বিষয়বস্তুতে চলুন

মেরী কার্পেণ্টার/ভারতের কার্য্য

উইকিসংকলন থেকে

ভারতের কার্য্য।

৮৬০ খৃষ্টাব্দের শরৎকালে একজন ভারতবর্ষীয় খ্রীষ্টান ইংলণ্ডে গমন করেন। ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে রাজা রামমােহন রায় ইংলণ্ডে গমন করিয়া মেরী কার্পেণ্টারের হৃদয়ে ভারতের প্রতি যে স্নেহ, যে উৎসাহ অঙ্কুরিত করিয়া দিয়াছিলেন, এই নবাগত ভারতবাসীকে দেখিয়া তাহা ভারতে আগমনের উদ্যোগ। প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি ভারতে আগমন করিয়া এতদ্দেশের নারীদিগের শোচনীয় অবস্থা পর্যবেক্ষণ করিতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইলেন। ১৮৬৪ খৃষ্টাব্দে ১২ই জানুয়ারী তাঁহার দৈনন্দিন লিপিতে লিখিয়া-ছিলেন, “আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, এখন হইতে ভারতের স্ত্রীজাতির কল্যাণসাধন করিতে সমগ্র মনঃপ্রাণ নিয়ােগ করিব। ঈশ্বর বল দিন, যেন এই প্রতিজ্ঞা পালন করিতে সমর্থ হই।” গৃহে তাঁহার বহু মহৎ কার্য্য ছিল; কিন্তু রামমােহন রায়ের জন্মভূমি ভারতের নারীদিগের অজ্ঞানান্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থা তাঁহার কোমল প্রাণকে এমনই দ্রবীভূত করিয়াছিল যে, তাঁহার গৃহের কর্তব্যকার্য্য তাঁহাকে আর বাঁধিয়া রাখিতে পারিল না। তিনি আর গৃহে থাকিতে পারিলেন না। তিনি ভারতে আসিবার জন্য উৎকণ্ঠিত হইয়া পড়িলেন।

 ঈশ্বরের আদেশে ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে তিনি বােম্বাই নগরে পদার্পণ করিলেন। তিনি ভারতে আসিয়া ভারতের
অভিজ্ঞতালাভ।
যে বিশেষ কিছু কার্য্য করিতে পারিবেন, তাহা কখন মনে করেন নাই। কিন্তু কারাগার এবং অন্যান্য জনহিতকর কার্য্যসম্বন্ধে তাঁহার অভিজ্ঞতার খ্যাতি এই সুদূর ভারতেও ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। বােম্বাই নগরে উপস্থিত হইবামাত্র ভারত গবর্নমেণ্ট স্ত্রীশিক্ষা, কারাগারের উন্নতি প্রভৃতি জনহিতকর কার্য্যসম্বন্ধে তাঁহার মতামত জানিতে চাহিলেন। এইরূপে এখানে আসিয়াই তাঁহার সম্মুখে কার্য্য করিবার নূতন পথ দেখিতে পাইলেন। নারীদিগের শিক্ষা, নারীদিগের অধঃপতিত, পদদলিত অবস্থার পরিবর্তন করিতে দৃঢ়সংকল্প হইলেন। যদিও তখন কলিকাতা, বােম্বাই, পুনা প্রভৃতি কয়েকটি নগরে বালিকাবিদ্যালয় ছিল,কিন্তু তাহাদের অবস্থা শোচনীয় ছিল। অতি অল্পসংখ্যক বালিকাই স্কুলে অধ্যয়ন করিত এবং প্রায় সকলেরই ১১।১২ বৎসর বয়সে জ্ঞানার্জ্জন শেষ হইত। যে জ্ঞানার্জ্জনের অন্ত নাই, যে জ্ঞানলাভসম্বন্ধে মহাজ্ঞানী নিউটন্ বলিয়াছিলেন, “আমি এখনও জ্ঞান-সমুদ্রতীরে উপলখণ্ড আহরণ করিতেছি,” সেই জ্ঞানলাভ ভারতবর্ষীয়া বালিকাদিগের দশ, এগার বৎসরেই শেষ হইয়া যাইত! তিনি এই অবস্থা দেখিয়া অবাক্ হইলেন। তিনি আরও আশ্চর্য্যান্বিত হইলেন যে, স্ত্রীলােকদিগের শিক্ষা দিবার জন্য প্রায় প্রত্যেক স্কুলে পুরুষ শিক্ষক নিযুক্ত। শিক্ষয়িত্রী পাওয়া অতি দুর্লভ ছিল।

 বােম্বাই নগরে আসিবার কয়েক দিন পরে তিনি আহ্-মেদাবাদ নগরে গমন করেন। এই স্থানের কারাগৃহ, হাঁসপাতাল, উন্মাদালয়, বিদ্যালয় প্রভৃতি পরিদর্শন করেন এবং তৎসঙ্গে ভারতবর্ষীয়দিগের চরিত্র এবং অভাবও পর্য্যবেক্ষণ করিয়া ভারতের অবস্থা সম্বন্ধে প্রভূত জ্ঞানলাভ করেন। তাঁহার প্রখর পর্য্যবেক্ষণক্ষমতা এবং তীক্ষ অনুভব শক্তির দ্বারা তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রকার অধিবাসীদিগের জীবনালােচনা করিয়া অপার আনন্দ সম্ভোগ করিতেন। তিনি অবসর সময়ে ভারতের অসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য চিত্রিত করিয়া ভারতের প্রতি তাঁহার অনুরাগ প্রকাশ করিতেন। তিনি তাঁহার অমূল্য কার্য্য দ্বারা ভারতানুরাগের পরিচয় দিয়াছিলেন; অধিকন্তু চিত্রকলা দ্বারাও তাঁহার হৃদয়ের এই গভীর ভাব প্রকাশ করিয়া আনন্দ পাইতেন। আহ‍্মেদাবাদ নগরেই তাঁহার ভারতীয় কার্যপ্রণালী স্থির হয়। ভারতে স্ত্রীশিক্ষার যে সকল অন্তরায় বর্ত্তমান, তাহা তিনি সাধারণ ভাবে জ্ঞাত ছিলেন। প্রাচীন কালে ভারতের নারীদিগের শিক্ষার অতি উচ্চ আদর্শ ছিল সত্য; কিন্তু এই সময়ে দেশের লােকে এই সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন এবং অমনােযােগী হইয়া পড়িয়াছিল। মেরী কার্পেণ্টার্ কলিকাতা, পুনা, আহ‍্মেদাবাদ, মান্দ্রাজ, বােম্বাই প্রভৃতি স্থানের বালিকাবিদ্যালয়গুলি পরিদর্শন করেন। তিনি কলিকাতা আগমন করিয়া বেথুন স্কুল পরিদর্শন করেন; এবং ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় যােগদান করেন।

 তিনি ভারতের রাজপুরুষদিগের তিনটি বিষয়ের প্রতি মনােযােগ আকর্ষণ করেন—স্ত্রীশিক্ষা, সংশােধন-বিদ্যালয় এবং কারাবন্দীদের অবস্থা। তাঁহার অদম্য উৎসাহ, অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে দেশের লােকে এই তিন বিষয়ের প্রতি মনােযােগ দিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। তাঁহারা সকলে স্ত্রীশিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা বুঝিতে লাগিলেন এবং নারীদিগকে শিক্ষা দিতে উৎসাহ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। নারীজীবনের উদ্দেশ্য অতি উচ্চ এবং মহান্। উপযুক্ত শিক্ষা পাইলে, নারী জগতে মহৎ কার্য্য সাধন করিতে পারেন। ভারতের নারীদিগের হীন অবস্থা, জীবনের হীন লক্ষ্য দেখিয়া মেরী কার্পেণ্টার্ অত্যন্ত দুঃখিত হন। মেরী কার্পেণ্টার্ দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করিতেন যে, ভারতের নারী শিক্ষিতা না হইলে ভারতবর্ষ কোন কালেও জগতের মধ্যে উপযুক্ত স্থান অধিকার করিতে পারিবে না। তিনি এই ভাব জনসাধারণের মধ্যে বিস্তার করিতে প্রাণপণে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, “এই মহৎ কার্য্য সম্পাদন করিবার পথে বহু বাধা, বিঘ্ন বর্তমান আছে সত্য, কিন্তু আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে বলিতেছি যে, দৃঢ় বিশ্বাস, অক্লান্ত অধ্যবসায় এবং অদম্য উৎসাহ থাকিলে সকল বাধা বিঘ্ন দূরে পলায়ন করিবে, এই কার্য্যে সিদ্ধিলাভ করা যাইবে।”

 তিনি কলিকাতায় আগমন করিয়া নিম্নশ্রেণীর বালক-বালিকাদিগের জন্য অবৈতনিক বিদ্যা-লয় স্থাপন করেন। অবৈতনিক
বালিকা-বিদ্যালয়।
ইতােমধ্যে সার জন্ লরেন্স সিমলা হইতে কলিকাতা আগমন করাতে তিনি গবর্নমেণ্ট-প্রাসাদে বাস করিবার জন্য নিমন্ত্রিত হইয়া তথায় গমন করেন। মেরী কার্পেণ্টার্ স্ত্রীশিক্ষা, কারাগৃহের উন্নতি-সম্বন্ধে যে সকল প্রস্তাব করিয়াছিলেন, এবং যে প্রণালী স্থির করিয়াছিলেন, তাহা কার্য্যে পরিণত করিতে সার্ জন্ এবং লেডী লরেন্স্ তাঁহাকে নানা প্রকারে সাহায্য করেন। তিনি গবর্ণমেণ্ট প্রাসাদ হইতে ভারত নারী-সম্বন্ধে তাঁহার ভগিনীকে এই পত্র লিখিয়াছিলেন,—“গোঁড়া লোকগুলি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসে না। আমি ভিন্ন-ধর্মাবলম্বিনী, এই জন্য যে, তাহারা আমার সহিত দেখা করে না, তাহা নহে; আমি ভারতীয়া স্ত্রীলােকদিগের অবস্থার উন্নতি করিতে এবং তাহাদিগকে শিক্ষা দিতে আসিয়াছি, এই একমাত্র কারণে তাহারা আমার নিকট আসে না। স্ত্রীলােকগণ শিক্ষিতা হইলে, তাহাদের অবস্থা উন্নত হইলে, পুরুষগণ তাহাদের স্ত্রীদিগকে আর সম্পূর্ণ দাসত্বপাশে আবদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিবে না, এই স্বার্থপর ভাবে প্রণােদিত হইয়াই এই গোঁড়া লােকগুলি সাবধানতার সহিত আমার সংস্রব ত্যাগ করিয়াছে। আমারও ইহাদের জন্য কোন সহানুভূতি নাই। কিন্তু এমন অনেক মহাপ্রকৃতিসম্পন্ন, বিদ্বান্, উন্নতচরিত্রের লােক আছেন, যাঁহাদের কার্য্যের সহিত আমি পূর্ণরূপে সহানুভূতি করি।” মেরী কার্পে-ণ্টার্ কলিকাতায় অবস্থানকালীন কয়েকটি বক্তৃতা করেন। একটি সভাতে তিনি ইংলণ্ডের সমাজ-বিজ্ঞান সভার কার্য্য বর্ণনা করেন। এই সভার পর বৎসরই বঙ্গদেশীয় সমাজ-বিজ্ঞান সভা (Bengal Social Science Association) স্থাপিত হয়।

 উপযুক্ত বালিকাবিদ্যালয় স্থাপিত হইল বটে; কিন্তু; উপযুক্ত শিক্ষয়িত্রী পাওয়া দুর্ল্লভ। ফিমেল নর্ম্ম্যাল
স্কুলের প্রস্তাব।
উপ-যুক্ত শিক্ষয়িত্রী ভিন্ন বালিকাদিগের শিক্ষা দেওয়ার আশা, সুদূরপরাহত। ইহা দেখিয়া তিনি শিক্ষয়িত্রী প্রস্তুত করিবার জন্য ফিমেল্ নর্ম্ম্যাল (Female Normal School) স্কুল স্থাপন করিতে চেষ্টিত হইলেন। এই বিষয়ের প্রয়ােজনীয়তা বুঝাইয়া দিয়া ভারতের তদানীন্তন ষ্টেট সেক্রেটারী লর্ড সলসবেরীকে সমুদয় অবস্থা অবগত করিয়াছিলেন। ভারতের তৎকালিক গবর্ণর জেনারেল সার জন্ লরেন্স, বঙ্গেশ্বর সার রিচার্ড টেম্পল্, শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টর ও প্রধান প্রধান রাজকর্ম্মচারীদিগকে স্ত্রী-শিক্ষা এবং ফিমেল্ নর্ম্ম্যাল্ স্কুল স্থাপনের গুরুতর প্রয়ােজনীয়তা বুঝাইয়া দেন।

 মেরী কার্পেণ্টার এক বৎসর ভারতে থাকিয়া, স্ত্রীশিক্ষা, কারা-সংস্কার, কয়েদীদিগের শিক্ষা প্রভৃতি কতকগুলি গুরুতর কার্য্যের অবতারণা করিয়া ইংলণ্ডে গমন করেন। ইংলণ্ডে গমন করিয়াও তিনি উপরি-উক্ত বিষয় সম্বন্ধে ভারতের গবর্ণর জেনারল, বােম্বাইয়ের গবর্ণর এবং ভারতের প্রধান প্রধান উৎসাহী লােকদিগের সহিত পত্রালাপ করেন এবং সুযুক্তিপূর্ণ প্রস্তাব দ্বারা গবর্ণমেণ্টের মনোেযােগ আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করেন। তিনি দেখিলেন, ভারতের উৎসাহী ব্যক্তিগণ যদি এই বিষয়গুলিসম্বন্ধে গবর্ণমেণ্টের নিকট আবেদন করেন, তবে কার্য্য,অচিরে সিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা। তাঁহারই পরামর্শমতে ভারতের প্রধান প্রধান উদ্যোগিগণ গবর্ণমেণ্টের নিকট স্ত্রীশিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা-সম্বন্ধে আবেদন করেন। এই আবেদনের ফলে গবর্ণমেণ্ট ফিমেল্ নর্ম্ম্যাল্ স্কুল-স্থাপনের জন্য বাৎসরিক ২২৫০০ টাকা নির্দ্ধারণ করেন। মেরী কার্পেণ্টার্ ইংলণ্ডে এই সংবাদ শ্রবণ করিয়া অত্যন্ত আশাম্বিত হন এবং ভারতের স্ত্রীশিক্ষার হিতৈষীদিগকে সত্বর এই শুভকার্যে নিযুক্ত হইবার জন্য অনুরােধ করেন।

 ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে ৭ই নবেম্বর মেরী কার্পেণ্টার্ পুনরায় ভারতবর্ষে আগমন করেন। লেডি সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের
পদ গ্রহণ।
ভারতবর্ষে আগমন করিয়া তিনি ফিমেল্ নর্ম্ম্যাল্ স্কুলের কোন প্রকার চিহ্ন না দেখিয়া গবর্ণমেণ্টের সাহায্যে স্বয়ং বােম্বাই সহরে এই প্রকার একটি বিদ্যালয় স্থাপন করিয়া তাহার লেডী সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টের পদ গ্রহণ করেন। তাঁহার এই মহাদৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইয়া বহুলােক স্ত্রী-শিক্ষা কার্য্যে অগ্রসর হন এবং কয়েকটি বিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়। তাঁহারই যত্ন এবং চেষ্টায় কয়েকটি দানশীলা মহিলা ও ধনী পুরুষ এই সকল বিদ্যালয়ে বৃত্তিদান করিতে স্বীকৃত হন। কিন্তু অতিরিক্ত পরিশ্রমে পীড়িত হইয়া তিনি পুনরায় ইংলণ্ডে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

 পূর্ব্বে দুইবার ভারতবর্ষে আগমন করিয়া অকৃত্রিম অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের সহিত যে বীজ বপন করিয়াছিলেন, তৃতীয় বার এদেশে আসিয়া তাহার কিঞ্চিৎ ফল দেখিয়া ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশান্বিত হন। দুঃখিনী ভারত-নারীর প্রতি যে অপার্থিব প্রেমে অনুপ্রাণিত হইয়া তাহাদের দুঃখ দূর করিতে চারি বৎসর পূর্ব্বে ভারতে আসিয়াছিলেন, শত লােকের অবজ্ঞা, উপহাস, কঠিন আচরণ এবং নিরাশার মধ্যেও তাহা অটল ছিল। তিনি মনে করিয়াছিলেন, তাঁহার এই আগমনই ভারতে শেষ আগমন হইল। ইহা ভাবিয়া স্ত্রীশিক্ষা-সম্বন্ধে তিনি লিখিয়াছিলেন, “আমি জানি যে, যদিও বিষয়ী এবং স্বার্থপর ব্যক্তি গণ ইহা অবিশ্বাস করিবে এবং এই বিষয় লইয়া উপহাস করিবে, কিন্তু এদেশে এমন অনেক মহানুভব, উন্নত-প্রকৃতির লােক আছেন, যাঁহারা এই কার্য্যের শক্তি অনুভব করিয়া ইহাতে প্রকৃতই আনন্দ লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা যে, দেশমধ্যে এই ভাব প্রজ্জ্বলিত করিবেন, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। আমি বিশ্বাস ও আশার সহিত বলিতেছি, ভারতবর্ষে এই কার্য্য উত্তরােত্তর উন্নতি লাভ করিবে। অতএব ভারতবর্ষ, এখন তােমার নিকট বিদায় হই।”

 ইংরাজ এবং ভারতবাসীদিগের মধ্যে প্রীতিস্থাপনের জন্য তিনি ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দে ব্রিষ্টল্ নগরে ন্যাশন্যাল ইণ্ডিয়ান্ এসােসিয়েশন্ (National Indian Association) স্থাপন করেন। তিনি এই এসােসিয়েশন্ দ্বারা ইংরাজদিগের মধ্যে ভারত সম্বন্ধে অধিকতর জ্ঞানবিস্তার করিতে প্রয়াস পাইয়াছিলেন। তিনি ইহা দ্বারা ভারতের সামাজিক অভাব, সাধারণ লােকের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার, স্ত্রীশিক্ষার উন্নতি, কারাগৃহসমূহের সংস্কার এবং অল্পবয়স্ক অপরাধীদিগের জন্য সংশােধন-বিদ্যালয় স্থাপন প্রভৃতি প্রয়ােজনীয় বিষয় সম্বন্ধে ইংলণ্ডের লােকের মনােযােগ আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।

 ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে মেরী কার্পেণ্টার্ শেষ বার ভারতবর্ষে আগমন করেন। এবারে ভারত-নারী- চতুর্থ বার
ভারতে আগমন।
দিগের অবস্থা পূর্ব্বাপেক্ষা উন্নত দেখিয়া অত্যন্ত আনন্দিত হন। পূর্ব্বে যাহারা জ্ঞানালােকের আস্বাদ কিছুমাত্র পায় নাই, তাহাদের মধ্যে কাহাকে কাহাকে শিক্ষাপ্রাপ্ত দেখিয়া অত্যন্ত আশান্বিত হন। তাঁহার প্রাণগত পরিশ্রমের ফল যে ফলিয়াছে, ইহাতে ঈশ্বরের নিকট গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। পুনাতে তিনি একদিন একটি স্কুল পরিদর্শন করিতে গিয়াছিলেন। স্কুলগৃহে প্রবেশ করিতেই সুন্দর ইংরাজীতে কে যেন তাঁহাকে সাদর অভ্যর্থনা করিল। তিনি ফিরিয়া দেখেন, বিচিবাই-নাম্নী একটী মহিলা তাঁহার সহিত কথা বলিতেছেন। বিচিবাই বলিলেন, “নয় বৎসর পূর্ব্বে আপনিই আমাকে ইংরাজী শিক্ষার প্রতি অনুরাগিণী করেন। তাহার ফলে এক্ষণে আমি আপনার সহিত ইংরাজীতে কথা বলিতে পারিতেছি।” কিন্তু তখনও দেশে আশানুরূপ স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্ত্তিত হয় নাই, কিংবা মহিলাদের হীন অবস্থার উন্নতি হয় নাই। তিনি এই শেষ বারেও ইংলণ্ডের এবং ভারতের প্রধান রাজকর্ম্মচারীদিগকে এই বিষয়ে মনােযােগ দিতে একান্ত অনুরােধ করেন।

 এদেশের কল কারখানাগুলিতে যে সকল কুলী, মজুর কাজ করিত, তাহাদের অবস্থা বড় ফ্যাক্টরী আইন। শােচনীয় ছিল। কল-কারখানাতে অল্প বয়স্ক বালকবালিকাগণ কাজ করিত এবং পূর্ণবয়স্ক লােকদিগকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করিতে হইত। অথচ তাহাদের পারিশ্রমিক পর্য্যাপ্ত পরিমাণ ছিল না। মেরী কার্পেণ্টার্ বােম্বাই, আহমেদাবাদ প্রভৃতির কল-কারখানাগুলিতে গিয়া তথাকার শ্রমজীবীদিগের দুরবস্থা দর্শনে ব্যথিতহৃদয় হন; এবং যাহাতে কল-কারখানাতে পাঁচ এবং তদূর্দ্ধ বৎসর বয়স্ক বালকবালিকাদিগের নিয়ােগ এবং পূর্ণবয়য়স্ক ব্যক্তিদিগের অতিরিক্ত পরিশ্রম নিবারিত হয়, তজ্জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। বােম্বাই নগরে কাপড়ের কলের কারখানাতে নিয়ােজিত বালকবালিকাদিগের শিক্ষার বন্দোবস্ত করিতে কর্তৃপক্ষকে উপদেশ দেন। তিনি যে স্থানে গমন করিতেন, সেই স্থানেই কারাগারের বন্দী অথবা কারখানার শ্রমজীবীদিগের পরিশ্রমের সময় নির্দিষ্ট করিতে চেষ্টা করিতেন। তিনি দেখিয়াছিলেন, ইংলণ্ডের ন্যায় ভারতেও আইন দ্বারা কারখানার বালকবালিকাদিগের শিক্ষার বন্দোবস্ত এবং শ্রমজীবীদিগের পরিশ্রমের সময় নির্দ্দিষ্ট করিতে না পারিলে, তাহার ফল অতি অশুভ হইবে। ইহা বুঝিয়া তিনি ভারতের ষ্টেট্ সেক্রেটারীর নিকট ইহার প্রয়ােজনীয় প্রতিপন্ন করিয়া তাঁহার মন্তব্য প্রেরণ করেন এবং তাঁহারই যত্নে ভারত-গবর্ণমেণ্ট ফ্যাক্টরী আইন বিধিবদ্ধ করেন।