বিষয়বস্তুতে চলুন

মৃতের কথোপকথন/আকবর, আওরঙ্গজেব

উইকিসংকলন থেকে

আকবর, ঔরঙ্গজেব

আকবর

 বৎস, আমার উদ্দেশ্যকে বিলম্বিত তুমি করেছ কিন্তু মিথ্যা প্রতিপন্ন কর‍্তে পার নি। বরং তোমার পথই যে ভুল তা বোধ হয় আজ স্বীকার করতে রাজী আছ। ভারত ভারতবাসীর, হিন্দুরও নয়, মুসলমানেরও নয়, আর কোন বিশেষ ধর্ম্ম বা জাতিরও নয়—এই গোড়ার সূত্র ঠিক না রেখে চললে কোন শৃঙ্খলা কোন ব্যবস্থাই এ দেশে দু’ দিনের বেশী স্থায়ী হবে না।

ঔরঙ্গজেব

 আমার আদর্শ সফল হয় নাই। কিন্তু একবার কি বারবার বিফল হইলেও, আদর্শ যে ভুল হতে বাধ্য এমন যুক্তি ত আমি দেখছি না। আমি বুঝ‍্তে পারি না একটা বিশেষ ধর্ম্ম বিশেষ জাতি ছাড়া কোন দেশ কি করে গড়ে ওঠে। দেশ ত খানিকটা মাটি নয়, একটা চিড়িয়াখানা নয় যে সেখানে রকম বেরকমের জীব জানোয়ার আস্তানা বেঁধে চরে বেড়াবে। দেশের পিছনে চাই একটা প্রাণ, একটা সজীব একত্ব, একটা জাগ্রত আদর্শ। এক জাতি, এক ধর্ম্ম ছাড়া কোথা থেকে আস‍্বে সে প্রাণ, সে একত্ব, সে আদর্শ?

আকবর

তা কেন? দেশ দেশ। তোমার ধর্ম্মবোধ জাতিবোধ বলে যেমন একটা জীবন্ত জিনিষ আছে, তেমনি দেশ-বোধ বলেও ঠিক আর একটা জিনিষ আছে। এই দুটো বোধকে আলাদা করে দেখ‍্তে হবে। বিশেষতঃ যে দেশে বহু জাতি বহু ধর্ম্ম এসে মিলেছে, সে দেশকে নিছক দেশাত্মবোধেরই উপর গড়তে হবে, ধর্ম্মের বা জাতির গোঁড়ামীর উপর গড়া উচিতও নয়, সম্ভবও নয়।

ঔরঙ্গজেব

 ধর্ম্ম থেকে জাতি থেকে আলাদা কাটা ছাঁটা একটা দেশবোধ মনের কল্পনা, দার্শনিক বুদ্ধির চাতুরী ছাড়া আর কিছু নয়। ওটা কৃত্রিম জিনিষ, বাস্তবে ওটাকে পাওয়া যায় না। দেশবোধ মানে কি? এক শিক্ষা দীক্ষায় গঠিত, এক ধর্ম্মভাবে অনুপ্রাণিত, ভ্রাতৃভাবে মিলিত একটি ভূ-খণ্ডের জনসঙ্ঘ। রক্তের মিল নেই, শিক্ষা দীক্ষার মিল নেই, ধর্ম্মের মিল নেই, আদর্শের জীবনের মিল নেই অথচ এক জায়গায় আছি বলেই ভাই ভাই, এমনতর ভ্রাতৃত্ব বন্ধন যে খুব শক্ত বা উঁচু ধরণের, তা আমি মনে করি না, আর তা কখন হয় কি না তাও জানি না।

আকবর

 আচ্ছা, চেয়ে দেখ আজকালকার জগৎ। দেখ, সুইট‍্জারল্যাণ্ড। তিন তিনটে জাত সেখানে —ফরাসী, জর্ন্মণ, ইতালীয়। দুটো বড় বড় ধর্ম্ম—কাথলিক ও প্রোটেষ্টাণ্ট। তারপর দেখ আয়র্লণ্ড, সেখানেও জাতে ধর্ম্মে দুটো ভাগ—অলষ্টর ও দক্ষিণী গেলিক। তবে আয়র্লণ্ড এখনও গড়ে উঠবার পথে, তাই সেখানে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষ দেখা দিচ্ছে—কিন্তু ঐ দুভাগের একটা রফা বা মিলন হতে বেশী দেরী হবে না। তারপর দেখ কানাডা—সেখানে আধা ইংরেজ আধা ফরাসী। আরও দেখ বেলজিয়ম— তার এক অর্দ্ধেক ফরাসী ভাবের ফরাসী শিক্ষা দীক্ষায় অনুপ্রাণিত, আর অর্ধেক জর্ন্মণীর প্রভাবে প্রভাবান্বিত।

ঔরঙ্গজেব

 এ সব উদাহরণই অধম শ্রেণীর দেশের কথা। নানা ধরণ-ধারণের মধ্যে রফা করে গোঁজা মিল দিয়ে, তাদের সবার ধার নষ্ট করে দিয়ে একটা পঙ্গু ক্ষীণপ্রাণ, কোন রকমে জীবন ধারণোপযোগী দেশ গড়ে তুলতে পার‍্লেও পারা যায় হয়ত; কিন্তু তেজীয়ান সৃষ্টিক্ষম দেশ পেতে হলে চাই সংহতি, সমভাবুকতা, সর্ব্ব বিষয়ে ঐক্য, জীবনের আদর্শ নিয়ে মিল ও তাকেই প্রকাশের প্রয়াস এবং সাধনা। মানুষ জড় পদার্থ নয়, মানুষ হচ্ছে সজীব গোটা জিনিষ, তার এক ভাগ আর এক ভাগের সাথে ওতঃপ্রোতঃ মিলে মিশে রয়েছে। মানুষকে দিয়ে কাজ কর‍্তে হলে তার সব খানি দিয়ে কাজ কর‍্তে হবে। জাতিবোধ ধর্ম্মবোধ সামাজিক জীবন এমন কি ব্যক্তিগত জীবন এ সব বাদ দিয়ে শুধু দেশবোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে অপরের সাথে এক হওয়া, কর্ম্ম করা, আমি আবার বলি, একটা কৃত্রিম কল্পনা। ধর্ম্ম হচ্ছে মানুষের জীবনের গোড়ার কথা, তার অন্তরাত্মার কথা, ধর্ম্ম মানুষের ভিতর বাহির তার সবখানি ঢেকে ছেয়ে তার প্রতিঅঙ্গের রন্ধ্রে রন্ধে রয়েছে, ধর্ম্মে অনৈক্য অথচ কর্ম্মে ঐক্য, মানুষ এতখানি দার্শনিক প্রকৃতির নয়। তাই আমি জানি, ভারতকে হতে হবে হয় হিন্দু, নয় মুসলমান-ভারত যদি মর‍্তে না চায়। হিন্দু যা দেবার ভারতকে তা দিয়েছে। হিন্দু হচ্ছে অতীতের শক্তি। আমি মুসলমান শক্তি দিয়ে ভারতকে নতুন দীক্ষায় নতুন জীবনে জাগাতে চেয়েছিলেম।

আকবর

 তোমার কথাই যদি স্বীকার করে নেই, দেশের লোককে মিল্‌তে হলে মিলতে হবে ধর্ম্মের মধ্যে, তবে জিজ্ঞাসা করি ধর্ম্ম তুমি কাকে বল? এ শিক্ষা কি এখনও তুমি পাও নি, ধর্ম্ম নানা, বাহিরের দিক থেকে,—মূলতঃ কিন্তু ধর্ম্ম এক, সব ধর্ম্মই সত্য। একই বস্তুকে হিন্দুরা ভগবান বলে, মুসলমানেরা খোদা বলে, খৃষ্টানেরা গড্‌ বলে। সে এক্ অজ্ঞানের যুগ ছিল যখন লোকে অর্থ না বুঝে নাম নিয়ে মারামারি করত। ধর্ম্ম হচ্ছে মানুষের সব চেয়ে যেটি বড় আদর্শ, তার শ্রেষ্ঠতম আকাঙ্ক্ষা। খুঁজে তলিয়ে দেখ, দেখবে দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে ধর্ম্মে ধর্ম্মে যুগে যুগে এই আদর্শ এই আকাঙ্ক্ষা মানুষের প্রায় একই রকম। দেশের কালের ভেদে সে বস্তু খুব বেশী ভিন্ন হয় নি। পার্থক্য যা সেটা অতি সামান্য খুঁটিনাটিতে। এই যেমন আমি কাবাব ভালবাসি, তুমি হয়ত কোপ্তা ভালবাস, এটা হচ্ছে রুচির ধাতের কথা, তা নিয়ে খুনোখুনি করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়; সেই রকম ধর্ম্মের যে বিশেষ রূপ বা আচার এক এক জনের ভাল লাগে তা তার রুচির ধাতের কথা। ধর্ম্ম যদি থাকে, জীবনের একটা মহৎ আদর্শ নিয়ে যদি আমরা চলি, তবে তার কি নাম দিচ্ছি বা তাকে ঠিক কি ভঙ্গীতে প্রকাশ কর‍্তে যাচ্ছি, সে সম্বন্ধে অনেক খানি উদার হওয়া বিশেষ কঠিন নয় —এটাও কি সেই ধর্ম্মের সেই আদর্শের অঙ্গ নয়? হিন্দুরা গায়ত্রী পাঠ করে, কিন্তু কলমা না পড়লেই যে তারা জাহান্নামে গেল, এটা কি অজ্ঞানতা নয়?

ঔরঙ্গজেব

 এ সব হচ্ছে রাজনীতিকের কথা, ধার্ম্মিকের কথা নয়। ধর্ম্মের টান যে বোধ করে নি, খোদার সাক্ষাৎ হুকুম যে কানে শোনে নি তারি মুখ থেকে এমন উদাসীন এমন জলো রক্তের কথা সব বেরোয়। আমি জানি সত্যের ও রূপের অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। আত্মা থেকে দেহ আলাদা থাকতে পারে না, তেমনি ধর্ম্ম থেকে ধর্ম্মের আচারও পৃথক করা যায় না। নামের রূপের মধ্যেও যে ধর্ম্ম দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত নয়, সে ত হাওয়ার জিনিষ—তর্কাতর্কির জিনিষ; প্রাণের জীবনের কর্ম্মের যে ধর্ম্ম তা বিশেষ নামরূপ ছাড়া থাক‍্তে পারে না।

আকবর

 তোমার শিক্ষা এখনও শেষ হয় নি। আমার এত বড় সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিয়েও, তুমি বুঝ‍্তে পারনি, কেন তার ধ্বংস হ’ল। আশা করি একদিন বুঝবে যে ভারতবাসী আগে হচ্ছে ভারতবাসী, তার পরে সে হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান।

ঔরঙ্গজেব

 হাজার বার ব্যর্থ হলেও, আদর্শ হতে আমি বিচ্যুত হব না। বুঝবো, ভুল আদর্শে নয়, ভুল হচ্ছে আমার নিজের অক্ষমতায়। আমায় আবার যদি ভারতে পাঠান হয়, তবে আমি আবার ঘোষণা করবো, ভারতবাসী তুমি আগে হও ধার্ম্মিক ও মুসলমান, তারপরে ভারতবাসী।

আকবর

 পৃথিবীতে গিয়ে দেখ‍্বে ধর্ম্মের অর্থ কতখানি বদলে গেছে। মানুষের দেখবার ভঙ্গী কত নতুন হয়েছে। ধর্ম্ম হচ্ছে প্রধানতঃ ব্যক্তিগত জীবনের কথা। কিন্তু সমষ্টিগত জীবনের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে দেশবোধ।