মেয়েলি ব্রত ও কথা/গাড়শী

উইকিসংকলন থেকে

গাড়শী ব্রত।

 আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি দিবস গাড়শী ব্রত করিতে হয়। “গাড়শী” শব্দ বোধ হয় “গার্হস্থ্য” শব্দের অপভ্রংশ। রাত্রির চতুর্থ প্রহরে কাক ডাকিবার পূর্ব্বে শয্যা হইতে গাত্রোখান করিয়া বালক বালিকা সধবা বিধবা সকলেই অন্তঃপুরের প্রাঙ্গনে প্রদীপ জ্বালিয়া সমবেত হইয়া থাকেন। পুষ্করিণী হইতে এক ঘটী জল আনয়ন করিয়া স্থাপন করিবে, এবং কয়েকটী বাঁটা মশলা, যথা, সরিষা, মেথী, হলুদ এবং কুলগাছের নুতন পাতা একখানি রেকাবে রাখিবে। এগুলি পূর্ব্বদিন সংগ্রহ করিয়া রাখিতে হয়। প্রদীপের শিখার উপর দুই একটী কাঁচা তেঁতুল পোড়াইবে। এই সময় সকলেই (শয্যা হইতে গাত্রোত্থানের পর বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে অনেকের সাধারণ কৃত্য বলিয়া?) ধুম পান করিবেন। কিন্তু স্ত্রীলোক ও বালক বালিকাগণের ধূম পান প্রথা নাই। এজন্য ইঁহারা পাট-কাটির (প্যাঁকাটি) এক প্রান্তে আগুন ধরাইয়া অন্যপ্রান্ত চুরুটের ন্যায় টানিয়া দুই এক বার ধূম উদ্গীরণ করেন। বালকগণ ইহাতে বিশেষ আনন্দ

অনুভব করে। এইরূপ অপূর্ব্ব ধূম্র পানের কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বয়োবৃদ্ধগণ গম্ভীরভাবে উত্তর প্রদান করেন যে, এতদ্বারা মানবজাতির যাবতীয় কাশির পীড়া আরোগ্য হইয়া যায়।

 অতঃপর একবার “জয়কার” উলুধ্বনি করিবে। পুনরায় শরন নিয়ম-বিরুদ্ধ হইলেও বালক বালিকাগণ পুনর্ব্বার শয্যার আশ্রয় গ্রহণ করে; যুবতী ও বৃদ্ধাগণ উষাকালে পূজার জন্য পুষ্প চয়ন করেন। প্রত্যুষে পূর্ব্বাহৃত পুষ্করিণীর জল দ্বারা সকলের মুখ প্রক্ষালন করা বিধি। অনন্তর বালক বালিকা ও সধবাগণ পূর্ব্বোক্ত হলুদ প্রভৃতি মশলা দ্বারা শরীর ম্রক্ষণ করিয়া প্রাতঃস্নান করিয়া থাকেন। চোখে কাজল দেওয়ার প্রথাও আছে।

 পূর্ব্বাহ্নে লক্ষ্মীপূজা হয়। নৈবেদ্যের প্রধান উপকরণ ভিজানো মুগ, মাষ ও বুট। নারিকেলও দেওয়া যায়। সধবাগণও আমিষ আহার করেন না; সকলেই কলাই বা মুগের ডাল ভাত আহার করেন। পরদিন প্রাতঃকালে বালক বালিকা ও সধবাগণের পর্য্যুষিত অন্ন আহার করা বিধি।

আশ্বিনে রাঁধিয়া কার্ত্তিকে খায়,
যে বর মাগে সেই বর পায়।

 পূজান্তে কথা শ্রবণ করিতে হয়।

গাড়শী ব্রত কথা।

 এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ পুত্র ও পুত্রবধূ লইয়া সংসার করেন। বৌটী অতি শুদ্ধাচারিণী। তাঁরই পুণ্যের জোরে ব্রাহ্মণ পরম সুখে আছেন, কিছুই অভাব নাই।

 আশ্বিন সংক্রান্তির পূর্ব্ব দিবস ব্রাহ্মণ পুকুরে সন্ধ্যা আহ্নিক, করিতে বসিয়াছেন। কিন্তু তাঁর মন অন্যদিকে। এমন সময় অলক্ষ্মী খুব সাজ গোজ ক’রে তার কুরূপ ঢেকে পরম রূপসী বেশে বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে দর্শন দিল। অলক্ষ্মী বলিল, আমি কা’ল সন্ধ্যার সময় তোমার ঘরে আসবো। কিন্তু তোমার বউটী ভাল নয়। তুমি তাকে সকালে উঠানে গোবর ছড়া দিতে মানা করো; আমি গোবরের দুর্গন্ধ সইতে পারি না। আর ঠিক সাঁজের সময় যেন সে ঘরে প্রদীপ না জ্বালে; আমি তখন লুকিয়ে তোমার ঘরে আসবে। আর তাও বলি, বউটা তোমার মানা শুনে মনে কিছু সন্দেহ বা দুঃখ না করে, এজন্যে কা’ল তাকে বেশী ক’রে মাছের ঝোল ভাত খেতে দিবে। তা যদি কত্তে পার, তবেই আমি তোমার ঘরে আসতে পারবে। নইলে, তুমি আমার আশা ছাড়ো, আর আমিও তোমার আশা ছেড়ে দি। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ রূপে ও মিষ্ট কথায় মোহিত হয়ে গিয়াছেন। ভাল মন্দ বিচার না ক’রে বউকে ঐ সব করিতে বিশেষ ক’রে মানা করে দিলেন। বউ ভাবলেন শ্বশুরের দুর্ম্মতি হয়েছে। তিনি খুব ভোরে উঠে গোবর ছড়া দিলেন, কিন্তু শ্বশুরের ভয়ে আবার ভাল ক’রে ধুয়ে ফেল্লেন। তারপর গাড়শী ব্রত ক’রে সেদিন মুগের ডাল ভাত আহার করলেন। সন্ধ্যা হ’লে ঘরে প্রদীপ জ্বেলে তখনি নিবিয়ে দিলেন। ঠিক সেই সময়ে, সকলে এক বিকট চীৎকার শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখতে পেলে একটা অলক্ষ্মী স্ত্রীমূর্ত্তি আঁস্তাকুড়ের পাশে বেহুস হয়ে পড়ে আছে। সকলে তাকে ‘অলক্ষ্মী’ বলে চিন্তে পাল্লে। বেহুঁস অলক্ষ্মীকে দেখে ব্রাহ্মণের চৈতন্য হলো এবং লক্ষ্মীমূর্ত্তি বৌয়ের শুদ্ধাচারেই যে অলক্ষ্মী ঘরে ঢুকতে পারে নাই তাহা তাঁর জানতে আর বাকী রইল না। তিনি বৌয়ের খুব সুখ্যাত কত্তে লাগলেন।

 এর নাম গাড়শী ব্রত; যে করে তার ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা থাকেন, অলক্ষ্মী ঢুকতে পায় না।

প্রণাম।  ওঁ বিশ্বরূপ্য ভার্য্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্ব্বতঃ পাহি মাংদেবি মহালক্ষ্মি নমোঽস্তুতে॥

 আশ্বিন-সংক্রান্তির পূর্ব্বেই যদি কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী ব্রত হইয়া যায় তবে গাড়শীব্রতে অলক্ষ্মীদেবীর উদ্দেশে পূজা করা বিধি। লক্ষ্মীর উপাসনা না হইয়া গেলে অলক্ষ্মীর অর্চ্চনা হইতে পারে না। অলক্ষ্মীর ধ্যানটী শুনুন।

ওঁ অলক্ষ্মীং কৃষ্ণবর্ণাঞ্চ ক্রোধনাং কলহপ্রিয়াং।
কৃষ্ণবস্ত্র পরিধানাং লৌহাভরণ ভূষিতাং
ভগ্নাসনস্থাং দ্বিভুজাং শর্করাঘৃষ্টচন্দনাং।
সন্মার্জনী সব্যহস্তাং দক্ষহস্তস্থ শূর্পকাং॥
তৈলাভ্যঙ্গিত গাত্রাঞ্চ গর্দ্দভারোহণাং ভজে॥

 অনেকে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন, এমন অলুক্ষণে ঠাক্‌রুণের ভজনা করাই বা কেন? বোধ হয়, দুষ্ট স্বরস্বতীর ন্যায় দুষ্ট লক্ষ্মী ছলে বলে কৌশলে কাহারও ঘাড়ে না চাপেন এজন্য করযোড়ে ভয়ে ভয়ে যেন বলা হয় “তোমাকে ঠাক্‌রুণ নমস্কার, তুমি আর এদিকে এসো না।”

 শারদীয় কোজাগরী লক্ষ্মীব্রতের দেশব্যাপী অনুষ্ঠান সর্ব্বজন বিদিত। এজন্য বাহুল্য ভয়ে তাহা পৃথকরূপে বিবৃত হইল না। লক্ষ্মীদেবীর অভ্যর্থনার নিমিত্ত কি ভদ্র কি ইতর, গ্রামের সকল গৃহই বিচিত্র আলিপনায় সুশোভিত হইয়া থাকে! বালিকা ও যুবতীগণের আনন্দের সীমা নাই। আজ ঘরে স্বয়ং লক্ষ্মী পদার্পণ করবেন, এজন্য মনের উল্লাসে তাঁহারা সকাল গৃহের দ্বারদেশে দেবীর পদাঙ্ক, পেচকমূর্ত্তি ও ধান্যশীর্ষ অঙ্কিত করিয়া চিত্রবিদ্যায় নৈপুণ্য প্রকাশ করিতে ব্যস্ত। বর্ষিয়সী গৃহিণীগণ নৈবেদ্য রচনায় নিযুক্তা। চিড়া, মুড়ি, মুড়কি, খই, মোয়া, লাড়ু, নারিকেলজাত বিবিধ মিষ্টান্ন ও সন্দেশ প্রভৃতি “রচনা” দ্বারা আজ গৃহ পরিপূর্ণ। বাড়ীর “সেকেলে” কর্ত্তাগণ লক্ষ্মীর আহ্বান শ্রবণের জন্য উৎকর্ণ হইয়া তাঁহার আগমন প্রতীক্ষায় রাত্রি জাগরণ পূর্ব্বক নিশি পোহাইতেছেন। তন্দ্রা নিবারণের জন্য ঘন ঘন তামাক সেবন ও অক্ষক্রীড়া করিতেছেন। আজ পূর্ণিমা নিশীথে লক্ষ্মী বরদাত্রী হইয়া ঝাঁপিকক্ষে দ্বারে দ্বারে বিচরণ করিয়া ধনরত্ন বিতরণ করিতেছেন। তিনি সকলকে আহ্বান করিয়া বলিতেছেন “তোমরা কে জেগে আছ, শীঘ্র এস, এই ধন লও। আমি অপেক্ষা করিতে পারি না, আমার আজ রাত্রে সমস্ত পৃথিবী পর্যাটন করিতে হইবে।”

নিশীথে বরদালক্ষ্মীঃ কো জাগর্ত্তীতি ভাষিণী।
নারিকেলোদকং পীত্বা অক্ষৈর্জ্জাগরণং নিশি।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি কো জাগর্ত্তি মহীতলে॥

 কো জগির্ত্তি? ইহা হইতেই নাম “কোজাগরি”।