মৈমনসিংহ গীতিকা/কমলা

উইকিসংকলন থেকে

কমলা

দ্বিজ ঈশান প্রণীত

কমলা


আরম্ভণ [১]

কানা মেঘারে[২] তুইন[৩] আমার ভাই।
এক ফোট৷ পানী দে সাইলের[৪] ভাত খাই॥
সাইলের ভাত খাইতে খাইতে মুখে হৈল রুচি।
মা লক্ষ্মীর নিয়ড়ে[৫] রাখ্য ধান এক খুচি[৬]
আসন পাতিয়া তাতে দিও পদ্মের আশি[৭]
এইখানে গাইবাম গান কমলার বারমাসী॥

এই গান গাইতে লাগে পাচ কড়ার কড়ি।
এই না গান গাইব আমি ভাগ্যিমানের বাড়ী।
ভাগ্যিমানের বাড়ী নারে আছে দালান মঠ।
আসন পাতিয়া সামনে দেও জলের ঘট
আইস মাগো সরস্বতী তোমার গুণ গাই।
তোমার গান গাইতে আমি অমৃত মধু পাই॥
তুমি হও তালযন্ত্র আমি বাদ্যকর।
আজিকার আসরে মোর কণ্ঠে কর ভর॥
সভার চরণে করি কোটী নমস্কার।
বারমাসী পাল৷ আমি করলাম প্রচার॥

( ১ )

মানিক চাকলাদার

হুলিয়া[৮] গেরাম ভাইরে দেখিতে সুন্দর।
বাগিজায়[৯] বেইড়া আছে যত সুন্দর ঘর॥
সেহিত গেরামে থাকে মানিক চাকলাদার।
ধনে জনে বাড়িয়াছে সম্পদ অপার॥
চৌচালা আটচালা তার ঘর যত খানি।
সুন্দি বেতে বান্দা আর উলুছনে ছানি[১০]
পাচ খণ্ড বাড়ী তার বিশ গোটা ঘর।
হাজারে বিজারে[১১] খাটে দাঙ্গর গাবর[১২]
খামারিয়া জমী[১৩] তার আছে চল্লিশ কুড়া[১৪]
দশ গোটা হাতি আর তিরিশ গোটা ঘোড়া॥
বন্ধ ভইরা চড়ে[১৫] তার যত দুধের গাই।
মইষ ছাগল মেড়া[১৬] লেখাজুখা নাই॥
টাইল[১৭] ভরা ধান আর গোয়াইল ভরা গরু।
বছরে বছরে বান্ধা এক পুরা সরু[১৮]
হাজারে বিজারে লোক দিন রাইত খায়।
অতিথ আইলে কভু ফিরিয়া নাই সে যায়॥
ফকির-বৈষ্টম যদি হাক ছাড়ে দুয়ারে।
কাটায় মাপ্যা[১৯] চাউল দেয় হরিষ অন্তরে॥

রান্ধা যদি হয় তবে দেয় খাওয়াইয়া।
নয়। কাপড় দিয়া দেয় বিদায় করিয়া॥
বামুন আস্যা ঘরে অতিথ হইলে।
দান-দক্ষিণা কত দেয় যাইবার কালে॥
বার মাসের তের পার্ব্বন ইতে[২০] নাহি আন।
দেবতার বরে তেই হইল ভাগ্যিমান॥

এক পুত্র হইল তার নামেতে সুধন।
রূপেতে জিনিয়া যেন রতির মদন॥
তার আগে এক কন্যা হৈল রূপবতী।
স্বৰ্গ ছাড়িয়া উপনীত যেমন সরস্বতী॥
সুলক্ষণা কন্যা তার নামটী কমলা।
চান্দের পসরে[২১] যেমন ঘর হইল উজলা॥
নিদান নামেতে তার আছয়ে কারকুন[২২]
মহলের যত কিছু করে দেখশুন॥১—৩২


( ২ )

চিকন গয়লানী

গেরামে আছয়ে এক চিকন গোয়ালিনী।
যৌবনে আছিল যেমন সবরি-কলা-চিনি॥
বড় রসিক আছিল এই চিকন গোয়ালিনী।
এক সের দৈয়েতে দিত তিন সের পানি॥
সদাই আনন্দ মন করে হাসিখুসী।
দই-দুধ হইতে সে যে কথা বেচে বেশী॥

যখন আছিল তার নবীন বয়স।
নাগর ধরিয়া কত কর্‌ত রঙ্গরস॥

রসেতে রসিক নারী কামের কামিনী।
দেশের লোকেতে ডাকে চিকন গোয়ালিনী॥
যদিও যৌবন গেছে তবু আছে বেশ।
বয়সের দোষে মাথার পাকিয়াছে কেশ॥
কোন দন্ত পড়িয়াছে কোন দন্তে পোকা।
সোয়ামী মরিয়া গেছে তবু হাতে শাখা॥
চলিতে চলিয়া পড়ে রসে থলথল।
শুখাইয়া গেছে তার যৌবন-কমল॥
তবু মনে ভাবে যে সে চিকন গোয়ালিনী।
বৃদ্ধ বয়সে যেমন ভাবের ভামিনী[২৩]
সংসারেতে আছে যত লুচ্চা লোকন্দরা[২৪]
গোয়ালিনীর বাড়িত গিয়া করে ঘুরাফেরা॥

শব্দে শুনি গোয়ালিনী পান-পড়া জানে।
ঘরতনে[২৫] কুলের বধূ বাইরে টাইনা আনে॥
তেলপড়া দেয় যদি চিকন গোয়ালিনী।
সুয়ামী এড়িয়া[২৬] যায় ঘরের কামিনী॥
আর একটা ঔষধ শুনি আছে তার কাছে।
গিরধনির কানে আর কাল-পনা মাছে॥
কিছু কিছু পেচার মাংস বাটিয়া গুটিয়া[২৭]
তিল পরমাণ বড়ী করে রৌদ্রে শুকাইয়া॥
এক এক বড়ীর দাম পাচ থুরি[২৮] কড়ি।
এরে খাইলে পাগল হয় পাড়ার যত নারী॥
বাসী জলে বড়ী খায় উঠিয়া বিয়ানে[২৯]
সতী নারী পতি ছাড়ে ঔষধের গুণে॥

( ৩ )

কমলা—যৌবনাগমে

দেখিতে সুন্দরী কন্যা পরথম যৌবন
কিঞ্চিৎ করিব তার রূপের বর্ণন॥
চান্দের সমান মুখ করে ঝলমল।
সিন্দুরে রাঙ্গিয়া ঠুট[৩০] তেলাকুচ ফল॥
জিনিয়া অপরাজিতা শোভে দুই আখি।
ভ্রমরা উড়িয়া আসে সেই রূপ দেখি।
দেখিতে রামের ধনু কন্যার যুগ্ম ভুরু।
মুষ্টিতে ধরিতে পারি কটিখানা সরু॥
কাকুনি শুপারি গাছ বায়ে যেন হেলে।
চলিতে ফিরিতে কন্যা যৌবন পড়ে ঢলে॥
আষাঢ় মাস্যা বাশের কেরুল[৩১] মাটী ফাট্যা উঠে।
সেই মত পাও দুইখানি গজন্দমে[৩২] হাটে॥
বেলাইনে[৩৩] বেলিয়া তুলছে দুই বাহুলতা।
কণ্ঠেতে লুকাইয়া তার কোকিলে কয় কথা॥
শ্রাবণ মাসেতে যেন কাল মেঘ সাজে।
দাগল-দীঘল[৩৪] কেশ বায়েতে বিরাজে॥
কখন খোপা বান্ধে কন্যা কখন বান্ধে বেণী।
রূপে রঙ্গে সাজে কন্যা মদনমোহিনী॥
অগ্নি-পাটের শাড়ী কন্যা যখন নাকি পরে।
স্বর্গের তারা লাজ পায় দেখিয়া কন্যারে॥
আষাইঢ়া জোয়ারের জল যৌবন দেখিলে।
পুরুষ দূরের কথা নারী যায় ভুলে॥১—২২

( ৪ )

কারকুনের প্রেম ও চিকন গয়লানীর শরণ লওয়া

একদিনত না কমলা গো স্নান করিতে যায়।
আগে পাছে সখীগণ চলে পায় পায়॥
যৌবনের ভারে কন্যা সাম্‌নে পড়ে এলি[৩৫]
এরে দেখ্যা সখীগণ দেয় করতালি॥
জলের ঘাটেতে গেল করি উলা মেলা[৩৬]
এমন সময়ে কারকুন পন্থে দিল মেলা॥
হাত পাও মাঞ্জিয়া কন্যা সানে বান্দা ঘাটে।
ডুব দিতে যায় গো কন্যা জলের নিকটে।
জলেতে সুন্দরী কন্যা ফুটা পদ্মফুল।
কন্যারে দেখিয়া কারকুন হইল আকুল॥
লুকাইয়া বকুলের ডালে মিটায় চক্ষের আশ।
যত দেখে তত তার বাড়ে যে পিয়াস॥
ছান[৩৭] করিতে যেদিন কন্যা যায় গো ঘাটেতে।
কারকুন লুকাইয়া দেখে কদম্ববৃক্ষেতে॥
মনের আগুন মনে জ্বলে না করে পরকাশ।
অন্ধিসন্ধি[৩৮] করে কত কেমনে মিটে আশ॥


চাকলাদার বাড়ীতে সেই বৃদ্ধ গোয়ালিনী।
ক্ষীর সর লইয়া নিত্যি করে আনিগুনি[৩৯]
গোয়ালিনীর সঙ্গে কন্যার হইল পরিচয়।
মিলিলে দুইজনে কত রসের কথা কয়॥
গোয়ালিনীর অত ভাব কন্যার যে সনে।
আরও কত ওষধপাতি গোয়ালিনী জানে॥

লুকাইয়া দেখা

“কারকুন লুকাইয়া দেখে কদম্ববৃক্ষেতে॥”
কমলা, ১২৬ পৃঃ

তবেত কারকুন শুনি গোয়ালিনীর গুণ।
খাইয়া বাটার পান না লইল চুন॥
ধীরে ধীরে যায় পরে গোয়ালিনীর বাড়ী।
কারকুনে দেখিয়া কয় গোয়ালের নারী॥
“কিসের লাগ্যা আইছুইন[৪০] দুয়ারে অইছুইন খারা[৪১]
কাঙ্গালের দুয়ারে আইজ আত্তির কেন পাড়া[৪২]॥”

গোয়ামরি হাসি[৪৩] তবে কহিছে কারকুন।
“খালি পান খাইয়া আইছি ভাণ্ডে নাই চুন॥
চুনের লাগিয়া আমি আইলাম তোমার বাড়ী।
সঙ্গে কিন্তু নাই মোর এক কানা কড়ি॥

গোয়ালিনী কয় “আমি নাহি বেচী পান।
বিনামূল্যে দেই পান সঙ্গেতে পরাণ॥
রসিক নাগর পাইলে রসে যাই ভাসি।”
গোয়ালিনীর কথা শুনি কারকুন কয় হাসি॥
“অত বয়স হইল তোমার নাহি যায় রস।
কত জানি গোয়ালিনী জান রঙ্গরস॥
তিন কাল গেছে তোমার এক কাল আছে।
কত রঙ্গ শিখ্যাছিলা তোমার গোয়ালের কাছে॥”

চিকন গোয়ালিনী কয় “শুন কথার নাল[৪৪]
মরিচ যতই পাকে তত হয় ঝাল॥
সময়ে বয়স যায় নাহি যায় রস।
মুখের কথায় মোর ত্রিজগত বশ॥
ফান্দ পাতি চান[৪৫] ধরি জমীনে থাকিয়া।
আমার গুণের কথা জানে যত ভূঞা[৪৬]

কি কারণে সন্ধ্যাবেলা আইলা মোর বাড়ী।
কোন কাজের হেতু আইলা কহ সত্য করি॥”

এত বলি গোয়ালিনী দৌড়ী তাড়াতাড়ি।
বৈসনের[৪৭] লাগি দিল নতুন একখান পিড়ি॥
কেওয়া সুপারী খয়ার[৪৮] সাচী পান দিয়া।
গোয়ালিনী কারকুনেরে দিল পান বানাইয়া॥
গুরগুরিতে ভরিয়। তামুক দিল কারকুনেরে।
কারকুন কহিল পরে গোয়ালিনীর হাত ধরে॥

“শুন শুন শুন ওগো চিকন গোয়ালিনী।
তোমার ত যৌবন ছিল জোয়ারের পানি॥
তুমিত রসিক নারী ভাল কইরা জান।
যৌবনে কেমন করে মন উচাটন॥
শুন তোমার কাছে কই মোর মনের কথা।
কমলারে দেখ্যা বড় পাই মনে ব্যথা॥
কেমনে পাইব তারে কও গোয়ালিনী।
কমলারে কৈরে দান রাখ মোর প্রাণী॥
আনইলে[৪৯] আমার প্রাণ রাখা হইল ভার।
মরিলেও না ছাড়িব তোমার কাছার[৫০]॥”

এতেক শুনিয়া তবে কয় গোয়ালিনী।
“এই কথা যেন আমি আর নাই যে শুনি॥
চাকলাদার শুনলে তোমার লইবে গর্দ্দান[৫১]
অকালে বিপাকে যেন হারাইবা প্রাণ॥”
এত শুনি পড়ে কারকুন গোয়ালিনীর পাও।
“সাত পাচ বলি মোর নাহি যে ভারাও[৫২]

ভাল জানি গোয়ালিনী তোমার ঔষধের গুণ।
তুমি দয়া করলে আমার নিবিব আগুন॥
মার আর কাট লইলাম তোমার আশ্রয়।
কর মোরে বধ যদি সমুচিত হয়॥”
এতেক বলিয়া কারকুন কি কাম করিল।
একশ টাকা গণ্যা গোয়ালিনীর হস্তে তুল্যা দিল॥১-৭৬


( ৫ )

প্রেমলিপির পুরস্কার

কারকুন নিত্যিই পরে করে আনিগুনি।
কিছু কিছু পয়সা কড়ি পায় গোয়ালিনী॥
পরেত কমলার নামে পত্র যে লিখিয়া।
গোয়ালিনীর সঙ্গে কারকুন দিল পাঠাইয়া॥
পত্রেতে লিখিল “কন্যা আরে শুন দিয়া মন।
তোমার লাগিয়া মোর মন উচাটন॥
কির্‌পা কইরা কন্যা একবার চাও মোর পানে।
পরাণে বাচাও মোরে ভরা যৌবন দানে॥
আমার যা আছে তোমায় সব কৈনু দান।
তোমার লাগিয়া পারি ত্যজিতে পরাণ॥
তুমি আমার ধরম করম তুমি গলার মালা।
তোমারে না দেখলে আমার মন হয় যে উতালা॥
প্রাণে বাচাও মোরে কন্যা খাও মোর মাথা।
আমার দুঃখেতে দেখ ঝরে বৃক্ষের পাতা॥”

পত্রখানি গোয়ালিনী গাইটে বান্ধিয়া।
কন্যার মন্দিরে পরে দাখিল হৈল গিয়া॥
সোনার পালঙ্গ পরে সাজুয়া[৫৩] বিছান।
তাহাতে বসিয়া কন্যা খায় গোয়া[৫৪]-পান॥

নবীন বয়স কন্যা প্রথম যৌবন।
রূপেতে রোশনাই[৫৫] করে চান্দমা[৫৬] যেমন॥
কাল চিকন কেশে বান্দিয়াছে খোপা।
মালতীর মালা দিয়া বেড়িয়াছে সোপা[৫৭]
আশ্বিন মাসেতে যেমন পদুমের[৫৮] কলি।
বসনে ঢাকিয়া রাখে নাহি দেখে অলি॥
স্নান করিতে যখন কন্যা জলের ঘাটে যায়।
ঝাড়িয়া মাথার কেশ পায়েতে ফালায়॥
বাতাসে বসন রঙ্গে যখন উড়ে পড়ে।
ভৃঙ্গ যত উড়িয়া আসি পদ্মফুল ছাইড়ে[৫৯]
নাকের নিশ্বাসে তার বায়ুতে সুবাস।
চান্দের কিরণ যেমন অঙ্গে পরকাশ॥
পরথম যৌবন কন্যা সদা হাসিখুসী।
হাসিলে বদনে ফুটে মল্লিকার রাশি॥
নিতম্ব দেখিয়া তার নিতম্বের তরে।
আসমান ছাড়িতে চান্দ মনে আশা করে॥
কন্যার কণ্ঠস্বরে কোইলে[৬০] পায় লাজ।
দণ্ডে দণ্ডে ধরে কন্যা নানারঙ্গের সাজ॥

বসিয়া পালঙ্ক উপরে কমলা সুন্দরী।
মালতীর ফুলে মালা গাথে যত্ন করি॥
হেন কালে গেল তথা চিকন গোয়ালিনী।
গোয়ালিনী দেখি তবে হাসিলা কামিনী॥
“শুন শুন গোয়ালিনী কই যে তোমারে।
আজিকালি উচিত শিক্ষা দিবাম তোমারে॥
চোকা দইয়ে[৬১] পোকা তোর দুধে দোনা পানি।
এমন বয়স তবু না গেল ভণ্ডামী॥

লনীতে ফেনাইয়া উঠে বদ গন্ধ ভারী।
রাজ্যি হইতে খেদাইব দিয়া বেড়াবাড়ী[৬২]॥”

গোয়ালিনী কয় “ইহা বয়সের দোষ।
এই দই খাইয়া তুমি হইতা পরিতোষ॥
আগের যৌবন যদি থাকিত আমার।
এই দই খাইয়া তুমি করিতে বাহার॥
এক সের দইয়ে দিছি সাত সের পানি।
তবু লোকে ডাকিয়াছে[৬৩] চিকন গোয়ালিনী॥
চোকা দই খাইয়া লোকে কহিয়াছে মিঠা।
যৌবন হারাইয়া কন্যা হইয়াছে লেঠা॥
কাছলা[৬৪]-ভরা সাচ্চা দই পাতিল-ভরা সর।
আমার দই খাইয়া লোকে হইয়াছে অমর॥
বুড়ির দই কিন্যা মোরে কাহন দিছে লোকে।[৬৫]
কত লোক ভাস্যা গেছে আমার দইয়ের পাকে॥
মৌমাছির চাক যেমন আছিলাম আমি।
দিনরাতি কানের কাছে মাছির ভনভনি॥
অখন বয়স গেছে নদী ভাটীয়াল।
পাকা দই চোকা হয় এমন জঞ্জাল॥
সদ্য করি ননী উঠাই হদ্য যে হইয়া[৬৬]
তবু লোকে ঘেন্না করে সেই ননী খাইয়া॥
দধি না বেচিব আর ছাড়িব বেসাতি[৬৭]
শেষ কালে কিষ্ট মোর যা করেন গতি॥”

দ্বিজ ঈশান ভনে বিপরীত কাণ্ড।
আজি হতে শূন্য হইল এই দধির ভাণ্ড॥”

তখন গোয়ালিনী কয় মনেতে হাসিয়া।
“এমন বয়সে কন্যা তোমার না হৈল বিয়া॥
বয়সের দোষে যখন পুষ্প যাবে চলি।
তখন ডাকিলে কন্যা না আসিবে অলি॥
এমন যৌবন কেন অনর্থে হারাও।
কেমন কঠিন জানি তোমার বাপ-মাও॥
সময় থাকিতে কন্যা বিলাও ফুলের মধু।
সাধ্যা[৬৮] দিলে কিছু পরে না আসিবে বঁধু[৬৯]
তোমার যৌবন দেখি চিত্তে অনুরাগী।
আবার মরিয়া জন্মি যৌবনের লাগি॥
এমন যৌবন কেন যায় অকারণ।
বিয়া না করিলে কন্যা না চিন মদন॥
গাথিয়া ফুলের হার দিবা কার গলে।
তোমার গাথা মালা দেখ্যা দুঃখে অঙ্গ জ্বলে॥
এমন সুন্দর মালা যাইব শুকাইয়া।
তোমার দুঃখু দেইখ্যা কন্যা আমার কান্দে হিয়া॥
নিজের মালা নিজে পইরা কেবা সুখী হয়।
এই মতে কাটাইতে কাল উচিত নাহি হয়॥
তোমার লাইগ্যা কত ভমর পাগল হইয়া ফিরে।
অন্ধকারে বস্যা কন্যা থাকহ অন্দরে॥
বিয়া যদি হইত তোমার বনদুর্গার বরে।
ভাল দৈ আন্যা দিতাম তোমার নাগরে॥”

এই কথা শুনিয়া কন্যা মুচকি হাসিয়া।
গোয়ালিনীর কাছে কয় অধষ্ণ[৭০] হইয়া॥
“শুন শুন গোয়ালিনী বচন আমার।
আমার বিয়ার কথা অতি চমৎকার॥

সংসার হাদমে[৭১] মোর জোরা নাহি মিলে।
এই যে ফুলের মালা দেহি কার গলে॥

“পূর্বজন্ম-কথা মোর শুন দিয়া মন।
স্বর্গে তে আচিনু মোরা রতি আর মদন॥
শাপেতে পড়িয়া জন্ম মানুষের ঘরে।
মানুষের সাধ্য নাই মোরে বিয়া করে॥
দেখই আমার রূপ চান্দের কিরণ।
আমারে ভোগিতে নাই মানুষ এমন॥
সেই মনে চিন্তা করি বিরলে বসিয়া।
ধরায় থাকিব কেমনে মদনে ছাড়িয়া॥
কত বিয়ার সম্বন্ধ মোর কয় বাপ-মায়।
মনুষ্যে না হবে বিয়া না দেখি উপায়॥
বিশেষ মদন ঠাকুর কোন দিন আসে।
উত্তর কি দিব বিয়া করিলে মানুষে॥
সেই হেতু চিত্তে ক্ষমা মন কইরাছি দঢ়।
বিয়া না করিব আমি রৈব আইবুড়॥
এমন ফুলের মধু মানুষে না দিব।
মদনের ঘাটে আমি খেওয়া দিয়া খাইব॥”

এই কথা শুইন্যা তবে চিকন গোয়ালিনী।
হাসিয়। ভাঙ্গিয়া পড়ে ভাঙ্গা দেহখানি॥
তাহা দেখি কমলা যে হাসে খলখলি।
রাঙ্গা দেহ ভাঙ্গি তার চুল পড়ে এলি॥

গোয়ালিনী কয় “কন্যা শুন মোর কথা।
সত্য কহিবাম যত না হইবে অন্যথা॥
একদিন দই লইয়া যাই স্বর্গপুরে।
পন্থেতে লাগাল পাই তোমার মদনেরে॥

তোমার লাগিয়া মদন ফিরে পাগল হইয়া।
আশমানের চান্দ যেমন আমারে পাইয়া॥
মদন কহিছে “তুমি থাক মর্ত্তপুরে।
একদিন নি দেখিয়ছি আমার রতিরে॥
দই-দুধ বেচ তুমি যাও রাজার বাড়ী।
রতির বিরহানলে আমি জ্বইল্যা মরি॥
কও কও দূতি আমার মাথা খাও।
সত্য কথ। কও মোরে কিঞ্চিৎ না ভারাও॥”

“আমি কইলাম রতি তোমার রাজার ঘর আলা।
জনম লইয়াছ কন্যা নামেতে কমলা॥
বাড়ীঘরের কথা কইলাম বাপ-মায়ের নাম।
উবুৎ হইয়া[৭২] মদন করে আমারে পন্যাম॥
একখানি পত্র মদন যত্নেতে লিখিয়া।
যত্ন করি আঁচে[৭৩] মোর দিয়াছে বান্ধিয়া॥
আচল খুলি গাছল[৭৪] কথা পরীক্ষা যে কর।
তোমার বিরহে মদন করে দড়ফড়[৭৫]
এত কষ্ট করিলাম তোমার লাগিয়া।
স্বর্গ পুরে গেছি আমি দধি-দুগ্ধ লইয়া॥
উঠিতে যোজন সিড়ি কমর ভাঙ্গ্যা পড়ে।
আমি বইল্যা গেছি কন্যা অন্যে যাইতে মরে॥
আইন্যাছি মদনের পত্র দেও পুরস্কার।
এত কাম কর্ত্তে বল সাধ্য আছে কার॥”
বক্‌সিস মিলিবে ভাল দ্বিজ ঈশান কয়।
মদনের পত্র পড়া আগে উচিত হয়॥

পত্র খুলিয়া কন্যা পড়িতে লাগিল।
পড়িতে পড়িতে কন্যা ক্রোধেতে জ্বলিল॥

পুষ্পবনেতে যেমন লাগিল আগুনি।
শিরে রক্ত উঠে কন্যার অন্তর বাগুনি[৭৬]
মনের গুমর[৭৭] কন্যা মনে লুকাইয়া।
গোয়ালিনীর কাছে কয় হাসিয়া হাসিয়া॥
“শুন শুন মনের কথা চিকন গোয়ালিনী।
আমার লাগিয়া তুমি পাইলে পেরাশনি[৭৮]
স্বর্গপুরী গেছ তুমি আমার লাগিয়া।
পুরস্কার দিব আমি ভাবিয়া চিন্তিয়া॥
মদন-আগুনে আমি পুড়ি রাত্রদিন।
তোমার কার্য্যেতে আমার ফিরিল সুদিন॥
তোমার মদন ঠাকুর দেখিতে কেমন।
দেখি নাই কোন দিন সে চাঁদবদন॥”

গোয়ালিনী কয় তার রূপের বাখান।
“কার্ত্তিক কুমার হেন কথায় নাই আন॥
চান্দের ছোরত[৭৯] তার সর্ব্ব অঙ্গে জ্বলে।
তোমায় দেইখ্যা পাগল হইছে সিনানের কালে॥
বকুলের ডালে বৈসা দেখিছে তোমায়।
তোমার লাগিয়া সদা করে হায় হায়॥
বাপের বাড়ীর চাকর তোমার হয় সে কারকুন।
একবার কহি শুন তার কত গুণ॥
নারী মজাইতে তার কত গুণ আছে।
আঁখির ইসারায় কত নারী মজিয়াছে॥
পিরীতি মজিবে ভাল পানে আর চুনে।
তাহারে ভজিলে কন্যা সুখ পাইবে মনে॥”

কন্যা বলে “গোয়ালিনী কিবা দিব আর।
মনের মত লও তুমি এই পুরস্কার॥”

এত বলি গলার হার খুলিয়া লইল।
হাসি গোয়ালিনীর কণ্ঠে পরাইতে গেল॥
গোয়ালিনী ভাবে তার সুদিন উদয়।
বিধাতা মিলাইলা ভাল এই মনে লয়॥
চুলেতে ধরিয়া কন্যা নিকটে আনিল।
গোয়ালিনীর গালে তিন ঠোকর মারিল॥
ভাত খাইতে নড়ে দত্ত সান্নিকের জোরে।
ভূমিতলে পড়ে দাত কন্যার ঠোকরে॥
চুলেতে ধরিয়া তার শিরে দিল ঢিল।
পৃষ্ঠেতে মারিল তার পাঁচ সাত কিল॥
লাথি ভেদা[৮০] দিয়া তারে মাটিতে ফালায়।
গোসায়[৮১] ফুলিয়া কেবল উষ্টা[৮২] মারে গায়॥
চুলেতে ধরিয়া তার দিল তিন পাক।
লাথি মাইরা গোয়ালিনীর ভাঙ্গিলেক নাক॥

ফাপরে পড়িয়া তবে চিকন গোয়ালিনী।
কন্যার পায়েতে ধরি চক্ষে বহে পানি॥
জোরে না কান্দিতে পারে পাছে কেহ শুনে।
কিবা পত্র লেখ্যা ছিল দুরন্ত কারকুনে॥

কন্যা বলে “শুন লো চিকন গোয়ালিনী।
তিন কাল গেছে তোর না গেল নষ্টামি॥
বয়সে মজেছ কত নাগরের সনে।
পরকে মজাও কত নানান ভানে[৮৩]
শূলেতে দিতাম তোরে বাপেরে কহিয়া।
ছাড়িয়া দিলাম তবে অনেক ভাবিয়া॥
মাছি মারিয়া করি কেনে দুই হাত কালা।
কারকুনের গিয়া কইছ তোর আগছালা[৮৪]

আমার মন্দিরে তুই না আসিস্ আর।
তা হইলে গর্দ্দান কিন্তু যাইবে আর বার॥
কারকুনে কহিস তার মুখে মারি ঝাটা।
বাড়ীর চাকর হইয়া এত বুকের পাটা॥
পায়ের গোলাম হইয়া শিরে উঠতে চায়।
বেঙ্গে কবে শুনেছিস্ পদ্মের মধু খায়॥
ইচ্ছা যদি করি তারে দিতে পারি শূলে।
কুকুরে কামড়ায় কেবা কুকুরে কামড় দিলে॥”

চুপি চুপি গোয়ালিনী আসিল বাহিরে।
দন্ত বাহিয়া তার রক্তধারা পড়ে॥
পন্থের লোক জিজ্ঞাসা করে রক্ত কেন দাতে।
গোয়ালিনী কহে মৌরে মারিল সান্নিকে॥
আরও লোকে জানিবারে চাহিত খুলাসা।
যতই জিজ্ঞাসা করে তত করে গুসা॥
মর্মকথা কইতে নারে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া।
বাড়ী গিয়া কান্দে নারী শিরে হাত দিয়া॥
দ্বিজ ঈশান কয় কিল আর তেল।
একবার পড়িলেই গণ্ডগোল গেল॥১—২১৬

( ৬ )

প্রতিশোধ

সন্ধ্যাবেলা কারকুন তবে কোন কাম করে।
উতলা হইয়া যায় গোয়ালিনীর বাসরে॥
আনচান করে মন কত লাগে ভয়।
কি জানি গোয়ালিনী কোন কথা কয়॥
কারকুনে দেখিয়া গোয়ালিনীর ক্রোধে অঙ্গ জ্বলে
গালি দিয়া কারকুনেরে যত কথা বলে॥

কারকুনকে দেইখ্যা কয় “আট-কুরীর[৮৫] বেটা।
মোর বাড়ীতে আইলে তোর মুখে মারবাম ঝাটা॥
তোর লাগিয়া মোর এতেক অপমান।
পুরুষ হইলে তোর কাইট্যা দিতাম কাণ॥
আর একবার যদি আইস আমারে ডাকিয়া।
শূলে দিবাম তোরে আমি কন্যারে বলিয়া॥”

গোয়ালিনীর মুখে শুইন্যা এতেক বচন।
দুঃখিত হইয়া কারকুন ভাবে মনে মন॥
“আর না আসিব ফিরে গোয়ালিনীর বাড়ী।
ছারকার করব চাকলা সাত দিনের আড়ি[৮৬]॥”
তারপর গিয়া দুষ্ট। কমলার পাশ।
বলেতে পুরাইবাম নিজ অভিলাষ॥
ঘরের খোন্দলে[৮৭] কারকুন ভাবে মনে মনে।
বেইজ্‌জতের প্রতিশোধ[৮৮] লইবাম কেমনে॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া কারকুন কি কাম করিল।
জমিদারের কাছে এক পত্র পাঠাইল॥

রঘুপুরে বাস করে মাল জমিদার।
তার অধীনে এই মানিক চাকলাদার॥
তার অধীনে কারকুন করিয়া চাকরী।
মনে মনে ফন্দি আঁটে দিতে গলায় দড়ি॥


পত্র

“পরথমে পন্নাম করি ধর্ম অবতার।
তার পর নিবেদন শুনখাইন[৮৯] আমার॥

চাকলাদার পাইছে ধন মাটি যে খুড়িয়া।
সাত ঘড়া মোহর কেবল গনিয়া বাছিয়া॥
না জানায় এই কথা মালিক গোচরে।
জমিদারের ধন আইন্যা রাখছে নিজ ধরে॥”১—৩২


( ৭ )

জমিদার কৃত নিগ্রহ

পত্র পাইয়া জমিদার কোন কাম করিল।
চাকলাদারে আনিবারে পাইক পাঠাইল॥
হাজারে বেজারে লোক বাড়ী যে ঘেরিয়া।
মানিকে বান্ধিয়া নিল পিছমোড়া দিয়া॥

চাকলাদারে জিজ্ঞাসা করিল জমিদার।
“কত ধন পাইয়াছ কিবা সমাচার॥”

হুজুরে মানিক কয় অবাক্কি হইয়া[৯০]
“এতেক জুলুম মোরে কিসের লাগিয়া॥
কে কহিল, ধন পাইয়াছি কোথায়।
কিসের লাগিয়া মোর ঘটল এমন দায়॥”

এত শুনি জমিদারের ক্রোধে অঙ্গ জ্বলে।
মানিকে বান্ধিয়া তবে রাখে খুন-শালে[৯১]

এ দিকে হইল কিবা শুন মন দিয়া।
কারকুনে আর্টিল ফন্দি মনেতে ভাবিয়া॥
বেড়ায় ভাঙ্গিতে যেমন চোরের হয় মন।
এক বেড়া কমলার ভাই সে সুধন॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া কারকুন কয় সুধনেরে।
“জমিদারে বাইন্ধ্যা নিছে তোমার বাপেরে॥

শুন শুন সুধনরে শুন মোর কথা।
পিতারে বাইন্ধ্যা তোমায় দিছে বড় ব্যথা॥
হাতে গলায় বাইন্ধ্যা তার বুকে দিছে পাট॥
শয্যায় বিছাই দিছে মনকাকরের কাটা[৯২]
কুপুত্র হইলা তুমি কিসের কারণ।
পিতার উদ্ধারকার্য্যে নাহি দেও মন॥
পিতার লাগিয়া দেখ শ্রীরাম-লক্ষ্মণে।
চৌদ্দ বছর ভরা গোয়াইল[৯৩] বনে॥
পিতার আদেশ পাইয়া পুত্র পরশুরাম।
মায়েরে মারিয়া রাখে বাপের সম্মান॥
শ্রীমন্ত পাটনে[৯৪] গেল বাপেরে আনিতে।
ঘরেতে বসিয়া তুমি থাক কি জন্যেতে॥
শীঘ্র করি যাও তুমি জমিদারের বাড়ী।
সত্বর আন তুমি পিতায় উদ্ধারি॥
কয় খান মোহর দিয়া জানাইও প্রণাম।
পিতার উদ্ধার তোমার জানাইও কান॥”

এহি মতে সুধনরে বাড়ী ছাড়াইল।
জমিদারের বাড়ী গিয়া সুধন দাখিল হইল॥
জমিদারে দেখ্যা সুধন করিল প্রণাম।
মোহরের থলি দিয়া কৈল নিজ নাম॥

তার পরে কহিল “সুধন আইলা কি কারণ।”
বিনা দোষে হৈল তার পিতার বন্ধন।
এই কথা শুন্যা পরে জমিদার কয়।
“যত মোহর পাইছ তার সমুদয় দেও॥
তার পরে করিয়া যে উচিত বিচার।
পরেত ছাড়িব জান্য[৯৫] পিতারে তোমার॥

তোমার বাপে পাইছে ধন মাটী খুড়িয়া।
নিজে ভোগ করে ধন আমারে ভারাইয়া॥”

পায়েতে ধরিয়া সুধন কহিল “হুজুর।
মিছা রটনা হইল নহি আমরা চোর॥”
এই কথা জমিদার যখন শুনিল।
পাষাণ চাপিতে বুকে হুকুম করিল॥
“পিতাপুত্রে এক সঙ্গে দেও পাষাণ-চাপ।
মোহর না দিলে জান্য নাহি ইতে[৯৬] মাপ॥” ১—৫২


( ৮ )

কারকুনের চাকলাদারী

এই কথা শুনিয়া কারকুন হরষিত মনে।
উগাইল[৯৭] যত খাজনা ডাক্যা প্রজাগণে॥
পাঠাইয়া সেই খাজনা জমিদার গোচরে।
চাকলাদারীর লাগি আর্জি করে সুবিস্তরে[৯৮]

খাজনা পাইয়। জমিদার খুসী যে হইয়া।
চাকলাদারীর সনদ একখান দিল যে পাঠাইয়া॥

সনদ পাইয়া কারকুন কি কাম করিল।
কমলার ঘরে গিয়া দাখিল যে হইল॥
কমলারে ডাকি কয় “শুন গো সুন্দরী।
আইজ হইতে হইল আমার এই চাকলাদারী॥
তোমার সঙ্গে মোর যদি বিয়া হয়।
সুখেতে থাকিবা কন্যা কইলাম সমুদয়॥
মনের সুখেতে করবা মোর চাকলাদারী।
চিরদিন কয়বাম আমি তোমার চাকুরী॥

আমার বিয়া করলে চিত্তে পাইবা বড় সুখ।
নৈলে গাছের পাতা ঝরব দেখ্যা তোমার দুঃখ॥
চিত্তে বুঝি দেখ যদি কর ইতে আন।
মোর বাড়ী ছাড়াইয়া জলদি করহ প্রস্থান॥”

এই কথা শুনিয়া কমলা কয় কারকুনেরে।
“শুনছ নি[৯৯] কেউ করে বিয়া নরপিচাশেরে॥
আমার বাপের লুন খাইয়া বাচিলা পরাণে।
তার গলায় দিতে দড়ি না বাঝিল[১০০] প্রাণে॥
পরাণের সোদর ভাইয়ে দুঃখ যেই দিল।
মুখে মারি ঝাটা তার পিঠে লাথি কিল॥
বনে জঙ্গলায় থাকবাম নাহি ইতে ডর।
তবু নাই সে করবাম এমন রাক্ষসার ঘর॥
মায়ে ঝিয়ে ভিক্ষা মাগ্যা খাইব নগরে।
তিলেক না রইব আর রাক্ষসের ঘরে॥
পায়ের গোলাম তুই পায়ের নফর।
চরণে আছস বান্ধ। হৈয়া চাকর॥
কি আর কহিব তরে[১০১] পশুর অধম।
মাথায় তুল্যা কেবা লয় পায়ের খরম॥
বাপ ভাই দেশে থাকত কইতে এমন কথা।
কোটালে ডাকিয়া তোর কাটিতাম মাথা॥
তেকাটিয়া[১০২] পথে নিয়া দিতাম তোরে শালে।
বিধি শুনাইলা কথা আছিল কপালে॥”

এই কথা বলিয়া কমলা কি কাম করিল।
আন্দি সান্দি দুই ভাইয়ে খবর যে দিল॥
তারা দুই ভাইয়ে করে সোয়ারীর কাম[১০৩]
মায়ে ঝিয়ে লইয়া তারা গেল মামার ধাম॥১—৪০

( ৯ )

কলঙ্ক রটনা

শুনিয়া আছয়ে কমলা মামার যে বাড়ী।
মামারে লিখিল পত্র অতি শীঘ্র করি॥
“শুন শুন শুন ওগো তোমার ভাগিনী।
পরপুরুষে মইজে হইল কলঙ্কিনী॥
তুমি যদি রাখ তারে আদর করিয়া।
পঞ্চাইতে রাখিব তোমার বাছ[১০৪] যে করিয়া॥
নাপিতে ছাড়িব তোমার ছাড়িব ঠাকুরে।
এক ঘইরা হইবা তুমি কইলাম সুবিস্তরে॥
চাড়াল বেটার লাগ্যা কমলা হইল পাগল।
কামেতে মাতিয়া দুষ্টা ভাসাইল কুল॥
কলঙ্কিনী হৈল তার গেল কুলজাতি।
এই পাপের নাহি জান্য পরাচিত্তির পাতি[১০৫]
বাপের কুল ভাসাইয়া গেল তোমার বাড়ী।
তোমার বাড়ী হইতে তারে খেদাও শীঘ্র করি॥
আর শুন কই তোমারে শুন মন দিয়া।
কিবা হুকুম দিল জমিদার শুনিয়া॥
কলঙ্কিনী কমলারে যেবা দিবে স্থান।
জন বাচ্ছা[১০৬] সহিতে তার যাইব গর্দ্দান॥”

পরবাসে থাইক্যা মাতুল এই পত্র পাইয়া।
বাড়ীতে লিখিল পত্র শীঘ্রগতি হইয়া॥
কমলার মামীর কাছে পত্র যে লিখিল।
এবারত[১০৭] লেইখ্যা যত কুচ্ছা যে করিল॥
“পরবাসে থাইক্যা শুনলাম দুইয়ে মায়ে ঝিয়ে।
আমার বাড়ীতে আছে কিসের লাগিয়ে॥

কুমারী হইয়া কন্যা ভাঙ্গাইল জাতি।
পর না পুরুষের[১০৮] ভজ্যা এত না দুর্গতি॥
বিয়া না হইতে কন্যা কুল মজাইল।
ভাড়াই[১০৯] নাগর সঙ্গে ঘরের বাইর হইল॥
এমন কন্যারে তুমি ঘরে নাহি দিবে স্থান।
ঘরের বাহির কইরা দিবা কইরা অপমান॥
এক দণ্ড যেন নাহি থাকে মোর ঘরে।
চুলে ধইরা ঘরের বাহির কইরা দিবা তারে॥
সমাজে না লইবে মোরে কমলা থাকিলে।
পতিত হইয়া রইব মজ্‌ব জাতিকুলে॥”

এই পত্র পাইয়া মামী কি কাম করিল।
পত্র পড়িয়া তবে ভাবিতে লাগিল॥
“সাক্ষাৎ ভাগিনী আর অবিয়াত[১১০] কুমারী।
কেমন কইরা দেই তারে ঘরের বাহির করি॥
জাতিকুল লইয়া কন্যা যাবে কার কাছে।
এমন কমলার ভাগ্যে এত দুঃখ আছে॥
মায়ে ঝিয়ে কান্‌বে[১১১] যখন কিবা কইবাম কথা।
এমন কোমল প্রাণে কেমনে দিব ব্যথা॥”
ভাবিয়া চিন্তিয়া মামী কোন কাজ করে।
পত্রখানা ফেইল্যা রাখে সেজের[১১২] উপরে॥১—৪৪


( ১০ )

কমলার গৃহত্যাগ

সন্ধ্যাবেলা ঘরে গেল কমলা সুন্দরী।
সেজের উপরে দেখে পত্রখানা পড়ি॥

পত্র পড়ি চক্ষের জলে ভাসিছে কমলা।
“এত দুঃখ ভাগ্যে মোর বিধি লিখেছিলা॥
বিদেশে হইল বন্দী বাপ আর ভাই।
কত দুঃখ পাইয়া আমি মামার বাড়ী যাই॥
বাপের বাড়ীর যত ধন লুটিল ডাকাতে।
এতেক অপমান পাইলাম কারকুনের হাতে॥
বিপাকে পড়িয়া আইলাম মামার বাড়ী।
কিছুকালে পুর্ব্বদুঃখ গেছিলাম পাশরি॥”

পড়িতে পড়িতে কন্যার চক্ষে বহে পানি।
সম্মুখে যে আইল তার কি কালরজনী॥
“চন্দ্রসূর্য্য ডুইব্যা গেছে আন্ধাইর সংসার।
এক দণ্ড এই ঘরে না থাকিব আর॥
বাপে জন্ম দিয়া থাকে যদি হই সতী।
বিপদে করিবে রক্ষা দুর্গা ভগবতী॥
জলে ডুবি বিষ খাই গলে দেই কাতি।
মামার বাড়ী না থাকিব দণ্ড দিবা রাতি॥”

যা করেন বনদুর্গা মনে মনে আছে।
একবার না গেল কন্যা আপন মায়ের কাছে॥
একবার না গেল কন্যা মামীর সদনে।
একবার না চাইল কন্যা মায়ের মুখপানে॥
একবার না ভাবিল কন্যা জাতিকুলমান।
একবার না ভাবিল কন্যা পথের আন্ধান[১১৩]
একবার না ভাবিল কন্যা কি হইবে আমার গতি।
একলা পন্থেতে পড়ি কি হবে দুৰ্গতি॥
একবার না ভাবিল কন্যা আশ্রয় কেবা দিবে।
সন্ধ্যাবেল। তারা ফুটে সূর্য্য ডুবে ডুবে॥
এমন সময় কন্যা কোন কাম করে।
বনদুর্গা স্মরি কন্যা পথে মেলা করে॥

আঁখিজলে ভরে কন্যা নাহি দেখে পথ।
বারে বারে চক্ষু মুছে নাহি চলে রথ॥


( ১১ )

মহিষালের গৃহে

হাটিয়া অভ্যাস নাই যৌবনের ভারে।
ক্ষণে উঠে ক্ষণে বসে চলিতে না পারে॥
হাওরে পড়িল তথা নাহি লোকজন।
বিধাতা শুনিলা বুঝি তাহার কান্দন॥
এক বৃদ্ধ মইষাল[১১৪] যে মইষ লইয়া যায়।
পন্থে পড়ি কমলা তাহার লাগ পায়॥
“অগতির গতি তুমি তুমি ধর্ম্মের বাপ।
সংসার ছাইড়া আইছি পাইয়া বড় তাপ॥
এত দুঃখ নাহি জানি আছিল কপালে।
আজি রাতি কর যাগা[১১৫] তোমার গোয়ালে॥
ভাতপানি নাহি চাই তোমার সদনে।
আঞ্চল বিছাইয়া থাকবাম গোয়াইলের কুণে[১১৬]॥”

অপরূপ রূপ দেখি মইমাল ভাবিল।
লক্ষ্মী বুঝি ছলিবারে আমারে আইল॥
“ভাল পূজা দিবাম মাগো আইস আমার ঘরে।
অচলা হইয়া থাকবা আমার না ঘরে॥
ধনে পুত্রে বর দেও বারুক সম্পদ।
তোমার কৃপায় ঘুচুক বালাই আপদ॥
বিয়ানী[১১৭] মইষে দেউক তিনগুণ দুধ।
আমার ঘরে থাক মাগো রাইখ্যা অনুরোধ॥”

এতেক কহিয়া মইষাল ঘরে লইয়া যায়।
সন্ধ্যাকালের বাতি কন্যা গোয়ালে জ্বালায়॥
তিন দিন রইল কন্যা মইঘালের বাসে।
সর্ব্বকর্ম্ম করে কন্যা মনের হরষে॥
সন্ধ্যাকালে জ্বালে বাতি গোয়ালে দেয় ধূমা।
মইষালের লাগ্যা পাতে খড়ের বিছানা॥
তিন বেলা ভাত রান্ধি খাওয়ায় মইষালেরে।
সর্ব্বকর্ম্ম করে কন্যা মইষালের ঘরে॥
বাথানে থাকিয়া মইষাল মহিষ চড়ায়।
বাড়ীতে আসিয়া মইষাল তৈয়ার ভাত খায়॥
গামছা-বান্ধা দই কন্যা যতনে পাতিয়া।
উলায় খই দিয়া খাওয়ায় সাম্‌নে খাড়া হইয়া॥
কমলার যত্নে মইষাল সর্ব্বদুঃখ ভুলে।
লক্ষ্মী অধিষ্ঠান হইল তাহার গোয়ালে॥


( ১২ )

নূতন অতিথির কমলাকে লইয়া যাওয়া

এক দিনের কথা সবে শুন দিয়া মন।
কোড়া শিকারে আইল শিকারী একজন॥
কোন দেশের শিকারী গো কোথায় বাড়ীঘর।
রূপে গুণে দেখি তারে দেবের কোঙর[১১৮]
সোনার অঙ্গেতে তার সোনার সাজন।
দেখলে মনে হয় তারে রাজার নন্দন॥

সন্ধ্যাবেলা মইষাল বাথান[১১৯] হইতে আসে।
কার্ত্তিক দেখিল যেন দাড়াইয়া পাশে॥

“বড় মেন্নত[১২০] পাইয়া আইছি দেও একটু পানি।
পানির লাগিয়া মোর যায় যে পরাণি॥”
টুপায়[১২১] করিয়া জল কমলা আনিল।
জল না খাইয়া কুমার শীতল হইল॥

পরিচয়-কথা কুমার কহে মইষালেরে।
“বিপাকে পড়িয়া আমি আইলাম তোমার ঘরে॥
তোমার ঘরে আইসা দেখি বুঝিতে নাহি পারি।
আমারে যে দিল জল এইবা কোন নারী॥
সন্ধ্যাকালের তারা কিম্বা নিশাকালের চান্দ।
লক্ষ্মীরে জিনিয়া রূপ দেইখ্যা লাগে ধন্দ॥
কার কন্যা কিবা নাম কোন দেশেতে বাড়ী।
অনুযানে বুঝি কোন রাজার কুমারী॥
কিবা কহ মইষাল তুমি কোন দেবতার বরে।
চান্দ হেন কন্যা তোমার জন্মিলেক ঘরে॥
বিয়া হইয়াছে কিবা রইয়াছে কুমারী।
সত্য পরিচয় মোরে কহু শীঘ্র করি॥”

মইষাল কহিছে কথা “ধর্ম্ম অবতার।
বাপ-মার নাম আমি নাহি জানি তার॥
কোন দেশেতে বাড়ী তার কোন দেশেতে ঘর।
সঠিক না দিতে পারি সকল উত্তর॥
সদয় হইয়া লক্ষ্মী দেবী দিলা দরশন।
তাঁরে পাইয়া মোর হইল সফল জীবন॥
যে দিন হইতে আমি পাইয়াছি মায়।
দধিদুগ্ধ বাড়িয়াছে মায়ের কৃপায়॥
বাথানের বন্ধ্যা মইষ হইয়াছে গাভীন।
মায়ের কৃপায় মোর হইয়াছে সুদিন॥”

শিকারী কহিছে “মইষাল মোর কথা ধর।
এই কন্যা দেও মোরে লইয়া যাই ঘর॥
মণিমুক্তা দিব তোমায় ধামাতে মাপিয়া।
চৌদ্দ পুরা জমি দিব বাপেরে কহিয়া॥”

কান্দিয়া মইষাল কয় “মোর ধনে কাজ নাই।
মায়েরে ছাড়িলে আর মোর বাঁচা নাই॥
রাঙ্গাচরণ পাইয়াছি অল্পে না ছাড়িব।
ক্ষীরসর দিয়া আমি জন্ম ভরা পূজব॥
এক দণ্ড না দেখিলে সংসার অন্ধকার।
তিলেক ছাড়িলে মায়ে না বাঁচিব আর॥”

যত কথা কহে কুমার মইষাল না মানে।
কি যেন লাইগাছে দাগা মইষালের প্রাণে॥

অনেক হইল বুঝা-পড়া দিনের হইল শেষ।
কন্যারে লইয়া কুমার যাইব আজি দেশ॥
কান্দিয়া মইষাল কয় “শুন মোর মাও।
অন্তকালে দিও মোরে রাঙ্গা দুটি পাও॥
বড় দুঃখ পাইছ মাগো থাকি মোর ঘরে।
মনেতে রাখিও মাগো এই অভাগারে॥
ধনরত্ন না চাই আমি না চাই জমীবাড়ী।
অন্তকালে দিও মাগো তোমার চরণতরী॥”

মইষালের চক্ষের জলে উলা[১২২] বাথান ভাসা।
কন্যারে লইয়া কুমার গেল নিজ দেশে॥


( ১৩ )

প্রদীপকুমার ও কমলা

সন্ধ্যাকালেতে কন্যার ঘরের দীপ জ্বলে।
মারের কথা স্মরণ কইরা ভাসে চক্ষের জলে।

এন[১২৩] কালেতে প্রদীপকুমার কোন কাম করে।
ধীরে ধীরে গেল কুমার কন্যার মন্দিরে॥
পালঙ্কে বসিয়া কন্যা চিন্তে মায়ের কথা।
এমন সময় কুমার গিয়া উপচিল[১২৪] তথা॥
“আজি কালি করি কন্যা কত বা ভারাও।
পরিচয়-কথা কও মোর মাথা খাও॥
দেখিয়া তোমার রূপ হইয়াছি পাগল।
দিবানিশি দেখি কন্যা তোমার চক্ষের জল।
মুছিলে না মুছে আঁখি কান্দ কোন দুঃখে।
বিয়া কইরা কন্যা মোরে থাক মনের সুখে॥
যে দিন হইতে দেখছি তোমায় মইষালের ঘরে।
জীবন-যৌবন সইপ্যা দিছি কন্যা তোমার করে॥
কোড়া শীকারে আর নাহি যাই আমি।
তোমার লাগিয়া উদাসী হইলাম আমি॥
বাগ-বাগীচা ফুলের শোভা চক্ষে নাহি লাগে।
পাগল হইয়াছি কন্যা তোমার অনুরাগে॥
তুমি আমার চন্দ্রসূর্য্য তুমি নয়নতার।
তুমি আমার মণিমুক্তা তুমি গলার হার॥
তিলেক ছাড়িয়া তোমায় নাহি বাচে প্রাণ।
তোমায় না পাইলে কন্যা ত্যজিব পরাণ॥
তুমি যদি ছাড় কন্যা আমি না ছাড়িব।
পায়ের গুঞ্জরী[১২৫] হইয়া পায়েতে থাকিব॥”
দ্বিজ ঈশান ভনে এই মদনের বান।
বাজিছে উভের মনে তাতে নাহি আন॥

বিয়ানবেলা যায় কুমার সন্ধ্যাবেলা আসে।
দিনের মধ্যে তিন বার পরিচয় জিজ্ঞাসে॥

কন্যা বলে “পরিচয় এক দিন দিব।
যে দিন সুদিন মোর সম্মুখেতে পাব॥
সত্য কইরাছ তুমি মইষাল বন্ধুর কাছে।
তোমার সে সত্য কথা মনে কিনা আছে॥
বলে না করিবা তুমি মোর পরিচয়।
আমার যত কথা তোমায় জান্‌তে উচিত হয়॥
সবুর করহ তুমি কিছু কাল রইয়া।
পরিচয়-কথা কইব সুদিন পাইয়া॥”

এইরূপে কুমার যে প্রতিদিন আসে।
বিফল হইয়া ফিরে আপনার বাসে॥
অন্তরে মন্তর কলি নাহি ফুটে মুখ।[১২৬]
ভৃঙ্গ যেমন উড়ে যায় মনে পাইয়া দুঃখ॥
এইরূপ করিয়া যে তিন মাস গেল।
একদিন রাজপুরে বাদ্য যে বাজিল॥


( ১৪ )

নরবলি

“কিসের বাদ্য বাজে আজি রাজার পুরীর মাঝে।”
“নরবলি দিয়া রাজা রক্ষাকালী পুজে॥”
“কেবা নর কিসের পূজা কারে দিবে বলি।”
পরিচয়-কথা কন্যা শুনিল সকলি॥
বাপ-ভাই বলি হবে কান্দে চন্দ্রমুখী।
কমলার কান্দনে কান্দে পশুপাখী॥
হেনকালে প্রদীপকুমার কোন কাম করে।
শীঘ্রগতি ধাইয়া যায় কন্যার মন্দিরে॥

“আজি কন্যা শুন এক আচরিত[১২৭] কথা।
নরবলি দিয়া বাপে পূজে রক্ষাকালী মাতা॥
তুমি আমি দুই জনে যাব সেইখানে।
দেখিব সে নরবলি সানন্দিত মনে॥”

“কোথা হইতে আনল নর কত ধন দিয়া।”
জিজ্ঞাসা করিল কন্যা দুঃখ যত হিয়া॥

একে একে কহে কুমার পরিচয়-কথা।
মনের আগুন লুকায় কন্যা পাইয়া বড় ব্যথা॥
বাপ-ভাইয়ের কথা শুইন্যা কন্যার ঝরে আঁখি।
ঝরিল চক্ষের জল দেখি বা না দেখি॥

“আজি কুমার দিব আমি সত্য পরিচয়।
একত নালিস মোর শুনতে উচিত হয়॥
গাহিব দুঃখের গান ধর্ম্মসভার কাছে।
কিন্তু এক কথা মোর শুনিবার আছে॥
হুলিয়া গ্রামেতে সেই চাকলাদারের বাড়ী।
তাহার কারকুনে তুমি আন শীঘ্র করি॥
আন্ধি সান্ধি দুই ভাই পাল্কী বইয়া যায়।
তাহারে ডাকিয়া আন পরিচয়ের দায়॥
সেই গ্রামে আছে এক চিকন গোয়ালিনী।
তাহারে আন হেথা সাক্ষী করি আমি॥
ইঙ্গিতে আনিতে কন্যা বলয়ে মাতুলে।
পরিচয়-কথা কন্যা নাহি বলে খুলে॥
মামীরে আনিতে কন্যা কুমারে কহিল।
এহাতেও কন্যা নাহি পরিচয় দিল॥
মইষাল বন্ধুরে হেথা আন শীঘ্র করি।
আমারে পাইয়া ছিলে তুমি যার বাড়ী॥
সকলে হাজির কর ধর্ম্মসভার ঠাঁই।
পরিচয়-কথা মোর সভাতে জানাই॥

( ১৫ )

বারমাসী

“কৈয়াম[১২৮] কৈয়াম প্রাণের কথা সভাজনের কাছে।
অভাগী কমলার ভাগ্যে এত দুঃখ আছে॥
সাক্ষী আমার চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী দেবগণ।
সাক্ষী আমার তরুলতা সাক্ষী পঞ্চগণ॥
মায়ের মন্দিরে আমি সাক্ষী করি তারে।
আগুন-পানি সাক্ষী আমার ডাকি সর্ব্ব দেবতারে॥
কার্ত্তিক-গণেশ সাক্ষী লক্ষ্মী-সরস্বতী।
জগতের মাতা সাক্ষী দেবী ভগবতী॥
ইন্দ্র-যম সাক্ষী মোর সাক্ষী বসুমাতা।
এই সকলে সাক্ষী কইরা কই মোর দুঃখের কথা।
বনের সাক্ষী বনদুর্গা সদায় পূজা করি।
জমীনে সাক্ষী যত কহি সুবিস্তারি॥
পইলা[১২৯] সাক্ষী মাতা-পিতা দেবতার সমান।
দোহার চরণে করি সহস্র প্রণাম॥
গর্ভসোদর ভাই সাক্ষী সাক্ষী করি তারে।
আর সাক্ষী করি আমি এই কারকুনেরে॥
চিকন গোয়ালিনী সাক্ষী ভাঙ্গা দন্ত যার!
মামা-মামী সাক্ষী করি সম্বন্ধে আমার॥
সন্ধ্যাকালের তারা সাক্ষী সাক্ষী আখির পানি।
আর সাক্ষী হাতে আমার মামার পত্রখানি॥
গলুর গোষ্টি[১৩০] সাক্ষী আমার মৈশাল বন্ধু ছিল।
সন্ধ্যাকালে বাপের মত মোরে আশ্রা[১৩১] দিল॥
তার পরে সাক্ষী আমার রাজার কুমার।
যাহার কারণে আমি পাইলাম নিস্তার॥

প্রাণের পতি সে আমার প্রাণের দেবতা।
সবাই কহিব আমি মোর প্রাণদাতা॥

“জৈষ্টি মাসের ষষ্টি দিন শুক্রবার যায়।
কালামেঘে করে সাজ আসমানের গায়॥
রাত্রিশেষে জন্ম লয় এই অভাগিনী।
কমলা রাখিল নাম আদরে জননী॥

“এক দুই মাস করি তিন বছর গেল।
গর্ভসোদর ভাই জনম লইল॥
পূর্ণিমার চান্দ যেমন দেখি মায়ের কোলে।
সর্ব্বদুঃখ দূর হইল জনমের কালে।
কোলে করি কাকে করি করি দোলা-খেলা[১৩২]
এইরূপে যায় দিন শৈশবের বেলা॥
ভাই আমার নয়ন-তারা মাও আদরিণী।
বাপ আমার চক্ষের মণি দেহের পরাণী॥

“এক দুই করি দেখ তের বছর যায়।
আমার বিয়ার কথা কয় বাপ-মায়॥
এক দিনের কথা মোর শুন সভাজন।
কোন বিধি লিখিল আমার দুঃখের লিখন॥
ধর্ম্ম অবতার রাজা ধর্ম্মে তোমার মতি।
আমার দুঃখের কথা কর অবগতি॥
আইল যৌবন-কাল অঙ্গে জলে সোনা।
একেলা যাইতে জলে মায় করে মানা॥
বসনে ভূষণে মন ঘন কাপে হিয়া।
দীঘল চুল বান্ধি আমি চাম্পাফুল দিয়া॥
কেশে মাখি গন্ধতৈল সিনানের বেলা।
আবের কাকই[১৩৩] হাতে লইল কমলা॥

আচরি বিচরি[১৩৪] চুল সখীগণ সঙ্গে।
জলের ঘাটেতে নিত্যি যাই মনের রঙ্গে॥
নিত্যি নিত্যি করি ছান[১৩৫] সানে বান্ধা ঘাটে।
কেও না আসিতে পারে তাহার নিকটে॥
আমি কি জানিরে ভাগ্যে এত দুঃখ ছিল।
একত দিনের কথা কহিতে হইল॥

“হাসিয়া খেলিয়া দেখ পৌষ মাস যায়।
পৌষ মাসের পোষা আন্দি[১৩৬] সংসারে জানায়॥
সকলের ছোট বোন পোষ মাস হয়।[১৩৭]
চোক মেলাইতে দেখ কত বেলা হয়॥
ভোরেতে উঠিয়া করি বনদুর্গার পূজা।
দুপরিয়া বেলাতে করি সিনানের সাজা[১৩৮]
গন্ধতৈল মাখিলাম কেশের বাহার।
গলা হইতে খুলিলাম হীরামতির হার॥
সোনার কলসী কাঁকে সঙ্গে সখীগণ।
জলের ঘাটেতে যাই সানন্দিত মন॥
কোন সখী হাসে নাচে কোন সখী গায়।
রঙ্গে ঢঙ্গে সব সখী জলের ঘটে যায়॥
চরণে ঠেকিল মাটী বাধা পড়ে পথে।
আজি কেন হিয়া মোর কাপিল চলিতে॥
আগে যদি জানি আমি পন্থে কাল সাপ।
বাহির হইয়া কেন পাইবাম এত তাপ॥
এইত স্থানেতে আমি কারকুনে সাক্ষী করি।
তার পরে হইল কিবা কহি সবিস্তারি॥

“পোষ গেল মাঘ আইল শীতে কাপে বুক।
দুঃখীর না পোহায় রাতি হইল বড় দুঃখ॥

শীতের দীঘল রাতি পোহাইতে না চায়।
এইরূপে আস্তেব্যস্তে মাঘ মাস যায়॥
এক দিনের কথা বলি কি কাম হইল।
দধির পশরা লইয়া গোয়ালিনী আইল
এইখানে সাক্ষী মোর চিকন গোয়ালিনী।
দধি বেচিতে দেখ আইল আপনি॥
হাতের পত্র সাক্ষী তার দিলাম সভার স্থানে।
পরা-দন্ত[১৩৯] সাক্ষী করি সভার বিদ্যমানে॥
না বলিব না কহিব পত্রে লেখা আছে।
এই পত্র রাখিলাম আমি সভার কাছে॥

“আইল ফাল্গুন মাস বসন্ত বাহার।
লতায় পাতায় ফুটে ফুলের বাহার॥
ধনু হাতে লইয়া মদন পুষ্পেতে লুকায়।
বেহুড়া[১৪০] যুবতী ঘরে না দেখে উপায়॥
ভ্রমরা কোকিলকুঞ্জে গুঞ্জরি বেড়ায়।
সোনার খঞ্জন আসি আঙ্গিন জুড়ায়॥
আস্তেব্যস্তে কয় কথা বাপে আর মায়।
কমলার হইব বিয়া শব্দে শুনা যায়॥
শব্দে শুনা যায় কথা আড়াল থাক্যা শুনি।
এত দুঃখ ছিল মোর আমি অভাগিনী॥

“আইল রাজার চর বাপের আগে কয়।
রাজার বাড়ীতে যাইতে উচিত যে হয়॥
হাতী সাজে ঘোড়া সাজে পাইক পহরী।
বাপ চলিল মোর পুরী আন্ধাইর করি॥
যাইবার বেলা বাপে দুঃখিনীরে কয়।
‘কত দিনে আসি মাও না জানি নিশ্চয়॥

সাবধানে থাক্য মাগো দিবসরজনী।’
বাপেরে বিদায় দিতে চক্ষে বহে পানি॥
বাপ বিদেশে গেল পুরী অন্ধকার।
চারিদিগ দেখি যেন খোয়ার[১৪১] আকার॥

“আইল চৈত্রিরে মাস আকাল দুর্গাপূজা।
নানা বেশ করে লোকে নানারঙ্গের সাজা॥
ঢাক বাজে ঢোল বাজে পূজার আঙ্গিনায়।
ঝাক ঝাক শঙ্খ বাজে নটী গীত গায়॥
মণ্ডপে মায়ের মুক্তি দেখিতে সুন্দর।
কারুয়া[১৪২] টাঙ্গাইয়া করে ঘর মনোহর॥
পাড়া-পড়সি সবে সাজে নূতন বস্ত্র পরি।
ঘরের কোনায় লুকাইয়া আমি কান্দ্যা মরি॥
মায়ে ঝিয়ে কান্দি ধরে গলা ধরাধরি।
বৈদেশী হইল পিতা অন্ধকার পুরী॥
এমন সময় দেখ কি কাম হইল।
রাজার বাড়ী হইতে এক পত্র যে আসিল॥
এই পত্র সাক্ষী করি ধর্ম্মসভার আগে।
আমার বাপ হইল বন্দি কোন অপরাধে॥

“বাড়ীর কারকুন ভাইরে বুঝাইয়া কয়।
‘বাপেরে আনিতে যাইতে উচিত তোমার হয়॥'
সরল অবুজ ভাই কিছু না জানে।
বৈদেশে চলিল ভাই বাপের সন্ধানে॥
মায়ে ঝিয়ে কান্দি মোরা ধূলায় পড়িয়া।
কার পূজা কেবা করে না দেখি ভাবিয়া॥
গলায় কাপড় বান্দি পড়িয়া ধূলায়।
বাপ-ভাইয়ের বর মাগি ঝিয়ে আর মায়॥

“বৈশাখ মাসেতে গাছে আমের কড়ি[১৪৩]
পুষ্প ফুটে পুষ্পডালে ভ্রমর গুঞ্জরি॥
ফুলদোলে পূজা আদি কহিতে বিস্তর।
আর বার পত্র আসে মায়ের গোচর॥
পিতাপুত্র দুইজন বন্দী পরবাসে।
মায়ের চক্ষের জলে বসুমাতা ভাসে॥
অভাগী কমলা কালে শয্যা ভাসাইয়া।
কেমনে বাচিব প্রাণ শানে বান্ধ। হিয়া॥
কোন বা দেবেরে পূজলে বাপ-ভাইয়ে পাব।
মায়ের ঝিয়ের দুঃখের কথা কার কাছে কইব॥
ঘরে আছে কাল সাপ যমের দোসর।
তার কাছে যাইতে দেখ মনে হইল ডর॥
মায় গিয়া ধন্বা[১৪৪] দিলাম চণ্ডীর দুয়ারে।
তার পরের কথা কহি সভার গোচরে॥

“জ্যৈষ্ঠ মাসেতে দেখ পাক। গাছের ফল।
রাত্রিদিবা না শুকায় নয়নের জল॥
মায়ে করে ষষ্ঠীপূজা পুতের লাগিয়া।
প্রাণের ভাই বিদেশে মোর দুঃখে কান্দে হিয়া॥
মায়ের স্নেহের ডুঙ্গা[১৪৫] পড়িয়া রহিল।
পুত্রেরে ডাকিয়া মায় বিলাপ জুড়িল॥
এক হস্তে মোছি আমি চক্ষের যে পানি।
সান্ত্বনা করিয়া ঘরে লইত জননী॥

“এমন সময় দুই কারকুন কি কাম করিল।
রাজার সনদ লইয়া অন্দরে ঢুকিল॥
এহিত সনদে আমি সাক্ষী করি যাই।
বিদেশে হইয়াছে বন্দী বাপ আর ভাই॥

নিজেরে বাসেতে বন্দী হইলাম পরবাসী।
মায়ে ঝিয়ে একেবারে হইলাম পরবাসী॥
দিন গোঞ্জরিয়া[১৪৬] যায় সন্ধ্যা আসে বাসে।
মায়ের চক্ষের জলে বুক যায় ভেসে॥

পাল্কী চড়িয়া দোহে যাই মামার বাড়ী।
সঙ্গেতে নাহি গেল এক কানার কড়ি॥

“আষাঢ় মাসেতে দেখ ভরা নদীর পানি।
মামার বাড়ীতে কান্দি দিবসরজনী॥
ডিঙ্গা বাইয়া আসবে ঘরে বাপ আর ভাই।
আশায় বান্ধিয়া বুক রজনী গুয়াই॥
এমন সময় দেখ কি কাম হইল।
বৈদেশে থাকিয়া মামা পত্র যে লিখিল॥

“দুঃখের কপালে দুঃখ লিখিল বিধাতা।
কারে বা কহিব আমি এই দুঃখের কথা॥
আগুনের উপরে যেন জ্বলিল আগুনি।
এই কথা নাহি জানে অভাগী জননী॥
এই পত্র সাক্ষী করি ধর্ম্মসভার আগে।
ছাড়িলাম মামার বাড়ী মনের বিরাগে॥

“সন্ধ্যা গোঞ্জরিয়া যায় না দেখি উপায়।
একেলা হাওরে পড়ি করি হায় হায়॥
মামার বাড়ীর অন্ন আর না খাইবাম আমি।
গলায় কলসী বান্ধ্যা ত্যজিব পরাণি॥
সাপে না খাইল মোরে বাঘে নাইসে খায়।
কোথায় যাইয়া লুকাই মুখ না দেখি উপায়॥
দেবেরে ডাকিয়া কই আশ্রা দিতে মোরে।
কেবা আশ্রা দিবে মোরে এই অন্ধকারে॥

চক্ষুর জলেতে মোর বুক ভাগি যায়।
আইঞ্চল[১৪৭] ধরিয়া মোছি পানি না ফুরায়॥
না দেখি পন্থের কায়া[১৪৮] জোর[১৪৯] আখির জলে।
তরাইতে দরদী[১৫০] নাই বিপদের কালে॥
সাত জন্মের সুহৃদ মোর মৈষাল বন্ধু ছিল।
গোয়ালায় যাইবার কালে পন্থে দেখা হইল॥
জন্মের সুহৃদ মোর বাপের সমান।
তিন দিন দিল মোর গোয়ালেতে স্থান॥
মায়া-মমতায় সে যে বাপের চাইতে বাড়া।
এইখানে পাইলাম সুখের আছরা[১৫১]
এইত মইষাল বন্ধু বড় সাক্ষী মোর।
জাতিকুল বাচাইল দুঃখ করল দূর॥
একে একে কহিলাম সকল সাক্ষীর কথা।
এইখানে সাক্ষী মোর প্রাণের দেবতা॥

শ্রাবণ মাসেতে দেখ ঘন বরিষণ।
বিলের মাঝে কোড়া-কোড়ি করয়ে গর্জন॥
কোড়া শীকার করতে আইল রাজার কুমার।
মৈঘালের বাসে দেখা হইল তাহার॥
পরিচয় চাইল মোর রাজার কুমার।
এক দিন পরিচয় দিবাম তাহার॥
সময় পাইলে কইবাম আমার পরিচয়-কথা।
আর কিছু কই আমি করমের কথা॥

“ভাণ্ড ভরিয়া দিলাম জল পরাণ শীতল।
অন্তরে ফুটিল মোর সোণার কমল॥

কার্ত্তিকের সমান রূপ তাহারে দেখিয়া।
পরাণে মজিলাম আমি দগ্ধ হৈল হিয়া॥
মনে প্রাণে সপিলাম পরাণ তার পায়।
আমার পরাণ বন্ধু ঘরে লইয়া যায়॥
উপায় না দেখি কান্দি কই মনের কথা।
ঘরেতে থাকিব আমি লইয়া বুকের ব্যথা॥

“চলিল সোণার পান্‌সি ভরা নদী দিয়া।
লিলুয়ারী[১৫২] বাতাসে দেখ পাল উড়াইয়া॥
কতদিনে আসিলাম এইত রাজার পুরে।
দাসী হইয়া আসি আমি রাণীর দুয়ারে॥
মনের আগুন মোর মনে জ্বলে নিবে।
আর কত দিন দুঃখ পরাণে সহিবে॥
মায়ের মতন রাণী আমারে ভুলায়।
সদাকাল আছি আমি ধইরা রাণীর পায়॥

“একদিন শুনি নগরের মধ্যি খানে।
ঢাক-ঢোল বাজে আর নাচে সর্ব্বজনে॥
দাস দাসীগণ যত আনন্দে অপার।
অঙ্গেতে বসন পড়ে যা আছে যাহার॥

“কিসের ঢাক কিসের ঢোল কিসের বাদ্য বাজে।
শায়ন্যা সংক্রান্তে[১৫৩] রাজা মনসারে পুজে॥
বাড়ীর কথা মনে পড়ে পড়ে মায়ের কথা।
শক্তিশেলে হাণে বুকে নিদারুণ ব্যথা॥
বাপের বাড়ীর মণ্ডপ শূন্যি কেবা পূজা করে।
অভাগিনী মাও মোর কান্দ্যা কান্দ্যা ফিরে॥
দরদ পাইয়া ছাইড়া আইলাম অভাগিনী মায়।
আমার দুঃখের কথা কইতে না জুয়ায়॥

এক দণ্ড না দেখিলে হইত পাগলিনী।
সন্ধ্যাবেলা ছাইড়া আইলাম আমি অভাগিনী॥
ভাদ্র মাসে তালের পিঠা খাইতে মিষ্ট লাগে।
দরদি মায়ের মুখ সদা মনে জাগে॥
গাঙ্গে দিয়া বাইয়া যায় দৌড় বাইছা নাও।
কোন্ বা দেশে রইলা মোর অভাগিনী মাও॥
দিনের বেলা ঝরে আখি রাইতের অন্ধকার।
ভাদ্র মাসের চান্নি[১৫৪] গেল রুসনাইর[১৫৫] বাহার॥
ভাদ্র মাসের চান্নি দেখায় সমুদ্রের তলা।
সেও চান্নি আন্ধাইর দেখ্যা কান্দিছে কমলা॥

“ভাদ্র গেছে আশ্বিন আইল দুর্গাপূজা দেশে।
আনন্দ-সায়রে ভাগ্যা বসুমাতা হাসে॥
বাপের মণ্ডপ খালি রইল কেবা পূজা করে।
বাপ ভাই মুক্ত হৌক দুর্গা মায়ের বরে॥
কার্ত্তিক মাসেতে দেখ কার্ত্তিকের পূজা।
পরদিমের ঘট আকি বাতির করে সাজা[১৫৬]
সারা রাত্রি হুলামেলা[১৫৭] গীত বাদ্যি বাজে।
কুলের কামিনী যত অবতরঙ্গে[১৫৮] সাজে॥
সেইত কার্ত্তিক গেল আগণ আইল।
পাকা ধানে সরু শস্যে পৃথিবী ভরিল॥
লক্ষ্মীপূজা করে লোকে আসন পাতিয়া।
মাথে ধান গিরস্থ আসে আগ বাড়াইয়া॥
জয়াদি জুকার[১৫৯] পড়ে প্রতি ঘরে ঘরে।
নয়। ধানের নয়া অন্নে চিড়া পিঠা করে॥
পায়েস খিচুরী রান্ধে দেবের পারণ।
লক্ষ্মীপূজা করে লোকে লক্ষ্মীর কারণ॥

বাপ কোথায় মাও কোথায় কোথায় গুণের ভাই।
এই সংসারে অভাগিনীর নাহি দেখি ঠাই॥
কান্দিয়া কাটাই নিশি মোছি চক্ষের পানি।
এইখানে সাক্ষী করি এই রাজার রাণী॥

“একদিন শিরে তৈল মাখিয়া রাণীরে।
কলসী লইয়া যাটে যাই জল আনিবারে॥
ঢাক-ঢোল বাজে রঙ্গে লোকে সাজে পারে[১৬০]
আজিগো কিসের পূজা দেবের মন্দিরে॥
কালীপূজা হয় আজি কালীর মন্দিরে।
নরবলি হৈব আজি মায়ের দুয়ারে॥
কেবা নর কোথা হইতে আনিল ধরিয়া।
নরবলি হৈব শুনি স্থির নহে হিয়া॥
লোকে করে বলাবলি পথে কানাকানি।
বাপ-ভাই দিবে বলি এই কথা শুনি॥

“সকাল ভরিয়া জল ফিরিলাম ঘরে।
শীঘ্র করিয়া স্নান করাই রাণীরে॥
রাণী করে সাজা পারা[১৬১] যাইব দেবের বাড়ী।
আপন মন্দিরে যাই হয়ে একেশ্বরী॥
আঞ্চল ধরিয়া মোছি নয়নের পানি।
উপায় না দেখি মোর আমি অভাগিনী॥

“হেন কালে সাক্ষী মোর আসিল মন্দিরে।
রাজপুত্র আসি মোরে জিজ্ঞাসা যে করে॥
‘বিয়া কর কন্যা মোরে রাখ মোর প্রাণ।’
আমি কহিলাম মোর পূর্ব্বের সন্ধান॥
‘আজি কেন রাজার পুরে আনন্দের রোল।
কিসের লাগিয়া এত বাজে ঢাক-ঢোল॥’

কহিলা রাজার পুত্র মনেতে ভাবিয়া।
‘কালীপূজা করে বাপে নরবলি দিয়া॥’

“কেবা নর কেবা পূজে কারে দিব বলি।
সকল জানিয়া আমি হইলাম পাগলী॥
‘এইত আমার দিন হইল উদয়।
এইবার দিবাম রে কুমার মোর পরিচয়॥
সঙ্গে লইয়া চল মোরে দেবের আঙ্গিনায়।
নরবলির বাদ্য যথা কোচেরা বাজায়॥’

“আগেতে চলিলা কুমার পাছে অভাগিনী।
এই খানে সাক্ষী মাতা জগতজননী॥
পরিচয়-কথা মোর কহিনু বিশেষে।
বাপ-ভাই দুই জন আছে বন্দীবেশে॥
বিচার করিয়া তবে দেও নরবলি।
আগেতে বিচার করি পূজ রক্ষাকালী॥[১৬২]১-২৯৬

( ১৬ )

কারকুনের বিচার

বারমাসী দুঃখের কথা এই খানে থইয়া[১৬৩]
রাজার বিচার কথা শুন মন দিয়া॥
পাত্রমিত্র সহ রাজা সভাস্থানে গেল।
সকলেরে সভাস্থানে ডাকিয়া আনিল॥
বিচার করয়ে রাজা ধর্ম্ম অধিপতি।
রোষিয়া কহিল রাজা কারকুনের প্রতি।
“সত্য কথা দুষ্টমতি কও এইবার।
দিবাম উচিত দণ্ড নাহিক নিস্তার॥”

কাডা[১৬৪] ভাঙ্গি ঠাডা[১৬৫] পড়ে কারকুনের শিরে।
কহিতে না পারে কারকুন ধর্ম্ম রাজার ডরে॥
পত্র পড়িয়া রাজা সভারে জানায়।
চিকন গোয়ালিনী তবে ঠেকিল যে দায়॥
রাজা বলে দন্ত তোর ভাঙ্গিল কি মতে।
গোয়ালিনী কয় কথা আকারে ইঙ্গিতে॥
পরক্ষণে বাহানা[১৬৬] ধরে চিকন গোয়ালিনী।
“সান্নিকে পড়িল দন্ত আর নাহি জানি॥”

রোষিয়া কোটালে রাজা হুকুম করিল।
গর্জিয়া কোটাল আসি চুলেতে ধরিল॥
উপায় না দেখি তবে ভাবে গোয়ালিনী।
কারকুনেরে গালি পারে “আমি নাহি জানি॥
পত্রে কিবা লিখা ছিল নাহি জানি তার।
দোষ ক্ষমা দিয়া মোরে করহ নিস্তার॥”

আন্দি-সান্দি সাক্ষী ছিল তারা দুইটি ভাই।
মায়ে ঝিয়ে পাল্‌কীতে করি মামার বাড়ী যাই॥
মাম। সাক্ষী মামী সাক্ষী কহে সকল কথা।
মৈষাল বন্ধু সাক্ষী দিল সত্যিকার কথা॥
রাজার কুমার সাক্ষী দিল “শিকারেতে যাই।
গোয়ালায় যাইয়া আমি কমলার দেখা পাই॥”
সকল সাক্ষী শেষ হইল বিচার হৈল দড়।
হুকুম শুনিয়া কারকুন হইল ফাফর॥

হাতে গলে বান্ধ্যা লয়া দারুণ কোটালে।
রাজা কয় কারকুনেরে নাহি দিবাম শূলে॥
করিয়া মায়ের পূজা রাত্রি নিশা কালি।
কারকুনে দিলেন রাজা পূজার নরবলি॥

দ্বিজ ঈশান কয় পূজা সাঙ্গ বিধিমতে।
জয়ধ্বনি কর সবে কালীর পীরিতে॥১—৩৬


( ১৭ )

কমলার বিবাহ

কারকুনের বলিয়া কথা নিরবধি থইয়া।
কমলার বিবাহ-কথা শুন মন দিয়া॥
বামুন পণ্ডিত যত সকলে মিলিয়া।
বিয়ার যে শুভ দিন দিল দেখিয়া॥
সোনার কালীতে পত্র সকলি লিখিল।
সিদুরের সাত ফোটা তার মাঝে দিল॥
দেশে দেশে রাজ্যে রাজ্যে করি বিতরণ।
ইষ্ট কুটুম্বে সবে কৈল নিমন্ত্রণ॥

ঢাক বাজে ঢোল বাজে আর বাজে সানাই।
নাইচ[১৬৭] গান হয় কত জুড়িয়া আঙ্গিনায়॥
জয়াদি জুকার গীত হয় ঘরে ঘরে।
বাড়ী ভরিয়া পাছে লোক আথারে পাথারে[১৬৮]
চারি ভইরা[১৬৯] ময়রা মিঠাই বানায়।
হাজারে বিজারে গোয়াল দই জমায়॥
সাজাইল পুরীখানি ঝলমল করে।
এরে দেখ্যা চান্দ যেমন লুকায় অন্ধকারে॥
ইষ্ট কুটুম্ব আইল তার সীমা নাই।
রাইয়ত বিলাত[১৭০] কত গণা বাছা নাই॥
গুরু পুরুইত পণ্ডিত আইল সকলে।
নায়রীর[১৭১] বাজার যেমন অন্দর মহলে॥

বিধিমত হইল কত দেবতা পূজন।
বনদুর্গা একাচুরা খেলা কীর্ত্তন॥
জোর পাঠা দিয়া বলি শ্যামাপূজা করে।
মইষ দিয়া পূজা দিল দেবী ডরাইরে[১৭২]

বিয়ার দিনেতে রাজা হইয়া উতজুগ।
মণ্ডপে বসিয়া তবে করে নান্দিমুখ।
নান্দিমুখের মাটী কাটে যত নারীগণ।
তার গীতেতে যেমন ছাইল গগন॥
তার পরে সোহাগের ডালা মাথায় করিয়া।
সোহাগ মাগে কমলার মা পাড়া জুড়িয়া॥
আগে চলে কন্যার মাগো পাছে যায় মামী।
গীত-জুকারে নারী, চলে গজগামী॥
তার পাছে চলে ঢুলি বাদ্যভাণ্ড লইয়া।
এই মতে আইল সবে সোহাগ মাগিয়া॥
কাকেতে কলসী লইয়া যতেক যুবতী।
জল ভরিতে যায় সবে পাছে বাদ্য-গীতি॥
নদীর ঘাটে জল ভরিয়া পন্থে মেলা দিয়া।
গীত-জুকারে আইল বাড়ীতে ফিরিয়া॥
সমুখে জলের ঘট নতুন কাপড় পরি।
বরকন্যা বসিল যে হইতে খৌরী॥
নবদ্বীপ তনে নাপিত আইল কামাইতে।
সেই নাপিত কামায় সোনার নরুন-ক্ষুরেতে॥
জয়া জুকারে দেখ যতেক যুবতী।
হরম অন্তরে গায় কামানির গীতি॥

তার পরে যে গেল তারা সিনান করিবারে।
সব সখী মিল্যা গাষ্ট ঘিলা[১৭৩] মাজন করে॥
হলুদ মাখিয়া গায়ে যতেক সুন্দরী।
ভরা কলসীর জল ঢালে ত্বরা করি॥

সিনানের গীত হইল যত জানা ছিল।
ছান করি বরকন্যা ধরেতে আসিল॥
বাদ্যভাণ্ড বাজে কত তার সীমা নাই।
সাজন করে বরকন্যায় সখীগণ সবাই॥
রতন মুকুট দিল বরের যে শিরে।
আরশি হস্তেতে তুলি দিল যত্ন করে॥
নানান জাতি কাপড়েতে হইল সাজন।
রূপেতে জিনিল যেমন রতির মদন॥
গলেতে ফুলের মালা সুগন্ধি চন্দনে।
সদরে বসিল যত ভাইস্তা[১৭৪] ভাগিনা সনে॥

কন্যারে বেড়িয়া আর যত সখীগণ।
মনের মতন করে অঙ্গের সাজন॥
আচুড়িয়া চিকন কেশ মাথায় বান্দে খোপা।
কাটা চিরুনি দিল আর দিল চুপা[১৭৫]
তার পরে পড়াইল সাড়ী নামে আসমান তারা।
ভূমিতে থইলে যেমন ভূয়ে আসমান পরা॥
হস্তেতে লইলে সাড়ী ঝলমল করে।
শুন্যেতে থইলে সাড়ী শূন্যে উড়া করে॥
কানেতে পড়াইল দুল চম্পক ঝুমুকা।
নাকেতে সোণার বেসর আর বলাকা[১৭৬]
গলাতে পড়াইল এক হীরার হাসুলি।
পায়েতে পড়াইল খারু গুজরী আর পাচুলী[১৭৭]
হস্তেতে সোণার বাজু সোণার বাতেনা।
মস্তকেতে সিথিপাটী সুবর্ণের দানা॥
এই মতে সখীগণে করিলে সাজন।
বিধিমত কলাতলে হইল বরণ॥

সাত পাক ঘুরে কন্যা বরের চৌদিকে।
শুভযোগ হইল দুহার মুখচন্দিকে[১৭৮]
চাক-ঢোল বাজে কত গীতবাদ্যধ্বনি।
বন্দুকের আওয়াজে যেমন কাপয়ে ধরণী॥
তুরমী ছাড়িল যেমন আগুনের গাছ খারা৷
হাউই পানাস[১৭৯] ছুটে আসমানের তারা॥
মহা আনন্দেতে হইল বিয়া সমাপন।
কমলারে পাইয়া কুমার আনন্দিত মন॥
এই মতে বিয়া কার্য্য হইয়া গেল শেষ।
পুত্রসহ চাকলাদার ফিরিল নিজ দেশ॥

এইখানে করিলাম শেষ বারমাসী গান।
বাটা ভইরা জামাইর মা দেও গোয়া[১৮০] পান॥
আমরা সবে দিয়া যাই ধনে পুত্রে বর।
ধন দৌলত যত বারুক বিস্তর॥
বনদুর্গা মায়ের পাও শতেক প্রণাম।
কর্ম্মকর্ত্তা করুন মাপ বিপদে আছান[১৮১]


কমলার স্বগত সঙ্গীত

“যেদিন হইতে দেখছি বন্ধু তোমায় মৈষালের বাড়ী।
সেই দিন হইতে বন্ধু আমি পাগল হৈয়। ফিরি॥
আন্দাইরে ডুইবাছে বন্ধু আরে বন্ধু চন্দ্রসূর্য্য তারা।
তোমারে দেখিয়া বন্ধু আরে বন্ধু হৈছি আপন-হারা॥
কপালের দোষে বন্ধু আরে বন্ধু বন্দী বাপ-ভাই।
দোসর দরদি বন্ধু আরে বন্ধু তুমি ছাড়া নাই॥
বিফলে ফিরিয়া আরে বন্ধু যাও নিজ ঘরে।
একেলা শুইয়া বন্ধু আরে বন্ধু কান্দি আপন মন্দিরে॥

বাইরেতে শুনিলে বন্ধু আরে বন্ধু তোমার পায়ের ধ্বনি।
ঘুম হইতে জাইগা উঠি আমি অভাগিনী॥
বুক ফাটিয়। যায়রে বন্ধু আরে বন্ধু মুখ ফুটিয়া না পারি।
অন্তরের আগুনে আমি জ্বলিয়া পুড়িয়া মরি॥
পাখী যদি হইতারে বন্ধু আরে বন্ধু রাখতাম হৃদ্‌পিঞ্জরে।
পুষ্প হইলে বন্ধু আরে বন্ধু গাইথা রাখতাম তোরে॥
চান্দ যদি হইতে বন্ধু আরে বন্ধু জাইগা সারা নিশি।
চান্দ মুখ দেখিতাম নিরালায় বসি॥
একদিনের দেখারে বন্ধু মৈষালের বাথানে।
চান্দ মুখ দেইখারে বন্ধু মজিছে পরাণে॥
বাট। ভরি বানাইয়া পানরে বন্ধু তরে দিতে লাজ বাসি৷
আপনার চক্ষের জলে আরে বন্ধু আপনি যাই ভাসি॥
কতক দিনের বন্ধুরে আমার আওব সুখের দিন।
তোমার লাগ্যা ভাবিয়া আমার যৌবন হইল ক্ষীণ॥”

দ্বিজ ঈশান কয় কন্যা আরে না কর ক্রন্দন।
বিধির নিবন্ধ থাকলে কন্যা আরে অবশ্য মিলন॥১-৯০

  1. এই মুখবন্ধটি কবির রচিত নহে, ইহা গায়েনের উক্তি।
  2. কানা মেঘারে=সুবিবেচনার অভাব হেতু মেঘকে দৃষ্টিশক্তিহীন বলা হইয়াছে।
  3. তুইন=তুমি না।
  4. সাইলের=শালী ধানের।
  5. নিয়ড়ে=নিকটে।
  6. খুচি=ধান্যাদি শস্যের পরিমাণ ভেদ
  7. দিও পদ্মের আশি = [আশি = দল (?)] পদ্যের দল আঁকিয়া দিও (?)।
  8. হুলিয়া=সম্ভবতঃ হালিউরা, এই গ্রাম নন্দাইল হইতে দশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে।
  9. বাগিজা=বাগিচা, উদ্যান।
  10. উলুছনে ছানি=উলুখড়ের ছাউনি।
  11. হাজারে বিজারে=অসংখ্য।
  12. দাঙ্গর গাবর=বলবান্ ভৃত্য। ধাঙ্গড় শব্দের অপভ্রংশ দাঙ্গর। গাবর শব্দ=গর্ভরা, নৌকার মাঝি; তাহা হইতে ভৃত্য ও যুবক অর্থ আসিয়াছে।
  13. খামারিয়া জমী=চাষের জমী।
  14. কুড়া=ভূমির পরিমাণবিশেষ।
  15. বন্ধ ভইরা চড়ে=গোচারণের মাঠ যুড়িয়া চড়া করে।
  16. মেড়া=ভেড়া, মেষ।
  17. টাইল=পালই, ধান্যাদি শস্যের স্তূপ।
  18. এক পুরা সরু=এক গোলা ক্ষুদ্র শস্য। তিল সরিষা প্রভৃতিকে ‘সরু’ বলে।
  19. কাটায় মাপ্যা=(কাঠায়), ধান্যের বেতনির্ম্মিত পাত্রবিশেষে ওজন করিয়া অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণে।
  20. ইতে=ইথে, ইহাতে।
  21. পসরে=আলোকে।
  22. কারকুন=কর্ম্মাধ্যক্ষ অথবা হিসাবের রক্ষক।
  23. ভাবের ভামিনী=যৌবনের ভাবে ভাবিতা।
  24. লুচ্চা লোকন্দরা=সহচর শব্দ, অথ—ইন্দ্রিয়পরায়ণ, চরিত্রহীন।
  25. ঘরতনে=ঘর হইতে; পঞ্চমীর অর্থে কোথাও কোথাও ‘থুন’ শব্দের প্রয়োগ আছে।
  26. এড়িয়া=ত্যাগ করিয়া।
  27. গুটিয়া=চূর্ণ করিয়া।
  28. থুরি=নির্দিষ্ট সংখ্যা-বিশেষ।
  29. বিয়ান=বিহান, প্রভাত।
  30. সিদুরে রাঙ্গিয়া ঠুট=সিদুররঞ্জিত ঠোঁট।
  31. কেরুল=কৌঁড়, অঙ্কুর।
  32. গজন্দম=গল্পগমন বা গজগতি।
  33. বেলাইন =বেলুন, যাহা দিয়া রুটি প্রভৃতি বেলা হয়।
  34. দাগল-দীঘল=সহচর শব্দ; অর্থ সুদীর্ঘ। দাগল=ডাগর।
  35. এলি=হেলিয়া।
  36. উলা মেলা=আনন্দোৎসব, তুল হালা মেলা।
  37. ছান=স্নান।
  38. অন্ধিসন্ধি=উপায়-উদ্যোগ।
  39. আনিগুনি=আনাগোনা, আসা-যাওয়া।
  40. আইছুইন=আসিয়াছেন।
  41. অইছুইন খারা=খাড়া রহিয়াছেন, দাঁড়াইয়া আছেন।
  42. আত্তির কেন পাড়া=হাতীর কেন পা অর্থাৎ বড়লোকের শুভাগমনের উদ্দেশ্য কি?
  43. গোয়ামরি হাসি=মৌরীর মত হাসি, পূর্ব্ববঙ্গের চলিত কথা। মৃদু-মধুর হাস্য।
  44. নাল=মর্ম্ম, ভাব। ‘নাল’ শব্দ ‘লহরী’ শব্দের অপভ্রংশ, পূর্ববঙ্গে প্রচলিত। যথা ‘পাঁচ নাল’ বা ‘পাচ নলী’ হার।
  45. চান= চাঁদ।
  46. ভুঞা = ভূম্যধিকারী, বড়লোক।
  47. বৈসনের=বসিবার।
  48. কেওয়া সুপারী খয়ার=কেয়াফুলে প্রস্তুত পানের মশলা।
  49. আনইলে =তাহা না হইলে, অন্যথা হইলে।
  50. কাছার=নিকট, সাহচর্য্য।
  51. গর্দ্দান=স্কন্ধ।
  52. ভাড়াও=ভাণ্ডাও।
  53. সাজুয়া=সজ্‌জিত।
  54. গোয়া=গুয়া, গুবাক।
  55. রোসনাই=আলো।
  56. চান্দমা=চন্দ্রমা।
  57. সোপা=(?)।
  58. পদুম=পদ্ম।
  59. ছাইড়ে=ছাড়িয়ে।
  60. কোইল=কোকিল।
  61. চোকা দই=অম্ল সরযুক্ত দধি।
  62. বেড়াবাড়ী=হাতে বেড়ি দিয়া।
  63. ডাকিয়াছে=ডেকে আদর করিয়াছে।
  64. কাছলা=গামছা।
  65. বুড়ির—লোকে=এক বুড়ি পরিমাণ কড়ির দই খাইয়া লোকে আমাকে এক কাহন কড়ি দিয়াছে।
  66. হদ্য যে হইয়া=যথাসাধ্য করিয়া।
  67. বেসাতি=পণ্য, (এখানে) ব্যবসায়।
  68. সাধ্যা=সাধিয়া।
  69. বঁধু=বন্ধু, নাগর।
  70. অধষ্ণ=অধোমুখ (?)
  71. হাদম=অ্যাডাম। যে শব্দ হইতে ‘আদমি’ শব্দ হইয়াছে, এখানে “সংসার হাদমে” অর্থ সংসারের পুরুষদের মধ্যে।
  72. উবুৎ হইয়া=হেঁট হইয়া।
  73. আঁচ=আঁচল।
  74. গাছল=লতা (?)
  75. দড়ফড়=ধড়ফড়; পাখীর ডানার ঝটপট শব্দের অনুকরণে
  76. বাগুনি=(?)।
  77. গুমর=ক্রোধমিশ্র অভিমান।
  78. পেরাশনি=দুঃখ।
  79. ছোরত=সুরত, রূপ।
  80. ভেদা=ঠেলা।
  81. গোসা=ক্রোধ।
  82. উষ্টা=চড়।
  83. ভান=ছল।
  84. কইছ তোর আগছালা=কারকুনকে তোর অবস্থা বলিস্ (কইচ্)।
  85. আট-কুরী=আটকুড়ি, আট জায়গায় যে কুড়াইয়া খায়; ভিক্ষুক, পর-প্রত্যাশী, হীন, অপুত্রক।
  86. আড়ি=অন্তরে।
  87. খোন্দল=কোণ (?)।
  88. বেইজ্‌জতের পর্‌তিশোধ = অপমানের প্রতিশোধ।
  89. শুনখাইন=শুনকান, শুনুন।
  90. অবাক্কি হইয়া=নির্বাক্, এখানে ‘আশ্চর্য্য’।
  91. খুন-সালে=যে ঘরে গুপ্তহত্যা ইত্যাদি অত্যাচার চলিত সেখানে।
  92. মনকাকরের কাটা=একরূপ গাছের কাঁটা।
  93. গোয়াইল=গত করিল, যাপন করিল।
  94. পাটনে=পত্তন শব্দের অপভ্রংশ।
  95. জান্য=জানিও।
  96. ইতে=ইহাতে।
  97. উগাইল=উসুল করিল।
  98. সুবিস্তরে = সমস্ত বিবরণ বিস্তৃতভাৰে লিখিরা।
  99. শুনছ নি=শুনেছ কি
  100. বাঝিল=বাধল।
  101. তরে=তোরে।
  102. তেকাটিয়া=তেমাথা।
  103. সোয়ারীর কাম=পাল্‌কি ভুলির কাজ, বাহকের কর্ম্ম।
  104. বাছ=একঘরিয়া, পতিত।
  105. পরাচিত্তির পাতি=প্রায়শ্চিতের ব্যবস্থাপত্র।
  106. জন বাচ্ছা=পরিজন ও পুত্রাদিসহ।
  107. এবারত=ভাষার ইঙ্গিত বা পাঠ।
  108. পর না পুরুষ=পর-পুরুষ।
  109. ভাড়াই=‘ভাড়াই’ নামক।
  110. অবিয়াত=অবিবাহিত।
  111. কান্‌বে=কান্দিবে।
  112. সেজ=শয্যা।
  113. আন্ধান=সন্ধান (?)।
  114. মইষাল=মহিষওয়ালা, মহিষরক্ষক।
  115. যাগা=যায়গা, স্থান।
  116. কুণে=কোণায়।
  117. বিয়ানী= যে প্রসব করিয়াছে।
  118. কোঙর=কুমার।
  119. বাথান=গোচারণের মাঠ।
  120. মেন্নত=মেহনত, পরিশ্রম।
  121. টুপা=জলপাত্র।
  122. উলা=উলাখড়ের বাথান (প্রান্তর)।
  123. এন=হেন
  124. উপচিল=উপস্থিত হইল।
  125. গুঞ্জরী=গুঞ্জত্নী, পদাভরণবিশেষ।
  126. অন্তরে—মুখ=অন্তরে যে কথা মন্ত্রের মত জপ করিতেছে, পুষ্পকলি মনের সে কথা মুখ ফুটিয়া বলে না।
  127. আচরিত=আশ্চর্য্য।
  128. কৈয়াম=কহিব।
  129. পইলা=প্রথম।
  130. গলুর গোষ্টি=গয়লা-জাতীয় (?)।
  131. আশ্রা=আশ্রয়।
  132. দোলা-খেলা=দোলার উপর ঝুলানো।
  133. আবের কাকই=অবের চিরুণী।
  134. আচরি বিচরি=প্রসাধন করিয়া।
  135. ছান=স্নান।
  136. পোষা আন্দি=পৌষের কুয়াসায় অন্ধকার।
  137. সকলের—হয়=পৌঘের দিন ছোট বলিয়া এই মাসকে বার মাসের মধ্যে সর্ব্ব-কনিষ্ঠ বলা হইয়াছে।
  138. সিনানের সাজা=স্নানের সজ্‌জা।
  139. পরা দন্ত=চিকন গোয়ালিনীর দাঁত পড়িয়া গিয়াছিল। সেই পড়া দাঁতকে সাক্ষী করিয়া বলিলেন।
  140. বেহুড়া=বেউড়া উন্মত্তা।
  141. খোয়া=কোয়া, কুয়াসা।
  142. কারুয়া=কারুকার্য্য-শোভিত চান্দোয়া (?)
  143. কড়ি=গুটি।
  144. ধন্বা=ধর্‌না।
  145. ডুঙ্গা=ষষ্ঠীর পুজোপচার সহিত কুলা, কদলীকাণ্ড।
  146. গোঞ্জরিরা=কাটিয়া, অতিবাহিত করিয়া।
  147. আইঞ্চল=আঁচল।
  148. পন্থের কায়া=পথের আকৃতি।
  149. জোর=যুগ্ম, দুই অথবা প্রবল।
  150. দরদী=ব্যথার ব্যথী।
  151. আছরা=আশ্রয়।
  152. লিলুয়ারী=ক্রীড়াশীল।
  153. শায়ান্যা সংক্রান্তে=শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে।
  154. চান্নি=জ্যোৎস্না রাত্রি।
  155. রুসনাই=আলো।
  156. বাতির করে সাজা=আলো সাজাঁর।
  157. হুলামেলা=আনন্দ-কোলাহল।
  158. অবতরঙ্গে=বিবিধ বিধানে।
  159. জুকার=জয়কার।
  160. সাজে পারে=সাজসজ্‌জা করে।
  161. সাজা পারা=সাজসজ্‌জা।
  162. আগেতে....রক্ষাকালী=আগে বিচার কর, তার পরে রক্ষাকালীর পূজা করিও।
  163. থইয়া=থুইয়া, রাখিয়া।
  164. কাডা=বজ্র।
  165. ঠাডা=ঠাটা, বিদ্যুৎ।
  166. বাহানা=অছিলা।
  167. নাইচ=নাচ, নৃত্য।
  168. আথারে পাথারে=চারি দিকে।
  169. চারি ভইরা=মাটির বৃহৎ পাত্র ভরিয়া।
  170. বিলাত=দেশী বিদেশী।
  171. নায়রী= কুটুম্বিনী।
  172. ডরাই=গ্র্যাম্য দেবতাবিশেষ।
  173. গাষ্ট ঘিলা = ঘাঁট ঘিলা, উদ্বর্ত্তনভেদ।
  174. ভাইস্তা=ভ্রাতুষ্পুত্র।
  175. চুপা (?)।
  176. বলাকা=একপ্রকার নাকের অলঙ্কারবিশেষ।
  177. খারু..........….পাচুলী—খারু=মল। গুজরী=নূপুর এবং মল এই দুই মিশিয়া একরূপ পদাভরণ। পাচুলী=পাশুলী, পদাঙ্গুলীর আভরণ।
  178. মুখচন্দিকে=মুখচন্দ্রিকা, বরকন্যার শুভদৃষ্টি।
  179. পানাস=ফানুস।
  180. গোয়া=গুয়া।
  181. আছান=আশান; শান্তি।