমন কি, তুমি যে তুমি, তোমার উপরেও তাঁর সন্দেহ হয় না।

 রাজধর। দেখো, ধুরন্ধর, দাদার কথা তুমি অমন করে বোলো না।

 ধুরন্ধর। ওঃ, ঐ জায়গাটা তোমার একটু নরম আছে, সেটা মাঝে মাঝে ভুলে যাই। যা হোক, তিনি বললেন, ‘না না, রাজধরের প্রতি তোমরা অন্যায় অবিচার করছ, তাঁর প্রস্তাবটা তো আমার ভালোই ঠেকছে। যুদ্ধে যদি সংকট উপস্থিত হয় তাহলে তিনি তাঁর সৈন্য নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।’ যুবরাজের অনুরোধেই তো ইশা খাঁ তোমার প্রস্তাবে রাজি হলেন, নইলে তাঁর বড়ো ইচ্ছে ছিল না। যাই হোক, কিন্তু আমি তোমার আলাদা থাকবার মতলব ভালো বুঝতে পারছি নে।

 রাজধর। ওঁদের সঙ্গে একত্রে মিলে যুদ্ধ ক’রে আমার লাভ কী——জিত হলে সে-জিতকে কেউ আমার জিত বলবে না তো।

 ধুরন্ধর। তবু ভুলেও কেউ তোমার নাম করতে পারে। কিন্তু তফাতে বসে থাকলে যুদ্ধে জয় হলেও তোমার অপযশ, হারলে তো কথাই নেই।

 রাজধর। আমার এই পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়েই আমি যুদ্ধে জিতব এবং আমি একলাই জিতব।

দূতের প্রবেশ

 রাজধর। কী রে, যুদ্ধের খবর কী?

 দূত। আজ্ঞে, লড়াই তো সমস্তদিন ধরেই চলছে কিন্তু এ পর্যন্ত এঁরা শত্রুদের ব্যুহ ভেদ করতে পারেন নি। সূর্য অস্ত যাবার আর তো বেশি দেরি নেই— অন্ধকার হয়ে এলে বোধ হয় যুদ্ধ আজকের মতো বন্ধ রাখতে হবে।

দ্বিতীয় দূতের প্রবেশ

 রাজধর। কে তুমি।

 দ্বিতীয় দূত। আজ্ঞে আমি ব্যোমকেশ— যুবরাজ আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন—সেও প্রায় দুই প্রহর হয়ে গেল—আপনার যেখানে সৈন্য নিয়ে থাকবার কথা ছিল সেখানে আপনার কোনো চিহ্ন না পেয়ে বহু সন্ধানে এখানে এসেছি।

 রাজধর। যুবরাজের আদেশ কী।

 দূত। শত্রুসৈন্যর সংখ্যা আমরা যে-রকম অনুমান করেছিলুম তার চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে— যুদ্ধ খুব কঠিন হয়ে এসেছে। কুমার ইন্দ্রকুমার তাঁর অশ্বারোহীদল নিয়ে শত্রুসৈন্যের উত্তর দিক আক্রমণ করেছিলেন, আর কিছুক্ষণ সময় পেলেই তিনি সেদিক থেকে শত্রুসৈন্যকে একেবারে নদীর কিনারা পর্যন্ত হঠিয়ে আনতে পারতেন।

 রাজধর। সত্যি নাকি। সময় পেলে কী করতে পারতেন সে-কথা কল্পনা করে বিশেষ লাভ দেখি নে— কিন্তু সময় পান নি ব’লেই বোধ হচ্ছে।

 ২য় দূত। শত্রুসৈন্যকে যখন প্রায় টলিয়ে এনেছেন এমনসময় খবর পেলেন যে, যুবরাজ সংকটে পড়েছেন, শত্রু তাঁকে ঘিরে ফেলেছে— ইশা খাঁ তখন অন্যদিকে যুদ্ধে নিযুক্ত ছিলেন, তিনি খবর পেয়ে বললেন, ‘যুবরাজকে উদ্ধার করবার জন্যে আমি এখানে আসি নি, আমাকে যুদ্ধে জিততে হবে; আমি এখান থেকে নড়তে গেলেই শত্রুরা সুবিধা পাবে।’

 রাজধর। দাদা কি তবে—

 দূত। না, তাঁর কোনো বিপদ এখনো ঘটে নি। ইন্দ্রকুমার সৈন্য নিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছেন কিন্তু এই গোলেমালে যুদ্ধে আমাদের অসুবিধা ঘটল। আপনাকে সন্ধান করবার জন্যে নানা দিকে দূত গিয়েছে— আপনার সাহায্য না হলে বিপদ ঘটতেও পারে, অতএব আপনি আর কিছুমাত্র বিলম্ব করবেন না।

 রাজধর। না, কিছুমাত্র বিলম্ব করব না। যাও তুমি বিশ্রাম করো গে যাও— আমি প্রস্তুত হচ্ছি।

[দূতের প্রস্থান

 ধুরন্ধর। তুমি যাচ্ছ নাকি।

 রাজধর। যাচ্ছি বটে, কিন্তু ওদিকে নয়, অন্যদিকে।

 ধুরন্ধর। বাড়ির দিকে?

 রাজধর। তুমিও কি ইশা খাঁর কাছ থেকে বিদ্রূপ অভ্যেস করেছ। বীরত্ব যাঁর খুশি তিনি দেখান কিন্তু যুদ্ধে জয় ক’রে যদি কেউ বাড়ি ফেরে তো সে রাজধর। ধুরন্ধর, যাও তুমি— দেখো গে আমার শিবিরে কোথাও যেন কেউ আগুন না জ্বালে, একটি প্রদীপও যেন না জ্বালতে পায়।

 ধুরন্ধর। আচ্ছা, আমি সকলকে সতর্ক করে দিচ্ছি—কিন্তু, কী তোমার অভিপ্রায় খুলেই বলো না— তুমি যদি আমাকে আর আমি যদি তোমাকে সন্দেহ করি তাহলে পৃথিবীতে আমাদের ছুটির তো কোথাও ভর দেবার জায়গা থাকবে না।

 রাজধর। আজ রাত্রের অন্ধকারে আমি সৈন্য নিয়ে গোপনে নদী পার হয়ে যাব। হঠাৎ আরাকানরাজের শিবিরে উপস্থিত হয়ে তাকে বন্দী করতে হবে।  ধুরন্ধর। এখানে কোথায় পার হবে। ঘাট তো নেই।

 রাজধর। পথঘাট আমি সমস্তই সন্ধান ক’রে ঠিক ক’রে রেখেছি। সূর্য তো অস্ত গেল। আজ আড়াই প্রহর রাত্রে চাঁদ উঠবে, তার পূর্বেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে, অতএব আর বড়ো বেশি দেরি নেই— তুমি যাও, প্রস্তুত হও গে। আর-একটি কাজ করো— যুবরাজের দূত যেন ফিরে যেতে না পারে, তাকে বন্দী ক’রে রাখো।