মৈমনসিংহ গীতিকা/কাজলরেখা

উইকিসংকলন থেকে

কাজলরেখা

(রূপকথা)

কাজলরেখা


আরম্ভ— (মানিকরে) 

সভাপতি-পদে আমি মিন্নতি[১] জানাই।
আমি যে গাইবাম গান হেন সাধ্য নাই॥
অল্পমতি অল্পজ্ঞানী মই দুরাচার।
এই সভায় গাইতে গান কি শক্তি আমার॥
দশ জনায় ধইরাছুইন্‌[২] মোরে না দেখি উপায়।
তবে যে গাইবাম গান উস্তাদের কিরপায়[৩]
উস্তাদের চরণে আমার শতেক পন্নাম[৪]
একমনে সভাজন কর অবধান॥

(১)

মানিকরে— 
ভাটিয়াল মুল্লুকে আছিল এক সদাগর।
কুঠীয়াল[৫] আছিল সাধু নাম ধনেশ্বর॥
এক কইন্যা এক পুত্র ছিল সাধুর ঘরে।
ধনী আদ[৬] হইল সাধু মা লক্ষ্মীর বরে॥
দশ না বছরের কন্যা কাজলরেখা নাম।
দেখিতে সুন্দর কন্যা অতি অনুপম॥
হীরা-মতি জ্বলে কন্যা যখন নাকি হাসে।
সুজাতি[৭] বর্ষার জলেরে যেমন পদ্মফুল ভাসে॥

চাইর না বচ্ছরের পুত্ত্র‌ু নাম রত্নেশ্বর।
রত্ন না জিনিয়া তার চিক্কণ[৮] কলেবর॥
দৈবের নির্ব্বন্ধ কথা শুন দিয়া মন।
গোসা[৯] কইরা লক্ষ্মী তার ছাড়িলা ভবন॥


(২)

মানিকরে-- 
জুয়া খেলাইয়া সাধু হারাইল সম্বল।
ধনরত্ন হাতীঘোড়া সব হইল তল॥
সকল হারিলা সাধু পাপিষ্ঠ জুয়ায়।
ফকীর হইয়া সাধু ঘুরিয়া বেড়ায়॥
বড় বাপের বড় বেটা ছিল ধনপতি।
জুয়াতে হারিয়া তার এতেক দুর্গতি॥
কন্যা পুত্ত্র‌ু মাত্র সাধুর হইল সম্বল।
বার ডিঙ্গা ধন সাধুর উভে[১০] হইল তল॥

* * * *
* * * *


(৩)

 সাধু ধনেশ্বর জুয়াতে সব হারাইয়া ফকীর হইল। তার যত হাতী-ঘোড়া, লোক-লস্কর—আর কিছুই রইল না। কন্যা কাজলরেখার বিয়ার কাল উপস্থিত। এগার বচ্ছরের কন্যা বিয়া না দিলেই না হয়। জুয়ারী[১১] বাপের কন্যাকে বিয়া কর্ত্তে কৈউ আইল না। সদাগরের পুরীতে এমনকালে এক সন্ন্যাসী আস্যা[১২] দেখা দিলাইন[১৩]। সন্ন্যাসী সদাগরেরে[১৪] এক শুকপক্ষী আর এক শিরি[১৫] আঙ্গুইট্[১৬] দিয়া কইলেন, “এই পক্ষী ধর্ম্মমতি শুক। তুমি এই পক্ষীর কথা মতন যুদি[১৭] কাম[১৮] কর, তা অইলে তোমার বাপের কালান্যা[১৯] যে সমুত্তি[২০]—সব ফির‍্যা[২১] পাইবা। এইকথা শুন্যা সদাগর খুব সুখী অইয়া শুকপক্ষী রাখল, সন্ন্যাসী বিদায় অইয়া চল্যা গেলাইন।

 একদিন সদাগর ধর্ম্মমতি শুকেরে জিজ্ঞাসা কর্‌ল,—

“কও কও শুক পংখীরে আমার বিবরণ।
আমার না দুঃখের দিন যাইব কখন॥
রত্নমন্দির আমার ভাঙ্গ্যা অইল মাটি।
ভূমিতে পড়িয়া শুই নাই একখান চটি॥
পানি যে তুলিয়া খাই নাই ঝাড়িঝুড়ি।
পন্থের ফকীর অইয়া দেশে দেশে ঘুরি॥
বাপের কাল্যা আত্তি[২২] ঘোড়ারে পংখী—
পংখী আরে—কত যে আছিল।
বিপদে ফালাইয়া পংখী—
পংখী আরে—দৈবে হইরা[২৩] নিল॥
এক পুত্ত্র‍‌ু এক কন্যারে পংখী বংশের বাতি জ্বলে।
কি দিয়া পালিবাম[২৪] পংখী সেই না দুই ছাওয়ালে[২৫]॥”
শুক- 
কাইন্দ না কাইন্দ না[২৬] সাধু না কান্দিও আর।
দুঃখের যে দিন সাধু যাইব তোমার॥
হাতের ছিরি আঙ্গুইট্ সাধু রে বিকাইয়া[২৭] সহরে।
ভাঙ্গা ডিঙ্গা বান্ধাইতে[২৮] আন কারিগরে[২৯]

কিছু মূলধন লইয়া বাণিজ্যেতে যাও।
ধনরত্নে ভইরা লক্ষ্মী দিবাইন[৩০] তোমার নাও॥
পুব দেশেতে যাওরে সাধু হাওর[৩১] পাড়ি দিয়া।
এক বছরের ধন খাইবা বার বচ্ছর বইয়া[৩২]


(8)

 এই কথা শুন্যা সাধু কর্‌ল কি,—সেই যে ছিরি আঙ্গুইট্,—নিয়া বাজারে বিক্রী কর্‌ল। পরে কামলা[৩৩] কারিগর ডাক্যা আন্যা[৩৪] বাপের কালাইন্যা যত ডিঙ্গা আছিল্, সব দুরস্ত কর্‌ল। কইরা—পূবদেশের দিকে বাণিজ্যে মেলা[৩৫] দিল। অল্পদিনের মধ্যেই সদাগর বাপের কালাইন্যা যত ধন ফির‍্যা পাইল।

 আত্তি-ঘোড়া, লোক-লস্কর, ডিঙ্গাভরা ধন সদাগরের পুরীতে আর আটে না[৩৬]। যত কামটুঙ্গি, জলটুঙ্গি ঘর[৩৭] সদাগর সব দুরস্ত কর্‌ল।


(৫)

এও[৩৮] চিন্তা গেল সাধুর আর চিন্তা হইল।
ঘরের কন্যা কাজলরেখা অবিয়াত[৩৯] রইল॥
এগার বছরের কন্যা বারয় নাই সে পড়ে।
বিয়ার কাল হইল কন্যার চিন্তে সদাগরে॥
ভাবিয়া চিন্তিয়া সাধু শুকের কাছে যায়।
কহ কহ শুক পংখী এহার[৪০] উপায়॥


(৬)

 এই কথা শুন্যা শুক পংখী কইল—“সদাগর, তোমার সকল দুঃখু দূর হইছে। এই দুঃখের আরও দেরী। মরা সোয়ামীর কাছে এই কন্যার বিয়া হইব[৪১]। এই কন্যারে তোমার পুরীর মধ্যে রাখ্যো না[৪২] বনের মধ্যে নিবাস[৪৩] দিয়া আইস।” তখন সদাগর কান্‌তে[৪৪] আরম্ভ কর্‌ল—“হায়! আমার অত আদরের কন্যা, আর তার কপালে এই দুঃখু। মরা সোয়ামীর কাছে বিয়া”—সদাগর হায় হায় করিয়া বিলাপ করিতে লাগিল।


(৭)

দিশা—গুণের[৪৫] ঝি গো, কেমন কইরা দিবাম তোমায় বনে। 
বাপে মায়ে পালে কন্যা বিয়া দিবার আশে।
আমি কেমন কইরা এমন কন্যা পাঠাই বনবাসে॥
শিশুকালে মাও মইল কত দুঃখু করি।
এমন করিয়া কন্যা পালন যে করি॥
দুষ্কের[৪৬] কপাল মোর দুঃখু নাইসে যায়।
শুক পংখী কহে কথা না দেখি উপায়॥
আধ পিষ্ট[৪৭] গেল আমার গুয়ে আর মুতে।
আধ পিষ্ট গেল আমার মাঘ মাস্যা শীতে॥
কত কষ্টে পাল্যা[৪৮] তুলে এরুর[৪৯] লাগিয়া।
বনবাসে দিবাম কন্যা নাহি দিবাম বিয়া॥
আমার দুঃখের দিন না হইব দূর।


(৮)

 তখন সদাগর কর্‌ল কি—বাণিজ্যে যাইবার ছল করিয়া ডিঙ্গা সাজাইয়া কন্যারে লইয়া রওনা কর্‌ল। উজান বাইয়া বাইয়া সদাগর যাইতে যাইতে সামনে এক অরণ্য জঙ্গলা[৫০] পড়ল। সাধু এই খানে ডিঙ্গা রাখ্যা কন্যারে লইয়া বনের মধ্যে গেল। যাইতে যাইতে অনেক দূর গেলে কাজলরেখা কন্যা মনে মনে ভাব্‌তে লাগল। মনের মধ্যে একটা দুঃখু হইল।

(৯)

দিশা—বাপ মোরে কই[৫১] লইয়া যাওগো, 

পরথমে ছাড়িলা বাড়ী বাণিজ্যকারণে।
ডিঙ্গা রাইখ্যা নদীর কূলে কেন আইলা বনে॥
মনে যদি ছিল বাপ দিবা বনবাসে।
আর দুই দিন থাক্‌তাম আমি মা-ভাইয়ের পাশে॥
কি কারণে আইলা বনে কিছুই না জানি।
বনবাসে দিবা মোরে এই অনুমানি॥
বনের যত তরুলতায় দেখহ জিজ্ঞাসি।
বাপ হইয়া কন্যায় কবে কর্‌ছে বনবাসী॥
চাইর না যুগের সাক্ষী চন্দ্রসূর্য্যতারা।
ধর্ম্মের মধ্যম খুঁটি[৫২] ধর্ম্মের পাহারা॥
জিজ্ঞাসা কর বাপ আরে তাহাদের স্থানে।
বনেলা[৫৩] পংখীর কথায় কে কন্যা দিছে বনে॥
পাহাড় থাইক্যা[৫৪] ভাইট্যাল[৫৫] নদী সাগর বইয়া যায়
চাইর যুগের যত কথা জিজ্ঞাস তাহায়॥
জিজ্ঞাস কর বাপ আরে জিজ্ঞাস কর তারে।
বনেলা পক্ষীর কথায় কে কন্যা দিল বনান্তরে[৫৬]


(১০)

 সেই অরণ্য জঙ্গলার মধ্য দিয়া যাইতে যাইতে তারা দুইজন অনেক দূর গেল। সেই বনের মধ্যে না ছিল মানুষ, না ছিল পশু পংখী। অনেক দূর যাইয়া দেখে কি, সামনে একটা ভাঙ্গা মন্দির। মন্দিরের মধ্য দিয়া কপাট বন্ধ। বাপ আর ঝি দুইজনে মন্দিরের সিড়ির মধ্যে[৫৭] বইল[৫৮]। তখন দুপইরা[৫৯] রইদ্[৬০]—ক্ষিধায় ও পানি তিয়াসে[৬১] কন্যা কাজলরেখা অত্যন্ত কাতর হইয়া পড়িল।

গান—

চলিতে না চলে পাও কোথায় রইল মোর মাও
কোথায় রইল গর্ভ সোদর ভাই।
কপালেতে ছিল দুঃখ তিয়াসেতে ফাটে বুক
এক ঢোক পানি দেও খাই॥

* * * *


 সদাগর কন্যারে কইল—“তুমি এইখানে থাক। কাছে জল আছে কিনা দেইখ্যা আয়ি[৬২]।” এই কথা কইয়া মেলা দিন। সদাগর চলিয়া গেলে কন্যা উঠিয়া মন্দিরের চাইর দিক দেখতে লাগ্‌ল। তারপর সে যখন মন্দিরের কপাটের মধ্যে হাত দিল, অমনি কপাট খুইল্যা গেল। তখন কন্যা মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ কর্‌ল, অমনি মন্দিরের কপাট আবার বন্ধ হইয়া গেল। অনেক চেষ্টা করিয়াও কাজলরেখা মন্দিরের কপাট খুলতে পার্‌ল না। সদাগর জল লইয়া আইয়া[৬৩] ডাক্‌তে লাগল।

 ‘কাজল! কাজল!’—কোন সাড়া-শব্দ নাই। কতক্ষণ পরে মন্দিরের মধ্যে থাক্যা কাজলরেখা শব্দ করিল। সদাগর কইল[৬৪] “তুমি বাইরে আইস, আমি জল আন্‌ছি[৬৫]।” হায়! কাজলরেখা যে মন্দিরের বন্দী; একথা সদাগর বুঝতে পারল না। কন্যা তখন সকল কথা খুলিয়া বলিল—সদাগর মন্দিরের কপাট খুলনের চেষ্টা কর্‌ল, কিন্তু পার্‌ল না। তারপর কপাট ভাঙ্গনের চেষ্টা কর্‌ল, কিন্তু তাও পার্‌ল না।


(১১)

গান— 
সদাগরে ডাক্যা কয় “পরাণের ঝি[৬৬]
এই না মন্দিরের মধ্যে দেখছ তুমি কি॥”

কাইন্দা কাজলরেখা বাপের আগে কয়।
“এক আছে মির্‌ত[৬৭] কুমার সে যে শুইয়া রয়॥
ঘরেতে ঘির্‌তের[৬৮] বাতি রাত্রদিবা জ্বলে।
সর্ব্বাঙ্গে বিন্ধিয়া রইছে সুইচ আর শালে[৬৯]॥”

সদাগর ডাইক্যা কয় “পরাণের ঝি।
তোমার কপালে দুক্ষু আমি করবাম কি॥
যা কইল শুকপংখী কপালে কলিল
ভাল করে বিয়া দিতে বিধি বাদী হইল॥
বাপ হইয়া মরার কাছে কন্যা দিলাম বিয়া।
গিরেতে[৭০] ফিরিবাম আমি কিবা ধন লইয়া॥
শুন লো পরাণের ঝি কইয়া যাই আমি।
সাম্‌নে আছে মরা কুমার সেই তোমার স্বামী॥
সাক্ষী হইয়ো চন্দ্রসূরুয বনের দেবতা।
আজি হইতে ছাইড়া[৭১] গেলাম পরাণের মমতা॥
সতী নারী হও যদি আমি যাই কইয়া।
ঘরে আছে মরা স্বামী লইও জিয়াইয়া[৭২]
জন্মের মত থইয়া[৭৩] যাই আর না হইব দেখা।
সোয়ামীরে জীয়াইয়া তুমি রাখ্যো[৭৪] হাতের শাঁখা॥”

বাপে কান্দে ঝিয়ে কান্দে কান্দে পশুপাখী।
অরণ্য জঙ্গলায় কন্যা রইল সে একাকী॥
বাপের ভাঙ্গয়ে হিয়া কন্যার ভাঙ্গে বুক।
যাইবার কালে না দেখিল কেউ বা কার মুখ॥

* * * *

(১২)

 তখন সদাগর চলিয়া গেল। একলা পড়িয়া কাজলরেখা মন্দিরের মধ্যে। সঙ্গের সাথী একমাত্র বাপ, সেও তাকে এক্‌লা ফালাইয়া[৭৫] গেল। তখন কন্যা সেই মরা কুমারের শিওরে বইয়া কান্তে লাগ্‌ল।

গান— 
“জাগ জাগ সুন্দর কুমার রে কত নিদ্রা যাও।
আমি অভাগিনী ডাকি আঁখি মেইল্যা[৭৬] চাও॥
জন্মিয়া না দেখ্‌ছে কভু তোমায় অভাগিনী।
বাপে ত কহিয়া গেছে তুমি মোর স্বামী॥
বাপ ত নিষ্ঠুর হইয়া দিল বনবাসে।
তিনদিন তিনরাত্রি কাইট্যাছে[৭৭] উবাসে[৭৮]
চান্দের ছুরত[৭৯] কুমার তোমার কাম-তনু[৮০]
মেঘেতে ঢাকিয়া যেমন প্রভাতের ভানু॥
কেম্‌নে হইল এমন দশা কে করিল তোর।
বনেতে এড়িয়া মরা পলাইছে দূর॥
তোমার যে নাও বাপ না জানি কেমন।
বংশের পরদীম[৮১] পুত্র রাইখ্যা গেছে বন॥
আমার বাপের মত সে কি নিষ্ঠুর কপটী।
বনে এড়ি মরা পুত্রে মনে দিছে ভাটী[৮২]
যে হও সে হও প্রভু তুমি ত সোয়ামী।
যতকাল দেহ তোমার ততকাল আমি॥
মুখ মেইল্যা কও কথা আঁখি মেইল্যা চাও।
জাগিয়া উত্তর দেও মোরে না ভাড়াও[৮৩]
কর্ম্মদোষে বেউলা রাড়ী[৮৪] শিরেতে বসিয়া।
মরা পতির কাছে বাপে দিয়া গেছে বিয়া॥”

(১৩)

 কতক্ষণ পরে আবার মন্দিরের কপাট খুইল্যা গেল। কাজলরেখা দেখ্‌ল, কি যে এক সন্ন্যাসী তখন মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ কর্‌ল। বাপে কন্যায় এতকাল চেষ্টা করিয়াও যে মন্দিরের কপাট খুলতে পারে নাই, সন্ন্যাসীর হাত কপাটে লাগ্‌বামাত্রই কপাট খুলিয়া গেল। এই দেখিয়া কাজলরেখা ভারি আশ্চর্য্য হইয়া গেল। ভাবিল যে সন্ন্যাসী যাদুকর; নিশ্চয়ই আমার স্বামীকে বাঁচাইতে পারিবে।

 তখন সে সন্ন্যাসীর পায় উপুর হইয়া কান্‌তে লাগ্‌ল। তখন সন্ন্যাসী তারে অভয় দিয়া কইল—“তোমার কোন চিন্তা নাই। এই যে মরা কুমার সে একজন রাজার পুত্র। আমিই তারে এই বনের মধ্যে আইন্যা[৮৫] রাখছি। এর গায়ের সুইচ কাঁটাগুলি তুমি এক একটা কইরা খুল্‌তে থাক। কেবল দুই চক্ষের যে দুইটি সূচ তাহা খুইল্যনা[৮৬]। সমস্ত সূচ তোলা হইলে পরে চক্ষের দুইটি সূচ খুলিয়া এই যে গাছের পাতা দিলাম তার রস চক্ষে দিও তা অইলেই[৮৭] সে আবার বাঁইচ্যা[৮৮] উঠবে। কিন্তু সাবধান, তোমার কপালে অনেক দুঃখু আছে; জোর করিয়া কপালের দুঃখু খণ্ডাইতে যাইয়ো না। এই কুমারই তোমার স্বামী, কিন্তু ধর্ম্মমতি শুক যতদিন পর্যন্ত তোমার স্বামীর কাছে তোমার পরিচয় না দেয়, ততদিন পর্যন্ত নিজে খুব দুঃখে পড়িলেও তার কাছে আত্মপরিচয় দিয়ো না। যদি দেও তা হইলে জন্মের মত বিধবা হইবা।” এই বলিয়া সন্ন্যাসী চলিয়া গেল।

 তখন কাজলরেখা সন্ন্যাসীর কথামত সাত দিন সাত রাইত[৮৯] বসিয়া বসিয়া মরা স্বামীর শরীর হইতে একটী একটী করিয়া সূচগুলি বাছিয়া তুলিল। সাত দিন কাজলরেখা মন্দির হইতে বাইরও হইল না, কিছু খাইলও না। আট দিনের দিন কন্যা কেবল চক্ষের সূচ দুইটা রাইখ্যা ছান[৯০] করিবার জন্য জলের সন্ধানে বাইর হইল। কতদূর গিয়া দেখে যে একটা পুষ্কুনী। তার চাইর পারে বান্ধা ঘাট, ডালিমের রসের মত পানি। তখন কন্যা ছান করণের জন্য লামল[৯১]। এই সময় পুষ্কুনীর আরেক পার দিয়া ‘ধাই চাই’ বলিয়া একটী লোক যাইতেছিল; তার পাছে একটী কন্যা, তার বয়স ১৩৷১৪ বৎসর। দেখিলে সাধারণ লোকের কন্যা বলিয়াই বোধ হয়। সেই লোকটী কাজলের নিকট আসিয়া দাসী কিনিয়া রাখিবে কিনা তাকে জিজ্ঞাসা করিল। তখন কাজলরেখা জিজ্ঞাসা করিল—এই মেয়েটা তোমার কে হয়? সে বলিল—এই মেয়েটা আমার কন্যা; পেটের দায়ে কন্যা বিক্রয় করিতে বাহির হইয়াছি। গাওয়ালে[৯২] যাচাই করিয়া দেখিলাম—কেউ দাসী রাখে না। একজন সন্ন্যাসী আমাকে এই বনের পথ দেখাইয়া কইল যে এই বনে এক রাজকন্যা বাস করে, তার দাসীর প্রয়োজন আছে। সে দাসী রাখিবে। আমার বোধ হয় তুমি সেই রাজকন্যা।

 কাজলরেখা মনে মনে ভাবিতে লাগিল—সংসারে এক নিষ্ঠুর বাপ তার কন্যাকে বনে নির্ব্বাসন দিয়া গিয়াছে; তাহ’তে আর-এক নিষ্ঠুর বাপ কিনা পেটের দায়ে কন্যা বিক্রয় কর্‌তে আইছে[৯৩]। কাজলরেখা ভাব্‌ল—এই কন্যা আমারই মত জনমদুঃখিনী। সে কন্যার দুঃখে দুঃখিত হইয়া তার দুঃখের দোসর মিলাইবার জন্য হাতের কঙ্কণ দিয়া ঐ কন্যাটিকে কিনিয়া রাখিল।

গান— 
কর্ম্মদোষে কাজলরেখা হইছিল[৯৪] বনবাসী।
কঙ্কণ দিয়া কিন্‌ল বাই নাম কাঙ্কণ দাসী॥

 তখন কাজলরেখা কন্যাকে ভাঙ্গা মন্দির দেখাইয়া কইল——“তুমি মন্দিরের মধ্যে যাও। এই মন্দিরের মধ্যে একজন মরা কুমার আছে, তারে দেইখ্যা ভয় পাইয়ো না। তার শিয়রের মধ্যে যে গাছের পাতা আছে তার রস লইয়া রাইখ্য। আমি ছান কইরা আইয়া[৯৫] তার চক্ষের দুটী সূচ খুইল্যা এই রস তার চক্ষে দিলেই সে বাঁইচ্যা[৯৬] উঠ্‌বে। এই কথা দাসীর কাছে কইয়া[৯৭] কাজলরেখা ভাল করে নাই। এই কথা কইবা মাত্রই তার বাম চক্ষের পাতা খুব কাঁইপ্যা উঠ্‌ল।

গান— 
কাঙ্কণ দাসীরে যখন কইল এই কথা।
তরাসে কাঁপিল কন্যার বাম চক্ষের পাতা॥
আগে চলে কাঙ্কণ দাসী পাছে পাছে চায়।
মনেতে অসুর বুদ্ধি ভাবিয়া জোয়ায়[৯৮]

দুই চক্ষের দুই সূচ দুই হাতে খুলে।
শিরেতে পাতার রস দুই চক্ষে ঢালে॥

অঙ্গ ঝাড়া দিয়া কুমার উঠিল জাগিয়া।
কাঙ্কণ দাসী কয় “কুমার! আমারে কর বিয়া॥”

এক সত্য করে কুমার চিনিতে না পারে।
“পরাণে বাঁচাইছ কন্যা বিয়া করবাম্ তোরে॥”
দুই সত্য করে কুমার দাসীরে ছইয়া[৯৯]
“পরাণ বাঁচাইছ[১০০] যদি তুমি পরাণ পিয়া[১০১]
তিন সত্য করে কুমার ধর্ম্ম সাক্ষী করি।
“আজি হইতে হইলা তুমি আমার ঘরের নারী[১০২]
রাজ্য ধন আছে যত লোক আর লঙ্কর।
কাননে ফালাইয়া মোরে গেল একেশ্বর॥
কির্‌পাতে তোমার কন্যা পরাণ যে পাই।
তোমা বিনা এ সংসারে মোর অন্য নাই॥”


(১৪)

 বাপ মায়ের কথা, বংশের কথা না সুধাইয়াই একমাত্র প্রাণ-দাতা বলিয়া রাজকুমার তাকে বিয়া কর্‌তে প্রতিজ্ঞা কর্‌ল।

গান— 
ঘরে আছিল ঘিরতের বাতি সদাই অগ্নি জ্বলে।
তারে ছুইয়া কুমার পরতিজ্ঞা যে করে॥

 ঠিক এমন সময় ছান কইরা ভিজা কাপড়ে কাজলরেখা মন্দিরে প্রবেশ করল। ঢুইকাই[১০৩] দেখে যে তার স্বামী বাঁইচ্যা উঠ্‌ছে[১০৪]

গ্রহণ ছাড়িলে যেমন চান্দেরর প্রকাশ।
কুমারে দেখিয়া কন্যা পাইল আশ্বাস॥

কঙ্কণ দাসী

“আগু হইয়া পরিচয় কহে কাঙ্কণ দাসী।
কঙ্কণে কিন্যাছি ধাই নাম কাঙ্কণ দাসী॥”

কাজলরেখা, ৩২৭ পৃঃ

প্রভাতের ভানু জিনি ছুরত সুন্দর।
একে একে দেখে কন্যা সর্ব্ব কলেবর॥

কন্যারে দেখিয়া কুমার লাগে চমৎকার।
এমন নারীর রূপ না দেইখ্যাছে আর॥
পরথম যৌবনে কন্যা হীরা-মতি জ্বলে।
কন্যারে দেখিয়া কুমার কহে মিঠা বুলে॥

“কোথা হইতে আইলা কন্যা কিবা নাম ধর।
কিবা নাম বাপ মার কোন দেশে ঘর॥
কিসের লাগিয়া কন্যা ভ্রম বনে বনে।
স্বরূপ উত্তর দেও এই অভাজনে॥
মাও ত নিঠুরা তোমার বাপ ত নিঠুর।
ঘরের বাইর কর‍‍্যা তোমায় দিল বনান্তর॥”

আগু[১০৫] হইয়া পরিচয় কহে কাঙ্কণ দাসী।
“কঙ্কণে কিন্যাছি[১০৬] ধাই নাম কাঙ্কণ দাসী॥”

রাণী হইল দাসী আর দাসী হইল রাণী।
কর্ম্মদোষে কাজলরেখা জন্ম-অভাগিনী॥

 সন্ন্যাসীর আদেশমত কাজলরেখা স্বামীর নিকট আত্মপরিচয় দিতে পারিল না। স্বামীর সঙ্গে দাসী হইয়াই স্বামীর রাজ্যে চলিয়া গেল।


(১৫)

 কাজলরেখা রাজবাড়ীতে দাসীর মত আছে, থাকে, খায়। তাহার কাজ জল আনা, ঘর ঝাট দেওয়া, বাসন মাজা আর রাত্রদিবা নকল রাণীর সেবা করা। এত করিয়াও সে নকল রাণীর মন পাইত না। সদা সর্ব্বদাই তাকে গাইল[১০৭] খাইতে হইত। পাছে কাজলরেখা কারো কাছে তার আত্মপরিচয় দিয়া ফালায় সেই কারণে নকল রাণী তাহাকে চক্ষের আড় করিত না। সূচ রাজা এই সব খুব নেহালিয়া দেখিতে[১০৮] লাগ্‌ল। রাজা তার চাল-চলন, কথাবার্ত্তা, আদব-কায়দা,—হগলের[১০৯] উপর তার চান্দের ছটা রূপ দেইখ্যা একেবারে পাগল হইয়া গেল।

গান— 
রাজা—“কে তুমি সুন্দর কন্যা কোথায় বাড়ী ঘর। 
কিবা নামটী মাতা পিতার কিবা নাম তোর॥
স্বরূপে সুন্দর কন্যা লো পরিচয় দাও মোরে।
বাইর কামুলী[১১০] দাসীর কাজ না সাজে তোমারে॥
তুমি যে হইবে কন্যা লো কোনো রাজার ঝিয়ারী[১১১]
কর্ম্মের লিখনে তুমি ফির বাড়ী বাড়ী॥
তোমার সুন্দর রূপ লো কন্যা চান্দ লাজ পায়।
ভাড়াইয়োনা কন্যা মোরে লো আমার প্রাণ যায়॥”
কাজলরেখার উত্তর— 
“আমি যে কঙ্কণ দাসীরে রাজা শুন দিয়া মন।
তোমার নারী কিন্‌ল দিয়া হাতের কঙ্কণ॥
বনে ছিলাম বনবাসী দুঃখে দিন যায়।
ভাত কাপড় জোটে মোর তোমার কিরপায়॥
মাও নাই বাপও নাই গর্ভসোদর ভাই।
আসমানের মেঘ যেমন ভাসিয়া বেড়াই॥”


 এইরকমে নিত্যি নিত্যি কাজলরেখাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া রাজা আর কোন কূল কিনারা কইরা উঠ্‌তে পার্‌ল না। এদিকে নকল রাণীর স্বভাব-চরিত্র, কথাবার্ত্তা, বেখ্‌নার[১১২] চোটে একেবারে অতিষ্ঠ হইয়া উঠ্‌ল। রাজা মনে মনে কাজলরেখাকেই প্রাণের সহিত ভালবাসত। কাজলরেখার রূপে গুণে রাজা এমন মুগ্ধ হইয়া গেল যে তার পরিচয় না পাইয়া রাজা পাগলের মত হইল। এই রাজ্য, রাজধানী তার কাছে বের্থা[১১৩] বোধ হইতে লাগিল। রাজা খায় না, ঘুমায় না, রাজকার্য্যে মন নাই, পিরথিমীটা ফাঁকা ফাঁকা। একদিন রাজা বৃদ্ধ মন্ত্রীকে ডাইক্যা কইল যে, আমি ছয় মাস ছয় পক্ষের জন্য দেশ ভর্‌মনে[১১৪] যাইবাম। এর মধ্যে তুমি যে রকমে পার এই কাঙ্কণ দাসীর পরিচয় লইয়ো। এই কথা কইয়া নকল রাণীর কাছে গেল। গিয়া কইল—“আমি দেশ-ভর্‌মনায় যাইতাছি[১১৫]; তোমার মনের মতন জিনিস কি আন্‌তে অইব[১১৬] আমার কাছে কও।” নকল রাণী বেতের ঝাইল[১১৭], বেতের কুলা, আম্‌লি[১১৮] কাঠের ঢেঁকী, পিতলের নথ, কাঁশার বেঁক্‌খাড়ুয়া[১১৯] এই সকলের ফরমাইস্ দিল। রাজা অবাক্যি লাইগ্যা[১২০] আসল রাণী কাঙ্কণ দাসীর কাছে গেল। কাঙ্কণ দাসী পরথমে কইল—“আমি কিছু চাই না; তোমার বাড়ীতে আমি খুব সুখে আছি। আমার কোন অভাব অনাটন নাই।” রাজা খুব আগ্রয়[১২১] দেখাইয়া কইল—“তোমার মনের মতন একটা কিছু জিনিস চাওনই[১২২] লাগ্‌ব[১২৩]।” তখন কাজলরেখা কইল এই কথা——“আমি আর কিছু চাই না; আমার লাইগ্যা[১২৪] একটি ধর্ম্মমতি শুকপক্ষী কিইন্যা আইন্যো[১২৫]।” নকল রাণীর ফরমাইসি দ্রব্য পাইতে রাজার বেগ পাইতে অইল না। বলা বাহাল[১২৬], নকল রাণী যে কি ধাত-পর্‌কিতির[১২৭] লোক রাজার তা বুঝিতে বাকি রইল না। এদিকে রাজা ধর্ম্মমতি শুকের তল্লাসে হয়রাণ হইয়া গেল এক রাজার মুল্লুক হইতে আরেক রাজার মুল্লুক, এক সদাগরের দেশ হইতে আরেক সদাগরের দেশ ঘুরিতে ঘুরিতে ছয় মাস যায় আর মাত্র ছয় পক্ষ বাকি আছে। ছয় পক্ষের সেও চাইর পক্ষ গিয়া দুই পক্ষ আছে। এমন সময় রাজা কাজলরেখার বাপের দেশে গিয়া উপস্থিত হইল। উপস্থিত হইয়া বাজারে ঢোল দিল যে-কেউ ধর্ম্মমতি শুক বিক্রয় করিবে কিনা? এইদিকে সাধু ধনেশ্বর ঢোলের ঘোষণা শুইন্যা খুব আশ্চর্য্য লাগ্‌ল[১২৮]। কারণ, তার কন্যা কাজলরেখা ছাড়া ধর্ম্মমতি শুকের সন্ধান আর কেউ জানিত না। রাজা ভাবল যে, সুখে থাউক[১২৯], দুঃখে থাউক—আমার কন্যা কাজলরেখাই এই শুকপক্ষী নিবার জন্য লোক পাঠাইয়াছে। তখন ধনেশ্বর মনের মধ্যে কোন দ্বিভাব না আইন্যা[১৩০] ধর্ম্মমতি শুক দিয়া সূচ রাজারে বিদায় দিল। রাজাও ধর্ম্মমতি শুক পাইয়া খুব সুখী হইয়াছিল। কারণ, সে কাজলরেখার মন রক্ষা কর্‌ত পার্‌ব বইল্যা[১৩১]



(১৬)

 রাজা বাড়ীতে যাইয়া—নকল রাণীর ফরমাইসি জিনিস নকল রাণীকে দিল। কাজলরেখার ফরমাইসি জিনিস কাজলরেখাকে দিল কিন্তু কাউকে কিছুই কইল না।

 এদিকে মন্ত্রী কি করল শুন;—মন্ত্রী রাজার অবর্ত্তমানে কর্‌ছিল[১৩২] কি রাজ্যের যত কঢিন[১৩৩] বিষয়াশয়ের কথা নকল রাণী এবং কাজলরেখার কাছে যাইয়া জিজ্ঞাসা কর্‌ত। নকল রাণী এই সব কিছু বুঝ্‌ত না, কিন্তু একটা হুকুম জারি কর্‌ত। সে একদিন মন্ত্রীকে এমন কাজের একটা হুকুম দিল যে রাজ্যের তাতে অনেক ক্ষতি হইল এবং[১৩৪] মন্ত্রী কিন্তু তার হুকুম মতই কাজ কর্‌ল। এই সময় রাজ্যে খুব একটা বিপদ পড়্‌ছিল[১৩৫]। মন্ত্রী সেই বিপদের কোনো কূল কিনারা না কর্ত্তে পাইরা[১৩৬] কাজলরেখার কাছে যুক্তি জিজ্ঞাসা কর্‌ল। কাজলরেখা এমন যুক্তি দিল যে তাতে রাজ্যের বিপদ বালাই কাইট্যা[১৩৭] গেল। এই দুই কারণ লইয়া মন্ত্রী রাজাকে সব বুঝাইয়া দিল। রাজারও বুঝতে বাকি রইল না। তখন আরও একটা পরীক্ষা করার কথা স্থির অইল। মন্ত্রী কইল,—মহারাজ! আপনার বন্ধুরে নিমন্তুন কইরা বাড়ীত আন্‌খুয়াইন্[১৩৮]। পাক করিবার ভার একদিন রাণীর উপর এবং একদিন দাসীর উপর দেওয়া হইল। নকল রাণী পাক করিল চাইল্‌তার অম্বল, ডৌউয়ার[১৩৯] ঝাল, আলবনে কচুশাক—সে সব খাইয়া রাজা খুব লজ্‌জিত হইল।

পরদিন দাসীর পালা। 

ভোরেত উঠিয়া কন্যা ভোরের সিনান করে।
শুদ্ধ শান্তে যায় কন্যা রন্ধনশালার ঘরে॥
উবু[১৪০] কইরা বান্ধ্যা কেশ আইট্যা[১৪১] বসন পরে।
গাঙ্গের না পানি দিয়া ঘর মাজন করে॥
মশল্লা পিটালি লইল পাটাতে বাটিয়া।
মানকচু লইল কন্যা কাটিয়া কুটিয়া॥
জোরা কইতর রান্ধে আর মাছ নানা জাতি।
পায়েস পরমান্ন রান্ধে সুন্দর যুবতী॥
নানা জাতি পিঠা করে গন্ধে আমোদিত।
চন্দ্রপুলি করে কন্যা চন্দ্রের আকির্‌ত[১৪২]
চই[১৪৩] চপড়ি[১৪৪] পোয়া[১৪৫] সুরস রসাল।
তা’ দিয়া সাজাইল কন্যা সুবর্ণের থাল॥
ক্ষীরপুলি করে কন্যা ক্ষীরেতে ভরিয়া।
রসাল করিল তায় চিনির ভাজ দিয়া॥
উত্তম কাঁঠালের পিড়ি ঘরেতে পাতিল।
ছিটা ছড়া[১৪৬] দিয়া কন্যা পরিচ্ছন্ন কইল॥
সোনার থালে বাড়ে কন্যা চিক্কণ সাইলের ভাত।
ঘরে ছিল পাতি নেম্বু কাইট্যা দিল তাত্॥
সোনার বাটীতে রাখে দধি দুগ্ধ ক্ষীর।
ঘরে মজা সবরি কলা[১৪৭] কইরা দিল চির॥

সোনার ঝাড়ি ভইরা রাখে আচমনের পানি।
তাম্বুলে সাজায় কন্যা সোনার বাটাখানি॥
কেওয়া খয়ার দিল কন্যা গন্ধের লাগিয়া।
রন্ধনশালা ঘরে রইল রান্ধিয়া বাড়িয়া॥

* * * *

 আর একদিন পরীক্ষা আরম্ভ হইল। লক্ষ্মীকুজাগরের রাত্র, মন্ত্রীর কথামত রাজা রাণী ও দাসীকে আল্‌পনা আঁক্‌তে কইল। সাবধান কইরা কইল যে আমার বন্ধু আজ আস্‌ব[১৪৮]; আলেপনা যে যত সুন্দর কইরা পার আঁইক্য[১৪৯]। নকল রাণী আঁকিল—কাউয়ার ঠেং[১৫০], বগার পারা[১৫১], হরুর টাইল্[১৫২], ধানের ছড়া।

কাজলরেখা আঁকিল— 

উত্তম সাইলের চাউল জলেতে ভিজাইয়া।
ধুইয়া[১৫৩] মুছিয়া কন্যা লইল বাটিয়া॥
পিটালি করিয়া কন্যা পর্‌থমে আঁকিল।
বাপ আর মায়ের চরণ মনে গাঁথা ছিল॥
জোরা টাইল আঁকে কন্যা আর ধানছড়া।
মাঝে মাঝে আঁকে কন্যা গিরলক্ষ্মীর পারা[১৫৪]
শিব-দুর্গা আঁকে কন্যা কৈলাস ভবন।
পদ্মপত্রে আঁকে কন্যা লক্ষ্মী-নারায়ণ॥
হংসরথে আঁকে কন্যা জয়া-বিষহরী।
ডরাই ডাকুনী[১৫৫] আঁকে কন্যা সিদ্ধ বিদ্যাধরী॥

বন দেবী আঁকে কন্যা সেওরার[১৫৬] বনে।
রক্ষাকালী আঁকে কন্যা রাখিতে ভুবনে॥
কার্ত্তিক গণেশ আঁকে কন্যা সহিত বাহনে।
রাম সীতা আঁকে কন্যা সহিত লক্ষ্মণে॥
গঙ্গা গোদাবরী আঁকে হিমালয় পর্ব্বত।
ইন্দ্র যম আঁকে কন্যা পুষ্পকের রথ॥
সমুদ্র সাগর আঁকে চান্দ আর সূরুষে।
ভাঙ্গা মন্দির আঁকে কন্যা জঙ্গলার মাঝে॥
শেজেতে শুইয়া আছে মরা সে কুমার।
কেবল নাই সে আঁকে কন্যা ছবি আপনার॥
সূইচ রাজার ছবি আঁকে পাত্রমিত্র লইয়া।
নিজেরে না তাঁকে কন্যা রাখে ভাড়াইয়া॥
আলিপনা আঁইক্যা কন্যা জ্বালে ঘির্‌তের বাতি।
ভূমিতে লুটাইয়া কন্যা করিল পন্নতি[১৫৭]

(১৭)

 নকল রাণীর আলেপনা দেখিয়া রাজা, বন্ধু এবং পাত্রমিত্রসহ কাজলরেখার আলেপনা দেখিতে উপস্থিত হইল।

 তখন কাজলরেখার আলেপনা দেইখ্যা পাত্রমিত্র সকল এবং রাজাও নিজে ঠিক কর্‌ল যে এ নিশ্চয়ই কোন ভদ্রবংশের কন্যা। এই রকম কইরা নানান রকম পরীক্ষা চল্‌তে লাগ্‌ল। এদিকে কন্যা শুকপক্ষীর কাছে কাইন্দ্যা বাপ-ভাইয়ের কথা এবং তার দুঃখ কবে খণ্ডিব[১৫৮] সেই সব কথা জিজ্ঞাসা করে।

গান— 
‘‘কও কও শুকপংখীরে পূর্ব্বের বিবরণ।
ঘরে মোর বাপ-মাও আছে বা কেমন॥
দশ বচ্ছর গোঁয়াইলাম পাইরা নানান দুঃখ।
একদিন না দেখিলাম মা-বাপের মুখ॥

প্রাণের দোসর ছিল মোর ছোট ভাই।
নিশার স্বপনে তার মুখ দেখ্‌তে পাই॥
কপালে আছিল দুঃখু বাপে দিল বনে।
মির্‌ত[১৫৯] কুমারের দেখা পাইলাম বনে॥
সাত দিন সাত রাইত বাইছা[১৬০] তুল্‌লাম শাল।
এই দুঃখ কপালে ছিল হইব এমন হাল[১৬১]
হাতের কঙ্কণ দিয়া কিনিলাম দাসী।
সে হইল রাণী আর আমি বনবাসী॥
সত্যযুগের পক্ষী তুমি কও সত্যবাণী।
কোন্ দিন পোয়াইব মোর দুঃখের রজনী॥”

পক্ষীর উত্তর। গান— 

“কাইন্দ না কাইন্দ না কন্যারে না কান্দিয়ো আর।
নিশি রাইতে কইবাম কন্যা তোমার সমাচার॥”

নিশি রাইতে পুনঃ কন্যা শুকে ডাইক্যা কয়।
“জাগ জাগ শুকপংখী রাত্রি যে ভোর হয়॥
বাপের বাড়ী দাসদাসী লেখাজুখা নাই।
কর্ম্মদোষে দাসী হইয়া জীবন কাটাই॥
বাপের বাড়ীত খাট পালঙ্ক আছে শীতল পাটি।
কর্ম্মদোষে আমার পংখী শয়ান ভুঁই মাটি॥
বাপেতে কিনিয়া দিত অগ্নিপাটের শাড়ী।
সেই অঙ্গে পইরা থাকি জোলার পাছাড়ী[১৬২]
হাতের কঙ্কণ দিয়া কিনিলাম দাসী।
যে হইল রাণী আর আমি বনবাসী॥
সত্যযুগের পক্ষী তুমি কও সত্যবাণী।
কোন্ দিন পোয়াইব মোর দুঃখের রজনী॥”

* * * *

“কাইন্দ না, কাইন্দ না কন্যা, না কান্দিয়ো তুমি।
বাপের বাড়ীর কুশল তোমায় কইবাম আমি॥
তোমারে যে বনে দিয়া বাপ সদাগরে।
দশ বচ্ছর ধইরা বাণিজ্য না করে॥
তোমার কারণে বাপ-মাও হইল পুত্রীশোকী[১৬৩]
দশ বচ্ছর কাইন্দা কাইন্দা অন্ধ করছে আঁখি॥
নাগরিয়া লোকে কান্দে তোমারে হারাইয়া।
দাসদাসী জনে কান্দে তোমারে বিচরাইয়া[১৬৪]
হাতী ঘোড়ায় কাইন্দা মরে নাহি খায় ঘাস।
যে দিন হইতে বাপে তোমায় দিছে বনবাস॥
চন্দ্রসূর্য্য মইলান[১৬৫] কন্যা রাত্রদিবা কালে।
তোমার লাইগ্যা বনের পক্ষী কান্দে বইয়া ডালে॥
জ্বালিলে না জ্বলে বাতি পুরী অন্ধকার।
এইখানে কহিলাম কথা দেশের সমাচার॥
দশ বচ্ছর গেছে কন্যা দুই বচ্ছর আছে।
দুই বচ্ছর গেলে কন্যা সুখ পাইবা পাছে॥”


(১৮)

 এই রকমে প্রায় পর্তেক[১৬৬] নিশি রাইতে কন্যা সুখ-দুঃখের কথা পক্ষীর কাছে কয়; কবে তার মুক্তি হইব—এই সব জিজ্ঞাসা করে। পক্ষীও তারে সান্ত্বনা দিয়া ভাড়াইয়া রাখে—এই রকমে আরও কএক দিন যায়। এর মধ্যে আর এক ঘটনা কি ঘট্‌ল, শুন। রাজার বন্ধু যে আছিল, সে ভাবল, এ নিশ্চয়ই রাজকন্যা—কাজলরেখার রূপ দেইখ্যা সে এতই মোহিত হইয়া গেছিল যে, তার আর ধর্ম্মাধর্ম্ম জ্ঞান আছিল না। সে কেমন কইরা যে কাজলরেখারে এইখান থাক্যা সরাইয়া নিয়া বিয়া কর্‌ব, সেই চিন্তা কর্ত্তে লাগল। তখন কর্‌ল কি নকলরাণী যে কাঙ্কণদাসী, তার লগে[১৬৭] গিয়া যোগ দিল। রাজা কাজলরেখার রূপগুণে এমন মুগ্ধ হইয়া গেছিল যে সে আর তার ঘর ছাইড়া রাজদরবারে কিম্বা নকলরাণীর ঘরে একবারও যাইত না। নকলরাণীও খুব মুস্কিলে পর্‌ছিল। আর এই আপদ্ যাতে দূর হইয়া যায় তার চেষ্টা করতেছিল। রাজার বন্ধু আর নকলরাণী দুই জনে মিল্যা সল্লা[১৬৮] কর্‌তে লাগ্‌ল—উদ্দিশ্য যে রাজার মনের মধ্যে কাজলরেখার চাইল[১৬৯] চরিত্রের উপর একটা অবিশ্বাস জন্মাইয়া দিতে পার্‌লেই রাজা তারে নির্ব্বাস দিব[১৭০]। কাজলরেখা রাত্রে তার শয়নঘরে একলা থাকত। তার সঙ্গের সঙ্গী ছিল একমাত্র সেই ধর্ম্মমতি শুক। নকলরাণী রাজার বন্ধুর পরামর্শ লইয়া কেউ না জানে এমন ভাবে, কাজলরেখার ঘরের দুয়ারের মধ্যে সিন্দুর দিয়া লেইপ্যা রাখল। আর রাজার বন্ধু সেই সিন্দুরের উপর, আসা-যাওয়ার, পায়ের চারিটা দাগ রাখিয়া আসিল। দেখলে মনে হয় কোন পুরুষ এই ঘরে একবার গিয়া বাইর অইয়া আইছে[১৭১]। এই কথা নকলরাণী রাজারে বিশেষ করিয়া বুঝাইল। তখন রাজা খুব রাগ হইয়া কাজলরেখার কাছে সমস্ত কথা জিজ্ঞাসা কর্‌ল। তখন কাজলরেখা কাইন্দা কইল—

“একলা করি নিশি রাইতে ঘরেতে শয়ন।
কোন্ জন হুইল মোর এমন দুষ্‌মন॥
সাক্ষী হইয়ো দেব ধরম তোমরা সকলে।
সাক্ষী হইয়ো চন্দ্রতারা দেখছ[১৭২] নিশাকালে॥
শুকপক্ষী সাক্ষী মোর আর ঘরের বাতি।
আর কারে মানিব সাক্ষী সাক্ষী কাইলের[১৭৩] রাতি॥
ঘরে থাকে শুকপংখী সাক্ষী মানি তারে।
সেইত বলুক ধর্ম্মসভার গোচরে॥”

তখন সোনার পিঞ্জরে কইরা ধর্ম্মমতি শুকেরে সভার মধ্যে আন্‌ল। 

“কও কও শুকপংখী ধর্ম্ম সাক্ষী করি।
কাইল রাইতে ছিল কিনা কন্যা একেশ্বরী॥
দোষী কি নির্দোষী কন্যা কও সত্যবাণী।
ধর্ম্মসভার মধ্যে পক্ষী সাক্ষী হইলা তুমি॥”

পক্ষীর উত্তর— 
“কইব কি না কইব রাজা শুন দিয়া মন।
কাইল রাতের যত কথা নাহিক স্মরণ॥
কপালে কইরাছে দোষ পড়িয়াছে দোষে।
কলঙ্কী বলিয়া কন্যায় দেও বনবাসে॥”

 তখন রাজায় তার বন্ধুরে কইল এই কথা যে—এই কন্যারে নিয়া সমুদ্রে একটা দ্বীপচরের মধ্যে নির্ব্বাস দিয়া আইস।

গান— 
বিদায় মাগে রাজার কাছে কন্যা কাঙ্কণদাসী।
“আইজ হইতে রাজ্য ছাইড়া হইলাম বনবাসী॥
কইরাছি নানান্ দোষ চিত্তে ক্ষমা দিও।
দাসী বলিয়া মোরে মনেতে রাখিয়ো॥
রাখ কি না রাখ মনে তাতে ক্ষতি নাই।
মরণকালে একবার যেন তোমায় দেখতে পাই॥”

নকলরাণীর আগে কন্যা মাগিল বিদায়।
চোখের জলে কাজলরেখা পথ নাহি পায়॥
“কইরাছি নানান দোষ চিত্তে ক্ষমা দিয়ো।
দাসী বলিয়া মোরে মনেতে রাখিয়ো॥”

বিদায় মাগিল কন্যা শুকপংখীর কাছে।
চক্ষের জলেতে কন্যার বসুমতী ভাসে॥
চন্দ্রসূর্য্য সাক্ষী কইরা উঠিল ডিঙ্গায়।
পুরবাসী যত লোক করে হায় হায়॥

(১৯)

 খুব বড় এক সমুদ্র। তার কোন দিকে কূল-কিনারা নাই। তার মধ্যে গিয়া ডিঙ্গা পড়ল। তখন রাজার বন্ধু কন্যারে কইতে লাগল—

গান— 
“কাঞ্চনপুরে আমার বাড়ীলো কন্যা নাম সোনাধর।
বড় বাপের বেটা আমি কন্যালো বাপ কোটীশ্বর॥

হাতী ঘোড়া আছে কত লেখাজুখা নাই।
বাথানেতে[১৭৪] চড়ে তার নব লক্ষ গাই॥
ধনদৌলতের তার নাহি কোন সীমা।
ডিঙ্গা বান্ধাইছে বাপে দিয়া যত সোনা॥
জলটুঙ্গী ঘর আছে আমার বাপের বাড়ী।
খাট পালঙ্ক আছে কত চান্দুয়া[১৭৫] মশারী॥
আবিয়াত আছি আমি না কইরাছি বিয়া।
শূন্যি ঘর পুন্নু[১৭৬] কর কইরা মোরে দয়া॥
বাড়ীর যত দাসদাসী সেবিব তোমারে।
এই পথে লইয়া যাই চল মোর ঘরে॥”

* * * *

“তুমি ত রাজার বন্ধু আমি রাজার দাসী।
কর্ম্মেতে কইরাছে মোরে এই বনবাসী॥
বনবাসে দিতে মোরে রাজা দিছে কইয়া।
রাজার পুত্র হইয়া কেন দাসী করবা বিয়া॥”

“দাসী যে আছিলা কন্যা রাণী করবাম তোরে।
একবার চল কন্যা আমার মন্দিরে॥
সুবর্ণ মন্দিরে আছে সোনার খাট পালঙ্।
আমার বাপের পুরী দেখিবা কেমন॥”

কন্যা কয় “শুন রাজা আমার কাহিনী।
বাপে বনবাস দিল জাইন্যা[১৭৭] কলঙ্কিনী॥
রাজার বাড়ীর দাসী ছিলাম কলঙ্কী হইয়া।
ধরের বাহির হইলাম আমি কলঙ্ক লইয়া॥
ডুবাইয়া দেও মোরে এই না সাগরজলে।
মাইন্‌সেরে[১৭৮] না দেখাইবাম মুখ কোন কালে॥”

 রাজার ছেলে কন্যার কথা মানল না। না মাইন্যা[১৭৯] কন্যাকে লইয়া তার বাড়ীর দিকে রওয়ানা হইল। তখন কন্যা কান্‌তে কান্‌তে কইল—

“কোথায় রইল মাও বাপ এমন বিপদকালে।
কেহ না বুঝিবে দুঃখ কান্দিয়া মরিলে॥
সোয়ামী যে বনে দিল জাইন্যা কলঙ্কিনী।
জন্ম হইতে কর্ম্মদোষে আমি অভাগিনী॥
মরার উপরে দুষ্টু এবে তুল্‌ছে খাড়া।
সতী নারী হই যদি সমুদ্রে দেউক চড়া[১৮০]

 অম্‌নি সমুদ্রে চড়া পড়িয়া ডিঙ্গা আটকাইয়া গেল। তখন মাঝি-মাল্লা কইল যে এ ডাকুনী[১৮১] কন্যা, এর দোষেই এমন অইছে[১৮২]। এরে এইখানে রাইখ্যা যাই। তখন রাজপুত্তুর উপায়ান্তর না দেইখ্যা কন্যারে ডিঙ্গা থাইক্যা[১৮৩] লামাইয়া[১৮৪] দিল, অমনি ডিঙ্গা আবার জলে ভাস্‌ল। তখন অগত্যা রাজার বন্ধু কন্যাকে এইখানে রাইখ্যাই[১৮৫] নিজের দেশে যাইতে বাধ্য হইল।

গান— 
কাজলরেখা কন্যার কথা এইখানে থইয়া।
রত্নেশ্বর সাধুর কথা শুন মন দিয়া॥

 এর কিছুদিন পরেই ধনেশ্বর সাধু মইরা[১৮৬] যায়। সাধু রত্নেশ্বর তখন বাপের বাণিজ্য-তরণী লইয়া বিদেশে বাণিজ্য করিতে বাইর অইল। নানান দেশে বাণিজ্য কইরা সাধু রত্নেশ্বর যখন বাড়ীত পৌছিব[১৮৭] তখন ঝড়তুফানের মুখে পইড়া সেই চড়ায় ডিঙ্গা লাগাইতে বাধ্য হইল—যেখানে কাজলরেখা কন্যা আইজ ছয়মাস খাগরার রস চিবাইয়া[১৮৮] খাইয়া কোনরূপে প্রাণ বাঁচাইতেছিল। রাত্রকাল গেলে পর পর্‌ভাত বেলায় সাধু রত্নেশ্বর দেখ্‌ল যে সেই চড়ার মধ্যে এক পরমা সুন্দরী কন্যা। এ যে তার নিজের বইন্, তা চিন্তে পার্‌ল না। এই দিকে কাজলরেখা মাত্র চার বৎসরের ভাইকে ঘরে রাখিয়া বনবাসিনী হইয়াছিল, সুতরাং সেও তার আপন ভাইকে চিনিতে পারিল না। অনেক বলিয়া কহিয়া কাজলরেখাকে তার ডিঙ্গায় তুলিয়া আপন দেশে চলিয়া গেল। বাড়ীঘর দেখিয়াই কাজলরেখা সমস্ত চিন্‌ল, কিন্তু কাহাকেও কিছু না বলিয়া কাজলরেখা মনে মনে কান্দিতে লাগিল।

গান— 
“আছে আছে হাতীরে ঘোড়া যে যাহার রে ঠাঁই।
অভাগিনী কাজলরেখার রে মাও বাদ নাই॥
বড় বড় দালানকোঠা যে রইয়াছে পড়িয়া।
জন্মের মত মাও বাপ গিয়াছে ছাড়িয়া॥
এই ঘরে মায়ের কোলে পালঙ্কে শয়ন।
ঘুমাইয়া দেখ্যাছি কত নিশার স্বপন॥
এই ঘরে থাকিয়া মায় দিছে ক্ষীরননী।
সেই মায় হারাইছি আমি জন্ম-অভাগিনী॥
হায় বাপ ধনেশ্বর রইছ কোথাকারে।
তোমার কন্যা ধরে আইছে বার বছর পরে॥
মাও নাই বাপ নাই নাই শুকপক্ষী।
বড় বাড়ীর বড় ঘরে রইয়াছি একাকী॥”

এক দুই তিন করি মাসেক গুয়ায়।
কাঁদিতে কাঁদিতে কন্যার দুঃখে দিন যায়॥
ধাই দাসী আস্যা সবে কন্যারে জিজ্ঞাসে।
একদিন রত্নেশ্বর সাধু আইল কন্যার পাশে॥

“বিধুমুখী কন্যালো (কন্যা আলো) ছিলা ক্ষীরসমুদ্রের চড়ে।
ভাটি বাগ[১৮৯] বাইয়া আমি উদ্ধার করলাম তোরে॥
হাঙ্গর-কুম্ভীরে তোরে করিত ভক্ষণ।
বাড়ীতে আনিলাম কন্যা করিয়া যতন॥
না কর্‌ছি না কর্‌ছ বিয়া যৌবনকাল যায়।
অনুমতি পাইলে বিয়া করিবাম তোমায়॥

মাও নাই বাপ নাই ঘর মোর খালি।
তুমি মুখ দিলে[১৯০] কন্যা বিয়া করি কালি॥
আত্ম[১৯১] জ্ঞাতি, বন্ধু, পুরোহিত জনে।
নিমন্ত্রণ করি কন্যা আইন্যাছি ভবনে॥
গাওইন্যা[১৯২], বাজুইন্যা[১৯৩], যত সবে উপস্থিত।
বিয়া কইরা সুন্দর কন্যালো কর নিজ হিত॥
ধাই, দাসী আছে যত তোমার শতেক কিঙ্করী।
যতনে থাকিবা তুমি পালঙ্ক উপরি॥
বাটাভরা পান-গুয়া[১৯৪] তুইল্যা দিব হাতে।
চিকন সাইলের ভাত খাইবা সোনার পাতে[১৯৫]॥”

* * * *

“বিয়া যে করিবা কুমার এক সত্য আছে।
সত্য পূর্ণ হইলে বিয়া বইবাম্[১৯৬] তোমার কাছে॥
কোন্ ঘরে জন্ম মোর কেবা বাপ মাও।
পরিচয় না জাইন্যা[১৯৭] মোরে বিয়া কর্‌তা চাও॥
হাড়ী কি ডোমের কন্যা নাহিক ঠিকানা।
না জানিয়া বিয়া করতে শাস্ত্রে আছে মানা॥”

“চান্দের সমান কন্যা চন্দ্রমুখখানি।
না হইবা হাড়ী-ডোম মনে মনে মানি॥
কেবা তোর বাপ মাও কোন দেশে ঘর।
কি কারণে ভাইস্যা[১৯৮] ছিলে জলের উপর॥
পরিচয় কথা কও না ভাড়াইয়ো মোরে।
পর্‌তিজ্ঞা কইরাছি আমি বিয়া কর্‌বাম তোরে॥”

* * * *

“আমারও যে পরিচর রে কুমার আমি কইতে নারি।
দশ বচ্ছর কালে বাপে কর্‌ল বনচারী।
শুকপক্ষী আছে এক সুইচ রাজার পুরে।
পরিচয়-কথা সেই কহিবে তোমারে॥
আমার বিয়ার ঘটক সেই পক্ষিয়াজ।”



(২০)

 তখন সদাগর শুকপক্ষীকে আনিবার জন্য সূইচ রাজার পুরে লোক পাঠাইল। ডিঙ্গা ভরা ধন-রত্ন লইয়া সাধু রত্নেশ্বরের লোক-লস্কর সূইচ রাজার দেশে রওনা হইল।

 এদিকে অইল কি—কাজলরেখাকে নির্ব্বাস দিয়া সুইচ রাজা একেবারে পাগল অইয়া দেশে দেশে ডিঙ্গা কইরা তার খোঁজে বাইর অইছে[১৯৯]। সুইচ রাজা এক রাজার দেশ হইতে আরেক রাজার দেশ, এক সমুদ্রের পার হইতে আর এক সমুদ্রের পার ঘুইরা ঘুইরা বেড়াইতেছে। এই সময় রত্নেশ্বরের লোক ডিঙ্গাভরা ধন লইয়া সুইচ রাজার দেশে গিয়া উপস্থিত হইল। ধনের লোভে কাঙ্কণদাসী শুকপক্ষীটিকে বিক্রয় কইরা[২০০] ফাল্‌ল। তখন শুকপক্ষী লইয়া তারা রত্নেশ্বরের রাজ্যে ফিইরা আইল[২০১]। তখন ঢোল-ডঙ্কা দিয়া রত্নেশ্বর-সাধু ঘোষণা কর্‌ল যে, সে সমুদ্র থাইক্যা যে এক জল-পরী ধইরা আন্‌ছে[২০২] তারে আইজ বিয়া কর্‌ব[২০৩]। সকলে আশ্চর্য্য অইয়া গেল। খুব বেশী আশ্চর্যের কথা এই যে, একটা বনেলা শুকপক্ষী তার (কন্যার) জন্মবৃত্তান্ত ব্যক্ত কর্‌ব। এই কথা শুইন্যা যত দেশের যত রাজা, ধনী সদাগর সব আইস্যা[২০৪] সভাস্থলে একত্র অইল। কতক্ষণ পরে এক সোনার পিঞ্জরের মধ্যে কইরা একটা শুকপক্ষীরে আইন্যা উপস্থিত করা হইল।

 বল্‌তে ভুইল্যা[২০৫] গেছ্‌লাম যে কাজলরেখার স্বামী সুইচ রাজা, সেও এই সভায় উপস্থিত ছিল।

 তখন ধর্ম্মমতি শুক পিঞ্জরের উপরে বসিয়া কাজলরেখার পিতৃকুলের পরিচয় দিতে আরম্ভ কর্‌ল।

গান— 
“ধর্ম্মমতি শুক আমি করি নিবেদন।
মন দিয়া পূর্ব্বকথা শুন সভাজন॥
ভাটিয়াল মুল্লুকে আছিল এক সদাগর।
কুঠীয়াল আছিল সাধু নাম ধনেশ্বর॥
এক কন্যা এক পুত্র ছিল সাধুর ঘরে।
ধনীয়াদ হইল সাধু মা লক্ষ্মীর বরে॥
দশ না বছরের কন্যা কাজলরেখা নাম।
দেখিতে সুন্দর কন্যা অতি অনুপাম॥
হীরা-মতি জ্বলে কন্যা যখন নাকি হাসে।
সুজাতি বর্ষার জলেরে যেমন পদ্মফুল ভাসে॥
চাইর না বছরের পুত্র নাম রত্নেশ্বর।
রত্ন না জিনিয়া তার চিক্কণ কলেবর॥
কন্যার অদৃষ্টে ছিল দুরক্ষর বাণী[২০৬]
কপালের ফেরে কন্যা হইল অভাগিনী॥
আমারে জিজ্ঞাসা করে সাধু সদাগর।
কোন্ দেশে পাইবাম কন্যার যোগ্য বর॥
ধর্ম্মমতি শুক আমি ধর্ম্মে মোর মন।
গণিয়া দেখিলাম তার ভাগ্য-বিড়ম্বন॥

“মরা পতির সনে তার বিবাহ হইবে।
দুঃখে দুঃখে এই কন্যার বার বছর যাইবে॥
এই কন্যা যদি সাধুর সংসারেতে থাকে।
কন্যা লইয়া সাধু পুন পড়িবে বিপাকে॥
এই কন্যা লইয়া তুমি রাখ বনান্তরে।
দুঃখ যে খণ্ডিবে কন্যার বার বছর পরে॥

“মোর বাক্যে ধনেশ্বর কন্যারে লইল।
আমারে লইয়া সাধু ডিঙ্গায় চড়িল॥
কতদূরে মউয়া[২০৭] বন সমুদ্রের পাড়।
কূল কিনারা কিছু ছিল তাহার॥
তিন দিন সেই কন্যা কিছু নাহি খায়।
উপাসে তিয়াষে[২০৮] কন্যার প্রাণ যায় যায়॥
জল আন্‌তে সদাগর কন্যারে থইয়া।
ভাঙ্গা মন্দিরের দ্বারে কন্যা রহিল বসিয়া॥

“বাপ যদি গেল কন্যা চারি দিকে চায়।
কপাট খুলিয়া কন্যা মন্দিরে সামায়[২০৯]
জল লইয়া আইসা[২১০] সাধু কন্যারে ডাকিল।
ভাঙ্গা মন্দিরে কন্যা বন্দী হইয়া রইল।
বজ্রের কপাট তার বজ্রের খিল দিয়া।
এইখানে আইল সাধু কন্যারে থইয়া॥

এই পর্য্যন্ত বলিয়াই শুকপক্ষী তিনতালা দালানের ছাদে গিয়া বসিল এবং আবার কহিতে লাগিল:—

মাণিকরে— 
“কাজলরেখা কন্যার কথারে (ভালা[২১১]) এইখানে থইয়া।
সুইচ রাজার জন্মকথা শুন মন দিয়া॥

চম্পা না নগরে ঘর নামে সাধু হীরাধর
সেও রাজার পুত্র কন্যা নাই।
আটকুর[২১২] বলিয়া খ্যাতি বংশে তার দিতে বাতি
সংসারেতে তার লক্ষ্য নাই॥

মাণিকরে— 
নানা দেবে করি পূজা পুত্র না পাইল রাজ।
হেন কালে দৈবের ঘটন।
নির্ব্বন্ধের কথা শুন সভাপতি দিয়া মন
সূইচ রাজার জন্ম বিবরণ॥

মাণিকরে— 
তার কিছু দিন পরে আটকুর রাজার ঘরে
সন্ন্যাসী গোসাই[২১৩] এক কয়।
রূপে গুণে চমৎকার এক পুত্র হইব তার
বিধি তোমায় হইয়াছে সদয়॥

“অকাল আমির্ত্তি[২১৪] ফল তুইল্যা দিল হাতে।
ফল পাইয়া হীরাধর তুইল্যা লইল মাথে॥
সেই আমির্ত্তির ফল দিল নিয়া রাণীরে।
মরা পুত্র হইল এক দশমাস পরে॥
সন্ন্যাসীর কথায় রাজা কি কাম করিল।
সর্ব্ব অঙ্গে মরা শিশুর কাঁটা বিন্ধাইল॥
সূইচ রাজা নাম হইল তেই সে কারণে।
সন্ন্যাসী কহিল পুত্র রাখ্যা আইস বনে॥

* * * *
* * * *

“নিরালা জঙ্গলে এক মন্দির গাঁথিয়া
তার মধ্যে রাখে শিশু যতন করিয়া॥
গর্ভেতে মরিয়া শিশু দেবতার বরে।
চন্দ্রসম সেই শিশু দিনে দিনে বাড়ে॥
বাড়িতে বাড়িতে তার যৌবনকাল আইল।
দেবের নির্ধ্বন্ধে কন্যা সেইখানে গেল॥

বাপে দিছিল[২১৫] বনবাসে কর্ম্মদোষ পাইয়া।
মরা পতির সঙ্গে সেই কন্যার হইব বিয়া॥
(হায়রে হায়) 
“কান্দিতে কান্দিতে কন্যা শিলা যায় গলে।
মরা স্বামী ধোয়ায় কন্যা আক্ষির[২১৬] জলে॥
সাত দিন সাত রাইত শিওরে বসিয়া।
অঙ্গের শাল তুলে কন্যা বাছিয়া বাছিয়া॥
না খাইয়া না শুইয়া কন্যার সাত দিন গেল।
চক্ষের শাল রাইখ। কন্যা মন্দিরের বাহির হইল॥

“ঔষধ রাখিয়া কন্যা ছান কর্‌ত যায়।
নগরিয়া লোক এক দাসী বেচ্‌তে[২১৭] চায়॥
হাতের কঙ্কণ দিয়া কন্যা লইল দাসী।
সেই দাসী রাণী হইল কন্যা বনবাসী॥”

একে একে কইল পক্ষী যত ইতিকথা।
কাঙ্কণদাসী তারে দিছিল যত ব্যথা॥
সূইচ রাজার বন্ধুর কথা সকল কহিল।
কি কারণে সূইচ রাজার মতিভ্রম হইল॥
কি কারণে কন্যারে সে দিল বনবাসে।
দুঃখের কথা কইতে পক্ষী চক্ষের জলে ভাসে॥

“পাপিষ্ঠি রাজার বন্ধু একাকিনী পাইয়া।
বলে ধরি কন্যারে কর্‌তে চাইল বিয়া॥
সতী কন্যার কান্দনে সমুদ্রে দিল চড়া।”
এই কথা কহিয়া পক্ষী শূন্যে দিল উড়া॥

উড়িতে উড়িতে পক্ষী সভার আগে কয়।
“আজি হইতে কন্যার বার বছর গত হয়॥

ভাই হইয়া রত্নেশ্বর বিয়া কর্‌তে চায়।”
এই কথা কইয়া পক্ষী শূন্যেতে মিলায়॥

আছে কি মইরাছে[২১৮] কন্যা সূইচ রাজা না জানে।
আবুড়[২১৯] হইয়া কান্দে রাজা সভার বির্দ্দমানে[২২০]
লজ্‌জা পাইয়া রত্নেশ্বর সভা ছাইড়া যায়।
ভগ্নীর পায়ে পইড়া ক্ষমা রিয়াইত[২২১] চায়॥


(২১)

 এইরূপে পরিচয় হইয়া গেল। ধর্ম্মমতি শুক স্বর্গে চলিয়া গেল। সূইচ রাজার সঙ্গে কাজলরেখার ধুমধামের সহিত বিয়া হইয়া গেল।

 সূইচ রাজা তখন কাজলরেখারে লইয়া নিজের বাড়ীতে চইল্যা গেল। কাজলরেখারে গোপনে রাইখ্যা নিজ অন্দর বাড়ীতে খুব বড় করিয়া একটী গর্ত্ত খনন করাইল। কাঙ্কণদাসী এর কারণ জিজ্ঞাসা করিলে সূইচ রাজা কইল যে ভাটীর রাজা রত্নেশ্বর-সাধু আমাদের বাড়ী লুট করিতে আসিবে। আমাদের ধন-সম্পত্তি লইয়া এই গর্ত্তের মধ্যে আশ্রয় লইতে হইবে। তখন কাঙ্কণদাসী আর কাহারেও কিছু না বলিয়া, নিজের গহনা-পত্র নিয়া সবার আগে গর্ত্তে প্রবেশ করিল। তখন রাজার ইঙ্গিতে লোকজন গর্ত্তে মাটি চাপা দিল।

আমার কথা ফুরাইল।

  1. মিন্নতি=মিনতি।
  2. ধইরাছুইন্=ধরিয়াছেন, অনুরোধ করিয়াছেন।
  3. কিরপায়=কৃপায়।
  4. পন্নাম=প্রণামের অপভ্রংশ।
  5. কুঠীয়াল=বৃহৎ পাকা গৃহাদির স্বামী।
  6. ধনী আদ=ধনবান্।
  7. সুজাতি=সুদৃশ্য।
  8. চিক্কণ=চিকন, সুন্দর।
  9. গোসা=রাগ।
  10. উভে=সমুদায়।
  11. জুয়ারী=যে জুয়া খেলায়।
  12. আস্যা=আসিয়া।
  13. দিলাইন=দিলেন।
  14. সদাগরেরে=সদাগরকে।
  15. শিরি=শ্রী; সুন্দর ও মূল্যবান।
  16. আঙ্গুইট্=আংটী।
  17. যুদি=যদি।
  18. কাম=কাজ; কর্ম্মের অপভ্রংশ।
  19. কালান্যা=কালীন, সময়ের।
  20. যে সমুক্তি=যে সমস্ত।
  21. ফির‍‍্যা=ফিরিয়া।
  22. আত্তি=হাতী।
  23. হইরা=হরণ করিয়া।
  24. পালিবাম=পালন করিব।
  25. ছাওয়াল=সন্তান, শুধু পুরুষ ছেলে নয়।
  26. কাইন্দ না=কাঁদিয়ো না।
  27. বিকাইয়া=বিক্রয় করিয়া।
  28. বান্ধাইতে=বাঁধিতে; পুনর্গঠন করিতে।
  29. কারিকর=কারিগর; মিস্ত্রী।
  30. দিবাইন=দিবেন।
  31. হাওর=বিল বিশেষ।
  32. বইয়া=বসিয়া বসিয়া; কোন কাজকর্ম না করিয়া।
  33. কামলা=মজুর।
  34. ডাক্যা আন্যা=ডাকাইয়া আনিয়া।
  35. মেলা=রওনা, যাত্রা।
  36. আটে না=ধরে না, কুলায় না।
  37. কামটুঙ্গি, জলটুঙ্গি ঘর=পূর্ব্বে জলাশয়ের মধ্য হইতে লোকে প্রমোদমন্দির গড়িয়া তুলিত (দেওয়ান ভাবনা দ্রষ্টব্য)।
  38. এও=এই।
  39. অবিয়াত=অবিবাহিত।
  40. এহার=ইহার।
  41. হইব=হইবে।
  42. রাখ্যো না=রাখিও না।
  43. ‘বনের মধ্যে নিবাস’=বনে নির্ব্বাসন দিয়া আইস।
  44. কান্‌তে=কাঁদতে।
  45. গুণের=গুণবতী।
  46. দুষ্কের=দুঃখের।
  47. আধ পিষ্ট=পৃষ্ঠের অর্ন্তভাগ।
  48. পাল্যা=পালন করিয়া।
  49. এরুর=ইহার।
  50. অরণ্য জঙ্গলা=জঙ্গলের অপভ্রংশ। অরণ্য এখানে বিশেষণরূপে 'গভীর অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে।
  51. কই=কোথায়।
  52. খুঁটি=খুটা; ধর্ম্মের মধ্যম খুঁটি=ধর্ম্মের মধ্যস্থলের অন্তস্বরূপ=প্রধান অবলম্বন।
  53. বনেলা=বন্য।
  54. থাইক্যা=হইতে; থেকে।
  55. ভাইট্যাল=ভাটিয়াল।
  56. বনান্তরে=বনের মধ্যে।
  57. মধ্যে=এখানে উপর।
  58. বইল=বসিল।
  59. দুপইরা=দুপ্রহরের।
  60. রইদ্=রৌদ্র।
  61. পানি তিয়াসে=জলতৃষ্ণায়।
  62. দেইখ্যা আয়ি=দেখিয়া আসি।
  63. আইয়া=আসিয়া।
  64. কইল=বলিল।
  65. আন্‌ছি=আনিয়াছি।
  66. ঝি=কন্যা।
  67. মির্‌ত=মৃত।
  68. ঘির্‌তের=ঘৃতের।
  69. সুইচ আর শাল=ছুঁচ ও শেল।
  70. গিরেতে=গৃহেতে।
  71. ছাইড়া=ছাড়িয়া।
  72. জিয়াইয়া=জীবন দান করিয়া।
  73. থইয়া=থুইয়া, রাখিয়া।
  74. রাখ্যো=রাখিয়ো।
  75. ফালাইয়া=ফেলিয়া।
  76. মেইল্যা=মেলিয়া।
  77. কাইট্যাছে=কাটিয়াছে।
  78. উবাসে=উপবাসে।
  79. ছুরত=সৌন্দর্য্য।
  80. কাম-তনু=কাম্য (রম্য) দেহ।
  81. পরদীম=প্রদীপ।
  82. মনে দিছে ভাটী=মন হইতে ছাড়িয়া দিয়াছে, বিস্মৃত হইয়াছে।
  83. না ভাড়াও=ছলনা করিও না।
  84. রাড়ী=বিধবা।
  85. আইন্যা=আনিয়া।
  86. খুইল্যনা=খুলিও না।
  87. তা অইলেই=তাহা হইলেই।
  88. বাঁইচ্যা=বাঁচিয়া
  89. রাইত=রাত্রি।
  90. ছান=স্নান।
  91. লামল=নামিল।
  92. গাওয়ালে=গ্রামে।
  93. আইছ=আসিয়াছে।
  94. হইছিল=হইয়াছিল।
  95. আইয়া=আসিয়া
  96. বাঁইচ্যা=বাঁচিয়া।
  97. কইয়া=কহিয়া।
  98. জোয়ায়=স্থির করে।
  99. ছইয়া=ছুঁইয়া, স্পর্শ করিয়া।
  100. বাঁচাইছ=বাঁচাইয়াছ।
  101. পিয়া =প্রিয়া।
  102. ঘরের নারী=এখানে ‘গৃহিণী’ অর্থ জ্ঞাপক।
  103. ঢুইকাই=ঢুকিয়াই, প্রবেশ করিয়াই।
  104. বাঁইচ্যা উঠ্‌ছে=বাঁচিয়া উঠিয়াছে।
  105. আগু=অগ্রসর।
  106. কিন্যাছি=কিনিয়াছি।
  107. গাইল=গাল।
  108. নেহালিয়া দেখা=খুব মনোযোগ সহকারে দেখা। নেহালিয়া ও দেখা একই অর্থজ্ঞাপক।
  109. হগলের=সকলের। পূর্ব্ববঙ্গের কোন কোন স্থানে ‘সকলের’ পরিবর্ত্তে কথ্য ভাষায় ‘হগল’ বা ‘হগ্‌গল’ বলা হইয়া থাকে।
  110. বাইর কামুলী=যে দাসী বাহিরের গৃহস্থালি কাজকর্ম্ম করে।
  111. ঝিয়ারী=কন্যা। “সখার কুমারী হয় আপন ঝিয়ারী”=কাশীরাম দাস।
  112. বেখ্‌না=নিজের গুণপনার ব্যাখ্যা, আত্মপ্রশংসা।
  113. বের্থা=বৃথা।
  114. ভর্‌মন, ভর্‌মনা=ভ্রমণের অপভ্রংশ।
  115. যাইতাছি=যাইতেছি।
  116. অইব=হইবে।
  117. ঝাইল=বাক্সবিশেষ, উহা গোল ও চৌকোণ উভয় প্রকালই হয়।
  118. আম্‌লি=তেঁতুল।
  119. বেঁক্‌খাড়ুয়া=পায়ের অলঙ্কারবিশেষ।
  120. অবাক্যি লাইগ্যা=আশ্চর্য বাক্‌হীন হইয়া।
  121. আগ্রয়=আগ্রহ।
  122. চাওনই=চাওয়া।
  123. লাগ্‌ব=লাগিবে।
  124. লাইগ্যা=জন্য।
  125. কিইন্যা আইন্যো=কিনিয়া আনিও।
  126. বলা বাহাল=বলা বাহুল্য।
  127. ধাত-পর্‌কিতি=ধাতু-প্রকৃতি।
  128. আশ্চর্য লাগ্‌ল=আশ্চর্যান্বিত হইল।
  129. থাউক=থাকুক।
  130. আইন্যা=আনিয়া।
  131. কর্‌ত পার্‌ব বইল্যা=করিতে পারিবে বলিয়া।
  132. কর্‌ছিল=করিয়াছিল।
  133. কঢিন=কঠিন।
  134. এবং=এখানে অনাবশ্যক ব্যবহার।
  135. পড়্ছিল=পড়িয়াছিল।
  136. কর্ত্তে পাইরা=করিতে পারিয়া।
  137. কাইট্যা=কাটিয়া।
  138. কইরা বাড়ীত আন্‌খুয়াইন্=করিয়া বাড়ীতে আনুন।
  139. ডৌউয়া=এক প্রকার ফল; পক্বাবস্থায় অম্লাস্বাদবিশিষ্ট হয়।
  140. ‘উবু’ করিয়া চুল বান্ধা। উবু=পিছন দিকে খোপার আকারে উঁচু করিয়া।
  141. আইট্যা=শক্ত করিয়া।
  142. আকির্‌ত=আকৃতি।
  143. চই=একরূপ শাক।
  144. চপড়ি=চিত্তে পিঠা।
  145. পোয়া=মালপুয়া।
  146. ছিটা ছড়া=জলের ছিটা।
  147. ঘরে মজা সব্‌রি কলা=গৃহে রাখিয়া পরিপক্ব করা চাটিম কলা।
  148. আস্‌ব=আসিবে।
  149. আঁইক্য=আঁকিয়ো।
  150. কাউয়ার ঠেং=কাকের ঠ্যাং (পূর্ব্ববঙ্গে স্থানভেদে ‘কাক’কে কাউয়া, কাইয়া, কাওয়া বলা হয়)।
  151. বগার পারা=বকের পায়ের দাগ (অত্যন্ত বিশ্রী বলিয়া উহার সহিত তুলনা করা হইয়াছে)।
  152. হরুর টাইল্=হরু [সরু=সরিষা (টাইল) রাখিবার পাত্রবিশেষ]।
  153. ধুইয়া=ধৌত করিয়া।
  154. গিরলক্ষ্মীর পারা=গির (গৃহ); পারা (পদচিহ্ন)=গৃহলক্ষ্মীর পদচিহ্ন।
  155. ডরাই ডাকুনী=এক প্রকারের প্রেতিনীবিশেষ।
  156. সেওরা=সেওরা গাছে দেবতারা থাকেন বলিয়া লোকের বিশ্বাস।
  157. পন্নতি=প্রণতি।
  158. খণ্ডিব=খণ্ডিবে, দূর হইবে।
  159. মির্‌ত=মৃত।
  160. বাইছা=বাছিয়া
  161. হাল=অবস্থা।
  162. জোলার পাছাড়ী=জোলাদের তৈয়ারী মোটা সুতার তৈরী বস্ত্রবিশেষ।
  163. পুত্রীশোকী=কন্যার বিচ্ছেদ-জনিত দুঃখ অনুভবকারী।
  164. বিচরাইয়া=অন্বেষণ করিয়া।
  165. মইলান=ম্লান।
  166. পর্তেক=প্রত্যেক।
  167. লগে=সঙ্গে।
  168. সল্লা=কুপরামর্শ।
  169. চাইল= চাল (ব্যবহার)।
  170. দিব=দিবে।
  171. অইয়া আইছে=হইয়া আসিয়াছে।
  172. দেখছ=দেখিয়াছ।
  173. কাইলের=কল্যকার।
  174. বাথান=গোচারণভূমি।
  175. চান্দুয়া=চাঁদোয়া।
  176. পুন্নু=পূর্ণ।
  177. জাইন্যা=জানিয়া।
  178. মাইন্‌সেরে=মানুষকে।
  179. মাইন্যা=মানিয়া।
  180. দেউক চড়া=চর ভাসিয়া উঠুক।
  181. ডাকুনী=‘ডাকিনী’র অপত্রংশ।
  182. অইছে=হইয়াছে।
  183. থাইক্যা=থেকে, হইতে।
  184. লামাইয়া=নামাইয়া।
  185. রাইখ্যাই=রাখিয়াই।
  186. মইরা=মরিয়া।
  187. বাড়ীত পৌছিব=বাড়ীতে পৌছিবে।
  188. রস চিবাইয়া=রস খাইয়া।
  189. বাগ=বাঁক, নদীর বাঁক।
  190. মুখ দিলে=কথা দিলে।
  191. আত্ম=আত্মীয়।
  192. গাওইন্যা=গায়ক।
  193. বাজুইন্যা=বাদক।
  194. গুয়া=(গুবাক হইতে) সুপারি।
  195. পাতে=পাত্রে।
  196. বিয়া বইবাম্=বিবাহ বসিব।
  197. জাইন্যা=জানিয়া।
  198. ভাইস্যা=ভাসিয়া।
  199. অইছে=হইয়াছে।
  200. কইরা=করিয়া।
  201. ফিইরা আইল=ফিরিয়া আসিল।
  202. ধইরা আন্‌ছে=ধরিয়া আনিয়াছে।
  203. কর্‌ব=করিবে।
  204. আইস্যা=আসিয়া।
  205. ভুইল্যা=ভুলিয়া।
  206. দুরক্ষর বাণী=মন্দ লিখন; দুর্ভাগ্য। খারাপ কথা।
  207. মউয়া=মহুয়া (মধুক হইতে)।
  208. উপাসে তিয়াষে=উপবাস ও তৃষ্ণায়।
  209. সামায়=প্রবেশ করে।
  210. আইসা=আসিয়া
  211. ভালা=ভাল।
  212. আটকুর=সন্তানহীন।
  213. গোসাই=গোস্বাসী।
  214. আমির্ত্তি=অমৃতের অপভ্রংশ; এখানে ‘আম’ বুঝাইতেছে।
  215. দিছিল=দিয়াছিল।
  216. আক্ষি=(আঁখি) অক্ষির অপভ্রংশ।
  217. বেচ্‌তে=বেচিতে।
  218. মইরাছে=মরিয়াছে।
  219. আবুড়=আকুল, দুঃখাতিশয্যে ব্যাকুল।
  220. বির্দ্দমানে=বিদ্যমানে।
  221. রিয়াইত=মুক্তি, মাপ, রেহাই।