মেরী কার্পেণ্টার/কর্ম্মক্ষেত্রবিস্তার

উইকিসংকলন থেকে

কর্মক্ষেত্রবিস্তার।

পিতার মৃত্যুর এক সপ্তাহ পরে তাঁহার ভক্তি-ভাজন বন্ধু ডাক্তার টকারম্যান্ পরলােক গমন করেন। ডাক্তার টকারম্যানের উন্নত চরিত্র এবং জীবনের উচ্চ আদর্শ তিনি কখনও বিস্মৃত হন নাই। তাঁহার পরজীবনে যখন একটির পর একটি জনহিতকর কার্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ডাক্তার টকারম্যানের মৃত্যু। তখনই ডাক্তার টকাম্যান্ তাঁহাকে যে মহান ভাবে অনুপ্রাণিত করিয়াছিলেন, তাহার পূর্ণ বিকাশ হইয়াছিল বলিয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ করিতেন।

 মেরী কার্পেণ্টার তাঁহার রবিবাসরীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র-দিগের প্রাণে জ্ঞানানুরাগ জাগরিত করিবার জন্য তাঁহার ভূতত্ত্ব মিউজিয়ম দান।এবং অন্যান্য জিনিষের একটি ছােট মিউজিয়ম্ অর্থাৎ কৌতুকা-গার তাহাদিগকে দান করেন। পূর্ব্বে এই সকল নিকৃষ্টচরিত্র ব্যক্তিদিগের পল্লী এবং গৃহ পরিদর্শন করিবার সময় তাঁহার হৃদয়ে কখন কখন ঘৃণা এবং বিরক্তির সঞ্চার হইত; কিন্তু তাহাদিগের মধ্যে কয়েক বৎসর কার্য্য করি-বার পর সমাজের নিম্নশ্রেণীর প্রতি তাঁহার করুণার উদ্রেক হয় এবং তাহাদিগের কার্যে প্রচুর আনন্দলাভ করেন। এই সময়েই তিনি এই হতভাগ্যদিগকে এত দূর ভালবাসিতে পারিয়াছিলেন যে, কত মাতা মৃত্যুশয্যায় শায়িত হইয়া সন্তানকে তাঁহার হস্তে নিঃশঙ্কচিত্তে সমর্পণ করিয়া যাইত। পাপে, তাপে তাপিত ব্যক্তিগণ তাঁহার নিকট সম্পূর্ণ সহানুভূতি পাইবে জানিয়া অনুতপ্ত হৃদয়ে তাঁহার নিকট আসিত। মেরী কার্পেণ্টারও প্রকৃত অনুতপ্ত পাপীকে সৎপথে ফিরিতে দেখিয়া অপার আনন্দ লাভ করিতেন এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেন।  মেরী কার্পেণ্টার্ যখন এইরূপে নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে কার্য্য করিতেছিলেন, তখন ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে মহাত্মা জন পাউসের
শিক্ষা প্রণালী।
লর্ড য়্যাসলি নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা-বিস্তারের জন্য পার্লামেণ্টে এক প্রস্তাব উপস্থিত করেন। কিন্তু অধিকাংশ সভ্যের প্রতিবাদে তাহা আইনে পরিণত হইতে পারে নাই। আইনের সাহায্যে আপাততঃ এই কার্য্য সংসাধিত হইবার কোন সম্ভাবনা না দেখিয়া কয়েকটি জনহিতৈষী ব্যক্তি নিজ নিজ নগরে নিম্ন শ্রেণীর মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা দেখিতে লাগিলেন। ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে বিখ্যাত জনহিতৈষী মহাত্মা জন্ পাউণ্ডসের মৃত্যু হয়। তিনি যে প্রকারে রাস্তার দুর্দান্ত, অসচ্চরিত্র বালকবালিকাদিগকে তাঁহার গৃহে লইয়া গিয়া তাহাদিগকে শান্ত করিতেন এবং ধর্ম ও নীতিশিক্ষা দিতেন, তাহা অনেকেরই মনােযােগ আকর্ষণ করে। তাঁহারা এই মহাত্মার পন্থা অবলম্বন করিয়া দরিদ্রবিদ্যালয় স্থাপন করিতে আরম্ভ করেন।  মেরী কার্পেণ্টার্ দেখিলেন, এই দরিদ্র বিদ্যালয় স্থাপন তাঁহার জীবনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ অবৈতনিক বিদ্যালয়
স্থাপন।
করিবার সুন্দর উপায়। ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে অসহায় দরিদ্র-বালকবালিকাদিগের জন্য তিনি দরিদ্র-বিদ্যালয় স্থাপন করিলেন। প্রথমতঃ, এই সকল অশান্ত এবং অসচ্চরিত্র বালকবালিকাদিগকে শান্ত এবং বাধ্য করিতে, তাঁহাকে বহু ক্লেশসহ্য করিতে হইত। একদিন কিছুক্ষণ শিক্ষা করিবার পর বালকবালিকাদিগের মধ্যে এক জন বলিয়া উঠিল “এস, এখন যুদ্ধ করা যাক।” যখনই এই কথা বলা—আর তৎক্ষণাৎ প্রায় কুড়িটি বালকবালিকা মিলিয়া মারামারি করিতে আরম্ভ করিল। কিয়ৎক্ষণের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হইল বটে; কিন্তু এইরূপ ঘটনা প্রায়ই ঘটিত। ইংলণ্ডের ন্যায় শীতপ্রধান দেশে এই বালকবালিকাদের মধ্যে কাহারও জুতা, মােজা, কি কোন প্রকার গাত্রাবরণ ছিল না; অনেকের গৃহও ছিল না। তাহারা লােকের বাড়ীর সিড়িতে কিংবা নদীতীরস্থ বিশ্রামস্থানে রাত্রিতে নিদ্রা যাইত এবং দিনে চৌর্য্য প্রভৃতি অসৎ উপায়ে জীবিকা অর্জ্জন করিত। মেরী কার্পেটার্ এই স্কুলে প্রধানতঃ, ধর্ম্ম এবং নীতি শিক্ষা দিতে লাগিলেন। তাহা-দের মধ্যে জ্ঞানানুরাগ বর্দ্ধিত করিবার জন্য তাহাদিগকে কখন পৃথিবীর মানচিত্র বা ভূ-গােলক দেখাইতেন; কখ-নও ইতিহাস হইতে গল্প বলিয়া, কি কোন বিখ্যাত কবির কাব্যের কথা বলিয়া তাহাদের চঞ্চল মনকে শান্ত করিতেন। কখনও বা ভূতত্ত্বের কোন নিদর্শন দেখাইয়া তাহাদের মনে পৃথিবীর আশ্চর্য নির্মাণকৌশলের ভাব জাগাইয়া দিতেন। তিনি কিরূপ ভাবে বালকবালিকা-দিগকে শিক্ষা দিতেন, তাহা তাঁহার দৈনন্দিনলিপি হইতে উদ্ধৃত নিম্নলিখিত অংশ পাঠ করিলেই বুঝা যায়।

 “পৃথিবীর মেরুদণ্ড কিঞ্চিৎ হেলিয়া আছে বলিয়াই যে, ঋতুর পরিবর্তন হয়, তাহা তাহাদিগকে দেখাইলাম এবং বুঝাইয়া দিলাম। তাহারা ইহাতে অতিশয় আহ্লাদিত হইল।”

 “এই ক্লাসের ছেলেরা কখনও মানচিত্র দেখে নাই। মানচিত্র বুঝিতে তাহাদের অনেকক্ষণ লাগিয়াছিল। একটি ছাত্র মানচিত্রে ব্রিষ্টল্ এবং বাথ নগর দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইল। আমি সর্ব্বদা অগ্রে জ্ঞাত স্থানগুলি দেখা ইয়া পরে অজ্ঞাত স্থান দেখাই।”

 “পূর্ব্ব সপ্তাহে আমি ছাত্রদিগকে কয়েকটি ফার্ণ দেখা-ইয়াছিলাম। তাহারা ইহার সৌন্দর্য্য বুঝিতে পারিয়াছিল; কিন্তু ইহা যে, কি জিনিষ তাহা কেহই বলিতে পারিল না। কেহ বলিল, ইহা তাল গাছ। আমি ফার্ণ সম্বন্ধে তাহাদিগকে যাহা বলিলাম, তাহা তাহারা অতি আগ্রহের সহিত শ্রবণ করিল।”

 “ম্যাকবেথের গল্প তাহাদিগকে বলিলাম; বেশ বুঝিলাম যে, ইহা তাহাদের মনে মুদ্রিত হইয়া গেল। তাহারা সেক্ষ-পিয়ারের নাম জানিত।কোন ভােজনালয়ের উপর তাহারা তাঁহার প্রস্তরনির্ম্মিত মস্তক দেখিয়াছে।”

 তিনি এইরূপে তাঁহার ছাত্রদিগের মানসিক অবস্থার ক্রমােন্নতি অতি আগ্রহের সহিত পর্যবেক্ষণ করিতেন এবং তাঁহার শিক্ষানুসারে যদি কেহ কোন সৎকার্য্য করিত কিংবা তাঁহার উপদেশ মনে রাখিত, তবে তাহার স্মৃতি তিনি যত্নপূর্ব্বক রক্ষা করিতেন। একদিন তিনি তাঁহার কোন অন্ধ বন্ধুকে বায়ুনিষ্কাশনযন্ত্রপ্রণালীটী ছাত্রদিগকে বুঝাইয়া দিবার জন্য নিমন্ত্রণ করেন। এই বক্তৃতাতে ৩০০ শত বালকবালিকা উপস্থিত ছিল। তিনি এই দিনের বক্তৃতাসম্বন্ধে লিখিয়াছেন——“এক বৎসর পূর্ব্বে আমি কল্পনাও করিতে পারি নাই যে, তাহারা এইরূপ ধীরতার সহিত বক্তৃতা শ্রবণ করিবে কিংবা জ্ঞানলাভে এই প্রকার আনন্দ পাইবে।” মেরী কার্পেণ্টার্ প্রধানতঃ ধর্ম্মশিক্ষা দ্বারাই এই সকল কঠিন হৃদয়গুলিকে আয়ত্ত করিতে পারিয়াছিলেন। তিনি রবিবার দুই বেলা এবং অন্যান্য দিনও ইহাদিগকে ধর্ম্মশিক্ষা দিতেন। এই সকল দরিদ্র বালকবালিকাদিগের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা তাঁহার জীবনকে মধুর করিয়াছিল।  দরিদ্রবিদ্যালয়ের ক্রমােন্নতি এবং ছাত্রছাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। তিনি ইহার জন্য অবৈতনিক বিদ্যালয়ের
বাটী ক্রয়।
১৮৫০ খৃষ্টাব্দে একটি বৃহৎ বাটী ক্রয় করেন। বাল্যজীবনে আমােদ কত দূর প্রয়ােজন এবং বালকবালিকাগণ নির্দ্দোষ আমােদের সুবিধা না পাইলে, কিরূপে কুপথে চলিয়া যায়, মেরী কার্পেণ্টার্, তাহা বুঝি-তেন। এই দোষ নিবারণার্থ তিনি এই বাটীসংলগ্ন ভূমির কিয়দংশ লইয়া ক্রীড়াভূমি নির্ম্মাণ করেন। ইহাতে বালক-বালিকাগণ আর রাস্তায় গিয়া অসৎ ক্রীড়াতে রত হইত। কিছুদিন পরে এই বাটীসংলগ্ন কয়েকটি গৃহ লইয়া তিনি গৃহশূন্য এবং অনাথ বালকবালিকাদিগের জন্য আশ্রম স্থাপন করেন। কত বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া এই সকল দুর্দ্দান্ত, নীতিহীন বালকবালিকাদিগের অন্যায় কার্য্য এবং অত্যাচার সহ্য করিয়া স্কুলটি যখন এক বৎসর টিকিল, তখন ইহার আশ্চর্য্য উন্নতি দেখিয়া সকলে অবাক্, হইলেন। লােকে বলিতে লাগিল, যে সকল বালক বালিকা দেখিয়া লােকে ভয় করিত, তাহারা কোন্ মন্ত্রবলে এই প্রকার শিষ্ট, শান্ত এবং সৎপ্রকৃতিসম্পন্ন হইয়াছে? দেশবিদেশে মেরী কার্পেণ্টারের দরিদ্র-বিদ্যালয়ের কথা প্রচারিত হইল।  দরিদ্র বিদ্যালয়ের ক্রমােন্নতি দেখিয়া মেরী কার্পেণ্টা-রের আর একটী ইচ্ছা বলবতী হইল। নৈশ বিদ্যালয়
স্থাপন।
তিনি দরিদ্র কৃষিজীবী ও শ্রমজীবিগণের শিক্ষা ও নৈতিক উন্নতির জন্য মনঃসংযােগ করিলেন। এই দরিদ্র-বিদ্যালয়ের সহিত তিনি একটি নৈশ-বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন। ইহা স্থাপিত হওয়াতে নিম্ন শ্রেণীর শত শত তরুণবয়স্ক পুরুষ ও রমণী ইহাতে যােগদান করেন। এই সকল পুরুষ এবং রমণীর চরিত্র ও স্বভাব এতদূর বিকৃত ছিল যে, তাহাদিগকে দেখিয়া মেরি কার্পেণ্টারের দৃঢ় হৃদয়ও কম্পিত হইত। কিন্তু তাঁহার উন্নত চরিত্র-প্রভাব, ক্রমে ইহাদিগকেও জয় করিয়াছিল। এই সকল দুর্দ্দান্ত নরনারী পরজীবনে এক একটি মানুষ তৈয়ার হইয়া মেরী কার্পেণ্টারের নিকট তাহাদের জীবনের ঋণ জ্ঞাপন করিয়া যে সকল বিবরণ লিখিয়াছে, তাহা পাঠ করিলে শরীর রােমাঞ্চিত হয়।

 মেরী কার্পেণ্টার্ দরিদ্রবিদ্যালয়ের বালক-বালিকাদিগের মধ্যে কার্য্য করিতে করিতে, দেখিতে পাইলেন সংশােধন বিদ্যালয়ের
প্রস্তাব।
যে——অনেক বালক এই বিদ্যা-লয়ে প্রবিষ্ট হইবার সময়েই বিখ্যাত চোর হইয়া আসিয়াছে। তখন অল্পবয়স্ক বালকবালিকা চৌর্য্য প্রভৃতি অপরাধে অপরাধী হইলে, তাহাদিগকে পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তিদিগের সহিত একই কারাগারে বাস করিতে হইত। শাস্তি দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য—চরিত্র সংশােধন। কিন্তু ক্রমাগত দণ্ডিত হইয়া, বার বার জেলখানায় বাস করিয়া ইহাদের চরিত্র আরও কঠিন এবং দূষিত হইত। অধিকন্তু যেরূপ ভাবে পূর্ণবয়স্ক ও অল্পবয়স্ক বালকবালিকাদিগকে শাস্তি পাইয়া একই কারাগৃহে বাস করিতে হইত, তাহাতে বালকবালিকাদিগের চরিত্র সংশােধিত না হইয়া বরং উত্তরােত্তর অধধাগতি প্রাপ্ত হইত। তিনি ইহার বিষময় ফল, সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। মেরী কার্পেণ্টার্ যদিও কাহাকেও কাহাকেও সৎপথে আনিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, কিন্তু তিনি বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, দরিদ্রবিদ্যালয় দ্বারা এই প্রকার বালকবালিকাদিগের চরিত্র সংশােধন করা যাইবে না। ইহাদিগকে মানুষ করিতে হইলে, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রকার বিদ্যা-লয়ের প্রয়ােজন। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা দ্বারা তাঁহার এই সঙ্কল্প দৃঢ়তর হইতে লাগিল। তিনি এই বিষয়ে অভিজ্ঞ কয়েকটি প্রধান ব্যক্তির সহিত ইহার প্রয়ােজনীয়তা-সম্বন্ধে পত্রালাপ করেন এবং অল্পবয়স্ক অপরাধীদিগের বিবরণ সংগ্রহ করিয়া তাহা আলােচনা করিতে আরম্ভ করেন।

 কয়েক মাস এই বিষয় আলোচনা করিয়া অল্পবয়স্ক অপ-রাধীদিগের স্বতন্ত্র বিদ্যালয় থাকা অতিশয় প্রয়ােজনীয়, এই সম্বন্ধে একখানি পুস্তক লিখেন। সমাজের মঙ্গলের জন্য যে, তিন প্রকার বিদ্যালয়ের প্রয়ােজন, তাহা এই পুস্তকে তিনি সাধারণকে বুঝাইতে চেষ্টা করেন। প্রথমতঃ অবৈতনিক বিদ্যালয়, দ্বিতীয়তঃ শিল্পবিদ্যালয়, তৃতীয়তঃ অল্পবয়স্ক অপ-রাধীদিগের জন্য জেলখানার পরিবর্তে সংশােধন-কারাগার অথবা বিদ্যালয়। তিনি এই পুস্তকে সুন্দর যুক্তি এবং বহু সত্য ঘটনা দ্বারা সংশােধন-বিদ্যালয়ের আবশ্যকতা প্রতিপন্ন করেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য কোন্ উপায় এবং কি কি নিয়ম অবলম্বন করিতে হইবে, তাহাও এই পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেন। ইংলণ্ডের লােক ইতঃপূর্ব্বে কখনও এই বিষয়ের চিন্তা করেন নাই; কিন্তু, মেরী কার্পেণ্টারের একা-গ্রতা এবং একনিষ্ঠার ফলে তাঁহারা এবিষয়ে মনােযােগ দিতে বাধ্য হন। তাঁহারই যত্নে এসম্বন্ধে দুইটি সভা হয় এবং তাহাতে অল্পবয়স্ক অল্পবয়স্ক অপরাধীদিগের সম্বন্ধে তাঁহার অভিজ্ঞতা ও তাহাদের উদ্ধারের উপায়, সভার সমক্ষে বিবৃত করেন। পার্লামেণ্টেও তাঁহার বক্তব্য উপস্থিত করা হয়। কিন্তু আইন দ্বারা এই প্রয়ােজনীয় বিষয় সিদ্ধ হইবার শীঘ্র কোন সম্ভাবনা তিনি দেখিলেন না।

 মেরী কার্পেণ্টার্ যাহা ভাল বুঝিতেন, তাহা সহজে পরিত্যাগ করিতেন না। সংশোধন-বিদ্যালয়-সংশােধন-বিদ্যালয়-স্থাপন।স্থাপনের প্রস্তাব পার্লামেণ্টে গৃহীত হইল না বলিয়া সঙ্কল্প ত্যাগ করিলেন না। বরং আরও দৃঢ়তর হইয়া যাহাতে এই সকল বালকবালিকা স্বতন্ত্র ভাবে নীতিপরায়ণ ব্যক্তির কর্ত্তৃত্বে বাস করিয়া ধর্ম্মশিক্ষা, বিদ্যাশিক্ষা, শিল্পশিক্ষা করিয়া সমাজের হিতকারী হইতে পারে, তাহার জন্য তিনি স্বয়ং সংশােধন-বিদ্যালয় (Reformatory School) স্থাপন করেন। তাঁহার কোন বন্ধুপ্রদত্ত একটি বাটীতে এই বিদ্যা-লয় স্থাপিত হয়। তাঁহার এই মহােদ্দেশ্য যখন দেশমধ্যে প্রচারিত হইল, তখন চতুর্দ্দিক হইতে টাকা আসিতে লাগিল। তাঁহার অন্য এক বন্ধু এই বিদ্যালয়ের জন্য চেয়ার, টেবিল প্রভৃতি প্রদান করিলেন। ১৮৫২ খৃষ্টাব্দে ১১ই সেপ্টেম্বরে এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দিনের বিষয় মেরী কার্পেটার লিখিয়াছেন——“অদ্য আমার মন, আশা অথচ ভয়ে পূর্ণ। আমি যাহাতে এই কার্য্য উপযুক্তরূপে চালাইতে পারি, তাহার জন্য প্রার্থনা ব্যতীত আর কিছুই সম্বল নাই”। তিনি দরিদ্রবিদ্যালয়ে শিক্ষা দান করিয়া যে সময় পাইতেন, তাহা এই সংশােধনবিদ্যালয়ে দান করিতেন। এতদিন ইহার জন্য যে প্রকার চিন্তা ও অনিশ্চয় ছিল, তাহা দূর হইয়া তাঁহার হৃদয় শান্তিপূর্ণ হইল। দরিদ্রবিদ্যা-লয়ের ছাত্রগণকে যে অগাধ প্রেম দ্বারা সৎপথে আনিতে-ছিলেন, সংশােধন-বিদ্যালয়ের ছাত্রগণের প্রতিও তাঁহার সেই প্রেম ধাবিত হইল। তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল—কঠিন, নির্দ্দয় ব্যবহার দ্বারা মানব-হৃদয়, মানব-চরিত্র কখনও পরিবর্ত্তিত হয় না। কিন্তু, প্রেম ও কোমল ব্যবহারই——মানবচরিত্র-পরিবর্তনের একমাত্র উপায়। তিনি এই প্রেম দ্বারাই এই সকল অশিষ্ট, অদম্য, কঠিনহৃদয়গুলিকে সম্পূর্ণরূপে অবনত করিয়া সৎপথে চালিত করিয়াছিলেন। এক মাস যাইতে না যাইতে দেখা গেল, এই বিদ্যালয় দ্বারা প্রভূত কল্যাণ সাধিত হইতেছে। তিনি লিখিয়াছেন “একটী ছােট বালক যাহাকে বাধ্য হইয়া আবদ্ধ করিয়া রাখা গিয়াছিল, সে যখন আমার নিকট নীত হইল, তখন আমার স্কন্ধে হস্তাৰ্পণ করিয়া ক্রন্দন করিতে করিতে, তাহার সকল দুঃখকাহিনী আমাকে বলিল। আমি তাহাকে আদরের সহিত কয়েকটী চুম্বন করাতে, তাহার সকল দুঃখ দূর হইল। আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম যে, আমি যে তাহাকে ভালবাসি, তাহা সে বেশ জানে। আমি তাহার ভালবাসা পাইয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ করিলাম”। এইরূপে মেরী কার্পেণ্টার্ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপীদিগকে পুণ্যবান্ করিতে লাগিলেন। শীত, বৃষ্টি অগ্রাহ্য করিয়া তিনি প্রত্যহ ব্রিষ্ট-লের দরিদ্র-বিদ্যালয় হইতে কিংসউডস্থিত এই সংশােধন বিদ্যালয়ে পদব্রজে গমন করিতেন।

 দরিদ্র-বিদ্যালয় এবং সংশােধন-বিদ্যালয় যাহাতে গবর্ণ-মেণ্ট কর্তৃক অনুমােদিত এবং সাহায্যপ্রাপ্ত হয়, তাহার জন্য মেরী কার্পেণ্টার্ ঘােরতর পরিশ্রম করিতে লাগিলেন। সম্মুখে মহানিষ্ট সাধিত হইতেছে, ঈশ্বরের সন্তানগণের উন্নতির কোন উপায় হইতেছে না, অথচ ইহার প্রতিকারের কোন চেষ্টা না করিয়া নিশ্চেষ্ট ভাবে বসিয়া থাকা মেরী কার্পেণ্টারের স্বভাব ছিল না। এই দুই স্কুলের জন্য তিনি গবর্ণমেণ্টের নিকটে কত আবেদন-পত্র পাঠাইয়াছেন, পার্লা-মেণ্টের সভ্যদিগের সহিত দেখা করিয়া ইহার প্রয়ােজনীয়তা বুঝাইয়া দিয়াছেন, ইহার জন্য কত সভা-সমিতি করিয়াছেন, তাহা ভাবিলে অবাক্ হইতে হয়। এ দিকে গৃহের যে সকল কর্ত্তব্য, তাহাও সম্পাদনে ত্রুটি করিতেন না।

 ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে তাঁহার পরিশ্রমের ফল ফলিল। সংশােধন-বিদ্যালয় পার্লামেণ্ট পার্লামেণ্টের
অনুমোদন।
কর্তৃক অনু-মােদিত হইল। তৎপূর্ব্বে এই সকল অপরাধীদিগকে এই বিদ্যালয়ে রাখিতে তিনি গবর্ণমেণ্ট হইতে কোন প্রকার সাহায্য পাইতেন না। তাহারা বিদ্যা-লয় হইতে পলায়ন করিলে কিংবা কোন প্রকার অন্যায় কার্য্য করিলে, বিচারক কি পুলিসের সাহায্য করিবার অধি-কার ছিল না। মেরী কার্পেণ্টার্ কেবলমাত্র কয়েকটি শিক্ষক ও শিক্ষয়িত্রীর সাহায্যে এই সকল দুর্দ্দান্ত অপরাধী-দিগকে অতি স্নেহের সহিত পরিচালনা করিয়া রক্ষা করিতেন। এই বৎসরেই তিনি “রেডলজ্” নামক বাটীতে বালিকাদিগের নিমিত্ত স্বতন্ত্র সংশােধন-বিদ্যালয় স্থাপন করেন। এই সময়ে তিনি রবিবাসরীয়-বিদ্যালয়, দরিদ্র-বিদ্যালয় এবং কিংস্উড স্থিত সংশােধন-বিদ্যালয়ে নির্দ্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত থাকিয়া প্রত্যেক বিদ্যালয়ের কার্য্য সম্পাদন করিতেন। বালিকাদিগের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই নব বিদ্যালয় এখন হইতে তাঁহার সর্ব্বাপেক্ষা অধিক মনােযােগ আকর্ষণ করিল। অত্যধিক পরিশ্রমে তিনি এই সময়ে পীড়িত হইয়া পড়েন; কিন্তু, সুস্থ হইয়া পুনরায় এই সমুদয় কার্য্য করিতে আরম্ভ করেন। তাঁহার অসুস্থতার সময়ে সমুদয় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীগণ তাঁহার জন্য এতদূর ব্যাকুল হইয়াছিল যে, এই সময়ে পাছে তাহাদের কোন ব্যবহারে তিনি মনােবেদনা প্রাপ্ত হন, সেই ভয়ে তাহারা কোন প্রকার অন্যায় কার্য্য করিত না। মেরী কার্পেণ্টার্ পরে এই বাটীতেই বাস করেন। আয়লণ্ডবাসিনী খ্যাতনাম্নী কুমারী কব্ ব্রহ্মবাদিনী ছিলেন। তিনি একেশ্বরবাদীদিগের ব্রহ্মবাদিনী
কুমারী কব্।
ধর্মগ্রন্থ পাঠ করিয়া খ্রীষ্টধর্মের প্রতি বিশ্বাস হারাইয়াছিলেন। যখন তদীয় পিতা মিঃ চার্লস্ কবকে তাঁহার ধর্ম্মপরিবর্ত্তনের কথা জ্ঞাপন করেন, তখন তাঁহার পিতা ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেন। ব্রহ্মবাদিনী কুমারী কব্, যখন পিতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হন, তখন মেরী কার্পেণ্টার্, তাঁহাকে সাদরে আহ্বান করিয়া নিজ বাটীতে স্থান প্রদান করেন। কুমারী কব্, মেরী কার্পেণ্টারের সংসর্গে আসিয়া আপনাকে কৃতার্থা মনে করিয়াছিলেন। তিনিও মেরী কার্পেণ্টারের মহচ্চরিত্রে ও পরার্থপরতায় অনুপ্রাণিত হইয়া দেশের ও দশের উপকারার্থে আপনাকে সমর্পণ করিয়াছিলেন। দরিদ্রা-বাসের উন্নতি-সাধন, অত্যাচারী স্বামীদিগের হস্ত হইতে স্ত্রীলােকদিগের পৃথক্ করণ, রুগ্ন, জীর্ণ, শীর্ণ, অসহায় দরিদ্রদিগের সাহায্যার্থ সভা স্থাপন, পশু-ব্যবচ্ছেদ নিবারণ প্রভৃতি নানাবিধ সৎকার্য্যের অনুষ্ঠান ও সম্পাদন করিয়া-ছিলেন। এই সকলই যে, মেরী কার্পেণ্টারের সংসর্গের ফল, তাহাদের কার্যবিবরণ দেখিলেই সহজে প্রতীয়মান হয়।  অত্যধিক পরিশ্রমে পীড়িত হইয়া মেরী কার্পে-ণ্টার্ রবিবাসরীয় বিদ্যালয়ের সুপারিণ্টে-সুপারিণ্টেণ্ডেণ্ট
পদত্যাগ ।
ণ্ডেণ্টের পদত্যাগ করেন। তিনি পঁচিশ বৎসর এই কার্য্য সুচারুরূপে সম্পাদন করিয়া যখন ইহা ত্যাগ করিলেন, তখন তাঁহার সহযােগী শিক্ষক ও শিক্ষয়িত্রী-গণ তাঁহাদের শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ তাঁহাকে উপহার প্রদান করেন। এক্ষণে রবিবাসরীয় বিদ্যালয়ের কার্য্য ত্যাগ করিয়া যে সময় পাইলেন, তাহা “রেডলজ”-স্থিত বালিকাবিদ্যালয়ে ক্ষেপণ করিতে লাগিলেন। মেরী কার্পে-ণ্টারের মহান্, প্রেমপূর্ণ চরিত্রপ্রভাব এবং উন্নত আদর্শের মধ্যে থাকিয়া মনুষ্যসমাজের হেয় এই সকল বালি-কার চরিত্র, ব্যবহার এবং প্রকৃতির আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন হইতে লাগিল। যে সকল পুলিসকর্ম্মচারিগণ তাহাদিগকে ধৃত করিয়া কারাগারে লইয়া গিয়াছিল, তাহারাও এখন এই বালিকাদিগকে চিনিতে পারিল না। উন্নত, পবিত্র এবং উচ্চ-শক্তির প্রভাবে মনুষ্যচরিত্র এইরূপেই পরিবর্ত্তিত হয়। নিরাশ্রয় বালকবালিকা ও কয়েদীদিগের অবস্থার উন্নতিবিধান জন্য গবর্ণমেণ্টের নিকট তিনি নানাপ্রকার সুযুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব করিয়াছিলেন। কয়েদী দের অবস্থা সুচারুরূপে জ্ঞাত হইবার জন্য তিনি আয়র্লণ্ডের কারাগৃহের উন্নত প্রণালী পর্যবেক্ষণ করিতে আয়ার্লণ্ড গমন করেন। যে সকল বালক বালিকা দরিদ্র-বিদ্যালয় এবং সংশােধন-বিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া বাহির হইত, তাহাদের অর্থোপার্জ্জনের সুবিধা করিয়া দিবার জন্য এবং তাহাদের উপর তীব্র দৃষ্টি রাখিবার জন্য “চিলড্রেন্স এজেন্সী (Childrens agency) স্থাপন করেন। তৎপরে শিল্প-বিদ্যালয় (Industrial Schools) এবং শ্রমজীবীদিগের উপকারার্থ তাহাদিগের জন্য বিশ্রামাগার স্থাপন করেন।